You are currently viewing কলকাতার এক প্রবাসী বাঙালির চোখে কবি আসাদ চৌধুরী || অতীশ চক্রবর্তী

কলকাতার এক প্রবাসী বাঙালির চোখে কবি আসাদ চৌধুরী || অতীশ চক্রবর্তী

কলকাতার এক প্রবাসী বাঙালির চোখে কবি আসাদ চৌধুরী
অতীশ চক্রবর্তী

সত্যকে খুঁজে না পেয়ে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে আসাদ চৌধুরী আজ চলে গেলেন আমাদের মায়া ছেড়ে। খবরটা সকালে দেখে আমার এক বাংলাদেশী বাঙালী বন্ধুকে, মেসেঞ্জারে টেক্সট করতেই সে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল – ওঃ একে একে ভালো মানুষগুলো সব চলে যাচ্ছে।

আমি কলকাতার বাঙালী হিসাবে আসাদ চৌধুরীকে যতটুকু দেখেছি বা বুঝেছি, তা তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে, বাংলাভাষা আন্দোলন, বাংলাদেশ স্বাধীনতা সংগ্রাম, সে সংগ্রামের যে দর্শন, লক্ষ্য ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর ভাবাবেগের বহিঃপ্রকাশের মধ্য দিয়ে। আসাদ চৌধুরী ছিলেন বরিশালের কবি, সেটাও আমার কাছে একটা গর্বের ব্যাপার ছিল। আমার নিজের কোনও দিন বরিশাল যাবার সৌভাগ্য হয়নি, বাবার কাছে শোনা বরিশালের ভৌগলিক মানচিত্রের সঙ্গে আজকের বরিশালের অনেক তফাৎ, তবু গায়ে বরিশালের গন্ধ থাকলেই তাঁর প্রতি ভালোবাসার ক্ষরণ যেন একটু বেশী মাত্রায় পক্ষপাতিত্ব করে!!

সেই সত্তর দশকের মধ্যভাগে কলকাতা শহর যখন লক্ষ লক্ষ বাঙালী উদ্বাস্তুকে সাদরে বরণ করে নিয়েছিল, তখন অত কষ্টের মধ্যেও, বঙ্গবন্ধু মুজিবের উদাত্ত ভাষণ ছাড়াও আর একটা জিনিষ আমাদের ধমনিতে ধমনিতে রক্তকে তরল ও গরম রেখেছিল। তা হল দুই পারের মধ্যে বাংলার সাহিত্য ও সংস্কৃতির আদানপ্রদান।

সেই সত্তর দশকের মধ্যভাগে যখন কলকাতা শহর তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান থেকে আসা লক্ষ লক্ষ বাঙালী উদ্বাস্তুকে সাদরে বরণ করে নিয়েছিল, সেই সময়ে ১৯৭৫ সালে আসাদ চৌধুরীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ “তবক দেওয়া পান” বেরিয়েছিল। সেটি যারা পড়েছিলেন, তাঁরা সকলেই মুগ্ধ হয়েছিলেন। ওই সময়ে সহজে ২০২২শে যখন কলকাতার বই মেলাতে গেলাম, বাংলাদেশের প্যাভিলিয়নের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে আগত অজস্র প্রকাশনী সংস্থায় কলকাতার বাঙালীদের উপচে পরা ভিড় দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে আসাদ চৌধুরীর বই ঘিরে পাঠকদের ভিড় দেখে বেশ ভালো লেগেছিল। তবে এ কথা সত্যি, বাংলা সাহিত্যকে যারা ভালবাসে, তাঁদের কাছে এটা হল অনেকটা অক্সিজেনের মত বায়বীয় পদার্থ। কোনও ভাবেই তাকে একেবারে আটকে রাখা যাবে না – বিশেষ করে যদি আসাদ চৌধুরীর মত লেখক হন।

“তবক দেওয়া পান” ভালো লাগলেও (তবক মানে স্তর), তাঁকে যথার্থভাবে চিনেছিলাম এর আরও পরে – সে কথায় পরে আসছি।

হাঁপানির জন্য সিগারেট ছেড়ে তিনি পান ধরেছিলেন এ কথা তিনি নিজেই জানিয়েছিলেন। তিনি ২০১৫ সালে কালের কণ্ঠ পত্রিকায় একটি সুন্দর সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন; সেখানে পান নিয়ে তার বক্তব্যের কিছু অংশবিশেষ তুলে দিলাম – ভালো লাগবে। “আমার একটা কবিতার অংশ ছিল ‘রূপালি তবক দেওয়া পান, রূপালি তবক দিয়ে পান নিয়ে বসে আছি তিন দিন’…। …আমি প্রধানত রাজশাহীর পান খাই। রাজশাহীর পান মচমচ করে, খেতেও সুস্বাদু। কিন্তু সাতক্ষীরার সাথি পানও ভালো লাগে, তাতে চমৎকার একটা মিষ্টি গন্ধ আছে। আবার মহেশখালীর পানও ভালো লাগে, এ ছাড়া বরিশাল, মাদারীপুর, খুলনা অঞ্চলের পানও খারাপ না, ভালোই লাগে। আর সার্বিকভাবে বলা যায়, বাংলাদেশের সব অঞ্চলের পানই ভালো। দেশের বাইরে পান খাওয়া বলতে, আমি বলব-কলকাতায় অনেক ধরনের পান পাওয়া যায়, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের কাকদ্বীপের পান নামকরা”। পান সম্বন্ধে এত কিছু কথা আমি জানতাম না। উনি যখন বিদেশ ভ্রমণ করেছেন, প্রবাসে পান তখন পাওয়া ছিল একরকম দুঃসাধ্যের ব্যাপার। সে নিয়েও অনেক মজার গল্প তিনি এই সাক্ষাতকারে উল্লেখ করেছেন।

মাঝে বহু বছর কেটে গেছে। পশ্চিমবাংলায় বসে খবর পাই, যে আদর্শ নিয়ে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল, স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার জন্য লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্ত ঝরেছিল, তার থেকে অনেক বিচ্যুতি ঘটেছে, শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষদের মধ্যে এ নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। ১৯৮৪ সালে, দুই শিখ দেহরক্ষীর হাতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মর্মান্তিক মৃত্যু দেখলাম। আর এই দুইজন শিখের কৃতকর্মের জন্য হাজার হাজার নিরীহ শিখের নিধনযজ্ঞ হল – সেটাও দেখলাম। একজন দুজনের অন্যায়ের জন্য সমস্ত জাতিটাকে কালিমালিপ্ত করা আমাদের চিরকালের অভ্যাস। তখন এই নিধনযজ্ঞের বিরুদ্ধে যারা ছিলেন, তাদের সকলকে সেদিন নির্বিচারে দেশদ্রোহী আখ্যা দেওয়া হয়েছিল।

নিজ নিজ দেশে আমরা যখন সংখ্যাগুরু তখন আমরা নিজের দেশটিকে সংখ্যাগুরুর ধর্মে ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাই আর প্রবাসী হলে সেখানে সংখ্যালঘু আন্দোলনের জন্য লড়াই করি, সমানাধিকারের জন্য লড়াই করি – এই ব্যভিচার আমার কাছে খুব কষ্টকর।

ধর্মনিরপেক্ষতা ছাড়া একটা দেশ তার জনসংখ্যার মধ্যে নিহিত সুপ্ত শক্তিকে (Latent Energy), জনসম্পদে (Active Energy) রূপান্তরিত করতে পারে না। আর এই কারণেই আসাদ চৌধুরীকে আমি সম্মান করি। একবার কানাডায় জন্মদিনের শুভেচ্ছার জবাবে বক্তব্য দিতে গিয়ে কবি আসাদ চৌধুরী বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের মনে যে স্বপ্ন দানা বেঁধে উঠেছিল, ১৯৭৫ সালের পর বাংলাদেশ সেই স্বপ্নের উল্টো পথে হাঁটা শুরু করেছে। এখন পর্যন্ত দেশ তার নিজস্ব পথে ফিরে আসতে পারেনি”। তিনি বলেন, “ইতিহাসের বিকৃতিতে মুক্তিযুদ্ধই যেন হারিয়ে যেতে বসেছে”।

ভারতীয় উপমহাদেশে, দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত, ও পাকিস্তান এবং পরবর্তীতে তৃতীয় রাষ্ট্র হিসাবে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হবার পরেও, এই তিনটি দেশেই, দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভূতকে, ছাইয়ের নীচে চাপা আগুনের মত পুষে রাখা হয়, প্রয়োজনে ছাই সরিয়ে তাতে হাওয়ার ইন্ধন জোগালেই কেল্লা ফতে। ৭৫ বছরের ওপর হয়ে গেল; দ্বি-জাতি তত্ত্বের বিষ বাষ্প থেকে আমরা যেন বেরোতেই পারলাম না।

সেটা ২০০১ সাল। ভারতে বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। সেখানে তখন তীব্র সাম্প্রদায়িক মারামারি চলছে। ঠিক এই সময়ে, আসাদ চৌধুরী, নিজে স্বাধীন বাংলাদেশে থেকে, বাবরি মসজিদ ধ্বংস হবার পরিপ্রেক্ষিতে, সে দেশের সংখ্যালঘুদের ওপর ব্যাপক হামলার বিরুদ্ধে গিয়ে, তার কবিসত্তাকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন, তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, যা আমার কাছে ছিল প্রশংসনীয় এবং উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আমি তাঁকে সামনাসামনি দেখিনি, তাঁর ব্যক্তি জীবন সম্পর্কে আমার সম্যক কোনও ধারণা নেই, যেটুকু তাঁকে চিনেছি, তা শুধু তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে। তাঁর নিজের কথায় – ‘বাবরি মসজিদ ধ্বংস হলো ২০০১ সালে। এরপর ভারতে মারাত্মক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সূচনা। তারই ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অবনতি ঘটে। মন্দির, প্যাগোডা, গির্জা ভাঙচুর ও ধ্বংস করা হয়। সে সময় আমার কবিসত্তাকে দারুণভাবে নাড়া দেয়। ১৯৭১-এর মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের পর এমন দামামা, আমাকে চরমভাবে ব্যথিত ও আন্দোলিত করে। ভাষা-সংস্কৃতি এক অথচ ধর্মকেন্দ্রিক এই দাঙ্গা। বিশেষত চট্টগ্রামে মারাত্মক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। তারই প্রতিফলন আমার এই ব্যথাভরা নতুন কবিতাটি’
‘কোথায় পালালো সত্য?
দুধের বোতলে, ভাতের হাঁড়িতে! নেই তো
রেষ্টুরেন্টে, হোটেলে, সেলুনে,
গ্রন্থাগারের গভীর গন্ধে,
টেলিভিশনে বা সিনেমা, বেতারে,
নৌকার খোলে, সাপের ঝাঁপিতে নেই তো।

গুড়ের কলসি, বিষের কৌটো,
চিনির বয়াম, বাজারের ব্যাগ,
সিগারেট কেস, পানের ডিব্বা,
জর্দার শিশি, লক্ষ্মীর সরা,
নকশী পাতিল, চৌকির তলা,
সবি খুঁজলাম, খুঁজে দেখলাম নেই তো!

সাংবাদিকের কাঠের ডেস্কে,
কাগজে, কেতাবে, পুঁথিতে, কলমে,
ইনজেকশনে, দাঁদের মলমে,
ভ্যানিটি ব্যাগে বা পকেটে, আঁচলে
ড্রয়ারে, ব্যাংকে, আয়রণ সেফে
সত্য নামক মহান বস্তু নেই তো!

কবিতায় নেই, সঙ্গীতে নেই
রমণীর চারু ভঙ্গিতে নেই
পাগলের গাঢ় প্রলাপেও নেই
নাটকের কোন সংলাপে নেই
শাসনেও নেই, ভাষণে নেই
আঁধারেও নেই, আলোতেও নেই
রেখাতেও নেই, লেখাতেও নেই,
উত্তরে নেই, প্রশ্নেও নেই
লেবাসে নেই, সিলেবাসে নেই
পারমিটে নেই, বোনাসেও নেই
হতাশায় নেই, আশাতেও নেই
প্রেম-প্রীতি ভালবাসাতেও নেই
এমন কি কালোবাজারেও নেই
কোথায় গেলেন সত্য?’

কালোবাজারেও যখন সত্যকে খুঁজে পাওয়া যায় না তখন কবি নিজেই ব্যর্থ মনোরথ হয়ে জীবন জগত থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। ঠাট্টা করে যাকে পানের কবি বলা হয়, সেই কবিটি আজ মৃত্যু বরণ করলেন। তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।

********************************

অতীশ চক্রবর্তীঃ প্রাবন্ধিক ও গবেষক

*******************************