You are currently viewing করোনা, আমি এবং সে – আদনান সৈয়দ

করোনা, আমি এবং সে – আদনান সৈয়দ

মস্ত একটা শরীর। দেখলে মনে হয় যেন শ্যাওলা জমা একটা পাথর। চোখেমুখে ধূর্তভাব ফুটিয়ে সে যখন পিট পিট করে তাকায় তখন সেই চেহারা আরো বেশি ভয়ংকর হয়ে উঠে। লোকটা চরিত্রহীন, ভন্ড, অসৎ বলতে যা বোঝায় ঠিক তাই। বিয়ে করার ছয় মাসের মাথায় আমি যখন বুঝেছিলাম এই ভন্ড টাইপের অমানুষটাকে নিয়ে আমার সংসারের তরিটি ভাসাতে হবে তখনই লোকটা থেকে আমার মন আর শরীর দুটোই আলাদা করে নিয়েছিলাম। মন যদি উঠে যায় তখন আর সেখানে শরীর থাকে না। থাকে শুধু শরীরের মত দেখতে এক দলা মাংস। আমার মা আমাকে সেই ছেলেবেলাতেই একটা কথা প্রায়ই বলতেন।

“ দুনিয়াটা এত সোজা নারে শেফালি। মানুষ খুব ভয়ংকর এক প্রাণী। অতএব এই ভয়ংকর দুনিয়ায় যদি বাঁচতে চাস তাহলে তোকেও সেভাবে তৈরি করে নিতে হবে, বুঝলি?”

আমি তখন সরল হরিণীর মত মার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করতাম, ’কীভাবে’?

মার উত্তর ছিল, “নিজের মধ্যেই একটা আলাদা জগৎ তৈরি করতে হবে তোকে। ঠিক গুটি পোকার মত। তুই বসবাস করবি সেই গুটি পোকার মত নিজের আপন রাজ্যে। তুই হবি সেই রাজ্যের একমাত্র রাণী। তুই ছাড়া কেউ তোর সেই গোপন রাজ্যে প্রবেশ করতে পারবে না। তোর চারপাশে যখন ঝামেলা দেখবি তখন নিজের জগৎে ডুব দিবি। দেখবে শান্তি আর শান্তি।”

মার এই কথাগুলো আমার খুব মনে ধরেছিল। বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে আমার মত অসংখ্য বাংলার এই নারী সমাজ নিশ্চয়ই গুটি পোকার মতই নিজের জগৎে বসবাস করছেন। পরবর্তীতে আমার বিবাহিত জীবনেও মার এই টোটকা এত ভয়ানকরকম ভাবে যে কাজে দিবে তা কে জানতো? বিয়ের ছয় মাসের মাথায় আমি আবিস্কার করি স্বামী পরিচয়ে লোকটা আদ্যপান্ত চরিত্রহীন। আমি তার আচরণ আর লক্ষণ দেখেই বুঝতে পারছিলাম লোকটার অন্য কোন মেয়ের সঙ্গে কোন গোপন সম্পর্ক আছে। সারাক্ষণ সে মোবাইলে ফিসিরফাসির করেই যাচ্ছে। কখনো আমাকে বলে তার অফিসের কলিগ, কখনো বলে বন্ধু। এই আরকি। আবার মাঝে মাঝে একেবারেই কোথায় যেন নাই হয়ে যায়। অফিস থেকে বাসায় রাতে দেড়ি করে ফেরে। মাঝে মাঝে ফোন করে আমাকে জানিয়ে দেয় আমি যেন রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পরি। সে তার পুরানো বন্ধুদের নিয়ে একটু ব্যস্ত। আমি প্রথম প্রথম বিষয়টায় খুব গুরুত্ব না দিলেও ধীরে ধীরে তা আমার বুঝতে অসুবিধা হয় না। একদিন অনেক রাতে সে বাড়ি ফেরে এবং সেদিন আর আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি।

” তুমি এত রাতে কোথায় ছিলে?

”বলে কী!, তোমাকেতো বলেছিলাম!! আমার কিছু পুরাতন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছি। তুমি কী আমাকে সন্দেহ করছ শেফালি”?

আমি তখন তার কথার কোন উত্তর দিতে পরিনি। কারণ আমার হাতে তখনো পাকা কোন প্রমান ছিল না। কিন্তু কথায় বলে না ’চোরের সাতদিন আর গৃহস্থের একদিন’? চোর নিজেকে যতই বুদ্ধিমান মনে করুক না কেন সে একদিন গৃহস্থের হাতে ধরা পরবেই।

তাহলে শুনুন ঘটনাটা। তখন আমি ৬ মাসের সন্তান সম্ভাবনা। ভাবলাম অসুস্থ শরীর নিয়ে একটু গ্রামের বাড়ি মার কাছ থেকে ঘুরে আসি। লক্ষ্য করে দেখলাম আমার এই বাড়ি যাওয়া প্রস্তাবে সে ভীষন খুশি! আমাকে সে বিপুলভাবে উৎসাহ জোগাল,

” আরে অবশ্যই, যাও যাও। এই সময়টা মায়েদের কাছে একটু থাকতে হয়। খুব ভালো হবে। কতদিন তুমি তোমার মাকে দেখো না। যাও দেখে আস। আর আমিই তোমাকে নিয়ে আসবো। ইত্যাদি ইত্যাদি।”

আমার বাপের বাড়ি যাওয়ায় তার এত উৎসাহ দেখে তখনই আমার মনের ভেতর সন্দেহটা আরো প্রবলভাবে দানা বাধতে শুরু করলো।আমি শুধু মনে মনে বললাম

”যাক এবার কল পেতে হাতে হাতেই ইঁদুরটাকে ধরা যাবে।”

যাইহোক বাপের বাড়িতে দিনকাল আমার ভালোই কাটছিল। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম ঢাকায় যেদিন আমার ফেরার কথা সেদিন না যেয়ে হঠাৎ করেই তার আগেরদিন হাজির হব। জিঞ্জেষ করলে বলবো “তোমাকে সারপ্রাইজ দিব তাই আগেই চলে এসেছি।”

যেই ভাবনা সেই কাজ। কেন জানি মনে হচ্ছিল সন্ধ্যার সময় সে বাসায় থাকবে। বাসার সামনে এসে একটু দাড়ালাম। নিজেকে আবারো প্রশ্ন করলাম।”শেফালি, তুমি ঠিক কাজটি করছোতো?” আমার ভেতর থেকে উত্তর এল, “অবশ্যই। একটা মিথ্যে ধারণা নিয়ে তুমি সারা জীবন থাকতে পারনা।” আমি ধীরে ধীরে বাইরে থেকে তালাটা খুলে দরজার হাতলটায় মোচর দিলাম। দরজাটা ক্যাচ শব্দ করে খুলে গেল। ঘরের ভেতরটা অন্ধকার। কোন আলো নেই। আমাদের বেডরুমটা ঘরের একেবারে শেষ প্রান্তে পেছনের দিকে। সেদিকে ধীরে ধীরে পা টিপে টিপে অগ্রসর হলাম। দরজাটা হালকা করে চাপানো। সেখানে আমি চুপ করে দাড়িয়ে আড়ি পাতি। আমার অনুমানেরই জয় হল। আমি আর সেখানে দাড়িয়ে থাকতে পারলাম না। পেটে তখন আমার সন্তান। ডাক্তার আমাকে পরামর্শ যত সম্ভব যেন হাসিখুশি থাকি, আনন্দে থাকি। কোন রকম ট্রেস যেন না নেই। আমি দ্রুত আমাদের ড্রয়িংরুম সংলগ্ন বাথরুমটায় ঢুকে কান্নায় ভেংগে পরি।

ব্যাস। সেদিন থেকেই সব শেষ। ‘স্বামী’ শব্দটি আমার অভিধান থেকে ঝেড়ে ফেলি। আমি পারতাম সেদিনই ঐ এক কাপড়ে আমার মায়ের কাছে চলে যেতে। কিন্তু যাইনি। তারপর কী হত? আমার ছোট বোনটার বিয়ে নিয়ে ঝমেলা হত। কিছুদিন আমার মা হয়তো আমাকে সান্তনা দিতেন কিন্তু কদিন পর মাও আমাকে কথা শুনাতে ছাড়তেন না। এদিকে আপনাদের সমাজের কাছ থেকেও আমাকে কথা শুনাতে হত। নারীবাদি বলে যতই চিৎকার চেঁচামেচি করি করেন না কেন এই বঙ্গ সমাজে নারীর সম্মান এখনো প্রতিষ্ঠা হয়নি। যাইহোক আমি এই লোকটার সাথেই গত ১৪ বছর ধরে আছি। আমার এখন একমাত্র বন্ধু আমার মেয়ে ইমা।সেই আমার সব। তার সঙ্গে আমার নানা রকমের গল্প, খুনসুটি। মেয়েটার বয়স কম হলেও বয়েসের তুলনায় অনেক ম্যাচুয়রড। সে যেন বড়দের সব কথা ঠিক বুঝতে পারে। সে যে তার বাবাকে একেবারেই পছন্দ করে না তা এখন আরো বেশি স্পষ্ট হচ্ছে। সুযোগ পেলেই ইমা আমাকে সান্তনা দেয়।

”আমি যখন বড় হয়ে চাকরী করবো তখন তোমাকে নিয়ে আমি আলাদা একটা বাসায় চলে যাব। শুধু তুমি আর আমি।”

তার এই আশ্বাস শুনে আমি শুধু হাসি।

মনে মনে ভাবি সেদিন কি আমার কপালে আসবে? সত্যি কী আমি এই নরক যন্ত্রনা থেকে মু্ক্তি পাব?

করোনার সময় এখন আমাদের অবস্থা আরো খারাপ। ‘স্বামী’ দাবিদার এই লোকটাসহ আমরা সবাই একসাথে লকডাউন হয়ে আছি। আগেতো লোকটা অফিসে গেলে তার চেহারাটা অন্তত আমাকে দেখতে হত না। এখন সারাক্ষণ সে বাসায়। সারাক্ষণ মোবাইলে তার বান্ধবীদের সঙ্গে ফিসফাস করে কথা বলেই যাচ্ছে। আমি আদা, লেবু, লবঙ্গ দিয়ে পানি গরম করে তাকে খাওয়াই। আমি যেন তার কেনা একটা চাকর। কোন কাজের কোন প্রশংসা নেই। মনে হয় আমি ঘরের ফুটফরমাস করা, রান্না বান্না করা, থালাবাসান ধোওয়া মোছা এসবের জন্যেই আমার জন্ম। অবশ্য এখন আর এসব বিষয় নিয়ে আমি ভাবি না। সে তার মত আছে আমরা মা-মেয়ে আমাদের মত। আমি নিরবে আমার কাজগুলো করে যাই।

একদিন একটা ঘটনাটা ঘটল। খুব সকালে দেখি সে কাশতে কাশতে ঘরবাড়ি একাকার করে ফেলেছে। লোকটা এমনিতেই খুব ভীতু প্রকৃতির। সারাক্ষন শুধু বুক চেপে কাশি দিচ্ছে আর বলছে আমার শাষ নিতে কষ্ট হচ্ছে। গায়ে হালকা জ্বর। ভয়ে তার চোখ বিস্ফরিত! আমরা বুঝতে পারলাম লক্ষণ ভালো নয়। এটা করোনার লক্ষণ। সে তার ডাক্তার বন্ধুদের কল দিল। তাদের একটাই পরামর্শ। বাসায় কোরেনটিনে থাকো। বেশি বেশি মাল্টা,লেবু খাও। এন্টিবডি বানাও।শরিরের ইমিউন শক্তিশালি কর। আর জ্বরের ওষুধ খাও। সিরিয়াস হলে হাসপাতাল। আমরা সবাই তার দেখভালে লেগে গেলাম। কিন্তু ৪/৫ দিন পরই অবস্থা আরো খারাপের দিকে যেতে থাকল।লোকটা শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আমরা এম্বুলেন্স ডাকি। এম্বুলেন্সে উঠার আগে আমি তার প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার জন্যে গোছগাছ করছি। হঠাৎ সে আমার কাঁধে হাত রেখে ফিসফিস করে বললো, “শেফালি, প্লিস আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি অনেক পাপ করেছি। তোমাকে কষ্ট দিয়েছি”। তার এই কথায় আমার মনের কোন পরিবর্তন হল না। কেন হল না কে জানে? আমি চোখ বুজে আমার কর্তব্য কাজগুলো করে যেতে থাকলাম। সে হাসপাতালে ভর্তী হয়ে গেল।

এখন সে হাসপাতালে আইসিওতে আছে। ইমা হাসপাতাল থেকে একটু আগে কাঁদতে কাঁদতে কল দিয়ে জানালো তার বাবার অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। ডাক্তার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কিন্তু তাকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পরেছে।

আমি সব কথা নীরব শুনে গেলাম। কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম এই অদেখা করোনা ভাইরাসটির প্রতি আমার কোথায় যেন একটা ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতাবোধ জন্ম নিচ্ছে! প্রতিশোধটা তাহলে করোনাই নিল? এমনও বুঝি হয়!! শুধু মনে মনে ভাবলাম, “প্রকৃতিও মাঝে মাঝে রুখে দাঁড়ায়। প্রতিশোধ নেয়। সম্ভবত সেই শোধটিই এখন নিচ্ছে।”