You are currently viewing করোটির আর্তনাদ || মাহবুব আলী

করোটির আর্তনাদ || মাহবুব আলী

করোটির আর্তনাদ
মাহবুব আলী

এপ্রিলের দুপুর। নদীতে জলের গভীরতা খুঁজতে-খুঁজতে এখানে-ওখানে এগোতে-এগোতে কী যেন পায়ে বেঁধে গেল। শীতল স্পর্শ। যতটুকু বোঝা যায়, গোলাকার কোনোকিছু। একরামুল একডুব দিয়ে ডানহাতে উপড়ে তুলল সেই জিনিস। তারপর চোখের সামনে ধরে তীক্ষ্ণ চিৎকার। তখনো মাথার ওপর ধরে আছে গোলক। সেভাবেই কুলের দিকে একটু একটু এগিয়ে ধাতস্ত হতে চেষ্টাও করে গেল খানিক। সকলের দৃষ্টি তার দিকে। কারও কারও বুকে আতঙ্কের হিমস্রোত নেমে এলো। একরামুল পাড়ে উঠে ভালোমতো লক্ষ্য করে দেখে। মাথার একটি খুলি। হলদেটে সাদা। অথচ ভেবেছিল, সোনার মোহরে ভরতি ছোট্ট কলস হতে পারে। সেও ভ্যাবাচাকা চেহারায় কী করবে বুঝে উঠতে পারে না।
কলেজ হোস্টেলের তিনতলায় ওয়াটার ট্যাংক পরিষ্কার করা হচ্ছে। কোনোরকম ঘোষণা ছাড়াই জল নাই। হোস্টেলের বাইরে বেশ দূরে কৃষ্ণচূড়া গাছের কাছে একটিমাত্র টিউবওয়েল। আজ সেটা দম ফেলার অবসর পায় না। একরামুল অগত্যা কয়েক বন্ধুর সঙ্গে নদীর দিকে রওয়ানা দিয়েছিল। গ্রীষ্মের এই সময়ে কাঞ্চনে হাঁটুজল। ওর মধ্যেই শরীর ভেজানো আরকি! গোসল যদি হয় সে কাকস্নান না কী কে জানে। সে নিয়ে ভাবনা নেই, যতটুকু না দূরত্ব তারচেয়ে কঠিন প্রখর এই রোদে হেঁটে যাওয়া আর আসা। পৌনে এক কিলোমিটার পথ। কাঞ্চন নদীতে একসময় জলের স্রোত বইত। এপ্রিলের তাপদাহ খররোদেও জলের হিমহিম শীতলতা। এখন সে-সব নেই। নদীগুলো ভূ-রাজনীতির কারণে মরে যেতে বসেছে। তারপরও দূরন্ত শৈশবের খানিক স্মৃতি আর সীমাহীন প্রত্যাশায় নদীতে স্নান করতে যাওয়া। ফেরার পথে ভেজা লুঙ্গি মাথার উপর ছড়িয়ে আবার ফিরে আসা। রোদের তাপে আসতে আসতে লুঙ্গি শুকিয়ে যায়। আজও তেমনভাবে কাঞ্চন যাওয়ার আলাপ হয়।
‘এই রোদে একটু বাতাস হলে মন্দ হতো না। একেবারে চারপাশ গুমোট হয়ে আছে।’
‘বৃষ্টি হওয়া দরকার।’
‘এরমধ্যে লোডশেডিং। জীবন ত্যানা ত্যানা করে ছাড়ল।’
‘আজ মেসে কী রান্না হচ্ছে রে?’
‘তানিম গেছে বাজারে। সে শালা কী পছন্দ করে জানিস না?’
‘ও ব্যাটা পয়সাও মারে।’
‘তোর সন্দেহবাতিক রোগ আছে বে। এত সন্দেহ করিস কেন? ওর সাথে যেতে পারিস।’
তাদের তিনজনের মধ্যে গল্প শুরু হয়েছে। শাহিনের কথায় বৃষ্টির গন্ধ খোঁজে একরামুল। একই ইয়ারের রুমমেট। একরামুল অঙ্ক। শাহিন বাংলা সাহিত্য। রাজিব দর্শন। এখনই দার্শনিকের ভূমিকা নিয়ে আছে। শাহিন বলে, –
‘এই যে আমরা কাঞ্চন যাচ্ছি, গোসল সেরে আসতে না আসতেই দেখবি, শরীর ঘেমে গেছে। সবকিছু অর্থহীন।’
‘পৃথিবীতে কোনোকিছুই অর্থহীন নয়।’
রাজিবের শেষকথায় কেউ মন্তব্য করে না। পনেরো মিনিট পর সেই অর্থহীন কাজই হয়ে গেল। একরামুল নদীর জলে করোটি পরিষ্কার করছে। শাহিনের ভেজা শরীর রোদে শুকোয়। রাজিব বেশ কৌতূহল নিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে করতে বলে, –
‘আশপাশে কবরস্থান বা শ্মশান আছে। সেখানেরই কোনো লাশের মাথা হবে।’
‘মনে হয় না। কত প্রাচীন মাথা দেখেছিস? সম্ভবত উনিশ শ একাত্তরের সময়কার।’
‘আচ্ছা নারী না পুরুষের মাথা?’
‘পুরো স্কেলিটন পাওয়া গেলে জানা যেত। মাথা দেখে কি বোঝা যায়!’
‘এখন কী করবি এটা নিয়ে? পুলিশে খবর দেয়া দরকার। কে জানে কেউ কাউকে মেরে গেছে কি না। আজকাল তো এসবই হচ্ছে।’
‘রাজিব ঠিক বলেছে। মোবাইল কর।’
‘তোদের কিছু করতে হবে না। আমি পেয়েছি, যা করার সব আমি করব। আমাকে আবার নামতে হবে। দেখি বডিটা আছে কি না?’
‘সত্যি তোর সাহস আছে বটে! তবে এখন ফিরে চল। কাল দেখা যাবে।’
একরামুল একপলক শাহিনের দিকে তাকিয়ে আলগোছে জলে নেমে পড়ে। কাঞ্চনের এপাশে আট-দশফুট গভীর। কেউ কেউ বলে, নদীর বুকে আগে কুয়ো করা হতো, যাতে জলে পরিপূর্ণ থাকে নদী। এ জায়গা তেমনই। একরামুল পরপর কয়েকটি ডুব দিতে দিতে চোখ লাল করে ফেলে। শাহিনের হাতে করোটি রোদের তাপে প্রায় শুকিয়ে যেতে শুরু করে। রাজিব বড় অস্থির হয়ে দেখে থাকে।
‘একরামুল বাদ দে রে ভাই। এটাও নদীর যেখান থেকে তুলেছিস, সেখানে ফেলে দে। ভয়ংকর ব্যাপার-স্যাপার।’
‘এই জন্য বলি তোর হরর মুভি দেখা বাদ দেয়া উচিত।
‘এখন দেখি না তো। সাইফাই দেখি।’
‘শাহিন শোন, ব্যাটা দার্শনিক বলে কী? পরশুরাতে অ্যাডাল্ট-হরর দেখছিল। আমরা কি জানি না?’
‘ডাউনলোড করে রেখেছি। ঘুম হারাম করা মুভি।’
অবশেষে করোটির বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত, কেউ খুশি হলো না। একরামুল একরকম সিনিয়র স্টুটেন্ড। কয়েক বছর ধরে ফোর্থ ইয়ার। তার সিদ্ধান্তের বিপরীতে কথা বলা যায় না। নিজের কাছে রাখবে সেটা। পুলিশি ঝামেলা করা যাবে না। অ্যান্টিক পিস। তার নানানরকমের শখ আছে। পোস্টেজ স্ট্যাম্প, দেশ-বিদেশের কয়েন আর বিভিন্ন সাইজের সেফটিপিন কালেকশন। ইদানীং অডিও ক্যাসেট সংগ্রহ শুরু করেছে। একটি ফ্ল্যাটবেড ক্যাসেট রেকর্ডার যক্ষের ধন। একা একা গান শোনে। রাগপ্রধান গানে কি মজা পায় কে জানে। তার কথা খুলির সকল দায়িত্ব নিয়েছে সে। রাজিব-শাহিন কিছু জানে না…কিছু দেখেনি। তাদের কাজ চুপ করে থাকা। ঠোঁটে তালা ঝুলিয়ে রাখতে হবে। পাসওয়ার্ড দেওয়া যাবে না।

একরামুল ডায়নিং-এ খেয়ে এসে চোকির তলে রাখা স্টিল ট্রাঙ্কের ভেতর থেকে খুলি বের করে আনে। শাহিন-রাজিব আর তেমন গুরুত্ব দিতে আগ্রহী নয়। রাজিব জড়বাদ পড়ছে। শাহিন চোখ বন্ধ করে ঘুমোবার চেষ্টায়। একরামুলের বেডের দক্ষিণে জানালা। কখনো জানালা গলিয়ে কদম গাছের বাতাস রুমে এসে পড়ে। দোতলার এই রুমটা চমৎকার। বিল্ডিং-এর একেবারে দক্ষিণ দিক। জানালা দিয়ে পুবদিকে কলেজের অফিস দেখা যায়। এখন কখনো কখনো অফিস খোলা থাকে। সামার ভ্যাকেশন শুরু হয়েছে সপ্তাহখানেক আগে। শাহিন আগামী সোমবার বাড়ি চলে যাবে। আজ শনিবার। একরামুল করোটি হাতে তুলে নিতে নিতে কেন জানি শনিবারের মধ্যে অশুভ ছায়া খুঁজে পায়। সবই মনের ভুল। তারপরও কেমন যেন লাগে। মাথার একটি খুলি অর্থাৎ একজন মানুষ। মানুষটি অনেক আগে মারা গেছে। মৃত। তার আত্মা আছে। শোনা যায়, আত্মার মৃত্যু নেই। শরীরের ক্ষয় আছে। আত্মার নেই। আত্মার শান্তি বিঘ্নিত করতে হয় না। মহাপাপ। একরামুল অকারণ চমকে ওঠে, তবে ভয় পাওয়ার মানুষ নয়। সে আলগোছে লুকিয়ে প্রায় বাথরুমে চলে গেল। এখন করোটি ভালোমতো পরিষ্কার করতে হবে। একটি মানুষের করোটি মানে অনেক কাহিনি। কে জানে কোন্‌ কাহিনি জড়িয়ে আছে।
জানালার পাশে রিডিং টেবিল। সেটির উপর দুইতাকের র‌্যাক। এককোণায় একটি পঁচিশ ওয়াট বাল্‌ব। বই মলাট করার ব্রাউন কাগজের শেড। পড়ার সময় এই টেবিল ল্যাম্প অন করে একরামুল। আজকাল পড়ার প্রতি জোর করে মনোযোগ দেয়। কয়েক বছর ধরে সেকেন্ড ইয়ারে পড়েছিল। মাথায় রাজনীতির পোকা। সকলের জন্য সম্পদের সুষ্ঠু অধিকার চাই। কয়েকজন নেতা আর সহপাঠি বন্ধুরা সেই পোকা ঢুকিয়েছিল। বছর দুয়েক আগে আরও মোহজালে জড়ানো ছিল জীবন। মেয়েটির নাম জেসমিন। একেবারে রেড লাভবাগের মতো লেপটে থাকত। একরামুলও কি একটু ঝুঁকে পড়েনি? সে তো বটেই! দিন আর রাতগুলো ছিল হাজার কল্পনা আর স্বপ্নের কথোপকথনে মুখর। প্রতিরাতে স্বপ্ন আসে। সেই জেসমিনও এপ্রিলের এমন বেলায় দিনশেষে বর্ণিল এনভেলাপ হাতে দিয়ে বলে, –
‘তুই আসবি কিন্তু! বোশেখের প্রথম সন্ধ্যায় আকদ্‌।’
‘ছেলে কী করে রে?’
‘বিজনেস। একবছর পর আমেরিকা চলে যাব।’
‘ভালো করেছিস।’
‘তুই কিন্তু কোনো উপহার নিয়ে আসবি না। একটি রক্তলাল গোলাপ শুধু।’
একরামুল গোলাপ নিয়ে গিয়েছিল। জেসমিন মঞ্চে একেবারে ডানাকাটা পরির মতো বসেছিল। তার হাতে জাপানি হ্যান্ডফ্যান। তারপরও ঠোঁটে-নাকে চিকন স্বেদবিন্দু। একরামুলের যা খুব ভালো লাগত। এখন শুধুই স্মৃতি আর দীর্ঘম্বাস। জেসমিন গোলাপ হাতে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে খোঁপায় গুঁজে নেয়। চেহারায় কৌতুকময় তৃপ্তির হাসি। চোখের দৃষ্টিতে অনাগত দিনের প্রতিচ্ছায়া। সেখানে একরামুল নেই। অথচ কত স্বপ্ন দেখেছিল। জেসমিনকে বডিগার্ডের মতো কলেজ ক্যাম্পাসে আগলে রাখত। কেউ কেউ তো অনেককিছু জেনেই গিয়েছিল, এদের মধ্যে প্রেম আছে; বিয়ে হবে। আফশোস!
‘শোন তোর এই গোলাপ বুকের মধ্যে রেখে দিলাম।’
‘দেখিস গোলাপের কাঁটা রক্ত ঝরায় না যেন।’
‘আমার বুকের রক্ত নীল রে। তোর বুকে রক্ত ঝরছে দেখতে পাচ্ছি।’
‘তুই জেনেবুঝেই এত বড় দাগা দিলি?’
‘প্রেম শুধু কাছেই টানে না, বড় প্রেম দূরেও ঠেলিয়া দেয়। হি হি হি! চল খাবি। আমি নিজ হাতে খাওয়াব।’
‘সিন ক্রিয়েট করিস না। আমি খেয়ে নেব। জন্মের মতো খাওয়া।’
‘শ্‌শালা!’
একরামুল কাঙালের ক্ষুধা নিয়ে লাজহীনের মতো একটু বেশিই খেয়ে ফেলে। রাতের খাওয়া সুদ্ধ। তার কপালে রাজভোগ কোথায়? শক্তি আর সামর্থ আছে? জেসমিনের কথাই ঠিক। বড় প্রেম দূরেও ঠেলিয়া দেয়। হা হা হা!

তিনতলার ছাদে ট্যাংকি রিপেয়ার হয়েছে। স্বাভাবিক হয়েছে জলের সাপ্লাই। ট্যাপের জল রোদের তাপে গরম। এমন উষ্ণ জলে ডিটারজেন্ট মিশিয়ে করোটি ঘষে ঘষে পরিষ্কার করা সহজ কাজ। হলদেটে রং ধীরে ধীরে অফহোয়াইট ধারণ করে। এটি নিশ্চয়ই কোনো মেয়েমানুষের মাথার খুলি। আকস্মিক কেন তবে জেসমিনের কথা মনে এলো? সেও তো এক-দেড় বছর পেরিয়ে যায় যায়। আহা জেসমিন! তুই কেমন আছিস? আমেরিকার ব্যস্ত কোনো শহরে কী করিস? কখনো কী মনে পড়ে হারিয়ে যাওয়া সেইসব দিন? একরামুলের মন পোড়ে। তার সাধ্য কোথায়? রানিশংকৈল আর নেকমরদের হাটে হাটে গামছা আর গেঞ্জি ফেরি করে একজন বুড়ো মানুষ। এক-দুই পয়সা গুনে গুনে সঞ্চয় গড়ে তোলে। সেই বৃদ্ধ মানুষটি হলো বাবা। একরামুল পড়ালেখা শিখে অনেক বড় হবে। চুক্তিতে ছেড়ে দেওয়া চল্লিশ শতক জমি উদ্ধার করবে। বড়লোকের একজন মেয়েকে বিয়ে করে সংসারি হবে। ছোট দুটো ভাইবোনের দায়িত্ব নেবে। বুড়ো মানুষের চোখে-মুখের ক্লান্তিতে প্রচ্ছন্ন হয়ে থাকে অন্যজগতে চলে যাওয়ার সীমাহীন আকাঙ্ক্ষা। একরামুল তবু কোন চক্করে ভেসে যায়…ভেসে যায়।
করোটি জায়গা পায় টেবিলের উপর যে র‌্যাক তার টপে। একবার ইচ্ছে হয়, চোখের কোটরে দুটো লেড বাল্‌ব বসিয়ে দেয়। সারারাত ব্লিংকিং হলে বেশ মজা। জবরদস্ত শো-পিস। শেষে আইডিয়া মন থেকে মুছে দিয়েছে। বিকেলের দিকে বাতাস হালকা ভেজা ভেজা লাগে। রেডিওয় শোনা যায়, পশ্চিমবঙ্গের কাছে লঘুচাপ শক্তিশালী হচ্ছে। শিলিগুড়িতে একনাগাড়ে বৃষ্টি। এদিকে সিলেটে আকস্মিক ঘুর্ণিঝড় আর শিলাবৃষ্টি হয়েছে। প্রায় দশমিনিট বর্ষণে ক্ষয়ক্ষতি অনেক। রাস্তায় চলাচল বন্ধ। শিলার গড়পড়তা ওজন নাকি দুইশত গ্রাম। মানুষের ঘরবাড়ির জানালার কাচ আর রাস্তায় থমকে থাকা যানবাহনের উইন্ডশিল্ড ভেঙে চৌচির। অথচ এই শহরে বৃষ্টি নেই। তাপপ্রবাহ চলবে আরও কয়েকদিন। আজকের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উনচল্লিশ পয়েন্ট দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবহাওয়ার এই পরিবর্তন আগামী দিনগুলোয় কী বার্তার ইঙ্গিত দেয় কে জানে।

একরামুল ভেবেছিল রাতে দুটো নোট মুখস্থ করে নেবে। এ দেশে শিক্ষা মানে মুখস্থবিদ্যা। পরীক্ষার খাতায় উগড়ে দিলেই মেধাবী। তার মুখস্থ থাকে না। নিজের মনে বানিয়ে বানিয়ে লেখে। আজ পড়া হবে না। রাত বারোটা বাজতে না বাজতে চোখ ঘুমে জড়িয়ে যায়। রাজিব আর শাহিন অডিটোরিয়ামে লেটনাইট মুভি দেখতে গেছে। গভীররাতের এই মুভিগুলোয় অ্যাডাল্ট সিকোয়েন্স বেশি থাকে। রাজিব ধীরে ধীরে শাহিনের মাথা খাচ্ছে। তাকে সাবধান করা উচিত। সিনেমার নেশা বড়ই সাংঘাতিক। এইসব ভাবনার মধ্যে জাগো-আধোজাগরণে কোন জগতে চলে গিয়েছিল একরামুল, আকস্মিক হাতে-পায়ে চমকে উঠে। টেবিলের উপর কেউ বসে আছে। তার কচি কলাপাতা সবুজ কামিজের উপর রুপালি রং জরির কাজ। মাথাভরতি কালো চুলের সঙ্গে ফরসা ছোট্ট চেহারা চকমকে উজ্জ্বল। প্রগাঢ় লাল ঠোঁট কী যেন বলিতে চায়। একরামুলের গলা শুকিয়ে আসে। সে কথা বলতে চায়, বলতে পারে না; কোথায় সবকিছু জড়িয়ে স্তব্ধ হয়ে আছে।
‘ভয় পেও না একরামুল, আমি তোমার ক্ষতি করব না।’
‘কে কে তুমি?’
‘আমি? আমার আর পরিচয় নাই। একসময় ছিল। তখন আমার নাম ছিল। ঘরবাড়ি সব ছিল।’
‘কী নাম তোমার? এখানে কীভাবে এসেছ?’
‘আমি মুনিয়া। আমি তো আসিনি…তুমি নিয়ে এসেছ।’
‘আমি নিয়ে এসেছি! কখন?’
‘তুমি জানো না? আশ্চর্য! উনিশ শ একাত্তরে বিহারিরা আমাকে মেরে ফেলল। আমার মা-বাবা ছোট ভাই আর বোন সবাই মরে গেলাম। আমার তলপেটে বেয়োনেট খুঁচিয়ে হত্যা করা হলো। আমার গর্ভে থাকা পাঁচ মাসের শিশু। সে আগে মরল। আমার হাজব্যান্ড তখন করাচিতে। সে জানল না কী হলো এখানে। আমরা পড়ে থাকলাম কাঞ্চন নদীর গভীর তলায়।’
‘ওহ্‌! তুমি তা হলে…তা হলে।’
‘এই তো তোমার ভয় কেটে গেছে। তুমি আমাকে তুলে এনেছ। আমার ঘুম ভাঙিয়েছ।’
‘আমি দুঃখিত মুনিয়া। আমি তোমাকে রেখে আসব।’
একরামুল এদিক-ওদিক তাকিয়ে কাউকে খোঁজে। সেই ছায়া কোথায় গেল? নেই…নেই, বাতাসে তবু লেপটে আছে অচেনা সুবাস। কে জানে বাগানের দিক থেকে ভেসে আসে কি না। সে আবার খুঁজতে থাকে।
‘হা হা হা! ভয় পেয়েছিস একরামুল? আমি জেসমিন। তুই যে একটা অশ্বডিম্ব এটা অনেক আগেই টের পেয়েছিলাম। তাই তোকে বিয়ে করতে চাইনি।’
‘তুই…তুই জেসমিন এখানে কী করে এলি। না না তুই জেসমিন না, মুনিয়া…মুনিয়া আমি তোমাকে ঠিক জায়গায় ফিরিয়ে দেব। আমি দুঃখিত। আমার এটা করা ঠিক হয়নি।’
‘আমি জেসমিন রে পাগলা…জেসমিন।’
‘তুমি মুনিয়া। মুনিয়া আমি দুঃখিত।’
একরামুল বেডের একপাশে ঝুলে পড়ে গোঙাতে শুরু করে। তার মুখ দিয়ে লালা ঝরে যায়। একহাতে বেডশিট খামচে নড়ে উঠতে চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। তখন কেউ তার কানে কানে বলে উঠে, তুমি স্লিপ অ্যাপনিয়ার ঘোরে আছ…ঘোরে আছ। সে তেমনই ঘোরের মধ্যে দক্ষিণের জানালায় নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে। আকাশ অন্ধকার। আজ কি অমাবস্যা? সে জানে না। সে সত্যি কিছু জানে না। কোনটি ঠিক কিংবা বেঠিক ঠাহর করতে পারে না। কদম গাছের শাখায় শাখায় বর্ণিল আলোকবিন্দু জ্বলতে থাকে। একরামুল জেগে উঠতে চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না; টেবিলে র‌্যাকের উপর একটি ছায়া ছায়া সাদা করোটি। তার কোটরজোড়া জ্বলছে আর নিভছে। একরামুল প্রচণ্ড আর্তনাদ করে, অথচ কোনো আওয়াজ হয় না।

এদিকে রাত আরও নিশ্চুপ সুনশান হতে থাকে।

**********************************