কয়েকটি টিকটিকি, একজন ধর্ষিতা ও ঝিনুকের গল্প
দেবাশিস ভট্টাচার্য
২৮ এপ্রিল ১৯৭১ মিলিটারির জিপটা বিকটশব্দে চাকা পাংচার হয়ে এক প্রকার কাত হয়ে যাওয়ার উপক্রম হতেই জোরে ব্রেক কষলো ড্রাইভার। কেমন একটা ঘড় ঘড় করতে করতে হিস হিস করে থেমে গেল চুপসে যাওয়া ফুটো বেলুনের মতো তার চাকাগুলো। একে তো পাহাড়ি পথ, চারদিক নির্জনতায় মোড়া। পাশেই কালিন্দী রাণীর মন্দির। ড্রাইভার বেলুচি, সঙ্গে ক্যাপ্টেন, সোলজার চার-পাঁচেক। হ্যাট খুলে ক্যাপ্টেন নিচে নামলেন। চারপাশ ভালোভাবে দেখে সঙ্গীদের নির্দেশ করলেন নামার জন্য । ক্যাপ্টেনের চোখ দু’টি লাল, রক্তবর্ণ-জবাফুলের মতো। গত রাতের অত্যধিক মদ্যপানের আড়ষ্টতা চোখে-মুখে, ঘোর ভেঙে ড্রাইভারকে জিপ সারাতে নির্দেশ দিয়ে হনহন করে হেঁটে চললেন মন্দিরের দিকে। চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট থেকে তারা বের হয়েছে চন্দ্রঘোনা হয়ে কাপ্তাইয়ের দিকে যাবেন। কিলিং মিশন ঠিক হবে। হাতে অত্যাধুনিক আগ্নেয়ার। তাদের ভারী বুটগুলো তর তর করে সিঁড়ি ভেঙে উঠে আসছিল উপরের দিকে। ক্যাপ্টেনের মাথার চড়ুই পাখি চুলগুলো উড়ছিল বুনো হাওয়ায়। তিনি হয়তো জানেন না, এ মন্দিরে থাকতো একজন- তাঁর নাম কালিন্দী, যার শাসনে চলতো পুরো এলাকা । প্রজারা যার প্রশংসায় গীত রচনা করে গেয়ে শোনাতো অপরাপর গ্রামের মানুষদের। যখন একের পর এক জমিদারদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশরা ব্যবস্থা নিচ্ছিল, তখনই ফুঁসে উঠলেন সাপের মতো কালিন্দী। তিনি তখন তাঁর দলবল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ব্রিটিশ সেনাদের ওপর। তারা হয়তো জানে না, যে মানেনি পরাভব, সে গিয়েছে যমের দুয়ারে । জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অসম সাহসী এক যুদ্ধে তিনি শহীদ হন। ভগ্নমন্দিরে কতিপয় দুর্বৃত্ত জায়গাটি উঁচু ঢিবির মতো। এটি কালিন্দী রানীর মন্দিরের ধ্বংসস্তূপ বলা যায়। চার-পাঁচটি সুড়ঙ্গপথ নেমে গেছে নিচের দিকে। তিন-চারটে ভাঙা দুর্গ, মাঝখানে সিংহ দরজা। সুড়ঙ্গ পথগুলো লতা-গুল্ম আর অন্ধকারে ঢাকা। সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে ক্যাপ্টেন সঙ্গীদের বললেন, হল্ট পেছনে তার চার-পাঁচ জোড়া বুট থমকে দাঁড়ালো। তিনি জানেন না যে ধ্বংসস্তূপেদাঁড়িয়ে আছেন, সেটি আজ কতো প্রাচীন সংগ্রামের জলন্ত আগ্নেয়গিরি । হাতের স্টেনটি তুলে তিনি পাশের একটি সুউচ্চ শিশু কড়ুইগাছে ঠা ঠা করে ব্রাশ করলেন, সাথে তার সঙ্গীরাও লুপ করে পড়লো পায়ের কাছে একটি রক্তাক্ত শকুন। গুলির আঘাতে পাখাটি তার থেঁতলে গেছে। চারপাশে কোনো লোকজন নেই, গুলির শব্দ ফিরে আসে টিলা থেকে টিলায় জায়গাটি আবার তার পূর্বের মৌনতায় ফিরে গেল। টিলাগুলোর ভেতর দিয়ে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা চৈত্রের পিঠপোড়া রোদে মন্দিরটির পাশ ঘেঁষে যে নদীটি বয়ে গেছে তার নামও কালিন্দী, সে নদীটির এখন আর আগের যৌবন নেই, বুকে পাতলা জলের স্রোত। নদীর দু’পাশে ব্যাসের মতো হাঁ-করা লালমুখো দুটি টিলা মুখ উচিয়ে দাঁড়ানো। শকুনটাকে মেরে জায়গাটা অন্ধকার আর স্যাতস্যাতে ভেবে তারা আর ভেতরে ঢোকার সাহস পায় না। টিলার একপাশে কয়েকটি টিকটিকি টিলার অন্যপাশে হরিহর, জীবন, আব্বাস তখনো জুয়ায় মত্ত। চারদিকে এ কিসের গোলমাল ভেবে টাকা-পয়সার রুমালটা লুঙ্গির ভাঁজে গেঁথে এক লাফে পড়ে খাদের ভেতর। তারা সেদিন নিশ্চিন্ত মনে আর জুয়া খেলতে পারেনি, হামাগুড়ি দিয়ে নদীপথ ফেলে নেমে গেছে খাদের ভেতর। এখানে ওরা তাদের কখনোই খুঁজে পাবে না। ক্যাপ্টেন আবারো এদিক-ওদিক দেখে কাউকে না পেয়ে জিপের দিকে যাবেন ভেবে ঘুরে দাঁড়ালেন আরেক দিন আসবেন, সেরকম একটা নির্দেশ দিলেন সঙ্গীদের টিলার ওপর সুন্দর একটি পাহাড়ি ঝর্না। সেই শুভ্র, স্বচ্ছ পাহাড়ি ঝর্নার উপর থেকে জলগুলো গড়িয়ে পড়ছিল নিচের দিকে। জল দেখে, হঠাৎ ক্যাপ্টেনের জন্মভূমির কোনো স্মৃতি হয়তো ভেসে ওঠে, দু’চোখে জল গড়িয়ে পড়ে। সে জল রেখে যায় হাতে করে নিয়ে আসা হলুদ শ্যাওলা। শ্যাওলাগুলো হলুদে হলুদে সয়লাব হয়ে গিরিখাদগুলো ভরিয়ে দেবে। পাশের গিরিখাদগুলোর ভেতর লুকিয়ে থাকা জুয়াড়ি হরিহর ও তার বন্ধুরা টিকটিকির মতো মাথা বের করে দেখে। তারা ইতোমধ্যে কুড়িয়ে নিয়েছে পাথর, যা তাদের আক্রমণের একমাত্র অস্ত্র। মৃত্যুকে ভয় নেই তাদের। প্রথম পাথরটি ছোঁড়ে হরিহর। পাথর লাগে ক্যাপ্টেনের ডান হাতে, মুহূর্তের ভেতর ক্যাপ্টেন ঘুরে দাঁড়াতেই পর পর পাথরখণ্ড তার সঙ্গীদের গায়ে এসে লাগলো। বিকৃত কণ্ঠে ক্যাপ্টেন বললেন, ফায়ার, অমনি ওরা অ্যামবুশ নিয়ে স্টেনগান থেকে অনবরত বৃষ্টির মতো গুলি ছুঁড়তে লাগলো। ওরাও ছাড়ার পাত্র নয়, আরেকটি বড় মতো পাথরের অ্যামবুশ করা সেনাটির মাথায় সে অস্ত্র ফেলে চিৎকার দিয়ে লাফিয়ে উঠলো। মাথা তার ফেটে গেছে। গলগল করে রক্ত ঝরছে ইউনিফর্ম বেয়ে। অন্য সেনারা ঠাঠা শব্দে অনবরত গুলি চালাতে থাকে। টিকটিকির মাথাগুলো খুব সন্তর্পণে গিরিখাদের ভেতর ঢুকে যায়। সম্ভবত আব্বাসই শেষ পাথরটা ছুঁড়েছিল। তাদের মুখে হাসি অনেকটা হতভম্ব হয়ে ক্যাপ্টেন শত্রুর অবস্থান নিশ্চিত হতে হাত তুলে অস্ত্র চালনা বন্ধের ইশারা করেন। অজ্ঞাত শত্রুর আক্রমণে দিশেহারা বেলুচি সেনার দলটি অনেকটা দৌড়ে জিপটির কাছে ছুটে যায়। ইতোমধ্যে তারা আহত কম-বেশি। জিপ স্টার্ট দিতেই গ্রুপ করে কি একটা এসে পড়লো সামনে। একটা উপজাতি মেয়ে । পরনে ছেঁড়া থামি। বুক এক টুকরা কাপড় অর্ধবৃত্তাকারে বাঁধা। সে সম্ভবত দা নিয়ে টিলায় যাচ্ছিল জুম খেতে। ওরা তাকে ঘিরে ধরলো। এক টানে থামিটা কেড়ে নিল। নগ্ন হয়ে গেলে কাঁধে নিয়ে জিপে ওঠালো। মেয়েটা আত্মরক্ষার জন্য হাত-পা ছুঁড়ছিল আর প্রবল চিৎকার করছিল বাঁচার জন্য। ও প্রান্তে তখন টিকটিকিগুলো টিলার সুড়ঙ্গপথে ও প্রান্তে গেল। হাতের দা দিয়ে কুপিয়ে খুব দ্রুত একটা বড় গাছ কেটে রাস্তায় ফেলে দিল। জিপে বসে সেনারা মেয়েটির তামাশা দেখতে দেখতেই জিপ থেমে গেল বিকট শব্দে। সমূহ বিপদ ভেবে সেনারা এবার জিপের আড়াল থেকে অস্ত্র উচিয়ে ধরলো। ক্যাপ্টেন ও প্রান্তে আর কোনো অশুভ বার্তা না পেয়ে নিজেই গাছটি সরানোর চেষ্টা করতে লাগলেন। অন্য সেনারা অস্ত্র রেখে তার সাথে গাছটি সরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মেয়েটিকে হাত-পা বেঁধে মাছের মতো শোয়ানো হয়েছে।
জিপের ভেতর থেকে যাতে সে পালাতে না পারে। চিৎকার থামিয়ে মেয়েটি অনবরত গোঁ গোঁ করে যাচ্ছিল। আবারো পাথর বৃষ্টি শুরু হলো। তবে এবার নিশানা ঠাহর করতে পারলো না। একটু পরে আরো কনভয় এসে যুক্ত হতে দেখে টিকটিকিগুলো আবার নেমে গেল খাদের ভেতর। গাছের জন্য তাদের সনাক্ত করা যাচ্ছিল না। অসহ্য এক বেদনা যেন তাদের চোখে-মুখে। যুদ্ধের আলামত তারা টের পেয়েছিল অনেক আগেই। মাথার উপর দিয়ে সাঁই সাঁই যখন জেট বিমানগুলো উড়ে উড়ে চারদিকে গোলাবর্ষণ করছিল, তখনই তারা বুঝেছিল এদিকেও তারা আসবে সহসা। মেয়েটিকে নিয়ে জিপটা একটু পেছনে হটলো। সব সৈন্য নেমে কেটে টুকরো টুকরো করে গাছটি সরিয়ে ফেললো দ্রুত। তারা সবকিছু দেখলো। মেয়েটিকে বাঁচাতে না পারায় তাদের চোখে জলের ধারা নেমে আসে। হরিহর জুয়াড়ি চিৎকার দিয়ে ওঠে, ‘সম্বন্ধীর পোলাগো হোগা ফাটাইয়া দে, পাথর মার আরো, মাঙ্গির পুতরা এখানে আইছে কু কামে, হোগা ফাটাইয়া দে মাঙ্গির পুতগো, পাথর মার হালাগো। কনভয়গুলো ছেড়ে গেছে ততক্ষণে, চিৎকার তাদের কানে পৌঁছায় না। নিরস্ত্র তিন-চার জুয়াড়ি বাক্যহারা, দু’চোখে গভীর ক্রন্দন ভাবনার ক্রান্তিকাল ১৯৭১ তাদের বুকের চেরাগখানি ঘিরে অন্ধকার ।। মনে তাদের স্বপ্ন আছে, দ্রোহ আছে, ঘৃণা আছে, তারাও যোগ দেবে যুদ্ধে.. আশ্চর্য ঝিনুক ঠিক বিশ-বাইশ দিন পর মেয়েটি ফিরে আসে। কারা যেন এনে ফেলে দিয়ে যায় পাড়ার কাছে । তার হাঁটা অসংলগ্ন, দু’চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে। চুলগুলো আলুথালু কোমরে এক টুকরো কাপড় প্যাচানো। এক প্রকার গড়িয়ে গড়িয়ে হামাগুড়ির মতো সে পাড়ায় ঢোকে। তখন অনেক বেলা মওদের পাড়ার শেষ ঘরটি তার। অতঃপর কালো কালো পুরনো বেড়া তার আলকাতরা মাথা ঘরটার ভেতর সবকটি দরজা-জানালার বিল তুলে দিল সে, যেন তাকে আবার কেউ ধরে নিয়ে যেতে না পারে, স্পর্শ করতে না পারে। বেরুনোর আর কোনো পথ নেই। শুধুই আটকে থাকা। স্বামী হয়তো কাজে গেছে। বাচ্চাটা শুয়ে আছে অন্ধকারে। আস্তে আস্তে সে শিশুটিকে জাগিয়ে তুললো, হাতে তার রক্তলাল জীবন্ত ঝিনুক. শিশুর হাতে তুলে দিল মাঝরাতে। ছেলে তার সমুদ্র ঝিনুক। ততক্ষণে তার তলপেট থেকে গলগল করে বেরুচ্ছে লাল রক্তের স্রোত।
=======================