কবি মাসুদ খান বাংলা কবিতার একটি স্বতন্ত্রস্বর। বাংলা কবিতার নানামুখী প্রবণতার মধ্যে তাঁর গতিপথ ভিন্ন বলয়ে স্বকীয় ভঙ্গীতে রচনা করেন প্রাজ্ঞতার সাথে। আভিধানিক শব্দের চরিত্র হনন করে শব্দের নবনির্মাণ করেন অপ্রচল অনুষঙ্গে। তিনি বাংলা কবিতায় যে মাত্রায় শাসন-সংহতির সমন্বয়ে বিদ্যমান সময়ের অসংগতি, রাজনৈতিক হতাশা ও জীবনবোধের টানাপোড়নের অনিবার্য পরিণতিতে বিদ্রুপ আর কষাঘাতের ভাষায় শাণিত হয়ে ওঠেন তা তাঁর অনন্য অভিযাত্রায় ভাস্বর হয়ে ওঠে। মিথের সাথে ইতিহাসের সমন্বয় এবং উপমা ও চিত্রকল্পের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে তিনি পলিমাটির শাঁসের ভেতর থেকে প্রজন্মের ইতিহাস রচনার শস্যদানা সঞ্চয় করেন। তাই তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে নৈঃশব্দের প্রগাঢ়তায় বিমূঢ় প্রেক্ষাপটে তুমুল উচ্চনিনাদ।
কবি মাসুদ খানের কাব্যচিন্তা, দর্শন, ইতিহাসচেতনা ও অচলায়তনের বিপরীতে সঞ্চারিত দ্যুতির গতিময়তা নির্ণয়ের লক্ষ্যে অনেকদিন ধরে নানামুখী বিচার বিশ্লেষণ, আলোচনা-পর্যালোচনা চলছে। কবির সৃষ্টিশীলতার বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রচুর বিশ্লেষণমূলক লেখালেখি হয়েছে ও হচ্ছে । আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, কবির সাহিত্যকর্ম নিয়ে নানামুখী গবেষণা অব্যাহত থাকবে। মন-মানচিত্র’র পক্ষ থেকে কবির সাথে আলোচনা হয়েছে এবং তিনি সক্রিয়ভাবে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত দিয়ে আমাকে সহযোগিতা করেছেন। সেজন্য আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই।
যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে কবির সামগ্রিক সৃষ্টিকর্ম নিয়ে কাজ করছেন তাদের সাথে যোগাযোগ করে তাঁদের লেখা পুনর্মুদ্রণের অনুমোদন পেয়ে এই বিশেষ আয়োজনটি করতে সক্ষম হয়েছি। বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আলোচনা, পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণমূলক মূল্যায়নগুলো একত্রে গ্রথিত করে পাঠকের সামনে তুলে ধরা যাতে কবির কাব্য অন্বেষার সাথে পরিচিত হতে পারে। এ ব্যাপারে কবি চঞ্চল আশরাফ, বিশিষ্ট সাহিত্য বিশ্লেষক মোহাম্মদ নূরুল হক, সাহিত্য সমালোচক ও প্রাবন্ধিক মামুন রশীদ, কবি ও প্রাবন্ধিক আলমগীর নিষাদ এবং লেখক ও প্রাবন্ধিক কুদরত-ই-হুদা সাগ্রহে সাড়া দিয়েছেন। আমি তাঁদের সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।
পাঁচটি মূল্যবান আলোচনার সাথে কবির একগুচ্ছ কবিতা ও সংক্ষিপ্ত পরিচিতিও সংযুক্ত করা হলো।
মাসুদ খানের সাম্প্রতিক কিছু কবিতা
আন্তর্জাগতিক
ভিন গ্যালাক্সির মেয়ে তুমি, ভিন্ন গ্রহের মেয়ে
তোমায় আমি ফুটিয়ে তুলি ইচ্ছাশক্তি দিয়ে।
দেখতে কেমন, ভাষা কী তার, কেমন অবয়ব—
জড়বুদ্ধি জাহিল আমি, জানি না ওসব।
তার মন তৈরি রূপ তৈরি কেমন উপাদানে
কল্পভীরু এই কবি আর কীই-বা তার জানে!
জানি না তার অনুভূতি, আবেগ, স্বভাবগতি
স্রেফ অনুমানেই ফুটিয়ে তুলি, এমন প্রাণবতী!
ছায়াপথ ছাড়িয়ে, দূরের ওই সুরগঙ্গা, তারও ওইপারে, বহির্গোলকে,
শঙ্কু-আকৃতির এক মিটিমিটি আলো-জ্বলা ঘরে ব’সে
ভিন্ন ভুবনের মেয়ে তুমি
নির্নিমেষ চেয়ে আছ হে আমারই জানালার দিকে।
হৃদয়ের নেশা, এক আন্তর্জাগতিক নেশা…
একদিন ঘনিয়ে আসব ঠিকই দুইজনে, পরস্পরে।
তোমার আমার ঘনীভূত অভিকর্ষ দিয়ে
আস্তে-আস্তে বাঁকিয়ে ফেলব দেশকাল
দূর দুই জগতের মাঝখানে যে ব্যাকুল মহাশূন্য,
বেঁকে যাবে তা টানটান অশ্বক্ষুরাকার চুম্বকের মতো।
আলোকবর্ষের ওই মহাদূর দূরত্বই হয়ে যাবে
তুড়ি-মেরে-উড়িয়ে-দেওয়া ঘণ্টা কয়েকের পথ।
আর আমি ঠিকই সাঁতরে পাড়ি দেবো ওইটুকু মহাকাশ।
জ্যামিতির ছুড়ে-দেওয়া এক জেদি অথচ লাজুক স্পর্শকের মতো
তোমাকেই ছুঁয়ে ছুঁয়ে বয়ে যাব আমি
পৃথিবী নামের গ্রহ থেকে ছোটা হেমন্তদিনের হাওয়া।
তৃষ্ণা
তেতে-ওঠা বালুর ওপর দিয়ে হাহাকার করে ধেয়ে আসে
এক মরুসরীসৃপ, মুসাফিরের দিকে।
‘বিষ ঢালব না, ছিঁড়ে খাব না মাংস, শুধু একটু গলা ভেজাব রক্তরসে,
এমন ছাতিফাটা কহর তৃষ্ণায় প্রাণ যায়-যায়, এটুকু রহম করো হে বেদুইন’
ব’লে সেই গনগনে সরীসৃপ ঝাঁপ দিয়ে পড়ে বিদ্যুৎ গতিতে,
গোড়ালি কামড়ে ধরে রক্ত শুষে ভিজিয়ে নেয় জিহ্বা ও গলা,
তারপর নিমেষে উধাও, এক ক্ষমাহীন বিষুবীয় ক্রুদ্ধ মরীচিকার ভেতর।
দীক্ষা
পথ চলতে আলো লাগে। আমি অন্ধ, আমার লাগে না কিছু।
আমি বাঁশপাতার লণ্ঠন হালকা দোলাতে দোলাতে চলে যাব চীনে, জেনমঠে
কিংবা চীন-চীনান্ত পেরিয়ে আরো দূরের ভূগোলে।
ফুলে-ফুলে উথলে-ওঠা স্নিগ্ধ চেরিগাছের তলায় বসে মৌমাছির গুঞ্জন শুনব
নিষ্ঠ শ্রাবকের মতো, দেশনার ফাঁকে ফাঁকে।
মন পড়ে রইবে দূরদেশে। সাধুর বেতের বাড়ি পড়বে পিঠে,
দাগ ফুটবে সোনালু ফুলের মঞ্জরীর মতো শুদ্ধ সালংকার…
দীক্ষা নেব বটে মিতকথনের, কিন্তু
দিনে-দিনে হয়ে উঠব অমিতকথক,
নিরক্ষর হবার সাধনা করতে গিয়ে আমি হয়ে উঠব অক্ষরবহুল
এই হাসাহাসিভরা ভুঁড়িটি ভাসিয়ে গল্প বলে যাব
কখনো প্রেমের ফের কখনো ভাবের…
অথবা ধ্যানের, কিংবা নিবিড়-নিশীথে-ফোটা সুগভীরগন্ধা কোনো কামিনীফুলের।
ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ঝরবে মঠের মেঘলা আঙিনায়
ওদিকে অদূরে লালে-লাল-হয়ে-থাকা মাঠে পুড়তে থাকবে ঝাঁজালো মরিচ
সেই তথ্য এসে লাগবে ত্বকে ও ঝিল্লিতে।
আমি সেই মরিচ-পোড়ার গল্প বলব যখন–
ঝাঁজের ঝাপটায় উত্তেজিত হয়ে তেড়ে গিয়ে যুদ্ধে যাবে সবে, এমনকি বৃদ্ধরাও।
যখন প্রেমের গল্প– কমলায় রং ধরতে শুরু করবে সোনাঝরা নরম আলোয়।
আবার যখন গাইব সে-গন্ধকাহিনি, সেই ভেজা-ভেজা রাতজাগা কামিনীফুলের–
ঘ্রাণের উষ্ণতা লেগে গলতে থাকবে মধুফল দেহের ভেতর।
ব্লিজার্ড
আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত দাপিয়ে ফিরে
সমগ্র নীলিমা তছনছ করে দিয়ে
কোটি-কোটি দুষ্ট দাপুটে শিশু খেলছে হুলুস্থুল বালিশ ছোড়ার খেলা।
অজস্র কার্পাস ঝরছে
লক্ষকোটি বালিশফাটানো তোলপাড়-করা অফুরন্ত তুলা।
যেন তুলারাশির জবুথবু জাতক হয়ে পড়ে আছে ধীরা ধরিত্রী, বিব্রত বেসামাল।
সাথে উল্টাপাল্টা ঝাড়ি একটানা বেপরোয়া বাবুরাম পাগলা পবনের।
আবার কোত্থেকে এক নির্দন্ত পাগলিনীর আকাশ-চিরে-ফেলা ওলটপালট অট্টহাসি
মুহুর্মুহু অট্টালিকায় প্রতিহত হয়ে ছুটছে দিশাহারা দিগবিদিক
ঘরবাড়ি মিনার-ময়দান বাহন-বিপণী আড়ত-ইমারত গাছপালা বন বন্দর বিমান
সবকিছুর ওপর এলোপাথাড়ি থার্ড ডিগ্রি চালিয়ে বের করে আনছে
তুলকালাম গোপন তথ্য, তুলাজটিল শীৎকার।
তুমি, তোমার সরাইখানা এবং হারানো মানুষ
একটি দিকের দুয়ার থাকুক খোলা
যেইদিক থেকে হারানো মানুষ আসে।
রান্নাবাড়ার ঘ্রাণ পেয়ে পথভোলা
থামুক তোমার সরাইখানার পাশে।
আজও দেশে দেশে কত লোক অভিমানে
ঘর ছেড়ে একা কোথায় যে চলে যায়!
কী যাতনা বিষে…, কিংবা কীসের টানে
লোকগুলি আহা ঘরছুট হয়ে যায়!
এ-মধুদিবসে আকাশে বাতাসে জাগে
ঘর ছাড়বার একটানা প্ররোচনা।
হারিয়ে পড়তে নদী মাঠ বায়ু ডাকে
ঘরে ঘরে তাই গোপন উন্মাদনা।
জগতের যত সংসারছাড়া লোক
ঘুরে ফিরে শেষে সরাইখানায় স্থিত।
এ-স্নেহবর্ষে তুমি কি চাও যে, হোক
ঘরছাড়া ফের ঘরেই প্রতিষ্ঠিত?
হারানো মানুষ সেই কত কাল ধ’রে
স্বজনের ভয়ে দেশ থেকে দেশে ঘোরে।
স্বজনেরা তবু নানান বাহানা ক’রে
বৃথাই খুঁজছে কালে ও কালান্তরে!
স্বজন যখন খোঁজে উত্তরাপথে
হারানো তখন দাক্ষিণাত্যে যায়।
স্বজন যখন নিরাশাদ্বীপের পথে
হারানো খুঁজছে নতুন এক অধ্যায়।
স্বপ্নভূভাগ
এবার বলো হে ফিরতিপথের নাবিক,
ওহে মাথা-মুড়িয়ে-ফেলা ভিনদেশি কাপ্তান,
সেই দ্বীপের খবর বলো
যেইখানে মানিপ্ল্যান্ট ও সোলার প্ল্যান্টের পাতারা
একযোগে চিয়ার্স-ধ্বনি তুলে পাল্লা দিয়ে
পান করে রোদের শ্যাম্পেন।
কোন প্রজন্মের উদ্দেশে তাদের সেই স্বতঃস্বাস্থ্যপান?
সেই দ্বীপদেশের কথা বলো যেখানে নারীরা
সামান্য একটি কাঠের কুটিরে
ফুটিয়ে তোলে অন্তত বাষট্টি রকমের বাৎসল্য ও প্রীতি।
প্রীতিপরবশ সেই কুটিরের কথা বলো, সেই
একটানা মমতালোকের কথা বলে যাও হে কাপ্তান
যে-দেশে নিশুতি রাতে রাধিকাপুরের ঝিয়ারিরা
পথ চলে শিস দিয়ে, তুড়ি বাজাতে বাজাতে।
আর আশপাশের ঝোপঝাড় থেকে
তালে-তালে পাল্টা তুড়ি বাজিয়ে সাড়া দেয়
নবীন উলটকমলের চটপটে পাতা ও পল্লব।
এবং হঠাৎই, টাশ-টাশ করে কথা বলে ওঠে
তরুণী বনবিড়ালিনীর সদ্য-বোল-ফোটা কনিষ্ঠা মেয়েটি।
তাক লাগিয়ে দেয় দ্বীপদেশের অরণ্য অধ্যায়ে।
নাবিক, অবাক সেই ভূভাগের কথা বলো
যেখানকার মাটি উষ্ণ, অপত্যবৎসল,
যেখানে মানুষ সোজা মাটিতে শুয়ে প’ড়ে
শুষে নেয় অষ্টাঙ্গে ভূতাপশক্তি সঞ্জীবন…
দেহ ও মাটিতে যোগাযোগ হয় একদম সরাসরি,
সোজা ও সহজ।
আমরাও তো চলেছি উজানে।
চলছি তো চলছিই অনিঃশেষ
উত্তর পেরিয়ে আরো দূর উত্তরোত্তর অঞ্চলে…
উগ্র লোনা বাতাসের সোহাগে, লেহনে
বিকল হয়েছে আমাদের সেক্সট্যান্ট
মর্চে ধরেছে কম্পাসে, দুরবিনে।
চলেছি তবুও।
বহু প্রত্যাশার, বহু সাধ-সাধ্য-সাধনার যোগ্য
স্বপ্নভূভাগ কি এরকমই দূর ও দুর্গম, যোগাযোগাযোগ্য?
অলুক, অনশ্বর
তোমরা কারা? কতদূর থেকে এলে?
মনোহরপুর? মধুপ্রস্থ? লীলাস্থলী? অবাকনগর?
কোন যুগেরই-বা তোমরা?
উপলীয়? তাম্র? প্রত্ন? নাকি নুহের আমল?
যে যেখান থেকে যে-যুগ থেকেই আসো-না-কেন
একই জাহাজের যাত্রী আমরা এ অকূল মহাকাশে।
সহযাত্রী, এবং সমবয়সী।
তোমাদের বয়স প্রায় চৌদ্দ শ কোটি বছর, আমাদেরও তা-ই।
যে-যে কণিকায় গড়া দেহ তোমাদের, আমাদেরও তা-ই–
অমরতা চাও? চাও অন্তহীন পরমায়ু?
বিলাপ থামাও, শোনো, আমরা যে যখনই আসি
অমরতা নিয়েই আসি হে অমৃতের সন্তান—
অলুক, অব্যয়, অনশ্বর, চির-আয়ুষ্মান।
জরা ব্যাধি মন্বন্তর মহামারী অনাহার অত্যাচার গুম খুন দুর্বিপাক দুর্ঘটনা
কোনো কিছুতেই হবে না কিছুই, ধস নেই, মৃত্যু নেই,
ক্ষয়ে যাওয়া ঝরে যাওয়া নেই
শুধু বয়ে চলা আছে, রূপ থেকে রূপান্তরে,
রূপক থেকে ক্রমশ রূপকথায়…
জলে স্থলে মহাশূন্যে অগ্নিকুণ্ডে…কোত্থাও মরণ নাই তোর কোনোকালে…
সাড়ে চার শ কোটি বছরের পুরনো এক সজল সবুজ
কমলা আকারের মহাকাশযানে চড়ে
চলেছি সবাই এক অনন্ত সফরে।
প্রলাপবচন
নদ এসে উপগত হবে ফের নদীর ওপর
দুই পারে জমে উঠবে কপট কাদার ঘুটঘুটে কেলেংকারি
মাঝখানে চোরাঘূর্ণি চোরাস্রোত
এলোমেলো এলোমেলো বাউরি ভাবনা এসে
পাক খেয়ে ঢুকে পড়বে বৃষ থেকে মিথুনের অধিক্ষেত্রে।
মাকাল ফলের মৃদু মনস্তাপ
করলা-লতার শ্যামলা আক্ষেপ
কোকিলস্য প্রবঞ্চনা, কাকের বাসায় উপঢৌকন
ভরা বিলের ওপর দিয়ে ভেসে আসা ভেজা-ভেজা সুর
হুদহুদ পাখির অস্থিরতা, অসমাপিকার লঘু তঞ্চকতা
একরোখা অশ্বের অস্মিতা, উগ্রবসনা আগুনের চঞ্চল রসনা…
আলগোছে সবকিছু পাশ কেটে গিয়ে
ওইদিকে বর থাকবে কনের বশে
খলনায়কের দাঁতের নিচে পড়বে কট্টরপন্থী কাঁকর
চার্জ করা হবে পশ্চিমের ব্লাস্ট ফার্নেসে
আর ঝাপটা এসে লাগবে পূর্বেরটা থেকে
খামাখা দিওয়ানা হবে রঙিলা বিড়ালিনী
ঘনঘন গণ-হাইপ উঠবে মামুলি ঘটনা ঘিরে এমনি-এমনি
হিস্টিরিয়ায় কাঁপতে থাকবে দেশকাল
সাত সাধু এক হবে, এক শয়তান সাত
দোষযুক্ত আলু নামবে হিমাগারের শ্রোণিচক্র থেকে…
এবং হয়তো আমি একদিন ঠিকই
পড়ো-পড়ো ঘরকে যোগাতে পারব
গাঁট-অলা তিন-বাঁকা শালকাঠের সমর্থন
নিশ্চিহ্নকে দেখাতে পারব কিছু লুপ্তপ্রায় চিহ্নের ইশারা
বিশেষকে কোনো ভ্রান্তিকর নির্বিশেষের আভাস
বেদিশাকে দিশার বিভ্রম…
আর দুম করে লিখে ফেলব এমন এক কবিতা একদিন,
যা পড়ে ভৌতিক সুর তুলবে একসঙ্গে সাধু ও শয়তান
সাপ-আর-অভিশাপে-গড়া মতানৈক্যে-ভরা গামারিকাঠের গিটারে
আর ‘চলে আয়’ বলে স্বয়ং ঈশ্বর টুইট পাঠাবেন দিব্য টুইটারে।
মাসুদ খান
কবি, লেখক, অনুবাদক। জন্ম ২৯ মে ১৯৫৯, জয়পুরহাট জেলার ক্ষেতলালে। পৈতৃক নিবাস সিরাজগঞ্জ। প্রকৌশলবিদ্যায় স্নাতক, ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর। তড়িৎ ও ইলেকট্রন প্রকৌশলী। বর্তমানে কানাডায় বসবাস।
প্রকাশিত বই:
পাখিতীর্থদিনে (১৯৯৩, পুনঃপ্রকাশ ২০১৯)
নদীকূলে করি বাস (২০০১)
সরাইখানা ও হারানো মানুষ (২০০৬)
আঁধারতমা আলোকরূপে তোমায় আমি জানি (২০১১)
এই ধীর কমলাপ্রবণ সন্ধ্যায় (২০১৪)
দেহ-অতিরিক্ত জ্বর (২০১৫)
প্রজাপতি ও জংলি ফুলের উপাখ্যান (২০১৬)
প্রসন্ন দ্বীপদেশ (২০১৮)
গদ্যগুচ্ছ (২০১৮)
শ্রেষ্ঠ কবিতা (২০১৮)
পাখপাখালির গান পাগলাঝোরার তান (২০১৯)
ঊর্মিকুমার ঘাটে (২০২০)
বিভিন্ন আলোচক, বিশ্লেষক ও গবেষকের আলোচিত কিছু লেখা মন-মানচিত্রের পাঠকদের জন্য এখানে দেয়া হলো। আশা করি, নিম্নোক্ত লেখাগুলো কবি সম্পর্কে পাঠককে পরিষ্কার ধারণা দিতে সক্ষম হবে।
চঞ্চল আশরাফ
অর্থান্তরের ‘হাওয়া’
কবি মাত্রই তার জন্মার্জিত নশ্বরতার বিপরীতে দাঁড়াতে চান, তাঁকে চ্যালেঞ্জও করেন। এটা করতে গিয়ে প্রচলিত যে জীবন, তার ধারণাকেও তিনি উপেক্ষা করেন, আক্রমণ করতেও কুণ্ঠিত হন না। ফলে প্রচলিত জীবনের যা-কিছু, বোধ, শব্দ, তার অর্থ, রুচি, অভিব্যক্তি সবই তিনি ডিঙিয়ে যেতে চান। এই চাওয়া, তার সাধনাই কবির নিজস্ব পৃথিবী নির্মাণের অপরিহার্য শর্ত।
মাসুদ খানও যে সেই শর্তের অনুগামী, তা বারবার প্রমাণিত। তাঁর কোনো কোনো কবিতা এই মন্তব্যের উজ্জ্বল বাহক হয়ে আছে। তারই একটি হলো ‘হাওয়া’—নদীকূলে করি বাস কাব্যগ্রন্থের কবিতা এটি। কবিতাটি শুরু হয়েছে এই লাইন দিয়ে : সারাদিন বিভিন্ন রকম হাওয়া বয়। হাওয়া!—এই উচ্চারণেই আভিধানিক অর্থজগৎ থেকে ‘হাওয়া’র মুক্তি ঘটে। এই মুক্তিতেই কবির উদ্যম নিঃশেষিত হলে চলে না। শব্দটির সঙ্গে এমন এক জগৎকে জড়িয়ে নিতে হয়, সেখানে যেন সেটি উল্লেখমাত্র হারিয়ে না যায়। ফলে কবির কাজ হয়ে দাঁড়ায় শব্দটির অর্থের পর অর্থ সৃষ্টি করা। এই অর্থান্তরের মেলায় গড়ে ওঠে অন্যতর জগৎ। ও তার সৌন্দর্য। হাওয়া শব্দটির অর্থের পর অর্থ সৃষ্টি করেছেন মাসুদ খান, তাতে গড়ে উঠেছে অন্যতর জগৎ। ‘অনেক দূরের দেহে, দূর মেরুরেখায় শোষিত হয়ে হয়ে/ আজ পুনর্মুক্ত হচ্ছে এখানে, এখন/ এই মধ্যপ্রকাশ অঞ্চলে।’ হাওয়ার একটা অঞ্চলে পুনর্মুক্ত হওয়ার চিন্তা মামুলি বা সাধারণ কিছু নয়, হাওয়ার যে অর্থ প্রচলিত, তাতে এই ভাবনা সঙ্গত নয়। কিন্তু এটা তো অর্থান্তরের উপক্রমণিকা, কেননা ‘গোলকের ওই পার থেকে’ হাওয়া এসে ‘প্রতিটি বিভাগ আর দিবস-রাত্রির দেহে দেহে / স্থির হয়ে আছে।’ এখানে অর্থান্তরের পূর্ণতা ঘটল।
হাওয়ার ‘স্থির হয়ে’ থাকার পর, কেবল নতুন অর্থ সৃষ্টিতেই সন্তুষ্ট নন কবি। তিনি শব্দটি পরের স্তবকে উচ্চারণ করেন না—সে-জায়গায় দু’টি বিশেষণসমেত ব্যবহার করেন বিকল্প শব্দ—‘একদিন সম্ভবত অস্থির অচেনা এক বায়ুপ্রবাহের/ মধ্যেই মুদ্রিত হয়ে রবো’। এখানে নিজেকে সংশ্লিষ্ট করা হয়েছে সংশয়বাচক ‘সম্ভবত’ দিয়ে আর ‘হাওয়া’ হয়ে উঠল বায়ুপ্রবাহ, তাতে ‘মুদ্রিত’ হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় ভবিষ্যৎবাচক ‘রবো’ ক্রিয়াপদটি আমাদের দূর-পূর্বসূরিদের ব্যবহার-করা; কিন্তু মাসুদ খানের এই কবিতায় বেশ মানিয়ে গেছে। শেষ অনুচ্ছেদের শেষাংশটুকু এই:
রকমারি রৌদ্র আর মরুবালুকার মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া গৌণ সংবাদের মতো
বায়ু বয়ে যায়।
মৃদু-মৃদু, গম্ভীর, বিশিষ্ট ভাবমূর্তি সহকারে।
উল্লেখ বাহুল্য নয়, পূর্ববর্তী অনুচ্ছেদে ‘বায়ুপ্রবাহের/ মধ্যেই মুদ্রিত’ হয়ে থাকবার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশের পর যখন কবি উচ্চারণ করেন : ‘তার বেশ আগে/ আমাদের অসম্পূর্ণ রেখে,/ আমাদেরকে অশেষ করে দিয়ে বায়ু বয়ে যায়’—তখন কালের প্রচলিত ধারণাটির নস্যাৎ হয়ে যায়। অভিধানের অর্থ থেকে শব্দকে মুক্ত করার পর তা উচ্চারণের জন্য এমন এক ভাষাপৃথিবী গড়ে তুলতে হয় কবিকে, যা প্রচলিত ভাবনা, তার প্রক্রিয়া আর উপাদানের সমস্ত ইউনিটকে আমূল বদলে দেয়। এখানেও ঘটেছে তা-ই। কিন্তু মাসুদ খান এক্ষেত্রে সম্ভবত এক ধরনের রফা করেছেন। তিনি যখন উচ্চারণ করেন—‘আমাদের অসম্পূর্ণ রেখে’ তখন এটা মনে হতে পারে মানুষের জীবনের অসম্পূর্ণতা সম্পর্কিত ধারণাটিকে মান্য করছেন। এই কথাটির দরকার আছে। কেননা, এতে কবির ভাষাপৃথিবীর সঙ্গে প্রচলিত ভাষাকাঠামোর ঘটকালির কাজটুকু হয়ে যায়। এটুকু না হলে, কবিতা প্রলাপে পরিণত হয়। এবং যখন বলা হচ্ছে ‘নদীকূলে বংশপরম্পরাক্রমে, আমার পুত্রের, তার পুত্রের, এবং দৌহিত্রের/ বহু চুল এলোমেলো করে দিয়ে’ ‘বায়ু বয়ে যায়’—আমরা বায়ুর পরিচিত অর্থের জগতে প্রবেশ করি। সেই জায়গা থেকে কবি আবার শেষে পাঠকের পরিচিত পরীক্ষা ও জিজ্ঞাসার মুখে ফেলে দেন ‘বিশিষ্ট, গম্ভীর, ভাবমূর্তি সহকারে’ বায়ুর বয়ে যাওয়ার কথা বলে। ব্যক্তিত্ব আরোপের মধ্য দিয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত অর্থান্তরের খেলায় পাঠকের স্নায়ুকে সক্রিয় রাখতে চান। মাসুদ খানের এই অর্থান্তর-খেলার প্রতিপক্ষ প্রচলিত পৃথিবী, তার অনুষঙ্গে প্রচলিত, বিবর্ণ আর একঘেয়ে অর্থরাশি।
মাসুদ খানের কবিতাঃ আবেগে ও প্রজ্ঞায়
মোহাম্মদ নূরল হক
প্রজ্ঞার শাসন ও আবেগের সংহতি—এই দুয়ের সম্মিলনে যাঁদের কবিতা রচিত, তাঁদের একজন মাসুদ খান। রাজনৈতিক বন্ধ্যাত্ব, সামরিক শাসন ও স্লোগান সর্বস্ব কবিতা রচনার কালে এই কবির আবির্ভাব ও বিকাশ। প্রেমে-দ্রোহ-বিজ্ঞান-ভূগোল-ইতিহাসচেতনা-সভ্যতা-দর্শন-ধর্মের নানা অনুষঙ্গে তাঁর কবিতার ভরকেন্দ্র রচিত। এতে তাঁর কবিতা হয়েছে হৃদয়সংবেদী, আবেগে মথিত।
মাসুদ খান শব্দে-চিত্রকল্পে-উপমায়-উৎপ্রেক্ষায় আপন অনুভূতির অনুবাদ করেন। সেখানে উপকরণ হিসেবে যুক্ত হয় তাঁর অভিজ্ঞতার সঙ্গে অবিকল্প ও অনিবার্য কল্পনা। কারণ, তিনি কবিতায় ছাপ রাখেন কল্পনার মৌলিকত্বের, অভিজ্ঞতার বৈচিত্র্যের। ফলে বাস্তব ও কল্পনার সংমিশ্রণে জেগে ওঠে এক পরাবাস্তব ভুবন। যেখানে কল্পনা ও বাস্তবের ভেদরেখা প্রায়ই ঘুচে যায়। এর সঙ্গে তিনি যুক্ত করেন তাঁর সময় ও মনীষার ছাপ। নিজের সময়কে আত্মস্থ করে, সময়ের ভেতর দাঁড়িয়েও নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করেন তিনি। এভাবে তাৎক্ষণিক সংঘটিত ঘটনার প্রতিবেদন রচনা না করে, ঘটনার অভিঘাতসৃষ্ট প্রতিক্রিয়াকে দেন শিল্পিত মহিমা। করে তোলেন কবিতার পঙ্ক্তি। এ কাজটি করতে গিয়ে কল্পনা ও অভিজ্ঞতার সুষম বিন্যাসে দিকে মনোনিবেশ করেন।
কেবল কল্পনা ও অভিজ্ঞতার সুষম বিন্যাসেই নয়, এর সঙ্গে মাসুদ খান যুক্ত করেন সমাজ-রাষ্ট্র-ধর্ম-দর্শনের সত্যও। সামাজিক দায় অনুভবের ছাপ পড়ে তাঁর কবিতায়। ব্যক্তির সমষ্টি হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে ওঠে নভমণ্ডল, বিশ্বচরাচর। একইসঙ্গে সূর্যটাকেও তিনি বুড়িয়ে যেতে দেখেন। তিনি কবিতাকে নিত্যপ্রয়োজনীয় বিষয়ের বিকল্প করে তোলেন না, আবার বিলাসিতাঁর উপাচারেও পর্যবসিত করেন না। একটি রাষ্ট্রের নাগরিক, সরকার ও এর ভৌত-অবকাঠামোর মতো কবিতাকে তিনি করে তোলেন জীবনের সামগ্রিক রূপ-রস-গন্ধ-প্রাণময় সার্বভৌম প্রপঞ্চ।
তাঁর কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ:
ক. সময়কে আত্মস্থ করেও সময়-উত্তর চিত্র আঁকা
খ. রাজনীতি-সমাজনীতি, ধর্ম-দর্শন, ইতিহাস-সভ্যতা, মিথ-ঐতিহ্যের সম্মিলন
গ. প্রতীক-রূপক-উপমা আশ্রয়ী চিত্রকল্পের ব্যবহার
ঘ. ছন্দের বিচিত্র প্রয়োগ
উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো সব কবিতায় সমান হারে যেমন নেই, তেমনি সব বৈশিষ্ট্যই সমান গুরুত্বে স্থান পায়নি। মাসুদ খান বিষয়বস্তুর পাশাপাশি প্রকরণকেও সমান গুরুত্ব দেন। বিষয়স্তু অনুযায়ী ছন্দ-আঙ্গিক ঠিক করেন। এমনকি শব্দ গঠন-নির্বাচন-প্রয়োগেও তিনি বিশেষ কৌশলের আশ্রয় নেন।
বিশেষ করে বিষয় নির্বাচনে তিনি সতর্ক। বিচিত্র তাঁর বিষয়। কেবল প্রথাগত নারীপ্রেম, প্রকৃতিপ্রেমেই তিনি নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেন না, ছড়িয়ে দেন দেশ-বিশ্বপ্রেম ও ভূগোলের দিকেও। নিছক নারীপ্রেমকে উজিয়ে প্রকৃতি-নিসর্গ ও জনপদের প্রেমেও পড়েন তিনি। বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের গুরুত্বপূর্ণ-অগুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন জনপদের কথাও। আবার ওইসব জনপদের মধ্যে দেখা-অদেখার ভেদ রাখেন না। তিনি জানেন, অদেখার প্রতি মানবমনের আকর্ষণ প্রবল এবং তা সুপ্রাচীন; চিরন্তনও। যা মানুষ কখনো দেখেনি এবং যেখানে সে কখনো যায়নি তাকে জানার ও দেখার এক ধরনের অদম্য স্পৃহা তার চিত্তকে সর্বদা চঞ্চল করে রাখে।একই স্বভাব কবি কিংবা শিল্পীকেও ব্যস্ত রাখে। মাসুদ খান ‘কুড়িগ্রাম’ কবিতায় মানবস্বভাবের সে অমোঘ বৈশিষ্ট্যই এঁকেছেন। বলেছেন, ‘কোনোদিন আমি যাইনি কুড়িগ্রাম।’ অথচ এরপরই বর্ণনা করেছেন ওই জনপদের ভূ-প্রকৃতি, নিসর্গ, মানবচাঞ্চল্য থেকে শুরু করে এর সম্পর্কিত চরাচরের সমস্ত দৃশ্য-ঘটনাও।
কোনোদিন আমি যাইনি কুড়িগ্রাম।
রাত গভীর হলে আমাদের এই প্রচলিত ভূপৃষ্ঠ থেকে
ঘুমন্ত কুড়িগ্রাম ধীরে ধীরে আলগা হয়ে যায়।
অগ্রাহ্য করে সকল মাধ্যকর্ষণ।
তাঁরপর তাঁর ছোট রাজ্যপাট নিয়ে উড়ে উড়ে
চলে যায় দূর শূন্যলোকে।
আমরা তখন দেখি বসে বসে আকাশ কত-না নীল
ছোট গ্রাম আরো ছোট হয়ে যায় আকাশের মুখে তিল।
অনেকক্ষণ একা-একা ভাসে নিখিল নভোভারতের রাজ্যে রাজ্যে।
(কুড়িগ্রাম)
আবার ‘চেরাগজন্ম’ কবিতায় তিনি দেখেন, ‘বাতাসে ভাসিয়া যায় বহু ব্যঞ্জনধ্বনি, ঘ্রাণ আর/ প্রলাপবিলাপবিকিরণ, নিরুদ্ধার, যুগের যুগের। /লণ্ঠন তুলে ধরো চারণপুত্র।’ জাগরণমূলক চেতনায় কবি উজ্জীবিত। কোনো পদপ্রদর্শককে বোধ করি কর্তব্যকর্মে সচেতন হওয়ার আহ্ব্বান জানান। বলেন, তুমি তোমার আলোকস্বভাব দিয়ে মানবজন্মের উপকার করো। না হলে তোমার এই জীবন অনর্থক। নাহলে, ‘চারণ, তোমার চেরাগ জন্ম বৃথা যায়, যায়।’ এখানে ‘চেরাগ’ কেরোসিনের কুপি। কিন্তু এই চেরাগ আলোকবর্তিকারই প্রতীক। কবি চেরাগ প্রতীকের আশ্রয়ে সমাজের অগ্রসর চিন্তাঁর তরুণদের আপন-আপন কর্তব্যে ব্রত হওয়ার প্রেরণা দেন। তিনি বলতে চান, এই জ্ঞানদীপ্ত তরুণদের সামনে এখন ঘোর অন্ধকার নেমে আসতে পারে। কিন্তু সে অন্ধকার দেখে, ঘাবড়ে গেলে চলবে না। অন্ধকারকে দূর করতে হবে এই চেরাগরূপী তরুণদেরই্। নাহলে তাদের চেরাগ জনমই বৃথা।
আগেই ইঙ্গিত দিয়েছি, বিষয় নির্বাচনে মাসুদ খান নির্বিচারী নাহলেও বিচিত্রমুখী। নারী-প্রকৃতি থেকে শুরু করে সাংসারিক নিত্য-অনিত্য অনেক অনুষঙ্গই তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে। চরাচরে সংঘটিত ঘটনাপুঞ্জের অভিঘাত শিল্পীকে আলোড়িত করে, শিল্পী সঙ্গে সঙ্গে তাতে সাড়া দেন না। কিংবা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন না। এরজন্য তিনি কিছুটা সময় নেন। যতক্ষণ পর্যন্ত বিষয়টা আত্মস্থ করতে তাঁর সময় প্রয়োজন, ততক্ষণ। এরপরই তিনি সে বিষয়টিকে শিল্পে রূপ দেন। সেটা হতে পারে শব্দে, হতে পারে রঙে-রেখায়। এক্ষেত্রে নারী, প্রেম, প্রকৃতির কোনো বিশেষ মুহূর্তের মুগ্ধতার চিত্রায়ন আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এরই আলোকে মাসুদ খানের দুটি কবিতার প্রসঙ্গ আসতে পারে। একটি ‘একজন বর্ণদাসী ও একজন বিপিনবিহারী সমাচার’ অন্যটি ‘বহুদিন পর আবার প্রেমের কবিতা’।
ক.
বনের কিনারে বাস, ছিল এক রূপবর্ণদাসী
আর ছিল বনে বনে একা ঘোরে সেই এক বিপিনবিহারী।
অসবর্ণ তাঁরা, অসমান, অসবংশের জাতক
একসঙ্গে তবু দোঁহে একই বুনো বাদলে স্নাতক।
তবু সেতু গড়ে ওঠে সন্ধ্যাকালে দূর দুই তটে
সেতু, দেহকথনের গোধূলিভাষ্যে তা ফুটে ওঠে।
(একজন বর্ণদাসী ও একজন বিপিনবিহারী সমাচার)খ.
দূর মহাকাশে
ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফুটে আছে কত ফুয়েল-স্টেশন–
সেইসব এলোমেলো নৈশ নকশার মধ্যে তাকে, প্রিয় তোমাকেই,
ঘোর মধ্যরাতে
এইভাবে দেখে ফেলি আমিও প্রথম।
সর্ববায়ু আমার সুস্থির হয়ে যায়।
(বহুদিন পর আবার প্রেমের কবিতা)
‘একজন বর্ণদাসী ও একজন বিপিনবিহারী সমাচার’ কবিতায় কবি একজন নিম্নবর্গীয় এক রমণীকে দেখে মু্গ্ধতা প্রকাশ করেছেন। বর্ণনা করেছেন তাদের বাসস্থানের করুণ দৃশ্য। বলেছেন এরপরও তার রূপযৌবন ঠিকরে পড়ছে। এই দৃশ্যকল্প কবিকে মোহিত করে, আর তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নেয় সেই মুগ্ধতার কথা। এদিকে, ‘বহুদিন পর আবার প্রেমের কবিতা’টির শিরোনামে প্রেমের প্রসঙ্গ থাকলেও, এটি কেবল প্রথাগত প্রেমেই সীমাবদ্ধ নেই। এতে যুক্ত হয়েছে, মহাবিশ্বের নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, সংঘর্ষের ঘাত-প্রতিঘাতও। কবি আবিষ্কার করেন, ‘দূর মহাকাশে/ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফুটে আছে কত ফুয়েল-স্টেশন।’ আর সেখানে ‘এলোমেলো নৈশ নকশার মধ্যে তাকে, প্রিয় তোমাকেই,/ ঘোর মধ্যরাতে/এইভাবে দেখে ফেলি আমিও প্রথম।/সর্ববায়ু আমার সুস্থির হয়ে যায়।’ বিজ্ঞান-দর্শন এসে এখানে প্রেমে একাকার হয়ে যায়। দীর্ঘ এক কবিতায় মাসুদ খান চরাচরের বিভিন্ন অনুষঙ্গ তুলে এনেছেন, কখনো প্রেমের অনুষঙ্গে, কখনো ব্যবহারিক জীবনের অনুষঙ্গে। তিনি বাতাসকে দেখেন বিব্রত হতে, আর ‘আদিগন্ত কুয়াশা-মোড়ানো সেই তৎকালীন রৌদ্রের মধ্যেই’ ‘গোলকেরই এক অপূর্ব রূপ’ আবিষ্কার করেন। আর সবশেষে এসে বলেন, ‘তোমার সাহিত্যে দ্যাখো এভাবে আমার বেলা বয়ে যায়।’ এই শেষ পঙ্ক্তি উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাঠকের বোধে নাড়া দেয়, এই তুমি তাহলে কোনো নারী নয়? তাহলে কে সে? এই তুমি আসলে কবির আরাধ্য পরাবাস্তব এক সত্তা। যার সন্ধানে চলেছেন তিনি, সেই সত্তা-ই এই তুমি। আর তারই সাহিত্যে এভাবে তাঁর বেলা বয়ে যায়। ‘মৌমাছি’ মূলত প্রতীক-রূপক আশ্রয়ী কবিতা। ‘মৌমাছি’র আড়ালে মূলত অস্তিত্ববাদের চিত্র আঁকা হয়েছে। যার কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ড নেই, আশ্রয় নেই, তবু বেঁচে থাকার, তবু টিকে থাকার রয়েছে দুর্মর বাসনা। কখনো রূপ-স্বভাবের রূপান্তরের ভেতর দিয়েও সে টিকতে থাকতে চায়। স্বভাবে বণিক হলেও শেষ পর্যন্ত অস্তিত্ব সংকটের চিন্তা তাকে বিপর্যস্ত করে তোলে। ফলে সে বেঁচে থাকার তাড়নায় বিনির্মিাণ বিবর্তনেও আস্থা রাখতে চায়। অর্থাৎ মানুষের যত রূপ-বৈচিত্র্যই থাকুক, সে শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকার জন্যই আপ্রাণ চেষ্টা করে। এবং এটাই তাঁর স্বভাবের মূল বৈশিষ্ট্য। এবং বলে, ‘ডাকি পূর্ণনাশ, ভাঙি বিনির্মাণ, চুম্বকীয় ঝড়ে/কোলাহল থেকে দূরে, হলাহলে, অস্থির প্রহরে।’
বিষয়বস্তু অনুযায়ী অলঙ্কার প্রয়োগে মাসুদ খান সতর্ক। উপমা-চিত্রকল্প-প্রতীক-রূপক-অনুপ্রাসেও তিনি স্বচ্ছন্দ্য। চিত্রকল্প নির্মাণের ক্ষেত্রে তিনি উপমা-প্রতীক-রূপককে গুরুত্ব দেন। এ কারণে প্রতীক-উপমা আশ্রয়ী চিত্রকল্প তাঁর কবিতায় বেশি পরিলক্ষিত হয়। বিষয় ও অলঙ্কার হিসেবে তাঁর একটি প্রিয় অনুষঙ্গ প্রজাপতি। এটি কখনো প্রতীক, কখনো রূপক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। `প্রজাপতি’ শব্দের প্রয়োগে তিনি বেশ কুশলী। প্রজাপতি প্রতীকের আড়ালে প্রাণচাঞ্চল্য-রঙের বিচিত্র ব্যবহারকে যেমন গুরুত্ব দেন, তেমনি মানবসমাজের বহুবর্ণিল, বর্ণচোরা স্বভাবকেও প্রকাশ করেন। এ কারণে ‘প্রজাপতি’ শব্দটি এর বাগর্থকে অতিক্রম করে, একাধিক ব্যঞ্জনার্থ ধারণ করে।
যেমন—
ক.
প্রজাদের ঋতুরক্ত রেণুকায়
ভূগোল ভিজতে থাকে
সীমানাবিলাস ভণ্ডুল হয়ে যায়।
এমন জননদিনে কোথায় রইলে প্রজাপতি?
(প্রজাপতি)খ.
কাগুজে তাসের গায়ে আঁকা বহুবর্ণ রাজা
রাজ্য আর রাজত্বের পরমার্থ তিনি, প্রজাপতি,
প্রজাদের পরি, ফুরফুরে রূপকে ও রহস্যে রঙিন।
(প্রজা, প্রজাপতি, চোর ও যম)গ.
শুধু মননেই, শুধু দর্শন বা স্পর্শনেই, এমনকি স্রেফ
হাঁচিতেও হয়েছে সম্ভব, আগে জীবের জনম
তাঁরপর কী মায়া লাগালে প্রজাপতি, আহা কী লীলা লীলালে-মিথুনে মৈথুনে অবলীলাক্রমে জীবের সৃজন
ঔরসে গর্ভের কোষে কিমাশ্চার্য রসায়ন।
(সংসার)
উদাহরণ আরও বিস্তৃত করা যাবে। কিন্তু সে উদাহরণ কেবল একটি বিষয়কেই প্রতিপন্ন করবে, তাহলো মাসুদ খান একটি বিষয়কে নানাভাবে প্রকাশ করার চেষ্টা করেন। একইসঙ্গে একটি প্রতীক সৃষ্টি করেন, যে প্রতীকের সাহায্যে তিনি সমাজ, সংসার, ব্যক্তি, দর্শন ও ধর্মকে প্রকাশ করেন।
মাসুদ খান কবিতায় বলার চেষ্টা করেন, তিনি সভ্যতা দর্শক মাত্র নন, নিবিড় পর্যবেক্ষকও। তাই মানুষ, সভ্যতা, ইতিহাস, নদী, মৌমাছি, দেশ-রাষ্ট্র, রাজনীতির প্রচল সংজ্ঞার্থ হাজির করেন। একইসঙ্গে এসব সংজ্ঞার্থকে কখনো কখনো ইঙ্গিতপূর্ণ, কখনো কখনো সাংকেতিক করে তোলেন। মাঝেমাঝে করে তোলেন সব্যাখ্যেয়। এরই অংশ হিসেবে তিনি সমাজ, সমাজপতি, রাজনীতির পাশাপাশি দর্শন ও আধ্যাত্ম চেতনাকেও কবিতার অনুষঙ্গ করে তোলেন। জাগতিক-বৈষয়িক লাভালাভ, ক্রোধ, হিংসা, লোভ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুচিন্তা ও দর্শনকেও গুরুত্ব দিয়েছেন। এরই আলোকে তিনি স্বসমাজ ও স্বকালের চিত্র এঁকেছেন। কিন্তু সে সময়ের মধ্যে নিজে আবদ্ধ থাকেননি। কারণ তিনি জানেন, ‘মানব সমাজে রাজনৈতিক চিন্তাধারার পরিবর্তন অনবরত ঘটে, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আসে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে শিল্পক্ষেত্রে কোনো বৃহৎ পরিবর্তন আসে না। উপস্থিতকালে জীবিত বুদ্ধিজীবীরা সবাই ভাবেন যে, রাজনীতির পরিবর্তন মানুষের চিন্তাঁর রাজ্যেও বিরাট পরিবর্তনের সূচনা করে। পরিবর্তন হয়তো আসে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই আসে না।’ (আধুনিক বাংলা কবিতা, শব্দের অনুষঙ্গে: সৈয়দ আলী আহসান)। তাই মাসুদ খানও সময়কে অতিবাহিত হতে দেন। নিজে কেবল পর্যবেক্ষণ করেন সময়ের রাজনীতি, অর্থনৈতিক স্রোতধারা। তিনি দেখেন ‘আজ এই পাখিতীর্থদিনে, খোলা জানালাদিবসে/ নিদারুণ এ অশনবনের ক্লেশ।/ দাউদাউ দুর্ভিক্ষের সামনে হা-দাঁড়ানো হতভম্ব মিকাইল।’ যার হাতে কাঁপতে থাকে ‘ভিক্ষামাপনযন্ত্র’। এভাবে চিত্রকল্প ও প্রতীকের আড়ালে তিনি সভ্যতাঁর ক্ষয়িষ্ণু একটি ছবি আঁকেন। কিন্তু কোথাও তিনি স্পষ্ট করে বলেন না তা। ঘটনা-চিত্রকল্প বর্ণনার পর বর্ণনা করে যান। এভাবে অনেকগুলো চিত্রের কোলাজ করে তিনি দেখান, সভ্যতার বর্তমান অবস্থান কোথায়।
তাঁর কবিতায় সমান গুরুত্বে স্থান পেয়েছে মিথ ও পুরান। কখনো কখনো দর্শন-আধ্যাত্ম্যচেতনা ও মিথপুরাণের ভেদরেখা মুছে যায়। বৈশ্যদের কাল কবিতায় এমনই একটি চিত্র আঁকা হয়েছে। যেখানে আবহমান বাংলার লোকবিশ্বাসের সঙ্গে বিজ্ঞানের সত্যকে এক করে দেখার বর্ণনা রয়েছে। গ্রামীণ জনপদের বিশ্বাসকে আশ্রয় করে কবি দেখিয়েছেন বাস্তবে মানুষ যা দেখে, তা ঘটনা হিসেবে সত্য, কিন্তু মানুষ সবসময় সঠিক ঘটনার স্বরূপ শনাক্ত করতে পারে না। তাই এক ঘটনাকে অন্য ঘটনা হিসেবে মেনে নেয়, কখনো কখনো প্রচারও করে। অপবিশ্বাস-লোকবিশ্বাসকে জানে সত্য হিসেবে, বৈজ্ঞানিক সত্যকে জানে ভৌতিক সত্য হিসেবে। ফাঁকিটা এখানে। এরকম একটি বহুল ঘটিত-পরিচিত ঘটনা হলো, অন্ধকার রাতে ফসলের ক্ষেতের আগাছা কিংবা স্তূপিকৃত আবর্জনা থেকে মিথেন গ্যাসের আলো। ওই আলোকে গ্রামের সাধারণ মানুষ ভূতের আলো হিসেবে জানে এবং প্রচারও করে। অনেকেই তাতেই আস্থা রাখে। আর এই অপবিশ্বাসের সুযোগ নেন সমাজের ধূর্তরা। কবি এই দৃশ্যটাই বর্ণনা করেন এভাবে:
ওইখানে হইহই রইরই পঞ্চকাণ্ড মেলা সে তো
হাজার বর্ষ আগে
আজ শুধু একজোড়া নিরিবিলি জলমগ্ন বৃক্ষ বাস করে।
দূরে ওই বৃক্ষমিথুনের থেকে, থেকে-থেকে মিথেন জ্বলে উঠলেই
ছেলেরা ও মেয়েরা একালে বলে ওঠে, ওই যে ভূতের আলো দেখা যায়।নীল-নীল আলো দেয় ছেলেটির শরীর অশরীর।
(বৈশ্যদের কাল)
পুরো কবিতাটি গ্রামীণ বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট মিথআশ্রয়ী চিত্রকল্পপূর্ণ। মিথটা এমন, কোনো এককালে কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে কেউ একজন মারা যান। তারপর কেটে যায় হাজার বছর। একসময় সেখানে অন্ধকার রাতে আবর্জনা থেকে সৃষ্ট মিথেনের আলো জ্বলে। লোকে ভাবে হাজার বছর আগে মৃত ’মুখ দিয়ে অবিরল তেজ বের হয়ে’ ভূ-খণ্ড ভাসানো ওই ছেলেটার শরীর ও আত্মা থেকেই ওই আলো জ্বলে।
এমন মিথ-আধ্যাত্ম্যসংকটের মিশ্রণে রচিত আরেকটি কবিতা ‘কবরের উপকথা’। এই কবিতায় মাসুদ খান দেখিয়েছেন, মানুষ যতই স্বপ্নচারী হোক, শেষপর্যন্ত তাকে আধ্যাত্ম্যচেতনা বিচলিত করে। মৃত্যুচিন্তা ও মৃত্যুর পূর্ববর্তী নানা অনুষঙ্গ তাকে বিপর্যস্ত করে তোলে। তাকে ভাবতে বাধ্য করে, অন্তিম মুহূর্তের কথা, মৃত্যুপরবর্তী পরিণতির কথাও। আর এভাবনা সাধারণত ব্যক্তির স্ব-স্ব সমাজ ও স্বধর্মের রীতি অনুযায়ীই হয়। এক্ষেত্রে দশ জন সাধারণ মানুষের সঙ্গে শিল্পী কিংবা কবিরও মিল রয়েছে। ‘কবরের উপকথা’য় এমন বিশ্বাস ও আচরণের বর্ণনা দিয়েছেন কবি। ‘কবরের উপকথা’র মতো ‘তুমি, তোমার সরাইখানা এবং হারানো মানুষ’ও আত্মজিজ্ঞাসাজারিত রচনা, তবে এ কবিতায় মৃত্যুচেতনা নেই। এর পরিবর্তে যুক্ত হয়েছে আত্ম-অন্বেষণের নতুন উদ্যোগ-উদ্বেগ।
একটি দিকের দুয়ার থাকুক খোলা
যেইদিক থেকে হারানো মানুষ আসে।
মাংস-কষার ঘ্রাণ পেয়ে পথভোলা
থামুক তোমার সরাইখানার পাশে।আজও দেশে দেশে কত লোক অভিমানে
ঘর ছেড়ে একা কোথায় যে চলে যায়!
কী যাতনা বিষে…, কিংবা কীসের টানে
লোকগুলি আহা ঘরছাড়া হয়ে যায়!
(তুমি, তোমার সরাইখানা এবং হারানো মানুষ)
কবি কামনা করেন ‘একটি দিকের দুয়ার থাকুক খোলা/ যেইদিন থেকে হারানো মানুষ আসে।’ এরপরই কবি বলছেন, মানুষ নানা কারনে গৃহত্যাগী হয়। একইসঙ্গে তারা সর্বস্বত্যাগীও হয়। আবার একসময় অভিমান ভুলে প্রত্যাবর্তনও করে। কিন্তু সে প্রত্যাবর্তন তার জন্য সবসময় সুখকর নাও হতে পারে। হারানো গৃহ আর নাও ফিরে পেতে পারে। সে অনেক ‘না’ যুক্ত ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষের জন্য সরাইখানা হোক বিশ্রামস্থল। অর্থাৎ মানুসের খোঁজা অন্তহীন। মানুষ যা খোঁজে তা অনেক সময় তার ভেতরেই বাস করে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চিনতে পারে না তাঁরা। তাই পেয়েও হারিয়ে পেলে। তাই ‘বৃথাই খুঁজছে কালে ও কালান্তরে।’ তবে তাতেও সম্ভাবনার দ্বার দেখা যায়। সেখানেও নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে পারে। লক্ষণীয় যে, ‘কবরের উপকথা’য় যতটা পরিণতিবাদী মাসুদ খান, ‘তুমি, তোমার সরাইখানা এবং হারানো মানুষ’ কবিতায় ঠিক ততটাই আশাবাদী।
ক.
তার কবিতার বিষয় বিচিত্রমুখী। আবেগ প্রকাশে তিনি নিয়ন্ত্রিত, চিন্তায় । কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক—
দশটিপথ এসে যেখানটায় কাটাকাটি হয়ে চলে গেছে দশ দিগন্তের দিকে, সেইখানটায় গিয়ে বসে থাকেন আমার মা। পথের ধারে বসে মা আমার মানুষ দ্যাখেন, মানুষের আসা-যাওয়া দ্যাখেন। কোনো পথ দিয়ে আসে হারিয়ে যাওয়া মানুষেরা। কোনো পথ দিয়ে আসে গ্রহণ-লাগা, ক্ষয়ে-যাওয়া, নিভু-নিভু সব বনি-আদমের দল। আবার মেঘ ও মিথুনরাশির ছায়ায় তুমুলভাবে বাঁচতে থাকা মানব-মানবীদের যাতায়াত কোনো কোনো পথে।
(ছক)খ.
হঠাৎ মায়ের স্তন্য থেকে, আজই, উৎখাত হয়েছে শিশু
ঘুরে ফিরে বারে বারে যায় তবু মায়ের নিকট
বকা খায়, কিছুটা অবাক হয়, তবু শিশু যায়…অবুঝ কী আর বোঝে কী-বা অর্থ হয় এই উৎখাতলীলার!
(প্রত্যাখ্যান)গ.
উদগান।
এই উদগান সখার উদ্দেশে।অদেখা অচেনা এক সখার জন্যে আকাঙক্ষা–
যে রঙিন। যে বহুদূর।
দূর কোনো অজানায় যার অবস্থান।
(সখাসংগীত)ঘ.
অদিনে অক্ষণে এসেছ ভেসে ভেসে
এ-কোন ঠিকানায়, প্রযত্নে
অঙ্গে ধরে রাখি রূপের মতো করে
হৃদের মতো করে সযত্নে।
মাসুদ খান ও তাঁর কাব্যজগৎ
মামুন রশীদ
মাসুদ খানের কবিতাভুবনে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা এক কথায় চমৎকার, অনন্যসাধারণ; যেন এক পূর্বাপর রূপক-সংকেতের মহাদেশ। যা এই ছায়াচ্ছন্ন, এই রৌদ্র-ঝলকানো। যে দেশে বালি ও ধূলিকণা, ঝরাপাতা ও কাঁকর, ঝাপসা হয়ে আসা প্লাস্টিক ও পলিথিন, পথের ধারে পড়ে থাকা কোচকানো সিগারেটের রাংতা, এসব তুচ্ছ দ্রব্যও হয়ে ওঠে প্রাণবন্ত, চকচকে, ঝিলিকপ্রবণ ও মানবীয়, মাসুদ খান যেন সে দেশই নির্মাণ করেন।
ভূকেন্দ্রিক বিভিন্ন বিবেচনা ও প্রত্যয় বারংবার অগ্রাহ্য হয়েছে তাঁর কবিতায়। প্রচলিত কেন্দ্রকে ভূ থেকে সরিয়ে নিয়ে কবি ছড়িয়ে দেন ভূমায়, মহাবিশ্বে। এই কবির জগতেও আছে পতঙ্গ ও পাতাবাহার। আর সেই পতঙ্গ, সেই পাতা ও পাতাবাহারও স্পন্দনশীল, তবে এক মহাজাগতিক ছন্দোস্পন্দে; এবং রঞ্জিত নিখিলেরই রঙে।
নিছক এই ভূমণ্ডলের অধিবাসী হয়ে নয়, কবি জীবিত থাকেন, তুমুলভাবে জীবিত থাকেন, অন্তত থাকতে চান, মহাবিশ্বের এক অনিবার্য অংশ হয়ে। ক্ষুদ্র কিন্তু অনিবার্য সেই অংশ। নিখিলে প্রকাশিত থাকেন, অন্তত থাকতে চান, যেন এক কালো বিন্দু! কালো, কিন্তু অব্যর্থ এক বিন্দু একইসঙ্গে সৃজনশীল ও দ্রুত প্রসারণক্ষম!
এসব উচ্চারণের কোনো ভিন্ন পাঠ থাকে না আর আমাদের কাছে, যখন আমরা দেখি, কুড়িগ্রামের মতো ছোট্ট একটি অখ্যাত অবজ্ঞাত বঙ্গীয় শহর-নয় তিলোত্তমা প্যারিস ভিয়েনা রোম, কিংবা মক্কা মদিনা মস্কো হলিউড, কিংবা নয় কুহেলিলিপ্ত সুদূর বিম্বিসার, ব্যাবিলন, কামাখ্যা-কামরূপ-তার আটপৌরে ধরলা নদী, তার যত ক্ষত আর আবিল্য-আবিলতা, কাঠিন্য ও ক্লেশ, সবসমেত গোপনে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কে রূপান্তরিত হয় পৃথিবীর আকাশে আকাশে, রাত্রিভাগে।
এখন উত্তর-মধ্যরাত্রি। এবং কুড়িগ্রাম পৃথিবীর হৃৎপিণ্ড। আর কবি এরকম কবিতা লেখেন বলেই বোধ হয় এই ধরিত্রী, আমাদের এই প্রচলিত ধরিত্রী, সত্যি-সত্যিই পড়ে থাকে অর্থহীন, কুড়িগ্রামহীন, অর্থাৎ হৃদয়বিহীন। আক্ষরিক অর্থেই পড়ে থাকে রাত্রিবেলা।
বিকীর্ণ হয় সংকেত ওই আটপৌরে কুড়িগ্রাম থেকে, সংকেত বিকীর্ণ হয় ফেলনা প্লাস্টিক, ধূলিবালি, রাংতা ও সিলিকা-সিলিকন থেকে, অপ্রতিভ ভ্যাবাচ্যাকা ছাতিমগাছ থেকে, নিরীহ বঙ্গীয় এক ফল আতাফল থেকে, একটি বিড়াল আর তার রোমরাজি থেকে, অলস দুপুরে পাঁচিলের ওপর দিয়ে মন্থর গতিতে হেলেদুলে চলা বেড়ালের কৌতুক-জাগানো গমনভঙ্গি থেকে, কুকুরের লেজতরঙ্গ থেকে (স্বর্গের পথে যুধিষ্ঠিরের আগে-আগে লেজ নাড়তে নাড়তে চলতে থাকা সেই কুকুর!)। সংকেত বিকীর্ণ হয় ‘নদীকূলে করি বাস’ কিংবা ‘কন্যা বারবার ঘুমিয়ে পড়ছে নদীতীরে আজ সকাল থেকেই’ এইসব সাধারণ ঘটনা থেকে। সংকেতেরা উচ্চতরঙ্গ হয়ে নাচতে নাচতে ছুটে আসে পতঙ্গবৎ। সংকেতেরা আত্মাহুতি দেয় কবির উচ্চসংবেদী এন্টেনায়। এরপর শুরু হয় এক রসায়নপর্ব। কবির গ্রাহকযন্ত্রের বিচিত্র গোলকধাঁধা, আশ্চর্য সব ম্যাজিক আর নানা রকমের বকমেশিনের মধ্য দিয়ে যখন ওইসব শাদামাটা সংকেতেরা প্রবাহিত হয় আর পরিস্রাবণ আর ডিমড্যুলেশন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যখন যেতে থাকে আহা, তখন ওই অখ্যাত কুড়িগ্রাম, ওই ভ্যাবাচ্যাকা ছাতিমগাছ, ওই আনস্মার্ট ছাতিমগাছ, কী রকম সম্ভ্রান্ত আর খ্যাতিমান হতে থাকে। ওই ফেলনা প্লাস্টিক, কাঁকর, মিহি বালিকণা, সবই সুবর্ণ হতে থাকে। মর্যাদায় রঙিন হতে থাকে ওই কৌতুকভঙ্গি বেড়াল। স্পর্ধায় বেগুনি হয়ে যায় নাম-না-জানা সব পতঙ্গরা। আর পথের পাশে পড়ে থাকা কোচকানো সিগারেটের রাংতা হতে থাকে রূপবান।
পথের ধারে পড়ে থাকে শাদামাটা নিরেট পাথর। কতই তো পড়ে থাকে! কেউ তাকিয়েও দ্যাখে না। কিন্তু কবি যখন তা অবলোকন করেন, শিশুর বিস্ময় আর কৌতূহলের সঙ্গে তিনি লক্ষ করেন-ওই পাথরখণ্ডটি, অভ্যন্তরে কী এক অবিশ্বাস্য গতি ও স্পন্দন, চাঞ্চল্য ও কোলাহল, এবং এক বিচিত্র বর্ণাঢ্য জগৎ ধারণ করে নিয়ে কী রকম স্তব্ধ হয়ে পড়ে থাকে! ধূসর পাথর হয়ে পড়ে থাকে! যেন বহুরকমের চাঞ্চল্য ও নীরব কোলাহল এককালে অশ্মীভূত হয়ে, স্তব্ধ হয়ে গিয়ে, তবে ওই নিরেট পাথর। যেরকম, সমস্ত শব্দরাজি ক্রমে কাষ্ঠীভূত হয়ে তবে ওই সার-সার সাজানো বৃক্ষ। এই কবি সেই স্তব্ধ নিরেট জড়ত্বে জাগিয়ে তুলতে চান সুপ্ত প্রাণের তরঙ্গ।
স্পিনোজা ভাবতেন, বিশ্বজগতের সকল কিছুই চিন্ময়। জড় আর চেতনায় কোনো ভেদ নাই, অভেদ। আলাদা নয়, আলাদা করা যায় না। যেমন ভাবতেন দার্শনিক কপিল প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে। এই যে দৃষ্টিভঙ্গি, যা কিনা পরিত্যক্ত ও বাতিল হয়ে গেছে এই তুমুল আধুনিকতাবাদী, তুমুল ভোগবাদী সভ্যতায়, তাকে যেন পুনরায় জাগিয়ে তুলতে চাইছেন মাসুদ খান নতুন বিন্যাস ও প্রকরণে, নতুন অবলোকন ও অনুভবে। চাইছেন নতুন এক সর্বপ্রাণবাদের ধারা কল্লোলিত করে তুলতে।
বৃক্ষে বৃক্ষে আর দ্রব্যে দ্রব্যে আর ভূতে ভূতে, সর্বভূতে কবি দেখতে পান সেই প্রাণ, প্রাণের মুহুর্মুহু উদ্ভাস। প্রায় বাতিল হয়ে গেছে যেখানে সর্বপ্রাণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি, সেখানে, বলা হচ্ছে, এই গ্লোবাল ভিলেজে, আরও নানা জানা-অজানা কবি ও ভাবুকের সঙ্গে মাসুদ খানও যেন এক শেষ ও পরিত্যক্ত সর্বপ্রাণবাদের বাদী।
মাসুদ খানের কবিতার আরও একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এপিকধর্মিতা। কবিতা হ্রস্ব বা দীর্ঘ যা-ই হোক না কেন, শৈলী ও বিষয়বস্তু যা-ই থাকুক না কেন, তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে এপিকধর্মী। তা যেন স্থাপিত হয় এক বিস্তৃীর্ণ ইতিহাস ও ভূগোলের প্রচ্ছদপটে, এবং অনেক সময়ই এক সীমাহীন দেশ-কালের পরিপ্রেক্ষিতে।
তাঁর এক গ্রন্থের থেকে অন্য গ্রন্থের কবিতা অনেকটাই আলাদা। দ্বিতীয় বইটির স্বভাবচরিত্র প্রথমটির থেকে অনিবার্যভাবেই আলাদা। সম্ভবত অনাগতগুলো হবে ক্রমেই আরও আলাদা, অন্যরকম। কী জানি! সংকলনের পর সংকলন পার হয়ে যাচ্ছেন তিনি তাঁর স্পষ্ট প্রস্থানচিহ্ন রেখে রেখে। পয়লা বই পাখিতীর্থদিনে-তে তাঁর কণ্ঠস্বরটি বেশ নিরীক্ষাপ্রবণ, আবৃত, ঘন, ও অনেকটা হারমেটিক স্বভাবের; কোথাও কোথাও বিজ্ঞান ও পুরাণগন্ধী। বলা হচ্ছে, ‘শুরু থেকেই দুটো বিষয় আদ্যোপান্ত আবিষ্ট করে রেখেছে তার কবিতার জগৎ : বস্তুর অপরিসীম উদ্ভাসের বিস্ময় আর শব্দের শ্রুতিমূল্য!’ দ্বিতীয় বই নদীকূলে করি বাস-এ তিনি যেন অনেকটা সহজিয়া সাধনায় মগ্ন। সেখানে কোনো কবিতায় দেখা যাচেছ মেটাফিজিক্যাল স্বরের সঙ্গে রোমান্টিক সুরের সহজ সমন্বয় (যেমন, সখাতত্ত্ব; বহুদিন পর আবার প্রেমের কবিতা; একটি ভোরবেলা: সদ্য-খসড়া-করা; যোগাযোগ)। কোনো কোনো কবিতার আবহাওয়া মেঘলা ও মেদুর; সেগুলোর কোনো কোনোটা আবার প্রেমজ, এবং কিছুটা কামজও বটে (বৃষ্টি- ও নিদ্রা-গুচ্ছের কবিতাগুলো; ধারাপাতগীতি; শ্রাবণে ও শৈশবে; সহবর্ণা, অতিসহজা আমার; বীজ ও বপনকেলি সংবাদ; লীলা; একজন বর্ণদাসী ও একজন বিপিনবিহারী সমাচার)। কোনো কবিতা হয়তো মেটাকসমিক কিংবা কসমো-মেটাফিজিক্যাল ঘরানার (বহুদিন পর আবার প্রেমের কবিতা, একটি ছুটির দুপুর; পরিভ্রমণ, দূরের আকাশে; একটি হারিয়ে যাওয়া নভোযান;) কোনোটা বা আবার ফ্যান্টাসো-ফিকশনাল (আতাফল; ২৬ বছর পর পিতামহের; একটি হারিয়ে যাওয়া নভোযান; ওসমান লঞ্চ ফেল করেছিল;)। এমনকি, কবিতায় এসেছে শ্লেষ, পরিহাস ও পরীবাদ— কখনো মৃদু, কখনো-বা তীক্ষè, তির্যক—যা তাঁর আগের দিককার কবিতায় সচরাচর দেখা যায়নি। বিজ্ঞানের তন্ময়তার সঙ্গে কখনো শিল্পের, কখনো বা সমাজ-দর্শন-রাজনীতির মন্ময়তার মিশ্রণ, ঘর্ষণ ও সমন্বয় (ইতিহাস; উপপাদ্য;)! আর অনেক কবিতাতেই দেখি, দূরের কোনো সত্তার সঙ্গে যোগাযোগ ও মিলনের জন্য আর্তি-আকুলতা, আন্তঃভৌবনিক সেতুরচনার উদ্বেলতা (সখাতত্ত্ব; বহুদিন পর আবার প্রেমের কবিতা; যোগাযোগ; একটি ছুটির দুপুর;)! তাঁর প্রথম বইয়ে এসব বিষয় ছিল দুর্লক্ষ্য। প্রথম বইয়ে যদি কবি আবির্ভূত হয়ে থাকেন এক নব্য সর্বপ্রাণবাদের মুখপাত্র হয়ে, তবে দ্বিতীয় বইটিতে তিনি আবির্ভূত হন এক নতুন সখাতত্ত্বের উদ্গাতা হিসেবে। এভাবে গ্রন্থ থেকে গ্রন্থে তিনি রেখে যাচ্ছেন তাঁর প্রাতিস্বিকতার চিহ্নরাশি।
অদেখা অচেনা অজানা এক সখার জন্য আকাঙ্ক্ষা, প্রাণের আকুলতা, কাষ্ঠের সঙ্গে লোহার পিরিত, মোটেই অর্থহীন নয় এইসব আকুতি-অনুভূতি, এমনকি এই আধুনিক নিষ্করুণ নাগরিক জীবনেও; বরং তা প্রতিভাত হয় আরও অর্থপূর্ণ, আরও তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে। এখন আর কবিতায় প্রেম, ফুল-পাখি, নদ-নদী নিয়ে কথা-কপচানোর দিন শেষ-এসব কথা যারাই বলুন, বলুক…খাঁটি কথা হচ্ছে, এসব বিষয়ও যে আবার নতুন বৈশিষ্ট্যে, নতুন ভাবে ও ভাবনায়, নতুন বিন্যাসে উপস্থাপিত হয়ে সম্ভব করে তুলতে পারে অসামান্য কাব্যকৃতি, এ সময়ের অপরাপর আরও কিছু জানা-অজানা কবিতার পাশাপাশি, সখাতত্ত্ব তার এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ—
আমার সখারা দূরের, অনেক দূরের শহরে থাকে
শুধু
একটি সখার নদীর কিনারে বাস
বিদেশী নদীর রাংতা-মোড়ানো বাঁকে
আমার বন্ধু নদীর কিনারে থাকে।ভিন্ন ভুবনে ভিন্ন নদীর বাঁকে
সখাটি আমার নদীর কিনারে থাকে
দূরে তার দেশ কাঁপা-কাঁপা রূপকাহিনীর মতো কাঁপে
আমার বন্ধু নদীর কিনারে থাকে।
(সখাতত্ত্ব, নদীকূলে করি বাস)
বিকীর্ণ হতে থাকে এক অদ্ভুত আকুলতা কোনো এক অদেখা অচেনা সখার জন্য, এই আধুনিক নগরজীবন ছাপিয়ে, ছাড়িয়ে, পেরিয়ে, দূরে, দূর কোনো অজানায়।
এপিকধর্মিতা, অধিবাস্তবতা ও রোমান্টিকতা, ফ্যান্টাসি-ফিকশন, এসব হয়তো সাম্প্রতিক কাব্যধারায় খুব একটা দুর্লভ নয়; তবে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় এই যে, একদিকে সর্বপ্রাণতা, অন্যদিকে সর্বভুবনতার যে নির্জন আপাত-কোলাহলহীন পদচিহ্নহীন অনিঃশেষ দেশকাল-প্রান্তর, সেই প্রান্তরে মাসুদ খান অনেকটাই যেন একা, এক, দ্বিতীয়রহিত; অন্বেষণমাতাল এক লোন রেঞ্জার!
মাসুদ খানের কাব্যভাষা ওজোগুণে সমৃদ্ধ। প্রথম বইয়ের কবিতায় তো বটেই, দ্বিতীয়টিতেও। শব্দব্যবহারে সেই অর্থে শুচিবায়ুতা নেই তাঁর। ভারি ভারি তৎসম অর্ধতৎসম শব্দের আশেপাশেই অবলীলায় ঘটিয়ে ফেলেন দেশী কিংবা আরবি ফারসি ইংরেজি হিন্দি কুলোদ্ভূত শব্দের সন্নিপাত। বিভিন্ন ধরনের শব্দের মধ্যে করিয়ে দেন মধুর মেলবন্ধন। রকমারি বাদী বিবাদী সমবাদী বিষমবাদী স্বরে ও সুরে, শব্দে ও শব্দে ঘটিয়ে দেন সন্ধি। কিংবা, শব্দে শব্দবন্ধে করিয়ে দেন নানা সুষম-বিষম চুক্তি। সে চুক্তি কখনো শান্তির, কখনো অশান্তির; কখনো শান্ত আলাপ-য়ের, কখনো বিস্তারের, কখনো বা তীব্র ঝালা-র। নানা উপসর্গ অনুসর্গ প্রত্যয় আর সন্ধিসমাসযোগে সম্ভব করে তোলেন বিচিত্র নতুন নতুন শব্দের উদ্ভব এবং তাদের বিকাশ।
শব্দে শব্দে মেলবন্ধনে, ভাবের ঘরে রং লাগিয়ে, পুরনো পরিত্যক্ত প্রায়-বাতিল-বনে-যাওয়া বিষয় ঘষে মেজে নতুনভাবে উপস্থাপন করে ঝাঁ-চকচকে তাক লাগিয়ে দেয় তাঁর কবিতা, অনেক ক্ষেত্রেই। তুমুলভাবে সৃজনশীল তিনি আর তাঁর কবিতা, নতুন নতুন আইডিয়ায়। কবিতা যে এক উচ্চতর অনির্বচনীয় শিল্প এবং তা যে এক নিবিড়-গভীর সাধনায় পাওয়া ধন—এই সত্যটির দিকেই নজর ঘুরিয়ে দিতে চায় মাসুদ খানের কবিতা—
আজ অগ্রহায়ণের এই তাক-লাগানো প্রভাতবেলা—
একা আমি বসে বসে ওইসব পাখিহারা স্তব্ধ গাছে গাছে
একটু একটু করে পাখি আর মৌমাছি মেশাই,
একটির পর একটি মৌচাক বসিয়ে যাই ডাল থেকে ডালে—
কিছুটা বিশেষ্য করে তুলি।
অনির্দিষ্ট পথে না ঘুরিয়ে প্রতিটি কবিতাকে তিনি পৌঁছে দিতে চান, দিতে প্রয়াস পান, কোনো না কোনো এক নির্বিশেষ বিশেষ-এ, কোনো না কোনো এক নির্দেশহারা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে— আর এখানেই সার্থক তিনি, এখানেই সার্থকতা তাঁর কবিতার।
থমকে আছে অনেক প্রকার নদী
আলমগীর নিষাদ
সমকালীন বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি মাসুদ খানের দস্তখত হলো—তাঁর কবিতাগুলো সংঘটিত। তাঁর কবিতার আনখে ছড়িয়ে আছে এর অমোঘ বিশিষ্টতা। ‘তটস্থ প্রাণছটফট কিন্তু সুশীলিত পালিশ-করা’ [সভ্যতা, নদীকূলে করি বাস] বিন্যাস; যা কিনা সমকালীন পৃথিবীর গতি-প্রযুক্তি-ব্যবস্থা চরিত্রেরই প্রতিফলন। আশির দশকে বাংলাদেশের রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারের পরিবর্তন সূচনার উৎসারণ থেকে উঠে এসেছে মাসুদ খানের কবিতার এই নির্মাণরূপ। এই কলাপ্রবৃত্তি তাঁকে উন্নীত করেছে কবিতার নতুন বাস্তবতায়। বাংলা কবিতাকে দিয়েছে নতুন ভাষার ঘর।
মাসুদ খানের কবিতা সে-সময় বাংলাদেশের নিজস্ব বিপন্ন কোমলতার সাথে বিজ্ঞানের অপ্রতিরোধ্য নির্মমতাকে আত্মস্থ করে নির্মাণ করেছে নতুন কাব্যভাষা।
মাসুদ খান বিকশিত হন আশির দশকে। এই সময়টা নির্দিষ্ট করে বাংলাদেশের কবিতার একটি বিশেষ ক্রান্তিকাল। সেই সময়ের গেরস্তি বলতে ছিল বিগত দশকের রোমন্থন। কাঠামো-হারা কবিতার উদ্ভ্রান্ত কীর্তন। রাষ্ট্রকাঠামোতে শাসক-গোষ্ঠীর মধ্যে অধৈর্য হিংসার পাশাপাশি চলছে বিদেশি রাষ্ট্রের পরামর্শে নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা অর্থাৎ ‘গণতন্ত্র’ সৃষ্টির বৈঠক। অবাধ বহির্বাণিজ্যের সূত্রে দেশে ঢুকে পড়ছে অত্যাধুনিক বিজ্ঞানের ব্যবস্থাপনা। টুপিওয়ালা ইমাম সাহেবের জগতের মধ্যে হঠাৎ মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে নদীশাসন ও ব্রিজ কনস্ট্রাকশনের কোরিয়ান হোন্দাই ক্রেন। কোমলতার সঙ্গে অজ্ঞানের শান্তি দুমড়ে চলতে থাকে জটিল যন্ত্রপাতি, দাঁতাল সব গাড়ি আর ফর্সা পা-ওয়ালা বিদেশি ইঞ্জিনিয়াররা। ধানখেতের আল সিমেন্টে স্থায়িত্ব পায়, কিন্তু অজ্ঞাত থেকে যায় সব কিছুই। এমনই এক রাহস্যিক আগন্তুক-বিকাশে পাড়ায় পাড়ায় হুলুস্থূল কাল হলো আশির দশক।
মাসুদ খানের কবিতা সে-সময় বাংলাদেশের নিজস্ব বিপন্ন কোমলতার সাথে বিজ্ঞানের অপ্রতিরোধ্য নির্মমতাকে আত্মস্থ করে নির্মাণ করেছে নতুন কাব্যভাষা। ‘ডানাভাঙা উত্থানরহিত কত ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র রাষ্ট্র’ ‘অপরিষ্কার কিছু কুচকাওয়াজসমেত’ ‘গ্রন্থিতে গ্রন্থিতে স্ফুটমান আর সদ্যফোটা কত-না বর্ণাঢ্য ধর্মরাজি’র [বৃষ্টি-২] বাংলাদেশে মাসুদ খান চেষ্টা করেন ‘অবিরাম পলায়নপর,/ অসহায়, ঠান্ডা যত বাক্যে বাক্যে অর্থ আরোপের/ উষ্ণতা আরোপের’ আর ‘কথাগুলি সংগঠিত করবার’ [বৃষ্টি-৩]। আমরা লক্ষ করি, বহুদিন পর বাংলা কবিতার গায়ে নতুন পরিধেয়।
২০০১ সালে প্রকাশিত নদীকূলে করি বাস কবিতাগ্রন্থের ‘বৃষ্টি’ নামের কবিতাগুলো অথবা ‘নিদ্রা’সমষ্টিতে রয়েছে সেই শিল্পার্ত সময়ের ধারণা। ‘বহুদিন পর আবার প্রেমের কবিতা’য়—
আকাশে আকাশে মেলে রাখা তার কী ব্যাপক কর্মাচার,
একটির পর একটি গ্রহ আর জ্বালানি-জংশন সব
অতর্কিতে নিভিয়ে নিভিয়ে প্রবাহিত হন তিনি।
এবং সময়ের রগ-রেশায় লক্ষ্য করেন—
আন্তঃভৌবনিক তথ্যজালিকায় আচম্বিতে লেগে গেছে জট।
[একটি ছুটির দুপুর]।
‘নিদ্রা-২’ কবিতার ভেতর কবি—‘নিদ্রায় দ্রবীভূত/ একটি পল্লির উপকণ্ঠে’ এসে দাঁড়ান।
অধিবাসীদের ঘন নিদ্রিত শরীর থেকে কত-কত প্রাণ
বের হয়ে প্রবল জ্যোৎস্নার মধ্যে এখন বিচরমান এই আশেপাশে।
প্রাণদের কী যে হালকা-হালকা ঘ্রাণ!
কোথায় কোথায় তারা ঘোরে ছোট ভালুকের মতো
অধিবাসীদের এই স্বপ্ন দেখার রাতে কবি একা বিচরমান—
এ-সময় হঠাৎ কাউকে জাগানো কি সমীচীন হবে?
এতগুলো বিচরণমগ্ন প্রাণ একসঙ্গে এত দ্রুত
কী করে প্রবেশ করবে তবে শরীরে শরীরে!
যদি কোনো একটা প্রাণকে বহির্গত
রেখেই জেগে ওঠে কোনো ঘুমন্ত শরীর!
প্রাণপালিনীর খুব দুঃখ হবে তাতে।
‘প্রাণপালিনী’র এই দুঃখের ভেতর মাসুদ খানের কবিতা জেগে থাকে। তাঁর কবিতার ভেতরে ক্রমশ সৃষ্টি হতে থাকে এক অধিবিদ্যার স্বদেশ।
তিনি আমাদের বলে দেন, মানুষের কোনো ইতিহাস হয় না। পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় বিভ্রমের নাম ইতিহাস।
চলৎ সময়টা কেবল বদ্বীপ পাড়ার নয়, গোটা ভুবন-সমাজেরই এক মহাক্রান্তি কাল। নূহের প্লাবনের মতো আন্তর্জালিক তথ্যপবনে অখিল বিশ্ব সমবেত হয় একই তীরে। আগন্তুক-বিকাশের সমান্তরাল বাংলার বৌদ্ধিক-চিন্তা দুনিয়ায় আছড়ে পড়ে সেই অভিঘাত। ‘রঙিন মেঘেদের সন্ধ্যা চ্যানেলে’ [সখাসংগীত] পরম সন্দেশ পাঠায় প্রাচ্যতত্ত্ব। মাসুদ খানের কবিতায় প্রথম সাফ রূপধারী হয় উত্তর-ঔপনিবেশিক চৈতন্যের পরিগঠন।
মাসুদ খান তার ‘প্রাচ্যতত্ত্ব’ কবিতায় প্রশ্ন করেছেন, ‘সূর্যের এই যে দিক-নিশানা, পশ্চিমমুখী—কারা ঠিক করে দেয় প্রতিদিন?’ তারপরেই বিদ্রোহ করেন ‘পশ্চিম?—মানি না’। মাসুদ খানের এই উচ্চারণ—সমাজতাত্ত্বিক, প্রাচ্যের গহ্বর থেকে উঠে আসা আত্মপরিচয়। বাংলা কবিতায় তিনিই প্রথম পশ্চিমকে যথার্থভাবে সত্যের মুখে বিপদগ্রস্ত করেছেন। তিনি ঘোষণা করেন, ‘আজ থেকে উলট-চলনে চলবে সূর্য, চলবে ইতিহাস—’ এবং এরপর তিনি প্রাচ্যের নিয়তি তুলে ধরেন এভাবে—এ কথা ‘বলতে বলতে গাট্টাগোট্টা ধরনের ক’জন খননবিদ অতীত খুঁড়তে/ দুড়দাড় করে নামতে গিয়ে হড়কে পড়ে যায় অথই অতীতে’।
মাসুদ খান আমাদের এক ইতিহাসমুক্ত দুনিয়ার সামনে দাঁড় করান। ‘ইতিহাস’ কবিতায় তিনি আমাদের সেই প্রশ্ন-মুখে ছুড়ে দেন, যার কোনো উত্তর নেই। তিনি জিগ্যেস করেন—‘কী করে সম্ভব তবে পৃথিবীর সঠিক ইতিহাস? কারণ, যিনি লিখেছেন, তিনি কে এবং কোথায়? কোন সময়ে, কোন অবস্থানে দাঁড়িয়ে কী উদ্দেশে লিখছেন, সে-সবের ওপর নির্ভর তার ইতিহাস। আর তাছাড়া বিষয়টি বিষয়ীগত, সাবজেকটিভ। তবে কি সত্যিই অসম্ভব সঠিক ইতিহাস?’ তিনি আমাদের বলে দেন, মানুষের কোনো ইতিহাস হয় না। পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় বিভ্রমের নাম ইতিহাস।
সমকালীন বাংলা কবিতায় মাসুদ খানের প্রধান কৃতিত্ব হলো তিনি একটি সাম্প্রতিক সম্পন্ন কাব্যভাষা নির্মাণ করেছেন। জীবনানন্দ-পরবর্তী বাংলা কবিতায় আহসান হাবীব, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আল মাহমুদ, শামসুর রাহমান, ফরহাদ মজহার, আবুল হাসান, নির্মলেন্দু গুণ এবং রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ-পরবর্তী যাদের কবিতায় আমরা পূর্ণ ধ্যানলোকের সন্ধান পাই, মাসুদ খান তাঁদের অন্যতম।
মাসুদ খানের কবিতা অতিমাত্রায় ‘সংঘটিত’। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, কবিতাকে যারা এখনো স্বয়ংক্রিয়তার শিল্প, সংগঠনের বিরুদ্ধপক্ষ মনে করেন, মাসুদ খান তাদেরও নিরাশ করেন না। কর্পোরেট কুলাচার, তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনার যুগে আমাদের অনুভূতিরা পর্যন্ত যেহেতু ‘সংগঠন’ ছাড়া অস্বিত্বময় হয়ে উঠতে পারে না—সুতরাং মাসুদ খানের এই কাব্য-প্রযুক্তিও প্রতিস্থাপিত হয় আসমানি বয়ানে। দুনিয়ার নয়া সেন্সিবিলিটির স্বতোৎসারিত কণ্ঠই মাসুদ খানের কবিতায় অবতীর্ণ হয়েছে অপার তরিকায়। মানুষের নতুন ভাব ও ভাষার এমন নিষ্ঠুর ও নির্লিপ্ত অনুশীলনের সঙ্গে বাংলা কবিতার ইতঃপূর্বে পরিচয় ছিল না।
এমন সময়ের ‘দুরারোগ্য সম্প্রসার’-এ [বহুদিন পর আবার প্রেমের কবিতা] সতত তাঁর কবিতার মধ্যে তাই ‘কিছু অতিনৈশ হাঁটুরেদের ছেঁড়া-ছেঁড়া হাঁকডাক’ [নিদ্রা-২] শোনা যায়। বিজ্ঞানবাসের অভ্যাসে ‘প্লাস্টিক-পলিথিনের লতায় গুল্মে আস্তে-আস্তে জড়িয়ে’ [মা] যাওয়া গ্রন্থি ছিঁড়ে যেখানে তিনি যেতে চান… অথচ দেখা যায় ‘একটি হারিয়ে যাওয়া নভোযান’-এ চড়ে ‘ভ্রান্ত আর অতিরিক্ত হয়ে’ তার গতিরা ছুটছে। রূপতরঙ্গ গাঁয়ের কবি তাঁর কবিতায় সময়ের ধারণা ভেঙেও সময়ের ভারে পীড়িত হন। তাঁর সম্মুখে উঠে আসে সেই একঘেয়ে পুরাতন রূপকথার ‘বামন মানুষদের কত কীর্তি আর বিষ্ঠা’ [কয়েকজন তরুণ কবি]। কিন্তু এখানে এসে মাসুদ খান তাঁর বাস-চৈতন্যের এক অত্যাশ্চর্য বিনির্মাণ ঘটান। প্রযুক্তিবিধির কবি মাসুদ খান হয়ে ওঠেন হাটখোলার বৈষ্ণব গাতক। কবিতায় শেষ পর্যন্ত তিনি সভ্যতাকে নদী নির্দেশ করেন। ‘নিস্তারহীন তথ্যজটের নিচে’ [সখাসংগীত] শনাক্তহীন অথই গভীরে শেষপর্যন্ত মাসুদ খান তাঁর নদীকূলে বাসরতা আত্মীয়ের পিপাসায় ভোগেন।
এইখানে এসে মাসুদ খান পূর্ণ হন। একই সূত্রে প্রযুক্তি-পীড়িত ও প্রযুক্তি-পুলকিত এক অপার সত্তায় হাজির হন।
দূরে তার দেশ কাঁপা-কাঁপা রূপকাহিনির মতো কাঁপে
বন্ধু আমার নদীর কিনারে থাকে।
এবেলা আমার গৃহ নেই কোনো সখা,
কী যে ঘোর গৃহতৃষ্ণা জাগছে তাই
মনে করি, যাব তোমাদের দেশে চলে
নাকি
তুমিই আমাকে অধীনে তোমার ধীরে ধীরে টেনে নেবে?
[সখাসংগীত]
মাসুদ খানের সখা নদীর কিনারে থাকে এবং মাসুদ খান নদীকূলে বাসরতা প্রাণসখার অধীনে, অধিগ্রহণে আর শাসনের নিচে থাকতে চান। বন্ধুকে বলেন—
তুমি আমি মিলে উধাও উড়ালে
চলে যাব এই দেহ ছেড়ে, এই যৌথ রচনা ফেলে।
আশেপাশে কত জরুরি ভাণ্ড, মহান কীর্তি,
গুরুত্ববহ স্থাপনাসমূহ আর,
কথিত সিভিল দুনিয়ার।
[সখাসংগীত]
এইখানে এসে মাসুদ খান পূর্ণ হন। একই সূত্রে প্রযুক্তি-পীড়িত ও প্রযুক্তি-পুলকিত এক অপার সত্তায় হাজির হন। এই সভ্যতা ভুবনগ্রামের মানুষের অস্তিত্বকে তিনি ‘যথাযথভাবে নদীনির্দেশ’ করেন।
যেভাবে পড়েছি প্রসন্ন দ্বীপদেশ
কুদরত-ই-হুদা
কিছুদিন আগের কথা। এক বড় ভাইকে আক্ষেপ করে বললাম, ‘ভাই আপনি তো অনেক বই-টই পড়েন বলে জানি। তা, বাংলায় লেখা দুইএকখান বই দ্যান, যা পড়ে টাসকি খেয়ে যাব। হতভম্ব হয়ে যাব। বই পাঠান্তে মনে মনে লেখককে বড় কুটুম (পড়ুন শালা) বা বড় কুটুমের পুত সম্ভাষণে বলব, …করছেটা কী! সাথে সাথে নিজের অজান্তে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হবে। দীর্ঘশ্বাসের বাষ্পের মধ্যে নিজের লেখালেখি সম্পর্কে একটা হতাশাও মেশানো থাকবে। অনেকদিন বই পইড়া এইরকম হয় না।’ আমার কথা শুনে পড়ুয়া বড় ভাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন মনে হলো। তিনি বললেন, এই মুহূর্তে বলতে পারতেছি না। আগামীকাল আইসো।’ আজকের সব পরের দিনই যেহেতু আগামীকাল, তাই বড় ভাইয়ের আগামীকাল এখনো শেষ হয় নাই। আমিও সেই থ’ মারা বাংলা বইয়ের নাম আর পাই নাই। এর মধ্যেই আমার হাতে আসে মাসুদ খান (জ.১৯৫৯)-এর প্রসন্ন দ্বীপদেশ (২০১৮) কবিতার বইটা।
এই কবির কবিতার বই আগেও পড়েছি। পাখিতীর্থদিনে (১৯৯৩), নদীকূলে করি বাস (২০০১) আর সরাইখানা ও হারানো মানুষ (২০০৬)। পাখিতীর্থদিনে আর প্রসন্ন দ্বীপদেশ-এর মাঝখানে নদীকূলে করি বাস আর সরাইখানা ও হারানো মানুষ ছাড়াও মাসুদ খানের আরো কবিতার বই আছে। আঁধারতমা আলোকরূপে তোমায় আমি জানি (২০১১), এই ধীর কমলাপ্রবণ সন্ধ্যায় (২০১৪) আর দেহ-অতিরিক্ত জ্বর (২০১৫)—বোধ হয় এই তিনটা। এগুলো নানা কারণে আমার পড়া হয় নাই। এইবার পড়লাম শেষটা—প্রসন্ন দ্বীপদেশ। এই যে কিছু বই পড়া আর কিছু না পড়া একেই বোধ হয় বলে খাবলা-খাবলা পড়া। এইটা খুব খারাপ। কিন্তু আমার বর্তমান কথা বলার ক্ষেত্রে সমস্যা নাই। কারণ প্রত্যেকটা কবিতাই সার্বভৌম বলেই মনে করি। আর আমি এখানে তাঁর সব বই নিয়ে কথা বলতে বসি নাই। কথা পাড়ব শুধু প্রসন্ন দ্বীপদেশ নিয়ে। সেইটা পড়া আছে আমার।
তা যে কথা বলছিলাম। প্রসন্ন দ্বীপদেশ বইয়ের প্রথম কবিতা ‘স্বপ্নভূভাগ’ পড়ে সত্যিই টাসকি খাইলাম। কত গভীর, সযত্ন, আরামদায়ক আর খাঁটি কবিত্বে ঠাসা! ‘কালের রেদার টানে সর্বশিল্প করে থরথর’—একথা জেনেও এই প্রশ্নও জাগল নিজের ভেতরে যে, এরকম কয়টা কবিতা থাকলে বহুকাল টিকে থাকা যায়। মনে মনে খোঁজ করতে শুরু করলাম বড় বড় কবি-সাহিত্যিকদের মাস্টারপিসের সংখ্যা নিয়ে। দেখলাম কারোরই কমপ্লিট কবিতার সংখ্যা খুব একটা বেশি না। কথাসাহিত্যিকদের খোঁজ করলাম। দেখলাম সেখানেও একই অবস্থা। সবাই লিখেছে ঢের। কিন্তু টিকেছে কম। আমরা যখন কোনো বড় কবি বা সাহিত্যিকের কবিতা বা সাহিত্য নিয়ে কথা বলতে যাই, তখন ঘুরেফিরে ওই কয়েকটা মাস্টারপিস নিয়েই কথা বলি। ওই হাতেগোনা কয়েকটার নাম নিয়েই বলি, দেখছেন বড় কুটুম বা বড় কুটুমের পুত করছেটা কি! তা, এই ‘স্বপ্নভূভাগ’ কবিতা পড়ে নিজের অজান্তে ওই রকম একটা কথা বের হয়ে আসল। সাথে নিজের লেখালেখি সম্পর্কে একটু হতাশা বোধ করলাম। বলে রাখা ভালো, মাসুদ খান বয়সে আমাদের বেশ বড় হলেও আমরা তাকে ভাই বলি। যেমন, শামসুর রাহমান জীবিত থাকতে তাঁকে আমরা বলতাম রাহমান ভাই। যদিও তাঁর জন্মসাল আর আমার বাপের জন্মসাল একই (১৯২৯)। আবার জীবিত নির্মলেন্দু গুণকে আমরা বলি গুণদা। কবি বলেই বোধ হয় এই ভাই বা ‘দা বলা যায়। আর আলাপ-পরিচয়সূত্রে দেখা-সাক্ষাৎ হয় বলেই বোধকরি তাঁদের টাসকি লাগানো কোনো লেখা পড়ে বড় কুটুমবাচক কোনো শব্দবন্ধ মাথা আসে না। আসে ভাই বা ‘দা। মাসুদ খানও সেইভাবে মাসুদ ভাই। চক্ষুলজ্জার খাতিরে আর-কি! তা নইলে তিনি ওই প্রথম কবিতায় যা করেছেন, তাতে তাঁরে বাঁচানো খুব মুশকিল হতো। পরের কবিতাগুলোর কথায় পরে আসি। আগে বলে নিই মাসুদ খানের ওই কবিতা কিভাবে পড়েছি। কী আমারে হতভম্ব করছে!
বাংলাভূভাগের এমন ইন্দ্রিয়ঘন বর্ণনা, প্রকৃতি ও রোদের শ্যাম্পেন পানের ‘চিয়ার্স-ধ্বনি’ বহুকাল কবিতায় শুনি না।
প্রথমত, এই কবিতায় একটা দ্বীপদেশ আছে। দেশটা কোন দেশ তার উল্লেখ নাই। সেটা স্বপ্ন-কল্পনার হতে পারে। আবার না-ও হতে পারে। কবিতার মধ্যে সাক্ষ্য পাওয়া যাচ্ছে, অন্তত কবিতাটা যার মুখে বর্ণিত হচ্ছে তিনি এখনো সেই দেশে পৌঁছাতে পারেন নি। তার কাছে এটা স্বপ্নেরই বটে। তাঁর বক্তব্য এমন, ‘বহু প্রত্যাশার, বহু সাধ-সাধনার যোগ্য/স্বপ্নভূভাগ কি এরকমই দূর ও দুর্গম, যোগাযোগাতীত?’ হতে পারে বর্ণনাকারী ওই নাবিকের কাছে বর্ণিত দ্বীপদেশটি স্বপ্নের। কিন্তু ওই দ্বীপদেশকে বাংলাদেশ বলে দারুণভাবে পড়া যায়। বাংলাদেশের কুটির, বনবিড়াল, ঝোপঝাড়, রাধিকাপুরের ঝিয়ারি, মাটি, প্রাণী ও পতঙ্গদের উচ্ছ্বাস সবই আছে কবিতায়। আছে মাটি আর মানুষের সরাসরি যোগাযোগের কথা। বাংলাভূভাগের এমন ইন্দ্রিয়ঘন বর্ণনা, প্রকৃতি ও রোদের শ্যাম্পেন পানের ‘চিয়ার্স-ধ্বনি’ বহুকাল কবিতায় শুনি না। আশির দশকের পরে বাংলাদেশের কবিতা সেই যে, এইসব নিষ্পাপ আর নিঃশর্ত দেশালপনা থেকে পাশ ফিরে শুয়েছে, দুএকটি ব্যতিক্রম ছাড়া, সে তো আর ফিরে আসে নি। একটু চেখে নেয়া যাক মাসুদ খানের বর্ণনায়:
নাবিক, অবাক সেই ভূভাগের কথা বলো
যেখানকার মাটি উষ্ণ, অপত্যবৎসল,
যেখানে মানুষ সোজা মাটিতে শুয়ে প’ড়ে
শুষে নেয় অষ্টাঙ্গে ভূতাপশক্তি সঞ্জীবন…
দেহ ও মাটিতে যোগাযোগ হয় সরাসরি,
সোজা ও সহজ।
এই বর্ণনা বাংলাদেশের বর্ণনা ছাড়া আর কিভাবে পড়ব! বাংলাদেশ ঘুরতে গেলে একথা যেকারো মনে হবে, মাটির সান্নিধ্যই এদেশের মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছে। নইলে এখনো যেদেশে মানুষ যেখানে-সেখানে মল ত্যাগ করে, সেদেশের মানুষ এত শ্রম-ঘামের পর, এত পুষ্টির অভাবের পর, কিভাবে টিকে আছে! মাটির গন্ধ আর মাখামাখিই এদের বাঁচিয়ে দিয়েছে। মাটির পাশাপাশি এখানকার মানুষদের জীবনের সাথে যুক্ত হয়েছে ‘জলবায়বীয় পরিস্থিতি’, ‘প্রাণী ও পতঙ্গদের উল্লোল উচ্ছ্বাস’ ‘আর গাছেদের স্বতস্ফূর্তি’। কবিতা পাঠান্তে মনে হলো বাংলাদেশ বুঝি স্বপ্নে কথা কয়ে উঠেছে মাসুদ খানের এই কবিতায়। এই কবিতায় বর্ণিত ভূভাগকে বাংলাদেশ বলে পড়তে গিয়ে মনে পড়ল জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন কাব্যের ‘নগ্ন নির্জন হাত’ কবিতার কথা। কবিতাটি কোনো দেশের কল্পিত বর্ণনা নয়। কিন্তু কবিতাটি যে নিরেট কল্পনা তাতে সন্দেহ নাই। কবিতায় কল্পিত একটি নগরীর এক প্রাসাদের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। সেই প্রাসাদে কবি কী কী রেখেছেন দেখা যাক, ‘মূল্যবান আসবাবে ভরা এক প্রাসাদ/পারস্য গালিচা, কাশ্মীরি শাল, বেরিন তরঙ্গের নিটোল মুক্তা প্রবাল,/…অজস্র হরিণ ও সিংহের ছালের ধূসর পাণ্ডুলিপি,/রামধনু রঙের কাচের জানালা…’। একে কি কেউ বাংলার কোনো মানুষের ঘর বলে পাঠ করবে! মাসুদ খান আর জীবনানন্দ দাশ দুজনের কবিতাদুটোরই একদিক থেকে মিল আছে। দুটো কবিতাই মূলত কল্পনা। কিন্তু আপনি আপনার কল্পনার মধ্যে কোন কোন অনুষঙ্গকে রাখছেন, আর কোন কোন অনুষঙ্গকে রাখছেন না, তা দিয়ে আপনার মনোজগতের গভীর প্রদেশের খবর কিন্তু সহজেই আঁচ করা যায়। জীবনানন্দের কল্পনায় চমৎকৃতি জাগলেও তা আপন আপন লাগে না। মনে হয় দারুণ, কিন্তু এটা কোনো বড়লোকের ব্যাপার-স্যাপার। লোকটা হয়তো বিলেতটিলেত থাকে। কিন্তু মাসুদ খানের এই কবিতার কল্পনার অনুষঙ্গের মূলে আছে জল-জংলা-বিল-ঝিল আর কালো মানুষের বাংলাদেশ, যাকে আমরা এক সময় আদর করে বলতাম পূর্ব বাংলা।
শুধু বাংলাদেশ বলে নয়, ‘স্বপ্নভূভাগ’ কবিতার উপস্থাপন একেবারে ভিন্ন। বহুকাল এই ধরনের উপস্থাপনের টেকনিক কবিতায় সচরাচর দেখি না। বাপ-দাদার আমলের গল্প বলার ঢঙের মতো। বাংলার লোকনাটকের মধ্যে এই ঢংটা প্রায়শ লক্ষ করা যায়। যেখানে রাজাগোছের কেউ একজন কোনো পারিষদের কাছে জানতে চান, ‘বলো ওহে অমাত্য! কী কী দেখলে?’ মাসুদ খান যেমন বলেছেন, ‘এবার বলো হে ফিরতি পথের নাবিক,/ওহে মাথা-মুড়ে-ফেলা ভিনদেশি কাপ্তান,/সেই দ্বীপদেশের খবর বলো…। উপস্থাপনের এই ধরনের কথা যখন বলছি, তখন খুব করে মনে পড়ছে জসীমউদ্দীনের মধুমালা নাটকের কথা। জিজ্ঞাসার এই ঢঙের মধ্যে একটা ক্লাসিক ক্লাসিক ভাব আছে, আবার যথেষ্ট টেকনিক্যালও বটে। টেকনিকের দিক থেকে মনে আসছে কালিদাসের মেঘদূত কাব্যের কথাও। কালিদাস তাঁর মেঘদূত কাব্যে যক্ষের বরাতে মেঘকে দূত করে পাঠিয়েছিলেন তার প্রিয়ার কাছে। মেঘকে যক্ষ বলেছিলেন, মেঘ যেন তাঁর প্রিয়াকে উজ্জয়িনীপুরে গিয়ে তার বিরহের কথা জানায়। পুরো কাব্যে আমরা কোথাও দেখি নি যে, মেঘ যক্ষপ্রিয়ার কাছে গিয়েছে এবং তার বিরহের কথা জানিয়েছে। যক্ষ মেঘকে একটা গাইড-লাইন দিয়েছে। মেঘ যে-পথ পাড়ি দেবে সেই পথ কেমন, সে-পথের কোথায় কী থাকবে, এইসবের একটা গাইড-লাইন আর-কি। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে যক্ষের বিরহকথা আর প্রকৃতির বর্ণনা কালিদাস বলে ফেলেছেন। ‘স্বপ্নভূভাগ’ কবিতায়ও মাসুদ খান ফিরতিপথের নাবিকদের কোনো কথা বলতে না দিয়ে, নিজেই ‘স্বপ্নভূভাগ’-এর বর্ণনা হাজির করেছেন। সরাসরি ক্লান্তিকর বর্ণনা না দিয়ে নাটকীয়তা তৈরির ভেতর দিয়ে কবি তাঁর কহতব্যকে বেশ আয়েশ করে বলেছেন। টেকনিকটা পুরোনো পুরোনো ঠেকে। কিন্তু ‘স্বপ্নভূভাগ’-এর ভাষাভঙ্গি, ওজস্বী বর্ণনা, আর অলক্ষ্য অথচ গভীর স্বদেশানুরাগের সঙ্গে তা এত বেশি মিলমিশ খেয়ে গেছে যে, তাকে ক্লাসিক বলে মনে হয়। মাসুদ খানের কবিতার এই এক বৈশিষ্ট্য যে, তিনি চলতি সময়ের কবিতাটেকনিকের ট্রেন্ডের খুব একটা ধার ধারেন না। তাঁর নিজের একটা চলন-বলন আছে। সেই নিজস্ব ঢঙে চলতে-বলতেই তিনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এ কারণেই মাসুদ খান আশি বা নব্বই দশক বা তাঁর পূর্বজ কবিদের থেকে আলাদা হয়েছেন। মাসুদ খানকে এ কারণেই আলাদা করে চেনা যায়। তাঁর কবিতা পড়তে গেলে তাঁর নাম ছাড়াও পড়া যায় এবং কবিতা পড়ে সিদ্ধান্ত নেয়া যায় যে, এটা মাসুদ খানের কবিতা। আমি তাঁর পাখিতীর্থদিনে, নদীকূলে করি বাস আর সরাইখানা ও হারানো মানুষ কাব্যগুলো পাঠের স্মৃতিকে মাথায় নিয়েই একথা বলছি। তাঁর কবিতার মুদ্রার মতো চকচকে আর ঝংকৃত শব্দচয়ন, ইন্দ্রিয়সঘনতা, অন্তর্গত অনায়াস অনুপ্রাসের সাংগীতিক মূর্ছনার কথা না হয় না-ই বললাম।
প্রাণ আর প্রকৃতির এই যৌথ উদ্যাপনের শৈল্পিক উপস্থাপন মাসুদ খানের জাত চেনার জন্য যথেষ্ট বলে মনে হয়।
‘স্বপ্নভূভাগ’ থেকে এগোলাম দ্বিতীয় কবিতা ‘প্রলাপবচন’-এর দিকে। দ্বিতীয় কবিতায় ঢুকে দেখলাম সেখানেও এক স্বপ্নের কথা, যা প্রলাপ বলে কবি চালান করতে চেয়েছেন। তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু নড়ে চড়ে বসলাম যখন কবিতাটা শুরু হলো এভাবে—
নদ এসে উপগত হবে ফের নদীর ওপর
দুই পারে জমে উঠবে কপট কাদার ঘুটঘুটে কেলেংকারি
মাঝখানে চোরাঘূর্ণি চোরাস্রোত
এলামেলো এলোমেলো বাউরি ভাবনা এসে
পাক খেয়ে ঢুকে পড়বে বৃষ থেকে মিথুনের অধিক্ষেত্রে…
মাকাল ফলের মৃদু মনস্তাপ
করলা-লতার শ্যামলা আক্ষেপ
কোকিলস্য প্রবঞ্চনা, কাকের বাসায় উপঢৌকন
ভরা বিলের ওপর দিয়ে ভেসে আসা ভেজা-ভেজা সুর
হুদহুদ পাখির অস্থিরতা…
এখানে বা এই কবিতায় কবি কী বলতে চেয়েছেন তা আমার কাছে গৌণ হয়ে গেল। অবাক বিস্ময়ে ভাবলাম, একজন মানুষের করোটি আর বুকের আনাচে-কানাচে, চিপা-চাপায়, কলিজার রন্ধ্রে রন্ধ্রে তাঁর স্বদেশ কী পরিমাণ গভীরতায় বাসা বাঁধলে এইভাবে একটা বর্ণনা হাজির করতে পারেন। ‘নদ’, ‘নদী’, ‘চোরাঘূর্ণি’, ‘করলা-লতার শ্যামলা আক্ষেপ’, ‘ভরা বিলের ওপর দিয়ে ভেসে আসা ভেজা-ভেজা সুর’, ‘হুদহুদ পাখি’ এগুলো কী! কিসের জন্যে এসব আয়োজন! কবির লক্ষ্য কী! হঠাৎ মনে হলো লক্ষ্যের (পড়ুন কবির বক্তব্য) খ্যাতা পুড়াই। উপলক্ষই এই কবিতার লক্ষ্য। আমার মনে হলো আমি ভাটিয়ালির সুর শুনছি। কবির স্বদেশের অদৃশ্য মর্মসুর মর্মরিত হয়ে উঠেছে কবিতা লাইন আর শব্দগুলোর ফাঁকে ফাঁকে, ঝরনার পানি যেমন পাথরের ফাঁকাফুকা দিয়ে আওয়াজ করতে করতে বয়ে যায়। আমি একটা শুভ-আতঙ্কে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ি। ভাবতে থাকি মাসুদ খান কি বাংলার প্রাণের শ্যাম্পেন পান করিয়ে তাঁর পাঠককে মাতাল করতে চান এই কাব্যে! মাথার মধ্যে তড়াক করে উঠল কাব্যগ্রন্থের নাম ’প্রসন্ন দ্বীপদেশ’। তবে কি এই দ্বীপদেশ পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ বাংলাদেশ! বাংলাদেশ নিয়েই কি তিনি পুরো কাব্য ফেঁদেছেন! লোভাতুর হয়ে কাব্যের তৃতীয় কবিতা ‘মৌসুম’-এর দিকে এগোলাম। দেখলাম সেখানে উৎসব বসেছে ‘গাছগাছালি’, ‘আলাভোলা আশশেওড়ার ঝাড়’, ‘মাটি-ঝোঁকা রাংচিতা-ঝোপ’, ‘ঘোড়েল’, ‘ফোকলা দাঁতের খিলখিল হাসির হিল্লোলসহ কাঠবিড়ালির শিশুকন্যা’, ‘উড়ুক্কু শিয়াল’, ‘বহুরূপী গিরগিটি’, ‘বন্য বেল্লিক ছাগল’ আর ‘গাছগাছালি’দের। প্রাণ-প্রকৃতি আর জীববৈচিত্র্যের এ-এক ভিন্ন জগৎ। আর পরের ‘হর্ষতরঙ্গ’ কবিতায় গিয়ে মনে হলো এ-তো কবিতা নয়, রীতিমতো চিড়িয়াখানা। না, চিড়িয়াখানা নয়। কারণ, চিড়িয়াখানা তো বানানো। বিচিত্র চিড়িয়া ধরে এনে বানানো খানাই তো চিড়িয়াখানা। ‘হর্ষতরঙ্গ’ কবিতায় দেখলাম রীতিমতো এক অভয়ারণ্য। দেখা যাক কী কাণ্ড বাঁধিয়েছেন মাসুদ খান সেই অভয়ারণ্যে—
সরো সরো, ঈশান থেকে তিরের বেগে ওই নেমে পড়ছে হংসবাহিনী—উঠানে, অঙ্গনে, ধানক্ষেতে, নয়ানজুলিতে। আর নৈর্ঋত থেকে ছুটে আসছে দস্যি বাচ্চারা। এসেই দুই ডানা পাকড়ে ধরে উঠে পড়ছে রাজহাঁসের পিঠে। তা-ই দেখে ঘাস থেকে মুখ তুলে মুচকি হাসছে খরগোশ, প্রশাখাজালের আড়াল থেকে কাঠবিড়ালি।
এক হোঁদলকুতকুতে, দুষ্টের চূড়ামণি, এমনিতেই লেট লতিফ, তদুপরি পিছিয়ে পড়ছে বারবার, কুকুরছানার কান মলে দিয়ে, পোষা শজারুর শলাকা ধরে টান মেরে, খুচরা নোটাংকি সেরে, দুই কাঁধে দুই অস্থির গুঞ্জরণরত বাচ্চা বসন্তবাইরিকে বসিয়ে নিয়ে এগিয়ে আসছে শেষ হংসবাহনের দিকে। হাঁসটি তখনো নয়ানজুলির জলীয় রানওয়েতে। উড়ালে উন্মুখ। বাচ্চাটি আছাড়ি-পিছাড়ি খেয়ে জলকাদা মাড়িয়ে কোনোমতে হাঁকুচ-পাঁকুচ করে উঠে পড়ছে সর্বশেষ হংস-ফ্লাইটে। পেছন পেছন আলপথে হেলেদুলে আসছে কান-মলা-খাওয়া নাদুসনুদুস কুকুরছানাটিও।
প্রাণিজগতের এই হুলুস্থুল যে-প্রকৃতির মধ্যে মাসুদ বাঁধালেন, পাঠকদের অনুরোধ করব, দেখেন তো এই পরিবেশের সাথে বাংলার মিথিক্যাল বা সাবেক অথবা বর্তমান প্রকৃতির কোনো মিল পাওয়া যায় কিনা—
তুলাপ্রসূ সব শিমুলের গাছ, ফলপ্রসূ সব আম ও আমড়া বাগান। তাদের ওপর দিয়ে উড়ে চলেছে হংসবাহিনী। এক-একটি হাঁসের পিঠে এক-একটি শিশু। উড়ে যেতে যেতে উৎফুল্ল বাচ্চারা ভূমণ্ডলের দিকে উড়ন্ত চুমু ছুড়ে দেবার মুদ্রায় ফুঁ দিচ্ছে হাতের তালুতে। একবার ডান হাত, আরেকবার বাম। দুই দিকে জেগে উঠছে ছোট-ছোট হাওয়াহিল্লোল।
আর সেই হিল্লোলের হালকা ধাক্কাতেই সঙ্গে-সঙ্গে নিচে আগুন ধরে যাচ্ছে হুলুস্থুল কৃষ্ণ ও রাধাচূড়ায়, আর আমের পাতারা খিলখিল আহ্লাদে ঢলে পড়ছে প্রতিবেশী আমড়ার পাতাপল্লবের ওপর।
প্রাণ আর প্রকৃতির এই যৌথ উদ্যাপনের শৈল্পিক উপস্থাপন মাসুদ খানের জাত চেনার জন্য যথেষ্ট বলে মনে হয়। দুই অর্থেই জাত চেনার জন্য এই কবিতা পাঠ করা যেতে পারে। প্রথমত, মাসুদ খান বড় জাতের কবি। দ্বিতীয়ত, তিনি বাঙালিজাতের কবি। বাংলার প্রাণ-প্রকৃতি মাসুদ খানের রক্তের সাথে কত গভীরভাবে মিশে আছে সে-পরিচয় মাসুদ খানের পাঠক মাত্রেই বোধ করি জানেন। তাঁর কবিতায় দর্শন থাকে, তত্ত্ব থাকে, অধিবাস্তবতা থাকে। কিন্তু আমি দেখি তাঁর কবিতায় কী গভীরভাবে বাংলাদেশ থাকে! বাংলাদেশের প্রাণ-প্রকৃতির ব্যাকরণ থাকে; প্রাণ-ভোমরা থাকে। বাংলার এই প্রাণ-প্রকৃতি আমরা একটু ভিন্নভাবে ভিন্ন প্রকরণে দেখেছি জীবনানন্দের মধ্যে। আবার দেখলাম মাসুদ খানের মধ্যে। বাংলার প্রাণ-প্রকৃতিই মাসুদ খানের কবিসত্তা নির্মাণ করেছে বলে তিনি সম্প্রতি ‘প্রথম আলো’ পত্রিকায় আলতাফ শাহনেওয়াজকে জানিয়েছেন। একথা বোধ করি সত্য। দেখা যাক সাক্ষাৎকারে কী বলেছেন মাসুদ খান—
হ্যাঁ আমার শৈশবও কেটেছে বগুড়া ও জয়পুরহাটের নানা জায়গায়, পিতার কর্মস্থলে। বরেন্দ্র অঞ্চল। শুকনো মৌসুমে সেখানকার কর্কশ লাল মাটি ফেটে চৌচির হয়ে যায়। ধূলি ওড়ে খরখরে হাওয়ায়। আবার বৃষ্টি হলেই একেবারে কোমল কাদা। আবার আমার কৈশোর ও যৌবনের প্রথমাংশ কেটেছে নরম পলিমাটি-গড়া যমুনা-ধোয়া অববাহিকায়। সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে, মেছড়া গ্রামে, পৈতৃক ভিটেমাটিতে। প্রচুর আলো ও ছায়া, অক্সিজেন, গাছপালা, পশুপাখি, প্রাণবৈচিত্র্য আর প্রাণচাঞ্চল্যমুখর এক জনপদ। নদী সেখানে ভাঙে, আবার গড়ে। তালে তালে তাই মানুষকেও ভাঙতে হয় অনেক কিছু, গড়ে তুলতে হয় পুনর্বার। প্রকৃতি ও জীবনসংগ্রামের এই সব কড়ি-কোমলের টানাপোড়েন ও মিথস্ক্রিয়া, রৌদ্র-রুদ্র-মেঘ-বৃষ্টি-খর্খরতা-নম্রতার এই সব দোলাচল ও মেলামেশা—এগুলোই হয়তো ছাপ ফেলে আসছিল ক্রমাগত আমার চেতনায়-অবচেতনায়। এভাবেই হয়তো ভেতরে-ভেতরে তৈরি হয়ে উঠছিল একধরনের কাব্যিক বোধ। যদিও পারিবরিক পরিবেশ ছিল পূর্বাপর অকাব্যিক।
এই কথাগুলোকে মাথায় রেখে প্রসন্ন দ্বীপদেশ পড়লে দুটি বিষয় বোঝা যায়। একটি বাংলাদেশের ভূগোল। অন্যটি আশির কবিতার স্বভাবের মধ্য থেকে মাসুদ খানের স্বকীয় রাস্তায় বের হয়ে আসার ইতিবৃত্ত। আশির দশকে কবিতাকে শ্লোগান আর বিবরণের একঘেয়েমি থেকে বের করে আনার সাধ্যসাধনা করেছেন এক ঝাঁক নতুন কবি, একথা আমরা জানি। কিন্তু একথাও আমরা জানি যে, কবিতাকে তাঁরা দেশ ও দশ থেকে মুক্ত করে আগের চেয়ে বেশি করে প্রাইভেট প্রপার্টিতে পরিণত করেছেন। সাধারণের প্রবেশাধিকারকে সংরক্ষিত করে দিয়েছেন। কবিতাকে আরো বেশি করে কবিদের মধ্যে আটকে ফেলেছেন। অথবা কবিতা পড়ার দীর্ঘ ট্রেনিং নাই এমন মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছেন। মাসুদ খান প্রসন্ন দ্বীপদেশ কাব্যে কবিতাকে যে মানুষের মধ্যে ফিরিয়ে এনেছেন তা নয়। কিন্তু বেশ কিছু কবিতায় তিনি কবিতাকে দেশের ভূগোলের মধ্যে এনেছেন। এখানেই এই কাব্যের বিশেষত্ব বলে মনে করি। শুধু ভূগোল নয়, কবিতায় কথকতার ভঙ্গির মাধ্যমে কবিতাকে পাঠের আরামের আওতায় নিয়ে আসার একটা প্রয়াস-স্বাতন্ত্র্য বরাবরই মাসুদ খানের মধ্যে দেখা যায়। প্রসন্ন দ্বীপদেশ কাব্যের বেশ কিছু কবিতায় এই চেষ্টা যে-কারো চোখে পড়বে। আগেই বলেছি, তার মানে আমার বলার চেষ্টা এই না যে, মাসুদ খান কবিতাকে মানুষের মধ্যে নামিয়ে এনেছেন। কবিতার সে কপাল স্বভাবতই অনেক আগেই পুড়েছে। সে ভিন্ন আলাপ।
মাসুদ খান তাঁর এই বইয়ে যখন বিশ্ব-অভিযাত্রায় বেরিয়েছেন, তখন প্রায়শই দর্শন বা ভাববস্তু কবিতার চেয়ে মুখ্য হয়ে উঠেছে।
তো, আমরা যে আলাপ করছিলাম। প্রসন্ন দ্বীপদেশ কাব্যের পঞ্চম কবিতা ‘হর্ষতরঙ্গ’ পড়ে তব্দা হয়ে গেলাম। তব্দা খাইলাম কবির কল্পনা, বুনন, ভাষা, শব্দসজ্জার মধ্যকার টুংটাং আওয়াজ আর ওই যে দ্বীদেশের স্বরূপের আবিষ্কার দেখে। কবি কী বলতে চাইলেন তা খোঁজার প্রয়োজন বোধ করলাম না। সাথে সাথে পুরো বই জুড়ে মাসুদ খানের চোখে দ্বীপদেশ দেখার জন্য নড়েচড়ে বসলাম। ভাবলাম পুরো কাব্য জুড়ে মাসুদ খান দ্বীপদেশের প্রজেক্ট নিয়ে হাজির হবেন বোধ হয়। মজা লুটার জন্য সন্তর্পণে পাতা উল্টালাম। পড়লাম পরের কবিতা ‘চারুশিল্প’। মারাত্মক ধাক্কা খেলাম! দেখি খানের মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে। তিনি দ্বীপদেশ থেকে অভিযাত্রা শুরু করেছেন বিশ্বের দিকে, এমনকি মাঝে মধ্যে অধিবিশ্বের দিকে। পৃথিবী নিয়ে তাঁকে ক্রমাগত খুব বিচলিত আর বিষণ্ন মনে হতে লাগল। সভ্যতা, বিশ্ব অর্থনীতি, সমাজনীতি নিয়ে তিনি ক্রমাগত ভেবেছেন আর বিপন্ন বোধ করেছেন। বিপন্ন হয়ে কাতরিয়ে উচ্চারণ করে উঠেছেন—‘দেশে দেশে রাজদণ্ড আজও রতিবাহিত ব্যাধির মতো চণ্ড।/স্নিগ্ধ বাতাসের দেশে, কূটবেশে, গুপ্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষারূপে/সুপ্ত থাকে ঘূর্ণ্যমান হিংস্র হ্যারিকেনে-মত্ত ও মাংসাশী।’ মাসুদ লক্ষ করেছেন বাণিজ্যনির্ভর বিশ্বব্যবস্থার সূত্র—‘যদি বাড়ে জন্মহার,/বাণিজ্য বাড়বে তবে শিশুখাদ্য ও ডায়াপারের/আর মৃত্যু বাড়লে চিরবিদায় স্টোরের। জন্ম মৃত্যু যেটাই বাড়ুক/বাণিজ্য বাড়বেই।’ এইসব ভাবনা যখন এখানে সেখানে নানা কবিতায় ইতিউতি উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল তখন হঠাৎ ‘জ্ঞাতি’ নামের কবিতা পড়ে বুঝলাম প্রসন্ন দ্বীপদেশ কাব্যের বারো আনা জায়গা জুড়ে কবির কিসের এত হাহাকার উৎকণ্ঠা আর চাপা ক্ষোভ। বুঝলাম মাসুদ খানের হৃদয় ব-দ্বীপ থেকে উদ্বাহু হয়েছে বিশ্বের দিকে। বিশ্বের মঙ্গলামঙ্গল কবিকে ভাবনা-ব্যাকুলতার মধ্যে ফেলেছে। কবির বিশ্বাত্মবোধ প্রকাশিত হয়েছে এভাবে—
অগণন অচেনা মানুষ
পৃথিবীর নানা প্রান্তে, দ্বীপে, দ্রাঘিমায়…
তুমি বংশলতা ধরে ধরে চলে যাচ্ছ ধীরে ধীরে
সময়ের উজানে। এবং দেখে আসছ—
দুনিয়ার প্রত্যেকটি মানুষই তোমার
ভাই কিংবা আত্মীয় পরম।
এমনকি প্রতিটি উদ্ভিদ, জীব, অণুজীব…
সবই বাঁধা দূরসম্পর্কের জ্ঞাতিত্বে তোমার।
এই বোধই কবিকে তাড়িত করেছে ব-দ্বীপ থেকে বিশ্বে।
কিন্তু একটা কথা বলতেই হবে, মাসুদ খান তাঁর এই বইয়ে যখন বিশ্ব-অভিযাত্রায় বেরিয়েছেন, তখন প্রায়শই দর্শন বা ভাববস্তু কবিতার চেয়ে মুখ্য হয়ে উঠেছে। কবি মাসুদ খান স্থানে স্থানে যেন ধোঁয়াশা হয়ে উঠেছেন। কবিতা ঠিক যেন দানাদার হয়ে ওঠে নি। কোনো কোনো কবিতায় মাসুদ খানকে অপ্রস্তুত মনে হয়েছে। মনে হয়েছে বিশ্বকে আলিঙ্গন করার মতো একটা বিরাট হৃদয় নিয়ে তিনি দুই হাত ছড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু হাতের মাপ ছোট হওয়ায় সে আলিঙ্গন অসম্পূর্ণ রয়ে গিয়েছে। বিড়াল সম্পর্কে একটা কথা চালু আছে। বিড়াল গৃহস্থের ঘরের কোথাও ঘুমানোর আগে চারদিক ভালো করে দেখে নেয় বিপদের সময় কোথায় লাফ দেবে, কিভাবে ঠিক ঠিক পার হয়ে যাবে। আক্রান্ত হলে বিড়াল অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঠিকই লাফিয়ে নিরাপদে বের হয়ে যায়। বিড়ালের লাফ সাধারণত মিস হয় খুব কম। লেখকের বক্তব্য আর শিল্পিতার ব্যাপারটা কিন্তু বিড়ালের লাফিয়ে নিরাপদে পার হয়ে যাবার মতো। কথার মাপে তিনি বানিয়ে তোলেন তাঁর শিল্পের খাপ। কিন্তু কথা যখন বড় হয়ে যায় কিন্তু খাপটা ছোট থাকে তখন পাঠক হোঁচট খায়। প্রসন্ন দ্বীপদেশ কাব্যগন্থের কিছু কবিতায় এই বিষয়টি লক্ষ করা যায়। বিশেষত, কবি যেখানে বিশ্বভাবনায় উদ্বেল সেখানে। কিন্তু এই ঘরানার কয়েকটি কবিতা আবার দারুণ খাপে খাপে মিলে গিয়ে পাঠককে স্তব্ধ করে দেয়। এরকম একটি কবিতা ‘রসমঞ্জরি’। এই কাব্যের একাধিক কবিতায় মাসুদ খানকে দেখা গিয়েছে যুদ্ধবিরোধী চেতনায়। বিশ্বব্যাপী যুদ্ধোন্মাদনা কবিকে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। কারণ, যুদ্ধের সাথে মানুষের ভাগ্য অনিবার্যভাবে জড়িয়ে যায়। যুদ্ধের ধ্বংসের নির্মম সত্যকে মাসুদ খান এমন আশ্চর্য সংযমশিল্পিতায়, নিরাসক্তিতে তুলে ধরেছেন যে, কবিতাটি পাঠ শেষে রক্ত হিম হয়ে আসে। লোভ সামলাতে না পেরে পুরো কবিতাটি তুলে দিতে চাই—
শান্ত সমুদ্রে ভেসে চলেছে একা এক রণতরি।
দূর থেকে মনে হচ্ছে যেন
অনন্ত ময়রার গোল গামলাভরা রসের ওপর ভাসছে
এক আয়তাকার রাঘব রসমঞ্জরি—
উপরিভাগে একটি একটি করে বসানো সব বুন্দিয়া
আর কুড়মুড়ে পেস্তা বাদাম।
মিঠাইয়ের দিকে চঞ্চু ব্যাদান করে তেষট্টি ডিগ্রি কোণে
তেড়ে নেমে আসছে এক মহাকায় খেচর।
ওই হা-করা ধেয়ে-আসা চঞ্চু তাক করে ছুটল মিসাইল মুহুর্মুহু।
অবিশ্বাস্য বেগে ছুটে-আসা সেইসব জ্যান্ত মিসাইল,
পেছনে লাঞ্চার, তারও পেছনে ডেকের ওপর
পেস্তা বাদাম বুন্দিয়ার মতো ছড়ানো-ছিটানো সব কামান ও জঙ্গি বিমান
আর জলযোদ্ধাদের কৃত্য ও কম্যান্ড
আর এই সবকিছু ধারণ করে আছে যে বহুতল রণতরি…
সুড়ুত করে সমস্তটাই টেনে নিল পাখি এক টানে, দ্রুত চঞ্চুক্ষেপে।
পাখির ঠোঁট আর কশ বেয়ে তখনো ঝরছে রসমঞ্জরির রস।
‘পাখির ঠোঁট আর কশ বেয়ে তখনো ঝরছে রসমঞ্জরির রস’—আশ্চর্য নরম সুরে একটা নির্মম ধ্বংসচিত্রকে প্রকাশের এই ধরনের মুন্সিয়ানার মুখোমুখি হলেই বোধ করি পাঠক তব্দা খায়! শিল্প আর ভাবের মনিকাঞ্চনযোগের কবিতা এই কাব্যে আরো আছে। যেমন, ‘সাক্ষাৎ’ এবং ‘উচ্চতর বাস্তবতা’। চেখে নেয়া যাক ‘সাক্ষাৎ’ কবিতার একটি স্তবক—
কতদিন হলো তুমি নেই এই দেশে।
উঠানে বরইয়ের গাছে চুপচাপ
ঘনিয়ে-জড়িয়ে-থাকা স্বর্ণলতাগুলি
এতদিনে বদলে গেছে জং-ধরা তামার তন্তুতে।
মৌমাছিরা সেই কবে উড়ে গেছে দূরের পাহাড়ে
ফাঁকা-ফাঁকা স্মৃতিকোষ হয়ে ঝুলে আছে
এখনো মৌচাক, কৃষ্ণচূড়া গাছে।
গুঞ্জনের রেশ, মধু ও মোমের অবশেষ, কিচ্ছু নেই
কোনোখানে।
ফিরে আসি আগের প্রসঙ্গে। প্রসন্ন দ্বীপদেশ-এর কবিতাগুলো পড়া শেষ করলাম। কিন্তু বাংলাদেশের ভূগোলের প্রাণ-প্রকৃতি, মানুষ যেসব কবিতার লক্ষ্য-উপলক্ষ, সেসব কবিতার প্রতি মোহ আমার রয়েই গেল। একটা অতৃপ্তি যেন তাড়া করে ফিরতে লাগল। কারণ, ‘সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে!’