কবি ফ্রাঞ্জ রাইটের সাক্ষাৎকার
মূল: ইলিয়া কমিনস্কি ও ক্যাথরিন তাওলার
বাঙলায়ন: ঋতো আহমেদ
পনেরোটি কবিতা বইয়ের লেখক ফ্রাঞ্জ রাইট। জন্ম ১৯৫৩’র মার্চে। আমেরিকার কবি তিনি। ইংরেজি কবিতায় ফ্রাঞ্জ রাইট এবং তাঁর বাবা জেমস রাইট এক অভূতপূর্ব উদাহরণ হয়ে আছেন। কারণ, বাবা আর ছেলে দু’জনই একই ক্যাটাগরিতে পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী হয়েছিলেন। কিশোর বয়সে কবিতা লিখতে শুরু করেন ফ্রাঞ্জ। তখন তার বাবা আলাদা থাকতেন। তাঁর প্রথম কবিতা পড়ে প্রতিউত্তরে বাবা চিঠিতে লেখেন, “তুমিও কবি হয়ে জন্মেছো। এসো, এই নরকে তোমাকে স্বাগতম।”
ভিয়েনায় জন্মেছিলেন এই কবি। বেড়ে ওঠেন ক্যালিফোর্নিয়ায়। এমারসন কলেজ ও আরকানসাস বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। মেসাচুসেটস্-এ মানসিক স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে কাজ করেছেন। স্বেচ্ছাসেবী হয়ে কাজ করেছেন সেন্টার ফ গ্রিভিং চিল্ড্রেন-এ।
১৬ বছর বয়সে তাঁর প্রথম ডিপ্রেশন দেখা দেয়। পরবর্তীতে মানসিক বিষণ্নতা প্রকট আকার ধারণ করে। বহু বছর এই সমস্যায় ভোগেন। নিজের ড্রাগ আসক্তি আর মদ্যপানের বিরুদ্ধে বহুকাল লড়ে গেছেন তিনি।
২০১৫ সালের ১৪ই মে এই কবির মৃত্যু হয়।
তার উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে—
I11 Lit: New and Selected Poems (1998),
The Beforelife (2001),
Walking to Martha’s Vineyard (2003),
God’s Silence (2006)
এছাড়া অনুবাদ করেছেন René Char, Erica Pedretti আর Rainer Maria Rilke। ২০০৪সালে Walking to Martha’s Vineyard কাব্যগ্রন্থের জন্য পুলিৎজার পুরস্কার পান।
কবিকে জানতে, আসুন আমরা আজ এই কবির একটি সাক্ষাৎকার পড়ি।
সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন যৌথভাবে ইলিয়া কমিনস্কি এবং ক্যাথরিন তাওলার। বাঙলায়ন: ঋতো আহমেদ
সাক্ষাৎকারী : প্রথম কখন বুঝতে পারেন আপনি লিখতে চান? আপনার এমন কোনো বিশেষ অভিজ্ঞতা আছে কি যা আপনাকে কবিতায় নিয়ে এসছে?
ফ্রাঞ্জ রাইট : আমার বয়স তখন চৌদ্দ, কিন্তু লিখব এমন তখনও মনে হয়নি। বরং আমার আগ্রহ ছিল সঙ্গীতশিল্পী হওয়ার কিংবা বিজ্ঞানী। তারপর পনেরোতে এসে কিছু একটা হলো আমার। আপনার মতো এরকম প্রশ্ন অনেকে করেছে আমাকে, আমি হাস্যকর একটি কথা সবসময় বলেছি, “লিখা ব্যাপারটা আমাকে বজ্রবিদ্যুতের মতো আঘাত করে।” কথাটা আসলে সত্যি নয়। গ্রীষ্মের ছুটিতে একবার সৎবাবা, মা আর আমি ক্যালিফোর্নিয়ার নাপা উপত্যকার উপর দিয়ে ক্লিয়ার বিলে বেড়াতে গিয়েছিলাম। একদিন খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল আমার, অদ্ভুত এক অনুভবে আবিষ্ট হয়ে হাঁটতে হাঁটতে নিচে নেমে আসি। সেখান আখরোট বাগানে এসে বসি। দারুণ এক ঘোরের ভেতর পরমানন্দে লিখতে শুরু করি। সাত লাইনের একটি কবিতা লিখে ফেলি। তারপর বাবাকে পাঠিয়ে দিই। এরপর কবিতা বিষয়ে আমরা পরস্পরের সাথে যোগাযোগ আরম্ভ করি। পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম এমন ঘোরের ভেতর দিয়ে আমাকে আবারও যেতে হবে। আগে কখনও এমন অনুভূতি হয়নি আমার। মনে হচ্ছিল এটাই করা উচিত ছিল এদ্দিন। সেই থেকে এইরকম আচ্ছন্ন হওয়া কখনো বন্ধ হয়নি আর। তাগিদ অনুভব করেছি সবসময়। আধ্যাত্মিক ব্যাপারের মতো কিছুটা রহস্যময় এই ডাক। সব ছেড়েছুড়ে আমাকে লিখতে হবে। সাংঘাতিক মনে হয়েছে একে। ভেবেছি আমার সম্পূর্ণ ভবিষ্যৎ দেখতে পাব। হয়তোবা আমাকে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ত্যাগ করতে হবে। হয়তো এটি কোনও আত্ম-পূর্ণতায় পৌঁছানো, দৈববাণী, কারণ পরবর্তীতে বাস্তবিক আমার কোনও জীবন ছিল না, আমি ছিলাম মাতাল, আর উন্মাদ। মনে হয় তখন কিশোর হিসেবে, সেই অনেক আগে, ড্রাগ নিয়ে কখনও বিপদে পড়তে হয়নি, এমনকি মানসিক সমস্যাও হয়নি আমার, কবিতা লিখাই ছিল আমার কাজ। দারুণ আনন্দিত ছিলাম যা অন্য কিছুতেই পাইনি। এছাড়া বলার মতো আর কোনও অভিজ্ঞতা নেই আমার। সবসময় একটা ঘোর আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে, প্রথম কবিতা লিখার সেই ঘোর আমার।
সাক্ষাৎকারী : কবি হতে হলে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ত্যাগ করতে হবে এমন কেন মনে হয়েছিল আপনার?
ফ্রাঞ্জ রাইট : জানি না। ওটা এক ধরনের প্রবণতা বলতে পারেন। মনে হয়েছিল কিছু মানুষ আছেন যারা সাফল্যের সাথে শিল্পী জীবন আর সাধারণ জীবনের যাপনে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারেন। আবার কেউ কেউ আছেন তা পারেন না। অনেক কবি আছেন, যাদের আমি জানি তারা সাহিত্য চর্চা ছাড়া আর কিছুই পারেন না। তাদের জীবন কঠিন ও দুঃখ দুর্দশাগ্রস্ত। আমিও সেই রকম একজন। ধীরে ধীরে এটা প্রকাশ পেয়েছে। ব্যাপারটা আমার ইচ্ছাধীন ছিল না। ছিল অবশ্যম্ভাবী।
সাক্ষাৎকারী :আপনার বাবাও কি সেই রকম সাহিত্যিক ছিলেন যাকে কঠিন জীবনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল?
ফ্রাঞ্জ রাইট : না, বাবার জীবন ছিল সাফল্যমন্ডিত। আমার বাবা স্বাভাবিক জীবনের বাইরে গিয়ে যোগ্য হয়ে ওঠেননি, বরং জীবনের গতির ভেতরে থেকেই দারুণ যোগ্য ও শক্তিমান ছিলেন। তিনি ছিলেন প্রকৃত শিক্ষকদের একজন। আরও অনেকে ছিলেন এইরকম, যেমন বেরিম্যান, রোথেক, আমার বাবা। সাহিত্য বিষয়ক তাদের আলাপচারিতা শুনতে পারা মানে এক বিস্ময়কর শিক্ষা গ্রহণ। আমার শোনা কথাবার্তার মধ্যে তাঁর কথাগুলো ছিল সবচেয়ে মেধাবী। অস্কার ওয়াইল্ড অথবা স্যামুয়েল জনসন সম্পর্কে মানুষ যেমন বলে অনেকটা সেইরকম। তিনি ওইসব অসাধারণ, অশেষ আর উদ্দীপ্তকারী বক্তব্য দিয়ে গেছেন। এমনভাবে গল্প উপন্যাসের চরিত্র নিয়ে কথা বলেছেন মনে হয়েছে যেন ওইসব চরিত্রের সাথে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক রয়েছে। তিনি ক্যাটালাসকে নিয়ে কথা বলেছেন যেন সে তাঁর পাশের বাড়িতে থাকে। ক্লাস-এ তিনি ছিলেন অসাধারণ। শিক্ষক হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য উপযুক্ত। ছিলেন দায়িত্ববান। নিজের খেয়াল রাখতে পারতেন। ওইরকম জীবনের বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত থেকেও লিখতে পারতেন।
তবে, আমি সেরকম ছিলাম না। স্কুলে ভালো করেছিলাম যদিও। তবু, ভরণপোষণ সংক্রান্ত বিষয়ে আর আমার বাবার অনুপস্থিতির কারণে আমার কিছু সমস্যা হচ্ছিল। আমার মা পরবর্তীতে যাকে বিয়ে করেন সে ছিল বর্বর প্রকৃতির। শারীরিকভাবে নির্যাতন করতো। মাঝেমধ্যে আমাকে আর আমার ভাইকে মারধর করতো। বাবা-মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদে আমরা ভেঙে পড়েছিলাম। যখন ওই সৎবাবা এলো তখন আমার বয়স এগারো কী বারো, মন ভেঙ্গে গিয়েছিল আমার। আঠারো হতে না হতেই নিজেকে সম্পূর্ণ পরাজিত মানুষ বলে মনে হতে লাগল। জগৎ-সংসার ভীতিপ্রদ হয়ে উঠলো। বেঁচে থাকার কোনও উপায় খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ওবার্লীনে গিয়ে কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিলাম। কিন্তু খুব দ্রুত সেই দিনগুলোও ফুরিয়ে যায়। চার্লস রাইটের সাথে আমিও চেয়েছিলাম ইউসি আইয়ারভিন-এ স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হবো। ওটাই আমার জন্য দারুণ বাস্তবতা ছিল। কিন্তু পড়ালেখার ওই জগতে আমি দাঁড়াতে পারিনি আর। স্পষ্টতই মনে আছে, ছয় মাসের মাথায় স্নাতক ছেড়ে দিই আমি। ভাবি পথই আমার ঠিকানা, পথেই আমার শিক্ষা।
বাবার প্রভাব আমার উপর এতোটাই বিস্তার করেছিল, যে কিশোর হিসেবে তখন নিজেকে তাঁর সন্তান জেনে গর্ব বোধ করতাম। একধরনের অতিরঞ্জিত ধারণা পোষণ করেছি তাঁর ব্যাপারে। এখন আমি বুঝতে পারি বিখ্যাত হওয়া আসলে কী। আমি একজন বিখ্যাত কবি আজ। এর মানে আসলে তেমন কিছুই না। যখন ছোট ছিলাম, মনে হোতো বাবা একজন দেবতুল্য ব্যক্তিত্ব। উনিশ বছর বয়সে যখন আমার কবিতা ছাপা হওয়া শুরু হলো সবাই বললো, “হ্যা, তোমার জন্য এ-তো খুব সহজ কারণ তোমার পেছনে আছেন তোমার বাবা।” এখন ভেবে দেখলে মনে হয় ব্যাপারটা উল্টো। যখন কোনও প্রতিষ্ঠিত লেখকের সন্তান লিখতে আর প্রকাশ করতে চেষ্টা করে আমার কেমন যেন সন্দেহ হয়। ছোট বেলায় আমার এমন হয়নি। কিন্তু এখন হয়। আমি নিশ্চিত তখন মানুষ ওভাবেই আমাকে দেখেছে।
সাক্ষাৎকারী :অনেক লেখককে বলতে শুনেছি কীভাবে লেখা তাদেরকে সুস্থির রাখে আর তাদের বেঁচে থাকাকে অর্থবহ করে তোলে। আপনার ক্ষেত্রেও কি এটা সত্যি?
ফ্রাঞ্জ রাইট : আমি বলবো যথাসম্ভব লিখা-লিখি আমার ভালো থাকার একটি কারণ। যখন আমার অসুস্থতা অথবা মদ্যপান নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তখন আমার লিখাই আমাকে প্রেরণা যোগায়, নিজেকে বলতে পারি “দাঁড়াও” আর আমি ঘুরে দাঁড়াতে নিজেকে তৈরি করি এবং সুস্থ হয়ে উঠি। এর মধ্যে কোনও থেরাপি-টেরাপি বলতে কিছু নেই। বরং উল্টো। উন্মত্তের মতো এগিয়ে নেয় যেন। লেখা আমাকে স্থিরতা দেয় আর জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে শক্ত ধারণা প্রদান করে। সময়ে সময়ে নিজেকে এর জন্য গড়ে নিই আমি।
পৃথিবীকে উপলব্ধি করি ভাষার মাধ্যমে, যেমনটি সব লেখক করেন। ছোটবেলা থেকেই, বই পড়তে গিয়ে সবসময় মনে হয়েছে আমি দ্বৈত জীবনে আছি, যাকে বলা যায় দু’বার বাঁচা, জাপানি কবিরা যেমনটি বলেছেন। আমার সৌভাগ্য যে এমন শাশ্বত দ্বিতীয় জীবন পেয়েছি, এমন দ্বিতীয় মহাবিশ্ব আমার ভেতর, যাকে সর্বদা আশপাশে বয়ে বেড়াচ্ছি। যেন এক প্রেমের ভেতর, যেন এক দারুণ গোপন জীবন। পৃথিবীকে জ্যোতির্ময় করে তোলে। এ এক এমন কিছু যা পৃথিবীর প্রতিটি বস্তুকে প্রাণময় করে তুলতে আমার প্রয়োজন। একে পাই আমার কাব্য-প্রেমের ভেতর। শুধুমাত্র লেখা নয়, বরং কাব্য-প্রেমে স্বয়ং। আমি সবসময় কবিতা লিখতে চেয়েছি যেন সেই সব মানুষের সহচর্য পাই, যেন তাদের একজন হতে পারি যারা পৃথিবীতে এমনটা বাস্তবে করে দেখিয়েছেন।
মনে আছে ছোটবেলায় আমার ধারণা ছিল পৃথিবীর এমনই একজন কবি আছেন। কখনওবা যদি তুমি খুব ভাগ্যবান হও আর খুব পরিশ্রম করো, হয়তোবা তুমি কিছুক্ষণের জন্য সেই কবি হয়ে উঠতে পারো। এক মুহূর্তের কবি হয়ে উঠতে তোমার সমস্ত সময় ব্যয় করে আসছো। ইতিমধ্যে, কবিতাকে তুমি ভালবাস। নিজেকে কবি বলতে এখনও অস্বস্তি হয় আমার। বরং কবিতায় নিয়োজিত একজন ভাবি নিজেকে। যদি আবারও সেই আশির্বাদপুষ্ট চেতনায় আবিষ্ট হতে পারি, লিখতে পারি কবিতা, আমার মনে হয় কেবল ওই মুহূর্তেই আমি একজন কবি।
সাক্ষাৎকারী : এই আশীর্বাদপুষ্ট চেতনায় আবিষ্ট হওয়া ব্যাপারটা আসলে কী, যা আপনাকে লেখায়?
ফ্রাঞ্জ রাইট : আসলে এটা কোত্থেকে আসে আমি জানি না । আমি এমন নই সবসময়। হঠাৎ আবিষ্ট হওয়ার মতো, মানসিক অবস্থার কেমন এক পরিবর্তন যেন। সাধারণভাবে আমার মনের অবস্থা ওরকম থাকে না। স্পষ্টতই বিশেষ স্তরের অনুভূতিশীল হয়ে উঠি আমি। প্রতিদিন লিখতে চেষ্টা করি আর নিরানব্বই ভাগ সময়ই নিজেকে উজবুক মনে হয়। আর যখন ওই বিশেষ চেতনায় আবিষ্ট হই যখন আমার সেরা কাজগুলো করি, তখন এক ধরনের আরাম আর প্রতিভার অনুভব হয় আমার ভেতর। বলতে গেলে এইসব মুহূর্তগুলোর জন্যই আমার এই বেঁচে থাকা। কিন্তু এগুলো এতোই দুর্লভ, যদি আমি অপেক্ষায় থাকি তাহলে হয়তো বছরে দুটোর বেশি কবিতা লিখা হবে না আমার। দিনের মধ্যে বেশ কয়েক ঘণ্টা লিখতে চেষ্টা করি, রসদ খুঁজে জড়ো করে রাখি যেন সেইসব মুহূর্ত এসে আবিষ্ট করলে তা কাজে লাগে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি প্রেরণার আশায় বসে থাকাটা একরকম বোকামিও। তাই আমি সেটা খুঁজতে থাকি।
বিভিন্নভাবে আমি এটা ভুল পথেও পেতে চেয়েছিলাম— মাদক সেবন, অবাধ যৌনাচার আর সমস্তরকম শোচনীয় ব্যবহারের মাধ্যমে চেয়েছিলাম খুঁজতে। কিন্তু এখন আমি আশাবাদী,– বদলাচ্ছি নিজেকে। জীবনের অধিকাংশ সময়, যে কোনও চরম অভিজ্ঞতাকে প্রেরণা হিসেবে পেতে চেয়েছি। কখনও কখনও সেটা ঠিক ছিল। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে গিয়েছি, আঘাত পেয়েছি বারবার এবং অবশ্যই অন্যদেরও কষ্ট দিয়েছি খুব। এখন আমি জানি, সত্যিকার অর্থে সেই প্রেরণা এসব থেকে আসে না। আসে অন্য কোনও জায়গা থেকে। আমার করণীয় শুধু এর জন্য নিজেকে তৈরি রাখা, এর আবির্ভাবের পথের দিকে নিজেকে স্থির দাঁড় করানো, কামনা করা, আকাঙ্ক্ষা করা, এর জন্য নিজেকে যোগ্য করে তোলার চেষ্টা করা। অভাবনীয় নম্রতার প্রয়োজন, প্রয়োজন সেই সত্যিকারের প্রেরণার গতির ভেতর পৌঁছুতে ব্যর্থতার অসংখ্য পথ মাড়িয়ে যাবার দারুণ ইচ্ছেশক্তির।
সাক্ষাৎকারী : মনে হচ্ছে যেন আপনি এক আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিচ্ছেন।
ফ্রাঞ্জ রাইট : অনেকটা একইরকম হলেও, ভিন্নতা আছে। গুলিয়ে না ফেলার চেষ্টা করি আমরা। আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় অবশ্যম্ভাবী মুহূর্তগুলো, আর সৃষ্টির প্রেরণার মুহূর্তগুলো, আর সমাগত সেইসব প্রেমপূর্ণ মুহূর্তগুলো যেগুলো পৃথিবীর আর পৃথিবীর অন্য প্রাণের প্রতি ভালোবাসায় উৎসারিত হয়—এদের সবার একই রকম আবেগানুভূতির রং থাকলেও প্রত্যেকে কিন্তু আলাদা। যখন শিল্পের প্রেরণায় উজ্জীবিত হই তখন আমি নির্মম আর স্বার্থপর। এর জন্য সবকিছুই করতে পারি তখন। নিজেকে, এমনকি পরিপার্শের যে কাউকে উৎসর্গ করে ফেলতে পারি। সত্যি বলতে এটা আমাকে একধরনের অপরাধীয় পরমানন্দ দেয়। একটা সমস্যাই বলা যায় একে। তবে, একটা সাধারণ ব্যাপার ঠিক দুটো বিষয়েই আছে। সেটা হচ্ছে সেখানে পৌঁছতে হলে তোমাকে অবশ্যই দীর্ঘ, রুক্ষ, ভয়ানক আর যন্ত্রণাময় সময়ের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। সেই মোক্ষম মুহূর্তে পৌঁছুতে হলে যেতে হবে একই আনন্দ, ইচ্ছেশক্তি আর সক্ষমতার মধ্য দিয়ে।
নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, অতীতের দিকে ফিরে তাকিয়ে আমার কাছে পরিস্কার হয়ে গেছে এখন, যা কিছু সৌভাগ্যের, সুন্দর আর আনন্দের চেহারা নিয়ে উচ্চকিত হয় তার পরিনতি হয় ঠিক এর বিপরীত, ঠেলে দেয় বিপর্যয়ের দিকে। আর যা কিছু বিপর্যয়ের, বেদনার আর ভয়ঙ্কর তা আমাদের নিয়ে যায় আত্মার উন্মেষের দিকে। তাই আমি এখন এইসব বেদনাক্লীষ্ট সময়কে ভালো কিছু হিসেবে গ্রহণ করতে সক্ষম যেখানে প্রেরণা আমাকে সামগ্রিকভাবে হৃদ্ধ করে তোলে। মানে হলো, আমি ঠিক পথেই এগুচ্ছি।
সাক্ষাৎকারী : সাত বছর আগে আপনি ক্যাথলিক হয়েছেন। আমরা জানতে চাইছি কীসের প্রেরণায় খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত হলেন আপনি?
ফ্রাঞ্জ রাইট : খ্রিস্ট ধর্ম সমসময় আমার ভালো লাগতো—এর সুন্দর সুন্দর কথা, আচার অনুষ্ঠান, ইতিহাস এবং যীশুর প্রথম শিষ্যদের সেই মহত্ত্ব গাঁথা এইসব। বাস্তবতার মুখোমুখি তাদের সেই বিশ্বাস সংক্রান্ত অভাবনীয় ও দুঃসাহসিক ঘটনাগুলোকে সর্বদা প্রশংসা করেছি। তখনকার রোমান সাম্রাজ্যে বাস করা তো ছিল দারুণ ভয়াবহ। এখন এই বিংশ বা একবিংশ শতাব্দীর চেয়ে খারাপ অবস্থায়ও ওঁরা ছিলেন অসাধারণ। বাস্তবে অসম্ভব কোনো কিছুর উপর সেইসব মানুষের দারুণ, দৈব বিশ্বাস আমাকে —আমার বুদ্ধিমত্তায় ঈর্ষান্বিত করে। কলেজে পড়ার সময় এর উপর পড়াশোনা করেছি। তখন আগ্রহ জন্মায়। বিশেষ করে বিংশ শতাব্দীর জার্মান প্রোটেস্ট্যান্টদের ওই ধর্মতত্ত্ব। যেখানে তারা নিউ টেস্টামেন্ট অধ্যয়ন করার অভিনব উপায় বের করেছিলেন। যীশুর বাণীর নির্দিষ্ট কোনও একটি বিষয়কে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে এর নির্যাস নির্ণয় করাই ছিল সেই অধ্যয়ন পদ্ধতি। তখনকার খ্রিষ্টিয় সম্প্রদায়ের প্রতি গভীর আগ্রহ বোধ করেছিলাম। যেখানেই বছর খানেক থেকেছি সেখানেই নিজেকে ক্যাথলিক চার্চের কাছে নিয়ে গেছি বারবার। আমার মা ছিলেন গ্রিক। আমাকে গ্রিক অর্থোডক্স সার্ভিসে নিয়ে যেতেন ছোট বেলায়। কিন্তু কোনও-না-কোনওভাবে, চলে যেতাম ক্যাথলিক চার্চে। ভীরের মধ্যে পেছনে বসে থেকে সেখান ওদের মাঝে গভীর আনন্দ পেতাম। ক্যাথলিক হওয়ার পর দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলাম। প্রায় আড়াই বছর। মনে হয়েছিল আমার সেই মনটা হারিয়ে গেছে এবং আমি আর লিখতে পারবো না। আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে গিয়েছিলাম।
এরপর কিছু একটা হলো আমার মধ্যে। পরিচয় হলো এক তরুণীর সাথে যাকে আমি বিয়ে করবো পরে। মদ খাওয়া ছেড়ে দিলাম। সুস্থ হতে থাকলাম আস্তে আস্তে। ওয়াল্থামে চলে এলাম,যেখানে আমরা এখন বসবাস করছি। একদিন, যেমনটি সবসময় করি, একটা ক্যাথলিক চার্চ পেয়ে প্রার্থনায় বসে গেলাম। সেই সকালে, এটা হঠাৎই মনে এলো আমার। ভাবলাম, “যাদের এতো ভালো লাগে, কেন আমি তাদেরই একজন হয়ে যাচ্ছি না?” যদি কেউ বিশ্বাস করে এটা সম্ভব, কে-ই-বা সেটা অস্বীকার করবে। খ্রিষ্ট ধর্ম আমার ঐতিহ্য। বিভিন্ন রকম ধর্ম আছে যেমন বৌদ্ধধর্ম, ইহুদি ধর্ম, ইসলাম ধর্ম, অথবা হিন্দু ধর্ম—আমি মনে করি এগুলো সব একই অভিজ্ঞতার ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ—আর এগুলোর মধ্যে ক্যাথলিক ঐতিহ্যই হচ্ছে আমার আশ্রয় আমার আনন্দ। এর মানে হচ্ছে সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যে বিশ্বাসের এই জীবনে বেঁচে ওঠার সবগুলো চেষ্টার একটি আশ্চর্য সমন্বয় এই আনন্দ। তাই ওই প্রার্থনা শেষে যাজকের কাছে যাই, জানতে চাই, “কীভাবে আমি ক্যাথলিক হতে পারি?” আমাকে খুবই কিম্ভূত দেখাতো তখন, যেন কেউ পিটিয়েছে খুব। পড়নের পোশাক থাকতো নোংরা। দাঁত মাজা হোতো না। ওজন ছিল এখনকার চেয়ে অনেক বেশি, প্রায় ৬০ পাউন্ড। এরকম নিদারুণ দুর্দশাগ্রস্ত ছিলাম। যদিও যাজক আমাকে দেখে ভয় পেয়েছিলেন প্রথমে, পরে জানিয়েছিলেন এটা, তবু তিনি আমাকে তার প্রাথমিক কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করে নেন। সেইসব সভায় প্রায় এক বছর নিয়মিত অংশগ্রহণ করি আর তারপর দীক্ষিত হই। তখন আমার বয়স ৪৭। খুব আনন্দের সময় সেগুলো।
হ্যাঁ, দীক্ষিত হওয়ার পরপরই যৌন নির্যাতনের ওইসব কুৎসা রটে। যেসব বন্ধুরা আমাকে নিয়ে হাসিতামাশা শুরু করেছিলো ওরা আস্তে আস্তে থেমে যায়। নারী কেলেঙ্কারি, যৌন কেলেঙ্কারি, গে সমস্যা, সমস্ত রাজনৈতিক সমস্যা, অলৌকিক, প্রাচীন, চার্চের বাইজেন্টাইন রাজনীতি, পোপ, পোপের ধনদৌলত, মুকুট, কোনো কোনো যাজকের পৈশাচিকতা—কোনোকিছুই আর আমাকে স্পর্শ করছিল না। যদি জিজ্ঞেস করি, “কেন এই চার্চ, কী মনে হয় তোমার?” আসলে চার্চ মহাপুরুষদের জন্য নয়। চার্চ হচ্ছে অবিকল সেইসব মানুষের জন্য যারা শয়তানের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে এবং সচেতন থাকে। শয়তানের বাস্তবতায় সবাই দারুণভাবে সজাগ থাকে। দস্তয়ভস্কি যেমন লক্ষ করে দেখেছেন, অশুভের প্রতি আমাদের অবিশ্বাসের জন্যই সমানুপাতিক হারে শয়তানের শক্তির বৃদ্ধি হয়। এই বিশ্বাসের অর্থ হলো যখন আমরা এর বিষয়ে সচেতন হবো, এর ভেতর দিয়েই এর থেকে পরিত্রাণের কোনও-না-কোনও উপায় খুঁজে নিবো। মানুষ না বুঝেই শয়তানকে অস্বীকার করে আর এভাবেই ওর কাছে নতিস্বীকারের ভয়াবহ বিপদে পর্যুদস্ত হয়। চার্চ তাদের জন্য যারা স্পষ্টভাবেই নিজের ভেতরের শয়তান আর নিজস্ব অপারগতা সম্পর্কে সচেতন, যারা শয়তান হতে চান না, তবু বারবার নিজেকে সেরকমই দেখতে পেয়ে আতঙ্কিত হন। এজন্যই প্রার্থনা প্রয়োজন প্রতিদিন। এজন্যই প্রতিদিন তোমাকে ক্ষমা পেতে হবে, কেননা ওখান থেকে বেরুবার দু’ঘন্টা পরই আবারও শয়তান ভর করবে তোমার মধ্যে। ঐকান্তিকভাবে ক্ষমা পাওয়ার প্রয়োজন তোমারই। চার্চের ভেতরের রাজনীতি আমার বিষয় নয়। আমার মনে হয় মহিলারাও একসময় যাজক নিযুক্ত হবেন, এমনকি আমাদের জীবদ্দশায়ও হতে পারে এটা। আমি বিশ্বাস করি সবকিছু আস্তে আস্তে পরিবর্তিত হবে। হয়তোবা, যৌন নির্যাতনের কেলেঙ্কারীজনক ঘটনা সমূহ একে তরান্বিত করবে।
চার্চে নিয়মিত অংশগ্রহণের মাধ্যমে ঔৎফুল্ল, গর্ব আর কৃতজ্ঞতা অনুভব করি আমি। আমার কাছে চার্চ মানেই হচ্ছে সাপ্তাহিক প্রার্থনায় নিয়োজিত একদল মানুষ, চার্চ মানেই হচ্ছে সেইসব কর্মময় মানুষের ছোট্ট পবিত্র স্থান। চার্চ মানে ভ্যাটিকান বা পোপ নন শুধু। সাইমন ওয়ায়েল-এর মতে একটি শিক্ষনীয় বিষয় হলো, অন্যদের যেমন দেখায় অথবা তাদের সম্পর্কে আমাদের যা ধারণা তারা আসলে সেরকম নন। আমি নিজেকে যা ভাবি অথবা যা হতে চাই, সেরকম আমি নই। এই উপলব্ধিতে পৌঁছুতে আপনাকে প্রকৃত ক্ষমাশীল হতে হবে। আর ক্ষমাশীলতা ছাড়া, সবকিছুই অসাড়। ক্ষমাশীলতার ক্ষমতা না থাকলে, আপনি আসলে মৃত। তখন আপনি নিজেই ক্ষমা পাওয়ার অযোগ্য। এইটুকু বুঝতে পারার সাথে সম্পর্কিত আছে, নিজেকে ছাপিয়ে উঠতে চাওয়া মানুষের সেই সংগ্রাম। আমি মনে করি, মানুষের ভেতর ক্ষমাশীলতাকে দেখতে, এর মাধ্যমে মানুষকে অথবা নিজেকে জানতে চাওয়ার মধ্যেই রয়েছে জীবনের সামগ্রিক চাবিকাঠি।
সাক্ষাৎকারী :প্রার্থনায় আসা মানুষ আপনার কী কাজে আসে? কী করে, আপনার জন্য তারা?
ফ্রাঞ্জ রাইট : প্রার্থনার ভিড় আমাকে আনন্দিত করে। যে দিন না যাই, তার চেয়ে যে দিন যাই, সেই দিনটি অন্যরকম হয়ে ওঠে, যদি সকালে প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করে আসি। মনে হয় যেন জেগে আছি, বেঁচে আছি, বাড়িতেই আছি একরকম। যখন আমি এর জন্য প্রস্তুত হই সেই সময়, যখন প্রার্থনায় যাই, কালবিলম্ব না করে বসে পড়ি, তারপর সম্পূর্ণ কবিতাটি প্রস্ফুটিত হয়। ঠিক আমার সামনেই ওদেরকে দেখতে পাই, যেন লিখে ফেলা হয়েছে এইমাত্র। এরপর আমি যা করতে পারি তা হচ্ছে, চার্চ থেকে বেরিয়ে দৌড়ে গিয়ে লিখে ফেলি। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারি যদি শান্ত থাকি তবে, যতটা প্রয়োজন, সমস্তটাই স্মরণ করতে পারবো পরে। এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয়। এর পূর্বে প্রায় তিন বছর কিছুই লিখতে পারিনি। একসময় এক বছর সময় ধরে যা কিছু লিখেছি, তার সবকিছু নিয়ে পরে একটি বই ‘দ্য বিফোর লাইফ’ হয়ে উঠেছে। বইটিতে যতগুলো কবিতা আছে তার তিন গুণ বেশি লিখেছিলাম। কিন্তু পরে বেছে বেছে পঞ্চাশটি কবিতা নিয়েছি। তারপর আমার পরবর্তী বই লিখতে শুরু করি, ‘ওয়াকিং টু মার্থাস ভিনিয়ার্ড’। এই বইয়ের অনেক কবিতাই আমি প্রার্থনায় যেতে যেতে, প্রার্থনায় রত অবস্থায়, অথবা ফিরে আসার সময় লিখেছি। বাসায় এসে কেবল টাইপ করেছি। এবং প্রায়শই, কোনও পরিবর্তন করিনি ওগুলোর।
সাক্ষাৎকারী :সত্যিই আগ্রহ উদ্দীপক ব্যাপার, প্রার্থনা আপনাকে কবিতায় ফিরিয়ে এনেছে। আর একটু বিস্তারিত বলবেন কি, কীভাবে প্রার্থনায় যাওয়ার ওই বাস্তব অভিজ্ঞতা আপনাকে কবিতায় ফিরে আসতে সাহায্য করেছিল?
ফ্রাঞ্জ রাইট : আমার একটি অভিজ্ঞতার কথা বলতে পারি যা অন্যদের হয়ে থাকতে পারে বিশেষ করে যখন আমরা পরিবার পরিজন দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকি। মনে হয় যেন আমরা পরিপূর্ণ এবং অকুণ্ঠ ভালোবাসার মধ্যে আছি, মনে হয় নিরাপদ আছি, আছি আমাদের আপনার ঘরে। অন্য কোথাও এমনটা অনুভূত হয়নি কখনও। সমাবেশের এই আনুষ্ঠানিক আয়োজনকে আক্ষরিক অর্থে সামান্য মনে হলেও এটা কিন্তু মহাবিশ্বের সমস্ত শক্তির এইখানে এসে কেন্দ্রীভূত হওয়াও হয়। মনুষ্য সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে নিজেকে অনুভব করেছি আমি। যেন তোমাদের ভোজসভারই একজন আমি। পরিপার্শের সম্পূর্ণ অপরিচিত সবার জন্য ভালোবাসা অনুভব করেছি। আমি এই অনুভব নিয়ে এখান থেকে বেরিয়ে গেছি পৃথিবীর দিকে। পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম বিগত জীবনে আমি সমাজ সংসার নিয়ে ভীত সন্ত্রস্ত ছিলাম। নিজেকে সবসময় আলাদা করে রাখতাম। কারও সাথে মিশতাম না তেমন। কোনও কাজ করতাম না। কিছু শিখতাম না, কেবল দু’একটা ছাড়া। অনেক নোংরা জায়গায়, বাজে পরিবেশে থেকেছি। কখনও কখনও বেঁচে থাকার জন্য বেআইনি কাজও করেছি আমি। কখনওবা ছিলাম আশ্রয়হীন। মানুষ এবং মানুষের পৃথিবীকে নিয়ে ভয় আর আতঙ্কে কেটেছে আমার দিনকাল। তারপর এই অনুভব, এই অকুণ্ঠ গ্রহণ ও ভালোবাসা আমার জীবনের চলার সবচেয়ে গতিময় অভিজ্ঞতা বলবো একে। এটাই আবার আমাকে লিখতে উৎসাহিত করেছে।
একটা ব্যাপার পরিষ্কার করে বলতে চাই আমি, সে হচ্ছে আমার স্ত্রী, বেথ। আমার কাছে সে-ই হচ্ছে এই সমস্ত কিছুর সত্যিকার দুয়ার। বেথ আমার ছাত্রী ছিল কিছু বছর আগে। তারপর প্রায় সাত বছর যোগাযোগ ছিল না। গ্রাজুয়েশন শেষ করে সে কিছু দিন বার্লিন ছিল। শেষদিকে যখন খুব অসুস্থ হয়ে পড়ি তখন হঠাৎ তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। এক রাতে বেথ-কে চিঠি লিখি। প্রায় এক বছর পর সেদিন টাইপ রাইটার হাতে নিই। মাত্র দুই প্যারা চিঠি লিখতে সারা রাত লেগে যায় আমার। তার বাড়ির ঠিকানায় চিঠিটা পাঠিয়ে দিই। চিঠি পায় সে। এর দু’সপ্তাহ পর আমি উত্তর পাই। শহরে গিয়ে দেখা করতে শুরু করি আমরা। যে আমি এক বছর ধরে ঘর থেকে বের হই না, সেই আমাকে বাসে চেপে আর ট্রেনে চড়ে বোস্টন যেতে হয়। সে এক ভীতিকর অবস্থা ছিল আমার জন্য। এ নিয়ে একটি কবিতা লিখেছিলাম, নাম ছিল “থ্যাংকস প্রেয়ার অ্যাট দা কোভ”। ট্রেনে যেতে গিয়ে আমার দৃষ্টি আর মনস্তাত্ত্বিক হ্যালুসিনেশন নিয়ে লেখা। খুব দ্রুতই বেথ জানিয়ে দিয়েছিল সে আমার সাথে থাকতে চায় আর যদি আমার দেখাশোনা করতে হয়—অসমর্থ আমাকে ‘টেক কেয়ার’ করতে হয় সেটাও করতে চায় সে। আমরা আসলে দীর্ঘদিন একে অপরকে ভালোবেসে যাচ্ছিলাম নিজেদের অজান্তেই। অপ্রকাশিত। তিরিশের গোড়ায় ও এক সুন্দরী, বিদূষী তরুণী আর আমি এই বয়স্ক, কুৎসিত, ঘেঁটো, নেশাগ্রস্ত পরাজিত এক মানুষ। পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছিল সে আমার অবশিষ্ট জীবনের সঙ্গী হতে চায়, আমার দায়িত্ব নিতে চায়। এটাই আমাকে উজ্জীবিত করেছে। সুস্থ হয়ে উঠার আমার ইচ্ছেকে জাগিয়ে তুলেছে। আমাকে নতুন ভাবে প্রাণীত করেছে।
আমি বিশ্বাস করি, পরিপার্শের মানুষদের মাধ্যমেই ঈশ্বর তার কাজ করে থাকেন। মদ্যপান আর নেশাগ্রস্ততার থেকে নিরাময় পেতে পেতে এই ব্যাপারটা বুঝতে পারছিলাম আমি। আমরা সবাই উদ্যম আর ভালোবাসার উৎস—যা একে অপরের মাধ্যমে উৎসারিত হয়। মাঝেমধ্যে এর আকস্মিকতায়, বিষ্ময়কর আগমনে আমরা স্তম্ভিত হই, আর হঠাৎ-ই শুরু হয় আমাদের আমূল পরিবর্তন। আমার কাছে বেথ-এর সাথে থাকা মানে হচ্ছে এইরকম একটা জাগরণ, আমূল পরিবর্তন। ওর মধ্যে এমন কিছু একটা আছে, যাকে বলা যায় সত্যিকার পবিত্রতা। যখন আমরা প্রথম দেখা করি, ওকে দেখেই মনে হয়েছিল সে সত্যিই মানুষিকভাবে অসমর্থ কাউকে ‘টেক কেয়ার’ করতে যাচ্ছে। বেশ কয়েক মাস ধরে গোসল করিনি, কাপড় বদলাইনি তখন। দিনের আঠারো ঘন্টাই বিছানা ছেড়ে উঠতে পারিনি। অসম্ভব নোংরা ছিলাম। এরপর বেথ যা করলো তা আমার জন্য ছিল সত্যি অপ্রত্যাশিত।
সাক্ষাৎকারী :এই পরিবর্তন আপনার লিখায় কেমন প্রভাব ফেলেছে, বিশেষ করে আপনার স্বর ও ভঙ্গিতে?
ফ্রাঞ্জ রাইট : লোকে যেভাবে বলে আমি অবশ্য তেমন কোনো পরিবর্তন দেখি না আমার লেখায়। হ্যাঁ, কিছুটা বিষয়ভিত্তিক আর স্বর সম্পর্কিত পরিবর্তন আছে বলা যায়—যদিও শেষ তিনটি বইয়ে কিছু অশুভ ব্যাপার রয়েছে আর এর আগের গুলোয় আছে আনন্দের কবিতা। ভেবেছিলাম আর কখনো পারবো না, কিন্তু এই সবটাই হতে পেরেছে কারণ আমি আবারও লিখতে পারছিলাম। সেই শক্তি আর উদ্যম সত্যি উৎসাহ উদ্দীপক আর বিষ্ময়কর। যা এর মধ্য দিয়ে এগিয়ে আসে। একধরনের আনন্দ এবং উদ্যম আছে, এমনকি অশুভ কাজের ভেতরেও তা থাকে, কেবল একটু আলাদারকম।
আমার সদ্য প্রকাশিত বইগুলোয় লক্ষ করেছি, এই যেমন ‘গড’স সাইলেন্স’এ, ‘আলো’ শব্দটি বহুবার এসেছে। এর আগে ছিল ‘আঁধার’, ‘আঁধার’, ‘আঁধার’। যদিও জানি ধর্মীয় অভিজ্ঞতা মানুষের লিখায় রং চড়ায়, আমার ক্ষেত্রে তার উল্টো, আমার মনে হয় আমার লেখা আর আমার ধর্মীয় অনুভূতি দুটি সম্পূর্ণ আলাদা। বলা যায়, লেখা হচ্ছে অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞানকে সংরক্ষণ, একটা স্থায়ী কাঠামো দান, শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও জীবনের ভেতর দিয়ে একে বয়ে নিয়ে যাওয়া। সাত বছর আগে আবার লিখতে শুরু করার পূর্বে, মনে হোতো কবিতা একধরনের ধর্ম। ভাবতাম, কবিতা স্বর্গীয়, সমস্ত কিছুর লক্ষ্য কবিতা। পরিবর্তন যদি কিছু হয়ে থাকে তা হচ্ছে আমি এই উপলব্ধিতে পৌঁছেছি: কবিতাকে লিখে শেষ করে ফেলার আর কোনো প্রয়োজন নেই। কবিতা আসলে এক জায়গা থেকে পরবর্তী জায়গায় পৌঁছার একটি ধাপ। ওই কবিতাগুলো ছিল এমন একটি জায়গা খুঁজে পাওয়ার প্রচেষ্টা যেখানে বাস্তব জীবনের পরম আবেগ, সঙ্গতি আর উদারতার আনন্দ আর নিশ্চয়তাকে সংগ্রহ করা যাবে।
এই নিশ্চয়তার অভিজ্ঞতা আমার ছিল, কেবল প্রয়োজন ছিল একে অক্ষুণ্ন রাখার, কেননা এর জন্য আমি তেমন ভালো গোছানো ছিলাম না কখনও। হতে পারতো লেখালেখি একেবারে ছেড়ে দিয়ে অলস সময় কাটাতাম সারাদিন আর কেবল ধর্মীয় চিন্তায় মগ্ন থাকতাম। তা না করে আমি যা করেছি, হয়তো তার চেয়ে সেটার আরও ভালো প্রভাব থাকতো সমাজে। আসলে সাহিত্যের প্রতি আমার ভালবাসাকে কখনো উৎরে যেতে পারিনি। যেন আমার অন্তরের অন্তঃস্থলে চির প্রোথিত। পরম ভক্তির ব্যাপার। কীভাবে করতে হয়, যা আমি জানি,। সেটাই কেবল করতে পারি। কবিতা লেখা এমনই একটি কাজ, আমি করতে জানি।
সাক্ষাৎকারী : আর একটু ব্যাখ্যা করে বলবেন কি, স্বপ্নদর্শী অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে কীভাবে একটি কবিতার জন্ম হয়ে ওঠে?
ফ্রাঞ্জ রাইট : এক্ষেত্রে অবশ্যই ভালোবাসার বিহ্বলকারী অনুভূতি, অথবা এমনই কোনও অভিজ্ঞতার প্রয়োজন রয়েছে যেখানে কবিতা লেখা বা নথি হয়ে থাকে। এটা শুধু ওই প্রেমের কোনও বিষয় নয়। যদি কেবল তা-ই হয়, যদি শুধুই ভাষা সর্বস্ব হয়, তবে সেই কবিতা টিকবে না বেশি দিন। মহৎ কবিতা হচ্ছে সেই কবিতা যেটা মানুষের যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা লব্ধ সুর থেকে উৎসারিত হয়। আপন সৌন্দর্যে মুগ্ধ নয় কেবল। স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ভাষাগত স্বভাবকে আমাদের আয়ত্তে নিয়ে এর চর্চা আর উন্মেষ ঘটানোর প্রতিভা থাকা প্রয়োজন। কবিতা বরং, প্রকৃত শিল্প সৌন্দর্যের সেই স্তর থেকেও অনেক উর্ধ্বের। নৈঃশব্দ্যের অনুভুতি আর পূর্ব অভিজ্ঞতার এক বাচনিক প্রকাশ যেন। যেমনটি আমি খুঁজছিলাম এদ্দিন: কবিতা, শব্দের ভেতর দিয়ে আমাদের নৈঃশব্দ্যের অনুভুতিকে উজ্জ্বল করে তোলে।
সাক্ষাৎকারী : আপনি কি নিজেকে খ্রিষ্টান কবি বলে মনে করেন?
ফ্রাঞ্জ রাইট : খুব সম্মানিত বোধ করতাম যদি খ্রিষ্টান কবি হতে পারতাম, আসলে এখনও ভালো একজন ধার্মিক হতে পারিনি আমি। আমার নিবিষ্ট চিত্ত খ্রিষ্টীয় অনুভবে আবিষ্ট হয়ে এর বাস্তবতায় উপলব্ধ রয়েছে। প্রচলিত প্রথা বিরোধী এক উপলব্ধি। বলতে গেলে এভাবে বলা যায় যেমন আমার কাছে খ্রিষ্ট বলতে এমন এক ভাবমূর্তিকে বুঝি যা আমাকে দারুণ এক চেতনায় উজ্জীবিত করে আর তা হচ্ছে পৃথিবীর সব প্রাণী আসলে ঈশ্বরের একেকটি রূপ। শুধু খ্রিষ্টের ভেতরই নয়, প্রতিটি মানুষের শারীরিক অস্তিত্বের ভেতর ঈশ্বরের একটি করে অংশ স্থাপন করা আছে। যীশু হচ্ছেন একটি সূর্য যিনি অন্য সবাইকে গ্রহণে গ্রাস করে ফেলেন, কিন্তু আমরাও আছি, অংশগ্রহণ করছি পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে। এই বিষয়ে সচেতন থাকাই আমাদের জন্য দারুণ একটি প্রচেষ্টা। কদাচিৎ-ই এমন বিষয়ে সচেতন হই আমরা। কাফকা যেমন বলেছিলেন, আমরা স্বপ্নচর।
যীশুকে আমি আর সংকেত হিসেবে দেখি না। অবতারত্ব সম্পূর্ণ ও আক্ষরিক অর্থেই মূর্ত ও বাস্তব। আমি জ্ঞানবাদী নই। তবে আমি মনে করি এই জ্ঞানবাদ যে বৈধর্মের অবতারণা করে তা ভালোর জন্যই। সবাই আমরা খ্রিষ্টের এমনটা মানি না আমি। এরকম বোঝাতেও চাচ্ছি না। আমি বলতে চাচ্ছি আমরা সবাই অবতারত্বের অংশ। আমরা এর একেকটি স্ফুলিঙ্গ। আমাদের সর্বোত্তম আর সর্বোচ্চ চৈতন্যে সেই রকম শক্তির অধিকারী আমরা, যা যীশু তাঁর বাণীতে বারবার বলে গেছেন। বৌদ্ধধর্মে আছে জেগে ওঠার সংকেত। আর খ্রিষ্টান ধর্মে আছে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে এগিয়ে যাওয়া।
প্রকৃতপক্ষে আত্মজাগরণ আর এই স্বপ্নদর্শী অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমরা মানিয়ে চলতে পারিনা বেশিক্ষণ। বারবার ফিরে আসে আমাদের বস্তুগত অবস্থা যা আমরা দেখতে পাই, ছুঁতে পারি। এজন্যই বোধহয় যীশুর ভাবমূর্তি এতোটা প্রভাবশালী। এমন নয় যে—শুধু আধ্যাত্মিকভাবে—তিনি একটি চেতনা। না, আসলে তিনিও আমাদের মতোই বাস্তব, রক্তমাংসের একজন মানুষ,—এইজন্য। আমার কাছে, সবচেয়ে আধুনিক ও গতিশীল উপলব্ধি হচ্ছে, মহাবিশ্বের এইসব স্বপ্নদর্শী বিকল্প বাস্তব, কেননা মানুষের রূপ নিয়ে ঈশ্বর দুঃখ-কষ্টকে আপন কাঁধে তুলে নিয়েছেন এইটুকু জেনে তা বুঝতে পেরেছি। আসলে মানুষের জন্য রয়েছে তাঁর অসীম ক্ষমাশীলতা যেন তিনি নিজেই এর মধ্যে থেকে বুঝে নিতে চান সন্ত্রস্ত, পরাভূত ও বিচূর্ণ শারীরিক অস্তিত্বের বাস্তব অভিজ্ঞতা বলতে কী বুঝায়। যীশুর এইরকম ভাবমূর্তিকে অনুধাবন করতে পারা বা এর সম্ভাবনা হচ্ছে মানব জাতির জন্য দারুণ এক অর্জন। মানুষের কোনও প্রচেষ্টা এই অর্জনের চেয়ে মহৎ নয় যেখানে আমরা দেখতে পাই আমাদের ভয়, কষ্ট আর পরাজয়ের মধ্যেও সেই অসীম অস্তিত্বের সম্ভাবনাকে।
সাক্ষাৎকারী : আপনি বলেছিলেন যদিও খ্রিষ্টান ধর্মই আপনার পথ, কিন্তু সব ধর্ম একই অভিজ্ঞতার প্রকাশ। তবে, এখন পর্যন্ত যীশু সম্পর্কে আর ইনকারনেশান বিষয়ে যা বললেন তাতে মনে হচ্ছে খ্রিষ্টান ধর্ম সম্পূর্ণ আলাদা কিছু। অন্য কোনো ধর্মে এমনটা নেই যে ঈশ্বর পৃথিবীতে নেমে আসেন মানুষ রূপে আর মানুষকে রক্ষা করতে নিজেকে উৎসর্গ করেন।
ফ্রাঞ্জ রাইট : আমার বিশ্বাস পৃথিবীর সব মূখ্য ধর্ম একই অভিজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ, আর আমার ব্যক্তিগত অভিমত হচ্ছে যীশুই হচ্ছেন এই সবের চূড়ান্ত পর্যায় যিনি সবাইকে প্রেরণা যোগান ও আলোকিত করেন। বৌদ্ধধর্মের বোধিসত্বের দিকে দেখুন। অন্য ধর্মেও এর কিছুটা পাবেন। কিন্তু পরিপূর্ণভাবে পাবেন না এই নগ্ন উদ্ঘাটন, এই মেনে নেয়ার অযোগ্য, এমনকি মৃত্যুর স্বাদ নিতে মনুষ্য শরীরে প্রবেশ করার ঈশ্বর সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদ্ভট এই ধারণা। এর চাইতে অদ্ভুত আর ভয়াবহ আর কিছুই হতে পারে না।
সাক্ষাৎকারী : এইরকম বিশ্বাস নিয়ে এই যে আপনি ইউনাইটেড স্টেটস এর একজন লেখক, যেখানে আপনার অধিকাংশ সহ-লেখকই সম্ভবত ভিন্নমত পোষণ করবেন, আপনি কি মনে করেন এ ব্যাপারে? কেমন অনুভব করেন আপনি?
ফ্রাঞ্জ রাইট : ঠিক আছে আমার জন্য। কিন্তু আমার মনে হয় উল্টোটাই আপত্তির। কিছু মানুষ আছে নিজেকে খ্রিষ্টান বলে দাবি করেন। ভেবে দেখেছি ওরা আসলে খ্রিষ্টান নন। এরাই আমাকে বেশি বিরক্ত করেন। খ্রিষ্টান এইসব মৌলবাদীরা মুসলিম মৌলবাদীদের মতোই অসহ্য, চরিত্রহীন ও ভন্ড। এরাই এখন এই দেশের নেতৃত্বে। দুরদর্শী বাস্তব আর ধর্মের এই দুই মৌলবাদী গোষ্ঠীর সংঘাত আজ খুবই ভয়ংকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইসলাম, অবশ্যই, খ্রিষ্টিয় ব্যবস্থার চেয়ে একধাপ এগুনো হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করে যদিও, যীশু-খ্রিস্টকে আরও বড়ো পবিত্র পরিমন্ডলে গণ্য করে, যা আমরা হতে পারি। এক্ষেত্রে ইসলাম সত্যি আকর্ষণীয়। কিন্তু শেষ ধাপ পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে না আমাদের। যীশু-খ্রিস্টের ত্যাগ, নিজেকে উৎসর্গ ও তাঁর মৃত্যুকে মানে না তারা। এটা অর্থহীন। তবে, ইসলামে যীশু উপস্থিত আছেন আপন মহিমায়।
সাক্ষাৎকারী : সমসাময়িক সাহিত্যে ‘বিদ্রুপ’এর প্রভাব নিয়ে কিছু বলুন।
ফ্রাঞ্জ রাইট : সবসময়ই এটা একটা সমস্যা। সবচেয়ে দুর্বল সমালোচনা হলো বিদ্রুপ। সবচেয়ে সহজ কাজ। যে কাউকে অপমান করা যায়। কোন ব্যাপারটা কঠিন—কোনটা সত্যি অসম্ভব—সেটা আলাদা বিষয়। হ্যাঁ, আমাদের সংস্কৃতি বিদ্রুপের হেঁয়ালিতে আচ্ছন্ন। অসুস্থ চর্চা। জঘন্য ব্যাধি। খুবই নাদান আর গোঁড়া। বিব্রতকরভাবে নাদান এবং অজাত। দূঃখজনক অর্থবোধ একেবারে নেই। অন্য সংস্কৃতিতে জীবনের দুঃখ-দুর্দশাকে হৃদয়ে ধারণ করতে পারে মানুষ। জীবন সেখানে ভোগান্তির ভেতর দিয়েই প্রস্ফুটিত। আমেরিকায় আমাদের আছে অদ্ভুত স্বাভাবিকতার পূরাণ, যেন সব কিছুই আনন্দের জন্য আর সাফল্যের, কিন্তু বাস্তবতা এরকম নয় মোটেও।
সাক্ষাৎকারী : আপনার সর্বশেষ বইটির নাম ‘গড’স সাইলেন্স’ কেন দিয়েছেন? ‘গড’স সাইলেন্স’ কথাটির অর্থ কি আপনার কাছে?
ফ্রাঞ্জ রাইট : নিরবতা মানেই অনুপস্থিতি বোঝায় না। এটা প্রকৃতপক্ষে আমাদের সেই মুক্তির দিকে ইঙ্গিত করে, যেন আরও উচ্চ পর্যায়ের আত্মিক গন্তব্যে পৌঁছাতে পারি। যেমনটি চাই তেমনি যেন করতে পারি। ঈশ্বর কোনও মন্তব্য করেন না। মুক্ত ইচ্ছে বা কামনার প্রতিফলন যেন। হ্যাঁ, মানুষের জন্য সব চেয়ে বড় কথা হলো নিজেকে সমর্পণ করা, আপন ইচ্ছেকে বলি দিয়ে পরম ঈশ্বরের ইচ্ছের আলোয় বাঁচা, কিন্তু এই একটি ব্যাপার যেখানে আমরা সবসময় ব্যর্থ হই। যদি আমরা আপন চাওয়াকে ত্যাগ করি, আমরা এক শাশ্বত সম্ভাবনাময় জগতে প্রবেশ করি যেন, কিন্তু বহাল থাকতে পারি না। খ্রিষ্টীয় গূঢ়ার্থ এই নিরবতার কথা বলে যেন তা ঈশ্বরের ভাষা। আমার প্রথা হচ্ছে, থমাস ক্যাটিং এর প্রবর্তিত প্রথা, মার্টনের সাথে কিছুটা মিলিয়ে, যাকে বলা যায় কেন্দ্রীয় প্রার্থনা। বৌদ্ধীয় মনোসংযোগ পদ্ধতি ধার করে অনেকটা। সমস্ত ছবি, চিন্তা, ভাষা পরিত্যাগ করে এমনভাবে আসন নিয়ে বসতে হবে যেন মনে হয় আমি ঈশ্বরের অস্তিত্বে সচেতন। তিনি আমার সামনেই উপস্থিত আছেন। ভাষা মানে হচ্ছে সেই ব্যাপার যাকে অপেক্ষায় থাকতে হয়। প্রথমে ঈশ্বরের নিরব অস্তিত্বে যাপন করতে হয় আমাদের, আর তারপর ধীরে ধীরে আমাদের মনের সমস্ত ভার নির্ভার হয়ে যায়।
যখন লিখতে শুরু করি, জানি না কী লিখি আমি। শুরুতে কিছুই জানা থাকে না। হয়তো বুঝতে পারি একেবারে শেষে। কিন্তু আমি শুনি। শুনতে থাকি। লিখা যেন একপ্রকার শোনা। ধর্মীয় অভিজ্ঞতা যেন এক নিঃশব্দে শ্রবণ ও লিখন প্রক্রিয়া। আমি বলতে পারবো কোন লিখাটা স্বতঃস্ফূর্ত আর কোনটা মগজ-কর্ষিত। পার্থক্যটা অনুভব করতে পারি, দেখতে পারি, আর স্বাদ নিতে পারি, কিন্তু আমি জানি না কীভাবে পারি। লিখা এমন নয় যে চাইলেই লিখতে পারি। আমি কেবল এর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে পারি এবং লিখা এসে যায় আপনাআপনি।
সাক্ষাৎকারী : সেন্টার ফ গ্রিভিং চিল্ড্রেন-এ আপনার কাজ নিয়ে কিছু বলুন।
ফ্রাঞ্জ রাইট : যখন বেথ-কে বিয়ে করি, প্রথম দিকে যখন চার্চে যাওয়া শুরু হয় আমার এটা তখনকার কথা। কিছু দিন চিল্ড্রেন সেন্টারের সাথে যুক্ত ছিলাম। সুখ তখন বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসের মতোই বয়ে যাচ্ছিলো আমার জীবনে। আর সেটা একসময় দারুণ একটা ইচ্ছের আকার ধারণ করে, যেন কিছু একটা করি, ভালো পবিত্র কিছু, যা আগে কখনও করার সামর্থ্য হয় নি আমার। আমার মতোই যারা দুঃখ কষ্টের ভেতর দিয়ে জীবন যাপন করছে, যারা মানসিক ভাবে অসুস্থ অবস্থায় আছে, নেশাগ্রস্ত যারা, আর চেয়েছিলাম বাচ্চাদের জন্য কিছু করতে যারা আপনজন হারিয়েছে। কেননা আমার শৈশবও ওইরকম ভাবে কেটেছে।
আমার বাবার অবর্তমানের শোক হচ্ছে আমার শৈশব আর কৈশোর। সবসময় তাঁর সাথে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করেছি। সেন্টারের যেসব ছেলেমেয়েদের বাবা-মা নেই তাদের মধ্যে আমি সেই শোক দেখতে পেয়েছিলাম। যাদের বয়স ছিল সাত কি আট তাদের সাথে ঘনিষ্ঠ হতে চেষ্টা করেছি। যাদের বাবা-মায়ের কেউ একজন নেই তাদের সাথে কাজ করেছি। কারণ, আমার ওই বয়সেই বাবা আমাদের ছেড়ে গিয়েছিলেন। ওদের নিয়ে কবিতা লিখিনি। কাজ করেছি শুধু। ওই প্রোগ্রাম ছিল খুবই সংগঠিত। ছেলেমেয়েদের নিরাপদ আশ্রয় ছিল ওটা। ওদের মনে হতো সবসময় সহকর্মীদের সহচর্যে আছে। অন্য বাচ্চাদের মতো হাসি খুশি, উচ্ছ্বল। এভাবেই অনেকটা এলকোহলের আসক্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার মতোই ছিল এটা আমার। হারানোর বেদনাই ছিল সাধারণ মান সেখানে, অন্যদিকে স্কুলে বা অন্য যেকোনও জায়গায় ওরা ছিল কিম্ভূত হিসেবে পরিচিত।
সাক্ষাৎকারী : আপনার লেখায় একটি বিষয়ের বারবার পুনরাবৃত্তি ঘটে, সেটা হচ্ছে মৃত্যু। যেমন আপনি লিখেছেন :
“কিন্তু কীভাবে
কেমন করেইবা
যেতে পারে কেউ মৃত্যুর পথে?
কে আছো পৃথিবীতে
শেখাবে আমায়—
মানুষে পরিপূর্ণ এই বিশ্ব এমন
যাদের মৃত্যু নেই।”
ফ্রাঞ্জ রাইট : দারুণ একটা বিষয়ের অবতারণা করলেন। আমিও আসলে এ বিষয়ে এমন সচেতন ছিলাম না। যখন আমরা মৃত্যু নিয়ে কথা বলি, এর মানে মৃত্যু নিয়ে বিষাদে তন্ময় হওয়া নয়। বরং আরও গভীরভাবে প্রাণময় হয়ে ওঠা, আরও গভীরভাবে সচেতন হওয়া। “মৃত্যুই সৌন্দর্যের প্রসূতি,” বলেছিলেন ওয়ালেস স্টিভেন্স। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যেন আমরা ভেবে দেখি, কারো পরম না-থাকা ব্যাপারটা এমন প্রভাব ফেলতে পারে যেন মনে হয় সে আরও দ্বিগুণ আরও গভীরভাবে উপস্থিত আছেন। এটা আরও বিশদ আকারে জেন বৌদ্ধবাদে পাওয়া যায়। এক বৌদ্ধ ভিক্ষু বলেছেন, “এই যে গ্লাসটি দেখছো, পানি খাচ্ছি? আমার চোখে, যদিও এটা ভাঙা, কিন্তু আমি এতে বিচলিত নই। মানে হচ্ছে আগের চেয়েও অনেক ভালো ভাবে একে উপভোগ করতে পারছি।” তিনি আসলে তাঁর দেহের কথা বলছিলেন। ইতিমধ্যে আমরা সবাই মৃত। যা কিছু অনুভব করেছি, বলেছি, চিন্তা করেছি, যা কিছু ঘটেছে আমাদের সাথে, এই মুহূর্তে যা ঘটছে, একেবারে সম্পূর্ণ রূপে মুছে যাবে যেন কখনও ঘটেনি। এই সম্ভাবনা নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। আমার জন্য, এটা একটা শক্তির উৎস। দশগুণ বেশি গভীর ও সচেতন করে তোলে এটা। প্রাণবন্ত করে তোলে। ভয় পাওয়ায় না। সবকিছু আলোকিত করে তোলে।
এইরকম কিছু মৃত্যুর মুহূর্ত কবিতা লেখার প্রেরণা হয়ে উঠতে পারে। আমি হলফ করে বলতে পারি না এইরকম আনন্দময় অভিজ্ঞতা আমার আবারও হবে। সবসময় মনে হয়েছে, প্রতিটি কবিতা, সে যত ছোটই হোক, যা বলতে চাই পুরোটাই যেন বলা হয়, যেন এ-ই শেষ সুযোগ। আমার কাছে, একটি কবিতা শেষ করার মুহূর্ত মানে, আমি অনুভব করি এই মুহূর্তটা আর আসবে না আমার। চোখের সামনে ভেসে উঠছে আমার সেই সব এলোমেলো পদক্ষেপ যেন ওই মুহূর্তটুকুতে পৌঁছুতে পারি যেন নিজেকে নিঃসঙ্গ করি আর লিখে ফেলি একটি কবিতা। ওই অবস্থায় কীভাবে ফিরে যেতে হয় জানা নেই আমার, জানি না কীভাবে আবারও ঘটানো যায় ওটা। চেষ্টা করেছি অনেক বার। ভেবেছিলাম হয়তো কোনো উপায় পেয়ে গেছি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা কাজ করে নি। প্রত্যেকবার আমাকে শিখতে হয় কীভাবে সেটা ফিরিয়ে আনা যায় আবার। কিন্তু কোনও নিশ্চয়তা নেই।
সাক্ষাৎকারী : সাহিত্যের জগতে বহুবছর আপনাকে বহিরাগত হিসেবে দেখা হয়েছে। আপনার কাজের উপর এর কোনো প্রভাব রয়েছে কি?
ফ্রাঞ্জ রাইট : এখনও আমি বহিরাগত, এবং তা-ই থাকতে চাই। একাডেমিক বিশ্ব একজন শিল্পীর জন্য মৃত্যুর নামান্তর। প্রতিদিন মামুলি জায়গায় অসাধারণ মুহূর্তের অবতারণার চেষ্টা যেন। কিন্তু আমার পৃথিবী, যেখানে আমার যাপন, সেখানে কবি হওয়া মানে সবার ধারণার বাইরের সবচেয়ে অসাধারণ একটি ব্যাপার। আমি এভাবেই রাখতে চাই এটা। এটাই আমার নিজস্বতা আমার সর্বস্ব। এ নিয়ে খেলার কিংবা কেড়ে নেয়ার সুযোগ দিচ্ছি না কাউকে।
সাক্ষাৎকারী : অধুনা আপনার কাজগুলো ভূয়সী প্রশংসায় গৃহীত হয়েছে সবার কাছে, তাই আপনি কি মনে করেন এখনো নিজেকে বহিরাগত হিসেবেই গণ্য রাখতে পারবেন?
ফ্রাঞ্জ রাইট : প্রশংসিত হওয়া মানে তো মনে মনে আরও সংরূদ্ধ আর সংগঠিত অনুভব করা যেন তোমার কাজ মহামূল্যবান সম্পদ, একে রক্ষা করতে হবে, যেন সবাই একে ধ্বংস করতে চায়। নিদারুণভাবে আত্মসুখে জর্জরিত আর অরক্ষিত আমি। তবে একধরনের মানসিক শক্তিও বলা যায় একে। কখনও মনে হবে না যা করতে চেয়েছি তা করে ফেলেছি। চোখের সামনে সর্বদা অপসৃত হতে থাকবে। ধরতে চাইবে কিন্তু পাবে না। আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হবে।
আমার আত্মমর্যাদাবোধ এতো দূর্বল যে পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েই তা ভেঙে পড়েছে। মনে হচ্ছে হুম, আমিও আছি। আর রাস্তায় এখন মাথা উঁচু করে হাঁটি। বাতাসে ভেসে একটুকরো কাগজ আমার পায়ের কাছে হুমড়ি খায় এসে, বিল নট যেমন বলেছিলেন, এমনকি আমার মৃত্যুর জন্য কোনও আবেদন পত্রও নয় এটা। শশুড়বাড়িতে আমাকে আগের চেয়ে বেশি পছন্দ করতে শুরু করেছে সবাই। অনেক টাকা পেয়েছি। কিন্তু এগুলো আমার লিখন-পদ্ধতিতে কোনও পরিবর্তন আনতে পারে না। বরাবরের মতোই দারুণ রহস্য আর বেদনা, অনিশ্চিয়তা আর নিরাশার নিদারুণ এক উৎস হয়েই আছেসে।
সাক্ষাৎকারী : যদি জানতে চাওয়া হয় তবে নতুন প্রজন্মের কবিদের জন্য আপনি কী উপদেশ দিতে চাইবেন?
ফ্রাঞ্জ রাইট : প্রথমেই যে তাড়নাটা দিতে চাই তা হচ্ছে, “ভিন্ন কিছু করো।” সত্যি বলতে, প্রথম থেকে যে ব্যাপারটা আমাকে তাড়িত করেছে সেটা প্রেম। উচ্চাশা নয়, ভালোবাসা। যদি তোমার মধ্যে কোনও কিছুর জন্য প্রতিভা থেকে থাকে, যেকোনও কিছু, সেটা যা-ই হোক, তুমি এটা এতো ভালোবাসো যে সবসময় লেগে থাকবে, অন্বেষণে থাকবে, যত ঝড়-ঝঞ্ঝাই আসুক না কেন, যত হতাশা, যন্ত্রণা আর প্রত্যাখ্যানের ভেতর দিয়েই যাও না কেন, দারুণ এক প্রেরণায় আচ্ছন্ন হবে তুমি। যদি সৎ হও, যদি এর জন্য তোমার অভিপ্সা হয় ভালোবাসা, তবে অবশ্যই প্রেরণা তোমাকে খুঁজে নেবে। যদি তুমি এ নিয়ে কাজ করো, যদি ভালোবাসো আর যত্ন নাও—উচ্চাশা নয়, শিল্প সৃষ্টির প্রেরণা তোমার সহায়ক হবে। এবং সাফল্য আসবে, যদিও জানি অনেক আশা থাকে এর জন্য। আমরা জানি, এমিলি ডিকিনসন কিংবা ভ্যান গগের সাফল্য আসেনি। কিংবা হয়তো এসেছিল। হয়তো সেই চুড়ান্ত সাফল্য অর্জিত হয়েছিল ঠিকই। হয়তো তাঁদের আনন্দ মিলে মিশে একাকার হয়েছিল পার্থিব সাফল্যে। যেমন আমার হয়েছে। একটা বিপর্যয়। ঘটার আগে বুঝতে পারা যায় না, আর যখন বুঝবে তখন অনেক দেরী হয়ে যাবে। ফিরে যেতে পারবে না আর আগের অবস্থায়। নিজস্ব, একান্ত আর অজানা ভালোবাসার কিছুই আর ফিরে পাওয়া যায় না। হয়তো তাঁরা খুব ভাগ্যবান ছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে ছিলেন যেখান থেকে হয় প্রকৃত শিল্পের বিকাশ। খ্যাতি অর্জন করে ফেললে, আত্ম-সচেতনতার এমন একটা দিক আছে, যা আর এড়ানো যায় না।
বয়স হয়েছে তাই হয়তো, নিজের সাথেই বোঝাপড়া করেছি, যেন মেনে নিই, সবকিছু নিয়ে এতো আদর্শিক হতে নেই, মেনে নিই একেকজন একসাথে অনেক কিছুই করতে পারে। অনুশীলনের মাধ্যমে আমি একটি কবিতা লিখার গোপন চেষ্টাকারী মাত্র, এবং চেষ্টা করতে পারি কাব্যশিল্পের একজন প্রতিনিধি হবার। কিন্তু সার্থক কবিতা লিখতে না পারার যন্ত্রণা আর ব্যর্থতার অনুভব থেকে এগুলোর কেউ আমাকে মুক্তি দিতে পারবে না। কিছুতেই এই যন্ত্রণার উপশম নেই। কেউ এটা দূর করতে পারবে না। এই ব্যথাটাই আমার সর্বস্ব এখন।
ঋতো আহমেদ: কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক