চিন্ময় গুহের কবিসত্তাকে তাঁর কবিতায় কিভাবে পেয়েছি সেটুকু আমার নিজস্ব অনুভব ও উপলব্ধির বাঙ্ময় প্রকাশে বলতে ইচ্ছে হয়। এ বড় কঠিন কাজ।তাঁকে কবিতা রাজ্যে আবিস্কার করার দক্ষতা প্রয়োজন। আমার তা আছে কিনা সেটা নিয়ে আমারই সংশয় আছে। তবু অজানাকে জানার নেশায় আমিও আজ দক্ষ কলম্বাস। কবিতার প্রতি অদম্য ভালোবাসা ও আকর্ষণই আমাকে বারবার টানছে চিন্ময়ের কবিতা-ভূমিতে।
কবিতা পড়বো, উপভোগ করব, বিশ্লেষণী বিচারশক্তিকে কাজে লাগিয়ে, এর মজাই স্বতন্ত্র।তবে তার কোন নিশ্চিতসূত্র নেই আমার হাতে।
তবু একথাও তো সত্য যে কবিতাপাঠ, তার উপভোগ ও মূল্যায়ণের বিষয়টি পাঠক ও আলোচকের বিশেষ অভিনিবেশ দাবি করে??
আমি আগে পাঠক পরে পর্যালোচনায় প্রবেশ করি।
পাঠক হিসেবে তাই ভেবে দেখতেই হয় একটি কবিতায় কবির ব্যক্তিগত আবেগ, মনন, অভিজ্ঞতা, অনুভব, এসব ঠিক কিভাবে ধরা পড়েছে কবিতাতে কিম্বা কিভাবে তা পাঠকের মনে পুনঃসৃষ্ট হচ্ছে। এর জন্য পাঠকের বিশ্লেষণী দৃষ্টি, নিবিড় পাঠ, অনুশীলন , রুচি ও রসবোধের অত্যন্ত প্রয়োজন। আমার তা কতটুকু আছে জানিনা।
ভালো কবিতা পড়ে সিদ্ধান্তের ক্রমিক নির্মলতায় পৌঁছাবার শক্তি পাঠকের থাকা চাই। ভালো কবিতা লেখা যেমন সহজ নয় তেমনই তার মূল্যায়ণ করাও কঠিন এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই কারণে আমরা অনেক ভালোকবিতা ও বড় কবিদের হারিয়ে ফেলি।
এত কথা বলছি এই কারণে যে, আমি এমনটাই কিছু ভালো কবিতার ফল্গুগোপন-অস্তিত্বকে দেখেছি এবং তাকে খুঁজে বার করতে পারলে যে স্বরস্বতীতে-(সরস্+বতুপ্=সরস্বা ন + স্ত্রীয়াম্ ঙীপ্=সরস্বতী)(এখানে কাব্যনদী) ধারাস্নান হতে পারে তাও দেখেছি।
আজ আমি তেমন এক কবিসত্তার কথাই বলতে বসেছি যিনি তাঁর অসাধারণ কবিতা গুচ্ছের প্রতি কোনো এক অজ্ঞাত অবহেলায় আন পথ কেটে বেরিয়ে গেছেন সাহিত্যের ভিন্নতর ক্ষেত্রে। সর্বত্রই তিনি অবশ্য শীর্ষজয়ী প্রতিভারূপে প্রতিভাত হয়েছেন।
তাঁর মত চূড়াচুম্বী প্রতিভাই কেবলমাত্র এমন করে আলো জ্বেলে দেয়—দিতে পারে।
আমি যে কবির কথা আজ বলতে চাইছি তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন গদ্যকার । তাঁর নামটি সকলের কাছেই পরিচিত—– তিনি কবি চিন্ময় গুহ।
তাঁর অপূর্ব , অসপত্ন গদ্য গুলো পড়তে পড়তেই আমি চমকে উঠেছি। আমি কি সত্যিই গদ্য পড়ছি? নাকি কবিতা? এমন গদ্যলেখা কি সম্ভব?
বিশ্বাস করুন পাঠক, তখন থেকেই আমার খোঁজ শুরু হয়েছে কবি চিন্ময়ের লুপ্ত কাব্যমঞ্জুষার।কোথায় যে সেসব তিনি লুকিয়ে ফেলেছেন,খুঁজেই পাচ্ছিলাম না ।একদিন হঠাৎ তাঁর সঞ্চয় থেকে পেয়ে গেলাম কয়েকটি কবিতা ।
পড়তে পড়তে মনে হলো, আমি তো তবে ঠিকই ভেবেছি—-! আমার অনুসন্ধান তো ব্যর্থ হয়নি!
কি যে আনন্দ হল চিন্ময় গুহের কবিতাগুলো পড়ে তা ভাষায় প্রকাশ করি কী করে?
তিনটি কি চারটি কবিতা হাতে পেতেই আর মুহূর্তমাত্র দেরি না করে লিখতে বসে গেলাম।
ভয় ছিল অভ্যন্তরীণ স্বভাবধর্মে কবি চিন্ময় যদি আপত্তি করেন, কিন্তু কার্যত তা হয়নি ।
আমি পরপর কবিতাগুলো পাঠকদের জন্য সাজিয়ে দেবো এবার—- একজন উদাসীন মহৎ কবির কাছে এই আমার নৈবেদ্য।
চিন্ময়ের তাৎক্ষণিক ও স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ থেকে জন্ম নিয়েছে যে কবিতার ভ্রূণ তাতে রয়েছে একান্ত অনুভব ও অভিজ্ঞতার সৃজনী প্রকাশ।শব্দেরা এখানে কেবলমাত্র অর্থপূর্ণ বাক্য গঠনের উপাদান মাত্র নয় কিম্বা কেবলমাত্র প্রতিবেশী অনুষঙ্গের ভরসায় সৃষ্টি মুখর নয়।
অথবা এসব কবিতাতে কেবল মাত্র ডিকনস্ট্রাকশনের জন্য তাসের ঘর সাজানো নেই, বরং সত্তালগ্ন একটা গভীর গুহাহিত সত্যকে যন্ত্রণার মত লালন করেছে এসব কবিতা।
চিন্ময়ের কাব্যভাষার অনন্যতা ও অপরিবর্তনীয়তা এবং নানান রীতিবিচ্যুতি (Deviation from the norm/stylistics) ও বিসারণ মহৎ কবিতার কুল-লক্ষণ সূচিত করেছে।
প্রসঙ্গতঃ আমি কবির একক কবিতা গুলির তন্নিষ্ঠ আলোচনা উপস্থাপিত করছি—-
প্রথমেই পড়ে নেব তাঁর কবিতা— “এখন”……
“■এখন সমস্ত পিদ্দিমের মুখ ঘোরানো
ঘুমের মধ্যে তারা-খসা জলের চিৎকার
কড়ি বড়গার অন্তস্থল অব্দি খুলে আসে
স্নায়ুশিরার কোটর পর্যন্ত দাঁতের দাগ
চতুর্দিকের অন্ধকার ভরা তছনছ
মানুষের কান্নার মুহুর্ত
হাতে পায়ের গিঁটে আটকে থাকে
আমরা কতক্ষণ এই থমকানো রক্তের কেন্দ্রে ভাসব
ভাঙা মাটি খসে নীল হয়ে ওঠে
ঢেউয়ের ঘষায় জ্বলে
আমরা কতক্ষণ এই থমকানো রক্তের কেন্দ্রে ভাসব।■”
এরপরে কবিকে খুঁজে নেব ,রূপে ও অরূপে।
রূপকৃৎ চিন্ময়, কবি চিন্ময় “এখন” কবিতাটিকে জড়িয়ে আছেন প্রজ্ঞাঘনতায়। এ কবিতা এমন একজন মানুষের কাব্যভাবনার পরিচয় বহন করছে যা আমি কি সহজে বুঝতে পারবো?
তবুও ভাবতেই হল। ভাবনা রূপ না পেলে আমাকে কিছুতেই মুক্তি দেবেনা।
মন্ত্রমুগ্ধের মত তাই পড়তে থাকলাম এবং একসময় লিখতে লিখতেও
এগোলাম একপা একপা করে। এবার প্রসঙ্গে আসছি—-
“এখন” মানে এইসময়। কবি খণ্ডিত সময়টিকে চিহ্নিত করে রেখে যেতে চান অলীক ব্যথার ইতিবৃত্তে যদিও তিনি সম্যগ জানেন সময় একটি অনন্তপ্রবাহ এবং এরই মধ্যে ক্ষণে ক্ষণে আছড়ে পড়ছে ক্ষণভঙ্গের ঢেউ। তবুও “এখন”—-এই কাল সীমাটিকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করার একটা দায় থাকে সম-সময়ের কবির্মণীষীদের। চিন্ময় সেই কাজটিই করলেন—-স্পষ্ট করেই জানালেন——
“এখন সমস্ত পিদ্দিমের মুখ ঘোরানো—-“—-মঙ্গলারতির জন্য প্রদীপ জ্বালানো হয়। দেবতার দিকে থাকে তার অভিমুখ। মাটির প্রদীপেই জ্বলে ঊর্ধলোকের আগুন আর তার শিখাও হয় ঊর্ধ্বমুখী। এই আগুন জ্বেলে তাপিত করা ও তাপিত হওয়ার নামই তপস্যা। আগুন কবিক্রতু। আগুনের দেবতা প্রমিথিউস। পার্থিবের সবরকম যজ্ঞভাগ সেই পূতাগ্নি পৌঁছে দেয় স্বর্গলোকে। ঘরে ঘরেই তাই একদিন জ্বলত মঙ্গলপ্রদীপ। মানুষের সঙ্গে দেবতার সহজ আদানপ্রদান চলত। মানুষের সঙ্গে ঈশ্বরের সহজ নৈকট্য ছিল। আজ স্ফীত অহং বস্তুবাদের অবিজ্ঞান তাদের সুগোপন প্ররোচনায় নিভিয়ে দিয়েছে সে নিত্যপ্রদীপ। যে জানে সে জানে। শুদ্ধচিত্তকবি চিন্ময়ের আর্শিনগরে তারই ছায়া কাঁপছে। প্রদীপ শব্দটির আঞ্চলিক উচ্চারণ “পিদ্দিম”।এই শব্দব্যহারে কবির ব্যথাটি সার্বভৌমব্যাপ্তি পেয়েছে। পেয়েছে কাল-ছাড়িয়ে চলার আমেজ। এই “পিদ্দিম” শব্দটি হয়ে উঠেছে কবির স্বসংবেদ্য ভাবের (ম্যালাডি অফ দ্য এজ) -এর ভাষা। এখন তাই সমস্ত পিদ্দিমের মুখ ঘোরানো—-তাবৎ মানুষের আজ বিরাট অসুখ।
শান্তিময় প্রাকৃতিক ঘুম-সমাধিটুকুও আজ কেড়েছে কারা যেন লুসিফার হয়ে।তাই—“ঘুমের মধ্যে তারা-খসা জলের চিৎকার”–আর
“কড়িবড়গার অন্তস্থল অব্দি খুলে আসে
স্নায়ুশিরার কোটর পর্যন্ত দাঁতের দাগ”—– যুগযন্ত্রণার এর চেয়ে স্পষ্টতর ছবি আর কি হতে পারে।!?
একেকটি বাক্যে ফুটেছে একেকটি ছবি। এটিকে চিত্রকল্প বলা যায় না বরং বলতে পারি ওয়ার্ড পেন্টিং কিম্বা আমার মত করে বললে বলতে হয় অক্ষরছবি। ( ওয়ার্ডপেন্টিং—শব্দটি পেয়েছি,কবি ও চিত্রী বন্ধু শ্যামল জানার কাছ থেকে।)
কড়িবড়গা—- আমাদের ঘরের নিজস্ব ছবি ফুটিয়ে তোলে। ২০৬ খানা কড়িবড়গায় গড়া আমাদের আপনার ঘর। যেখানে নিয়ত চেতনের পিদ্দিম জ্বলত আজ তার অন্তস্থল অব্দি খুলে আসে। অর্থাৎ ঘরে বাইরে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের জীবন ও নিজস্ব যাপন। ধারকরা রূপের আলোয় ধাঁধা করছে সব । তাই আজ আর মানুষের আপনার স্নেহপিদ্দিমটি জ্বলে না। আশ্চর্য হই ভাষার অবলীল সহজতায় যখন চিন্ময় উচ্চারণ করেন “অব্দি”….
সে শব্দে যে ধরা আছে কত সুখ, শান্তি ও সুর তা কেবল প্রাজ্ঞ কবিসত্তাই জানেন। এইখানে মনে হয় নবী আর কবি মিলে এক ঋষিকল্প শিল্পীর শিল্প মূর্ত হয়ে উঠছে কবিতায়।
স্নায়ুশিরার কোটর পর্যন্ত দাঁতের দাগ—- কী সুন্দর অন্তর্বয়ান ! কি অপূর্ব মৌখিক সন্দর্ভ ( spoken inner discourse)!! মানুষের বেপথুমানতায় কবিহৃদয়ের যন্ত্রণাবোধ মিশে এ এক অনন্য মিথস্ক্রিয়া (interaction)। যদিও প্রত্যক্ষ ভাবে দ্যোতক দ্যোতিতের সম্পর্ক তৈরি করেন নি কবি কিন্তু অলক্ষে সেটা আরোপিত হয়েছে বলেই আমার বিশ্বাস।চিন্ময়ের linguistic entity এখন কবিতাটিতে অন্য এক অভিমুখ নির্দেশ করে বসে আছে। শব্দে শব্দে, বাক্যে বাক্যে একটা অনন্য coherence এবং cohesiveness ,পাঠককে মুগ্ধ করে ,অবাক করে, আশ্চর্য করে।এর পরের অধিবাচনটির মধ্যে প্রবেশ করবো আমরা—-
“চতুর্দিকের অন্ধকার ভরা তছনছ”—-তছনছ খুব প্রচলিত অ-বাংলা শব্দ যা আমাদের colloquial ভাষার সহজ আত্তীকরণ এবং আত্মীকরণ বলতেই পারি। ভাষা ব্যবহারে চিন্ময়ের এই পারদর্শিতা মুগ্ধ করে। অনেক ভাষার সমুদ্রে অবগাহন শেষে তিনি তুলে এনেছেন এইসব সাগর-ছেঁচা মণিমুক্তো। এই “তছনছ”— বিশেষ্য পদটির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে একটি বিশেষণ—“অন্ধকার ভরা”—শব্দবন্ধে তৈরী এমন বিশেষণ প্রয়োগ কম দেখেছি। এই deviation from the norm…চিন্ময়ের প্রাতিভতাকে চিনিয়ে দেয়। এমন এক অন্ধকার (অন্ধ-কৃ+খচ্) যা মানুষকে অন্ধ করে দিচ্ছে। আক্ষরিক অর্থেই তাইইই।
মানুষের কান্নার মুহূর্তগুলোকেই গিলে ফেলছে মানুষ। মরে যাচ্ছে সহজ আবেগের বহিঃপ্রকাশ। তাদের সব কান্না আজ নিম্নাঙ্গের গাঁটে গাঁটে আটকেছে । কবি বেদনার সঙ্গে বলেছেন —
“হাতে পায়ের গিঁটে আটকে থাকে”—- চোখ পর্যন্ত কান্না অশ্রু হয়ে পৌঁছতে পারছেনা। হৃদয়ের দরজা রুদ্ধ। চোখের জলে দ্বিদল পাপড়ি আর মেলেনা। প্রজ্ঞার পিদ্দিমটা আর জ্বলেনা তাই ২০৬ নং লেনের ঘরে ঘরে। কবি-মানুষ শুধু চৈতন্যের রুদ্ধ দুয়ারে করাঘাত করে আর বলে—
আমরা কতক্ষণ আর থমকানো রক্তের কেন্দ্রে ভাসবো!!!হে মহাজীবন !!!?
কী গোপন অবক্ষয় আড়ালে কবর খুঁড়ে চলেছে—-
ভাঙা মাটি খসে নীল হয়ে ওঠে—-এই নীল কি হলাহল নয়? মাটি তো মা। খণ্ডখণ্ড তার পচিত দেহ। আমাদের কাঁধে আজ মৃতমাতার শব। নীলবিষে জর্জর। আশীবিষ কি এর চেয়ে ভয়ঙ্কর??
“ঢেউয়ের ঘষায় জ্বলে “—- এখানে ক্ষণভঙ্গবাদের কথা কেন যেন মনে পড়ে যায়। বুদ্ধচেতনার আলো খুঁজে বেড়ায় পাঠক। ঘটনার ঢেউ উছলায় পরতে পরতে । উছলায় তার “এখন”–এর বিষবাস্প । তাই কবির ব্যাসচেতনায় ঘুরে ফিরে আসে একটাই প্রশ্ন—-
“আমরা কতক্ষণ এই থমকানো রক্তের কেন্দ্রে ভাসব”—-এইটিই শেষপর্যন্ত key sentence হয়ে কবি চিন্ময়ের সার্বিক অনুভূতির মূল্যায়ণের সহায়ক হয়ে ওঠে। একটা অধিবাচনিক সংলগ্নতা সুন্দরভাবে একবিতাকে অর্থবহ করেছে। আবার বলি , ‘অন্ধকার ভরা’ এই সর্বনামীয় সংযোজকটি (anaphor) কবিতার অবয়বকে অনন্য করেছে। চিন্ময় সার্থক রূপকৃৎ । সমগ্র কবিতাটিতে একটা অনুক্তগঠন (ellipsis) কবির মরমীচেতনাকে পাঠকের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সংশ্লিষ্ট রেখেছে। কবিতাটিতে যুগপৎ কবি ব্যবহার করেছেন অধিবাচনিক সংযুক্তি ও বিরতি—কার্যকরী প্রকরণ কৌশলে। মাঝের ছোট ছোট স্পেস বা ফাঁকগুলোই কবিতার ভাববিন্যাসকে যথাযথ করেছে এবং মূলতঃ চিন্ময় গুহ-র “এখন”– কবিতার ভাবাশ্রয়ী বিভাজনের ক্ষেত্রে এটি প্রয়োজনীয় ছিল। একটি পংক্তি এখনো ধ্রুবপদ হয়ে বেজে চলেছে–
“আমরা কতক্ষণ এই থমকানো রক্তের কেন্দ্রে ভাসব”—- আমাদের সকলেরই হাতে পায়ের গিঁটে আটকে থাকা স্তব্ধরক্তে দ্রোহের দোলা জাগে !!
কবি চিন্ময়ের কবিতা লেখার সঞ্চারপথে এসে হাজির হয়েছিল অনেক জ্ঞাত অজ্ঞাত সন্দর্ভ। হৃদয়ের সংযত উচ্চারণে তা কখনোই এরিয়া ছাপিয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠেনি বরং বেড়াভাঙা ব্যাপ্তিতে এনেছে অন্য ঐশ্বর্য। বলতেই হয়, একটি অদ্ভুত সংহতিই কবি চিন্ময়ের কবিতার ভাষিক সম্পদ।
ভারসাম্যগুণেই তাঁর কবিতা আধুনিক হয়েও গঠনে ক্ল্যাসিক সংহতিকে ধরে রেখেছে। বস্তুতঃ তাঁর মধ্যেকার কবি ও কর্মী সত্তার যে বিরোধাভাস তাঁর চলনপথ রচনা করেছে সেখানেও তিনি একটি মানানসই নৈর্ব্যক্তিক সুসমঞ্জসতায় অনেক বেশি গাঢ় সংবেদনা এনেছেন।
যাঁরা চিন্ময় পড়েছেন তাঁরা , চিন্ময় গুহ আসলে কবি , নাকি সফল গদ্যকার —- এই দ্বান্দ্বিকতায় দোল খাবেনই। আশ্চর্য এই যে ,কাব্য এবং গদ্যে সর্বত্রই তিনি এই দ্বৈততাকে আত্মসাম্যে ধরতে পেরেছেন। ঠিক এই কারণেই তাঁর গদ্যও হয়েছে কাব্যধর্মী। আমি বলি, এসব গদ্যও স্বতন্ত্র কবিতা। লক্ষ্য করেছি , যখন চিন্ময় কবি তখন তিনি অনেকবেশি নিঃসঙ্কোচ ও একমুখি। তাঁর কবিতাতে রয়েছে যে সহজাত রোমান্টিকতা , তাকে তিনি আড়াল করেননি, করতে চানও নি। কবিতা ক্ষেত্রে তিনি কোনোরকম মুখচ্ছদ ব্যবহারে অনীহ ছিলেন। তাঁর কবিতায় প্রতীকি ঐশ্বর্য অবশ্য অবাক করে। বোধকরি এসব কারণেই তাঁর কবিতায় এসেছে স্বপ্ন ও সত্যের যুগনদ্ধতা।
শব্দ ব্যবহারে চিন্ময়ের অসপত্ন অধিকার। সহজ কিন্তু গভীর, ব্যাপক ও রহস্যময় ,কখনও চূড়ান্ত মিস্টিক শব্দচয়নে এক অজাতদ্বন্দ্বী প্রতিভা তিনি। তাঁর একটি শব্দ, একটি শব্দবন্ধ কিম্বা বাক্যবন্ধ যেন শূন্যের মধ্যে থেকে উঠে আসে অন্য এক পরিপূর্ণতা নিয়ে।
সেসব শব্দেরা প্রতিবেশ-অনুষঙ্গে টেনে আনে কবিরই অনুভূত জীবনের নানান আকস্মিক চেতনা। সবচেয়ে আশ্চর্য হই তখন, যখন দেখি এসবকিছুই এগিয়ে এসেছে তাঁর নির্বাচিত একটিমাত্র শব্দিত কেন্দ্রের দিকে। আমার মনে হয় কবিতার নামকরণ গুলোর অনুধাবনেই এ সত্য খুঁজেপাওয়া যাবে। এসব যেন নিঃশব্দ-মেটাল্যাঙ্গুয়েজ হয়েই শিরোনামের সঙ্গে গ্রন্থিত। সমস্ত কবিতাকেই কবি ও পাঠকের চেতনার রাজ্যে পৌঁছে দেয় ঐ শব্দ। প্রসঙ্গতঃ চিন্ময় গুহের “যাদু” কবিতার কথা উল্লেখ করবো। একটা ঐন্দ্রজালিক সত্যতা সমগ্র কবিতাটির ভরকেন্দ্র। এ কবিতায় শব্দার্থ ও শব্দমূর্ছনা কি এক অনন্য সমাহৃতিতে ধৃত হয়েছে ,ভাবলে বিস্ময় জাগে।
চিন্ময় গুহের কবিতাতে একদিকে রয়েছে একটা সর্বতোভদ্র ঋজুতা অন্যদিকে রয়েছে নির্বস্তুক শব্দের অধ্যক্ষতা — এসব তাঁর কবিতাকে বিত্তশালী করেছে।
আসুন পাঠক, আমরা কবি চিন্ময়ের “যাদু” কবিতাটি একবার পড়ে নিই—–
“সামুদ্রিক নোনা গন্ধে স্মৃতির উঠোনে খড়
অন্ধকারে আভাময় হ’য়ে ওঠে ভয়ঙ্কর অগোছালো
গোধূলি বিকেল,যেন দুয়ারে দুয়ার
খুলে বিকেল গড়িয়ে ঘাস, কাঁচা ঘাস ঠাণ্ডারাতে
বর্শাহাতে অবিকল নারীর ধরণে নদী, ভিজে আলো
বিচ্ছুরিত, জলের ভিতরে সুর, দূর
ভাটিয়ালি মেঘ মাখে
হীরক ঠিকরানো ঢেউ, যেন-বিষতীক্ষ্ণ বৈদ্যুতিক
জ্বালা খসে যায় মৃদু মরালীর
চাবুক-আছড়ানো দেহে,ফুল ছিটকে যায় শূন্যে,
মাটিঘুম ছোঁয়া ফুল উদ্ভাস আকাশে ওড়ে
বর্শাহাতে নারী,নদী শুয়ে থাকে
ভাসমান ফুলে দীপ্ত, গতির নিশ্বাসে যাদুময়।”
কবিতাটি পড়তে পড়তে প্রথমেই মনে হল, কবি চিন্ময় কেন “যাদু”—এই নামকরণ করলেন? আমরা জানি চিন্ময় দর্শনে অর্ষণে মননে যতখানি ঋদ্ধ ঠিক ততখানি পারঙ্গম রূপকৃৎ-ও বটে। এ কবিতা কি তবে আঁকতে চাইছে কোনো ইন্দ্রজাল বাস্তবের ছবি যার জন্ম কবির মননে? এ কি কালার্ড পোয়েট্রি ? এ পেন্টিং কি তবে কবিরই ভেতরে ভেতরে জন্ম নিয়েছিল আর তাকেই কবি আঁকলেন অক্ষর দিয়ে? সরঞ্জাম কেবল কালি কলম পৃষ্ঠা আর মন?? নিতান্ত স্বল্প ও আড়ম্বরহীন সরঞ্জাম ব্যবহার করলেন কবি।
কবিতাটি যদি ম্যাজিক রিয়্যালিটি ক্রিয়েট করে থাকে তাহলে কিছু অব্যর্থ চিন্তা এসেই পড়ে——
১) এখানে ম্যাজিকও আছে রিয়্যালিটিও আছে।
২) পাঠকের দৃশ্য পরম্পরার একটা বোধ ক্রিয়াশীল আছে ।
কবিতাতে রিয়্যালিটি কি আগে বুঝতে পারলেই তার পরম্পরার ক্রিয়াশীলতাও বোধে অসবে। এ তো গেল কবিতায় রিয়ালিটির খোঁজের কথা কিন্তু ম্যাজিকটা কি? বিশেষতঃ কবিতার নামকরণ যেখানে “যাদু”…। আসলে ম্যাজিক হল রিয়্যালিটির পরম্পরাকে কনশাসলি ব্রেক করে কিছু ছবি লুকিয়ে ফেলার প্রবণতা। পাঠকের বোধের বাইরে এই অবস্থায় একটা ট্রান্স তৈরী হয়।
আমি কিন্তু এখনও নামকরণের স্তরেই রয়েছি। চিন্ময় এখানে বস্তু অবস্তু তে মিলিয়ে এবং কল্পনার ঐশ্বর্যে একটা নিজস্ব নান্দনিক কাব্যবিশ্ব গড়েছেন। ঠিক এখানেই যখন আমরা মুগ্ধ তখন কবি চিন্ময় লুকিয়ে ফেললেন অনুষঙ্গের কিছু পরম্পরা আর আমরা হারিয়ে গেলাম তাঁর এই “যাদু”ময় কবিতা বিশ্বে।
এই জায়গাটিই আমরা প্রথমে খুঁজবো।—–
“সামুদ্রিক নোনাগন্ধে স্মৃতির উঠোনে খড়”—-কী অদ্ভুত ইন্দ্রিয়ঘনতায় চিন্ময় সামুদ্রিক নোনা গন্ধের কথা বললেন। “নোনা”–শব্দটা সাদামাটা জীবন থেকে উঠে এসেছে। এই অনাড়ম্বর দেশজ লেক্সিস নির্বাচনটি আকর্ষণ তো করেই।
এই গন্ধ উসকে দেয় কবির অবচেতনের মাইক্রোচিপ। আনলিমিটেড ডেটা থেকে স্মৃতিরই উঠোনে বেরিয়ে আসে কিছু এককালিন শুকনো খোড়ো স্মৃতি। আর ঠিক তখনই—–
“অন্ধকারে আভাময় হ’য়ে ওঠে ভয়ঙ্কর অগোছালো
গোধূলি বিকেল,”…..
—-অন্ধকার কেন? অন্ধকার অবচেতনা কি ফ্রয়েডীয় ভাবনার স্পর্শে ইষৎ আভাময় ? নাকি আইভরি ব্ল্যাকে কবি এবার আঁকবেন কালার্ড অক্ষরছবি? আর গোধূলি বিকেল? বিকেল কি ঠিক গোধূলিই? নাকি কবির জাক্সট অপজিশন ব্যবহারের প্রকরণে তৈরী তৃতীয় কোনো সময় নির্দেশ যা আস্তে আস্তে প্রকৃতির ওপর টেনে দিচ্ছে জাদুওড়না?
ভয়ঙ্কর অগোছালো কেন ?
এখানেই কি শুরু হয়েছে সুশৃঙ্খল অনুষঙ্গের পরম্পরার বিচ্যুতি ? নর্ম্ থেকে ডেভিয়েশন ? এটি একটি প্রেগন্যান্ট চিত্রজল্প (চিত্রকল্প নয়) যা থেকে বেরিয়েছে আরো একটি উপমা।
এই তো ম্যাজিক শুরুর নির্দেশনামা মনে হয়।”যেন”–এই সাকল্যবাচক শব্দটি দিয়ে কবি কবিতার মধ্যে প্রতিস্থাপন করলেন একটি উপমাকল্প—
“যেন দুয়ারে দুয়ার
খুলে বিকেল গড়িয়ে ঘাস, কাঁচা ঘাস ঠাণ্ডারাতে
বর্শাহাতে অবিকল নারীর ধরণে নদী,”—- দুয়ারে দুয়ার খুলে????
সে কেমন? কবি ইনটেনশনালি লুকিয়ে ফেলছেন পাঠকের চিন্তার অতিসাধারণ অনুষঙ্গ পরম্পরার কিছু স্টেপ। এই স্টেপ জাম্পই ম্যাজিক।যাদু। আছে অথচ যেন নেই। দুয়ার খোলার সহজ অনুষঙ্গ পাঠক চেনে কিন্তু যখনই “দুয়ারে দুয়ার”–খোলার কথা আসে তখন পরম্পরা হারিয়ে যায়। শুরু হয় ইন্দ্রজাল কিম্বা চিন্ময়-ম্যাজিক , যাদু। তখন আমরা সনাক্ত করতেই পারিনা কাব্যসৌভিক কবি চিন্ময় গুহকে। কবি তাঁর কাজ করে চলেন। প্রতিবেশী অনুষঙ্গরাও এসে দাঁড়ায় একে একে কেননা শব্দের একক কোনো মানে নেই। এসে পড়ে—-
১) ভিজে আলোর বিচ্ছুরণ
২) বেজে ওঠে জলের ভিতরে সুর,
৩)দূর ভাটিয়ালি মেঘ মাখে
হীরক ঠিকরানো ঢেউ,
—একটা রোমান্টিক ট্রান্সে ভেসে যায় পাঠকের ব্যক্তিচৈতন্য ও পরিবেশচৈতন্য একসঙ্গে।
আবার একটি উপমা পাচ্ছি— শীতের সমুদ্রে জল বর্শার মত সূচীমুখ। নদীর সঙ্গমে আপাতচঞ্চল সমুদ্র অবশেষে স্থির চৈতন্য। সে এক অনন্য প্ল্যাটফর্ম যার ওপর নেচে ওঠে নারী ও নদী ,সমার্থক হয়েই। সে কেমন অক্ষরছবি?—-
“যেন-বিষতীক্ষ্ণ বৈদ্যুতিক
জ্বালা খসে যায় মৃদু মরালীর
চাবুক-আছড়ানো দেহে”—-
নদী , নারী , মৃদু মরালীর চাবুক আছড়ানো দেহ কি চরম শৈত্যের আঁচড়? জীবন ও যাপনের পরম্পরা ভেঙে কবি কিন্তু তার সঙ্গে মিশিয়ে দিলেন কিছু সাররিয়ালের স্পর্শ। তাই কবিতার এই শেষের অংশে পৌঁছে কবির ঐ ম্যাজিক সৃষ্টি ড্রিমলাইক স্টেটে পৌঁছে যাচ্ছে—–
“ফুল ছিটকে যায় শূন্যে,
মাটিঘুম ছোঁয়া ফুল উদ্ভাস আকাশে ওড়ে”—–এসব ফুল কি আকাশ কুসুম? নাকি রবফকুচি জলের উদ্ভাস ভাটিয়ালিতে মিশে নির্ভার উড্ডীনতায় অলৌকিক হয়ে উঠেছে? মাটিঘুম ছোঁয়া ফুল উড়ে যায় মানডেন থেকে ডিভিনিটির কক্ষপথে।
সবশেষে শান্তচেতন কবির দর্শনে ধরা দেয়—–নদী আর নারীর রহস্যময় ইন্দ্রজাল। আমরা এখন কেবল অপলকে দেখতেই থাকি—-
“বর্শাহাতে নারী,নদী শুয়ে থাকে
ভাসমান ফুলে দীপ্ত, গতির নিশ্বাসে যাদুময়।।”—–
এই যাদু সৃষ্টিটাই মূল রস এ কবিতার ।আমাদের কাছে এটিই মহাপ্রকৃতি-জড়ানো এক অতিলৌকিক উপনিষদীয় আশ্চর্যরস। এ যেন গাণিতিক এ্যাবসোলিউট। অনন্তের খণ্ডবিস্ময় ।
কবি চিন্ময়ের আলোকিত অনুভবে তাঁর কবিতার ভাব ও রূপ অখণ্ড একটি বিস্তীর্নতার মধ্যে স্পন্দিত হয়েছে। আশ্চর্য কুশলতায় একটা সমগ্রকে একক কবিতার মধ্যে ধরে রেখেছেন কবি। আমি এখানেই চিন্ময়কে ইমপ্রেশনিস্ট বলতে সচ্ছন্দ বোধ করি। এই সমগ্রতায় লুকিয়ে আছে অনন্ত। সেই অনন্তের সঙ্গে কখনও কখনও হয়তো কবির প্রাণের সুরটি মেলেনি , হয়ত সেকারণেই তাঁর কবিতায় ছায়া পড়েছে অন্যতর মর্মবেদনার, কিন্তু যখনই যেখানে যে মুহূর্তে সেই সুর মিলেছে তখন তা স্রষ্টাকেও ছাড়িয়ে গেছে।
অবাক হয়ে দেখেছি ইমপ্রেশনিস্ট কবি চিন্ময় অভিজ্ঞতার টুকরো টুকরো ঘনকের মধ্যেই একটা ভাবার্থ তৈরী করে দিয়েছেন। বলতে সংকোচ নেই ,ঘোর লাগে ঐ ইম্প্রেশনের জগতে প্রবেশাধিকার পেলে। সেখানেই দেখতে পাওয়া যাবে যেসব শব্দ নিয়ে কবি ইন্দ্রজাল সত্যতা জড়িয়ে দিয়েছেন তাঁর কবিতার গায়ে। সেসব কখনও হয়েউঠেছে শরীরী ,কখনও বা অশরীরী । বিস্ময়ের অন্ত থাকেনা যখন দেখি সেটিও বাঁধা পড়েছে অত্যন্ত আধুনিক বুননে। একই সঙ্গে অবিশ্বাস্য পাথরস্থৈর্যে ও গতিময়তায় গড়ে উঠেছে চিন্ময়ের চেতনাবিশ্ব—-তা যেন রবীন্দ্রনাথ ও বার্গসঁ এর গতির অনাস্বাদিতপূর্ব মেলবন্ধন।
সেইসব চেতনাপ্রত্যুষে চিন্ময়ের কবিতা-রা হয়ে উঠেছে তাঁরই আত্মবোধের বাহন। মনে হয়েছে যেন চিন্ময়ের কবিতায় তাঁরই অন্তরপুরুষ কবির্মণীষী হয়ে প্রতিনিয়ত নবীভূত হতে চাইছেন। এই পথেই সহজে এসেছে তাঁর শব্দের জীবন্তব্যঞ্জনা শক্তি। এইসব শব্দের মিলিত জাদুই পাঠকেরও চেতনাগত সংবেদনকে সংবাহিত করেছে।
কখনও সেই সংবহন মূর্ত হয়েছে কবিতাদেহের অস্থিমজ্জায়, কখনও বা তার ঊর্ধ্বে কোনো অলোকসম্ভাব্যতার ইথারে। প্রতি ক্ষেত্রেই একটা Extra Sensory Perception ক্রিয়াশীল দেখেছি আর কবি যেন এক আশ্চর্য লক্ষ্যের দিকে মন্ত্রারূঢ়ের মত ভ্রমণ করেছেন।
আমরা এখন কবি চিন্ময় গুহের অন্য আরেকটি কবিতা পড়ে নেব——শিরোনাম–“শরীর”
“সমস্ত অন্তরঙ্গ পিদ্দিম গ’লে যাচ্ছে
সমস্ত মুখ গলে যাচ্ছে
দশাশ্বমেধের ঘাটের ওপর দিয়ে ব’য়ে যাচ্ছে গঙ্গা
সমতল থেকে পদ্মাভসঙ্কাশ
অপ-হাওয়ার গলুই-এর মধ্যে মাথা নিচু
আমার মা, ধ্বংসোন্মুখ
কয়েকটি জ্যামিতিক মুঠো এবড়োখেবড়ো শরীর
শ্মশানবন্ধুরা ছড়িয়ে দিচ্ছে ইতস্তত।”
কবিতার নামকরণটি ভাবায়। কবিতাটি শরীরের মৃত্যু ও জীবনের বুনোটে ধরে রাখে নিজ নিজ অবস্থান।কবিতার প্রথম স্তবকে প্রতীকি চিত্রকল্পের প্রতিস্থাপন চমৎকার।
চারটি কাব্যিক সংবর্গের (genre—-এখানে stanza ভাগ )এর অধিস্তরীয় অধিবাচনকে নিয়ে কবি চিন্ময় এই কবিতা দেহ গড়লেন। স্তবকগুলির মধ্যের ঐ ফাঁকটুকুই পাঠকের বোধ ও মননের সঞ্চরণ ক্ষেত্র। এই অধিবাচনিক স্তরের ওপরেই আবার নির্ভর করে আছে প্রথম পোয়েটিক ডিসকোর্সটি—“সমস্ত অন্তরঙ্গ পিদ্দিম গ’লে যাচ্ছে”—— এ এমন একটি অদ্ভুত ডিসকোর্স যার সঙ্গে মিশে আছে ভাবময় অন্তরঙ্গ উজ্জ্বল মানুষদের গলে যাওয়ার ছবি। যারাই অন্তরঙ্গ ছিল তারা সব গলে যাচ্ছে? এ কি অন্য নির্বাপণ? “সমস্ত”–এই শব্দটির সংযুক্তিতে বাক্যটি অখণ্ডতার ভাব পেয়েছে।আবার একই সঙ্গে “অন্তরঙ্গ পিদ্দিম”— শব্দ ব্যবহারে কিন্তু রয়ে যাচ্ছে খণ্ডের প্রতিভাস। স্বাভাবিকভাবে এইখানে একটা
“না-অন্তরঙ্গতার” কথাও থেকেই যাচ্ছে। অথচ আশ্চর্যভাবে কবি এ দুটিকে মিলিয়ে দিচ্ছেন একটা দারুণ যোগবিয়োগের ক্ষেত্রে।
“সমস্ত মুখ” গলে যাচ্ছে আর “সমস্ত অন্তরঙ্গ পিদ্দিম” গলে যাচ্ছে—– উভয়ের সামান্য ধর্ম গলন। এই সম্পূর্ণ নির্মাণটিকে ভাঙলে পাবো দুটি প্রক্রিয়া। একটি subtractive আর অন্যটা additive….। এছাড়াও “পিদ্দিম” শব্দের (দ+দ) onomatopoetic প্রয়োগটিও প্রণিধানযোগ্য। এখানেই তৈরী হচ্ছে অলৌকিক বাকপ্রতিমা যাকে বলতে পারি phono-aesthetic-image..।মনে হয় কবিতাটির বুনোটে এই ধ্বন্যাত্মক প্রয়োগটি অপরিহার্য ছিল। ‘পিদ্দিম’ — এই ধ্বন্যাত্মক শব্দটিতে , স্ট্রেসে ও একসেন্টের আশ্রয়ে দেখতে পাচ্ছি রয়েছে ধ্বনির সঙ্গে কবির অনুভূতির প্রগাঢ় একটা যোগাযোগ। মনে হয় অন্য শব্দের তুলনায় এই ব্যথাময় অনুভবটি অপেক্ষাকৃত দ্রুতগতিতে অর্থকে সরাসরি শ্রোতা বা পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছে।কবির সাফল্য এখানেই।
“সমস্ত অন্তরঙ্গ পিদ্দিম” ও “সমস্ত মুখ” গলে যাচ্ছে—-অন্তরঙ্গ মানুষের নাকি পিদ্দিমের গলে যাওয়ার ছবি কবি আঁকছেন? এই ছবিতে রয়েছে সময়ের লুপ্ত ইম্প্রেশন ( impression of time) —পিদ্দিম সন্ধ্যারাতের কথা বলে। ইমপ্রেশনিস্ট কবি চিন্ময় গলতে দেখছেন দশাশ্বমেধঘাটের সন্ধ্যার পিদ্দিমকে নাকি দালির ঘড়ির মত তৃতীয় কোনো গেরস্থালির স্মৃতিমেদুর সন্ধ্যারাতকে? আমরা একটা অবলোপের মধ্যে দিয়ে চলছি আর আমাদের ঘাড়ে কবিতার মেটামরফোসিসের নতুন বিশ্ববয়ন চলছে।আমি কি কবির ভাবনাকে ডিকনস্ট্রাকট করছি???
এখন এলাম, দশাশ্বমেধ ঘাটে। সেখানে দেখি—
“দশাশ্বমেধের ঘাটের ওপর দিয়ে ব’য়ে যাচ্ছে গঙ্গা
সমতল থেকে পদ্মাভসঙ্কাশ”…. সুন্দর ব্যবহার ‘পদ্মাভসঙ্কাশ’….
পদ্মের আভার সদৃশ গঙ্গা অর্থাৎ পদ্মশোভন গঙ্গা।গঙ্গা বুকে করে বইছে মানুষের জীবনের অথবা মরণের অঞ্জলি।অপ্ মানে জল, গঙ্গার জল, হাওয়াও এখানে গাঙ্গেয়। সেই…”অপ-হাওয়ার গলুই-এর মধ্যে মাথা নিচু
আমার মা,”—–গলুই নৌকোর হয়।এটি আশ্রয়। কবির মা ওখানেই আশ্রিতা? কেন? মৃতা? কোন্ মা? গর্ভধারিণী অথবা জগজ্জনী মা ? তিনিই কি অদ্ভুতভাবে বস্তু ও অ-বস্তুতে মিলেমিশে এক অন্যছবি তৈরী হলেন?
—- মৃত্যুপথের ছবি আঁকলেন চিন্ময় এখানে ধ্বংসোন্মুখ আরো কয়েকটি “জ্যামিতিক মুঠো এবড়োখেবড়ো শরীর”..এমন সব খণ্ড খণ্ড চিত্রের কোলাজে। এখানেই —-এইসব খণ্ডিত খ-হর চিত্রগুলো শ্মশানবন্ধুরা ছড়িয়ে দিচ্ছে ইতস্তত।স্পষ্টতঃ এটি পুন্যতম মৃত্যুর ছবি এঁকেছেন কবি।একি কোনো স্বজনবিয়োগের ছবি? ব্যথাময় এক নির্বাপিত আলোর কথা?
এমন নর্ম্-ভাঙা কবিতারা কখনও জন্মমাত্রই জনপ্রিয় হয় না আর এখানেই এ কবিতার কৌলীন্য। চিন্ময়ের কবিতার বাকনির্মিতিই তাঁর কাব্য। বলাবাহুল্য গদ্যতেও তাইই। তাঁর কবিতায় শব্দেরা উঠে আসে শূন্যতা থেকে যে শূন্যতা পূর্ণ—- একথা আমি আগেই বলেছি। শব্দদের মধ্যে মধ্যে , কখনোবা বাক্যেদের মধ্যেও শূন্যকে, কবিই সৃষ্টি করেন । এছাড়া অন্যকোনো নেতিশূন্যতার শৈথিল্য তাঁর কবিতায় নেই।
“বিভাস”—-কবিতাতে চিন্ময় গুহকে পেতে পারি অন্য অন্তরঙ্গতায়। রসের পরিবেশনায় , চিন্ময় যেন বিন্দু থেকে বৃত্ত রচনা করেছেন। “বিভাস” ভাসছে অতিচৈতন্যের সিংহদুয়ার খুলে যাওয়া আনন্দ বিভাসে। চিন্ময়ের প্রতিভা এ কবিতাতে অনাস্বাদিতপূর্ব এক অপূর্ববস্তু নির্মাণ করেছে।সৃষ্টি করেছে বস্তুরাশির পিছনে এক মায়ার জগৎ। এ কবিতায় রয়েছে অন্য আবেদন। এখানে যেমন আছে বুদ্ধিগ্রাহ্য অর্থ তেমনি আছে আশ্চর্য আত্মগত স্বরূপ। এখানেই কবি ও পাঠকের প্রাণ ও মননের পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াটি নীরবে সম্পাদিত হয়ে চলেছে।এসব পাঠকের চোখের সামনেই ঘটছে….যেন এও এক জাদুবাস্তবের এলাকা। কবির সঞ্চারি শক্তির এমন ডানা মেলা আমাদের মুগ্ধ করে রাখে।
কবিতাটি এইবার পড়ে নেব।―――
“নারী, তুমি মুখ তোলো,
তোমায় দেখব।
জলে ডুবছে চাঁদ,
তার ঠোঁটে ঝরছে মধু।
নারী, একবার মুখ তোলো,
তোমায় দেখব।
সুদূর জলে নদীর খয়েরি বাঁকে
কে তুমি যাও, উদাস, আকাশ কাঁখে
দোহাই, একটু দাঁড়াও।
নারী, তুমি মুখ তোলো,
তোমায় দেখব।”
১৯৭৬ এ লেখা চিন্ময়ের কবিতা “বিভাস”…চিন্ময়ের এই কবিতার চাবিকাঠিটি কবিতার শিরোনামেই লুকোনো রয়েছে। প্রথমেই জানবো বিভাস শব্দের প্রসারণ কতখানি। বিভাস রাত্রিকালীন একটি রাগিনী।সেই সূত্রেই কি চাঁদের কথা এল? উজ্জ্বল দীপ্তির প্রকাশ। মতান্তরে ভোরের রাগিনী। (বি+√ভাস্+অ) এখানে তবে কোন অর্থ বহন করছে খুঁজতে হবে।
ধরি বিভাস যদি প্রাতঃরাগিনী (রাগিনী কিন্তু স্ত্রীবাচক) হয় তবে কবি কি ঝলমলে কোনো নারীর সঙ্গে তাকে এক করে দেখছেন? অথবা কোনো রক্তমাংসের নারীই হয়েছে বিভাসরাগিনী !!
সেই নারীকেই কবি বলছেন—–
নারী, তুমি মুখ তোলো,
তোমায় দেখব। —– কি অদ্ভুত আবেদন ! এই নারীই কি মুখ ডুবিয়ে রেখেছে জলে? একান্ত আত্মমগ্নতায়? সকালের ঝলমলে বিভাস কি সন্ধ্যায় ধরেছে অন্যসুর? রাতের রাগিনী হয়ে? আবছায়া, কুহকের মত ! এই নারীই কি পরে রূপান্তরিত হল ব্যক্তিগত চাঁদে? তবে যে কবি বললেন—
“জলে ডুবছে চাঁদ,
তার ঠোঁটে ঝরছে মধু। —-“–এই জলজ চাঁদেই কি চন্দ্রাহত কবি খুঁজছেন মধুপর্ণা রাতের আলো কিম্বা অলৌকিক প্রসন্নতা!?
একটা সুগোপন synesthesia image যেন উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে শরীরী আচ্ছন্নতায়। চাঁদের ঠোঁটে ঝরছে মধু। চাঁদ ডুবছে জলের প্রসন্ন গভীরতায়। সমগ্র প্রকৃতিই যেন সেই মুহুর্তে মধুপর্ণা হল—নিভৃত প্রণয়োচ্চারণে—ওঁ মধু!!
একি প্রাকৃতিক চাঁদ নাকি চন্দ্রালস কবির আন্তর প্রেরণা—বাক্ অথবা
প্রতিবিম্বিত নারীরূপ যার
উপমা কেবলমাত্র চাঁদ।
এ তো কল্পনারী—অর্ধেক মানুষী আর অর্ধেক কল্পনা। কবি যেন “আপন মনের মাধুরী মিশায়ে”— তাকেই রচনা করছেন তিলোত্তমা করে। কিন্তু একবার তার মুখ না দেখলে সমর্পণ কি আব্রহ্ম আকাশ হয়ে উঠবে?তাই কবির প্রার্থনা—-অপাবৃণু। অবগুন্ঠন খোলো। সনির্বন্ধ আবেদন—
“নারী, একবার মুখ তোলো,
তোমায় দেখব। “
চাঁদ আর নারী কি সমার্থক? কি গভীর তার আত্মরতি। পৃথিবীর কোনো প্রেমিকের ছায়া পড়ে না সেখানে। কেবল জলের আয়নায় প্রতিবিম্ব দেখে সে, নিজের। জাগেনা কোনো মন্ময় বা তন্ময় তনুময় প্রেম সে বুকে। চাঁদ আর সরসীর প্রেমে পাগল প্রেমিকের আকুতি চাপা পড়ে যায়।
কি অসাধারণ কাব্যিক ডিসকোর্সগুলো। মনে হয় এক এক করে কুড়িয়ে রাখি স্মৃতিমঞ্জুষায়——কী অনন্য উপমাকল্প—–“সুদূর জলে নদীর খয়েরি বাঁকে”
—- সুদূর জল…নদীর খয়েরি বাঁক —কবি চিন্ময়ের সংবেদনার রঙে খয়েরী—-কিছু বাস্তব দর্শন কিছুটা কল্পনার রঙে বাঁক নিয়েছে উপমাটি যার রঙ খয়েরী।
কবি আপূর্যমান বিহ্বলতায় দেখেন—-
“কে তুমি যাও, উদাস, আকাশ কাঁখে” —নদীর বাঁক কবি কল্পনায় নারীর কাঁখ।সেখানে উদাসীন নারী হয়তো কোনো প্রসারিত জগৎ-ভোলা আকাশ ব্যাপ্তিতেই নিলীন। কি অসাধারণ কল্পনা। কী এক্সপ্যানশন। উদাস আকাশ কাঁখে? সমস্ত প্রকৃতিই — কি নিসর্গ, কি মানব, সবটুকুই যেন সূফীসাধনার প্রিয়া-অভিমুখী হয়ে গেছে। আকাশকে আপনার কাঁখে ধারণ করেছে কে? কবির কল্প নারী যার বাস্তব অস্তিত্ব আছেই। সন্দেহাতীতভাবে।
তাই তার কাছে কবির আবেদন—-
“দোহাই, একটু দাঁড়াও।
নারী, তুমি মুখ তোলো,
তোমায় দেখব।”— কেননা কবিই জানেন নারীই সেই মানবী আইডল যার কাছে আছে সার্বভৌম প্রেমের সম্পদ। নারীই তাই ট্রেজার আইল্যাণ্ড ইয়েট টু বি এক্সপ্লোরড্……!!!!
বস্তুতঃ চিন্ময় গুহর কবিতা পড়তে পড়তে আমরা একটা Maze এর সামনে এসে দাঁড়াই। হতে পারে সে এক অন্যবোধের সিংহদুয়ার। সে এক অবোধবিস্ময় ! কিম্বা শুধুই ডুবে যাওয়া কোনো পরমাশ্চর্যের মধ্যে !কবিতার মধ্যে যে স্পেসগুলো রয়েছে সেখানেই কি তবে উঠেছে কোনো মরমীয়া ঢেউ?! এভাবেই চিন্ময় পাঠকের মনে ভ’রে দেন অনন্য বেদন (বোধ)।যার সেই সংবিদ হল সে পাঠক কখনও চিন্ময়ের কবিতাভূমি ছেড়ে যেতে পারবেন না।।