কবি ও কবিতা বিষয়ক গদ্য
পারমিতা ভৌমিক
যাদু * চিন্ময় গুহ
সামুদ্রিক নোনা গন্ধে স্মৃতির উঠোনে খড়
অন্ধকারে আভাময় হ’য়ে ওঠে ভয়ঙ্কর অগোছালো
গোধূলি বিকেল,যেন দুয়ারে দুয়ার
খুলে বিকেল গড়িয়ে ঘাস, কাঁচা ঘাস ঠাণ্ডারাতে
বর্শাহাতে অবিকল নারীর ধরণে নদী,ভিজে আলো
বিচ্ছুরিত, জলের ভিতরে সুর,দূর
ভাটিয়ালি মেঘ মাখে
হীরক ঠিকরানো ঢেউ, যেন-বিষতীক্ষ্ণ বৈদ্যুতিক
জ্বালা খসে যায় মৃদু মরালীর
চাবুক-আছড়ানো দেহে,ফুল ছিটকে যায় শূন্যে,
মাটিঘুম ছোঁয়া ফুল উদ্ভাস আকাশে ওড়ে
বর্শাহাতে নারী,নদী শুয়ে থাকে
ভাসমান ফুলে দীপ্ত, গতির নিশ্বাসে যাদুময়।।
কবিতাটি পড়তে পড়তে প্রথমেই মনে হল, কবি চিন্ময় কেন “যাদু”—এই নামকরণ করলেন? আমরা জানি চিন্ময় দর্শনে অর্ষণে মননে যতখানি ঋদ্ধ ঠিক ততখানি পারঙ্গম রূপকৃৎ-ও বটে। এ কবিতা কি তবে আঁকতে চাইছে কোনো ইন্দ্রজাল বাস্তবের ছবি যার জন্ম কবির মননে? এ কি কালার্ড পোয়েট্রি ? এ পেন্টিং কি তবে কবিরই ভেতরে ভেতরে জন্ম নিয়েছিল আর তাকেই কবি আঁকলেন অক্ষর দিয়ে? সরঞ্জাম কেবল কালি কলম পৃষ্ঠা আর মন?? নিতান্ত স্বল্প ও আড়ম্বরহীন সরঞ্জাম ব্যবহার করলেন কবি।
কবিতাটি যদি ম্যাজিক রিয়্যালিটি ক্রিয়েট করে থাকে তাহলে কিছু অব্যর্থ চিন্তা এসেই পড়ে——
১) এখানে ম্যাজিকও আছে রিয়্যালিটিও আছে।
২) পাঠকের দৃশ্য পরম্পরার একটা বোধ ক্রিয়াশীল আছে ।
কবিতাতে রিয়্যালিটি কি আগে বুঝতে পারলেই তার পরম্পরার ক্রিয়াশীলতাও বোধে অসবে। এ তো গেল কবিতায় রিয়ালিটির খোঁজের কথা কিন্তু ম্যাজিকটা কি? বিশেষতঃ কবিতার নামকরণ যেখানে “যাদু”…। আসলে ম্যাজিক হল রিয়্যালিটির পরম্পরাকে কনশাসলি ব্রেক করে কিছু ছবি লুকিয়ে ফেলার প্রবণতা। পাঠকের বোধের বাইরে এই অবস্থায় একটা ট্রান্স তৈরী হয়।
আমি কিন্তু এখনও নামকরণের স্তরেই রয়েছি। চিন্ময় এখানে বস্তু অবস্তুতে মিলিয়ে এবং কল্পনার ঐশ্বর্যে একটা নিজস্ব নান্দনিক কাব্যবিশ্ব গড়েছেন। ঠিক এখানেই যখন আমরা মুগ্ধ তখন কবি চিন্ময় লুকিয়ে ফেললেন অনুষঙ্গের কিছু পরম্পরা আর আমরা হারিয়ে গেলাম তাঁর এই “যাদু”ময় কবিতা বিশ্বে।
এই জায়গাটিই আমরা প্রথমে খুঁজবো।—–
“সামুদ্রিক নোনাগন্ধে স্মৃতির উঠোনে খড়”—-কী অদ্ভুত ইন্দ্রিয়ঘনতায় চিন্ময় সামুদ্রিক নোনা গন্ধের কথা বললেন। “নোনা”–শব্দটা সাদামাটা জীবন থেকে উঠে এসেছে।এই অনাড়ম্বর দেশজ লেক্সিস নির্বাচনটি আকর্ষণ তো করেই।
এই গন্ধ উসকে দেয় কবির অবচেতনের মাইক্রোচিপ। আনলিমিটেড ডেটা থেকে স্মৃতিরই উঠোনে বেরিয়ে আসে কিছু এককালিন শুকনো খোড়ো স্মৃতি। আর ঠিক তখনই—–
“অন্ধকারে আভাময় হ’য়ে ওঠে ভয়ঙ্কর অগোছালো
গোধূলি বিকেল,”…..
—-অন্ধকার কেন? অন্ধকার অবচেতনা কি ফ্রয়েডীয় ভাবনার স্পর্শে ইষৎ আভাময় ? নাকি আইভরি ব্ল্যাকে কবি এবার আঁকবেন কালার্ড অক্ষরছবি? আর গোধূলি বিকেল? বিকেল কি ঠিক গোধূলিই? নাকি কবির জাক্সট অপজিশন ব্যবহারের প্রকরণে তৈরী তৃতীয় কোনো সময় নির্দেশ যা আস্তে আস্তে প্রকৃতির ওপর টেনে দিচ্ছে জাদুওড়না?
ভয়ঙ্কর অগোছালো কেন ?
এখানেই কি শুরু হয়েছে সুশৃঙ্খল অনুষঙ্গের পরম্পরার বিচ্যুতি ? নর্ম্ থেকে ডেভিয়েশন ? এটি একটি প্রেগন্যান্ট চিত্রজল্প (চিত্রকল্প নয়) যা থেকে বেরিয়েছে আরো একটি উপমা।
এই তো ম্যাজিক শুরুর নির্দেশনামা মনে হয়।”যেন”–এই সাকল্যবাচক শব্দটি দিয়ে কবি কবিতার মধ্যে প্রতিস্থাপন করলেন একটি উপমাকল্প—–
“যেন দুয়ারে দুয়ার
খুলে বিকেল গড়িয়ে ঘাস, কাঁচা ঘাস ঠাণ্ডারাতে
বর্শাহাতে অবিকল নারীর ধরণে নদী,”—- দুয়ারে দুয়ার খুলে????
সে কেমন? কবি ইনটেনশনালি লুকিয়ে ফেলছেন পাঠকের চিন্তার অতিসাধারণ অনুষঙ্গ পরম্পরার কিছু স্টেপ। এই স্টেপজাম্পই ম্যাজিক।যাদু। আছে অথচ যেন নেই। দুয়ার খোলার সহজ অনুষঙ্গ পাঠক চেনে কিন্তু যখনই “দুয়ারে দুয়ার”–খোলার কথা আসে তখন পরম্পরা হারিয়ে যায়। শুরু হয় ইন্দ্রজাল কিম্বা চিন্ময়-ম্যাজিক , যাদু। তখন আমরা সনাক্ত করতেই পারিনা কাব্যসৌভিক কবি চিন্ময় গুহকে। কবি তাঁর কাজ করে চলেন। প্রতিবেশী অনুষঙ্গরাও এসে দাঁড়ায় একে একে কেননা শব্দের একক কোনো মানে নেই। এসে পড়ে—-
১) ভিজে আলোর
বিচ্ছুরণ
২) বেজে ওঠে জলের ভিতরে সুর,
৩)দূর ভাটিয়ালি মেঘ মাখে
হীরক ঠিকরানো ঢেউ,
—একটা রোমান্টিক ট্রান্সে ভেসে যায় পাঠকের ব্যক্তিচৈতন্য ও পরিবেশচৈতন্য একসঙ্গে।
আবার একটি উপমা পাচ্ছি— শীতের সমুদ্রে জল বর্শার মত সূচীমুখ। নদীর সঙ্গমে আপাতচঞ্চল সমুদ্র অবশেষে স্থির চৈতন্য। সে এক অনন্য প্ল্যাটফর্ম যার ওপর নেচে ওঠে নারী ও নদী ,সমার্থক হয়েই। সে কেমন অক্ষরছবি?—-
“যেন-বিষতীক্ষ্ণ বৈদ্যুতিক
জ্বালা খসে যায় মৃদু মরালীর
চাবুক-আছড়ানো দেহে”—-
নদী , নারী , মৃদু মরালীর চাবুক আছড়ানো দেহ কি চরম শৈত্যের আঁচড়? জীবন ও যাপনের পরম্পরা ভেঙে কবি কিন্তু তার সঙ্গে মিশিয়ে দিলেন কিছু সাররিয়ালের স্পর্শ। তাই কবিতার এই শেষের অংশে পৌঁছে কবির ঐ ম্যাজিক সৃষ্টি ড্রিমলাইক স্টেটে পৌঁছে যাচ্ছে—–
“ফুল ছিটকে যায় শূন্যে,
মাটিঘুম ছোঁয়া ফুল উদ্ভাস আকাশে ওড়ে”—–এসব ফুল কি আকাশ কুসুম? নাকি রবফকুচি জলের উদ্ভাস ভাটিয়ালিতে মিশে নির্ভার উড্ডীনতায় অলৌকিক হয়ে উঠেছে? মাটিঘুম ছোঁয়া ফুল উড়ে যায় মানডেন থেকে ডিভিনিটির কক্ষপথে।
সবশেষে শান্তচেতন কবির দর্শনে ধরা দেয়—–নদী আর নারীর রহস্যময় ইন্দ্রজাল। আমরা এখন কেবল অপলকে দেখতেই থাকি—-
“বর্শাহাতে নারী,নদী শুয়ে থাকে
ভাসমান ফুলে দীপ্ত, গতির নিশ্বাসে যাদুময়।।”—–
এই যাদু সৃষ্টিটাই মূল রস এ কবিতার । আমাদের কাছে এটিই মহাপ্রকৃতি-জড়ানো এক অতিলৌকিক উপনিষদীয় আশ্চর্যরস। এ যেন গাণিতিক এ্যাবসোলিউট। অনন্তের খণ্ডবিস্ময়