কবিতার সংযোগ
ঋতো আহমেদ
সত্যের দেখা
যে মন জীবনকে ছুঁতে চায়, আমরা সেই মন নিয়েই কি কবিতার দিকে যাই? ‘কবিতার ট্রান্সট্রোমার’ বইয়ের ভূমিকায় জুয়েল ভাই লিখেছিলেন, ‘ট্রান্সট্রোমারের কবিতা পড়ে মাঝেমাঝে মনে হয় তিনি যেন আমাদের ছেড়ে দিয়েছেন এক প্রশ্নময় পৃথিবীতে। যেসব প্রশ্নের সহজ কোনও জবাব বা সমাধান নেই। আর পাঠক দাঁড়িয়ে থাকেন এক অচেনা সীমান্তে; কেননা, তিনি মনে করেন, ‘‘সীমান্তেই দেখা মেলে সত্যের– truth appears only at the borders.” আবার ওসমান গণি তাঁর এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছিলেন, ‘বাংলা সাহিত্যে কবি জুয়েল মাজহারের সংযোজন বেশ মজবুতই বলা চলে। তিনি শক্তিমান, স্পষ্টবাক, গভীর গভীরতর কাব্যসত্তার কবি। তিনি বেশিরভাগ কবিতায় ঘটনাচ্ছলে জীবনের অমোঘ জিজ্ঞাসাগুলোকে উন্মোচিত করেন, যেখানে শব্দ ও বাক্যবন্ধ খুবই সহজ মনে হবে, কিন্তু বিষয় ও ভাবের দিক থেকে এগুলো অনেক উচ্চমার্গীয়, দার্শনিক বোধসম্পন্ন। কবির কবিতায় ডুবে যাবার মত একটা ব্যাপার স্যাপার আছে।’ – আমার জিজ্ঞাসা ছিল ওই জিজ্ঞাসায়। কবিতার ট্রান্সট্রোমার তার কবিতার মাধ্যমে আমাদেরকে এক প্রশ্নময় পৃথিবীতে ছেড়ে দিচ্ছেন। আবার তাঁর কবিতাগুলো জীবনের অমোঘ জিজ্ঞাসাগুলোকে উন্মোচিত করছে। পাঠককে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে এক সমাধানহীন অচেনা সীমান্তে। কিন্তু কেন? কবিতার এই রকম হতে হয় কেন? যেসব প্রশ্নের সহজ কোনও জবাব বা সমাধান নেই, সেসব প্রশ্নের মুখোমুখি কেন দাঁড় করাতে চান একজন কবি তাঁর পাঠককে? এর উপযোগিতা আসলে কী?
জুয়েল ভাই এই প্রশ্নের উত্তর এখনও দেননি। তবে আমরা জানি, কবিতার রয়েছে ঐতিহ্য আর পরম্পরা। জীবন ছাড়া ঐতিহ্য কিংবা পরম্পরা কোনটাই হয় না। তাই কবিতার হতে হয় জীবন সংলগ্ন। জীবনের সংযোগেই কবিতার বিকাশ ও পরিব্যাপ্তী। কবিতার রক্তমাংসস্পন্দন সবসময় জীবন বিজড়িত আর অমোঘ জিজ্ঞাসায় আলোড়িত। আত্মশিকড়কৃত চৈতন্যে আত্মস্থ। অন্তর্গত অন্ধকার থেকে উত্থিত। যে অন্ধকারকে আমরা অস্বীকার করতে চাই যদিও। একটা ভুল ভাবনায়, একটা অনিশ্চয়ে, একটা প্রহেলিকায় চালিত করতে চাই জীবনকে। অথচ কবিতা আমাদেরকে জীবনের ছোট ছোট দুঃখ, ক্ষোভ, যন্ত্রণা, স্বপ্ন, কামনা-বাসনা, ঈর্ষা কলহ, ক্ষরণ, সম্পর্ক ও সংঘর্ষ, আক্রমণ ও প্রতিআক্রমণ ইত্যাদির ভিতর দিয়ে নিয়ে যায় মনুষ্য বোধিয় সীমায়। তখন আমরা বুঝতে পারি অভ্যন্তরের এই অন্ধকারটা জীবনের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সত্য। এবং বিস্মিত হই। একটা সামগ্রিক মহাজাগতিক বিস্ময় আমাদের আচ্ছন্ন করে।
আমাকে যারা জঙ্গল আর পাহাড়ে প্রতিফলিত অন্ধকার ভেবেছ
তাদের জন্য বলছি
আমাকে যারা মেঘের জমাটবদ্ধ স্তুপ কিংবা বাতাসের ঠুনকো শরীর ঠাউরেছ
তাদেরকে বলছি
তোমরা যারা মন্ত্রসিদ্ধ ঘুমঘোর এলিজিও ভাবছ আমাকে—
শোনো,
একসময় তোমরাও সাক্ষ্য দেবে হে
জলদগম্ভীর রাত বলতে কেবল অলৌকিক অশ্রুছায়াই বোঝায় না
সুড়ঙ্গের ভিতর নিঃসঙ্গতার আলোক কোনও অলীক কাণ্ডও নয়
সমস্তই
মোহরঞ্জন মোহরঞ্জন মোহরঞ্জন
[বোধিবৃক্ষের ধ্যান]
আমরা এও ভাবতে পারি, আমাদের জীবন কি কোনও পারম্পর্যে গ্রথিত? কোনও অবচেতনের উৎসার? মনে আছে, আজ থেকে প্রায় কুড়ি বছর আগে, একটা ঊর্মিল সময়ের ভিতর দিয়ে এগিয়ে এসছিলাম আমরা কয়েকজন সিলেটের শাহ্জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তুচ্ছ কারণে তখন বিছিয়ে যেত পরীক্ষা। ধীরে ধীরে সেশান জ্যাম ভয়াবহরকম পেঁচিয়ে ধরেছিল আমাদের। অবশ্য তেমন গায়ে মাখছিলাম না আমরা। বরং ওসব যেন আমাদের জন্য আরও ভালো আরও সুবিধার হয়ে এসেছিল। কারণ, যেহেতু কবিতাই ছিল আমাদের ধ্যান ও জ্ঞান, আমরা তখন আমাদের পুরোটা সময় কবিতার দিকেই বইতে দিয়েছিলাম। শাপগ্রস্ত দিনের ব্যর্থতার ভিতর দিয়ে জীবনের খুব কাছে পৌঁছে যেতে পারছিলাম। আমাদের এক হাতে ছিল পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ আর অন্য হাতে দুইনো এলিজি। এক হাতে প্রত্নজীব তো অন্য হাতে মেঘদূত কিংবা পাগলী তোমার সঙ্গে। আমাদের রাত্রিগুলো পেরিয়ে যেত হাঁটতে হাঁটতে। কখনও বাগবাড়ি থেকে মজুমদারি। আবার কখনও মজুমদারি থেকে টুকেরবাজার। লিখিত কবিতাগুলো পড়ে পড়ে শোনা, আবার পড়া। এইসব চলছিল। নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে করে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। ভাবছিলাম কবিতা আসলে কী? কী করে হয়ে ওঠে কবিতা? এবং অবাক হয়ে লক্ষ করছিলাম কথারাও কবিতা হয়। দেখছিলাম আমাদের নিত্যদিনের কথায় কী করে কাব্যভঙ্গি যুক্ত হয়। কী করে সেই কথা গতি পায়। হয়ে ওঠে সাধারণ অর্থেরও অধিক কিছু। যাকে সরাসরি ধরতে পারি না। আবার পারিও। একটা অনির্বচনীয় অনুভূতি আমাদের গ্রাস করে। আমাদের পারস্পারিক আলোচনাগুলো একেকটা গদ্যের আকার পেয়ে যায়।
ভালো কবিতা
[রঞ্জিত সিংহের গদ্য থেকে’ ভালো’ কবিতার শনাক্তকরণ সম্পর্কে –
১) ভালো কবিতায় একটি স্বতন্ত্র কবিকণ্ঠস্বর শোনা যাবে।
২) কবিতাটি পড়া শেষ হয়ে গেলে কবিতাটি পাঠকের মনের সঙ্গে সঙ্গে সর্বময় চলবে।
৩) ভালো কবিতা কোনও ভৌগোলিক বাধা মানে না।
৪) ভালো কবিতা জীবনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিকে পাল্টে দিতে সক্ষম।
৫) ভালো কবিতার প্রধান লক্ষণ স্থায়িত্বগুণ।
৬) ভালো কবিতা কখনোই তাত্ত্বিক কবিতা নয়।
প্রকৃত ভালো কবিতা ও প্রকৃত ভালো পাঠকের মধ্যে রুচিগত বা ভাবনাগত কোনও পার্থক্য নেই। এরা সমগোত্রীয়। প্রথমজন লেখেন, দ্বিতীয়জন পড়েন। এইটুকুই পার্থক্য। দু-জন একই নৌকার যাত্রী।]
মাঝেমধ্যে প্রশ্ন জাগে, জীবনের কোনও অর্থ হয় কি? অর্থই তো অনর্থের মূল। অবশ্য এই অর্থ সেই অর্থ নয়। তারপরও, কেনইবা জীবনের অর্থ থাকতে হবে? কী হবে সেই অর্থ দিয়ে? কবিতার ক্ষেত্রে একটি কবিতা পড়ে যেমন এর অর্থ খুঁজতে চাওয়া কর্তব্য নয় তেমনি আমার কাছে মনে হয় জীবনের ক্ষেত্রেও এর অর্থ মিলিয়ে নেয়া দরকারি কিছু না। আমারা কেবল ভাবতে পারি কবিতাটি কীভাবে আমাকে স্পর্শ করছে। কবিতাটি কতোখানি আমাকেই স্থানচ্যুত করছে গভীরতর অর্থে। কবিতায় যে বাঁচে জীবনেও তো সে বাঁচে। কবিতার ভিতর যে জীবন শ্বাস নিতে চায় সে জীবনই তো জীবন। সেখানে কবিতা যাকে স্পর্শ করতে পারে সে আসলে জীবনকেই ছুঁয়ে দিতে পারে। বিভূতিভূষণ তাঁর ডাইরিতে লিখেছিলেন, গভীর রাত্রিতে নির্জন জানালার ধারে বসে এক মনে আঁধারভরা আকাশের স্পন্দমান নক্ষত্ররাজির দিকে চেয়ে থাকলে গভীর রাতের দক্ষিণ বাতাস যখন কালো গাছপালার মধ্যে সির সির বয়ে যায় তখন যেন মাঝে মাঝে অস্পষ্ট তার বুকের স্পন্দন শুনতে পাওয়া যায়। আনন্দের রহস্যের গভীরতায়, বিপুলতায় মন ভরে ওঠে। জীবনের অর্থ হয়। অর্থাৎ আনন্দের রহস্যের গভীরতায় আর বিপুলতার অনুভবে তিনি জীবনের অর্থ খুঁজে পান। তিনি আরও লিখেছিলেন, পৃথিবীর জীবনের পারে যে জীবন, অসীম রহস্যময় অনন্তের পথে মহিমাময় যাত্রাপথের পথিক যে জীবন, সেই রাতে তার সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয় তাঁর। অর্থাৎ আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি মহাকালকে অনুভব করতে পারছিলেন। পারছিলেন নিজেকে একাত্ম ভাবতে। দৈনিক জীবনের সাংসারিক কর্মকোলাহলে যে মহিমাময় শাশ্বত জীবনের সন্ধান আমরা পাই না, জগতের সুখ দুঃখের ওপারে যে অনন্ত জীবন সকলের জন্যে চঞ্চল প্রতীক্ষায় রয়েছে, অসীম নীল শূন্য বেয়ে যার উদ্দাম রহস্যভরা পথযাত্রা, সে জীবন তাঁর একটু একটু করে চোখে পড়তে থাকে। সেই বিস্ময় থেকেই জীবন তাঁর কাছে অর্থময় হয়ে ওঠে। জীবনের জন্যে গভীরতর টান তৈরি হয়। দুঃখময় কবিতাও তো আমাদেরকে গূঢ় অর্থে সুখী করে। যেমন সুখী করেছিল আমাকে ‘ফিরে যাচ্ছে ফুল।’
২০২০ সালে অপ্রকাশিত একটি পাণ্ডুলিপির উৎসর্গপৃষ্ঠায় লিখেছিলাম, “যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয় হয়ে ওঠেনি এখনও। তবে, পরিচয় হয়েছে তার কবিতার সঙ্গে। যে কবিতা নতুন করে বিস্ময় জাগায়, ঈর্ষান্বিত করে। বুঝতে পারি, এই সময়ের যে অল্প ক’জন কবির কবিতা কালোত্তীর্ণ হতে যাচ্ছে, তাঁদের মধ্যে শ্বেতা শতাব্দী এষ অন্যতম।” শুধু তাই নয়, রঞ্জিতদা ভালো কবিতার যে গুণগুলোর কথা বলেছিলেন তাঁর গদ্যে, বিস্ময়করভাবে আমি আবিষ্কার করেছিলাম, শ্বেতার কবিতায় সেই সবই রয়েছে। আর যখন ওপার বাংলা থেকে কবি শ্বেতা চক্রবর্তী জানতে চান, “তোমাদের ওদিকে অতি তরুণ কিন্তু লেখে ভালো, এমন ক’জন কবির কবিতা পাঠাও। এখানে কেবল পশ্চিমবঙ্গ আর এবিপি। এর বাইরে কিছু নেই।” তখন আমার প্রথমেই যে নামটা মনে আসে, সেটা শ্বেতা শতাব্দী এষ। বিষণ্ণ সুন্দর আর অদ্ভুত সব কবিতার জন্ম দিয়েছেন তিনি। ‘অনুভূতি নাশ করে/ফিরে যাচ্ছে ফুল/বনের উলটো পথে—/তার কোনো অভিমান নেই/বৃক্ষের-বাতাসের-ভ্রমরের সাথে/তবু সে পাপড়ি থেকে ঘ্রাণ রেখে/চলে যায় একা/নিজের ছায়ার সাথে—/দূর পথে তাকে ডাকে শূন্যতা!’ [বিয়োগ/ফিরে যাচ্ছে ফুল]
আলাহিয়া নিজেকে খুন করার পর পৃথিবীর সমস্ত আয়না
ভেঙে ফেলেছিল—
তাকে আমি চিনি না, তবু তার কথা ভাবলে
দূরত্বকে বেশ সহজ মনে হয়।
আলাহিয়া বলেছিল, ‘পৃথিবীর চোখের রং লাল!’
পতনমুখী পাহাড়ের যন্ত্রণায় খুলে যাচ্ছে মুঠিবদ্ধ হাত
তাই লাল পতাকায় চোখ বেঁধে
একদিন নিজেই সে খুন হয়ে যায়—নিজস্ব বোধের ফাঁদে!
আলাহিয়া, যাকে কখনও জানা হয়নি!
তবু পুরনো চিঠির মতো
সে লুকিয়ে থাকে পলকের ভাঁজে।
আর তার গল্প বলতে গেলেই মনে পড়ে,
একটা নিষিক্ত ফুল ক্যামন করে ঝরে গিয়েছিল
যেভাবে একটা সবুজ বিকেলের আগে সন্ধ্যা ঘনায়!
[আলাহিয়া/ফিরে যাচ্ছে ফুল]
জীবনকবিতা
[কোন অনাদিকাল থেকে আলোর পিছনে ছায়ার মতো, জীবনের পিছনে মৃত্যুর ছায়ামূর্তি নির্ভুল পদক্ষেপে অনুসরণ করে আসছে। পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শের আস্বাদ পেয়ে জীবন যখন পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হতে চায়, এমন সময় সহসা মৃত্যুর তুষার-শীতল কঙ্কাল হস্তের স্পর্শে জীবন শিউরে ওঠে। হাহাকার জাগে, পৃথিবীর প্রতি ধূলি-কণা আঁকড়িয়ে বাঁচবার বিপুল প্রয়াসে ক্লান্ত, অবসন্ন এই জীবন কি শেষ পর্যন্ত অকালেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে?]
২০২০ এর পর ২১, ২২, ২৩ পেরিয়ে ২৪এর জুলাইয়ে এসে হঠাৎই একটা ফেসবুক পোস্ট দেখে আঁতকে উঠল হৃদয়-মন। শ্বেতার বড় বোন মন্দিরা লিখছেন, ‘এই গুরগাঁও এ এসেছিলাম গতমাসের ৩০ তারিখ। শ্বেতাকে নিয়ে একা। ভেবেছিলাম আগে ভালো একটা হাসপাতালে ওর ডায়গনোসিসটা প্রপার এবং কমপ্লিটলি নির্ভুল হোক। তাতে কিছু বেশি টাকা লাগলে লাগুক। এরপর ডাক্তারের ট্রিটমেন্ট প্ল্যান নিয়ে তো আমি যেকোনো সহজলভ্য এবং ভালো যায়গাতে ট্রিটমেন্ট করতেই পারবো। সবমিলিয়ে ১০ দিনের প্ল্যান। কিন্তু বিধি বাম। এখানে ডায়গনোসিস শেষে জানতে পারলাম হাতে সময় নেই একদমই। একদিনও অপেক্ষা করার উপায় নেই। লিভার ক্যান্সার তো হয়েছ সেটা বাংলাদেশের ডাক্তাররাই বলেছিলেন, কিন্তু তার মেইন ব্লাড ভেসেলের মধ্যে হয়ে গেছে একগুচ্ছ টিউমার যার একটিও যদি যে কোনও মুহূর্তে ব্রাস্ট করে তো কয়েক ন্যানোসেকেন্ডের মধ্যে সম্পূর্ণ শরীরের মধ্যে ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়বে। উপায় নেই। এখানেই শুরু করলাম তার রেডিও থেরাপি।’ … অন্যদিকে, দেশে চলছে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন, সেই থেকে গণঅভ্যুত্থান। ফেসবুক, হোয়াটসএপ, ইন্টারনেট বন্ধ করে সমগ্র দেশ জুড়ে চালানো হচ্ছে গণহত্যা। আগেই জেনেছিলাম, শ্বেতা জন্ম থেকে বিটা থ্যালাসেমিয়া মেজরের পেশেন্ট। বহুবার মৃত্যুকে সঙ্গে নিয়ে অপারেশন থিয়েটারে যেতে হয়েছে। হার মানেন নি। খোদার কৃপায় তিনি বারবার বেঁচে ফিরেছেন। শুধু বেঁচে থাকার সংগ্রামই নয়, তাকে লড়তে হয়েছে আমাদের সবার মতো একটি স্বাভাবিক জীবনের জন্যও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর শেষে অসুস্থ শরীর নিয়েই, প্রতিমাসে দু-ব্যাগ নতুন রক্ত নিয়ে, নিয়মিত ডাক্তারের শরণাপন্ন হবার পরও একটা চাকরির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। সব বাঁধা একপাশে রেখে নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখছিলেন তিনি। এইতো গত বছর আমার জন্মদিনে মেসেঞ্জারে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন শ্বেতা। কবিতা লিখার কথা প্রসঙ্গে বলছিলেন নিজেকে সময় দিতে পারছেন না খুব একটা। চাকরির জন্য পড়াশোনা করতে হচ্ছে। একটা সরকারি জবের আশায় ছিলেন। বলেছিলেন, না হলে অন্য কিছু তো করতেই হবে। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস মাঝেমধ্যে এতই নির্মম হয়, মাসে যে দু-ব্যাগ রক্ত নিতে হয়, সেই রক্তের মাধ্যমেই সি-ভাইরাসে আক্রান্ত হতে হলো। লিভারে দানা বাঁধল টিউমার। যার পরিণতি—লিভার ক্যান্সার। অগাস্টের ২ তারিখে মন্দিরা আবার লিখলেন, ‘বাবু মশাই, জিন্দেগি লাম্বি নেহি, বাড়ি হোনি চাহিয়েন’। ‘আনান্দ’ মুভির একটা ডায়লগ। এই মুভিটা আমি কতবার দেখেছি, আমি নিজেও জানিনা। কিন্তু শ্বেতা এর আগে কখনও দেখেনি। এর আগে বলতে ‘মুগ্ধ’ ছেলেটা মারা যাবার আগে। তার কাছে হয়তো মনে হইছে,ওল্ড স্কুল পিপলসের কোনও ইমোশনাল ট্র্যাশ। আমি জানি না। হয়তো সে ‘গেইম অফ থর্নস’ বা ‘কুংফু পান্ডা’ ফ্যান হিসেবে বড় হয়ে উঠেছে। কিন্তু আমাদের ‘মুগ্ধ’ ছেলেটা হয়তো তারই চোখে আঙুল দিয়ে দেখাইছে, দ্যায়ার ইজ সামথিং ইন নাইন্টিনস জনারা। ওকে। মুগ্ধ তাকে ইন্সপায়ার করছে এই মুভিটা দেখা উচিৎ। সে দেখছে। একবার না। কয়েকবার। সিনেমার বিশেষ বিশেষ মুহুর্ত। এবং…তার মনে হইছে, ইটস সামথিং রিলেটেড টু হার…।’
শ্বেতা আর মন্দিরার কথা ভাবতে গিয়ে আমার কেন যেন বারবার মনে আসছিল বাংলা সাহিত্যের সেই কিংবদন্তী দুই বোনের কথা। তরু দত্ত আর অরু দত্ত। মনে হচ্ছিল, ১৯ শতকের ওঁরাই যেন এই শতাব্দীতে এষ বোনদ্বয় হয়ে এসছেন আমাদের মাঝে। একটু অন্যভাবে।
মন্দিরা লিখে চলেছেন, ‘শ্বেতা, আমার নিজের সন্তানতুল্য ছোটবোন হতে পারে, আপনাদের জন্য সে একজন কবি। ক্যান্সার আক্রান্ত এবং থ্যালাসেমিয়া মেজর ট্রেইট। ব্যাপারটা এতো সহজ না। যতটা আপনারা ভাবতে পারেন। দিস ইজ মোর ক্রিটিকেল দ্যান দ্যাট। যাই হোক। সে মুভিটা দেখছে। সে এখন এরকমই ভাবে তার জীবন নিয়ে। মানে পারসোনাললি জীবনযুদ্ধ প্লাস দেশের অবস্থা। তো, তার একটা মেসেজ আছে সমগ্র পৃথিবী প্লাস তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে। ‘প্লিজ, সবাই আমার সাথে থাকো। কেউ চিরজীবি নয়। আমিও একদিন মারা যাবো। কিন্তু আমি চাই, যে টাকা দিয়ে সাহায্য করেছো এবং যে মোর্যাল সাপোর্ট দিয়েছো—কেউ কারো থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ নও। কেউ যদি আমাকে আর্থিকভাবে সাহায্য না-ও করতে পারো, অন্তত মনের দিক থেকে আমার সঙ্গে থেকো। যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা কোনওভাবেই কাম্য নয়। কারণ, ‘বাবুমশাই, জিন্দেগী লাম্বি নেহি। বাড়ি হোনি চাহিয়ে।’…
অনিম শ্বেতা, আমাকে কথা দিয়েছে সে যতদিন বাঁচবে, সে কিছু লিখবে, এটাই আমার জীবনের একমাত্র অর্জন।’ আর আমি দেখতে পাচ্ছি ঘুমের দরজা ঠেলে চিন্ময়দা লিখছেন, ‘রাত আটটা। ছোট একটি মেয়ে ঘুমিয়ে আছে বইপত্রের মধ্যে। সীমাহীন অন্ধকারের কালো জল পার হয়ে আপার সার্কুলার রোডের সমাধিক্ষেত্রে তার শেষ শয্যার সামনে দাঁড়িয়ে আমি পাথরে উৎকীর্ণ মৃত্যুশব্দ পড়ি –
TORU DUTT
youngest daughter of
Govin Chunder Dutt
BORN 4 MARCH 1856
DIED 30TH AUGUST 1877
BE THOU FAITHFUL UNTO DEATH AND I
WILL GIVE THEE A CROWN OF LIFE.
বাবা গোবিন চন্দ্র দত্ত কবিতা লিখতেন। ছিলেন ১৮৩৬ সালের কোলকাতার হিন্দু কলেজে মধুসূদন দত্তের সহপাঠী। চেয়েছিলেন মেয়েদের জন্যে শ্রেষ্ঠ শিক্ষার ব্যাবস্থা করতে। তাই ১৮৬৯ সালে পারি জমান ফ্রান্সে। সেখানে মেয়েরা ফরাসি শেখেন। ধীরে ধীরে হৃদয় মনে ফরাসি হয়ে ওঠেন উনিশ শতকের তার দুই বিস্ময় বালিকা অরু দত্ত আর তরু দত্ত। ফরাসি ভাষায় তরু লিখে ফেললেন উপন্যাস ল্য জুরনাল দ্য মাদামোয়াজেল দারভার (কুমারী দারভেরের জার্নাল)। কিন্তু ফরাসি আবহাওয়ায় অরুর শরীর খারাপ হচ্ছিল। তারা বিলেতে গিয়ে ওঠেন। সেখানে ইংরেজিটা রপ্ত করে নেন খুব ভালো করেই। লিখতে থাকেন অসংখ্য কবিতা। এমন চিত্ররূপময়তা, জীবন ও প্রকৃতির এমন উৎসব, রঙের এমন খেলা, রঙ এবং ধ্বনির চমকপ্রদ ভারসাম্য আর সমন্বয়, এক অন্তর্লীন বিষাদময়তা, পাশ্চাত্যের আঙ্গিকের আত্মবিশ্বাসী ব্যাবহারের সঙ্গে গভীর প্রত্যয় ও মমতায় ভারতীয়ত্বের বুনন তাকে করে তুলেছে অনন্য।
‘আমরা কাল সকালে দেশে ফিরে যাচ্ছি। যাচ্ছি না আসছি বলবো বুঝতে পারছি না। শ্বেতার রেডিও থেরাপি শেষ হলো। এখন তার মূল ট্রিটমেন্ট ট্যার থেরাপির জন্য কিছুটা সময় অপেক্ষা। সর্বোচ্চ দুই মাস। সর্বোচ্চ বলছি, কারণ সময়টা আমি ডক্টরদের কাছ থেকে মিনতি করে চেয়ে নিয়েছি। আসলে রেডিও থেরাপি দেয়ার দুই সপ্তাহের মধ্যে ট্যার থেরাপি দিতে হয় ইউজ্যুয়ালি। কিন্তু আমার কাছে এই সমুদ্র সমান টাকার যোগাড় বর্তমানে নেই। আমাকে আগে টাকাটা মেনেজ করতে হবে, তারপর চিকিৎসা।
যাই হোক, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে আমি আতংকিত, ভীত এবং ট্রমাটাইজড। আমি যে আসলে ঠিক কী সিচ্যুয়েশনে আছি, তা হয়তো কেউ আন্দাজও করতে পারবে না।
কিন্তু আমি শুধু এটাই জানি, এনি হাউ আই উইল ডু ইট।। বাট কেউ আমাকে প্রশ্ন কইরেন না, কীভাবে?’
দিদি অরুর মৃত্যুর পর ফরাসিনী ক্লারিস বাদের-কে তরু লিখেছিলেন, আমার শরীর খারাপ। তোমার একটা ছবি পাঠালে ভালো হয়। সমস্ত প্ল্যান পালটাতে হচ্ছে। এপ্রিলে ইউরোপ যাওয়া হবে না।
Of all sad words of tongue and pen
The saddest are these—it might have been.
তরু চলে যাওয়ার পর ফ্রান্সে ছাপা হয় সেই উপন্যাস। পড়ে জেমস ডার্মস্টেটর লিখেছিলেন, ‘কিছুতেই বোঝার উপায় নেই এটি এক বিদেশিনীর লেখা। তুলনাহীন অসাধারণ এক সাফল্য।’ ইংরেজিতে লিখা তরুর ২য় উপন্যাস ‘বিয়াঙ্কা অর দ্য স্প্যানিশ মেডেন’’-ও বিষাদ মাখা এক অসমাপ্ত টুকরো।
জুলাই পেরিয়ে অগাস্ট। অগাস্ট পেরিয়ে আজ ৩রা সেপ্টেম্বর। ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হয়েছে। গণতন্ত্র মুক্তি পেয়েছে। আমরা স্বাধীন হয়েছি আবার। আবার নতুন করে দেশটাকে গড়ার শপথ নিয়েছি আমরা। এরই মধ্যে হানা দিয়েছে ভয়াবহ বন্যা। মোকাবিলা করছি সকলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। কিন্তু শ্বেতা? আর তো সময় নেই তার হাতে। দিল্লীর ডাক্তারেরা যে সময় বেঁধে দিয়েছিলেন তার অর্ধেকটাই শেষ। এ’মাসের শেষে আবার যেতে হবে। সংগ্রহে আসতে হবে চিকিৎসা-খরচ। হাত বাড়াতে হবে যে যার মতন আমাদের সবার। দেখতে হবে আমাদের— কে জেতে— মৃত্যু না জীবন? –
এক আশ্চর্য আপেল থেকে বের হয়ে আসছে ছুরি
আমার বুক বরাবর!
এ এক অনিঃশেষ অতৃপ্তি—
একে একে সব ফুল ঝরে যাবার পর
তবু একটি অন্তিম মাধবীলতার ঘ্রাণে
পৃথিবীতে ঘোর নেমে আসে—
আর আমার হৃদয়
মৃত্যুর আঙুল ধরে উচ্চারণ করে—জীবন সুন্দর!
[মোহ/ফিরে যাচ্ছে ফুল]
***********************
ঋতো আহমেদ
কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক