You are currently viewing কবিতায় চিত্রে চিত্রকল্পে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় || পারমিতা ভৌমিক

কবিতায় চিত্রে চিত্রকল্পে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় || পারমিতা ভৌমিক

কবিতায় চিত্রে চিত্রকল্পে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

পারমিতা ভৌমিক

খেয়ালী কবিরা ভাষার ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখেন কাব্যরূপের রূপছবি। রূপকল্প শব্দের ইংরাজী প্রতিশব্দ হল Image / Imagery. Art of Imagery হল একটি গঠনগত টেকনিক বা আঙ্গিক ।
কাব্যকবিতার সীমানা ছাড়িয়ে যেতে কবিরা এসবের কদর করেন। নন্দনতত্ত্বের বিচারে এটি কবিতার বহিরঙ্গ অঙ্গসজ্জা মাত্র। সুনীলের কবিতায় Art of Imagery – খোঁজার কাজটি এখন সম্পূর্ণ করা যেতে পারে।
কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের দর্শনভঙ্গী নিখাদ Lyricism-এর ফসল। অনুপুঙ্খ বিষয়কে বর্ণনার বিস্ময়কর প্রতীকে, অনুপম উপমার মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন কবি। রবীন্দ্রনাথের ঈশাবাস্যমিদং— মন্ত্রের উত্তরণের ছবি এখানে জায়গা জুড়ে নেই বটে, তবু বলা যেতে পারে যে সুনীলের কাব্যভাবনার কাছে তা একেবারেই দুর্নিরীক্ষ্য নয়। বস্তুজীবনের সঙ্গে কবির গভীর একটা সম্পৃক্তি আছে আর তাতেই মনে হয় জাঁ পল সাঁর্ত্রের মত কবিরও কেন যেন অস্তিবাদী দর্শনে আস্থা ছিল। ..
কবি সুনীলের কবিমনের নিগূঢ় অনুভূতি, ভাষাতীত সুগভীর তাৎপর্য যখনই তাঁর রূপকল্প ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে তখনই তা সহজবোধ্য হয়েছে পাঠকের কাছে।  এই রূপকল্প নির্মিতিতে সুনীল তুলনাবিরল প্রতিভা। কবি তাঁর অনুভবের ঋজু পাঠ পাঠককে পৌঁছে দিয়েছেন একের পর এক তাঁর কবিতায় image ব্যাবহারের মাধ্যমে।
Shelley-র Skylark-কবিতায় দেখি সুরমুগ্ধ কবি Skylark এর স্বরূপ বুঝতে চান। জানতে চান আনন্দময় অমৃতলোকের এই শরীরি প্রতিনিধিটির কথা অশরীরি ব্যঞ্জনায় : ‘What thou art, we know not’
অনেক সমালোচক চিত্রকল্প সৃষ্টিকেই কাব্যের প্রাণ বলে মনে করেন। সুনীলের ব্যবহৃত রূপকল্পের মধ্যে দেখি, যে আইডিয়াকে কবি প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন তা পিছিয়ে পড়েছে বরং তাঁর আঁকা ভাষাছবিই কবিতার অনেকটা জায়গা অধিকার করে আছে। ছবিকল্পের সর্বাঙ্গে পড়েছে ব্যঞ্জনার আলো। ল্যাম্বোর্গ বলেছেন, কাব্য Image বা ভাষাচিত্র নিয়েই কারবার করে। অবশ্য আমরা মনে করি এটা অতিশয়োক্তি। ষ্টিফেন ও ব্রাউন ‘Realm of Poetry’ গ্রন্থে বলতে চেয়েছেন মূল সত্যটি : It is not true to say that bodies forth the ideas, even the most abstract, through the medium of Images.’ এ. টি. কুইলার কাউচ মনে করেন মানুষের কল্পনার উদ্দীপনা ঘটে রূপসৃষ্টির প্রয়াস থেকে।
এখানে নিজেকে প্রকাশ করার সীমাহীন অবকাশ আছে। কবি সুনীল, বস্তুকে গ্রহণ করেও, বস্তুর অতিরিক্ত এক সীমাহীনতায় নিজেকে খুঁজেছেন। এই অসীমকে কাছে পেতে গিয়ে বেদনা নিঙড়ে দিয়েছেন বিভিন্ন চিত্রকল্পে :
‘জানলায় বাদুড় এসে হেসে যায় দগ্ধ ভোরবেলায়
বিবাহিতা রমণীরা সিঁড়ির ওপর থেকে চকিতে দাঁড়িয়ে
যেন বহু কষ্টে কেনা
মুণ্ডহীন হাসি দিয়ে চলে যায় ঝুল বারান্দায়।”
(আটাশ বছরে)
মৃতবন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলে এমনই হয়ে থাকে বলে, কবি মনে করেছেন। কবি এখানে Pathos -এর আশ্রয় খুঁজেছিলেন কিনা আমাদের তা জানা নেই তবে লক্ষ্য করা গেছে এইসব চিত্রকল্পে রঙের সন্ধান করতে গিয়ে কবি রঙ ব্যবহারের ও চিত্র ব্যবহারের বিবর্ণ জাদুতে, গা ছমছমে চিত্র মিশিয়ে দিয়েছেন। বস্তু ও অবস্তু কিম্বা অতীন্দ্রিয়তায় অথবা পরাবাস্তবের (Surrealism) ছবি এঁকেছেন কবি মুণ্ডহীন হাসি’-র প্রতীকে, যেমন জীবনানন্দ দাশের চিত্রকল্প রচনায় পাওয়া গেছে—‘উটের গ্রীবার মতো’ মৃত্যুর উঁকি মারা। হেগেলীয় ‘Sublime’ এর স্পর্শ পাই, কবির একটি কবিতায় যেখানে Image অনেকটা আড়ালে থেকে তবু বাজিকরের মত টুকরো উপমায় ধরে রেখেছে কবিতার খোলনলচে :
“‘শুধু কবিতার জন্য তুমি নারী; শুধু
কবিতার জন্য এত রক্তপাত, নামে গাঙ্গেয় প্রপাত'”
• * * * * * * * * * * * * * *
“……….শুধু কবিতার
জন্য আমি অমরত্ব তাচ্ছিল্য করেছি।’
—এই Sublimation, কবিতারাজ্যের অমূল্য সম্পদ। এই উৎসর্জনের ভিত্তিভূমিতে কবিরও চাওয়া থেকে গেছে। বহিরঙ্গ Sublimation-এ কবিরও তৃপ্তি পাওয়ার আশা রয়ে গেছে :
“আমিও অপ্রেম থেকে ফিরে এসে, অরুন্ধতি
তোমার চোখের অশ্রুপান করি।’
— স্থবির চেতনার যে অশ্রু কবি পান করেছেন বা করতে চেয়েছেন, সেই অরুদ্ধতির কাছেই আবার আলো চেয়েছেন : ‘অরুন্ধতি, আলো হও, আলো করো, আলো, আলো,
অরুদ্ধতি, আলো—’
—-শুদ্ধ কবিপ্রাণের এই আলোর তৃষ্ণাই একদিন তৈরী করেছিল নীরার Idea.-body, রবীন্দ্রনাথের লাবণ্যের মতো কিম্বা জীবনানন্দের ‘বনলতাসেন’ এর মতো।
যেখানে সুনীল বিদেহ বন্ধুত্ব ও প্রেমের কিম্বা উগ্রসমাজের রিরংসার চিত্রকল্প উপহার দিয়েছেন , সেখানেও দেখি সেইসব অদ্ভুত চিত্রেরা কবি মনের বিশেষ ধর্মে বা চিন্তায় জারিত হয়ে কবিতার অন্য অর্থরচনা করেছে।
বীভৎস ও শান্তরসের সম্মিলিতরূপ আর এক কবিরও চিত্রকল্পে ঢেউ এঁকেছিল :
“আমারো ইচ্ছা করে ঐ ঘাসের ধান
হরিৎ মদের মতো
গেলাসে গেলাসে পান করি এই ঘাসের শরীর ছানি, চোখে চোখ ঘষি।’
কিম্বা :
“ঘাসের ভিতরে ঘাস হয়ে জন্মাই
কোন এক নিবিড় ঘাস মাতার
শরীরের সুস্বাদু অন্ধকার থেকে নেমে।”
(জীবনানন্দ দাশ)
—এই এ্যাবসার্ডিটির মধ্যেই কবিধর্মের প্রকাশ ভিন্নমাত্রা পেয়েছে। এই বৈশিষ্ট্য আধুনিক ও উত্তর আধুনিক কবিদের স্বভাব-সম্পদ। একান্ত নির্জনতায়, কবি সুনীলের যে ব্যক্তিগত মনোবীক্ষণের ছবি আমরা পাই, সেইসব ছবিতে বা চিত্রকল্পে ধরা পড়ে অদ্ভুত এক কামনা মদিরতা। মনে করতে পারি এখানেই কবির সীমাবদ্ধতা আবার এখানেই কবির সীমামুক্তির সাধনা।
সুনীলের কবিতার আবেদনে তাই সত্যের সঙ্গে মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন’ কিম্বা ‘নীরা’-র শরীর, কিম্বা নীরার সর্বব্যাপী ছায়াময় শীতলতার ছবি দেখি :
“অপ্সরাদের মতন সাদাফুল ছড়িয়ে ছিটিয়ে
ফুটে আছে ওদেরি জন্যে, আজ মেঘভাঙা জ্যোৎস্না
কিছু বেশী
হঠাৎ ইচ্ছে করে তছনছ করে দিই রাত্রির বাগান
ঝড় আসবার আগে ঝড় তুলি…..
“শরীর, শরীর, তোমার মন নাই কুসুম?” ”
(নির্জনতায়)
—যে কবির চিত্রকল্পে রাত্রির মেঘভাঙা জ্যোৎস্নায় অপ্সরা ফুল ফুটে থাকে, যে কবির চেতনায়, মাণিক বন্দোপাধ্যায়-এর পুতুলনাচের ইতিকথার ঝংকার ওঠে, “শরীর, শরীর, তোমার মন নাই কুসুম?।’—সে কবি কি নারীর শরীরে ভালোবাসার নাম করে শুধুই রিরংসা খোঁজে? ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’-র নায়ক শশীর শরীর-বিবিক্ত সংস্কার যার নাড়ীতে বাজে, সে কবির পবিত্র কবিধর্মে কোন সংশয় রাখতে—নেই। এই কবিতায় যে চিত্রকল্প রচনা হয়েছে তার মধ্যে শরীরের কোন গ্রহনযোগ্যতা নেই। পরেই আবার কবির স্বীকারোক্তি দৃষ্টি আকর্ষণ করে :
“আমি একা। আমাকে কেউ দেখছে না।
যেন আমার নারীকে ভালোবাসার নাম করে
শুধু তার শরীরে লোভ করেছি।”
—বস্তুতঃ ফ্রয়েডীয় মনোবিকলনের সূক্ষ্মপ্রকাশ, কবিতার ছোট্ট ক্যানভাসে যেভাবে সুনীলের কবিতায় পাই, মাণিকের উপন্যাসেও তা পাইনা। কবির তন্ময়তার ছবিও পাই অন্য অন্য সব চিত্রকল্পে ——”ঐ তো আমার বিস্ফোরণের ভিতরে একটি জোনাকি
ধপধপে সাদা বক উড়ে যায় মায়াবী সন্ধ্যা পেরিয়ে নদীর ওপারে ঝাড়লণ্ঠন জ্বালিয়ে রেখেছে আকাশ প্রতিধ্বনির মত ফিরে এল বন্ধু’ অথবা,
‘সব যেন ঠিক স্বপ্ন, যদিও মাটিতে রয়েছি দাঁড়িয়ে
ঐ তো আমার স্বর্গ,
ভগ্নসেতুর প্রান্তে ঐ তো উদাস নশ্বরতা।’.
(ঐ তো আমার)
যে নশ্বরতা উদাস, তারি ওপর সিঁড়ি গড়ে তুলে কবি কি তবে—অ-নশ্বরকে চেয়েছেন? গোপন সে অভিসারে নিয়ে গেছেন নারীকে, নিয়ে গেছেন নীরাকে চোখ এড়ানো পথে? এ নারীই বুঝি তার জীবন দেবতা। কবি জানতেন নশ্বরতা নীরাকে কখনও স্পর্শ করবে না, জানতেন বস্তুজগতের শরীরি প্রেমের সোপানেই অ-বস্তু সম্ভব প্রেম রচনা কি করে করতে হয়। তাই নীরা কখনও মরেনি। নীরারা মরে না। নীরার সঙ্গে কবি সুনীলও Myth হয়ে গেছেন। রোমান্টিক জীবনানন্দ ব্যক্তিক যন্ত্রণার প্রেক্ষাপটে স্বপ্নের রূপছবি (Image) রচনা করেছেন:
“ঘুমোনো গন্ধের মত স্বপ্ন হয়ে তার ঠোটে
চুমো দিও প্রিয়া।’
—মনে হয় নারী প্রেমের এই প্রতিভাস কবি জীবনের পরিপূরক হয়েছিল। কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি অসামান্য চিত্রকল্পেও সেই বিকল্প ভালোবাসার প্রতিশ্রুত ছবিটি দেখতে পাই :—
‘লঘু মরালীর মত হাওয়া উড়ে যায়
জ্যোৎস্নারাতে
নক্ষত্রেরা স্থান বদলায়
ভ্রমণকারিণী হ’য়ে তুমি গেলে কার্শিয়াং
অন্য এক পদশব্দ পেছনে শোনোনি?
তোমার কানের পাশে ফুঁ দিয়ে কে সরিয়েছে চূর্ণ অলক?’
(তুমি যেখানেই যাও।)
এই বিদেহ প্রেমের ছবি ব্যক্তি কবির অসমাপ্ত পরিণতির ছবি। মর্ত্যে মর্ত্যপ্রেমের স্বপ্নপুরণের কল্পছবি। এ ছবি প্রিয়ার সঙ্গে মানস ভ্রমণের:—
‘তোমার সুঠাম তনু
ওষ্ঠের উদাস লেখা
স্তনদ্বয়ে ক্ষীণ ওঠানামা
ভিখারী বা চোর কিম্বা প্ৰেত নয়
সারারাত
আমি থাকি তোমার প্রহরী।’
(তুমি যেখানেই যাও।)
প্রেমের কল্পচারিতা অনির্দেশ স্তর ছুঁলে তবে নচিকেতা প্রত্যয়ে কবিকণ্ঠে জেগে উঠতে পারে এমন বলিষ্ঠ সুর। কবির চিত্রধর্মীতার যে মানস প্রতিফলন ছবি হয়ে ধরা দিচ্ছে তাঁর কাব্যে কবিতায়, রূপকল্পনা সৃষ্টির উল্লাসে, তা দেখে আজ আবার মনে হয় জগৎসত্য, ব্রহ্মও সত্য, জীবন যতবড় সত্য পরমও ততটাই সত্য, দৃশ্যবস্তুও সত্য সূক্ষ্মও সত্য। মনে হয় একটি ডানায় ভর করে পাখি উড়তে পারেনা। তাই কবির অলোক-সম্ভব-প্রেমবোধও কোনদিনও জগৎকে ত্যাগ করে যায়নি। অতৃপ্ত প্রেম-ক্ষুধার প্রেরণার রূপ সুন্দর হয়ে উঠেছে সুনীলের চিত্রকল্প রচনায়—কাব্যের রূপটিকে তা করেছে শিল্পিতসুন্দর।
জীবনানন্দেও তাই দেখেছি :
‘ওখানে চাঁদের রাতে প্রান্তরে চাষার নাচ হোত
ধানের অদ্ভুত রস খেয়ে ফেলে, মাঝি বাগদীর
ঈশ্বরী মেয়ের সাথে
বিবাহের কিছু আগে বিবাহের কিছু পরে
সন্তানের জন্মাবার আগে।’ (‘৪৬-৪৭ জীবনানন্দ)
ঐ প্রেমবিলাসের ছবি সুনীলেও একই মাত্রা পেয়েছে :
―জলস্রোতে ফিরে গেছে যেখানে যাবার
কথা ছিল?
―চাঁদ ভুলে গেছে তাকে ?
―বাতাসে কিসের গন্ধ?
―আমি এক মরালীকে চুম্বন করেছি
―কেউ কি এসেছে ঋণশোধ নিতে?
― একজন, যে তোমার জন্য কেঁদেছিল
সে তোমার বাহুতে রেখেছে
অনুতপ্ত মুখ’
(খণ্ডকাব্য / সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়)
সুনীল যে রঙ দেখেছেন জীবন ও প্রকৃতিতে, সে রঙ বাইরের নয়, তাঁর নিজের। মনের অবরুদ্ধ স্তরের বাসনাই যে আমাদের জীবনের নিয়ন্তা, কবির বাকবিন্যাসেই তা ধরা পড়েছে।
একটি দুঃসাহসিক সামাজিক চিত্রকল্প কবি এঁকেছেন :
“ঊনিশে বিধবা মেয়ে কায়ক্লেশে ঊনতিরিশে এসে,
গর্ভবতী হল……”
দুঃসাহসী কবি জানিয়েছে সেই গোপন প্রেমিকের কথা সরাসরি,
উত্তরণের শাম্পানে পা দিয়ে :
এবং আড়ালে বলি, আমিই সে সুচতুর গোপন প্রেমিক – যে প্রেম মৃৎভাণ্ডে জ্বলেছিল তারি উর্ধ্বাচারী শিখা জ্বলেছে সেই গোপন প্রেমিকের হৃদয়ে, আর তাই সে প্রেমিক সত্য গোপন করেনি।
কলঙ্কের যন্ত্রণাও তাই স্পর্শ করতে পারেনি তাকে।
এ চিত্রকল্প-এর ছবির পিছনে কবির কোন ব্যক্তিক ছায়া নাও থাকতে পারে কিন্তু সমাজের জীবন্ত ছবি সেখানে উপস্থিত। জৈবপ্রেমই এ চিত্রকল্পগুলির মাপক। আমরা মনে করি কবি সুনীলের গভীর মানব-বোধ ও জীবনীক অভিজ্ঞতাই এমন ছবি আঁকিয়েছে যদিও রসের ঝরণাটি তাঁর অন্তর্লোক থেকেই এসেছে।
অস্তিবাদী জাঁ পল সার্ত্র যে anguish বা উদ্বেগের কথা বলেছেন, যা জীবনকে ক্লান্ত করে। মুহূর্তে মুহুর্তে, নির্বাসন দেয় তাকে, কবি সুনীলের কবিতায় সে ছবিও অদ্ভুত চিত্রকল্পের ফ্রেমে বাঁধানো রয়েছে:
‘কপালে রক্তের মত, তবু বোঝেনা রক্তের ভাষা তৃষ্ণা ও ব্যর্থতা
বারবার প্রশ্ন করে, জানিনা কোথায় লুকিয়েছি নীরাকে…….
• * * * * * * * * * * * * * * *
……….কেউ এলনা সঙ্গে, না প্রশ্ন, না ছায়া,
না নিখিলেশ, না ভালোবাসা;
শুধু নির্বাসন”
— (শেষযাত্রী/সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়)
জীবনানন্দ দাশেও এই anguish আগেই দেখেছি।এলিয়টীয় জীবনবীক্ষণ নয়, আত্মসমাহিতির পূর্ণফসল কবিমনে বিপন্নতার পটভূমিতে আমরা দেখেছি :
“আরও এক বিপন্নবিষ্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে
আমাদের ক্লান্ত করে।”
একথা বলাবাহুল্য যে কবিত্বের শেষ উত্তরণ — গভীর আশাবাদে…. এই-ই এক মহার্ঘ সঞ্চয়। সমস্ত ভুল কিম্বা ঠিক কামনা বাসনার শেষে গভীর দীপ্র আত্ম আবিষ্কার কবির অন্তর্লোকেই শ্রেয়স ও প্রেয়সকে জাগিয়ে তোলে— সেখানে জীবনমুক্ত কবি আশ্রয় করেন শ্রেয়সকে। Message পাঠিয়ে দেন প্রজন্মের সিংহদুয়ারে। যে বাধা এতদিন দেহের আর ভোগের দরজায় দুর্লঙ্ঘ্য বাধা হয়ে ব্যবধান রচনা করেছিল, তা সরে গিয়ে কবি চেতনায় ঝরে পড়ে একমুঠো স্নিগ্ধ আকাশ…….।
গভীর আশাবাদে প্রোজ্জ্বল হয়ে সুনীল বলেন :—
“আলিঙ্গনে এত গোপন, রাজধানীতে এত গোপন
মানুষ-ভরা গোপনতার ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে ঐ ছেলেটা……
সভ্যতাকে ডেকে বলে—
ঐ ছেলেটা সভ্যতাকে হাসতে হাসতে ডেকে বলে,
আমার অধঃপতন থেকে রক্ষা করো।”
যে ছেলের শরীরি কামনায় ঢেকেছিল পৃথিবীর বুক,
পর্দা সরে গেলে, চৈতন্যের আধারে সেই গেয়ে ওঠে আশাবরী সুর …..
আমায় অধঃপতন থেকে রক্ষা করো।
জীবন পরিক্রমার পথেই এই সুনীলকেও চিনেছি আমরা। কবিতার ভাঁজে ভাঁজে, রহস্যের মত ছায়াছন্ন ছিল যে জৈব পৃথিবী, ঢাকা ছিল সত্যদর্শন, জীবনের সহস্র সহস্র কৃত্রিম রশ্মিজালে – আজ অপাবৃত হয়েছে তা। ভোরের আলোয় উজ্জ্বল সুনীল বিস্তীর্ণ নীলে পুলকে মেলেছে সবুজ ডানা আর পৃথিবীকে দিয়ে গেছে ব্যথানীল নীরার ঠিকানা। সুনীলের বিশ্বাস ছিল সব কবি ও সংবেদনশীল প্রাণ অবশেষে খুঁজে পাবে একান্ত আশ্রয়, নীরার বিদেহ মনে, দেহে নয়, দেহে নয়!!
=====================