কথাশিল্পী কায়েস আহমেদের ক্ষত-বিক্ষত অন্তর্মুখী ভুবন
শাখাওয়াত বকুল
পাঠক হিসেবে পুরোনো হয়তো নই কিন্তু লেখক হিসেবে নবীন আর পাঠক লেখকের নবতর দ্বন্দ্বে নিজেকে একরকম অপরাধীই মনে হচ্ছে। কেবলি মনে হচ্ছে কায়েস আহমেদের ভূবন আর অন্তর্ঘাত এত দেরী করে অনুধাবন করায় নিজের সাথে সাথে তথাকথিত জনপ্রিয় পত্রিকাগুলোকেও সমানভাবে দায়ী করতে চাই। কায়েস আহমেদের জীবন নিয়ে সামান্য কথা না বললে নিজেকে অপরাধীর চুড়ান্ত কাঠগড়ায় দাড়াতেই হয়। শুধুমাত্র নবীন লেখক হিসেবে নয় বরং নতুন পাঠক ও লেখকদের কায়েস আহমেদকে জানা শুধু জরুরী নয়, অত্যাবশ্যক। একজন লেখক কতটুকু বলতে পারেন বা পারার ক্ষমতা রাখেন? তারপরেও বলতেই হবে, কায়েস আহমেদ সর্বাধিক গুরুত্বপুর্ণ ও উত্তীর্ণ মানের লেখক। সমকালীন বাংলা সাহিত্যের তিনি পাদপ্রদীপের আলোয় থাকা সমাদৃত সাহিত্যিক নন,প্রচারের শীর্ষে থাকা দৈনিকের সাহিত্যপাতায় তাঁকে নিয়ে আদিখ্যেতা বা বিশেষ কভারেজ করা হয়নি মোটেই। গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যিক হওয়া সত্বেও জনপ্রিয় ভীড়ে তাঁর ডেডিকেটেড সাহিত্যকর্মকে আড়াল করে রাখবার প্রয়াস ছিল লক্ষ্যণীয়। সবকিছু ছাপিয়েও কায়েস আহমেদকে অস্বীকার করা যায়না বরং তাঁকে বাংলা সাহিত্যে একটা স্বতন্ত্র স্থান দিতে হয় , দিতে বাধ্য, যদি তার সাহিত্যকর্মকে উপেক্ষা না করে পাঠ ও আলোচনায় নিমগ্ন হই।
তথাকথিত আলোচনার আলোকচ্ছটা তিনি প্রচল ভেঙ্গে এগিয়ে গেছেন, যেন নির্লিপ্ত এক পরিভ্রাজক আর এর বিপরীতে কোন মোহগ্রস্থতা তাকে আক্রান্ত করতে পারেনি বরং বিমুখতা ছিল প্রবল। তিনি কম লেখতেন, বোধকরি ,আজেবাজে, ট্রাশ তৈরী করতেন না। তিনি যে চেতনায় আদ্যান্ত নিমজ্জিত ছিলেন, সেই চেতনার দ্যুতিই তার সাহিত্যে আলোক ছড়িয়েছে দুর্বার, দুর্নিবার।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস মরিবার হ’লো তার সাধ প্রবন্ধে তাঁকে নিয়ে বলেছেন।,
প্রতিষ্ঠা ও খ্যাতি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেশিরভাগ লেখকের কাছে লেখাটা হল অভ্যাসমাত্র–চাকরিবাকরি আর ব্যবসাবাণিজ্য আর দেশপ্রেমের ঠেলা সামলাতে এনজিও বানিয়ে মালপানি কামাবার সঙ্গে তখন এর কোনো ফারাক থাকে না। তখন লেখায় নিজের সুখ আর বেদনা জানান দেওয়াটা হয়ে দাঁড়ায় তেল মারা আর পরচর্চার শামিল। লেখক হিসেবে সেই সামাজিক দাপট কায়েসের শেষ পর্যন্ত জোটেনি। তাই, কেবল মানুষের খুঁত ধরে আর দুর্বলতা চটকে সাহিত্যসৃষ্টির নামে পরচর্চা করার কাজটি তাঁর স্বভাবের বাইরেই রয়ে গেল। আবার এই দুনিয়ায় সকল ভালো/ আসল ভালো নকল ভালো..এই ভেজাল সুখে গদগদ হয়ে ঘরবাড়ি, পাড়া ,গ্রাম, সমাজ ,দেশ, পৃথিবী, ইহকাল ও পরকাল সবকিছুতেই তৃপ্তির উদ্গার শুনিয়ে মধ্যবিত্ত পাঠকদের তেল মারার কাজেও তিনি নিয়োজিত হননি। ১
কায়েস আহমেদ ছিলেন ষাটের গল্পকার যদি দশক বিচার করি। কিন্তু তার বিকাশ ও বিস্তরণ-বিচ্ছুরণ সত্তর ও আশির দশকের পরিক্রমায় ছড়ানো ছিল। বাংলা ছোটগল্পের বাক পরিবর্তন হয় বারবার। বাংলা ছোটগল্পের বাক পরিবর্তন ও এর বৃত্তাবদ্ধ পরিধি প্রসারে এক ভিন্নমাত্রার শিল্পদ্রষ্টা ছিলেন কায়েস আহমেদ( ১৯৪৮- ১৯৯২)। ষাটের দশকের গণজাগরন, গণ অভ্যুত্থান, নির্বাচনের চাতুর্য্য, মুক্তিযুদ্ধ, যুদ্ধোত্তরকালের এক বিভৎস বাস্তবতা, সামরিক শাসনের পুনরুত্থানের নিবিড় প্রত্যক্ষকারী কথাশিল্পী কায়েস আহমেদ।
এই সময়কালের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে লেখকের মননে কেটেছে গভীর রেখাপাত, উদ্বেলিত লেখকচিত্ত। উপনিবেশিকালের সোসিও ইকোনোমিক পলিটিক্যাল ক্রাইসিস, স্বাধীকার সংগ্রাম,সমকালীন জীবনের অসমতা অসঙ্গতি, অবক্ষয়পীড়িত সমাজে মানুষের বিপন্ন অস্তিত্ব সংকট, বিপন্নের গুমরে গুমরে ওঠা যন্ত্রণা, মনোজগতের ভেতর নিয়ত ভাংচুর কায়েস আহমেদের গল্পে সেই প্রতিবিম্ব ফেলেছে ঠিক সমাজ পরিবর্তনের অভিপ্রায়ে। সমকালীন গল্পকার হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসদের গল্পেও সেই বিপন্ন ঢেউ এসে লেগেছিল । কিন্তু কায়েস আহমেদ যেন এক বিষন্ন বিপন্ন স্বর নিয়ে পাঠকের সামনে দেদীপ্যমান। তাকে চিহ্নায়িত করেন জীবনের সুক্ষ্মবোধের ভেতরে প্রবেশের পারঙ্গমতায়।
কায়েস আহমেদ ভিন্ন প্যারাডাইমে ভিন্ন ভিন্ন ব্যঞ্জনার জন্ম দেন , একই প্রেক্ষাপটে ভিন্ন ভঙ্গিতে বয়ানকৌশলে পাঠককে মোহাবিষ্ঠ করেন। টিপিক্যাল গল্প বলার প্রবণতা থেকে তিনি নিজেকে মুক্ত করেছিলেন স্বদর্পে । চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে কাহিনিনির্ভর বর্ণনা প্রধান ধারা থেকে স্বতন্ত্র সুর স্বর তৈরী করেন আর নিরীক্ষাধর্মী শিল্পদৃষ্টির স্বাক্ষর রাখেন। একটি ঘটনার বয়ানকৌশলে তার প্রয়াসী বিশেষত্ব দেখিয়েছেন, দেখিয়েছেন উচ্চতর ভিন্ন প্রকরণ-কৌশল।
আখ্যানের ভিত্তিতে গল্পকে এগিয়ে নেয়ার বাসনা সেই অনাদিকালের হলেও সেটা এখন পর্যন্ত গল্পকারদের মধ্য থেকে বিলুপ্ত হয়নি। আখ্যানতত্ত্বে বা ন্যারেটলজির উপর দাঁড়িয়ে এর বিস্তার ও সমৃদ্ধি লাভ করলেও মূলত বিংশ শতাব্দির দ্বিতীয় দশকে রুশ প্রকরণবাদী রোমান জেকবসন, ভিক্টর স্কলভস্কি প্রমুখরা এই আলোচনা সূত্রপাত করলেও এর গোড়াপত্তন হয় অ্যারিস্টটলের ট্রাজেডির গঠন নির্ধারণের মাধ্যমে, পরে অবশ্য আকরণবাদ, চিহ্নবিজ্ঞান, নৃতত্ব, লোকসংস্কৃতি এটিকে শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করায়। এছাড়াও ৮০ ও ৯০ দশকে মিশেল ফুকো, রোলাবার্ত, জ্যাক দ্যারিদা, জ্যাক লাকা এই আখ্যানতত্ত্বকে ভিন্ন মাত্রায় স্থাপন করেন। এরও পরবর্তীতে উমবার্তো একোর চিহ্নবিজ্ঞান তত্ত্বের প্রসার ঘটালেও রবীন্দ্রনাথের স্বর্ণকুমারী দেবী,ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়, নগেন্দ্রনাথ মিত্র গল্প লেখলেও তাদের গল্পে ছোটগল্পের প্রকৃত শিল্পস্বরূপের প্রকাশ ঘটেনি। রবীন্দ্রানাথ ঠাকুরের মাধ্যমেই বাঙ্গলা ছোটগল্পে কাহিনি রচনার পরিবর্তে রচনাশৈলীর শৈল্পিক রূপায়ন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তিরিশের দশকে এসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরোধিতা এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী জীবনের গভীর সংকট বাংলা ছোটগল্পের বিষয়, মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা, চরিত্রনির্মাণ, ভাষাবৈচিত্রে নতুন এক নির্মিতির প্রকাশ। আদি-মধ্য-অন্ত সম্বলিত কাহিনির ধারণা থেকে বেরিয়ে এলেন গল্পকারেরা। এই ধারায় যুক্তজনরা হলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। ভাষার কাব্যময়তা , তীক্ষ্ণতা , সাংকেতিক বিন্যাস গল্প ও চরিত্রচিত্রণে এনেছে ভিন্ন মাত্রা। সেখানে উল্কার মত উদয় হলো তারাশংকর ,মানিক, সুবোধ ঘোষ, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, নারায়ণ বন্দ্যেপাধায় , সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শওকত আলী , শওকত ওসমান, মাহমুদুল হক সহ অনেকেই। ষাট ও সত্তরের ছোটগল্পের বক্তব্য ও ভাষায় যুক্ত হলো মেটাফোরের অনন্য অভিব্যাক্তি, যেন কবিতার মত কাব্যময়তা। কাব্যময়তা আর ক্লেদাক্ত জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় বড় বেশি সঁপে দিলেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সেদিক থেকে ভাষায় জাদুকরী উন্মেষ থাকলেও রাষ্ট্রযন্ত্রের নানান জটিল বিষয়কে গল্পে প্রায় অনুপস্থিত রাখলেন হাসান আজিজুল হক আর গুরুতর জীবনের গল্পে মগ্ন হলেন শওকত আলী প্রমুখেরা। এই ধারারই যেন একটা সুক্ষ্ম বুননের কারিগর কায়েস আহমেদ। তবুও নিরীক্ষাধর্মী সব পথকে এক করে দিয়ে তিনি নামলেন এক নতুন উদ্ভাসিত পথে। ছোটগল্পের টিপিক্যাল সমস্ত রীতিনীতিকে মাড়িয়ে তার দৃষ্টি রাখলেন, দূর নিরীক্ষণে। তার লেখালেখির সাথে সাথে তিনি আমুল বিশ্বাস করতেন সাহিত্যকর্ম সমকাল আর সমাজকে পাল্টে দিতে পারেন। সময়ের চিন্তাসূত্রের মাধ্যমেই পালটায় সমকাল।
ষাটের দশকের ছোটগল্পের ঈর্ষনীয় প্রবল জোয়ারকে কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন কায়েস আহমেদ। তবে শ্রোতের জোয়ারে গা ভাসিয়ে দেননি, নিজের আইডেন্টিটি আর সিগনেচারকে আলাদা করে পাঠককে চিনিয়েছেন। কে তিনি সযত্নে লালন করেছেন। তাঁর প্রথম ছোটগল্পগ্রন্থ “অন্ধ তীরন্দাজ এই সাধনার আর বিশিষ্টতা সদর্প ইঙ্গিতবাহী।
কায়েস আহমেদের গল্প সম্পর্কে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বলেন,
“ প্রথম বইতে দেখি , গল্প বলার, জমিয়ে গল্প বলার একটি রীতি তিনি প্রায় রপ্ত করে ফেলেছেন। আভাস পাওয়া যায় এই রীতিটিই দাঁড়িয়ে যাবে একটি পরিনত ভঙিতে, পাঠককে সেঁটে রাখার যাদু তিনি আয়ত্ব করে ফেলেছেন। …… পরের বইতেই নিজের রীতিকে , কিংবা প্রায় রপ্ত রীতিকে অবলীলায় ঠেকে কায়েস পা বাড়িয়েছেন নতুন রাস্তার দিকে । তার এসব কান্ড কিন্তু আঙ্গিক নিয়ে পরীক্ষা করার জন্য নয় , মানুষের ভেতরটাকে খুঁড়ে দ্যাখার তাগিদেই একটির পর একতী রসায়ন , তার ক্লান্তিহীন পদসঞ্চার।“
মানুষের অন্তর্গত জীবনের দীর্ঘশ্বাসের অনুসন্ধান কায়েস আহমেদের প্রথম দিকের গল্পের প্রধান উপজীব্য বিষয় ছিল। তারপর লেখক নিজেকে ব্যাপৃত করেন সমাজ জীবনের নানা পঙ্কিলতার বৃহত্তর পটভুমিতে। যে পটভুমিতে মানুষের বিষন্ন যন্ত্রণার অধ্যায়গুলো অনুল্লেখিত থাকে তথাকথিত ফুল পাতা জল নিয়ে কাব্য করা সাহিত্যিকগণ। তার বিষয় বৈচিত্রতায় তার সৃষ্টিচেতনায় তার নিজস্ব সৃষ্টিশীলতাকে এক ভিন্ন মাত্রায় স্থাপন করেন, ক্রমাগত ক্ষরণ আর খননের মধ্য দিয়ে। ‘অন্ধ তীরন্দাজ’ কায়েস আহমেদের প্রথম গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৭৮ সালে যেখানে গল্পের সময়কাল ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত একটি স্বাধীন দেশের মানুষের মননের পরিবর্তন ও আশাভঙ্গের সেই ভগ্নচিত্রই এঁকেছেন।
প্রেক্ষাপট শহর ও গ্রাম হলেও প্রায় সকল চরিত্রের নব্য স্বাধীন দেশের প্যাটার্ণে মানুষ ক্রমশ একটা আত্মজিজ্ঞাসায় বেদনাহত হয়, স্বাধীনতার পুরো স্বাদের আস্বাদনে ব্যর্থ হয়, সেই বিষয়টি কায়েস আহমেদ তার গল্পে ধারণ করেন। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হতাশাগ্রস্ত জীবনযুদ্ধে পরাজিত ও বিপদগামী মানুষ তার গল্পের প্রধান উপজীব্য ছিল। আত্মজিজ্ঞাসার মাধ্যমে আত্মানুসন্ধানে প্রাপ্ত একটা জীবন খুঁজে পেতে ব্যর্থ হওয়া মানুষজন তার গল্পের বিষয় ছিল। অবক্ষয়িত সমাজদর্পনে ব্যক্তিসত্তার অনিশ্চয়তা ও আত্মজিজ্ঞাসা আর নিজেকে অনুসন্ধান অনিবার্য হয়ে ওঠে তার গল্পে , এই প্রবণতায় তিনি হয়ে ওঠেন একজন সামাজিক ভাষ্যকার। মূলত সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখাই যেকোন গল্পকারের প্রধানতঃ চাইবার থাকে এবং কায়েস আহমেদ ছিলেন সেই মহান সাহিত্যিকদের সমস্বরের প্রতিনিধি। মনস্তাত্ত্বিক সংঘাত আর অস্তিত্বজিজ্ঞাসা তার গল্পের প্রধান সুর বলেই মনে করি।
অন্ধ তীরন্দাজ গল্পগ্রন্থের প্রথম গল্প ‘অন্তর্লীন চখচখি’ গল্পে নাগরিক জীবনের বৃত্তাবদ্ধ সময় ও নির্মম বাস্তবতা ও একঘেয়েমি থেকে প্রকৃতির বিশাল ভূবনে আত্মমুক্তি খোঁজে। প্রকৃতির ধুসরতা ও ক্ষয়িষ্ণু জীবনের চিত্র পল্টুর চিন্তায় ক্রমাগত বিলীন হতে থাকে গল্পের মাঝখানে।
“ খঞ্জরোদে শালিক ফড়িং ‘ গল্পের প্রেক্ষাপট আবারও প্রকৃতি এবং আবহমান সত্যকে গল্পে ধারণ করেছেন । গল্পে মৃত্যুই যেন মানুষের জীবনের অনিবার্য নিয়তি। যদিও নিয়তিবাদ তার গল্পে প্রায় অনুপস্থিত । লেখকের নিজের চিন্তার সাথে তো রেটরিক হয়ে ওঠে। গল্পের উপাদানে আমরা পাই সেই অমোঘ উচ্চারণ
“ মানুষের কি মরার জন্য কারনের অভাব? বেঁচে যে আছি এইতো ঢের!’
সুক্ষ্ম সব বিবরণ আমাদের চমকে দেয় , উপকরণের বুননে শালিক, ফিঙে, টুনটুনি, ফড়িং এর মতই তুচ্ছ মানুষের জীবন ও মৃত্যু। লেখকের ব্যক্তিক ভাবনা যখন যখন অন্তর্জগতের চেতনাপ্রবাহ কায়েস আহমেদের গল্পের প্রধান অনুষঙ্গ । এছাড়াও ঘটনাবিন্যাসে সময়ের সরল ও ক্রমাগত ভঙ্গুরতা কায়েস আহমেদের গল্পের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। যেখানে জীবনযুদ্ধে কর্মক্লান্ত মানুষ জীবনের প্রতি পরম বীতশ্রদ্ধতা।
গল্পকার কায়েস আহমেদকে নিয়ে যখন লিখতে বসেছি তখন বাংলাদেশে তখন একটা পারস্পারিক সাম্প্রদায়িক অবিশ্বাস , হানাহানি, রংপুরে মাঝিপাড়া আগুনে ভস্ম করা, কুমিল্লায় কোরান হনুমানের কোলে রেখে সাম্প্রদায়িক উস্কানীর মাধ্যমে হতদরিদ্র হিন্দুদের উচ্ছেদের মাধ্যমে এক গভীর রাজনৈতিক সংকট চলছে। ফেরা যাক কায়েস আহমেদের গল্প যা আলোচিত গল্পের বাইরের একটি গল্প “ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৈতৃক ভিটে ও মালপদিয়ার রমনী মুখুজ্জে” গল্পটি দিয়ে তিনি এখানে বেশ কটি চরিত্রকে সামনে এনেছেন- বিমল মুখুজ্জের বিপরীতে মোহান্ত মন্ডল। বিমল মুখুজ্জের বাবা রমনী মুখুজ্জে – একজন অন্ধ লোক । তিনি মানিক বন্দ্যোপাধায়ের বাবা হরিহর বন্দ্যোপাধায়কে চিনতেন, এমনকি তার বড় ছেলেকেও চিনতেন। রমনী মুখুজ্জে কানে কম শোনেন কিন্তু হরহর বাড়ুজ্জের কথা বলায় তার চোখ চকচক করে ওঠে। কারন তার বড় ছেলের বিয়েতে তিনি নিমন্ত্রণ পেয়েছিলেন। সেই বিয়েতেও তিনি গিয়েছিলেন কিন্তু কোনভাবেই প্রখ্যাত লেখক মানিক বন্দ্যোপাধায়ের নাম মনে আনতে পারলেন না। মানিক বন্দ্যোপাধায়ের পৈতৃক ভিটের কথা ওঠায় , তারা কিছুটা সংকোচ বোধ করছিলেন, তারপর অভয় দিলে তিনি তখন মোহান্ত মন্ডলের কাছে যেতে পরামর্শ দেন। এর ফাঁকেই কথা হয় বিমল মুখুজ্জের সাথে। আশ্চর্যের বিষয় হলো রমনি মুখুজ্জের মৃত্যুর তার পরিবার সহ ইণ্ডিয়ায় চলে যেতে পারছেন না। তার ছোট ভাই ইতিমধ্যে ভারতে চলে গেছেন। এখন বাবার মৃত্যুই তাদের আটকে দিয়েছেন।
বিমল মুখুজ্জে আর মোহান্ত মন্ডলের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে – বিমল মনন আর ভীতির কারনে ছাপোষা একজন মধ্যবিত্ত, যার ফলে এদেশ ছেড়ে চলে যাওয়া তার ফরজ কাজ মনে হয়- বাধা শুধু রমনী মুখুজ্জের মরণ। অন্যদিকে মোহান্ত মন্ডলের সাথে দেখা হলে তার ভেতরে দেখতে পাওয়া যায়, একদম খাঁটি দেশপ্রেমিক কৃষক। যিনি কয়েকবার বল্লমের খোচা খেয়ে নির্বিকার তার জমির অধিকার ছেড়ে দেয়ার। গল্পকার কায়েস আহমেদ অনেককাল আগেই পোর্ট্রট করেছেন মধ্যবিত্ত হিন্দু আর কৃ্ষক হিন্ধুদের পার্থক্য। শেষ পর্যন্ত মানিক বন্দ্যোপাধায়ের বাড়ীটির সামান্য অস্তিত্ব পেলেও , মুলত ওটা তাদের মামাবাড়ি। কিন্তু গল্পকার কায়েস আহমেদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ দুটি প্রশ্ন রেখে গেছেন। তিনি যেমন তার জীবনের ঝড়কে উপলব্ধি করেছেন তেমনি , অপরের ভেতরের মনস্তত্ত্বকে হাজির করেছেন , প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন। বিমল বাবুকে তিনি জিজ্ঞাস করতে গিয়ে করেননি কিন্তু তার অন্তর্জগত ফুটো করে বের হয়ে এসেছে এক মর্মদন্তু প্রশ্ন, যা আজও এই চেতনার সামান্য বাইরে যেতে পেরেছি বলে মনে হয়না। কায়েস আহমেদের গল্পে লেখেন-
“ বিমলবাবুকে বলতে পারতাম , জায়গা জমি নিয়ে এসব জটিলতা একা আপনার নয়, এবং আপনি হিন্দু বলেই শুধু নয়, সারাদেশ জুড়েই এ সমস্যা আছে, যারা এই অবস্থা করছে তারা নিজেদের সম্প্রদায়কেও রেহাই দেয়না; আর ডাকাতি ! সেতো এ দেশের মুসলমান ঘরেও হচ্ছে, কিংবা যে দেশে যেতে চাইছেন সেখানেও ডাকাতি হয়, তারা তাই বলে দেশ ছাড়েনা।“
“ ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর আজ পর্যন্ত – এত বছর পরও বিভক্ত ভারতবর্ষে প্রবল দুই সম্প্রদায় হিন্দু মুসলমান- যারা তাদের স্ব স্ব জন্মভূমিতে সংখ্যালঘু এই নামে অভিহিত হয়ে আসছে, কী হিন্দু কী মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে এক ধরনের মানস সংকট সৃষ্টি হয়ে আছে, মনোজগতের এই পরবাসি চেতনাই তার শিকড় আলো করে দিয়েছে স্বদেশের ভুমিতে। কিন্ত পাশাপাশি সংখ্যাগুরুর একজন নিঃস্ব ব্যক্তিও এ ধরনের মানস সংকটে ভোগেন না – তার কারনও সেই একই রাজনীতি। এই গল্পটিতে যতটা না মানিক বন্দ্যোপাধায়ের বাড়ি খোঁজা তার চেয়ে এই সংকটকে আদ্যেপান্ত চিহ্নিত ও চিত্রিত করা গল্পকার কায়েস আহমেদের পরম সার্থকথা।
‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৈতৃক ভিটে ও মালপদিয়ার রমণী মুখুজ্জে’ কি গল্প না স্মৃতিচারণ তা ধোঁয়াশা হয়ে আচ্ছন্ন করে রাখে। কখনো কখনো যে নিজদেশেই পরবাসী হয়ে থাকতে হয়, তা কেউ বরণ করে নেয় আবার কেউবা যে তা থেকে পালিয়ে বাঁচতে চায়; তারই প্রকাশ এতে ।
অন্ধ তীরন্দাজ গল্পগ্রন্থের দশ বছর পর প্রকাশিত হয় গল্পগ্রন্থ ‘ লাশকাটা ঘর’ । সমাজের প্রতি পরম দায়বদ্ধ শিল্পির সমাজমনস্কতা খুঁজে পাওয়া যায় এই গল্পে। ভারতীয় উপমহাদেশের বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসের দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যার একটি মহান মুক্তিযুদ্ধ আর নকশালবাদী আন্দোলন। পশ্চিমবঙ্গের ও বাংলাদেশের গ্রামীন জীবনের পটে তিনি গল্পের প্লট সাজিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের মহান বীরোচিত ইতিহাস ও যুদ্ধপরবর্তী বিষদময় উপাখ্যান, নকশালবাদীদের আন্দোললনের তৎপরতা, হত্যাযজ্ঞ, লুটতরাজ এবং বিত্তহীন ও মধ্যবিত্ত মানুষের সুখ-দুঃখ , আশা আকাঙ্ক্ষা , সামাজিক নিপীড়ন , শোষণ আর নানা অসঙ্গতির পোর্টেট করেছেন, তার এই গল্পগুলোতে তীক্ষ্ম ও ব্যঙ্গাত্ত্বক দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ তার স্বাতন্ত্র শিল্পসত্তার প্রকাশ। গল্পগুলোতে সাধারনের প্রতিবাদমুখরতা ও তার মূর্ত চেতনার বহিপ্রকাশ। হতাশাগ্রস্ত নিঃসঙ্গ আত্মমগ্ন চরিত্রের বিন্যাস থেকে সরে সক্রিয় , প্রতিবাদী চরিত্র এঁকেছেন আর উদ্ভাসিত হয়েছে মানবীয় উন্মেষ। গল্পকার কায়েস আহমেদের গল্পে পরিমিতিবোধের সাথে সাথে প্রায়শই নিরীক্ষা চালিয়েছেন ভাষা ও নির্মিতিতে। তবে এই কারনে কখনো কখনো তার গল্পে মূলসুর দিকভ্রষ্ট হয়েছে বটে কিন্ত মানুষের ক্ষরণের চিত্র অঙ্কনে সামান্য স্খলিত হননি। মানুষের যাপনের হাহাকার তার নিজের ভেতরে যেমন ধারণ করেছেন , তেমনি তার গল্পের বিন্যাসে বিন্যস্ত করেছেন সযতনে। তার গল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বক্তব্যপ্রবণতা, গল্পের প্লটে বক্তব্য ঢুকে পড়ার অন্যতম কারন তার সমাজ সচেতনার এক অনন্য স্বাক্ষর। তবে ডিটেলসে তাঁর অত্যাগ্রহ যে অমূলক নয়, সেটা কিন্তু মাঝেমাঝেই বিমূর্ত হয়ে উঠেছে।
ঝিলিক দিয়ে উঠেছে-গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে, জন্ডিস রোগীর মতো ফ্যাকাশে, ক্রমাগত নিঃশোষিত হয়ে আসতে থাকা বনতুলসী, চিচ্চিড়ে, আশ শ্যাওড়া বন আর পিঙ্গল ঘাসের গায়ে লেপ্টে থাকা প্রায় ফুরিয়ে আসা দুপুর যেন থমকে আছে, গাছের পাতা নড়ে না, তামাটে রং এর উপুড় হয়ে থাকা বিশাল সরার মতো আকাশের নীচে শেষ অক্টোবরের পৃথিবী যেন চুপ করে আছে।
“যাত্রী”গল্পের মত কিছু কিছু গল্পে পরাবাস্তবতার ছাঁচে ঢেলে তিনি নিরীক্ষা করতে চেয়েছেন। নিঃসঙ্গতার বীভৎস রূপ গল্পের প্রকট আকার ধারণ করেছে। লেখক নিজে নিঃসঙ্গ যাপনে অভ্যস্ত থাকার কারনে নিঃসঙ্গতার উপাদান সন্নিবেশিত করেছেন এবং সেটা তিনি উপভোগ আর এর নির্যাস আহরণ করেন সমাজ বাস্তবতার নিরিখেই।
নিরীক্ষাধর্মী আরেকটি গল্প “বন্দী দুঃসময় একঘেয়ে ক্লিশে উত্তাপহীন যাপনে তীব্রদহন, চেনা পরিপার্শ্ব পাল্টে যায়, স্রোতের মত ঘুরপাকের পর কেবলি ভাঙ্গতে চায় , মুক্তি চায় কিন্তু মুক্তি কি সত্যিই সম্ভব? সেটি তো হতাশায় নিমজ্জিত এক দুর্ভাবনা। বিষ্ময়াভিভূত হয়ে ‘অন্ধ তীরন্দাজে’ ‘সম্পর্ক’ গল্পে এসে লেখক নিজেকে মেলে ধরেছেন এক শান্ত দিঘীর মত, যেখানে স্রোত নাই, টুপটাপ শিশিরের শব্দ পাওয়া যায়,বিহঙ্গস্বরূপ ভাবনাগুলোর নিজের চেতনার মত করে নির্মিতি দিয়েছেন। চরিত্রগুলো এই দুটি গল্পে উপযুক্ত বিকাশ পেয়েছে, অনাবশ্যক ডিটেইলে গল্প ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েনি। “অন্ধ তীরন্দাজ” গল্পে একদল দিকশূন্য যুবকের ভেতরে গুমরে গুমরে থাকা হতাশা, অত্যন্ত স্পষ্টতার পেরেকে মোড়া। “সম্পর্ক” গল্পে দুই বন্ধুর মধ্যে বহুদিন পর পুনর্মিলনীর পরের চিত্র যা অনিবার্য ধেয়ে আসা বাস্তবতা নির্মাণে লেখক অনেকটাই সংযত, উত্তীর্ণ। অথচ দৃশ্যকল্পের প্রতি লেখকের স্বভাবজাত মুগ্ধতার আবেশ এখানে স্পষ্ট , কিন্তু কখনোই তা বেসুরো হয়ে উঠেনা বরং কায়েস আহমেদকে ঘিরে মনোযোগী পাঠকের প্রত্যাশার পারদ ক্রমশ একটা অনন্য উচ্চতায় স্থাপিত হয়।
ভাবুন একটা সাগরের মাছের কথা, যে লাফ দিতে গিয়ে পানি থেকে অনেক উপরে উঠে পড়ে প্রথম সূর্যের তীব্র আলো দেখে ফেলে, কিন্তু যান্ত্রিক নৌকার প্রোপেলারে ধাক্কা লেগে তার নিজের পাখনা ভেঙ্গে যায়। এখন সে তলিয়ে যাচ্ছে সাগরের অতলে। আস্তে করে উপরের ফেলে আসা আলোটুক মিলিয়ে যাচ্ছে। আলোর গোলক ছোট হতে থাকছে আর শীতল অন্ধকার চারপাশে চাঁদরের মত জড়িয়ে ধরছে আপনাকে, আপনিই মাছটা। তলিয়ে যাচ্ছেন, অন্ধকারে। তলিয়ে যাচ্ছেন অতলে। অন্ধকারে চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে আপনার, সময় যেতে যেতে যখন ভাবলেন অন্ধ হয়ে গেছেন, তখনই পাতালে দেখলেন হঠাত একটা জ্বলজ্বলে গাছ। উজ্জ্বল নীলচে তেজস্ক্রিয় সবুজ। আপনি কি সেদিক যাবেন? ভাবছেন। কিন্তু বেশি ভাবতে পারছেন না। আপনি তো মাছ।
কায়েস আহমেদের গল্পের বেশিরভাগ চরিত্রই কাল্পনিক কিন্তু পাঠকের আত্মিক সম্মিলন ঘটাতে সামান্যও সমস্যা হয়না আর আমাদের পরিপার্শ্বে ঘটে যাওয়া ঘটনায় পাঠক এমনভাবে সেঁটে থাকেন যেখানে পাঠক নিজেই হয়ে ওঠেন এক একজন কায়েস আহমেদ। কায়েস আহমেদ সমকালীন বাস্তবতা, ভাষার নির্মিতি, নিরীক্ষা, আর সমাজ পরিবর্তনের ভেতরকার আর্তনাদসহ সকল বিবেচনায়ই অনন্য এক ক্ষণজন্মা লেখক। কায়েস আহমেদ বারবার ফিরে আসুক, পাঠকের সাথে হাটুক অপরিবর্তনীয় পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে।