You are currently viewing ওরা কেউ ফেরেনি -৪ || বিচিত্রা সেন

ওরা কেউ ফেরেনি -৪ || বিচিত্রা সেন

ওরা কেউ ফেরেনি || বিচিত্রা সেন

কিস্তি-৪ ৭. নন্দলাল রেঙ্গুন ফিরে যেতে দোমনা করলেও শেষ পর্যন্ত সাত মাসের মাথায় সে গ্রাম ছাড়ে। মনিবালার প্রস্তাবটা তার মনে ধরেছিল। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এবার গিয়ে ব্যবসাটার একটা হিল্লে করে সে দেশে ফিরবে। ওসানি আর সূর্য তাকে ছাড়া ঠিকই চলতে পারবে। সূর্যকে বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করাবে। দরকার হলে মাঝে মাঝে গিয়ে সে ওদের দেখে আসবে। কিন্তু গ্রামে তার থাকাটা খুব জরুরী। একে তো তার প্রচুর ভূসম্পত্তি হয়ে গেছে। তার ওপর মায়েরও বয়স বাড়ছে। মনিবালা সম্পত্তি এবং ছেলে দুটো একসাথে সামলাতে পারবে না। এসব ভেবেই সে আবার রেঙ্গুন ফিরে গেছে। যাওয়ার আগে নন্দলাল আদিত্যকে গ্রামের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে। ভালো ভালো মাস্টারের জন্য স্কুলটা বেশ সুনাম কুড়িয়েছে। মাস্টাররা সব অন্য গ্রাম থেকে এসে এগ্রামে বসত গেড়েছে। মাস্টারদের সুনামের কারণেই স্কুলটার নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। নন্দলাল যখন পড়ালেখা করেছিল তখন তাদের গ্রামে স্কুল ছিল না। পাশের গ্রামে গিয়ে তাকে পড়তে হয়েছিল। এখন বাড়ির কাছে স্কুল। আদিত্যের জন্য খুব সুবিধাই হয়েছে। প্রতিদিন সকালবেলা বাড়ির আশেপাশের ঘরের আরও সব ছোট বাচ্চাদের সাথে সে স্কুলে যায়। ফেরেও ওদের সাথে। ফেরার পর মনিবালা ওকে ভাত খাইয়ে দেয়। ঠাকুরমা তখন সংসারের নানা কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এরই মধ্যে স্কুলের মাস্টাররাও সবাই জেনে গেছেন আদিত্য নারায়ণ খুব ভালো ছবি আঁকে। তাঁরা আদিত্য নারায়ণের কয়েকটা ছবি স্কুলে আঠা দিয়ে লাগিয়ে দিয়েছে। লেখাপড়াতেও আদিত্য সবার নজর কেড়েছে। তবে এর ভেতর এক মজার কা- ঘটেছে। আদিত্যকে যখন তার মাস্টার ঘরে এসে পড়ায়, তখন মনিবালা পাশের কক্ষ থেকে সব শোনে। এভাবে সে পড়ালেখাটা শিখে ফেলেছে। আদিত্য তাকে বর্ণমালা, অইঈউ, নামতা, ১, ২ এসব শিখিয়েছে। শাশুড়ির চোখে কয়েকবার পড়েছে মনিবালার এই পড়ালেখার চর্চা, তবে তিনি কিছু বলেননি। বরং মনে মনে খুশি হয়েছে এই ভেবে যে, মনিবালা লেখাপড়া শিখলে জমি জিরাতের কাগজপত্র বুঝতে পারবে। এভাবেই দিন যায়, মাস যায়, বছর ও গড়িয়ে চলে। নন্দলাল সেই যে একেবারে ব্যবসা গুটিয়ে চলে আসবেন বলে গেছে, তারপর তিন বছর চলে গেলো। কিন্তু নন্দলাল আর আসেনি। তবে টাকাপয়সা নিয়মিত পাঠায়। মাঝে মাঝে চিঠিও লেখে। কারণ আদিত্য যে সে চিঠি পড়ে সবাইকে শোনাতে পারবে নন্দলাল তা জানে। তবে সে চিঠিতে নিজের কুশলবার্তা ছাড়া আর কিছু থাকে না। মনিবালার খুব ইচ্ছে করে নন্দলালকে একটা চিঠি লিখতে, কিন্তু সে তো ঠিকানা জানে না। তাই মনের ইচ্ছা মনেই গুমরে মরে। আদিত্য এখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। ভালো ছাত্র হিসেবে স্কুলে তার বেশ নাম ডাক। এসময় শৈলেন দাশগুপ্ত নামে এক শিক্ষক এই স্কুলে যোগদান করলেন। তিনি যোগদানের পর পর স্কুলে বেশ সাড়া পড়ে গেলো। তিনি ছাত্রছাত্রীর নিয়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে লাগলেন। রবীন্দ্রসংগীত, নজরুল সংগীত, পল্লীগীতি, দেশাত্মবোধক গানের পাশাপাশি তিনি চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতারও আয়োজন করলেন। এ নিয়ে গ্রামে বেশ উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হলো। শাশুড়ির কাছে আবদার করে মনিবালা একটি চার ব্যাটারির রেডিও কিনেছিল আদিত্যের জন্মের পর পরই। সেই রেডিও প্রায় সারাদিনই বাজতো মনিবালার ঘরে। ওই রেডিও থেকে শুনে শুনে আদিত্য যে কখন পল্লীগীতি মুখস্থ করে ফেলেছিল তা কারো জানা ছিল না। স্কুলের প্রতিযোগিতা শেষে আদিত্য যখন দুটো প্রথম পুরস্কার নিয়ে বাড়িতে এলো, তখন মা-ঠাকুরমার চোখ তো ছানাবড়া। চিত্রাঙ্কনে প্রথম হবে তা তো তাঁদের জানাই ছিলো, কিন্তু আদিত্য যে সঙ্গীতশিল্পীও হয়ে গেছে তা তো তাঁদের একেবারেই জানা ছিল না। সেদিন একেবারে আদিত্যকে ঘিরে উৎসব জমে গেলো। আশেপাশের ঘরের সবাইকে আদিত্যের ঠাকুরমা খেতে বললেন। মনিবালা আর রাঁধুনী যে মহিলা দুজন ছিল তারা মিলে রান্নাটাও সেরে ফেললো। রাতে হ্যাজাক আনা হলো। হ্যাজাকের আলোতে নন্দলালের ঘরের টানা বারান্দায় পুরো বাড়ির জ্ঞাতিরা একসাথে খেলো। খেযে সবাই প্রাণভরে আশীর্বাদ করলো আদিত্য যেন একদিন মানুষের মতো মানুষ হয়। আদিত্যের নাম যেন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। আদিত্যের নাম একদিন সারাদেশে না হলেও সারা থানায় ছড়িয়ে পড়বে, তবে তাঁরা যেভাবে চেয়েছিলেন সেভাবে নয়, অন্যভাবে। আদিত্য পুরস্কার জেতার এক সপ্তাহ পর হঠাৎ এক বিকেলে আবির্ভাব ঘটে নন্দলালের। সেদিন সবাই বসে চা-মুড়ি খাচ্ছিল। হঠাৎ উঠোন থেকে হাঁকডাক শোনা যায়- – মা, অ মা, তুঁই হডে? আঁই চলি আইশশি। নন্দলালের মা একলাফে পালঙ্ক থেকে নেমে বাইরে ছুটে আসেন। দেখেন, হাতে, কাঁধে চার পাঁচটা ব্যাগ নিয়ে নন্দলাল ঘরে ঢুকছে। মাকে দেখে ব্যাগগুলো নামিয়ে রেখে প্রণাম করে সে। তারপর মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, -অ মা, আঁই এক্কবারে চলি আইশ্শি। তুঁই এবার খুশি না? এতক্ষণে আদিত্য এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরেছে। মনিবালার চোখে জল। মানুষটা সেই যে আসবে বলে গিয়েছিল আর তিন বছর আসেনি। তবে এবার একেবারেই চলে এসেছে বলছে। এতেই তার চোখে আনন্দের অশ্রু নেমেছে। জ্ঞাতিরা সাবই এসে ভিড় করেছে নন্দলালের উঠোনে। নন্দলাল দুই/তিনটা মিষ্টির হাঁড়ি বের করে সবাইকে দিতে বলে। সবাই হৈহুল্লোড় করে মিষ্টি খায়। ঘরের কেউ বলার আগে ওরাই আদিত্যের পুরস্কার জেতার খবর দেয় নন্দলালকে। আদিত্য একছুটে মায়ের ঘরে ঢুকে পুরস্কার দুটো নিয়ে আসে। পুরস্কার দেখে নন্দলাল খুব খুশি হয়। ৮. নন্দলাল এবার আসার পর থেকে জমির কাগজপত্র নিয়ে আছে। তার পৈতৃক সম্পত্তি ছিল অনেক। তার আর কোনো ভাইবোন না থাকায় সব সম্পত্তির সে একক মালিক। এর মধ্যে রেঙ্গুন ব্যবসা করে সে নিজের নামে অনেক জমি কিনেছে। গ্রামে এখন সবচেয়ে বেশি ভূ-সম্পত্তি তার। এতসব জমি দেখে শুনে রাখা কষ্টকর বটে। ইদানিং তার মাথায় একটা নতুন স্বপ্ন জেগেছে। সে চায় তার নামে একটা গ্রামে হাট বসাতে। তাহলে অনন্তকাল ধরে এই হাট তার নামের বার্তা প্রচার করবে। রেঙ্গুনে এরকম অনেক হাট সে দেখে এসেছে। কিন্তু হাট বসানো সহজ কর্ম নয়। এ জন্য দরকার লোকবল। তার আশেপাশে প্রচুর মানুষ আছে, তবে এরা বিশ্বস্ত কিনা সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। তাছাড়া এতবড় কাজে নামার আগে মা এবং মনির মতামতও জানা উচিত। একরাতে খেতে বসে নন্দলাল মায়ের কাছে কথা তোলে- -অ মা, আঁই একখান আঁর নামে হাট বোয়াইতাম চাইর। তুুঁই কী হ? মা বলেন, -হাট তো একখান আছে, লালির হাট। নতুন হাট জমিবু না? হাট না জমিলে টাকা-পয়সা বেগগুন তো ছাড়খার অইবু। নন্দলাল বলে, -হাট যিয়ান আছে, ইয়ান তো এক মাইল দূরে। আঁর হাট আরঁ গ্রামত অইবু। তুঁই আশীর্বাদ কইরলে জমি যাইবু, চাইও। মা বুঝতে পারেন, ছেলে একবার যখন হাট বসাবে মনস্থির করেছে তখন হাট বসাবেই। কোনো বাধাই তাকে নিরস্ত করতে পারবে না। তাই তিনি বাধা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বলেন, -তোর মনে কইলি হাট বোয়া। ঠিক এসময় আচমকা প্রশ্ন করে মনিবালা, -আইচ্ছা, অনর রেঙ্গুনর ব্যবসার খবর কী? ইয়িন ঠিক বন্দোবস্ত করিত ফাইরগুন না? মনির প্রশ্ন শুনে মনে তীব্র ধাক্কা খায় নন্দলাল। বুকে কেমন মোচড় দিয়ে ওঠে। ওসানি এবং সূর্যের মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। নিশ্চয় তারা প্রতিবারের মতো এবারও অপেক্ষায় থাকবে ওর জন্য। ও যে আর ফিরবে না তা তো একবারের জন্যও বুঝতে দেয়নি ওসানিকে। শুধু একটা কাজ করেছে গত তিন বছরে ওসানিকে আবার ব্যবসার কাজে জড়িয়ে নিয়েছে। ছেলের দায়িত্ব মাকে বুঝিয়ে দিয়ে এখন অফিসে বসে। নন্দলালকে ছাড়া ওদের কোনো অসুবিধা হবে না। কিন্তু একজন স্ত্রীর প্রয়োজন তো তার স্বামীকে, একজন পুত্রের প্রয়োজন তো তার বাবাকে। ওরা তো সেটা আর কখনো পাবে না। মনটা অপরাধবোধ নুইয়ে আসে নন্দলালের। আর ভাত খেতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু এখন ভাত ছেড়ে উঠে গেলে সবার মনে প্রশ্ন দেখা দেবে। তাই সে ভাত নাড়াচাড়া করতে করতে বলে, -রেঙ্গুনের ব্যবসা আঁই বেচি দি। হেডে আর হনো কিচ্ছু নাই। উত্তর শুনে মনিবালা নিশ্চিত হয়। কোনো রকমে ভাত শেষ করে নন্দলাল হাতমুখ ধুয়ে ঘুমন্ত আদিত্যের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ে। আদিত্যের মুখের দিকে চেয়ে খুব করে মনে পড়ে সূর্যকে। মন হু হু করতে থাকে। একসময় নন্দলাল খেলাল করে তার চোখের পানিতে বালিশ ভিজে গেছে। তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে বালিশটা সে উল্টে দেয়। সে চায় না মনিবালা তাকে সন্দেহ করুক। পরদিন সকাল থেকে নন্দলাল হাট বসানোর প্রক্রিয়ায় একেবারে কোমর বেঁধেই নামে। তাকে এ কাজে উৎসাহিত করতে রীতিমতো একপাল সাগরেদও জুটে যায়। গ্রামের মাঝ বরাবর নন্দলালের যে জমিটা ছিল সেটাই নির্ধারিত হয় হাটের জন্য। ঠিক হয় গ্রামের দরিদ্র গৃহস্থ যারা আছে, তারাই গ্রামের স্বচ্ছল গৃহস্থদের থেকে জিনিসপত্র সংগ্রহ করে হাটে গিয়ে বসবে। ওই হাট থেকেই সবাই যার যা লাগে, তা কিনে নেবে। হাটের নামও ঠিক হয়। সবাই এক বাক্যে সায় দেয়, হাটের নাম হবে ‘নন্দলালের হাট’। শনিবার এবং মঙ্গলবার দুদিন হাট বসবে। যথারীতি এক শনিবারে হাট বসেও যায়। অনেকেই জিনিসপত্র সংগ্রহ করে হাটে যায় বেচতে। কিন্তু শনিবারে শনির দশা লাগলো কি না কে জানে! হাটে অনেক মানুষ যায় সত্যি, কিন্তু কেউ কিছু কেনে না। হাটুরেরা চিৎকার করে মানুষজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়, তবুও মানুষজন কেউ সওদা করে না। সবাই শুধু ঘুরে ঘুরে দেখে। দুই ঘন্টা যেতে হাটুরেরা হতাশ হয়ে পড়্ কোরো কোনো বিক্রি হয়নি। অগত্যা তাদের মনোবল চাঙ্গা রাখার জন্য নন্দলাল নিজেই সব হাটুরের সওদাপাতি কিনে নেয়। যারা নন্দলালকে হাট বসাতে পরামর্শ দিয়েছিল তারাও যদি একটা করে কিছু কিনতো, তাহলেও হাটটি জমে উঠতো। কিন্তু বাস্তবে সেটা ঘটে না। প্রথমদিনেই হাটের এই অবস্থা দেখে নন্দলাল অনেকটা মুষড়ে পড়ে। সে ভেবে পায় না কেন কেউ একটা জিনিসও কিনলো না হাট থেকে। খুব মন খারাপ নিয়ে সে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরে। মা এবং মনি খুব আগ্রহ নিয়ে বসেছিল হাট কেমন জমেছে তা জানার জন্য। নন্দলালের বিমর্ষ মুখ দেখে তারা দমে যায়। বুঝতে পারে খবর তেমন ভালো না। মনি একগ্লাস জল এনে দেয় স্বামীর হাতে। মা নন্দলালের গা ঘেঁষে বাতাস করতে করতে বলে, -তোর হাট ক্যান জোম্মি? নন্দলাল দুপাশে মাথা নেড়ে জানায় ভালো না। মনির বুকটা ধক করে ওঠে। স্বামীর এতদিনের স্বপ্ন ধুলিসাৎ হয়ে যাবে! মা সান্ত¦না দিয়ে বলে, -আজুবা ফয়লা দিন তো, এতর লাই ন জমে। চিন্তা না হরিশ্। সামনের বার জমিবু। এমন সময় উঠোন থেকে সব হাটুরের শোরগোল শোনা যায়। নন্দলাল তাদের সবার সব জিনিস কিনে নিয়েছে। তাই তারা সেসব নিয়ে এসেছে। এত এত জিনিসপত্র দেখে মা আর মনি পরস্পরের দিকে তাকায়। তারপর মা মনিকে ইশারা করে সব জিনিস ঘরে তুলে রাখতে। নন্দলাল খুব আশা করে থাকলেও মঙ্গলবারেও শনিবারের পুনরাবৃত্তি ঘটে। হাট জমে না। হাটুরেরা দেড়ঘন্টার মতো অপেক্ষা করে হৈ চৈ শুরু করে দেয়। বাধ্য হয়ে নন্দলাল আবারও নিজের টাকা দিয়ে ওদের সব জিনিসপত্র কিনে নেয়। আজ আর হাটুরেরা অপেক্ষা করে না। নন্দলালের কাছ থেকে টাকা বুঝে নিয়ে তারা সবাই নন্দলালের বাড়ির দিকে ছোটে। নন্দলাল হতাশ হয়ে বসে থাকে হাটে। এ সময় গ্রামের এক মুরুব্বি বলেন, -তোরে ওডা এক্ খান্ হতা হইতাম চাইর। আঁর হতা হুনিবি না? নন্দলাল বৃদ্ধের দিকে তাকায়। কী কথা বলতে চায় বাদলদার বাবা? তার দৃষ্টি দেখে বৃদ্ধ যেন আশ্বাস পায়। বলে, -তোর হাট না জমের যে একখান কারণ আছে। হাট বোয়ানর আগে হাটর জাগাত পরী আনন ফরে। নন্দলাল ভ্রু কুঁচকে তাকায়। পরী আনতে হবে হাট জমাতে? এ কথা তো আগে কেউ বলেনি। এখন সে পরী কোথায় পাবে? আদৌ কি পরী বলে কিছু আছে? বৃদ্ধের কথাকে কয়েকজন সমর্থন দেয়। বলে, হাট জমাতে পরী আনা লাগে এ কথা তারাও শুনেছে। অগত্যা নন্দলালকে এবার নতুন ভাবনায় পেয়ে বসে। আবার একদল সাগরেদ জুটে যায় নন্দলালের সাথে। পাঁচ গ্রাম দূর থেকে ওঝা আনা হয়। কোনো এক শনিবারে সারাদিন ব্যাপী চলে পরী আনার কসরত। পরী আনার দৃশ্য দেখতে পুরো গ্রাম ভেঙ্গে পড়ে নন্দলালের হাটে। নারী-পুরুষ-শিশু কেউ বাদ যায় না। এমনকি নন্দলালের মা এবং মনিবালাও আসে হাটের মধ্যে। আদিত্য নারায়ণ সবকিছু ভালোমতো দেখার জন্য একেবারে ওঝার গা ঘেঁষে বসে। অনেক রকম কেরামতি দেখায় ওঝা ভরা হাটে। এতসব জোগাড় করতে নন্দলালের বিপুল অর্থ ব্যয় হয়। কিন্তু তাতে তার আফসোস হয় না। সবকিছুর বিনিময়ে সে পরীকে চায়। পরীর আশীর্বাদে তার হাট জমে উঠুক। কিন্তু সারাদিন জুড়ে নানা তন্ত্রমন্ত্র ঝাড়ফুঁক করে বিকেলে ওঝা ঘোষনা দেয় পরী আসবে না। পরী চায় না এ স্থানে কোনো হাট হোক। মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে নন্দলালের। এত টাকা পয়সা খরচ করেও তার হাট জমবে না? পরী দেখার জন্য এতক্ষণ যারা ভিড় করেছিল। পরী আসবে না শুনে তারা এবার বাড়ির দিকে রওয়ানা দেয়। তাদের মুখে মুখে এ কাহিনী তিল থেকে তালে রূপ পায়। নন্দলালের পরিবারের সবাই এবার বাড়ি ফিরতে উদ্যোগী হয়। কিন্তু নন্দলাল বেঁকে বসে। সে এখন বাড়ি যাবে না। শত অনুরোধে তাকে টলানো যায় না। মনিবালার ডানচোখটা বার বার কাঁপছে। বুকের মধ্যে কেমন দূর্গাপূজার বাদ্য। তার কেবলই মনে হচ্ছে বড় কোনো বিপদ আসছে। *******************************