You are currently viewing ওরা কেউ ফেরেনি-৩ || বিচিত্রা সেন

ওরা কেউ ফেরেনি-৩ || বিচিত্রা সেন

ওরা কেউ ফেরেনি || বিচিত্রা সেন

সেই যে দেশ থেকে এসেছিল, এরপর আর দেশে যাওয়া হয়নি নন্দলালের। তার ব্যবসাটা ফুলে ফেঁপে উঠেছে। এ অবস্থায় সব ফেলে দেশে গেলে ব্যবসার বারোটা বাজবে। ওসানি এখন ছেলেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে বেশি। সূর্যের বয়স এখন দুবছর। নন্দলাল জানে মনিবালার ঘরেও তার একটা পুত্রসন্তান হয়েছে। ছেলের নাম রাখা হয়েছে আদিত্য নারায়ণ চৌধুরী। নন্দলালদের পাশের গ্রামের একটা ছেলে কেমন করে যেন রেঙ্গুনে এসেছে। তার সাথে নন্দলালের যোগাযোগ হয়েছে। তবে ছেলেটাকে কখনো বাড়িতে আনেনি সে। ছেলেটা জানে না নন্দলালের এখানে সংসার আছে। ছেলেটার সাথে যোগাযোগ হওয়াতে নন্দলালের বেশ উপকার হয়েছে। ছেলেটার মাধ্যমে নন্দলাল বাড়িতে টাকা পাঠায়, খবরাখবর জানতে পারে। সে খবর পেয়েছে তার পাঠানো টাকা দিয়ে মা আরও জমি কিনেছে। জমি থেকে যে ফসল আসে তার সামান্যই মা এবং মনিবালার জন্য লাগে। বাকি ফসল বিক্রি করে বেশ ভালোমতোই সংসার চালাচ্ছে মা। এদিক দিয়ে নন্দলাল বেশ নিশ্চিন্তেই আছে। তবে মনিবালা এবং অদেখা ছেলেটার জন্য তার বুক কেমন খাঁ খাঁ করে। যদিও উপরে সে তা কাউকে প্রকাশ করে না। সূর্য খুব বাপভক্ত হয়েছে। যতক্ষণ নন্দলাল বাড়িতে থাকে, ততক্ষণ তার কাছছাড়া হয় না সূর্য। সূর্যের জন্মের এক বছর পরেই ওসানির পঙ্গু বাবা মারা গিয়েছিল। তাই ওসানির মা ও সংসা রের কাজে এখন অনেক সময় দিতে পারে।
রেঙ্গুন শহরটাকে নন্দলাল এমনভাবে আপন করে নিয়েছে, মাঝে মাঝে সে ভুলেই যায় কোনো এক সময় চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলায় ছিল তার আদি বাড়ি। সেই উপজেলার প্রত্যন্ত একটা গ্রামে তার যে একটা সংসার এখনো তার অপেক্ষায় প্রহর গোণে সে কথা তার মনে থাকে না। কোনো এক অলস দুপুরে, কিংবা বিষণœ সন্ধ্যায় মনিবালা যখন করুণচোখে তার সামনে এসে হাজির হয় তখন বুকের ভেতরে এক চিনচিনে ব্যথা সে অনুভব করে। তবে পরক্ষণেই সবকিছু মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে নিজের মনে বলে উঠে, আমি তো ওদের প্রতি অবিচার করছি না। নিয়মিত টাকা তো পাঠাচ্ছি। ওদের খবরও তো পাচ্ছি। ওরা তো ভালোই আছে।
এভাবে দিন গড়িয়ে চলে। সূর্যের বয়স এখন পাঁচ। ওকে স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছে। সবচেযে দামি স্কুলকেই সে বেছে নিয়েছে তার ছেলের জন্য। লেখাপড়া শিখে একদিন ওর ছেলে অনেক বড় হবে, এমন স্বপ্নই দেখে নন্দলাল হররোজ। তবে ইদানিং তার মনটা খুব অস্থির হয়ে উঠেছে। মাকে দেখার জন্য, মনিবালা এবং ছেলেকে দেখার জন্য ভেতর থেকে কেমন তাগিদ অনুভব করছে। কিন্তু দেশে যাওয়ার কথা বললে ওসানি কী ভাববে সেটা ভেবেই সে কিছু বলতে পারছে না। ওসানিকে তো সে কথা দিয়েছিল সে আর দেশে ফিরবে না, বিনিময়ে চুনা ফ্যাক্টরির মালিক হয়েছে সে। কিন্তু‘ কয়দিন ধরে মনটা এত অস্থির লাগছে। ব্যাপারটা ওসানিরও নজর এড়ায় না। এক সন্ধ্যায় চায়ের টেবিলে ওসানি জানতে চায়,
-কী হয়েছে তোমার? কয়দিন ধরে দেখছি তোমার মনটা খুব খারাপ। মায়ের কথা মনে পড়ছে?
নন্দলাল ভেতরে ভেতরে চমকে যায়। ওসানি কি অন্তর্যামি নাকি? চেহারায় সেটা প্রকাশ না করে নন্দলাল বলে,
-হ্যাঁ, খুব মনে পড়ছে। মা কেমন আছে কে জানে!
নন্দলাল যে বাড়িতে নিয়মিত টাকা পাঠায় ব্যাপারটা ওসানির জানা ছিল না। সে ধরে নিয়েছিল পাঁচ বছর ধরে নন্দলালের বাড়ির সাথে যোগাযোগ নেই। তাই কেমন এক অপরাধ বোধ তাকে পেয়ে বসে। মনে হয় তারই কারণে তো নন্দলাল মাতৃ¯েœহ বি ত। সে তো নিজে মায়ের সাথেই আছে। তাই অপরাধী মন নিয়ে সহানুভূতির স্বরে ওসানি বলে,
-তুমি এক কাজ করো, কয়েক মাসের জন্য বাড়ি গিয়ে ঘুরে আসো। সূর্যকে আমরা সামলাতে পারবো।
ওসানির কথায় হাতে যেন চাঁদ ধরা পড়ে নন্দলালের। সে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে,
-সত্যি যাবো? তোমার অসুবিধা হবে না তো? ওসানি হেসে বলে,
-না, মোটেও অসুবিধা হবে। তুমি যাও।
পরের সপ্তাহেই সবকিছু ব্যবসার ভার ওসানির ওপর দিয়ে নন্দলাল দেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়।

৬.

আদিত্য নারায়ণের বয়স এখন সাড়ে চার বছর। কিন্তু দেখতে মনে হয় ছয়/সাত বছর। বয়সের তুলনায় বেশ লম্বা হয়েছে ছেলেটা। শ্যামলা, লম্বা, ছিপছিপে গড়নের ছেলেটা হাতের কাছে যা পায় তা দিয়ে শুধু ছবি আঁকে। ওর জন্য ঠাকুরমা পাড়ার একটা ছেলেকে মাষ্টার রেখেছে। প্রতিদিন বিকেলে এসে ছেলেটা ওকে পড়ালেখা শেখায়। এরই মধ্যে স্বরবর্ণ-ব্যঞ্জনবর্ণ শিখে ফেলেছে। মনিবালা এবং তার শাশুড়ি এক মুহুর্তের জন্য আদিত্যকে চোখের আড়াল করেন না। সেদিন বিকেলে আদিত্য দাওয়ায় বসে সাদা কাগজে ছবি আঁকছিল। ঠিক এসময়েই বাড়ির উঠোনে পা রাখে নন্দলাল। আদিত্যকে দেখে সে চমকে দাঁড়ায়। লম্বায় বাবার মতো হলেও চেহারায় একদম মায়ের আদল। মা এবং মনিবালাকে আশেপাশে কোথাও দেখতে পায় না সে। আস্তে আস্তে আদিত্যের সামনে গিযে দাঁড়ায় নন্দলাল। অচেনা লোককে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুটা যেন ভড়কে যায় আদিত্য। পেছন ফিরে সে ‘মা’ ‘মা’ বলে ডাকতে থাকে। ছেলে চিৎকার শুনে ভেতর থেকে ছুটে আসে মনিবালা। এসেই থমকে যায় সে। এক পলকেই চিনে ফেলে নন্দলালকে। মাথায় ঘোমটা টেনে দিয়ে বলে, অনে? অনে হঁত্তে আইশশুন্ যে?
নন্দলাল হাতের কাঁধের ব্যাগগুলো দাওয়ার ওপর নামিয়ে রেখে ছেলের পাশেই বসে পড়ে। তারপর ছেলের দিকে দু’হাত বাড়িয়ে মনিবালার উদ্দেশ্যে বলে,
-এহন আইলামে যে! তোঁয়ার ফোয়ারে হ আঁই হন? ইতারে আঁর কোলত আইশতা হ।
মনিবালা নন্দলালকে দেখে এতটাই অবাক এবং খুশি হয়েছে, সে এ মুহুর্তে কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। তার শাশুড়ি ঘরে নেই। তিনি গেছেন পাড়া বেড়াতে। ছেলেকে টেনে বাবার কোলে দিয়ে বলে,
-অ আদিত্য, ইবা হন চিনশ না? ইবা তোর বাপ।
আদিত্য বাবা শব্দটি অনেকবার মা-ঠাকুরমার মুখে শুনেছে। কিন্তু ‘বাবা’ দেখতে কেমন হয় সে তা জানতো না। আজ লম্বা সুঠামদেহী এই লোকটাকে বাবা বলাতে সে হা করে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে। নন্দলাল ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে। সূর্য আর আদিত্য ছয় মাসের বড় ছোট। অথচ দুজনের ভাগ্য সম্পূর্ণ বিপরীত। একজন সারাক্ষণ বাবার কোলে পিঠে মানুষ হচ্ছে, আরেকজন জন্মের পর থেকে বাবাকে দেখতেই পায়নি। নন্দলাল ছেলেকে কোলের ওপর বসিয়ে ব্যাগ থেকে খেলনা বের করে তার হাতে দেয়। খেলনা পেয়ে আদিত্যের চোখ চক চক করে ওঠে। সে সব খেলনাকে বুকের সাথে জড়িয়ে নেয়। ঠিক এ সময়েই পাড়া বেড়িয়ে বাড়িতে ঢোকেন নন্দলালের মা। ছেলেকে দেখে তিনি চিৎকার দিয়ে ওঠেন। বলেন,
– অ বুক, অ নন্দ, তুই হঁত্তে আইশ্শুশ্ যে? আঁরে তো কেউ ইক্ষিনি হবরও ন দে।
নন্দলাল মাকে প্রণাম করে। মা ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখে কিছুক্ষণ। দুজনের চোখেই বাঁধভাঙ্গা অশ্রু আজ।
এবার নন্দলাল বাড়িতে আসার পর থেকে বাড়িতে যেন উৎসব লেগে রয়েছে। সারাদিন মানুষে গমগম করে বাড়িটা। এরই মধ্যে নন্দলাল আরও কিছু জমি কিনে নিয়েছে। গ্রামে এখন সবচেয়ে ভূসম্পত্তি নন্দলালের। আদিত্য সারাদিন বাবার সাথেই থাকে। বাবাও ছেলেকে একমুহুর্তের জন্য চোখের আড়াল করে না। এতবছর পর স্বামীকে কাছে পেয়ে মনিবালার সমস্ত অভিমান যেন গলে জল হয়ে গেছে। নন্দলাল আসার পর থেকেই খেয়াল করেছে তার ছেলেটা আঁকতে খুব ভালোবাসে। সারাঘরে তার আঁকা ছবি মনিবালা আঠা দিয়ে লাগিয়ে রেখেছে। লেখাপড়াতে ও ছেলেটা ভালো হবে বলে মনে হচ্ছে। এরই মধ্যে স্বরবর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণ, অইঈউ, ১, ২, ১, ২ সব শিখে ফেলেছে।
মা, মনিবালা, আদিত্যকে নিয়ে দিনগুলো এত ভালোই কাটছিলো যে, নন্দলালের এবার আর রেঙ্গুন ফিরে যেতে মন টানছিল না। ওসানি আর সূর্যের জন্য মনের ভেতর একটা আকুলতা টের পায় ঠিকই, তবে মনিবালা আর আদিত্যের আকর্ষণ যেন তার চেয়ে কিছুটা বেশি। নন্দলাল সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। একদিকে তার বিশাল ব্যবসা, স্ত্রীপুত্র নিয়ে ছিমছাম সংসার, অন্যদিকে গ্রামে তার বিপুল বিত্ত-বৈভব, মা-স্ত্রী-পুত্র, আত্মীয়, পড়শি সব মিলিয়ে বর্ণাঢ্য জীবন। কোনটা বেছে নেবে তা সে স্থির করতে পারে না। তাই মাঝে মাঝে সে আনমনা হয়ে পড়ে। এই আনমনা ভাবটা সবার আগে চোখে পড়ে মনিবালার। এক রাতে ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে স্বামীর মুখোমুখি বসে সে। তারপর জানতে চায়-
-আইচ্ছা, অনরে একখান হতা হইয়ুম না?
নন্দলাল হেসে বলে,
– হ না।
– অনে হারাদিন কী চিন্তা হরন যে? আত্তে লার যে অনে হনো ঝামেলায় ফইরগুন।
নন্দলাল মনে মনে চমকে ওঠে। ওসানিও ঠিক এভাবে নন্দলালের মন পড়ে ফেলেছিল। তাহলে কি ঘরের বউদের মা দুর্গার মতো একটা তৃতীয় নয়ন থাকে? যে নয়ন দিয়ে ওরা মন দেখতে পায়! নন্দলাল একটু নড়ে চড়ে বসে। তারপর ঘুমন্ত ছেলের পিঠে হাত বুলাাতে বুলাতে বলে,
-আসলে আঁত্তে আর রেঙ্গুন যাইতু ইচ্ছা ন অর। কিন্তু হেডে আঁর বড় ব্যবসা। আঁই ন গেইলি বেগিগন ছাড়খাড় অই যাইবো।
মনিবালা বলে,
-অনে এক কাজ হরন। এবার যাইয়ারে ব্যবসা গুটায় ফেলন। সামনের বার এক্কেবারে চলি আইশশুন। প্রস্তাবটা ভালোই লাগে নন্দলালের। মনি ঠিকই বলেছে। কিন্তু ও যদি ব্যবসা গুটিয়ে এখানে চলে আসে তাহলে ওসানি এবং সূর্যের কী হবে? ও তো ওসানিকে কথা দিয়েছিল সারা জীবন ওসানির সাথেই থাকবে। ওসানির ব্যবসার আয় দিয়েই তো সে গ্রামের এত জমি কিনলো। এখন যদি সব ফেলে সে দেশেই চলে আসে তবে তো ওসানি আর সূর্যের সাথে বেঈমানি করা হলো। আবার মনি আর আদিত্যকে সারাজীবনের জন্য একা করে দিয়ে সে যদি রেঙ্গুন থেকেই যায়, তাহলে তো এদের প্রতি অবিচার করা হলো। সে বুঝে উঠতে পারে না কী করবে। থাক এসব ভেবে রাতের ঘুমটা নষ্ট করার দরকার নেই। বরং রাতটাকে উপভোগ করাই শ্রেয়। এই ভেবে সে হারিকেনটা নিভিয়ে দেয়। তারপর মনিবালাকে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে বলে,
– বাদ দেও ইয়িন। যেঁত্তের চিন্তা হেঁত্তে হইরগুম।
তারপর দুজন নরনারী পরস্পরের মাঝে মিশে যায়।

*************************