ওরা কেউ ফেরেনি
বিচিত্রা সেন
কিস্তি-দুই
৩.
নন্দলাল যখন গ্রামের বাড়িতে এসে পৌঁছালো তখন চারপাশ অন্ধকার করে সন্ধ্যা নেমে গেছে। ঘরে ঘরে হারিকেন কিংবা কুপির আলো জ্বলছে। নন্দলালের মা মাটির দোতলা ঘরটিতে একলাই থাকেন। একমাত্র ছেলে দেশান্তরী হওয়ায় তার এখন সময় কাটেই না। সময় কাটাবার জন্য তিনি নকশীকাঁথা বোনেন। আজও তিনি কুপির আলোয় নকশীকাঁথাটি নিয়ে বসেছেন। বাতাসে কুপির আলো বার বার নড়ে ওঠায় তিনি ভালোমতো পেন্সিলে আঁকা কাজটা দেখতে পাচ্ছিলেন না। হারিকেনের চিমনিটি পরিষ্কার করা হয়নি। এখন হারিকেন জ্বালাতে গেলে চিমনিটি আবার পরিষ্কার করতে হবে। কী করবেন তিনি বুঝে উঠতে পারছেন না। ঠিক এমন সময় উঠোন থেকে কে যেন ডেকে উঠলো, ‘মা’। নন্দলালের মায়ের সারা শরীর একবার কেঁপে ওঠে। নন্দলালের মতো করে কে ডাকে তাকে? গাঁও গেরামে সবাই জানে এক ধরনের ভুত আছে, যারা আপনজনের মতো করে ডাক দিয়ে ঘর থেকে মানুষ বের করে গলা টিপে মারে। কথাটা মনে হতেই গাটা আবার কেঁপে ওঠে নন্দলালের মায়ের। ‘মা’ ডাকটা এবার উঠোন পেরিয়ে ঘরের দরজায় ঢুকে পড়ে। মা অবাক হয়ে দেখের ভুতটা ঠিক নন্দলালের চেহারা নিয়েই তাঁর ঘরে ঢুকে পড়েছে। নন্দলাল হাত এবং কাঁধ থেকে ব্যাগগুলো নামিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে। বলে,
-অ.মা, আরে ন চিনর? আঁই তোঁয়ার নন্দলাল।
নন্দলালের মা ফ্যালফ্যাল করে তােিকয় থাকেন ছেলের দিকে। সত্যিই তাঁর ছেলে ফিরে এসেছে? তিনি সব ভুল দেখছেন না তো? নন্দলাল হো হো করে হাসে। হাসি শুনে মা বুঝতে পারেন সত্যিই তাঁর যাদু ফিরে এসেছে। ছেলেকে বুকে জড়িয়ে কতক্ষণ কাঁদেন তিনি। তারপর ছেলে একের পর এক ব্যাগ খুলে দেখায় মায়ের জন্য কী কী এনেছে সে। সারাটা রাত মায়ে ছেলে আর ঘুমায় না। কত কথা বলে নন্দলাল, কিন্তু ভুল করে একবারও বলে না যে সে বিয়ে করেছে। পরদিন থেকে নন্দলাল খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সে এবার দেশে এসেছে মাকে সব গুছিয়ে দিতে। তার অবর্তমভনে যেন মায়ের কোনো কষ্ট না হয়। কয়েকদিন গ্রামে ঘুরে সে বেশ কিছু জমি কিনে ফেলে। গ্রামের লোকেরা প্রতিদিন নন্দলালের বাড়িতে ভিড় জমায়। দুই-তিন ঘন্টা এক নাগাড়ে গল্পগুজব চলে। মাকে সাহায্য করার জন্য পাশের বাড়ির দুজন দরিদ্র মহিলাকে রেখে দিয়েছে সে। তাই গ্রামের লোকেরা আসলে চা-খই-মুড়ি চলতেই থাকে। গ্রামের লোকেরা এখন নন্দলালকে খুব সমীহ করে। কারণ তারা বুঝে গিয়েছে নন্দলাল এখন এ গ্রামের সবচেয়ে বড় পয়সাওয়ালা।
এদিকে নন্দলালের মা হন্য হয়ে মেয়ে খোঁজেন। শেষ পর্যন্ত চার মাইল দূরে পশ্চিমের এক গ্রামে মেয়ে পছন্দ হয়। মেয়ের বয়স ১৩ বছর। হালকা পাতলা গড়নের মেয়েটা দেখতে ভারী মিষ্টি। মেয়ের বাবার তেমন অর্থসামর্থ্য নেই, কিন্তু উঁচু বংশ। নন্দলালকে না জানিয়েই তিনি পাকা কথা দিয়ে দেন। সেদিন দুপুরে নন্দলাল খেতে বসলে মা প্রসঙ্গ তোলেন। বলেন,
– তোর বিয়া ঠিক করি ফেলাইলাম।
কথা শুনে বিষম ওঠে নন্দলালের। শ্বাসনালিতে ঢুকে পড়ে ভাত। কাশতে কাশতে বমি হওয়ার উপক্রম হয় তার । মা জলের গ্লাস এগিয়ে দেন। পিঠে হাত বুলান। একটু ধাতস্থ হয়ে নন্দলাল বলে,
-আঁই এহন বিয়া টিয়া হরিত ফাইরতাম ন। আঁত্তে হয়েকদিনের মধ্যে রেঙ্গুন যন ফরিবু।
কিন্তু নন্দলালের আপত্তি মা শুনবে কেন? ছোটবেলা থেকে বাপছাড়া ছেলেকে তিনি একা মানুষ করেছেন। সেই ছেলে এখন বড় হয়ে তাঁকে না মানলে হবে? তিনি মানিয়েই ছাড়বেন। নন্দলালের মা গোঁ ধরে বসেন। নন্দলাল যদি বিয়েতে রাজি না হয় তবে তিনি আর অন্ন স্পর্শ করবেন না। নন্দলাল মাকে অনেক বোঝায়, কিন্তু কিছুতেই বলতে পারে না রেঙ্গুনে তার বউ আছে। মা কিন্তু সত্যিই খাওয়া বন্ধ করে দেন। নন্দলাল মাথা কুটেও মাকে খাওয়াতে পারে না। প্রতিবেশীরা এসে নন্দলালকে বোঝায়। স্বপ্নার বাপ এসে বলে,
-বাজি, তোঁয়ার মার হতাত রাজি অই য। তুঁই আবার রেঙ্গুন গেলিগুই, তোঁয়ার বউ ফোয়া লইয়ারে তোঁয়ার মা থাকিবু।
শেষ পর্যন্ত মায়ের জেদের কাছে নন্দলালকে হার মানতে হয়। তেরো বছরের কিশোরী মনিবালা বউ হয়ে আসে নন্দলালের ঘরে। শুভদৃষ্টির সময় মনিবালার চোখে তাকিয়ে নন্দলাল ওসানিকে দেখে। অপরাধবোধে চোখ নিচু করে ফেলে সে। মনে মনে ক্ষমা চায় ওসানির কাছে। ছেলের বউকে কয়েকদিনেই খুব আপন করে নেয় নন্দলালের মা। নন্দলাল ছিল তাঁর একমাত্র যক্ষের ধন। মনিবালাকে পেয়ে তিনি যেন একটা মেয়ে পান। মনিবালাও সারাদিন শাশুড়ির সাথে সাথে থাকে। রাত হলে নন্দলালের ঘরে যায় সে। প্রথম প্রথম লোকটাকে তার খুব লজ্জা লাগতো। এখন আর লজ্জা লাগে না। লোকটা তাকে খুব আদর করে। সোহাগে আদরে ভরিয়ে দেয় সারারাত।
নন্দলাল নিজের সাথে কয়েকদিন যুদ্ধ করে নিজের কর্তব্য স্থির করে ফেলেছে। সে বুঝে গেছে তার মায়ের দরকার মানুষের সঙ্গ। একটা নাতি পেলে মায়ের আর কিছু লাগবে না। রেঙ্গুন যাওয়ার আগে সুসংবাদটা সে মাকে দিয়ে যেতে চায়। মনিবালার দিকে তাকালে তার মায়া হয়। মেয়েটি জানেই না তার সপত্নী রয়েছে। ওদিকে ওসানি কেমন আছে কে জানে। অবশ্য ওসানি সাহসী মেয়ে। সে একা চলতে জানে। একসময় একা চুনার ফ্যাক্টরি সামলিয়েছে। তবুও তার কাছে ফিরে যেতে নন্দলাল প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তাছাড়া জীবনে স্বচ্ছলতার যে স্বাদ সে ওসানির মাধ্যমে পেয়েছে তা সে হেলায় হারাতে পারবে না। মনিবালা হয়তো স্বামীর সুখ পাবে না। তবে তাকে সে স্বচ্ছল একটা জীবন দেবে।
এভাবে প্রায় ছয় মাস কেটে যায়। নন্দলালের আশা বাস্তবের পথে। মনিবালা মা হতে চলেছে। এবার তাকে ফিরতে হবে রেঙ্গুনে। হাতের টাকা পয়সা ও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। যদিও এক দোনের মতো জমি কিনে নিয়েছে সে নিজের নামে। ঘরে গাভী-বলদ-ছাগল সব মিলিয়ে সে এখন সম্পন্ন গৃহস্থ। গ্রামের সবচেয়ে বিত্তশালী। এ অবস্থাতেই তাকে ফিরে যেতে হবে।
একরাতে খেতে বসে মায়ের কাছে নন্দলাল প্রস্তাব রাখে। বলে,
-অ মা, আঁই সামনের সপ্তাত রেঙ্গুন যাইয়ুম গুই।
মা এবার আপত্তি করে না। কারণ সংসারের এই জৌলুস দরে রাখতে চাইলে ছেলেকে তো বিদেশ পাঠাতেই হবে। তাই তিনি কোনোরূপ আপত্তি না জানিয়ে বলেন,
-ঠিক আছে বাজি, বছরে বছরে আইয়েরা আরাঁরে চাই যাস।
মনিবালার চোখ ছল ছল করে ওঠে। তবুও যেতে তো দিতেই হবে। নাহলে সংসারে টাকা আসবে কোথেকে? রাতে শুয়ে স্বামীর গলা জড়িয়ে ধরে সে বলে,
-অনে সামনের বছর আবার আইবানত? অনর ফোয়ারে চাইতা ন আইবাক?
নন্দলাল মনিবালাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে,
-আইশশুম, আইশশুম। তোঁয়ারারে ফেলাই আঁই হেডে থাইত পাইরগুম না?
মনিবালাকে সে কথাটা বলে ঠিকই, কিন্তু চোখের সামনে ভেসে ওঠে ওসানির মুখ। কেমন এক অপরাধবোধে নন্দলাল নিস্তেজ হয়ে পড়ে। পরের সপ্তাহে নন্দলাল যাত্রা শুরু করে রেঙ্গুনের উদ্দেশ্যে। তাকে নৌকা পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয় গ্রামের ছেলেপুলেবুড়োর লম্বা এক মিছিল।
৪.
নিজ দেশে ছয়সাত মাস কাটিয়ে রেঙ্গুনে ফিরে এসেছে নন্দলাল। এসেই পেয়েছে একটা সুখবর। ওসানি আট মাসের অন্ত:স্বত্তা। নন্দলাল কোনো ঠিকানা দিযে যায়নি বলে ওসানি খবরটা তাকে এতদিন জানাতে পারেনি। অন্তঃসত্ত্বা হওয়াতে ওসানির রূপ আরও বেড়ে গেছে। হলুদ গায়ের রঙের মাঝারি গড়নের ওসানি যখন থামি পরে এঘর থেকে ও ঘরে যায় দেখতে তাকে ঠিক পুতুলের মতো লাগে। ওসানির মায়ের কাজ খুব বেড়ে গেছে। পঙ্গু স্বামীর সাথে সাথে তাঁকে এখন মেয়ের যত্নও নিতে হয়। নন্দলাল এসেই ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছে। ওসানির দিকে তাকালেই তার মনে পড়ে যায় হালকা পাতলা গড়নের শ্যামবর্ণের এক কিশোরীকে। মায়াভরা মুখখানি নিয়ে যে যেন করুণ চোখে নন্দলালের দিকে তাকিয়ে থাকে। নন্দলাল পড়েছে এক নিদারুণ সংকটে। বুকের ভেতর চাপ চাপ ব্যথা করে তার। একবার ইচ্ছে করে রেঙ্গুন শহরের পাটতাড়ি গুটিয়ে সোজা চলে যাবে নিজের দেশে। সেখানে জমি জিরাত চাষ করিয়ে বেশ ভালো মতোই চলতে পারবে সে। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবে তার স্বপ্ন ছিল বড় ব্যবসায়ী হওয়ার। ওসানি তাকে সে সুযোগ করে দিয়েছে। ওসানিকে সে কথা দিয়েছিল দেশের সাথে সব সর্ম্পক চুকিয়ে এখানেই থাকবে এখন এত বড় বেঈমানিটা সে করতে পারবে না। তবে হৃদয়ের একপাশে ওসানি তার অন্যপাশে মনিবালাকে রেখে তার শ্বাস ফেলতেও বড্ড কষ্ট হয়।
নন্দলাল রেঙ্গুন আসার দেড় মাস পর ওসানির একটা ছেলে হয়। ঠিক যেন ওসানির মুখটা বসিয়ে রেখেছে। ছেলেকে কোলে নিলে যে এমন লাগে নন্দলাল এর আগে বুঝতে পারেনি। নিজেকে কেমন পরিপূর্ণ লাগে তার। ওসানির মা নবজাতককে নিয়ে নানারকম আচার পালন করেন। ঘরের চারপাশে ঝোপকাঁটা দিয়ে রাখেন যেন শক্রর নজর নবজাতকের ওপর না পড়ে। ঘরের মধ্যে একটা হারিকেন জ্বালিয়ে তার পাশে একটা তেলের প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখেন। ঘরে কেউ ঢুকলে প্রথম হারিকেন ছুঁতে পারে। তেলের প্রদীপে প্রতিদিন তেল ঢালতে হয় যেন বাতিটা নিভে না যায়। এতে করে নাকি নবজাতকের জীবন আলোকিত হবে। অনেক তর্কবিতর্কের পর ছেলের নাম রাখা হয় সূর্য। নন্দলাল ছেলের মায়ায় এমনভাবে সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে যে ভুলেই যায় দেশেও রয়েছে তার আরেক সংসার। সেখানে মনিবালারও সন্তান জন্মদানের কথা ছিল। নন্দলাল চলে যাওয়ার পর থেকে মনিবালার আর কিছুই ভালো লাগে না। রাতে তো ঘুমই আসে না। একা থাকতে ভয় পায় সে। তাই শাশুড়ির সাথে শোয়। ঘুম না আসলেও শাশুড়ি কিছু মনে করবে ভেবে ঘুমের ভান করে পড়েই থাকে। নন্দলাল যাওয়ার আগে চিঠি দেবে কিনা জিজ্ঞেস করেছিল। মনিবালা নিষেধ করেছে। সে তো লেখাপড়া জানে না। চিঠি দিলে সে চিঠি আবার অন্য কাউকে দিয়ে পড়াতে হবে। যে পড়বে, সে তো সব জেনে যাবে কী লিখেছে। কী লজ্জার কথা! না, না, মনিবালা এমনটা চায় না। তার চেয়ে বরং নন্দলালকে ভেবে ভেবেই তার সারাটা দিন কাটুক।
শাশুড়ি মনিবালার খুব যত্ন করে। শাশুড়ি নিজে হিন্দু বিধবা হওয়াতে নিরামিষ খান। কিন্তু নাতি যেন ঠিকমতো পুষ্টি পায় এই ভেবে মনিবালাকে তিনি প্রতিদিন মাছ, ডিম, মাংস এসব খেতে দেন। মনিবালা গরিবের মেয়ে। তাই বাবার বাড়ি থেকে তেমন কেউ আসে না এ বাড়িতে। মনিবালাও বাবার বাড়ি যেতে চায় না। শাশুড়ির সাথে এ সুন্দর বাড়িটাতে থাকতে তার বেশি ভালো লাগে। তাছাড়া তাকে কাজকর্মও করতে হয় না। পাশের বাড়ির দরিদ্র ঘরের দুই মহিলা সারাদিন এ বাড়িতে থেকে কাজকর্ম সব করে দেয়।
এভাবে দিন যায়, মাসও গড়িয়ে চলে। বৈশাখের এক দুপুরে মনিবালার ব্যথা ওঠে। দাইকে খবর দেওয়া হয়। বিকেলের দিকে মনিবালার একটা ছেলে হয়। শাশুড়ি খুব খুশি। তাঁর বংশে বাতি দেবার লোক চলে এসেছে। মনে মনে ভাবেন, নন্দলালের বাবাই হয়তো নন্দলালের ঘরে পুত্র হিসেবে ফিরে এসেচে। ছয়দিনের দিন পাড়ার সবাইকে ডেকে খই, মুড়ি, বাতাসা খাইয়ে ছেলের নাম রাখা হয়। একশ আটটা নামের মধ্যে বাছাই করে দুটো নাম ছেলের জন্য ঠিক করা হয়। মনিবালারও পছন্দ হয় নাম দুটো। মনে মনে সে ছেলের নাম আওড়ায়। বেশ সুন্দর তার ছেলের নাম, আদিত্য নারায়ণ চৌধুরী। সে স্বপ্ন দেখে তার ছেলে একদিন অনেক বড় হবে, লেখাপড়া শিখবে। তবে বাবার মতো এস বার্মামুল্লুক পড়ে থাকবে না। সে দেশেই থাকবে। মাকে ছেড়ে সে কোথাও যাবে না।
*****************************