এলিজা খাতুন
বিধ্বস্ত ভিতে দাঁড়িয়ে
এভাবে চললে সমস্ত সংসার অরণ্যে যায়
রক্তিম শিমুলেরা বিবর্ণ হয় ক্রমশ
এভাবে চলতে চলতে
চিরচেনা তুমি ভালোবাসার মতো দুর্বোধ্য হও
প্রহর ভেঙ্গে পড়ে একগোছা নিষ্পাপ ফুলে
এভাবে চলতে চলতে
রোদপ্রখর প্রশস্ত দিগন্ত ছোট হয়ে আসে
শিশির-মায়া ঘাসের বুকে রেখে যায় তীক্ষ্ম ফাঁকি
এভাবে চলতে থাকলে
মানুষ ভুলে যায়- ফুল দেবার মৌলিক অর্থ
চোখের কার্নিশে জমে ওঠে প্রতীক্ষার ধুলোবালি
নিস্প্রভ শোকের মতো, নির্জনতা যাপনের মতো
শব্দহীন হাঁটা ! যন্ত্রণা তৃষ্ণায় অধীর হৃদয়-
অনর্থক বাঁচিয়ে মুক্তির কাঙ্খায়-
তবু মানুষ “যুদ্ধ চাই না“–এই মর্মে
বিক্ষোভ তোলে জীবনের বিধ্বস্ত ভিতে
গ্রেফতার
চোখের সম্মুখে নিয়ন্ত্রিত ক্যামেরা
দৃষ্টিকে শাসায় কতিপয় দৃষ্টিভঙ্গি
নৈরাজ্যের করাতকলে বোধ ও বোধি
হাতের তালু আঙুল সমেত হাতকড়া
অথচ এইসব চোখ হাত ও স্নায়ু
পৃথিবীর হাত ধরে হাঁটিয়ে নিতে পারতো
কেননা এখন পৃথিবীর-
চোখে ছানি, মুখে মুখোশ, হাতে পক্ষাঘাত
সক্ষম আত্মা থেকে খসে যাওয়া দেহ
অপশক্তির নিয়ন্ত্রণে
আত্মার গ্রেফতার হয়না কখনও
স্নায়ুতে যায় না কোনো শেকল পরানো
আবারও শরীরকে মেরামত করে, অথবা
অন্য শরীরে ভর করে আত্মারা উঠে দাঁড়ালে ;
এমনও তো হতে পারে যে-
ভাঙার নির্দেশনা পেয়েও গড়তে লেগে যাবে !
দোদুল্যমান অগ্রসর
এই যে পথ অবিরাম হা হয়ে থাকছে উপরের দিকে
চিলের নখের নিচে ঝুলে আছে আস্থার দালানকোঠা
আর আমাদের প্রজন্মরা সর্পিল গলিপথে দাঁড়িয়ে
ঘোর অন্ধকারকে রঙিন দেখছে,
তাদের পায়ের নিচ দিয়ে সেঁধিয়ে যাচ্ছে
অসুস্থ পথের দিক নির্দেশক এ্যারোচিহ্ন
ধুলোভর্তি চিরন্তন মেঠোপথে তারা
নিজ অবয়বের ছায়া দেখার ফুরসত পায় না
মূলত তারা
বিকাশযোগ্য মনস্তত্বের অভ্যর্থনা মাড়িয়ে যাচ্ছে
ধ্বংসস্তূপে যোগ হয়ে যেতে
অথচ বোধের বিস্তৃত সৈকতে ‘পথ’ এবং ‘বিপথ’
দুটো পথই আছে মহাকালের আঁকিবুকি সমেত
এখন সম্মুখে অবশিষ্ট পথ
ঘোরতর অন্ধকার তান্ডবে ভেবে দ্যাখো
পা’জোড়া কোন্ পথে কতদূর হাঁটবে !
বাজেট
অবশেষে পেশ করলাম নিজেকে
স্বাস্থ্যবান আঙ্গুলের ইশারায়
আমার শরীর জুড়ে লেখা হয়েছে
তোমাদের জন্য বরাদ্দ ভাতের দরদাম
ওরা আগুন ভরেছে আমার বুকপকেটে
শরীরময় ঝলসানো দাগ ! তা নিয়ে
সংসদে উঠি দ্রুত; আত্মপ্রকাশের প্রয়াসে
অনুমোদিত হই
অবরুদ্ধ হই
গ্রন্থিত হই
লুট হই ওদের কলমের টানে
অতঃপর দগ্ধ আমাকে ছুঁড়ে দেয়
তোমাদের ভয়ানক দীর্ঘশ্বাস সৃষ্টিতে
তোমাদের কোটি হাতে তুলে নাও
এই আগুনগোঁজা শরীর ;
স্যাঁতসেঁতে হেঁসেলে
বর্ষা-বিপন্ন উঠোনে
সানকির ভেজা উদরে
পৌঁছে দাও আমাকে
দাউ দাউ জ্বলতে দাও তোমাদের বুকের উনুনে
শুকাতে দাও, সারাতে দাও- অযুত ভেজা ক্ষত
সন্তপ্ত
যখন বৃক্ষদঙ্গল কেটেছেঁটে নির্মাণ হয় সুবিধাবাদী-সুড়ঙ্গ,
আর মৃত্যু-সমুদ্রে ছুঁড়ে দিতে থাকে আমাদের জীবন্ত
যতকিছু ; তখন নির্ঝরিণীর সাথে মিশেছিল
পাথরের নিঃশব্দ আর্তনাদ
চারপাশে বাতাসে নিরুপায়ের ঘনগন্ধ
যখন ধান-ঐশ্বর্যে আচ্ছাদিত সোনার মাঠ থেকে
কানে আসে শেয়ালের হল্লা, যখন ঝড়-বাদলে-
সবুজের গায়ে আটকে যায় ছিন্নভিন্ন দেহাস্থি,
আর সম্মানিত মাঠ থেকে বিদায় নেয় জারি সারি ;
তখন রক্তপ্রবাহে নিদারুণ যন্ত্রণার ঘোরাঘুরি
সেই থেকে শোক নয়, বিলাপ নয়…
বুকের কোণে জড় হওয়া বহুদিনের বরফ-অশ্রুজল
ক্রোধ অতিক্রম করে করে আমাদের বিচূর্ণ হৃদয় থেকে
তীব্রদগ্ধ স্রোত এসে বোধের ভেতর তপ্ত লাভা হয়ে আছে
আত্মপ্রকাশের সামনে
আমাকে বার বার দাঁড় করাও ফোকাসে
আমার আকাশ কাঙাল করে সমস্ত বিজলী যেন
ঐ ক্যামেরায় বন্দি করা ! নগ্ন চালার নিচে-
অর্ধেক ডুবে আছি জলকাদায়
অর্ধেক ডুবে আছি দারিদ্র্যবিমোচন-প্রহসনে
‘আশ্রয়কেন্দ্র’র স্তম্ভের নিচে ক্রমশ বাড়ছে
লুটের গোপন শেকড়!
ঘর ভাঙনে ছিন্ন শিশু, বেঁচেবর্তে থাকা বৃদ্ধ-বৃদ্ধা
গৃহপালিত পশু, ব্যাঙ-শামুক সহ গুটি গুটি-
জমে উঠি সড়কের পাশে পিঁপড়ে-সারির মতো।
এ সুবাদে আমাদের সারিভুক্ত হয় কিছু সারমেয়
ক্যামেরা তাক করে পুনঃ পুনঃ আমাকে তুলে নিচ্ছো
অসাধারণ সব ডকুমেন্টারী ও স্থিরচিত্রে
আমাদের সামান্য খাবারের জন্য
বৃহৎ অংকের বাজেট-বরাদ্দ শুরু হয়ে গেছে
ঝড়ের পূর্বাভাস পাবার সাথে সাথে, আর
হৃষ্টপুষ্ট গ্রাসের কথা খবর-শিরোনাম বহির্ভূত রেখে
আমাকে বার বার দাঁড় করাও আত্মপ্রকাশের সামনে
ত্রাণশিবিরে নয়, তোমাদের পরিত্রাণ শিবিরে !
মুহূর্তে বেড়িবাঁধ ভেঙে আসা জলের তান্ডবে
আমরা কে কখন তলিয়ে যাই…
ক্যামেরার নিরলস ক্লোজশর্ট পিছু ছাড়ে না কোনরকম !
=================================