এক আকাশ হাইকু: জাপানি থেকে অনুবাদ চিন্ময় গুহ
পারমিতা ভৌমিক
(১)
একটি অসাধারণ অনুবাদ। মাকড়সা। ঊর্ণবাভ। ঊর্ণা বয়ন to wave) করে যে।লোকনিরুক্তিতে তার হয়েছে ঊর্ণনাভ। ঊর্ণা নাভিতে যার। ঊর্ণা কিন্তু নাভিতে থাকে না।
এই ঊর্ণবাভ জাল বোনে।নিজে থাকে কেন্দ্রে। একে তাই ব্রহ্মের প্রতীক ধরা হয়। সেই পরমের বিশ্বজোড়া ফাঁদে সৃষ্টি ধরা পড়ে। যখন সৃষ্ট জগতের দ্বিধা চলনে প্রাণী কষ্ট পায়, স্বয়ং স্রষ্টাও তখন কাঁদেন। কেননা ব্রহ্ম সত্য জগৎ ও সত্য। কাজেই ঐ দুঃখ পরমকেও স্পর্শ করে। তাই মাকড়সাও কাঁদে।
জেন সাধক বাশো, তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বা সাতোরি থেকে এ কান্না দেখেছেন —-
“মাকড়সা,
তুমি কাঁদছ?
না, হেমন্তের হাওয়া? “
—হেমন্তপ্রধান ভৌগোলিক নিসর্গের স্থানিক সত্যও বাশোকে স্পর্শ করেছে। পাতাঝরা হেমন্তের, প্রৌঢ় হেমন্তের কষ্ট তাই এখানে বাশোর ব্যাক্তিক অনুরণনে একটুকরো ছবি হয়ে ফুটেছে।
শ্রদ্ধা নেবেন অনুবাদক-চিন্ময় গুহ। এমন সহজ সুন্দর অনুবাদ অঙ্গুলিমেয়।
( ২)
প্রসঙ্গত বলি, আমি চিন্ময় গুহর “এক আকাশ হাইকু” পড়তে পড়তে চাঁদ পেয়েছি হাতে। সেই সব চাঁদ একত্রিত করে পরে যোগ করব এবং তারও পরে সেই সব হাইকুর আস্বাদন নেব।
এখন বাশো দিয়ে শুরু করছি।
” চাঁদটি দ্রুতবেগে ভেসে যায় শাখাগুলি এখনও ধরে আছে বৃষ্টির ফোঁটা “
(বাশো)
অনুবাদক যেখানে চিন্ময় গুহ, সেখানে সততই শ্রদ্ধায় নতজানু হতে হয়। তিনি যোগ্য নচিকেতা তাই- অগ্নিবিদ্যার অধিকারী আর সে অগ্নিতে স্বয়ং পুড়েছেন তিনি, পুড়েছে তাঁর পাণ্ডিত্যের অভিমান ও যাবতীয় অর্জনের শ্লাঘা। তা না হলে এমন হাইকু অনূদিত হতে পারত না।
স্বীকার করতেই হয় ‘হাইকু’তে পাঠকের নিবিড় অনুভবের একটা বিশেষ ভূমিকা আছে। চিন্ময় তাঁর অন্তর্মন দিয়ে আগে হাইকু কবিতিকাকে ভালোবেসেছেন, তারপরে পড়েছেন। সে এক অনন্যপাঠ।কেবল ঋদ্ধ পাঠক জানবেন। সেখানে, সেই পাঠে স্বয়ং চিন্ময় গুহও বাশোর পাঠক।হাইকু গুলো পড়ে মনে হল সেসবের ভাবের পিছনে রয়েছে চিন্তার সুস্থিরতা। সে সুস্থিরতা কতকটা প্রাচ্যযোগীর। সে যেন একটা নিরেট ভাবস্থৈর্য। প্রকাশ ভঙ্গিতে রয়েছে সুগভীর স্বচ্ছতা। সুভাষিতের মত।
হাইকু গুলো পড়তে পড়তে মনে হয়েছে প্রাণের ঊর্ধ্বাচারী আবেগ বাইরের দিকে ছুটে চলার অসহিষ্ণু প্রেরণাকে যেন হঠাৎই থমকে দিয়েছে। তার এক প্রগাঢ় আন্তর অনুভবের মিথস্ক্রিয়া ঢেলে দিয়েছে তাতে। অনুবাদ কতখানি সার্থক হলে তা পাঠকের মনে এমন দূরাগত ভাবব্যঞ্জনা এনে দিতে পারে???? হাইকুতে বিন্দুতে সিন্দু দর্শনের কথা চিন্ময় গুহই বলে দিয়েছেন কথামুখ অংশে। এইই জাপানের হাইকুতে ফলিত “বিশ্ববীক্ষণ”….. বিশ্ববীক্ষণেরই কোনো গোপন রহস্যকথা প্রকাশে প্রকাশে হয়ে ওঠে জাদুকরী। সেই জাদুরও একটা বিজ্ঞান আছে। সেটাই জেনদর্শন। ওখানেই আছে সংক্ষিপ্ত প্রকাশের মধ্যে “অপ্রকাশ” কিন্তু আরও বড় এক সত্যের অভিব্যঞ্জনা।
চিন্ময় তাঁর নিজস্ব নিবিড় অনুভব মিশিয়ে দিয়েছেন হাইকুতে । সেইসব অনুবাদগুলো আমরা তাঁর “এক আকাশ হাইকু” তে এখন পড়ছি। এখানে আমরা পাঠক। তবে বাশোর থেকে দূরতম। কিন্তু চিন্ময় থেকে কাছে।এই ব্রিজিং টাই হাইকুর পরিধি বাড়িয়ে চলেছে। অনেক ক্ষেত্রেই এমন হয়, হয়েছে। জানিনা অনুবাদক চিন্ময় গুহর ঐ নিবিড়তম অনুভব কতটা সংগুপ্ত রয়েছে আমাতে। সাধারণত হাইকুতে কবির চারপাশের জগৎ ও জীবনের অভিজ্ঞতার কথা ছবি হয়ে আঁকা আছে। প্রকৃতির সেখানে অনিবার্য আশ্রয়। মহৎ উপলব্ধি আসে মহাপ্রকৃতির সান্নিধ্য থেকে। রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্রেও তার আভাস আছে।
শুধু নিসর্গ নয় জীবপ্রকৃতিও তার আওতায় আছে। চর ও অচর নিয়ে তার স্থিতি। বস্তুত চিন্ময় গুহর মধ্যে যে সাবলাইম কেন্দ্রিত রয়েছে তা তাঁকে দিয়েছে সমাধিচেতনা। সেটি থেকে তিনি সর্বভেদী অন্তর্দৃষ্টি লাভ করেছেন এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের পরম একত্বের সচেতন সন্ধান আমাদের দিতে চেয়েছেন। হাইকু তারই
প্রত্যক্ষ ফল।
উপরে উদ্ধৃত বাশোর হাইকু টিতে রয়েছে দুটো মাত্র বাক্য।
১) চাঁদটি দ্রুতবেগে ভেসে যায়
২) শাখাগুলি এখনও ধরে আছে বৃষ্টির ফোঁটা
অসাধারণ অনুবাদ। জাপান চিত্রকরের আঁকা দুটো নিসর্গ পট। ছবি কি করে কথা হয়ে যায় আর কথা কি করে ছবি এঁকে দেয় এই হাইকু থেকেই ধারণা করা যাবে। যে সূক্ষ্ম তরঙ্গ বিজ্ঞানে এটি সম্ভব হয় তা আজ বিজ্ঞান স্বীকৃত।
চিন্ময়ের অনুবাদটি পড়ে বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়নি যে এর মর্মমূলে রয়েছে জেন-এর বিশুদ্ধ ‘বোধি’র অর্জন। প্রথম বাক্যে দ্রুত ভাসমান চাঁদ একটি কিরেজি। কাটিং। দ্বিতীয় বাক্যে তারই রেফারেন্স রয়েছে দিনাবসানের বৃক্ষশাখাতে বৃষ্টির ফোঁটার মধ্যে। এই যে বিস্তার, এক্সপ্যানশন তা কবির অর্জিত। অর্জিত এই বোধি এখানে আনন্ত্যের কথা বলছে। অবশ্য এর গুরুত্ব কিন্তু বোধের অর্জনেই মাত্র নয়, বরং সামগ্রিকভাবে অভিজ্ঞতার।
এখানে চিন্ময় বিস্ময়কর শব্দযোজনায় এনেছেন “প্রত্যক্ষ নির্দেশনা” বা অন্তর্জ্ঞানমূলক মূল জেন সত্যকে। মনে রেখেছেন বাশো মূলতঃ জেন সন্ন্যাসী কবি। শুধু চর নয়, অ-চরের মধ্যেও চিন্ময় দেখেছেন হাইকুতে প্রতিফলিত আছে প্রাত্যহিক সক্রিয়তা। ঐ চাঁদ চর বস্তু ও দ্রুতবেগে রোজই সে ভেসে যায় কোনো অনন্ত প্রবাহ ধারায়। ছবিটি অত্যন্ত স্পষ্ট ও চরাচরের সম্পর্ককে প্রকাশ করেছে। আমি জাপানি জানিনা কিছু এ অনুবাদ যেন আমার তীব্র ও সূক্ষ্মতম অংশকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। এখানেই অনুবাদের সাফল্য। একে কেউ যদি ট্রান্সক্রিয়েশন বলেন, আমার আপত্তি নেই তাতে কেননা আমিও রূপান্তরে বিশ্বাস করি। হাইকুর রূপান্তরের ওপরে নজর করলেই বোঝা যাবে সেটা কতখানি অমোঘ ছিল।
জেন তথা হাইকু কবিদের এই তাৎক্ষনিক অর্জনটুকুই ছবিতে ও ইঙ্গিতে ধরে রেখেছে হাইকু। এর আগে যে দ্রুতবেগে ভেসে যাওয়া চাঁদটির ছবি পেয়েছি তা তখন কেবল চাঁদই ছিল।
কিন্তু হাইকুটি বারবার যখন পড়ছিলাম ঐ-চাঁদটিই তখন অনন্তগতিতে চূড়ান্ত সূক্ষ্ম স্তরে মিশে গিয়ে একেবারে নেই হয়ে গেছে। পাঠ শেষ হলে নিমগ্ন পাঠক আমার মতোই দেখবেন ঐচাঁদ আবার ভেসে চলেছে দ্রুতবেগে আর সঙ্গে থাকছে আর একটি স্ট্যাটিক ইমেজ-―” শাখাগুলি যা এখনও ধরে আছে বৃষ্টির ফোঁটা”। এই ডায়নামিক ইমেজ সৃষ্টি ও তাকে স্ট্যাটিকের সঙ্গে অভেদ করে দেয়া এক ভীষণ উচ্চমানের সাধনার ছবি। পাঠকদের মনে হবেই যে এভাবেই চিন্ময় গুহর মরমী হাদয়ে ও সেখানে সঞ্চিত ঐতিহ্যগুলোতে এক প্রারব্ধ ও অধুনালব্ধ “বিশ্ববীক্ষা “র আবির্ভাব ঘটেছে আর তাকেই আমি ধ্যানই বলব। বস্তুত এই ধ্যানগহনতা ছাড়া আর যাই হোক জেন স্বজ্ঞা শাসিত হাইকুর অনুবাদ সম্ভব নয়।
বাশোর এই হাইকুটিতে এসেছে
১) প্রাকৃতিকতা (যেমন, সচরাচর হাইকু তে ঘটে)
২) স্বতঃস্ফূর্ততা (এটা টাও /তাও উৎস থেকে এসেছে)
বোধকরি হাইকু নিহিত চিরায়ত মরমী জ্ঞানের সঙ্গেই চিন্ময় একান্ত হতে পেরেছেন। লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে চিন্ময়ের প্রখর প্রজ্ঞা, যুক্তির সীমা ছাড়িয়ে এই জ্ঞান সরাসরি নেমে এসেছে তাঁর অন্তর্মনে।
এ যেন ঠিক জেন কথিত “সাতোরি”র মতো। এ হল কালক্ষেপ না করে মামগ্রিক অভিজ্ঞতা অর্জন।
বাশোর অন্যান্য হাইকুর মতো এখানেও রয়েছে উৎক্ষেপহীন একটা শমিত ভাব। এ যেন কবিতাই জেন , জেনই কবিতা।
এই কবিতাশিল্প নান্দনিক- পরিশীলনের পরমতাকে স্পর্শ করেছে। আলোচ্য অনুবাদেও দেখি একটা সাবলাইমের অধিষ্ঠানে সামুরাই-এর সৌকুমার্য ও শৌর্য দুয়ের প্রকাশ ঘটেছে অবলীল ভাবে। অন্তর্মন যখন আলোচ্য অনুবাদটি পড়তে পড়তে গুটিয়ে বিন্দুলীন হতে থাকে এখন একটা শূন্যতা মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। অথচ সে শূন্যে জগৎটাও ভেসে থাকে। বুদ্ধের শূন্য। চাঁদ দ্রুত ভেসে যায়- মহুর্তে চোখের বাইরে- যায়। বহিঃইন্দ্রিয় ব্যর্থ হয়। তখন খুলে যায় অন্তর ইন্দ্রিয়। ঐখানে ধরা দেয় প্রকৃতির চিরন্তন প্রবহমানতায় চাঁদের ভেসে যাওয়া যা শুরুর বিন্দুতেই ফিরবে আবার। ঐ বস্তু সত্যটাই স্পৃহনীয়।
এভাবেই ঐ শূন্যতার বোধ এসে দুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিল বুঝি চিন্ময় গুহর সামনে যার সঙ্গে ছিল থরে থরে সাজানো নির্জনতা, স্তব্ধতার অনুভব, স্থির কিছু দুঃখ, পিছুটান, হেমন্ত, হয়তোবা ধ্বংসের বৈনাশিক লয়বোধ, রহস্য এবং একটি “অজানা দরজা” যা একই সঙ্গে আবদ্ধ এবং উন্মুক্ত। নিঃশব্দ ছবি কিন্তু কত প্রাণময়। না হলে এত কথা ভাবাচ্ছে কেন? কোন তত্ত্ব অবতারণা নেই, আছে সংক্ষিপ্ত হাইকু দেহে কিছু “প্রত্যক্ষ প্রত্যয়”। কখনও কখনও এ্যাবসার্ড রচনার ঘোর লেগেছে মনে হয়।
বাশোর অনুবাদে চিন্ময় গুহ পাঠকদের জন্য বাশোর আরদ্ধ কাজটিই করেছেন তবে তিনি তাঁর সময়সীমায় দাঁড়িয়ে তা করছেন। বাশো থেকে চিন্ময় গুহ―এই (১৬৪৪ থেকে ২০২৪)…. এই বিস্তারের নামই জেন। এখানে যা বলা হল তারচেয়ে বেশী রইল না-বলা বাণী যার ঘন অন্ধকারে ” জেন বিশ্ববীক্ষণ”স্তব্ধ আকাশে তারার মত স্নিগ্ধ আলো দেয় স্থির এক স্থৈর্যে।
শেষমেশ বলি স্যার চিন্ময় গুহ,
■আপনি কিছু বলেন নি…..
■আমরাও কিছু শুনিনি……
■■আর এইই হাইকু।
ভেতার ভেতরে আপনি কেবল আঘাতে আঘাতে বেদনা জাগিয়ে তোলার জন্য জেন দের কথা গ্রহন করেছেন সেই সঙ্গে আমাদেরও চেতনাকে বেদনায় জাগিয়ে দিতে চেয়েছেন। আপনি আমাদের অধ্যাত্মশিক্ষক।টোকা মেরে নয়, আচমকা ধাক্কা দিয়েই খুলে দিতে চেয়েছেন আমাদের চেতনার বন্ধ দরজা। এজন্যই উন্মুক্ত করে দিয়েছেন তোরণহীন এক মহা তোরণের দরজা। এইই “সাতোরি'” লাভই আমাদের পাওনা।
তৃতীয় নয়ন খুলে দেবার অনন্য প্রচেষ্টা। অতিশীতে আগুন নিভে এলে ঘরের প্রিয় আসবাব তাতে নিক্ষেপ করে কেবল কবোষ্ণ বাঁচার পথ উন্মীলিত করেছেন আপনি।আমরা “সাতোরি” র পথনির্দেশ পেয়েছি।
পেয়েছি বোধির আভাস। প্রতিধ্বনি। এক অনুত্তর যোগ। যেন চিরপ্রশ্নের বেদীতে চিরনির্বাক হয়ে থাকার সাধনা। এইসব শিক্ষা আপনার হাইকু অনুবাদের ছত্রে ছত্রে রইল।
চাঁদ বিষয়ক হাইকু গুলো দিলাম। আলোচনা পরে হোক……
চাঁদ
( ১)
মধ্যরাত্রির চাঁদ
শীতলতার
একটি কঠিন রূপ?
(তেইশিৎশু)
(২)
চাঁদটি দ্রুতবেগে ভেসে যায়
শাখাগুলি এখনও ধরে আছে
বৃষ্টির ফোঁটা
(বাশো)
(৩)
জলের ভেতর চাঁদ
ডিগবাজি খেয়ে
ভেসে গেল।
(রিওতা)
(৪)
বিশ্বাস করা শক্ত ――
সে চাঁদ আজকে
কেবল একটিই ছিল।
(রিত্ততা)
(৫)
হাত ধোয়ার বেসিনে
চাঁদটিকে তুলে
ছড়িয়ে দেওয়া।
(রিউহো)
( ৬)
শীতের চাঁদ।
একটি পাথরও নেই-― কুকুরটির দিকে ছোড়ার মতো।
(তাইগি)
(৭)
কাক ভোরে ব্যাঙটি
মুখ থেকে উগড়ে দেয়
চাঁদ।
(শিকি)
(৮)
সন্ধ্যেবেলা চাঁদের আলোয়
শামুকটি
কোমর পর্যন্ত নগ্ন।
(ইসসা)
(৯)
শেয়ালেরা খেলা করছে,
নার্সিসাস ফুলের ভেতর
উজ্জ্বল জ্যোৎস্না রাত।
(বুসন)
(১০)
ঝাপসা চাঁদের নীচে
ডাল আর আকাশকে মুছে দিয়েছে
ব্যাংটি।
(বুসন)
(১১)
চাঁদের আলোয়
পুষ্পিত নাশপাতি গাছ,
মেয়েটি কার চিঠি পড়ছে?
(বুসন)
(১২)
পর্ণকুটিরের চারপাশে
কলাপাতা,
চাঁদের পানে তাকিয়ে।
(বাশো)
(১৩)
পুর্নিমার চাঁদ;
কাকতাড়ুয়াটি ঠায় দাঁড়িয়ে,
যেন কিছুই হয়নি।
(ইসসা)
(১৪)
ঝাপসা চাঁদ
মেয়েটিকে নদীর ওপারে
নিয়ে যায়।
(বুসন)
(১৫)
নদীর ওপর
জাল ছোড়ার শব্দ,
চাঁদের অস্পষ্ট রেখা।
(তাইশি)
(১৬)
যারা চাঁদ দেখছে,
মাঝে মাঝে
মেঘেরা তাদের বিশ্রাম দেয়।
(বাশো)
(১৭)
যতদূরেই যাই,
হেমন্তের দীপ্ত চাঁদ,
আরও দূরে, এক অজানা আকাশে।
(চিও-নি)
(১৮)
আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে,
চিত্ররেখার ডোরে বাঁধা
চাঁদ আর বরফ।
(কোয়ু-নি)
(১৯)
চোরটি
পেছনে ফেলে গিয়েছে
জানলার চাঁদ।
(রিওকান)
(২০)
শিশুরা আমায় বলতে পারো,
ওই টকটকে লাল রঙের চাঁদটা
কার?
(ইসসা)
(২১)
দিগন্তে চাঁদ ডুবে গেছে,
এখন শুধু বাকি রইল
টেবিলের চারটি কোনা।
(বাশো)
(২২)
আজকের চাঁদ;
পৃথিবীতে একজনও আছে
সে কলম তুলে নেবে না?
(ওনিৎসুরা)
(২৩)
হেমন্তের পূর্ণ চাঁদ:
আমার ছায়া আমায় সঙ্গে করে নিয়ে যায়
আর ফিরে আসে।
(সোদো)
(৩)
চিন্ময় গুহর “এক আকাশ হাইকু”―র অনূদিত কবিতাগ্রন্থটি পড়তে পড়তে অজান্তেই মনে এল রবীন্দ্রনাথ এর কথা। হাইকু ও রবীন্দ্রনাথের অটোগ্রাফ অথবা রবিকবির অণুতমকবিতা কিছুটা যেন অদলবদল রূপে অণুতম কবিতার ছবি নিয়ে উঠে এল আমার কাছে। দেখতে ও বুঝতে গিয়ে দেখি ওগুলো একটু যেন ছাড়া ছাড়া, খটমট।
তবুও পরিচিত যেকোনো কাব্যরূপকে ছাড়িয়ে হাইকু হয়ে উঠেছে হাইভোল্টেজ কবিতা। জাপানী কবিতা আঙ্গিকের একটি বিশেষ নাম হাইকু। স্বাভাবিক ভাবেই বুঝি এ ধরনের কবিতার একটি বিশেষ নির্দিষ্ট আঙ্গিক আছে। হাইকু—মূলত এক টুকরো ছবি,… হালকা তুলির টানে আঁকা, কিন্তু ভারি মিষ্টিক। কখনও দুটি অসম্পৃক্ত ছবিও উঠে আসে হাইকুতে— মজাটা জমে ওঠে এই শূন্যটুকু ঘিরেই। এই মাঝের ফাঁকটুকুকেই ভরিয়ে নিতে হয় জমাট কিম্বা রহস্যময় (Mystic) কল্পনা দিয়ে। ঐ শূন্যতা প্রাচ্যের পজিটিভ নাথিংনেস। ময়ূরের ডিমের মতো। ছোট্ট খোলটির ভেতরেই রয়েছে সুন্দর ময়ূরের সম্পূর্ণ ব্লুপ্রিন্ট। চিন্ময় গুহর হাইকুগুলোও হয়ে উঠেছে ঐরকম এক আকাশময়ূরী।
রবীন্দ্রনাথের অটোগ্রাফ এর মতোই এক আকাশ হাইকুর অন্ধিসন্ধিতে মিশে আছে মিস্টিক দর্শন। প্রহেলিকা নয় কুহেলিকা। চিন্ময় গুহর হাইকু পড়তে পড়তে এসে দাঁড়িয়েছি একটা MAZE এর সামনে।
বলা যেতে পারে এই মরমীয়া বা Mystic রহস্যই হাইকুর প্রাণ। সেটি চিন্ময়ের অনুবাদে যথাযথ ধরা পড়েছে।
এই কবিতাগুলির বক্তব্য প্রকাশটি অত্যন্ত Suggestive এবং স্বাভাবিকভাবেই Symbolic হয়ে ওঠে। চিন্ময় তো রাজা সিম্বলিস্ট। অত্যন্ত সাজেস্টিভ না হলে এমন অনুবাদ সম্ভব হত না। কবিতার এই “অতিসংক্ষিপ্ত ক্যানভাস”ই হাইকুর চরিত্রবৈশিষ্ট্য গঠন করেছে। বস্তুতঃ মিতভাষ কবিতার জোর বেশি ― হাইকু প্রসঙ্গে আর একজন কবিও, বিশেষতঃ তাঁর বাশোর অনুবাদে (কবি অগ্নি বসুর কেন ভালো বাশো) একথা বলেছিলেন। এ তো সর্বাংশে সত্য। এসব কবিতার ক্ষেত্রে পাঠকের অবশ্য বুঝে নেবার একটা দায় থেকে যায়।
‘হাইকু, জাপানের একফালি নিসর্গের মতো সংক্ষিপ্ত’— “এই মতটি কবি সমীরকান্ত গুপ্তের। (সমীরকান্ত রচনাবলী ৩য় খণ্ড)।
হাইকু বিস্ময়কর ….বিস্ময় আদিরস। তার ফলশ্রুতি আশ্চর্য রসে। ঐসব বৈশিষ্ট্য বুকে নিয়ে হাইকু হয়েছে ভাব ও ভাষার বামনাবতার।
তবে হাইকুর রূপদক্ষতা ও ভাববিলীনতাই তার একমাত্র সম্পদ নয়, এর অবয়ব গঠনেও রয়েছে আশ্চর্য সংক্ষিপ্ততা ও ছন্দমাত্রা বিন্যাস। ভাবে ও নির্মিতিতে একটা সফল সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন চিন্ময় গুহ।
হাইকুতে থাকে সতেরো (১৭) মাত্রার ব্যবহার। বিন্যাসটি হয় এরকম――
পাঁচ (৫) + সাত (৭) + পাঁচ (৫)।
আমি জাপানি ভাষা জানি না। তার মোরাস ঠিক কেমন তাও জানি না। স্যার চিন্ময় গুহর ভূমিকা পড়ে এবং প্রচলিত মত অনুযায়ী বললাম। তবে হাইকুর অনেক আধুনিকীকরণ হয়েছে পরে এবং রিজিডিটিও কমেছে।
চিন্ময় গুহ এক অপরূপ রিলেস্টেশন। জাপানের হাইকু বাংলাতে ঠিক আমাদের মতো করে এনে দিলেন।
সাধারণ ভাবে আমরা ইংরেজি অনুবাদের বাংলা অনুবাদ করি।
মূল ভাষা জানা থাকে না প্রায়শই। সেক্ষেত্রে সাত নকলে আসল খাস্তা হবার সম্ভাবনাও কিন্তু থেকে যেতে পারে।
মূল হাইকু কবিরা কাব্যের মর্মভেদের জন্যে পাঠককে একটি কথায় বা দুটি কথায় মূলসূত্রটি ধরিয়ে দেন…. হতে পারে তা ‘প্রত্যহের কোনো ইঙ্গিতপূর্ণ শব্দ যা পুরোপুরি মরমীয়া কিম্বা অতীন্দ্রিয়…. Mystic…..
তা থেকেই পাঠককে টেনে নিতে হয় পূর্ণ ঋতুরঙ্গে পূর্ণ প্রত্যহের একান্ত রস- নির্যাস। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে জেন (Zen) বৌদ্ধদের মরমীয়া তত্ত্বের কথা….. তাঁদের দৃষ্টি এই খণ্ড ছাড়িয়ে অখণ্ড ধারণার বৃত্ত খুঁজে চলেছে। আবহমানের সমৃদ্ধি খুঁজে চলেছে।
চিন্ময় গুহর কলমে হাইকু কবি বাশো(১৬৪৪-১৬৯৪)―
“এই তুষার-ঝরা সকালে
এমনকি ঘোড়াগুলোর দিকেও
তাকিয়ে আছি।”
এই হাইকুতে মহাপ্রকৃতির কথা ধরা আছে।আছে বৃহত্তম মানবের আবহমান গতির কথা যেখানে দুঃখ জড়িয়েছে সুখকে অন্য শৈত্যতায়। বৌদ্ধমরমীয়া অনুভাবনাকেই যেন সংশ্লিষ্ট করেছেন কবি চিন্ময়।
চিন্ময় হয়ে উঠেছেন এক স্বতন্ত্র অক্ষর-ভাস্কর।
আর একটি হাইকু অনুবাদ পড়ছি এক আকাশ হাইকু থেকে―
“শূন্য গৃহের দরজায়
একটি কুকুর ঘুমিয়ে আছে।
ছড়িয়ে পড়ছে উইলো গাছের পাতা।”(শিকি)
ছবিগুলো সাজিয়ে নিচ্ছি―
১) শূন্য গৃহের দরজা
২) ঐ দোরগোড়ায় একটি কুকুর ঘুমিয়ে আছে।
৩) ছড়িয়ে পড়েছে উইলো গাছের পাতা
তিন ছবিতে ভিজুয়ালাইজড হয়েছে এক অখণ্ড মহাজীবন।মহা প্রকৃতিও। কি নিসর্গ কি মানব কি অন্যপ্রাণ ―সবকিছু। চূড়ান্ত মিষ্টিকতায় চিন্ময় গুহ একান্ত কাব্য আকুতিতে এই হাইকুটির অন্তর্লোকে উঁকি দিয়ে দেখেছেন কবির দ্বি-খণ্ড সত্তাকে। যেন ঠিক শূন্যতার বিপরীতে ঠেস দিয়ে বিপন্ন বিদেহ এক মনকে দেখেছিলেন চিন্ময়।
বস্তুতঃ হাইকুর বিস্তর প্রভাব আজ এই দশকেও সুনিরীক্ষ। এই মিতভাষ কবিতা তাই আজো সুধীজনের কাছে আদৃত হয়।
বাশোর অনুগামী কবি বুসন (১৭১৫-১৭৮৩)। এক অদ্বিতীয় হাইকু রচয়িতা । তিনি হাইকুর গঠনশৈলীতে তুলনা বিরল কবি।
“পাহাড়ের ওপর একটি মন্দির
ঘন্টার শব্দ থেমে থেমে বাজতে বাজতে
ধোঁয়ায় মিশে যায়।”(অনুবাদক চিন্ময় গুহ।)
বুসনের অন্য একটি উদাহরণ মনে পড়ল :―
“ঐ ঝড় থেমে যায়
কাঠখড়ি খুঁজে মরে
তিনবুড়ি, নির্ভয়।” (ভাবানুবাদ সমীরকান্ত গুপ্ত।)
হাইকু-র অন্য এক কবি ইসসা। (১৭৬৩-১৮২৭)। কারুণ্যে শ্লেষে, রসিকতায় অনন্য। আত্মিক আকুলতায় কবিতাগুলো Subjective হয়ে গেছে:—–
অবাক করে এই সাবজেক্টিভ দ্যুতি যখন চিন্ময় লেখেন―
“এখনও বুদ্ধ হয়ে উঠতে পারেনি
এমন এক প্রাচীন পাইন গাছ
অলস স্বপ্ন দেখছে।”(অনুবাদ–চিন্ময় গুহ।)
এই প্রসঙ্গে আর একবার সমীরকান্ত পড়ব । সময়ের ব্যবধানে চিন্ময় আধুনিক অনেক কিন্তু উপলব্ধি ও ভাব গ্রন্থনে দুই অনুবাদকই শীর্ষস্থানীয়―
“নববর্ষের দান…….
আদুড় দেহশিশু
ছোট্ট মুঠি তোলে…। (ভাবানুবাদ/ সমীরকান্ত)
ঐ দুজনের হাইকুতে দেখিনা কি একটা তীব্র গণতান্ত্রিক ও মানবিক সুরের
অনুরণন রয়েছে???
তীব্র শ্লেষ আর গভীর মর্মযন্ত্রণাকে অনুভব করেছেন লিপিত করেছেন কবি ও অনুবাদক ভবিষ্য প্রজন্মের জন্য???
কবি শিকিও (১৮৬৬-১৯০২) বুসনের প্রতিভা এবং রূপসৃজনদক্ষতা আত্মস্থ করেছিলেন
এবং তাকে আধুনিকীকরণের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন।
চিন্ময় গুহর কলমে দেখব―
“মাথা উঁচু করে দেখছি
একটি বিরাট জাহাজের কোণ
ভাটার সময়।”(চিন্ময় গুহ।)
বস্তুত হাইকু শৈলীর পরাকাষ্ঠা এই কবির প্রতিভাতেই সম্যক দেখা গেছে।
আর একটি ‘হাইকু’ দিলাম যা শিকির দৈনন্দিন জীবনদৃষ্টির পরিচয় বহন করে :
“করুণ… ভয়ংকর…..
দীনহীন কাকতাড়ুয়া জীবন্ত
শারদ-জ্যোৎস্নায়।” (ভাবানুবাদ /সমীরকান্ত।) এছাড়াও অনেক হাইকু কবি আছেন জাপানী সাহিত্যে যাঁদের নাম বেশ উল্লেখযোগ্য। এঁদের অনুবাদ চিন্ময় গুহর এক আকাশ হাইকু তে রয়েছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, জাপানী হাইকুর মতো তার প্রকাশ মাধ্যমটিও অর্থাৎ জাপানী কর্ণলিপিও সাংকেতিক এবং চিত্রধর্মী (heiroglyphic)—একটি স্বর বা সিলেবল্ এখানে একাধিক অর্থ বহন করে।
এটি হাইকুর বিশেষ সংকেত বহনের উপযুক্ত বটে।
Intense reading -এ মনে হয় হাইকুর ছন্দ (মূল জাপানী মোরাস থেকে) বাংলায় খানিকটা স্বরবৃত্তের মেজাজ নিয়ে তৈরী হয়েছে।
বটা না হলেও অন্তত কিছুটা হাত ধরাধরি করে চলেছে বলা যায়।
এখন আসব রবীন্দ্রনাথের লেখন প্রসঙ্গে—-
‘রবীন্দ্রনাথের অটোগ্রাফ’
আমরা জানি ১৯২৬-এর কিছু আগে ও পরের সময়সীমাকে ঘিরেই রবীন্দ্রনাথের চীন জাপান ভ্রমণ পর্ব চলেছিল। সেই সময় ব্যক্তিকবির সাক্ষর পড়েছে ভক্তদের পাখায়, কাগজে, কিম্বা রুমালে … কবি ভক্তদের যুগ্ম ব্যক্তিক দেরাজে।
এইসব ছোট ছোট সুন্দর ভাবসমৃদ্ধকবিতাগুলি নিশ্চিত অটোগ্রাফ বলে খ্যাত হবে।
হয়তোবা হাইকু নয় তবুও
হাইকু না হলেও তার সঙ্গে তুলনীয় বটে।
মানুষের সঙ্গে কবি রবীন্দ্রনাথের হার্দিক এই দেয়ানেয়ার দলিল এইসব অটোগ্রাফ… বাংলার সংক্ষিপ্তভাষ ‘লেখন’- এগুলো। এসব কবিতা বা অটোগ্রাফ-কবিতাগুলো স্বচ্ছন্দ্য, নির্ভার ও সুন্দরভাবে মার্জিত। এসব কবিতা বা অটোগ্রাফকে ঘিরে আছে ষোল আনা স্বতন্ত্র সব ছবি… সেসব স্বয়ংসম্পূর্ণও বটে।
২৭৫টির মধ্যে ৮৫টি ইংরেজিতেই রয়ে গেছে তর্জমাহীন, প্রকাশহীন।
সেই চমৎকার সংগ্রহ থেকে একটি তুলে আনা গেল
‘God seeks comrades and claims love,
The devil seeks slaves and claims obedience.”
ভাবানুবাদ যদি এমন বলে?—-
“হৃদয়ে ঈশ্বর খোঁজে প্রেম,
শয়তান দাসত্বে বাঁধে হেম।”
বাংলা “লেখন” থেকে কিছু উদ্ধৃতি না দিলেই নয়―
ক) স্বপ্ন আমার জোনাকি/দীপ্ত প্রাণের মণিকা…..
খ) যত বড় হোক ইন্দ্ৰধনু সে/সুদূর আকাশে আঁকা
আমি ভালোবাসি মোর ধরণীর / প্রজাপতিটির পাখা।
গ) ফুলগুলি যেন কথা/ পাতাগুলি যেন চারিদিকে তার পুঞ্জিত নীরবতা।
――এইসব খণ্ডখণ্ড ছবির আবেশটুকু দিয়েই সমগ্রের ইঙ্গিতকে ধরে রেখেছে ‘লেখন’।
হাইকুর মর্মসত্যের স্পর্শ এখানে দুর্নিরীক্ষ্য নয় ।
যদিও অবয়বগঠনের ধরা বাঁধা শৈলীতে এসব মিতভাষ কবিতা কে আঁটোসাটো করে বাঁধা যায় নি।।
(৪)
এক পশলা হাইকু সম্পর্কে অনুবাদক চিন্ময় গুহর নিজের কথা শুনে নেব——
“তিন ছত্রের মুক্তোর মতো জাপানি কবিতা, যা সারা বিশ্বে তার স্বতন্ত্র চরিত্রের জন্য বিশেষ মর্যাদা পেয়েছে। হাইকু আঙ্গিকটি সতেরো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, (যখন ফ্রান্সে নাটক লিখছেন মলিয়ের, ইংলণ্ডে মিলটন লিখছেন ‘প্যারাডাইস লস্ট’, মুঘল সাম্রাজ্যে ঔরঙ্গজেবের সময়) কবি মাৎসুও বাশোর (১৬৪৪-১৬৯৪) হাতে এক সূক্ষ্ম কবিতাকারুশিল্প হিসেবে আবিষ্কৃত হয়। এ যেন অক্ষরের মিনিমালিস্ট আর্ট, যার তুলনা মেলে না। কতগুলি অপরূপ ছবি, যা রঙিন ও বাঙ্ময়।প্রকৃতি, ঋতু, বুদ্ধ, বিড়াল, কীটপতঙ্গ, মনের নানা স্তর এই খোদাইচিত্রে অনন্তের সমীপে নিয়ে আসে। এগুলি যেন এক-একটি দীপমালা, যা ফুটিয়ে তোলে দার্শনিকের বিস্ময়! অসীম সম্ভাবনাময় এই তিনটি করে পংক্তি যেন অমোঘ তুলিটানে আমাদের সীমাবদ্ধ জীবনকে প্রসারিত করে!বাশোর পর যোসা বুসন (১৭১৬-১৭৮৪), কোবাইয়াশি ইসা (১৭৬৩-১৮২৮), মাসোয়াকা শিকি (১৮৬৭-১৯০২) ছাড়াও উয়েজিমা অনিৎসুরা (১৬৬৮-১৭৩৮) বিশিষ্ট নাম।জাপানি ফর্মটি সুনির্দিষ্ট, সেখানে তিনটি লাইনে যথাক্রমে পাঁচ, সাত ও পাঁচটি ছান্দস একক, বাংলা অনুবাদে যা রক্ষা করা কঠিন। তবু আমরা এক অনির্বচনীয়ের স্বাদ পাই। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কলমে এর প্রথম সাক্ষাৎ পায় বাঙালি। সেটি ছিল তাঁর অনুবাদে বাশোর বিখ্যাত হাইকু :পুরোনো পুকুরব্যাঙের লাফজলের শব্দ।
১—- ভাঙা বাড়ির পাশে একটি নাশপাতি গাছে ফুল হয়েছে;এখানে একটি যুদ্ধ হয়েছিল। ●শিকি
২—- পদ্মপাতার ওপর এই পৃথিবীর শিশিরটি বেঁকে আছে। ●ইসা
৩— কখনও ভুলতে পারবে না,শুভ্র শিশিরের নির্জন সুস্বাদ। ●বাশো
৪—- মেঘের নীচে—একটি পিঁপড়ে উঠে আসছে,দোয়াতদানির ওপর। ●শিকি
৫—- আমার ছড়ানো দু’পায়ের ওপর,মেঘমালা। ●ইসা
৬—- ওই পিঁপড়েদের সারি কিমেঘের স্রোত থেকে নেমে এলো? ●ইসা
৭—- আমার বার্ধক্যের বছরগুলো,গ্রীষ্মের বৃষ্টির মতোঝরে পড়ছে বৃষ্টির নল দিয়ে। ●বুসন
৮—- সারসের পা দুটিগ্রীষ্মের বৃষ্টিতে ছোট হয়ে গেছে। ●বাশো
৯—- মাকড়সা,তুমি কাঁদছ? না, হেমন্তের হাওয়া? ● বাশো
১০—- মাঠের সামনে,উড়ন্ত পাতাগুলি বিড়ালটিকে প্ররোচিত করে। ● ইসা
১১—- হেমন্তের সন্ধ্যা;একটুও শব্দ না করে একটি কাক উড়ে গেল। ● কিশু
১২—-হেমন্তে—এমনকী মেঘ ও পাখিরাও শ্রান্ত হয়ে আছে। ● বাশো
১৩—- প্রজাপতিটি ঘুমিয়ে আছে পাথরে,তুমি স্বপ্ন দেখবে আমার বিষণ্ণ জীবন। ● শিকি
১৪—-সারস-শিশুটি প্রজাপতিটিকে ঝেড়ে ফেলে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। ● ইসা
১৫—- একটি ঝরা ফুলশাখায় ফিরে এলো!না! একটি প্রজাপতি। ● মরিতাকে
১৬—- বুদ্ধদিনের মশাদের লুকিয়ে রেখেছেনপিছনে। ● ইসা
১৭—- মাছিটি লাফাতে পারে না,কী করুণ! ● ইসা
১৮—- বিদ্যুৎ চমকায়—একটি সারসের ডাক অন্ধকারের বুকে ছুড়ি মারে। ● বাশো
১৯—- একটি শিশিরবিন্দু—বসুন্ধরার ধুলো ধোয়ার জন্যএর চেয়ে অপরূপ কী হতে পারে? ●বাশো
২০—- ঘোড়ার পিঠে ঢুলতে ঢুলতে দাবানলের ধোঁয়া চাঁদের উদ্দেশ্যে ভেসে যায়। ● বাশো
২১—- ভোরের ফুলের মধ্যে আকুল হয়ে খুঁজছি,ঈশ্বরের মুখ। ● বাশো
২২—- কুড়েঘরের চারধারে—কলাপাতা,চাঁদের পানে তাকিয়ে। ● বাশো
২৩—- এইভাবে আমার নাম লিখো :সে ভালবাসত কবিতা আর খেজুর। ● শিকি
২৪—- নাসপাতি কাটার সময়,ছুরি বেয়ে মিষ্টরস নেমে আসে। ● শিকি
২৫—- কাকতাড়ুয়াটি,এমনকী রানির সামনেও,তার ভাঁজ করা টুপিটি খোলে না। ● সানসুই
২৬—- মধ্যরাতের কুয়াশায় আমি ঘুমিয়ে পড়ি, কাকতাড়ুয়াটির জামার হাতাটি ধার করে। ● বাশো
২৭—- পূর্ণিমার পূর্ণ চাঁদ—কাকতাড়ুয়াটি ঠায় দাঁড়িয়ে,যেন কিছুই হয়নি। ● ইসা
২৮—- শীতরাত;কোনও কারণ ছাড়াই আমি কান পেতে প্রতিবেশিটির কথা শুনি। ● কিকাকু
২৯—- ভাঙা বাড়ি;রাতের বৃষ্টির মধ্যে,কুকুরের গুমরানি। ● বাশো
৩০—- কুয়াশার বৃষ্টি;আজ কী আনন্দের দিন!যদিও ফুজি পাহাড় দেখা যাচ্ছে না। ● বাশো
৩১—- থালার ওপর ইঁদুরের খুটখুট—কী ভীষণ শীত! ● বুসন
৩২—- মাকড়সাটিকে মেরে ফেলার পর, একটি নির্জন শীতের রাত। ●শিকি
৩৩—- ক্যামেলিয়াটি ঝরে পড়তে পড়তে পাতায় আটকে গেছে। ●শোহা
৩৪—- বন্য খেজুর গাছ;তার মা তেতো অংশটি খেয়ে নিয়েছে। ●ইসা
৩৫—- ঝুলন্ত সাঁকো;লতানো আঙুর গাছটি জীবনকে জড়িয়ে ধরে আছে। ●বাশো
৩৬—- কাঠবাদাম ঝরে পড়ছে;ঘাসের ভেতর ঝিঁঝিঁর আওয়াজ গেছে থেমে। ●বাশো
৩৭—- একটি কালো কুকুর বদলে গেছে একটি লণ্ঠনে!তুষার ঢাকা রাস্তা। ● অনামা
৩৮—- শীতের গাছের মধ্যে যখন কুঠারটি ঢুকল—গন্ধে চমকে উঠেছি। ● বুসন
৩৯—- কুকুরটি ডেকে উঠল,অর্থাৎ কেউ হেঁটে গেল,এই তুষার ঝরা রাতে। ● মেইমেই
৪০—- সাদা সারসটি এমন ভাবে পা ফেলছে যেন ধানক্ষেতটি নোংরা! ●অজানা
৪১—- পীচ ফুল;দরজা খোলা,—যদিও ঘরে কেউ নেই… ● চিও-নি
৪২—- সমস্ত খেজুর বিক্রি হয়ে যাওয়ার পরপাহাড়ি গ্রামটিতেএমনকী কাকও আসে না। ● শুদা
৪৩—- শীতের সূর্য—ঘোড়ার পিঠে বরফ হয়ে যাওয়া একটি সিলুয়েট। ● বাশো
৪৪—- আজ সন্ধ্যায়… সুখ, আহ্,যখন পা ধুচ্ছিলাম…শুধু ওই দু’তিনটি শব্দ। ● কাইতো
৪৫—- চোরটি বাড়িতে ঢুকে,মিষ্টি সংলাপ শুনে জিব বের করে। ● অনামা
৪৬—জোয়ারভাঁটার বেলাভূমিতেযা কুড়োতে যাই,নড়ে ওঠে। ●চিও-নি
৪৭—- জলীয় উদ্ভিদে চড়ে,ব্যাঙটিভেসে যায়। ●কেইসা
৪৮—- ঝাপসা চাঁদমেয়েটিকে নদীর ওপারে নিয়ে যায়। ●বুসন
৪৯—- নদীর ওপর জাল ছোড়ার শব্দ—আর চাঁদের অস্পষ্ট রেখা। ●তাইশি
৫০—- জ্যোৎস্নায়পাম-কুঁড়ির গন্ধ,যা স্বর্গের দিকে ভেসে যায়? ●বুসন
৫১—- যারা চাঁদ দেখছে,মাঝে মাঝে মেঘেরা তাদের বিশ্রাম দেয়। ●বাশো
৫২—-যত দূরেই যাই,হেমন্তের দীপ্ত চাঁদ,আরও দূরে, এক অজানা আকাশে। ●চিও-নি
৫৩—-জ্যোৎস্নায় বিছানো হয়েছে,—টাটকা খড়ের মাদুর। ●ইয়াসুই
৫৪—-ঘুমিয়েও হাতের পাখাটি দোলায়—জ্বলন্ত উত্তাপকে। ●ফুকোকু
৫৫—- পুরুষটির মিষ্টি মিথ্যেকে দাসীটি সত্যি বলে ধরে নিয়েছে। ● অনামা
৫৬—- হরিণের বাঁশি আচমকা থেমে গেছে,বন্দুকের শব্দে! ●শিকি
৫৭—- প্রজাপতির শব…পিঁপড়েরা এগিয়ে আসছে,যেন কুচকাওয়াজ। ●তোনবো
৫৮—- মাকড়সার জালের মধ্যে একটি প্রজাপতির খোলস—কী করুণ! ●শিকি
৫৯—- শীতের নদীটি—সেখানে চার পাঁচটি হাঁসের মতোও জল নেই। ●শিকি
৬০— হিমের রাতে হঠাৎ জেগে উঠে দেখি—জলের পাত্রটি ফেটে গেছে। ●বাশো
৬১—- ঈর্ষা হয়!পড়তে পড়তেও উজ্জ্বল,মেপল পাতাটি দেখে! ●শিকো
৬২—- ভিতর উন্মোচিত করে,বাহির উন্মুক্ত করে,ঝরে পড়ছে একটি মেপল পাতা। ●রিওকান (সম্ভবত)
৬৩—- পুতুলটির মুখে…আমার পুতুলেরই মতো, অভিজ্ঞতালব্ধ প্রজ্ঞা। ●সেইফু
৬৪—- হতচ্ছাড়া বুড়ো হুলো বিড়াল!সে-ই জিতে নিয়েছে মেনি বিড়ালটির যোনি। ●ইসা
৬৫—- সুন্দরী নারীর—এমনকী যোনিও কলুষতাহীন! ●ইয়াশু
৬৬—- এমনকী বৌদ্ধ ভিক্ষুওনারী-ফুলটিকেলুব্ধ চোখে দেখে। ●শিগেইওরি
৬৭—- কী আমার কপাল! স্বর্গে এসেও শুধু হাই উঠছে। ●নানবকু
৬৮—- এই হেমন্তে আমি এত বুড়ো হয়ে গেলাম?মেঘের পাখি। ●বাশো
৬৯—- আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে,ওরা ভাগ করে নিয়েছে একই রেখারঙ,চাঁদ আর বরফ। ●মাৎসুমোতো কোয়ু
৭০—-আস্থা রেখো; পাপড়িগুলো কি ইতস্তত ঝরে পড়ে নাওভাবেই? ●ইসা
৭১—- শিশুরা, আমায় বলতে পারো,ওই লাল, লালরঙা চাঁদটাকার? ●ইসা
৭২—- চাঁদ ডুবে গেছে দিগন্তেরেখায়,এখন শুধু হাতে রইল টেবিলের চারটি কোনা! ●বাশো
৭৩—আজকের চাঁদ;পৃথিবীতে একজনও কি আছে যে কলম তুলে নেবে না? ●ওনিৎসুরা
৭৪—- সুন্দরী মেয়েটির বিরক্তিকে এলোমেলো করে দিচ্ছে বসন্তের হাওয়া। ●গিওদাই
৭৫—- একরত্তি গায়ক পাখিটিএদিক ওদিক দেখছ,‘কিছু কি ফেলে গেলে?’
●ইসা
●●● অনুবাদ : চিন্ময় গুহ।”
(৫)
হাইকু হল তিন লাইনের জাপানি কবিতা।
শিশির বিন্দুর মতো (Lime af transition)
এটি বিশ্ব চরাচরের আভাস বয়ে আনে।
(বিশ্ব চর + অচর-
আভাস-ইঙ্গিত)
এটি শুদ্ধতম শিল্প ।
কেন?
এটিতে পাওয়া যায় জেন ধর্মী ধ্যানমগ্নতা।
এই ধ্যানময়তা দেয় সুপ্তি শান্ত আলো
যা ক্ষণস্থায়ী জীবনের মায়াকে জ্বালিয়ে
মোহকে অতিক্রম করে যায়।
হাইকুর ছোট ফ্রেমে ধরা থাকে—
মহাকাল
সেখানে মানুষ আর প্রকৃতি দুজনেই একা—
ব্যাঙটি
আমার দিকে-―
চেয়ে থাকার খেলা খেলছে।
■(ইসসা)
অনুবাদ–চিন্ময় গুহ।
জলীয় উদ্ভিদে চড়ে,ব্যাঙটিভেসে যায়। ■(কেইসা)
অনুবাদ-চিন্ময় গুহ।
( ৬)
“হেমন্তের পূর্ণ চাঁদ :
আমার ছায়া আমায় সঙ্গে করে নিয়ে যায়,
আর ফিরে আসে।”
—চিন্ময় গুহ।এক আকাশ হাইকু।
■
হাইকুতে থাকে একটুকরো নিসর্গ।
একটি বস্তু থেকে শুরু হয় বিশ্ববীক্ষণ। ভীষণ সাংকেতিক ও সংহত কবিতা হাইকু।
আমরা কবি ও অনুবাদক চিন্ময় গুহর এক আকাশ হাইকু (অনুবাদ) থেকে একটি পড়ব।
“হেমন্তের পূর্ণ চাঁদ :
আমার ছায়া আমায় সঙ্গে করে নিয়ে যায়,
আর ফিরে আসে।”
—–হাইকু টি সোদোর।
অনুবাদ করেছেন চিন্ময় গুহ।
হাইকুর রীতিকে অতিক্রম না করেই “হেমন্তের পূর্ণচাঁদ”—একটি নিসর্গচিত্র উপহার দিয়েছে পাঠককে। বলাবাহুল্য হাইকুর চিন্তন গভীরতার আড়ালে থাকে তাদের দেশীয় প্রবাদগুলো এবং মিথিক ধারণার ফুলকি।
সেসব না জানা থাকলে কেবলমাত্র মনকাড়া একটা ভালো লাগাই উপহার পেতে পারেন পাঠকরা। এই আলোচ্য হাইকুটিতে জীবন, জীবন বিশ্বাস, অন্তর্জীবনচর্চা—সব মিশে একটা ছোট্ট কবিতা তৈরি হয়েছে।
এই হাইকুটিতে ,জাপানের বিশ্বাসের প্রান্তভূমি থেকে উঠে এসেছে “SHINIGAMI”–র কথা। শিনিগামী হল– God of Death…… তার মেসেঞ্জার রা পৃথিবীতে আসে যায়।
হেমন্ত কাল জীবনের প্রৌঢ়ত্বকে নির্দেশ করে। ভারতবর্ষেও ঐ সময়ে ঘরে ঘরে আকাশ প্রদীপ দেয়া হয় মৃতপ্রপুরুষদের জন্য। ঐ হেমন্তে যখন চাঁদ পরিপূর্ণ হয় মানুষ তখন between Life and Death…..wanning…..
তখনই তারা দেখতে পায় ঐ মেসেঞ্জারদের ছায়াশরীর যারা চারপাশে ঘোরে ফেরে কিছুটা আগে থেকেই। জীবনের নিঃসঙ্গতা তখন ঐ ছায়াকেই আঁকড়ে ধরে । তাদের একটা Emotional understanding তৈরী হয়ে যায় ঐ ছায়াগুলোর সঙ্গে । ঐসময়ে ঘিরে আসে একটা loneliness…. একই সঙ্গে তাদের কানে বাজতে থাকে , “যেতে হবে যেতে হবে।”
ঐ মেসেঞ্জাররা যাকে বলা গেল ছায়াশরীর, তারা দীর্ঘদিন এইসব হেমন্তের ছোঁয়া লাগা মানুষ গুলোকে observe করে। মর-জীবনের টালবাহানা এরই reflection…… কখনও চেতনা বিহার করে অতিচৈতন্যলোকে কখনও ফিরতেই হয় এই মর-পৃথিবীতে।
এভাবেই চলতে থাকে wanning…..
শুধু যাওয়া আসা।
এই বিশ্বাস জাপানের নিজস্ব ঐতিহ্য। এইভাবেই সোদোর হাইকু টির প্রাণ উঠে এসেছে চিন্ময় গুহর কলমে।
*****************************************