একাত্তরের যুদাস
মনিজা রহমান
যাত্রা পথে সার্ভিস সেন্টারে থামার পরে সব সময়ই আমার একই ধরনের অনুভূতি হয়।
মনে হয় হয় যেন আমি সেই মধ্যযুগের পরিব্রাজক। অজানার উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বেরিয়েছি। মুসাফিরের মতো পথে যেতে যেতে কোন সরাইখানা পড়েছে, সেখানে থেমেছি। আগে তো এখনকার মতো সার্ভিস সেন্টার ছিল না। মধ্যযুগে সুফিসাধকদের জন্য ছিল দরগাহ। সেখানে নানা ধরনের মারফতি আলাপ হত, সঙ্গীত চর্চা হত। মাঝে মাঝে মনে হাহাকার ওঠে, আহারে কেন যে মধ্যযুগে জন্মালাম না!
পথমধ্যে কোথায় থামব সেটা অবশ্য নির্ভর করে প্রয়োজনের ওপর। আদতে কোথায় থেমেছি সেটা মনেও থাকে না। গন্তব্যে পৌঁছানোর আকাঙ্খাই প্রধান হয়ে ওঠে।
‘কফি খাবা নাকি?’ – আমার যাত্রাপথের সঙ্গী মিলি জানতে চাইল। বেড়ানোর আনন্দকে স্বার্থক করতে আমরা দুই পরিবার মিলে একসঙ্গে বাইরে যাচ্ছি। মিলির কথাটা প্রথমে মাথায় ঢোকেনি। কেমন মন খারাপ করা মেঘলা অন্ধকারাচ্ছন্ন দিন আজ। ইংরেজীতে সম্ভবত একেই বলে- ‘গ্লোমি ডে’। এমন দিনকে মাথায় রেখে রেজো সেরেজ লিখেছিলেন হাঙ্গেরিয়ান সুইসাইডাল সঙ। সত্যি বলছি, গানটা একবার শোনার পরে জীবনে আর দ্বিতীয়বার শোনার সাহস হয়নি। মনের ওপর এমন প্রভাব ফেলেছিল যে বলার মতো নয়। বুকের মধ্যে একদম খামচে ধরেছিল বিষণ্ণতা।
– চল আগে রেস্টরুম থেকে ঘুরে আসি। তারপর ওখানে বসে কফি খাওয়া যাবে।
কথা বলতে আমি দূরে একটা টেবিল দেখাই। মেঘলা দিন হলেও তাপমাত্রা উঠতির দিকে। সেলসিয়াসে ১৩ বা ১৪ ডিগ্রি হবে। ছেলেমেয়েদের নিয়ে তাদের বাবারা ফাস্ট ফুডের দোকানে লাইন দিয়েছে। একেক জনের পছন্দ একেক রকম।
– তোমার কি মন খারাপ ?
স্টারবাকস থেকে দুজন দুটো ‘লাটে’ কফি নিয়েছি। মগগুলি টেবিলের ওপরে রেখে পাশে রাখা বেঞ্চে বসতেই মিলি প্রশ্ন করে।
আমি কিভাবে শুরু করব বুঝি না। অনেকদিন পরে কাল বিকেলে কারো মুখে মুক্তিযুদ্ধ দিনের কথা শুনলাম। আর কেন যেন বাবা-মায়ের কথা মনে পড়ছিল। আব্বা তো সময় পেলেই যুদ্ধ দিনের বন্দী জীবনের কথা বলতো। একটা কাঠের আলমারির ভিতরে লুকিয়ে কিভাবে দিন কেটেছে, কিভাবে চলে গেছে মাসের পর মাস। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমার মায়ের বয়স ছিল ষোল বছর। একজন উঠতি তরুণীর জন্য সময়টা সুখকর ছিল না নিঃসন্দেহে!
মায়ের মুখে শুনেছি, নৌকায় করে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে ওনাকে। এভাবে ঝালকাঠির এক গ্রামে যাবার সময় আম্মা সত্যি সত্যি একদিন মুক্তিযোদ্ধাদের দেখেছিলেন, খালের কাঁদার মধ্যে এমবুশের ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে থাকতে। আমার কিশোরী মা সেদিন ভেবেছিলেন, এত কষ্টও করতে পারে মানুষ!
খালের কথা ভাবতেই মনে পড়ল চকের কথা।
‘মিলি, তুমি আগে কখনও চকের নাম শুনেছ?’ আমি জানতে চাই।
‘চক, মানে তো চকবাজার। আমরা তো সংক্ষেপে চক বলতাম।’ পুরান ঢাকার বংশালের মেয়ে মিলির উত্তর দিতে দেরী হয় না।
‘ না, না, সেই চক না। গ্রামের ধানক্ষেত বর্ষাকালে যখন পানিতে ভেসে যায় তখন তাকে চক বলে। ওখানে তখন নৌকা চলে। জানতো, এক সময় বাংলাদেশের যাতায়তের প্রধান মাধ্যম ছিল নৌকা। ফাদার উইলিয়ামস ইভান্সকে সেদিন যদি নৌকায় মাঝি চকের ওপর দিয়ে যেত, তিনি বেঁচে যেতে পারতেন। কিন্তু, সেটা না করে ইচ্ছে করে ওনাকে নদী দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। আর যে কারণে ওনাকে মরতে হয়েছিল।’
বলা নেই, কওয়া নেই হঠাৎ একজনের প্রসঙ্গে কথা বলা শুরু করা আমার পুরনো স্বভাব। সেটা ভালো না খারাপ বলতে পারব না। তবে অন্য কেউ হলে অবাক হত। মিলি আমার ক্লাস ওয়ান থেকে বন্ধু। ও অবাক হয় না। বরং খুব আগ্রহ আর মায়াভরা কণ্ঠ নিয়ে জানতে চায়, ‘ফাদার উইলিয়ামস কে? কেন ওনাকে মারা যেতে হয়েছিল?’
মুখ খোলার আগে আমার বড় মেয়ে পদ্য ছুটে এসে বলে, ‘আম্মু, বাবা গাড়ি স্টার্ট দিয়েছে। তোমাদের তাড়াতাড়ি আসতে বলছে।’
‘ফাদার উইলিয়ামস ইভান্স ঢাকার নওয়াবগঞ্জের মানুষ ছিলেন না ? মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদ হয়েছিলেন। বাংলাদেশ সরকার মনে হয় কয়েক বছর আগে মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী বন্ধুদের মধ্যে ওনাকেও সম্মাননা দিয়েছে।’
আমার স্বামী মারুফ গাড়ি চালাতে চালাতে বলে। মারুফের পাশের সিটে মিলির স্বামী মেজবাহ ভাই। মাঝের সিটে আমি ও মিলি আর আমার বড় মেয়ে পদ্য। পিছনে ছোট মেয়ে কাব্য আর মিলির দুই ছেলে। নিউইয়র্ক সিটি থেকে আমরা যাচ্ছি ম্যাসাচুসেটসের কেপ কডে বেড়াতে।
গতকাল বিকেলে ম্যাসাচুসেটসের নাম বলার পরেই এই গল্পের সূচনা।
– মা জননী তোমরা কোথাও যাইতেছ ?
আমাদের ব্যাগ গোছানো দেখে জেসিন্তা গোমেজ জিজ্ঞাসা করেন। আমার ছোট মেয়ে কাব্যর বয়স্ক হোম এটেন্ডডেন্ট।
আমি ওনাকে আন্টি ডাকি। আমি ম্যাসাচুসেটসের নাম বলাতে আন্টির চেহারা কেমন বিষণ্ণ হয়ে গেল। চোখগুলি যেন ছলছল করতে লাগল। ওনাকে হাতে ধরে পাশে বসালাম।
আমার মা মারা যাওয়ার কয়েক মাস বাদে জেসিন্তা গোমেজ আমার ছেলের হোম এটেন্ডডেন্ট হিসেবে বাসায় আসে। বয়স পঁয়ষট্টি হলে কি হবে এখনও বেশ শক্তপোক্ত। প্রথম দিনেই উনি জানিয়ে দিলেন, ‘আমি কিন্তু তোমাদের আপনি করে বলতে পারব না। তুমি করে বলব। আমার বড় নাতি তোমাদের চেয়ে বয়সে বড়।’ তোমাদের বলতে উনি আমি আর আমার স্বামীকে বোঝালেন। মারুফ তো খুব খুশী। এমনিতে বয়স্ক মানুষের প্রতি ওর শ্রদ্ধা-ভক্তি অগাধ।
আমি জেসিন্তার কথায় সায় দিয়ে বললাম, ‘আমি তাহলে আপনাকে আন্টি বলব আর আমার মেয়েরা নানু ডাকবে।’ উনি খুব খুশী হলেন। এখন বাড়িতে নাতিদের নিয়েই নাকি ওনার সময় কাটে। ওনার ভাষায়- জীবনের এই সময়ে এসে সন্তানদের চেয়ে নাতি-নাতনিরাই বেশী প্রিয় হয়ে যায়।
আমার ছোট মেয়ে কাব্য নিজের অনুভূতি সেভাবে প্রকাশ করতে পারেনা। তবে বড় জন পদ্য সে তো রীতিমত নানুর ভক্ত। নির্দিষ্ট কর্মঘন্টা শেষে জেসিন্তা যখন ফেরার উদ্যোগ নেয়, তখন সে বলে-‘নানু, আরও কিছুক্ষণ থাকেন না আমাদের সঙ্গে।’ নানুকে এত ভালোবাসার কারণ- জেসিন্তা ওদের গল্প শোনান। প্রকাশভঙ্গী অনেকটা গ্রামের দোহারের মতো। একই সঙ্গে গান, কথা, নাচ সবই করেন। এমনভাবে কথা বলেন যে মন দিয়ে শুনতে হয়।
‘জান, মা জননী ছবির মতো একটা গ্রাম ছিল আমাদের। মানুষ ছিল অসাম্প্রদায়িক। কেউ ভাবতো না কার জাত কি, কার ধর্ম কি ? কেউ বুঝত না, কে হিন্দু, কে মুসলমান আর কে খৃষ্ট্রান। কিন্তু সেই সুখ বেশীদিন সইল না। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ক্রমে তার আচ আমাদের গ্রামে এসেও লাগল।’ জেসিন্তা গোমেজ বলে যান।
‘আমাদের বাড়িতে অনেক মুক্তিযোদ্ধারা আসতো। যুদ্ধের সময় আমার বড় ভাইয়ের বয়স হবে বাইশ বছর। ওর নাম ক্রিস্টোফার গোমেজ, পিআই ফ্লাইটে কাজ করতো। পঁচিশে মার্চ রাতে পাকিস্তানী সৈন্যরা ঢাকায় আক্রমণ করলে ও হেঁটে বাড়িতে চলে আসে। তিন দিন লেগেছিল ওর ঢাকা এয়ারপোর্ট এলাকা থেকে বাড়িতে হেঁটে আসতে। আমার ভাই সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ না করলেও সবাইকে সাহায্য করতো। রাতের বেলা মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে খাবার দিয়ে আসতো। আমরা রান্না করে রাখতাম। আমার ভাই গ্রামে বিভিন্নজনের বাড়ি ঘুরে ঘুরে খাবার সংগ্রহ করতো। আমাদের গ্রামের ছেলেরা নানা জায়গায় শরণার্থীদের পানি দেবার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতো। পানি দেবার সময় ছেলেরা বলতো- বল জয় বাংলা।’
‘আমাগো গ্রামের গীর্জার পুরোহিত ছিলেন ফাদার উইলিয়াম ইভান্স। উনি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেন নাই। একজন আমেরিকান হইয়া উনি যে কতভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেছেন সেটা বলার মতো নয়। বহু বছর বাংলাদেশের থাকার কারণে এই দেশকে তিনি ভালোবেসে ফেলেছিলেন। নবাবগঞ্জের গোল্লায় গীর্জাতে উনি থাকতেন। আমাগো পাল পুরোহিত ছিলেন উনি। রোমান ক্যাথলিক ফাদার হিসেবে উনি বিয়ে শাদি করেন নাই। ওনার অধীনে আঠারোটা গ্রামের গীর্জা ছিল।’
এভাবে শুরু করেন জেসিন্তা গোমেজ। আমিও সেভাবে বলতে থাকি গাড়ির সবাইকে। পিছনের সিটে বসা ছোট বাচ্চারা গাড়ির দুলুনিতে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমার বন্ধু মিলি আর ওর স্বামী মেজবাহ মন দিয়ে আমার কথা শোনে। মারুফ তো বরাবরই আমার কথার শ্রোতা। কারণ ও কথা বলে কম, তবে শোনে বেশী।
‘জেসিন্তার গ্রাম দেওতলা সেই আঠারোটা গ্রামের একটা ছিল। ওই এলাকার বেশীরভাগ পুরুষ মধ্যপ্রাচ্যে চাকরী করতো। তখন তো বিদেশ থেকে গ্রামের বাড়িতে টাকা পাঠানোর এত ব্যবস্থা ছিল না। গ্রামের খৃষ্টান যারা তারা ঢাকার কাকরাইলে আর্চবিশপের হাউজে টাকা পাঠাতেন। ফাদার উইলিয়াম ঢাকায় গিয়ে সেই টাকা তুলে নৌকায় করে অথবা পায়ে হেঁটে গ্রামে গ্রামে গিয়ে সবার পরিবারের কাছে সেই টাকা পৌছে দিতেন। ওই টাকায় বহু পরিবার খেয়ে পরে থাকতো। সবার বিপদে আপদে এক ডাকে ছুটে আসতেন ফাদার। যে কারণে ওনার নির্মম মৃত্যু পরিবারের কেউ মেনে নিতে পারে নাই।’
‘ঘটনাটা ঘটেছিল কি মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই ?’ মেজবাহ ভাই প্রশ্ন করেন। উনি ঢাকায় থাকতে কিছুদিন সাংবাদিকতা করেছিলেন। পরে সরকারী চাকরী পাওয়ায় সাংবাদিকতা ছেড়ে দেন। নিউইয়র্কে এসেও সিটি জব করছেন।
‘ফাদার উইলিয়াম ইভান্স মারা যান ১৯৭১ সালের ১৩ নবেম্বর। তারিখটা আমার সারাজীবন মনে থাকবে। কারণ তার একদিন পরে কাব্যের জন্মদিন। ১২ নভেম্বর ঢাকায় গিয়েছিলেন ফাদার। যুদ্ধের কারণে লঞ্চ তখন বন্ধ ছিল। বাস চললেও সেটা অনিশ্চিত ছিল। নৌকায় করে উনি ঢাকায় যান। ঢাকায় তখন ফাদার ও বিশপদের প্রতি মাসে একটা মিটিং হতো। মিটিংয়ে যোগ দেবার পাশাপাশি প্রবাসীদের অর্থও নিয়ে আসতেন ফাদার।’
কথা বলতে বলতে যেন পুরো কাহিনী ছায়াছবির মতো চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
ঢাকা থেকে ফেরার পরের দিন ১৩ নভেম্বর নৌকায় করে বক্সনগর গ্রামে যাচ্ছিলেন ফাদার। তখন বর্ষাকালে পুরো গ্রাম জুড়ে পানি। চাষের ক্ষেত পানিতে নিমজ্জিত। যেটাকে এলাকার লোকজন বলতো চক। নৌকা নিয়ে ওখান দিয়ে গেলে নিরাপদ ছিল। পাকিস্তানী সৈন্যদের চোখে পড়ার সুযোগ ছিল না। কিন্তু মাঝি জোর করে ফাদারকে নদীপথে নিয়ে যায়। নদীর পাশে নবাবগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে ছিল পাকিস্তানীদের ক্যাম্প। নৌকা যাবার সময় ক্যাম্পের কমান্ডার ফাদারকে ডেকে নিয়ে যায়। পাক সৈন্যরা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে।
– তুমি কি জান এখানে কারা মুক্তিযোদ্ধা ? আমরা শুনেছি তুমি তাদের সাহায্য কর। ক্যাম্পে গিয়ে তাদের সেবা শ্রুশুষা কর ?
– মানুষকে সাহায্য করাই আমার ধর্ম। এই যে যুদ্ধের মধ্য নৌকা নিয়ে বের হয়েছি, গ্রামে গ্রামে যাচ্ছি, সেটাও মানুষের জন্য। কারণ মহান যীশু বলেছেন, সবার সেবা কর। সবাইকে ভালোবাস।
পাকিস্তানী সৈন্যদের প্রশ্নের উত্তরে ফাদার বলেন।
পাকিস্তানী সৈন্যরা ফাদারের কথায় সামান্যতম প্রভাবিত হল না। তবে তাকে ছেড়ে দেবার কথা বলল। বলল, ‘যাও’।
নদীর ধারে নৌকা অপেক্ষা করে ছিল। ফাদার সেখানে যাবার জন্য পা বাড়ালেন।সঙ্গে সঙ্গে পিছন থেকে রাইফেলের বাট দিয়ে ফাদারকে আঘাত করা হল। দড়াম করে মাটিতে পড়ে গেলেন ফাদার। মাটিতে শুয়ে থাকা মানুষটাকে বেয়োনেট দিয়ে খুচিয়ে ক্ষতবিক্ষত করল পাকিস্তানীরা। বুট পরা পা দিয়ে আঘাত করতে লাগল। শেষে আঘাতে আঘাতে অর্ধমৃত ফাদারকে গুলি করে হত্যা করে নদীর পানিতে ভাসিয়ে দেয় ওরা।
পরদিন ভোরে ঘটনাস্থলের কয়েক মাইল দূরে ভাটির গ্রাম কৈলাশের বাহরা নদীর ঘাটে ফাদারের মরদেহ ভেসে ওঠে।
গ্রামের মহিলারা নদীতে স্নান করতে আর থালা বাসন মাজতে যায়। হিন্দু মহিলারা খুব সকালে উঠে সেখানে স্নান করে। তারা প্রথম দেখে ফাদারের লাশ।ইতিমধ্যে গ্রাম থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে ফাদারকে মেরে ফেলা হয়েছে। ওই মহিলারা ছুটে বাড়িতে গিয়ে স্বামীদের জানায়। কৈলাস গ্রামের পুরুষরা, মুক্তিফৌজের লোকজন দলে দলে আসতে থাকে। সকাল এগারোটায় মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী ও ময়নাল হোসেনের নেতৃত্বে মুক্তিফৌজের দল লাশ নিয়ে গোল্লা চার্চে নিয়ে আসে। আর্চবিশপ থিয়োটোনিয়াস অমল গাঙ্গুলি তখন উপস্থিত ছিলেন। তিনি মরদেহের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরী করেন। গির্জার রেকর্ড বইতে তা সংরক্ষিত আছে।
আমার বন্ধু মিলির চোখে পানি। আমার কণ্ঠও বাস্পরুদ্ধ। ভাঙ্গা ভাঙ্গা কণ্ঠে সেই প্রতিবেদনের লেখা উল্লেখ করি- ‘ফাদার ইভান্সের মুখে গভীর ক্ষত ছিল। বেয়োনেটের আঘাতে তাঁর নীচের ঠোট কেটে যায়। মুখের ভিতর দাঁত ভাঙ্গা। দুইটা গুলি শরীরে ঢুকেছিল। একটা গুলি বাম দিকের পাঁজর দিয়ে ঢুকে ডান হাতের কাঁধের পাশ দিয়ে ভিতরে ঢোকে। অপরটি ডান দিকের কোমরের পাশ দিয়ে ভিতরে ঢোকে। দুটো হাতেরই ভিতর দিকে কাটা। হাত ও পায়ে অসংখ্য আঁচড়ের দাগ।’
সেদিন রোববার ছিল। বিকেলে গোল্লা কবরস্থানে সমাহিত করা হয় ফাদার উইলিয়াম ইভান্সকে। তখন তো কোন ফোন ছিল না। কিন্তু গ্রাম থেকে গ্রামে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে-পাক বাহিনী হত্যা করেছে ফাদারকে। হাজার হাজার মানুষ ভেঙ্গে পড়ে ফাদারের মুখটা শেষ বারের মতো দেখার জন্য।
‘ফাদার কিন্তু মরতেন না! মিলি জানো, ওই দিন যদি নৌকার মাঝি নদীর ধার দিয়ে না গিয়ে চক দিয়ে যেতেন, ফাদার বেঁচে যেতেন।’ ভাঙ্গা গলায় বললাম আমি।
‘কি বল?’ মিলি এবার সত্যি বিস্মিত। ফাদারের মতো ভালো মানুষকে কেউ ধরিয়ে দিতে পারে ও কিছুতেই যেন বিশ্বাস করতে পারছে না।
গ্রামের রাজাকাররা পাকিস্তানীদের খবর দিয়েছিল- ফাদার উইলিয়ামস ইভান্স মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করেন। তাদের ওষুধ-খাবার দেন। ফাদার নিয়মিত নানা গ্রামে যেতেন বলে, তার একটি বাধা নৌকা ছিল, তার মাঝি ছিল- মোহন মোল্লা। সে রাজাকারদের কাছ থেকে টাকা খেয়ে ফাদারকে ধরিয়ে দেবার ব্যবস্থা করে।অথচ মোহন মোল্রাকে কতভাবেই না সাহায্য করেছেন ফাদার। তার বিনিময়ে ফাদারের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে সে।’
এতক্ষণ কথা বলে লম্বা দম নেই। সিটের পকেট থেকে বোতল বের করে পানি খাই। সবাই চুপচাপ। আমার বড় মেয়ে পদ্যও আমাদের সঙ্গে মন দিয়ে গল্প শুনছে।
‘ওই গ্রামের বেশীরভাগ মানুষ তো খ্রীষ্টান ছিল। তারা পরে মাঝি মোহন মোল্লার নাম দেয়- ‘যুদাস’।
‘ইস্কারিয়োত যুদাস’- পদ্য চিৎকার করে ওঠে। ও নিউইয়র্কর সিটির স্কুলের পাঠ্যবইয়ে বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে আলোচনায় খ্রীস্টান ধর্ম সম্পর্কে পড়েছে। ও বলল, ‘আমি যুদাসের কথা পড়েছি। লিওনার্দো দি ভিঞ্চি লাস্ট সাপার চিত্রকর্মে যীশু যে বারো জন শিষ্য নিয়ে সর্বশেষ ডিনার করেছিলেন, যুদাস সেখানে ছিল। যুদাস যীশুকে ধরিয়ে দিয়েছিল রোমান রাজার লোকজনের কাছে। পরে রোমান রাজার লোকেরা যীশুকে ক্রুশবিদ্ধ করে মেরে ফেলে। যুদাস কি পেয়েছিল পুরস্কার হিসেবে জানো?”
‘কি পেয়েছিল মা?’ মারুফ জিজ্ঞাসা করে। বড় মেয়ে কিছু জানলে বা বললে তার বাবার যে কি গর্ব!
‘মাত্র তেরটি তামার মুদ্রা।’
‘তাই নাকি? মাত্র তেরটি তামার মুদ্রা!’ মেজবাহ ভাই এবার কথা বলেন। ‘বিশ্বাসঘাতকের পুরস্কার এমনই হয়। ফাদারকে ধরিয়ে দেয়া মাঝি যুদাসের পরে কি হয়েছিল জানেন?’
প্রশ্নটা আমার উদ্দেশ্যে বুঝতে পারি। ‘জেসিন্তা বলেছে- মোহন মোল্লার নৌকায় পরে কেউ উঠতো না। পরিবারের লোকজনও তাকে ত্যাগ করেছিল। পরে লোকটা পাগল হয়ে যায়। সারাক্ষণ বিড়বিড় করে বলতো- আমি কি করলাম! আমি কি করলাম! অযত্ন-অবহেলায় লোকটা মারা যায়।’
‘উপযুক্ত শাস্তি হয়েছে বিশ্বাসঘাতকের।’ মিলি মন্তব্য করে।
‘ জান তোমরা, যীশুকে ধরিয়ে দেয়া যুদাস পরে আত্নহত্যা করেছিল।’ পদ্য জানায়। আমাদের সবার মধ্যে যুদাস বিষয়ে ওর জ্ঞান বেশী।
আমাদের গাড়ি কানেক্টিকাট ছাড়িয়ে ম্যাসাচুসেটসের দিকে চলতে থাকে। ম্যাসাচুসেটসের পিটসফিল্ডে বহুকাল আগে জন্মেছিলেন উইলিয়ামস ইভান্স নামে এক শিশু। মানবসেবার ব্রত নিয়ে ব্রিটিশ জাহাজ মালঞ্চে করে বাংলাদেশে গিয়েছিলেন। তারপর সেই বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানীদের হাতে মৃত্যু হয় তাঁর।
আমাদের গন্তব্য পিটসফিল্ড না, আমরা যাচ্ছি কেপ কডে। ওখানে জন্মেছিলেন আমেরিকার ইতিহাসে অন্যতম সেরা প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি। আততায়ীর গুলিতে নিহত হন তিনিও।
যুদাসের মতো বিশ্বাসঘাতকরা তো যুগে যুগে নানা রূপে বার বার ফিরে আসে।