You are currently viewing একাত্তরের বেশ্যা || জাকিয়া শিমু

একাত্তরের বেশ্যা || জাকিয়া শিমু

একাত্তরের বেশ্যা

জাকিয়া শিমু

শরতের কোন এক ভোরসকালে আমার জন্ম হল। দাদি আমার নাম রাখলেন, সায়রা বানু। দাদি আঁতুড়ঘরের ধকল সেরে ভোরের নীলচে-আলো ফুটতে উঠোনে এসে গা ঝাড়া দিয়ে দাঁড়ালেন। উঠোনের এককোণে আঁধার রাতে আকাশের গায়ে ফুটে থাকা নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করছে শিউলিতলা। টকটকে কমলা বোটায় সাদা-শুভ্র শিউলি ফুলগুলোকে আকাশে ফুটে থাকা তারারফুলের মতো লাগছে। ফুলের সুবাস হাওয়ার উপর ভর করে ছড়িয়ে পড়ছে হিজলতলা গাঁয়ের প্রতিটি কোণায় কোণায়। দাদির বহুদিন আগেকার এমন শিউলিফুলের সুবাস ছড়ানো এক বিশেষদিনের কথা মনে পড়ে যায়। তিনি অনেকক্ষণ স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন শিউলিতলায়। এরপর আঁতুড়ঘরে ফেরত গেলেন এবং আমার নাম বদলে ফেলে নতুন নাম রাখলেন- শিউলিমালা। পরে অবশ্য নামের শেষাংশ হাওয়ায় মিলিয়ে দিয়ে সবাই আমাকে শিউলি নামেই ডাকে। তবে দাদির কাছে আমি শুধু শিউলিমালা হয়ে রয়ে গেলাম।

আমার বয়স সবে ষোলতে পড়েছে। বাবার কাছে অবশ্য আমি সেই হাতাকাটা ফ্রকপরা ছোট্ট ছ’বছরের গাল ফুলিয়ে যখনতখন ফুঁসলে-ওঠা অহ্লাদি আদরের খুকিটিই রয়ে গেছি। তিনি এখনো সারাদিনের কাজ শেষে বাড়ি ফিরবার পথে মিছরিরপুটলা পাঞ্জাবীর পকেটে লুকিয়ে এনে গোপনে আমার হাতে গুঁজে দিতে ভুল করেন না।
আমাকে নিয়ে অবশ্য মায়ের ধারণা বাবার উল্টো। তার ধারণা আমার বিয়ের উপযুক্ত বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে! বাড়ন্ত বয়সকালে মেয়েদের দেহ-মনে অপার্থিব এক সৌন্দর্য ধরা দেয়। আমার সেই বয়সকাল চলছে। এবয়সে বিয়ে দেওয়া মাত্র আমি একজোড়া সন্তান পয়দা করে বইপুস্তকে লেখা গল্পের মতো সুখের সাগরে ভেসে যাওয়া সংসারে ভাসতে পারব। অবশ্য মায়ের সুখস্বপ্নরা আমার দাদি এবং বাবার কারণে আঁতুড়ঘরেই হাতড়ে মরে পড়ে থাকে। আমি দাদি ন্যাওটা। দাদি আমার পৃথিবী। দাদির সাথে খাইদাই ঘুমাই। দাদির রাতজাগা রোগ। সারারাত প্রায় জেগেই পার করেন। মানুষের স্বভাব যেটা- এটাওটা কিছু একটা নিয়ে সময় বয়ে দেওয়া, অযথা শুয়েবসে সময় কাটাতে পারে না। এমন যেন কাজ নাই তো খই ভাঁজ টাইপের- আমার দাদি সেই কিছু একটা করার অজুহাতে রাতভর আমার মাথায় বিলি কাটেন আর গল্প বলেন! আমার সেসব গল্প শুনতে শুনতে আরামে চোখ বুজে আসে এবং গভীর ঘুমে তলিয়ে যাই।

শ্রাবন মাস। চারদিকে পানি থৈথৈ করে। আমাদের হিজলতলা গাঁও নিচু হওয়ায় নদীনালা খালবিল জনবসতি সবস্তটাই বর্ষাকালে সমান সমতল হয়ে যায়। মাঠঘাট আলাদা করার যোগার থাকে না। তারপরও আমি হাঁটুজল ভেঙ্গে কলসি কাঁখে গাঙের ঘাটে যাই। গাঙ্গের ওপারের গ্রাম থেকে বেঁধে দেওয়া সময়ধরে স্নান করার উছিলায় অনিল নদীর হাঁটুজলে আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকে। আমরা জলেরঢেউ এপার হতে ওপারে ছুড়ে ছুড়ে ইশারায় ভালোবাসা বিনিময় করি। আমার এক কলস জল আনতে বেলা পড়ে যায়। ওপারের অনিলেরও একই দশা। আমি আর অনিল একই ক্লাশে পড়ি। স্কুলে দু’জনের কথা চোখেচোখে হয়, নদীর মতো অঢেল জলের ঢেউ নেই সেখানটায়। স্কুল শেষে পাশাপাশি দু’জোড়া নির্ভরতার পা একসাথে হেঁটে ফিরে অনেকটা পথ, এছাড়া অন্যকিছু নয় তারপরও আমার মনে অনিল শক্তপোক্তভাবে বাসা বাঁধে। অনিলের মন জুরেও শুধু আমিই থাকি। এমনটাই সময়সুযোগে দু’জন দুজনকে বলি এবং বিশ্বাস করি।

অর্ধেক হাঁটাপথ শেষ হতে অনিলের পথ ভিন্নপথে বাঁক নেয়। দু’জোড়া পা কিছুক্ষণের জন্যে থমকে দাঁড়ায়। সুনীল খুব কৌশলীচোখে চারপাশ দেখে নিয়ে তার বুক পকেটে হাত রাখে। সুনীলের বুকপকেটে আমার সাতরাজার ধন-সমস্ত চাওয়াপাওয়া জমা পড়ে আছে। আমি চোখ বন্ধ করে সেসবের মাঝে ডুব দিই,ভালোবাসার আবেশে ভেতর ভেতর কাঁপতে থাকি। ওটুকু অপেক্ষা আমার কাছে যেন শতসহস্র বছরের সময়ের মতো মনেহয়। সুনীলের বুকপকেট হাতড়ে দু’চার লাইনের একটা চিরকুট বেরিয়ে আসে। তড়িঘড়ি করে সে হাঁটাপথের ঘাসের ওপর তা বিছিয়ে রেখে বাঁশের সাঁকো পার হয়ে নদীর ওপারে তার বাড়িরপথ ধরে। আমি আমার বইয়ের পাতায় রাখা ময়ূরের নীলপালকের সাথে যতনে চিরকুট লুকিয়ে নিয়ে দ্রুতপায়ে বাড়ি ফিরে আসি। মা যখন সান্ধ্যপূজায় তুলসীতলায় ব্যস্ত থাকে, আমি কুপিবাতির আবছা আলোতে চিরকুট খুলে দ্রুত পড়তে বসে যাই। আমার মতো অনিলের বুকেও আমি ঠিকঠাক শক্তঘর বেঁধেছি। সুনীল স্পষ্ট করে একই কথা চিরকুটে ভিন্নভাবে আমাকে জানান দেয়।

দেশে একটার পর একটা গণ্ডগোল লেগেই আছে। বড়দের মুখে কিংবা স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে ১৯৪৭ সালের খণ্ডবিখন্ড জমিনের হৃদয়ভাঙ্গা গল্প অহরহ শুনে আসছি। দেশটা বেখেয়ালি কলমের আঁচড়ে ছিন্নভিন্ন হয়েছে,কতো নিরোপরাধ লোক মারা পড়েছে। সবচেয়ে ধকলে পড়েছে বেঁচে যাওয়া মানুষগুলো। প্রিয়জন, বংশপরম্পরায় আঁকড়ে থাকা জন্মভিটা, মুক্ত আকাশ-হাওয়া ছিন্ন হয়ে সেই ভয়ঙ্কর ঝরে লন্ডভন্ড নীড়হারা পাখির মতো উড়ে যেয়ে বাসা বাঁধতে হয়েছে ভিন্নদেশে। বাদবাকি জীবনটা অধিবাসী তকমা কপালে জুরে নিয়ে মৃত্যুসম যন্ত্রণায় কাটিয়ে দিতে হচ্ছে তাদের বাকি জীবন!
এরপরও চতুর্দশী খণ্ডিত চাঁদের মতো একচিলতে জমিনের বুকে কোনমতে দাঁড়িয়ে থাকা দেশটায় একদণ্ড স্থিরতা ফিরেনি। একটার পর একটা দুর্দশা দুঃখী দেশটার কপালে লেগেই আছে।
স্কুল থেকে মিছিল বের হয়। অনিল মিছিলে যায়। আমি মায়ের বারণে স্কুলমুখি হই না প্রায় দু’মাস। ক্লাশ বন্ধ, ঘরে বসে বসে বয়োঃবৃদ্ধ গাছের অনড় শিকড়ের মতো মনেহয় নিজেকে। সুনীলের সাথে গাঙ্গেরঘাটে জলের ঢেউয়ে আগের মতো মনেরভাব বিনিময় হয়, তাও সবদিন না। কাছাকাছি দেখা হয় না, চিরকুট পাই না- তাও বহুদিন। বইয়ের ভাঁজ খুলে ময়ূরের নীলপালকে ঢাকা বিগতদিনের চিরকুটগুলোতে যতনে হাত বুলাই,স্বপ্নসাগরে ডুবে থাকি সারাক্ষণ।

আমাদের ঘরে একটা সবুজ প্যানাসনিক ব্রান্ডের ৮ ইঞ্চি লম্বা ২ ব্যান্ডের রেডিও আছে। বাবা আর আমার অকৃতদার জ্যাঠামশাই আড়ালে আবডালে লুকিয়ে তাতে সংবাদ শুনেন, মাঝেমধ্যে আমরাও তাদের সাথে যোগ দিই। বিনাতারে ভেসে আসা সেসব সংবাদ ভয়ঙ্কর আপদদিনের আভাস দেয়। ধীরেধীরে দেশের সকলে বিপদের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। আমাদের সম্প্রদায়ের জন্যে সেটা আরও ভয়ঙ্কর। অনেকে দেশ ছেড়ে ওপার বাংলায় চলে যায় কিন্তু আমার বাবা-জ্যাঠামশায় মাতৃভূমি রেখে পরবাসী হতে রাজি নন।
একসময়ে শত্রুপক্ষ মাকড়সার জালের মতো ঘিরে ফেলে আমাদের পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইলের ছোট্ট এই দেশটাকে। আমরা সবাই তাতে বন্দি হয়ে পড়ি। মা এসময়ে পারলে আমাকে গহীন গুহায় লুকিয়ে রাখেন। ঘর হতে দু’পা দূরের পুকুরঘাটেও আমার যেতে বারণ। আমার কোথাও যাওয়া হয় না। বড়ঘাটের বকুলতলা, উঠোনের কোণের শিউলিতলা, স্কুল কিংবা গাঙ্গেরঘাট কোথাও আমার পায়েরচিহ্ন পড়ে না। অনিল হয়তো আমার জন্যে অপেক্ষা করতে করতে গাঙ্গেরঘাটে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। আমি খাঁচার বন্দিপাখির মতো ছটফট করি। একসময়ে এক সহপাঠীর মারফতে অনিলের চিঠি পাই। একটা দীর্ঘচিঠি, চিরকুট নয়। অনিল দেশের জন্যে যুদ্ধ করতে বাড়ি থেকে পালিয়েছে। যুদ্ধে শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করে ফিরে আমাকে নিয়ে ঘর বাঁধবে। আমাকে নিরাপদে থাকতে বলেছে।

একদিন ভোরবেলায় আমাদের ঘরের দরজায় পাহাড়চূড়া-ভেঙ্গেপড়ার মতো আওয়াজ হলে আমরা ঘুমন্ত মানুষগুলো আতঙ্কে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরি। ততক্ষণে দরজার কপাট ভেঙ্গে শত্রুপক্ষ আমাদের ঘরে ঢুকে পড়েছে।
মায়ের কপালে গণ্ডগোলের শুরু থেকে একফুঁটা সিঁদুর পড়েনি, বাবা চুলদাঁড়ি যদ্দুর বড় করা যায়, করেছেন। গাঁয়ের ইমামের কাছ থেকে চার কালেমা কণ্ঠস্থ করেছেন। বাবা সবসময় হাওয়াই শার্ট পরতেন। এখন অবশ্য ওসব তুলে রেখে দর্জিঘর থেকে দু’খানা খদ্দেরের পাঞ্জাবী সেলাই করিয়ে নিয়েছেন,সেসবেই অভ্যস্ত হতে বাধ্য হয়েছেন। শত্রুপক্ষ ভিন্ন দেশের। সবার মাঝথেকে আমাদের আলাদা করার সাধ্য তাদের নেই। কিন্তু আমাদের হিজলতলা গাঁয়ের হাজারবছর ধরে নদীজল হাওয়াবাতাস গায়ে মেখে একত্রে বেড়ে ওঠা একান্তই নিজঘরের প্রিয়জনের মতো প্রতিবেশিরা,- শত্রুদের আমাদের বাড়ির পথ চিনিয়ে দিয়েছে।
ওরা বাবাকে উঠোনে নিয়ে চোখমুখ বেঁধে দাড় করায়, জ্যাঠামশায়কেও। এরপর পরপর দু’খানা গুলির আওয়াজ শুনতে পাই। আমার আর কিছু মনে নেই। যখন জ্ঞান ফিরল নিজেকে ঘুটঘুটে এক আঁধার-কামরায় দেখতে পেলাম। এতটুকু অনুভব করলাম- আমি বিবস্ত্র, গায়ে একটুকরো কাপড়ও নেই। শরীরটাকে পাহাড়ের মতো ভারি মনে হচ্ছিল, পিপাসায় গলা মরুভূমির মতো শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে কিন্তু উঠে দাঁড়ানোর একফোঁটা বলও গায়ে নেই। এই আমি কোথা থেকে কোথায় এসেছি তার ঠাহর করতে পারছি না। চারদিক নিস্তব্দ। মাঝেমধ্যে কেউ একজন মিলিটারিজুতার আওয়াজে ছন্দেছন্দে আমার কামরার বাইর দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে আন্দাজ করতে পেলাম। আবার কখন ক্লান্তচোখ বুজে ফেলেছি বলতে পারব না। মোমের মৃদু আলো চোখের উপর পড়তে ক্লান্ত চোখেরপাতা পিটপিট করে বহুকষ্টে খুলে তাকাই। আবছা-চোখে চেয়ে দেখি চারপাঁচজন খাকিপোশাক পরা লোক, আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। এদের চোখ-জিহবা থেকে কুকুরের মতো লোলুপ লালা ঝরে পড়ছে। এরা উর্দুভাষায় কথা বলছে যার একটা শব্দও আমার বোধগম্য হয় না। আমার শরীরে পা দিয়ে একটা ঘুমন্ত কুকুরকে অমানুষরা যেমন করে গুতো মেরে জাগিয়ে তুলে সেরূপে এরা আমাকে জাগিয়ে তুলতে চেষ্টা চালায়। আমি জেগে আছি কিন্তু শরীরের ব্যথায় চোখ মেলে তাকানোর শক্তিটুকু পাই না। আমার গলা দিয়ে গোঙানোর আওয়াজ বের হয়ে আসে।
একসময় এরা ধৈর্য হারিয়ে ফেলে, আমার জেগে ওঠার অপেক্ষায় থাকে না। একজন একজন করে আমার প্রায়মৃত শরীরটার উপর চেপে বসে। আমি সহায় শক্তিহীন শরীরটার ভেতর কোনমতে দমটা ধরে রাখি। আমার চোখে বহুআগে দেখা- নিরীহ শশকের উপর হিংস্র খেক শিয়ালদের ঝাঁপিয়ে পড়ার দৃশ্য, বাস্তব-দৃশ্য হয়ে ধরা দেয়। এরা আমার শরীর নিয়ে নোংরা-অসভ্য খেলায় মেটে ওঠে। কতক্ষণ এই নারকীয় কর্ম চলে, আমি জানি না। বেশিরভাগ সময়ে আমি অচেতন থাকি। এরপর আমি ব্যবহার শেষে মুচড়েফেলা কাগজের ঠোঙ্গার মতো দুমরানো মুচড়ানো দেহটাকে নিয়ে ঘরের এককোণে নির্জীব হয়ে পড়ে থাকি।

একসময় মরণ গোঙানির আওয়াজে আমার হুঁশ ফেরে। আমার মতো আরও কয়েকজন ঠিক ক’জন বুঝতে পারি না, বিবস্ত্র-রক্তাক্ত মেয়েকে টেনে হ্যাচড়ে এই ছোট্ট ঘরটায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। বহুকাল অযত্নে পড়ে থাকা নুনা-ধরা দেওয়ালের বদ্ধ অন্ধকার কামরাটা আর আগের মতো নিস্তব্ধ থাকে না। তাদের সোরগোলে বড়ো বেমানান হয়ে ভরে ওঠে। মুখগুলো শক্তআঁটে বাঁধা আছে তারপরও প্রাণে বাঁচতে গোঙানির আওয়াজে কামরাটা নরকের মতো মনেহয়। অবশ্য একটা সময় পর এরা চিৎকারের শক্তিটুকু হারিয়ে ফেলে। উদোম, ইটসুরকি-উঠা ঘরের মেঝেতে নগ্নশরীরগুলো গোরস্তানের কংকালের মতো নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকে। এরপর পালা করে খাকি পোশাক পরা কাপুরুষগুলো দলে দলে ঘরে ঢুকে। মনের খাইস মিটিয়ে আবার চলে যায়, আবার আসে এবং আবার আসে। ঘরের এককোণে টিমটিমিয়ে একটি হারিকেন দিবানিশি জ্বলছে। এরআগের মোমবাতিটার নিঃশ্বাস শেষ হলে ঘর অন্ধকারেই কয়েকদিন ঢাকা পড়ে ছিল। ঘরের ভেতরের মেয়েগুলোর ফুরিয়ে যাওয়া জীবনের মতো হারিকেনের অপরিষ্কার চিমনীফুঁড়ে সামান্য আলো ঘরটায় ছড়িয়ে পড়ছে। ভেজা স্যাঁতসেঁতে ঘরটায় অমাবস্যার ঘোরলাগা আঁধার ভর করে আছে, অন্ধকার একফোঁটা কাটেনি। দিন-রাত্রির প্রভেদ বুঝা যায় না। কতোদিন এভাবে আছি জানিনা। বেঁচে আছি নাকি মরে গেছি সেটাও টের পাই না ঠিকঠাক।

বাবার চেহারাটা খুব ঘনঘন মনে পড়ছে। পশুগুলো তাঁর হাতদু’খানা টেনে পেছনে বেঁধে দেয়, তখনো চোখে কালো কাপড় পরায়নি; বাবা নিশ্চিত মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে আমার দিকে মার্বেলের মতো শক্তস্থির দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে রইলেন। ও-অসহায় চোখের দৃষ্টি সহ্য করার ক্ষমতা কোনো সন্তানের থাকার কথা নয়। আমি আমার চোখ বুজে ফেললাম এবং আমার মুখ অন্যদিকে ফেরালাম। তারপর বাবাকে ওরা ধাক্কা দিয়ে উঠোনে ফেলে দিতে চাইলে- বাবা ঘরের চৌকাঠে উল্টে পড়ে গেলেন । দু’হাত বাঁধা থাকায় নিজেকে সামলে উঠতে পারেলেন না। কপাল ফেটে দরদরিয়ে রক্ত ঝরতে শুরু করল। আমার বাবা অতিশয় ভয়কাতুরে। রক্ত দেখলে ভড়কে যেতেন। এজীবনে মুরগিটা পর্যন্ত কাটাছেঁড়া করতেন না কিংবা এসময়ে কাছেধারে থাকতেন না। সেই বাবার কপালের রক্ত উঠোনে ছড়িয়ে পড়ল। বাবা অপার্থিব চোখে তাকিয়ে রইলেন নিজের রক্তধারার দিকে।
আমি দৌড়ে বাবাকে ধরতে গেলে ওরা আমাকে খপ করে ঝাপটে ধরে ফেলে। যেমন করে একটি শেয়াল তার শিকার ধরে ফেলে সেরূপে আমাকে খাকি পোশাক পরা লোকটা নোংরাভাবে ঝাপটে বুকের কাছে চেপে ধরে, পৈশাচিকহাসি হাসে। ঘৃণায় আমার পেটের ভেতরের সমস্তকিছু উগরে বের হতে চাইছিল। মা আর ঠাকমা লোকটার পায়ে পড়ে খুব আহাজারি করছিল। তাদের কান্নায় হিজলতলা গাঁয়ের গাছপালা কাঁদছিল, বাড়ির পাশে কুলকুলিয়ে বয়ে চলা নদীটাও আহাজারি করেছিল। কিন্তু আমি একফোঁটা চোখেরপানি ঝরাতে পারিনি। আমি আমাদের ঠাকুরঘরের প্রতিমার মতো স্তব্দ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। ঠিক সেসময় পরপর দু’টো গূলির আওয়াজ ভেসে এলো। তারপর আর কিছু মনে নেই।

আমার পাশে উপুর হয়ে পড়ে থাকা মেয়েটি নিজের হাতমুখের বাঁধন খুলে ফেলেছে। আমার অবশ্য হাতমুখ বাঁধা ছিল না। এরপর সে একেএকে সবার বাঁধন খুলে দেয়। বেশিরভাগ মেয়ে চোখ বন্ধ করে নিস্তেজ হয়ে একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে আছে। কচি শরীরগুলোতে জানোয়ারদের আঁচরে দেহমন বিস্মিত হয়েছে। মৃত্যুর মতো বেঁচে থাকা মানুষগুলোর শরীর-মনে একফোঁটা শক্তি নেই। মেয়েটি অন্ধকার ঘর হাতড়ে কোথা থেকে চিড়া-গুঁড় যোগার করল। ঘরেরকোণে এসব হয়তো ওরা দিয়ে রেখেছিল। মেয়েটি বেশ চপলা। আধমরা মেয়েগুলোকে জোর করে তুলে চিড়া-গুঁড় খাইয়ে দেয়। আমি খেতে চাইনা। অভুক্ত কতোদিন মনে নেই। পেটে অম্বল জমেছে। সমস্ত অনুভূতির মতো ক্ষুধাবোধও আমার হারিয়ে গেছে। তারপরও মেয়েটি আমার চেয়ে বয়সে ঢের ছোট হবে- ছোটবোনের মতো ভালোবাসার জোরে জোর করে একদলা চিড়ে মুখে পুড়ে দেয়। আমার ঠাকমার কথা মনেপড়ে যায়।

আমি খেতে চাইতাম না। ঠাকমা কাঁসার থালায় খাবার সাঁজিয়ে গাল ফুলিয়ে বসে থাকতেন। আমি না খেলে সেও খাবে না। আমি আসলে ঠাকমার সেই আদুরে প্রতিমার মতো মুখটা দেখতে না-খাওয়ার ভান করতাম। আমার ঠাকমার বেশ বয়স হয়েছে। শরীরের মাংস শুকিয়ে হাড়ের সাথে লেপটে গেছে। চামড়া শুকিয়ে দুধেরসরের মতো কুঁচকে রয়েছে। ঠাকমা যুবতীকালে বেশ লম্বা ছিলেন। এইবয়সে এসে সেই লম্বা অংশ পিঠের উপর উটের কুঁজের মতো পুঁটুলি হয়ে জমে গেছে।
ঠাকমা আমাদের গাঁয়ের সবার ঠাকমা। নিজের পরিবারের মতো গাঁয়ের প্রতিটা মানুষের জন্যে উদগ্রীব থাকেন। সূর্য না জাগতে লাঠি ভর করে ধনুকের মতো বাঁকা শরীরটা নিয়ে হিজলতলা গাঁয়ে টইটই করে ঘুরে বেড়ান। ঠাকমা আমাকে পশুটার কাছ থেকে ছাড়াতে ওর পা ধরে খুব করে অনুনয় করছিলেন। হায়েনাটা আমার শরীর নোংরা ভাবে নাড়াচাড়া করছিল। ঠাকমা অশ্লীলকদর্য সেসব সইতে না পেরে ওর পা আরো জোরে ধরে অঝোরে কেঁদে ওঠেন। পশুটা আমার ঠাকমার মুচড়ানো কাগজের ঠোঙ্গার মতো শরীরটাকে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে লাথি মেরে মুহূর্তে দরজার বাইরে উঠোনের তুলসীতলায় কাছটায় ছুড়ে ফেলে দেয়। একদলা ন্যাতানো ত্যানার মতো দেহটা গুটিসুটি মেরে তুলসীতলায় পড়ে থাকে আমার পৃথিবী- ঠাকমা। ঠাকমার দেহটাজুরে তখনও প্রাণটা নিবু নিবু করে রয়ে গিয়েছিল কিনা, নাকি প্রদীপের শেষশিখার মতো দপ করে নিভে গিয়েছিল ! নাকি প্রায় শতবর্ষ দাপিয়ে চলা প্রাণটা শেষবিদায়ে প্রিয়জনের মায়াজড়ানো হাতের স্পর্শের অপেক্ষায় ছিলো ! এর কোনটাই আমার জানা হয় নাই।

আমি সেসময়ে আমার মায়ের আরশ কাঁপানো রোনাজারিতে চমকে উঠেছিলাম। আমার মাকে আমি এরআগে কখনো কাঁদতে কিংবা আহাজারি করতে দেখিনি। দু’বছর আগে একদিন আমার পিঠাপিঠি ভাইটা বাড়িরপাশের নদীটাতে নাইতে নেমে আর ওঠে আসলো না। সুস্থসবল লায়েক ভাইটা আমার জলেরতলে হারিয়ে গেল। সারাদিনের খুঁজাখুঁজি শেষে ভরসন্ধ্যায় খবর এলো, ভাইয়ের লাশ ভেসে উঠেছে পাশের গাঁয়ের জেলেদের মাছধরার জাঁটায়। তার দেহ বাড়িতে আনা হলো। সারা এলাকার মানুষের ঢল নামলো আমাদের বাড়িতে। সেদিনে শত্রুও চোখের পানি ধরে রাখতে পারল না কিন্তু একমাত্র আমার মায়ের চোখে কেউ পানি দেখলো না। মা একটা নরম গামছা দিয়ে ভাইয়ের ভিজে শরীরটা যত্ন করে মুছে দিলেন। নিজহাতে ভাইকে সাঁজালেন। এরপর চিতেয় নেওয়ার পূর্বপর্যন্ত পরম মমতায় মাথার চুলগুলোতে বিলি কেটে দিলেন।
বাবা আর জ্যাঠাকে হাত-চোখ বেঁধে দুয়ারে লাইন ধরিয়ে দাঁড় করাতে মা পশুদের উদ্দেশ্য টের পেয়ে যান। মায়ের খুব সাহস। কঠিন বিপদে ঘুরে দাঁড়াতে জানেন। মা, আমাদের পরিবারটিকে একা হাতে সামলে নেন। বাবা-জ্যাঠা এমনকি আমার ঠাকমা মায়েরকথার বাইরে চলেন না। তারা তাঁকে বিশেষ আমল দিয়ে চলেন। সঠিক সময়ে ঠিক কাজটি মা করতে জানেন। মা, হেঁসেলঘরে ছুটে যান। চুলার গা ঘেঁষে মায়ের তরকারি কাটার বটিটা কাত করা ছিলো। মা আলগোছে বটিটা হাতে তুলতে, পশুদের একজনের চোখে পড়ে যায়। একঝটকায় মায়ের হাত থেকে বটি কেড়ে নিয়ে মায়ের পিঠ বরাবর বটির ফলা দিয়ে ঘাড় থেকে কোমর অবধি লম্বা একটা লাইন কেটে দেয়। ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে। মা, যন্ত্রণা সইতে না পেরে চিৎকার করে ওঠেন। একটা মাত্র চিৎকারের আওয়াজ শুনি তারপর সব নিস্তব্ধ হয়ে যায়।

চপল মেয়েটি বহুক্ষণ উপুর হয়ে পড়ে আছে। পশুদল চলে গেছে তাও অনেকক্ষণ হয়। আবার পালা করে আসার সময় হয়ে এলো বলে। বাকিরা ব্যথার যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। কারো বুক-পেটে কুকুরদের কামুরে রক্ত জমাট বেঁধে কালো হয়ে আছে। আমাদের সবার হাত-মুখ এখন খোলা কিন্তু কেউ কারো সাথে কথা বলি না। অন্যসব কিছুর মতো আমাদের ভাষাও মরে গেছে কিংবা বলার মতো কিছু নেই। আমি কাত হয়ে শুয়ে আছি। উঠে বসার বল সেই কবে হারিয়েছি। মেয়েটির নাম খুব জানতে ইচ্ছে করছে। কতো হবে বয়স। আবছায়ে যতটুকু দেখেছি তাতে তের-চৌদ্দর বেশি হবে না। পশুরা যখন ঘরে ঢুকল, মেয়েটা খুব জবরদস্তি করছিল। অতটুকু মেয়ে! কিছু বুঝার আগেই সব শেষ হয়ে যাবে এমনটা মেনে নিতে পারেনি। আমি নিজেও নরকযন্ত্রণায় ছিলাম। মেয়েটি পশুটির হাত কামড়ে ধরেছিল এইটুকু বুঝতে পারছিলাম। তারপর আমারও জ্ঞান ছিল না। যখন জ্ঞান ফিরল সেই থেকে মেয়েটিকে একইভাবে পড়ে থাকতে দেখছি। আমি আবার অচেতন হয়ে পড়ি। আবার জ্ঞান ফিরে। মেয়েটি সেভাবেই পড়ে আছে। একসময় বুঝতে পারি মেয়েটির দেহে রুহুটুকু আর নেই, এই দুনিয়া ছেড়ে সে চলে গেছে। পশুদের সাথে লড়ে বীরের মতো মরে গেল। মেয়েটিকে আমার ভাগ্যবান মনে হলো। মরে যেয়ে বেঁচে গেল !

কতদিন কতমাস এমন করে বেঁচে রইলাম সেই বদ্ধঘরে জানি না। একদিন জ্ঞান ফিরে দেখি আমি হাসপাতালের বেড এ শুয়ে আছি। আমার আশেপাশে আরও অনেক আমার মতো মেয়েরা। আমাদের চারপাশ উৎসুক লোকজন ঘিরে আছে। বহুদিন পর শরীরে কাপড়ের অস্তিত্ব টের পেলাম, আমাদের হয়তো আব্রু হয়ে থাকবার সময় হয়েছে। আমাদের নরক থেকে তুলে আনা হয়েছে। বিভিন্ন চিকিৎসা চলছে। কিছুদিন পরে আমার শরীরে কিছুটা হলেও বল ফেরে। ধীরে ধীরে আমি উঠে বসতে পারি, দু’কদম কষ্ট করে হলেও হাঁটতে পারি। আমার তলপেট স্ফীত হয়ে ওঠে। আমার মতো অনেকের পেট উঁচু হয়ে আছে। কারো কারো বাচ্চা প্রসব হয়েছে। আমি নিজের শরীরে আরেকটা শরীরের অস্তিত্ব টের পাই। একদিন ডা. আমাকে সেই স্ফীত পেট কেটে পাপের চিহ্ন মুছে দেন। একসময় নিজথেকে খুড়িয়ে খুড়িয়ে হলেও হাঁটতে পারি। একদিন হসপিটাল থেকে বেরিয়ে আসি।

লোকে বলাবলি করে দেশ স্বাধীন হয়েছে। আর ভয় নেই। আমি নির্ভয়ে আমার হিজলতলা গাঁয়ে ফিরে আসি। আমাদের বাড়িটা খাঁখাঁ করছে। কেউ নেই। বাবা, মা, ঠাকমা, জ্যাঠামশাই কেউ নেই। আমি বহুদিন পর অনিলের বাড়ি যাই। অনিল বাড়ি ছিল। যুদ্ধ শেষে সে ফিরে এসেছে। অনিল আমাকে দেখে চমকে ওঠে। আমাকে খুব স্বাভাবিকভাবে সে অস্বীকার করে। আমি অনিলের চিঠিটা হারিয়ে ফেলেছি সাথে অনিলকেও। অনিলের কাছে আমি বড্ড অচেনা হয়ে গেছি। অচেনা হয়ে গেছি একই মাটি-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা আমার প্রাণের পড়শিদের কাছে, আমার প্রাণের প্রিয় হিজলতলা গাঁয়ের প্রতিটি মানুষের কাছে। তারা কেউ আমার অস্তিত্ব দেখতে চান না ! কুকুরের মতো আমাকে তাড়িয়ে দেন।
স্বাধীনদেশে আবার আমার মনপ্রাণ নতুন করে ধর্ষিত হয়। অনিলের কাছে,দেশের মানুষের কাছে, হিজলতলা গাঁয়ের কাছে, বাড়িরপাশের কুলকুলিয়ে বয়ে চলা নদীটার কাছে,আলো হাওয়া আসমান জমিন সর্বত্র- সবকিছুর কাছে। একবার নয় বার বার ধর্ষিত হতে থাকি।
তারপর তারা খুব কৌশলে আমার বাবার দেওয়া ভালোবাসার নামটি চিরতরে মুছে দেয়। আমাকে সবাই পাগলি নামে ডাকে। পথের ন্যাংটা ছেলেপুলে আমাকে ঢিল ছুড়ে মারে। আমাকে বাড়িছাড়া করা হয়। আমি রাত-বিরাতে পথেঘাটে ঘুরে বেড়াই। একটা সময় পর আমিও সবকিছু ভুলে যাই। আমার বাড়ি, প্রিয়জন এমনকি আমার বড়ো প্রিয় হিজলতলা গ্রামটিকেও।

একদিন আষাঢ়ের ভরা পূর্ণিমা-রাতে আকাশের ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ ফুটো করে ফকফকা জ্যোৎস্না-নহর ধরায় নেমে আসে। আমি শ্মশান ঘাটে যাই। শ্মশানঘাটের শানবাঁধানো ঘাটে চিত হয়ে শুয়ে পড়ি। হঠাৎ হাওয়া এসে আমাকে অসীম শূন্যে, আকাশে তুলে নেয়। আমি অসীম শূন্যতার ভেতর ভাসতে থাকি। আমার চোখদুটো মার্বেলের মতো শক্ত স্থির হয়ে মহাশূন্যের বিশালতায় চেয়ে রয়।

এ-গল্প আমার নয়। হিজলতলা গাঁয়ের শিউলিমালার গল্প। দাদির কাছে এগল্প বহুবার শুনেছি। ১৯৭১ সালে শত্রুপক্ষ তাঁকে ক্যাম্পে তুলে নিয়ে যায়। তাঁর চোখের সামনে প্রিয়জনদের একে একে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। দেশ স্বাধীন হলে সে গাঁয়ে ফিরে আসে কিন্তু কেউ তাকে গ্রহণ করে না। শিউলিমালাকে আমার দাদির মতো গাঁয়ের সবাই পাগল হয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখেছে। একসময়ে শ্মশানঘাটে মরে পড়েছিল। এবং তার লাশ থেকে শিউলিফুলের সুঘ্রাণ হাওয়ায় ভেসে ভেসে পুরো হিজলতলা গাঁ ম ম করছিল।

*******************************