You are currently viewing একটি বিকৃত লাশ এবং ৭১ || জাকিয়া শিমু

একটি বিকৃত লাশ এবং ৭১ || জাকিয়া শিমু

একটি বিকৃত লাশ এবং ৭১
জাকিয়া শিমু

ইছামতী নদীপাড়ে পচা,আধগলা একটি লাশ উপুর হয়ে পড়ে আছে! প্রকৃতিতে বর্ষাকাল চলছে। তারওপর বন্যা;পাহাড়িঢলে নেমে আসা ঘোলাজল, নদীর দুকূল উপচে আশেপাশের গ্রামগুলোকে প্রকাণ্ড এক নদীর রূপ দিয়েছে! বাড়িঘর,গাছপালা নদীতে কচুরিপানার মতো ভাসছে! নদীতে তীব্রভাবে স্রোত বইছে। স্রোতের টানে মড়া পশুপাখি এমনকী ভেসে-আসা আস্ত গাছগাছড়া শাখা-প্রশাখাসমেত মুহূর্তে নদীর কূল ছাপিয়ে বহুদূরে ভেসে যাচ্ছে! সেখানে মড়া নদীপাড়ে পড়ে আছে’- এমনকথা অবিশ্বাস্য হলেও আদতে দেখা গেল ঘটনা সত্য! মেছেপাড়ার ঘাটে তেঁতুলগাছের ডালপালা স্তুপ করে মাছ শিকারের ঝাঁট ফেলা হয়েছে, সেই ঝাঁটে,লাশ এসে আঁটকে আছে!
দেশে গণ্ডগোল চলছে- সময়কাল বড্ড খারাপ। চারদিকে প্রতিদিন কতো লোক নিখোঁজ হয়,তার ইয়ত্তা নাই! দিনে-দুপুরে পাক মিলিটারির কেড়াই-নাও, যার-তার বাড়ির ঘাটে এসে ভিড়ে এবং যাকে ইচ্ছে ধরে নিয়ে যায়! কপাল ভালো হলে ফিরে আসে, তাও আধমরা হয়ে; নয়তো লাশ হয়ে বানের জলে ভেসে ভেসে কোথায় যায়, কেউ জানে না! শনি মণ্ডলের বসতবাড়ি পুবহাটি হিন্দুপাড়ায়। সে-পাড়ায় জনাপাঁচেক হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত পরিবার কোথাও যাওয়ার জায়গা নাই বলে আতঙ্ক উৎকণ্ঠায় নাক ডুবিয়ে কোনোমতে রয়ে গেছে ভিটেমাটি আঁকড়ে। শনি মণ্ডল নিজেও ভিটেছাড়া হয়নি তবে তার হিসেব ভিন্ন! সে চাইলে পালাতে পারে। ওপার বাংলায় তার জ্ঞাতিকুলের অভাব নেই। তারা তাকে যেতে জোর করছে কিন্তু সে পণ করেছে, -মরে গেলেও বাপদাদার ভিটে ছেড়ে অন্যদেশে উদবাস্তু হয়ে যাবে না।
অবশ্য এ-তল্লাটে গণ্ডগোল এখনো দু’পক্ষের সামনা-সামনি বাঁধেনি। দু’চার মাইল দূরে ধলেশ্বরী নদীপাড়ে অবশ্য মিলিটারির সাথে মুক্তিদের কৌশলী এক যুদ্ধ বেঁধেছিল। তাও এ-গাঁয়ের লোক নিজচোখে দেখেনি তবে শুনেছে সেসব দুর্দান্ত-বীরত্বগাঁথা যুদ্ধকাহিনী।
ঢাকা থেকে পাক মিলিটারি ভর্তি লঞ্চ রওনা করে ধলেশ্বরী নদী ধরে। ধরেশ্বরী নদী ছাড়িয়ে লঞ্চ যাবে ইছামতী নদী ধরে আরোও পশ্চিমে, দোহার-নবাবগঞ্জ পাক সেনাক্যাম্পে। এ খবর গোপনে পৌঁছে যায় মুক্তিবাহিনীর কাছে। পাকসেনারা সাঁতার জানে না,পানি এদের বড়ো শত্রু কিন্তু নদীপথ ছাড়া ও-স্থানে যেতে এই ভরাবর্ষায় অন্য কোন পথও নেই। সড়কপথ ডুবে আছে জলের তলে। এমন মোক্ষম-সুযোগ মুক্তিরা হাতছাড়া করে না। গভীররাতে মুক্তিদের এ বিষয়ে মিটিং বসে। দলনেতার নির্দেশ মতো তাঁরা ওঁত পেতে থাকে মাঝনদীতে! লঞ্চ যেই ইছামতী নদীতে ঢুকে, এরা কৌশলে লঞ্চের তলায় শক্তিশালী তুরপুনে বড় বড় কয়েকটি ছিদ্র করে দেয়! লঞ্চের তলায় ছিদ্র করায় ভুড়ভুড়িয়ে পানি ঢুকে এবং অল্পসময়ে লঞ্চ পানিরতলায় তলিয়ে যায়! বেশিরভাগ পাকসেনা ডুবন্ত লঞ্চের ভেতর ডুবোজলে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা পড়ে!
তবে প্রাথমিকভাবে মুক্তিদের উদ্দশ্য সফল হলেও এরপর ঘটে চরম বিধ্বংসী ঘটনা। পাকসেনারা সবসময় জলপথে পাশাপাশি দুটি জলযান নিয়ে চলাচল করত। একটাতে সমস্যা হলে যা-তে বাকিটা রক্ষাকবজ হয়ে দাঁড়িয়ে যেতে পারে। এখানেও দুটি লঞ্চ ছিল এবং লঞ্চ দুটি বেশ কিছুটা দূরত্বে থাকায় মুক্তিদের নজরে পড়ে না।
ঘটনার আকর্ষিকতায় অপর লঞ্চের সেনারা হতবিহব্বল হয়ে পড়ে! এবং সঙ্গীদের এমন করুন মৃত্যু-দৃশ্য প্রস্তরমূর্তি চোখে তাকিয়ে দেখলেও বিকল্প কিছু সেমুহূর্তে চিন্তা করতে পারে না। আকর্ষিক তীব্র আঘাতের পরের খানিকক্ষণ মানুষ যেমন স্থির-মগ্নতায় ডুবে থাকে,সেরূপে তারাও কিছুক্ষণের বিরতি নেয়। সেসময় পার হয়ে গেলে পাকসেনারা প্রচণ্ড ক্রোধে ফেটে পড়ে এবং প্রতিপক্ষের উপর সহস্রগুন শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে! ততক্ষণে অবশ্য মুক্তিরা পালিয়ে নিরাপদ স্থানে ফিরে গেছে। কিন্তু পাকসেনারা প্রতিশোধ নিতে ইছামতীপাড়ের গ্রামগুলোতে মুক্তি খোঁজার নামে ভয়ঙ্কর হত্যাযজ্ঞ শুরু করে! তারা যাকে সামনে পেয়েছে তাকেই বন্দূকের নলায় ঝুলিয়ে মেরেছে। ঘর থেকে তন্নতন্ন করে খোঁজে ধরে নিয়ে গেছে ত্যাগড়া জোয়ান ছেলেপুলেদের এবং নদীপাড়ে একসাথে লাইন ধরিয়ে দাঁড় করে গুলি করে হত্যা করেছে! যুবতী- কিশোরী মেয়েদের টেনে হিঁচড়ে লঞ্চে ভরে নিয়ে গেছে সেনাক্যাম্পে। আচমকা এমন ভয়ঙ্কর হামলায় কেউ কেউ দিকভ্রান্ত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে নদীর অথৈ জলে এবং লম্বা জলাপথ ডুবসাঁতারে পাড়ি দিয়ে কোনমতে প্রাণটা বাঁচিয়ে আশপাশের গ্রামে এসে উঠেছে! শনি মণ্ডলের পিসিবাড়ি সেই এলাকায়, ভাগ্যগুণে সে এরূপে পালিয়ে বেঁচে গেলেও তার স্বামী এবং তাদের একমাত্র ছেলের হদিস এখনো পাওয়া যায় নাই!

শনি মণ্ডলের সারাক্ষণ মনেরমধ্যে কেমন অয়োয়াস্ত্রি লাগে, বুক ধরফড় করে। পাকসেনাদের তাঁকে চেনার কথা নয়,ধর্মবিশ্বাস কারো গায়ের গন্ধ শুঁকে বের করা যায় না। কিন্তু ধর্ম বেশধারী আদতে ধর্মহীন কিছু শয়তান দেশে ধানক্ষেতের আগাছার মতো লিকলিকিয়ে বেড়ে উঠেছে। তারা পাকসেনাদের দালাল হয়ে কাজ করছে। তাদের খপ্পরে পড়লে রক্ষা নেই। যদিও সে তার বন্ধু সেলিম লস্করের পরামর্শে চার কালেমাসহ বেশকিছু দোয়া দুরুদ গণ্ডগোলের শুরুতে বহুকষ্টে কণ্ঠস্থ করেছে।! গত ক’মাস বাড়ির বাইরে বলতে একমাত্র বন্ধু সেলিমের বাড়ি ছাড়া কোথাও যায়নি সে,ঘরবন্ধি হয়ে আছে তা সে বন্ধুর নির্দেশ মতো। চারপাশের মানুষগুলো যাদের সাথে একত্রে বেড়ে উঠেছে সে,কেমন অচেনা মুখোশে নিজেদের ঢেকে ফেলেছে! সময় বড়ো নির্মম, কাউকে বিশ্বাস করা যায় না যদিও তাঁর ছেলেবেলার বন্ধু সেলিম সেদিক থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ। সেলিম লস্কর বেঁটেখাটো একহারা গড়নের ওপর শ্যামো বরণের দেখতে অর্থাৎ সহজে কারো চোখে পড়ার মতো নয় কিন্তু দিল-টা খোলা আসমানের মতো কূলকিনারা বিহীন। সম্ভ্রান্ত বংশে জন্ম, এঅঞ্চলে বাপ-দাদা চৌদ্দ পুরুষের নামডাক বেশ পুরনোকাল ধরে।

তাঁর বড় দাদারা বিলাতের জাহাজে কাজ করত। তাঁদের ডাকা হত লস্কর নামে। একসময়ে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজ মসলাপাতি,সুগন্ধিসহ প্রয়োজনীয় মাল-সামাল ভরে কলিকাতা বন্দর থেকে ছুটে যেত বিলাতের বিভিন্ন বন্দরে। জাহাজের কাজে বিশেষ করে খালাসির কাজে বিলাতিদের পছন্দের তালিকায় ছিল বাঙ্গালি পুরুষ। দেশভাগের আগে পুরো ভারতবর্ষ এক-পাতে ছিল। মানুষ কাজের খোঁজে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে ছুটে বেড়াত। এবং এঅঞ্চলের মানুষ কাজের খোঁজে সিলেট, আসাম, কলিকাতা এসব অঞ্চলকে প্রাধান্য দিত। সেলিম লস্করের বড়দাদা কাজের সন্ধানে গেলেন আসামে। সেখানে বিলাতি এক সাহেবের সুনজরে পড়তে কাজ পেলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জাহাজে। কাজের শুরুতে জাহাজে ফুট ফরমাশ, খালাসির কাজ করলেও একসময় নিজগুণে লস্করের দায়িত্ব পেলেন। এ-কাজে টাকাকড়ি যেমন আছে নানাবিধ সুযোগ সুবিধাও তেমন আছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে গাঁয়ের অনেককে তিনি কোম্পানিতে কাজ ধরিয়ে দিলেন। বিধায় তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনে পুরোগ্রামের চেহারা দ্রুত পাল্টে গেল। একসময় ব্রিটিশরা হটে গেলে ভারতবর্ষ মুক্ত হয়; তবে ভারতবর্ষ ঝনঝনিয়ে কাঁচেরপাত্রের মতো বে-খেয়ালভাবে ভেঙ্গেচূড়ে খণ্ডবিখন্ডে ভাগ হয়ে স্বাধীন হল ঠিকই কিন্তু প্রত্যেকের জীবনধারা উলটপালট হয়ে গেল! অনেকের মতো লস্করাও কাজ হারাল। জমিদারদের মতো লস্কররা কাজ হারিয়ে প্রাচীন অতিকায় হস্তির মতো পুরোদস্তুর লোপ পেয়ে কেবল নামের শেষে পদবি নিয়ে কোনোমতে টিকে রইল। সেই বংশের সেলিম লস্কর আজ,মূখ্যত কপর্দকশূন্য একজন মানুষ! তবে বাহ্যিক বিষয়সম্পদ না থাকলেও তাঁর মধ্যে পূর্বপুরুষদের বিশেষ একটা গুণ রয়ে গেছে নিজের অগোচরেই। অন্যের উপকারেই নিজের সুখ খুঁজে পান তিনি। এই যুদ্ধকালে গাঁয়েরলোকের বিশেষকরে হিন্দু ধর্মাবলীদের একমাত্র আশ্রয়, এই সেলিম লস্কর।

বিক্রমপুরের এ অঞ্চল হিন্দু ধর্মাবলীর জনাধিক্য সেই প্রাচীনকাল থেকে। ৪৭’-এ দেশ ভাগের আগেপিছে বহু হিন্দু পরিবার ওপারবাংলায় পাড়ি দিলেও এখনো অন্যান্য স্থান হতে এ স্থানে হিন্দু আধিক্য বেশি বলা চলে। যদিও এখন ৭১’- এ হিন্দুদের মধ্যে যারা যেভাবে পেরেছে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ঘরবাড়ি জমিজিরত ফেলে কিংবা স্বল্প-দামে বেচে দিয়ে জান নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। এলাকার অনেক হিন্দু পরিবার গভীর রাতে সোনাদানা, টাকাকড়ি কোনোরকম সাক্ষী সাবতের তোয়াক্কা না করে, সেলিম লস্করের কাছে গচ্ছিত রেখে দেশ ছাড়ছে। সেলিম লস্কর বিশ্বাসীলোক, ধর্ম বর্ণভেদে তাঁকে গাঁয়ের সকলে বিশ্বাস করে। কাজেই অনেকে টিনের ট্রাঙ্কে যক্ষেরধনের মতো এতকাল আগলে রাখা পূর্বপুরুষের চিহ্ন, দলিলপত্র তাঁর কাছে গচ্ছিত রেখে নির্ভারে ওপারে চলে যায়।
পাকসেনাদের সাথে সেলিম লস্করের জানাশোনা নাই, থাকার কথাও নয়। এরা বিদেশি লোক এবং এই বিদেশীদের সেলিম লস্কর কিংবা অন্যান্যদের খবর জানা অসম্ভব। কিন্তু দেশি খচ্চরেরা পাকসেনাদের সাথে হাত মিলিয়ে গাঁয়ের হিন্দু এবং সেলিম লস্করদের মতো সজ্জন মানুষগুলোকে ধরিয়ে দিচ্ছ এবং খুন হত্যা, লুটতরাজ যাচ্ছে তাই করছে! এতদিন যাদের কারণে তারা গাঁয়ে দেদারেসে অকাজ করতে পারতো না, প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে পাক মিলিটারি দিয়ে তাঁদের শায়েস্তা করছে। সেলিম লস্কর মুসলমান, ধর্মকর্মও করেন তারপরও মিলিটারি ক্যাম্পে তাঁর ডাক পড়ে! তিনি সেনাক্যাম্প থেকে বেরিয়ে আসার সময় খেয়াল করেন তার গাঁয়ের গাঁজাল,বখিয়ে যাওয়া কিছু ছেলেপুলে আর্মিক্যাম্পে ঘুরঘুর করছে! এরা দুষ্টলোক। দুষ্টলোকের উঠাবসা হবে দুষ্টের সাথে, অবশ্যই সাধুসন্তের সাথে নয়! এরা গাঁয়ের ভেতর বেলেল্লাপনা,জোরদখল করে! এদের দৌরাত্নে বৌ-ঝিরা ঘরের বাইর হতে ভয়ে তটস্থ থাকে। সেলিম লস্কর গাঁয়ের মুরব্বী,গাঁয়েরলোকের বিভিন্ন অভিযোগে বারকয়েক তাদের বিরুদ্ধে বিচার শালিসও তাঁকে করতে হয়েছে। তিনি প্রথম দেখায় অবশ্য এদের চিনতে পারেননি! এদের বেশভূষার অহেতুক পরিবর্তন হয়েছে! মাত্র কয়েকমাসের ব্যবধানে গাল-মুখজুড়ে ছাগলের মতো ছোপ ছোপ দাড়িতে ছেয়ে গেছে, পরনেও বেমানান ভিনদেশি-আলখেল্লা, চোখেরকোণে সুরমার ধূসরনীলচে রঙ! ধর্মকর্মের বালাই নেই অথচ কী অবলীলায় নিজের অবয়ব ছেড়ে ধর্মীয় খোলসে ঢুকে পড়েছে! তাদের সাথে উত্তরপাড়ার বাবুল মিয়াঁকেও দেখা গেল! সে এলাকায় দাদন ব্যবসা করে। সেলিম লস্করকে দেখে সে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দেয়। পোকেখাওয়া দাঁতে খিলখিলিয়ে হাসে, ঘন ঘন শাহাদাত আঙ্গুলে গুড়াকু নিয়ে পোকখাওয়া দাঁতগুলো ঘষামাজা করে- অশ্লীল সে-দৃশ্য! সেলিম লস্করের গা ঘিনঘিন করে ওঠে। তিনি হাত না মিলিয়ে পাশ কাটিয়ে ক্যাম্পের বাইরে চলে আসেন। এবং বাবুল মিয়াঁকে দেখে সেনাক্যাম্পে নিজের তলবের কারন স্পষ্ট বুঝতে না পারলেও কেমন যেন বিপদের আঁচ পান এবং ভবিষ্যৎ দুর্ভাবনায় বিষণ্ণ মনে বাড়ির পথ ধরেন!

উত্তরহাটির নিরঞ্জন সরকার সাতসকালে রঙচটা এক ভারী টিনেরট্রাঙ্ক মাথায় নিয়ে সেলিম লস্করের উঠোনে ধপাস করে নামিয়ে রাখে। শনিমণ্ডল উঠোনের কোণায় বসে বন্ধু সেলিমের কাছে গতকালের সেনা ক্যাম্পের ঘটনা শুনছিল। ঝনঝনানি শব্দে তাঁদের সম্বিৎ ফেরে। নিরঞ্জন সরকারের উপস্থিতি টের পেতে শনি মণ্ডল মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে ফিরে। তাদের দু’জনের স্বেচ্ছায় মুখ দেখাদেখি বন্ধ আছে। যদিও নিরঞ্জন সরকার তাঁর স্বকূলের কিন্তু সে মন্দলোক! গাঁয়ে সবাই তাকে এড়িয়ে চলে। সেলিম লস্কর নিজেও তাকে পাত্তা দেয় না কিন্তু গাঁয়েরলোকের ভালোমন্দের দায় স্বেচ্ছায় নিজকাঁধে নিয়েছেন বিধায় সে অধিকারে ট্রাঙ্ক গচ্ছিত রাখতে সে বাড়ির পরে আসার সাহস পায়। শনি মণ্ডল সপ্রতিভ-লোক, মন্দলোকের কু-মতলব বুঝতে পারে। সে চোখের ইশারায় বন্ধুকে সতর্ক করে কিন্তু বন্ধু তা অবজ্ঞা করে নিরঞ্জন সরকারের ট্রাঙ্ক তাঁর শোবারঘরের খাটের তলায় যত্ন করে রেখে দেয়!

শনি মণ্ডলের বউ ইন্দুবালা অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেল! গাঁও-গেরামে বেড়ে-ওঠা মেয়েলোক সাঁতার জানে না- এমন তাজ্জব কথা আজন্মে কেউ শুনছে বলে মনে হয় না। বাপেরবাড়ি নদীর তীরঘেঁষা, সারাদিন নদীর পানিতে দাপাদাপি করে লায়েক হয়েছে। শনি মণ্ডলের বাড়িও নদী থেকে কয়েক কাইকের পথ। নদীর সাথে জীবন তার অষ্টেপৃষ্টে বাঁধা। কিন্তু সে সাঁতার জানে না। এ-কথা এতকাল মানুষ জেনে থাকলেও ঠিকঠাক বিশ্বাস করত না কিন্তু আজকের ঘটনা তা প্রমান পেল! সে যে বেঁচে ফিরেছে , সে-ও এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা বটে!
ইন্দুবালা প্রতিদিন ভোরসকালে কদুলীগাছের ভেলা চালিয়ে বিল থেকে শাপলা,কলমিলতা,হেলেঞ্চা শাক তুলে আনে। বেলা নাই উঠতে গাঁয়ের ঘরে ঘরে সেসব বেচাবিক্রি করে। যে’কটা পয়সা জুটে তা দিয়ে সংসার টেনেটুনে কোনোমতে চালিয়ে নেয়, এই যুদ্ধকালিন দুর্যোগকালে। শনি মণ্ডল জাতব্যবসায় কাঠমিস্ত্রি। দেশের এমন অবস্থায় গত ছ’মাসে কোথাও কাজ পায় নাই! এমন দুর্যোগকালে মানুষের যেখানে জানপ্রাণের একমুহূর্তের ভরসা নেই সেখানে ঘরদোরের চিন্তা মাথায় আসার কথাও নয়! সে ভরদুপুরে বেচাবিক্রি শেষ করে বাজার থেকে সদাইপাতি নিয়ে বাড়ির পথ ধরতে ভেলা ভাসায়। গাঁয়ের রাস্তায় কোমরজল। ডহরডাঙার এখন আর প্রভেদ করা চলে না! চারদিকে জল থৈথৈ করছে। তার ভেলা গাঁয়ের খালের ভেতর ঢুকতে সে তাকিয়ে দেখে উল্টোপথে পাকসেনাদের কেড়াই নৌকা গাঁয়ের ভেতর ঢুকছে! সেনাদের গায়ে ধূসররঙা ইউনিফর্ম, মাথায় গোল আকৃতির টুপি, চারদিকে বন্দুক তাক করে ধরে আছে! সে ইহজন্মে মিলিটারি দেখে নাই। তবে তাদের ঘৃণ্য-কার্যকলাপ লোকমুখে এমন কী শনি মণ্ডলের বোন সাক্ষাৎ দেখে এসেছে, তার কাছে শুনেছে। মিলিটারি মানে সাক্ষাৎ যমদূত, আজরাইল! এমনটা ভাবতে ভাবতে ভয়ে তার মাথা কেমন যেন চক্কর দিয়ে ওঠে এবং টুপ করে খালের জলে পড়ে যায়! খালের অথৈ জলে হাবুডুবু খেয়ে বানেরস্রোতে ভাসতে ভাসতে চলে যায় বহুদূরে ইছামতী নদী যেখানে মোচড় মেরে বাঁক বদল করছে, সেখানে। বাঁকঘেঁষে একঝাঁক বাঁশেরঝোপ,জলের নিচে গাছের গোঁড়া। তার বিধস্ত- শরীরটাকে নদীরস্রোত টেনেটুনে একসময় বাঁশঝারের গোঁড়ায় আটকে দেয়। ওপাড়ার এক লোক মাছ ধরতে সেপথ ধরে নাও বেঁয়ে যাচ্ছিল হঠাৎ তার চোখ আঁটকে যায়, লাল ডোরাকাটা শাড়িতে, যা কিনা ঢেউয়ের টানে পানির উপর দুলছিল। শেষে অবশ্য সে লোকের দৌলতে আধমরা অবস্থায় সে উদ্ধার পায়! তবে সে জানে বেঁচে গেলেও প্রাণটা যে তার এরপর পুরোপুরি মরে যায়!

সেলিম লস্কর দুপুরের খাওয়া শেষে অভ্যাস মতো শরীরটাকে একটু বিছানায় গড়িয়ে নেয়। সারাদিনের ক্লান্তি ঝরাতে ভাতঘুম তার শরীরে বেজায় কাজ দেয়। তাঁর শোবার ঘরের দখিন বরাবর জানালা দিয়ে অতিরিক্ত গরমেও কোথা থেকে কে জানে, ভুরভুরিয়ে হাওয়া ঢুকে। অবশ্য ওদিকটা যতদূর চোখ যায় ধুধু খোলা প্রান্তর। বাড়ির সীমানা পেরিয়ে দিগন্ত ছুঁয়া ত্রিফসলী খোলা মাঠ। বছরে তিনবার এখানে তিন রঙের ফুল-ফসলে ভরে যায়। চোখ ধাঁধানো সেসব দৃশ্য। এখন ভরা বর্ষায় অবশ্য চারদিকে জল থৈ থৈ করছে, জলের সমুদ্র। যতদূরে চোখ যায় জল আর জল তাতে হাওয়া উড়ে উড়ে ঢেউ জাগিয়ে তুলেছে।
সেলিম লস্কর জানালার ও-ধারে চোখ রেখে ঢেউতরঙ্গ দেখছিলেন। হঠাৎ শোয়া অবস্থা থেকে ধরমরিয়ে ওঠে বসলেন! বারকয়েক দু’হাতে চোখ কচলে নিজ মনে বিরবির করলেন! তবে ঠিক দেখছেন, ভুল নয়! মিলিটারির নৌকা ঢেউতরঙ্গ ছেদ করে তাঁর বাড়ির দিকে ধেয়ে আসছে এবং নাওয়ের গুলুইয়ে বাবুল মিয়াঁ দাঁড়িয়ে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসছে! তিনি নিজেকে শান্ত রেখে বিছানা থেকে নামলেন,বেতমোড়া চেয়ারের হাতলে রাখা সাদা পাঞ্জাবিটা গায়ে জড়ালেন। জানালার কপাট বন্ধ করলেন। এবং দরজার খিল শক্ত করে আঁটকে ওপাশে দাঁড়াতে, দরজায় ধুরুম ধুরুম লাথির শব্দ শুনতে পেলেন! তিনি কেঁপে উঠলেন! শব্দ ক্রমশ জোরালো হল এবং একের পর এক লাথিতে পুরনোকালের দরজার কবজি ঝুরঝুরিয়ে ভেঙ্গে পড়ল! সেলিম লস্কর তাকিয়ে দেখেন,-উঠোন ভরে গেছে মিলিটারিতে! এসময় মেজর, যার সাথে তাঁর ক্যাম্পে সেদিন সাক্ষাৎ হয়েছিল, তিনি সাথে আরও সাত আটজন সেনা ভাঙ্গাদরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গেল! এসময় বাবুল মিয়াঁ দোরের পাশে এসে দাঁড়ায়। এবং একগাল পানেরপিক বিকট শব্দে থু করে দরজার চৌকাঠে ছুঁড়ে দেয়। বিশ্রি-পোকাখাওয়া হলদেটে দাঁত কেলিয়ে সেলিম লস্করের দিকে তাকিয়ে হাসে এবং তাঁর গা-ঘেঁষে এসে দাঁড়ায়। শরীর থেকে আঁশটে ভাগাড়ের মতো দুর্গন্ধ নাকে এসে লাগতে, ঘৃণায় সেলিম লস্কর সরে এসে বদ্ধ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে।

তারা প্রায় ঘণ্টাখানেক ঘরদোর তন্নতন্ন করে খুঁজে কিছুই উদ্ধার করতে পারে না! ঘরে অতি সাধারন কিছু আসবাবপত্র এবং নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপাতি ছাড়া সন্দেহজনক কিছুই নেই! এসব তছনছ করে সময়ের অপচয়ে মেজরের চোখেমুখে চরম বিরক্তি ফুটে ওঠে। তিনি বাবুল মিয়াঁর দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যান। অর্থাৎ বাবুল মিয়াঁর তথ্য ভুল প্রমানিত হয়েছে! সেনারা বেরিয়ে গেলেও বাবুল মিয়াঁ তার পরিণতি বুঝতে পেরে কী না, ঘরের ভেতর শকুনিচোখে কী যেন খুঁজতে থাকে! এবং একসময় কাঙ্ক্ষিত সে-বস্তু সে পেয়েও যায়! নিরঞ্জন সরকারের সেই টিনের ট্রাঙ্ক,টেনেহিঁচড়ে খাটেরতলা থেকে বের করে নিয়ে আসে! ততক্ষণে সেনাসহ মেজর ফিরে যেতে উঠোনের পাশে নৌকায় ওঠে বসেছে! বাবুল মিয়াঁ তালঠোকা কায়দায় ট্রাঙ্ক দুহাতে ঝাঁপটে ধরে উঠোনে দাঁড়িয়ে গুপ্তধন পাওয়ার আমেজে চেঁচিয়ে মেজরকে উদ্দেশ করে ভাঙ্গা ভাঙ্গা উর্দু শব্দে, তার তথ্যের সত্যতার প্রমান দেয়!
সেলিম লস্করের বুকটা ছ্যাঁত করে ওঠে! শনি মণ্ডল আসলেই পোড়া-লোক। তাঁর আশঙ্কা অমূলক ছিল না। ট্রাঙ্কটি তাঁকে ফাঁসাতে নিরঞ্জন সরকারকে দিয়ে বাবুল মিয়াঁ আঁতাত করে পাঠিয়েছিল! এটা বন্ধু সেদিন তাঁকে ইশারায় বলেছে কিন্তু সে তা আমলে নেয়নি! বন্ধু বিজ্ঞলোকের আদলে একটি কথা সবসময় বলে,“পৃথিবীতে সবাইকে বিশ্বাস করে বোকারা তবে কিছু কিছু মানুষকে অবিশ্বাস করে নির্বোধরা! ট্রাঙ্কটি খোলা হলে ভেতরে একটি গণেশ মূর্তি এবং পুজোর বিভিন্ন জিনিসপত্র পাওয়া যায়। বাবুল মিয়াঁ ইতোমধ্যে বেশকিছু উর্দু শব্দ রপ্ত করেছে সেসবের সাহায্যে এবং হাতপা চোখমুখ নেড়েচেড়ে গণেশ মূর্তির বিষয়আশয় মেজরকে বুঝিয়ে বলে!

মিলিটারি সেলিম লস্করকে ধরে নিয়ে গেছে’- সেখবর গ্রামসুদ্ধ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু তাঁকে কেনো মিলিটারি ধরে নিয়ে যাবে, চোখে-মুখে একছোপ উদ্বিগ্নতা নিয়ে গাঁয়ের সকলে প্রশ্ন তুলে! ভালো মানুষ, ধর্মকর্ম করে এমন মানুষকে ধরে নিয়ে গেল, ভেবেচিন্তে তারা কুল কিনারা পায় না! বন্ধুর খবর শোনার পর থেকে শনি মণ্ডলের দিন-রাত সমান হয়ে গেছে। চোখের ঘুম উবে গেছে। এপর্যন্ত যত লোককে মিলিটারি তুলে নিয়ে গেছে,তাদের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে ফিরে এসেছে তাদের সিকিভাগেরও কম। এর আগে অবশ্য আরও একবার সেলিম লস্করের ডাক পড়েছিল সেনাক্যাম্পে কিন্তু সেটার কারণ ভিন্ন ছিল। মেজর নিজে এসে তাঁর ঘর তল্লাশি করে অবৈধ মাল হাতেনাতে পেয়েছে এবং জনসম্মুখে তাঁকে দড়ি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে নৌকায় তুলে সেনাক্যাম্পে নিয়ে গেছে! গাঁয়ের বহুলোক সেদৃশ্য দেখেছে এবং চোখের জল ফেলেছে। যদিও এসব গুজবে এরা বিশ্বাস করে না। সেলিম লস্করের কাছে অবৈধমাল পাওয়া গেছে’- এমন গাঁজাখুরি গপ্প শুনলেও যে মহাপাপ হবে! কিন্তু শনি মণ্ডল তা বিশ্বাস করে। নিরঞ্জন সরকারের রঙচটা টিনেরট্রাঙ্কটি তার চোখের কোণায় ভাসতে থাকে!

ইন্দুবালার চোখে একফোঁটা ঘুম নেই, ভয়ে রাতভর জেগে থাকে! নিজের মনে সারাক্ষণ কীসব বিরবির করে বকে যায়। সেই ঘটনার পর থেকে বাজারঘাট দূরে থাক একদিনের জন্যে ঘরের বাহির হয়নি! দিনে দিনে অবস্থা আরও বেগতিক হচ্ছে! অন্ধকার ঘরেরকোণে বিড়ালের মতো চার হাতপা গুঁটিয়ে বসে থাকে! বদ্ধ পাগল বনে গেল! ভয়-আতঙ্ক শুধু ইন্দুবালা কিংবা শনিমণ্ডলের মনে নয়,তাতে জড়িয়ে গেছে গোটা জাতি! তারপরও শনিমণ্ডল পেট বাঁচাতে বেরিয়ে যায়। উপোষে শরীর বড়ো কাহিল হয়ে গেছে। সে ইন্দুবালার ভেলাটি ঠেলে বিলের দিকে হেলেঞ্চা শাকের খুঁজে বের হয়। যদি কিছু তুলে এনে উত্তরপাড়ায় বিক্রি করা যায়, সেই আশায়। খালেরপাড় ধরে ভেলা ছুটতে,পথে বাবুল মিয়াঁর সাথে দেখা হয়ে যায়! সে গয়না নৌকার গলুইয়ে পা ঝুলিয়ে আয়েসি ভঙ্গিতে বসে আছে। মুখে পিশাচী হাসি! হাতের ইশারায় তাঁকে ভেলা থামাতে বলে। সে বাবুল মিয়াঁর নৌকো ঘেঁষে ভেলা ভিড়াতে বাধ্য হয়। বাবুল মিয়াঁ তাঁর মুখের খুব কাছে ঝুঁকে এসে সেলিম লস্করের কথা জানতে চায়! এবং শনিমণ্ডলের উত্তরের অপেক্ষা না করে, উচ্চস্বরে পিশাচের মতো নোংরা দুর্গন্ধে ভরা পোকাখাওয়া দাঁত কেলিয়ে হাসে! বাবুল মিয়াঁর বিকৃত হাসির অর্থ শনি মণ্ডলের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় এবং বন্ধুর ভয়ঙ্কর বিপদের আঁচ করতে পেরে সে দিশেহারা হয়ে যায়! এবং এঘটনার পাঁচদিন পর মেছেপাড়ার ঘাটে,ফুলেফেঁপে ঢুল হওয়া বিকৃত সেলিম লস্করের লাশটি ঝাঁটায় এসে আঁটকে থাকে!

*****************************