একটি গ্রাম্য সালিশের ইতিবৃত্ত
জাকিয়া শিমু
করিম বেপারীর বাড়ির দক্ষিণে, শতবর্ষীয় এক হিজল গাছ। বয়সের পোড় গাছের বাকলে খাঁজ হয়ে বসে গেছে। কুমিরের পিঠের মতো খাঁজকাটা গাছের গুঁড়ির সাথে চোরকে শক্তপোক্তভাবে বেঁধে রাখা হয়েছে। খাঁজের আঁচড়ে চোরের পিঠ বেঁয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত ঝরছে।
মানুষের ঢল নামে করিম বেপারির বাড়িমুখি। গাঁয়েরলোকের বিনোদনের রসদ কম। সামান্য উপলক্ষে শত শত মানুষের মুহূর্তে জড়ো হওয়া, অতি- তুচ্ছ ঘটনা ! ইছামতী নদীর এপার ওপারের গ্রামগুলো থেকেও মানুষ ছুটে আসতে শুরু করেছে। মহিলারা হাতের কাজ ঝেরে ফেলে কোলের বাচ্চাকে মাটি থেকে ঝাপটে তুলে মানুষের ঢলের সাথে মিশে যাচ্ছে। গাঁয়ের বয়োবৃদ্ধরাও হাঁটুগেঁড়ে বসে নেই। সবেমাত্র বর্ষাজল মাঠ থেকে নেমেছে। মাঠের এবড়োথেবড়ো অমসৃন জলকাদা পথ ভেঙ্গে জোরপায়ে মানুষের মিছিলের সাথে তারাও সমান তালে ছুটছে। মানুষগুলোর চোখেমুখে রহস্যজনক উৎকণ্ঠা। “চোর’- যেন ভিনগ্রহের এলিয়েন!
চোর দর্শনে অবশ্য কারো মনের আক্ষেপ তেমন একটা মিটেছে বলে মনে হয় না। এ-তো চোর নয়, পাশের গাঁয়ের মতি মিয়া। আধপাগলা মরাধরা-কংকালসার বাচ্চাছেলে। মানুষগুলোর মুখে হতাশার ছাপ। চোরকে গুটিকয় চরথাপ্পড় দিলে পঙ্গুরও পুরুষত্ব বাড়ে। কেউ কেউ আরোও একধাপ এগিয়ে এটাকে নাগরিক দায়িত্ব-কর্তব্য এবং ধর্তব্য মনে করে ! কিন্তু কংকালসার,হাড়গোড় লড়বরে মতি মিয়াঁকে মেরে সে- হাউস মোটের উপর মেটে না! তারপরও যে মতিপাগলার কপালে কিলঘুসি,লাথিঝাঁটা জুটে নাই তা কিন্তু নয়। অতি উৎসাহীরা হাঁটুভাঁজ করে বসে নেই। এরমধ্যে কয়েকপ্রস্তে কিল ঘুষি তাঁর কপালে জুটে গেছে। আঘাতের জেরে মতি মিয়ার বামচোখ লালগোল্লার মত ফুলেফেঁপে টসটসে হয়ে আছে। শরীরজুড়ে কিলঘুষি, নোখের আঁচড়ের চিহ্ন। পিঠ থেকে বিন্দু বিন্দু রক্ত ঝরছে। কিন্তু তাতেও সকলের মনের আক্ষেপ দমেছে বলে মনে হয় না।
গাঁয়ের বাজার থেকে বাদাম,আইসক্রিম, আঁচারের খুচরা দোকানপাট এরই মধ্যে করিম বেপারির উঠোন সেঁটে বসে গেছে। কেউ একজন মতি মিয়ার প্রতি দয়া-দাক্ষিণ্য দেখাতে, বাদামের ঠোঙ্গা হাতে ধরিয়ে দিয়েছে। মতি মিয়াকে ফুরফুরা মেজাজে দুহাতের শক্তবাঁধন সামান্য ঢিলে করে বাদাম ছুঁলে খোসা ফুঁ দিয়ে খেতে দেখা যায়। বাচ্চারা তাতে দারুণ মজার রসদ খুঁজে পেলেও অনেকের বিশেষ করে বদরুল চেয়ারম্যানের চ্যালাদের মেজাজ বিগড়ে যায়। তাঁদের একদল এরইমধ্যে চেয়ারম্যানের কাছে ছুটে গেছে। এটাই মোক্ষম সময়, মতি মিয়াকে জনমের মতো শায়েশ্তা করার।
চেয়ারম্যান সাহেব বাড়ি নাই। পাশেরগাঁয়ে বিকেলে শালিস ডাকা হয়েছে। শালিসের আগে দু’পক্ষের সাথে তার গোপন বৈঠক সারতে হয়। এটা অবশ্য তার আর দশটা অলিখিত নিয়মের একটা! গাঁয়েরলোক এখন এসবে অভ্যস্ত হতে বাধ্য হয়ে গেছে। টাকাকড়ির হিসেবনিকেশেরে ঝক্কিঝামেলা তাঁকে পোহাতে হয় না; তার সুযোগ্য চ্যালারা তাকে এসবের পথ বাতলে দিতে তার সাথে সদা- সর্বদা -সদর্পে লেপটে থাকে। “সূর্যের চেয়ে বালুর তেজ বেশি”-এসব কাজ দেখভাল করতে চ্যালারা বেজায় সরেস।
চেয়ারম্যান সাহেব বাদী কিংবা বিবাদীর উঠোনে বসে বাড়ির লোকজনের দুঃখ দুর্দশার গল্প শুনেন। তার মন ভারাক্রান্তের ভারে ন্যুজবুজে হয়। মাঝেমধ্যে জায়গা বিশেষ জনদরদী চেয়ারম্যানের চোখজোড়ায় রাজ্যের অশ্রুজল জমে দীঘির জলের মতো টলমল করে। সহজ সরল গাঁয়েরলোক তাতে খুশিতে উদ্বেলিত হয়। এ সুযোগে চ্যালারা বাড়ির মুরব্বীকে গোপনে আলাদা করে ডেকে নিয়ে চেয়ারম্যানের সম্মানীর বিষয়ে একটা বিহিত করেন। চেয়ারম্যানের খায় খরচের একটা ব্যাপার আছে ! মান্যগণ্য মানুষ ! দুপক্ষের মাঝে যে বেশি সম্মানী দেয় সালিশের জিত তার পক্ষে যায়। ন্যায় – অন্যায় হিসেব নিকেশের অযাচিত বাড়তি সময় জনদরদী চেয়ারম্যানের হাতে নেই !
মতি মিয়াকে কয়েকপুস্তে উত্তম মাধ্যম দেয়া হয়েছে। সে এখন অনেকটাই ক্লান্ত। ক্লান্তিতে তার চোখের কোনে একসমুদ্র ঘুম জমেছে। কিন্তু চারপাশের লোকজনের চিৎকার চ্যাঁচামেচিতে ঘুমানোর ফুসরত মেলা ভার। কার্ত্তিক মাস- বেলা নাই উঠতে, বেলা পড়ে যায়। মতি মিয়ার পেটে গতরাত থেকে তেমন কিছুই পড়েনি। উপোস হয়ে আছে, সামান্য কটা বাদাম জুটেছে বটে! পেট ক্ষুধায় চোঁ চোঁ করছে।
চেয়ারম্যানের লোকেরা মতি মিয়ার বিচারের ফয়সালা মাইক যোগে ঘোষণা দিয়েছে। এবং মানুষের ভিড় কিছুটা হলেও কমতে শুরু করেছে।
বাদ- আছর মতি মিয়ার বিচার শুরু হবে এবং বিচারের রায়ও মাইকে ঘোষণা এসেছে। মতি চোরার হাত কেটে ফেলা হবে। অবশ্য চোরের ভাগ্যে ধর্ম মতে এমন বিচার ধার্য করা হয়েছে -তাতে মানুষের হাত নেই। গাঁয়ের মৌল্ভি সাহেবকে সামনে রেখে চেয়ারম্যানের লোকেরা ফয়সালা দিয়েছে যদিও মৌল্ভি সাহেব মাথা নিচু করে অসহায় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মৌল্ভি সাহেবের মাথা উঁচুনিচুতে চ্যালাদের মাথা ব্যথা নেই। সবই তাদের মর্জি।
গাঁয়ের সাধারন জনগণের কথা সামান্য চিন্তায় রেখে মৌল্ভি সাহেবকে উপস্থিত রেখে বিচারের রায় ঘোষণা হয়েছে, তাতে ধর্মীয় ব্যখ্যার প্রয়োজনবোধ করার আক্ষেপ কারো ( মৌল্ভির) থাকলেও সে সুযোগ দেয়া হবে না- চ্যালাদের কড়া নির্দেশ। চেয়ারম্যান এবং তার চ্যালাদের উপর কথা বলার হিম্মত এ এলাকায় কারো নেই। গুটিকয় মুরব্বী অবশ্য রায় ঘোষণায় নাখোশ হোন কিন্তু চেলাদের গর্জনে তাদের মুখে ‘র’ ফোটার জো থাকে না। মহিলারা দ্রুত পায়ে বাড়ির দিকে পা ফেলে। চট জলদি কোনোমতে কুটাবাছা-রান্নাবাড়া শেষ করে, আছর ওয়াক্তের আগে সালিশে ফিরতে হবে।
মতি মিয়া ছিঁচকে- ছ্যাঁচড়া টাইপের চোর। ভবঘুরে, বোকাসোকা- আলাভোলা চেহারার। ধরণ- সুরতে তা ফুটে উঠে বৈকি। বয়েস ঠিকঠাক মতো বলার জো নেই। কুড়ি- একুশ হবে হয়তো। সারাদিন টুঁ টুঁ করে মাঠে ঘাটে, ঝোপেঝারে, নদীরপাড়ে ঘুরে বেড়ায়। ফসলী জমির আল-পাড়ে ঘুরঘুর করে এবং সময় সুযোগ মতো আনাজপাতি কোঁচড়ে খুব কৌশলে চালান করে দেয়। তবে স্থানিয় বাজার হাঁটে তার আনাগোনা একটু আধটু বেশিই। বিশেষ করে যখন পেটে খুব ভোক লাগে। চা-পুরির দোকান ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থেকে সময় সুযোগ মতো দু একটা লুঙ্গির তলে গুঁজে আড়ালে আবডালে চলে যায়। কেউ কেউ অবশ্য তাকে ডাকখোঁজ করেও খাওয়ায়। চেয়েচিন্তে এবং কখনও ছ্যাঁচড়া চুরি করে দিন কাটালেও তার নিজস্ব কিছু রীতিনীতি আছে। সেসব অবশ্য বোঝদার মানুষদের বোধের শিকড় ধরে ঠিকঠিক নাড়া দেয়।
সে ভুলেও নিজগাঁয়ে চুরি করে না। নিজের প্রয়োজনের বাড়তি কিছুতে তার আগ্রহ নেই। আজকের জন্যে যতটুকু দরকার ততটুকু সে যোগার করে। আশেপাশের গ্রামগুলো থেকে দিনের আলোতে চেয়ে-চিন্তে,হাতটানে যেটুকু পায় তাতেই সে সন্তুষ্ট থাকে। রাতে সে ঘরের বাইরে বেরোয় না। বহুবার সে এমন ছ্যাঁচড়া চুরি করে ধরা পড়েছে এবং উত্তম মাধ্যম শেষে ছাড়াও পেয়েছে। কিলঘুষি তার কাছে নস্যি। কিন্তু…
গতবছর ভরা বর্ষারাতে উত্তরপাড়া বদরুল চেয়ায়ম্যানের গাঁয়ে ঘটল এক অঘটন। চারদিকে বর্ষারজল থৈ থৈ করে। এ-বাড়ি থেকে ও-বাড়ি যেতে গলা – কোমরজল, কোথাও কোথাও ডুবসাঁতার। খুব নিদানে না পড়লে কেউ কারো বাড়ির সিমানা মাড়ায় না।
আঁকাশে আষাঢ়ে- পূর্ণিমার চাঁদ। ফকফকা জ্যোৎস্না। গাঁও গেরাম ডুবে আছে বর্ষাজলে। চাঁদের ঘোরলাগা আলোকছটা ঠিকরে পড়ছে বর্ষাজলের ছাদে। কুলসুম বেগমের বাহ্যে চাপলে ঘরের কপাট ডিঙ্গে দুয়ারে বের হয়। দুয়ারে কোমরজল। উঠোনের একপাশে উঁচু মাচাঁতে তার মুরগির খোঁয়াড় বেঁধে রাখা আছে। সেখানে চোখ পড়তে সে মরাচিৎকার জুড়ে দেয়। তার আস্ত খোঁয়াড় গায়েব। গোটা পনের মোরগমুরগিতে ঠাঁসা ছিলো খোঁয়াড়, তার একমাত্র খেয়েপরে বেঁচে থাকার সহায় সম্বল। নিশুতিরাতে কুলসুম বেগমের বুকফাটা প্রলাপে পড়শিদের ঘুম ভাঙলেও কারো কোনো সারা পাওয়া যায় না। মাঝরাতে সাঁতারজল ভেঙ্গে তার বাড়ি ছুটে আসা মহামুসিবতের কাজ। অবশ্য ভোরের নীল-আলো ফুটতে পড়শিরা তার বাড়িমুখি হয়। চেয়ারম্যানের কানেও সে ঘটনা পৌঁছে যায়। চেয়ারম্যানের লোকদের চোখ পড়ল- মতি মিয়ার উপর। চেয়ারম্যানের বাড়ির গোটাপাঁচেক বাড়ি উত্তরে মতি মিয়াঁর বাড়ি। কুলসুম বেগমের বাড়ি থেকে অবশ্য সে বাড়ির সীমানা ঢের দূরে- গাঁয়ের একদম শেষ সীমানায়। কিন্তু গোটা এলাকায় চাওর হলো–মতি মিয়াঁ মুরগীচোর!
মতি মিয়াকে গত কদিন এ তল্লাটে দেখা যায় নাই। তার শরীরে মাত্রা ছাড়া জ্বর চলছে। এমনিতে সাধারণত তাকে এপাড়ায়- ওপাড়ায় টইটই করে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। তার চলার একমাত্র বাহন, বাবার আমলের একখানা মাটির ভাটি- মটকি। গোলাকৃতি সে ভাটির ভেতর কোনোমতে দেহটাকে গুঁজে দিয়ে ছোট্ট বাঁশের বৈঠা বেঁয়ে জলেরছাদে ভেঁসে বেড়ায়। ঝিলেরধারে শাপলা কলমিলতা তুলে আনে। মাঝেমধ্যে এ-বাড়ি ও-বাড়ির দুয়ারে চালখুদ-কুটোনাটা চেয়েচিন্তে নিয়ে বাড়ি ফিরে। কিন্তু গত বেশ কদিন হয় তাকে কেউ দেখেছে বলে মনে করতে পারে না। জ্বরের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় সে ঘরের বাইরে যেতে পারেনি। সংসারে অন্ধ মা আর একমাত্র বিয়ের লায়েক বোন। এক আধ-পেট খেয়ে, না- খেয়ে কোনোমতে তারা দিন পার করছে।
চেয়ারম্যানের ডিঙি নৌকায় জ্বরে জবুথবু মতি মিয়াঁর দেহখানা টেনে হিঁচড়ে তার চ্যালারা তুলে নিয়ে আসে। চেয়ারম্যান সাহেবের উঁচু ভিটা,জলেরসমুদ্রে মাথা উঁচু করে সদর্পে দাঁড়িয়ে আছে। বর্ষারজল তাকে কিংবা তাদেরকে কাবু করতে পারে না। উঁচু উঠোনের মধ্যিখানে মতি মিয়াঁকে বাঁশেরখুঁটির সাথে শক্তেপুক্তে বেঁধে রাখা হয়েছে। মতি মিয়াঁ জ্বরের প্রকোপে প্রলাপ বকে যায়। চোখ বুজে আসে, শরীরে থরথরিয়ে কাঁপন ধরে। গতরে একখানা ছেঁড়াফুটা গামছা জড়ানো। সে বেহুঁশ হয়ে বাঁশেরখুঁটিতে মাথা ঠেস দিয়ে বসে থাকে। চতুরপাশে ঘিরে আছে গাঁয়ের লোকজন। তাদের চোখমুখে মতি মিয়াঁর জন্যে বড়ো মায়া। অবশ্য চেয়ারম্যানের কাছের লোকদের চেহারায় প্রতিহিংসার দাবানল দোজখি আগুনের মতো জ্বল জ্বল করে জ্বলে ওঠে। চেয়ারম্যান অতিমাত্রার চতুরলোক, ভেতরের লোলুপ্সা চেহারা বাহিরের চেহারা সুরতে মাখতে দেন না। তার ভেতরে বইছে বজ্জাতি ভাবনা- এ মোক্ষম সুযোগে মতি মিয়াঁকে যদি একটা উচিত শিক্ষা দেয়া যায় !
সালিশের সময় বাদ যোহর। সময়ের আগেই বর্ষার জলকাদায় মাখামাখি হয়ে শ’দুয়েক মানুষ জড়ো হয় চেয়ারম্যানের উঠোনে। চেয়ারম্যান এবং তার সাঁজানো সাক্ষীরা শলাপরামর্শ শেষে ঘর থেকে উঠোনে ফিরে। চেয়ারম্যানের সাথে মতি মিয়াঁর চোখাচোখি হতে– মতি মিয়াঁ একদলা থুথু চেয়ারম্যানের মুখ বরাবর ছুঁড়ে মারে। উপস্থিত জনগণ মুহূর্তে স্তম্ভিত হয়ে যায়। চেয়ারম্যানের লোকেরা মুহূর্তে ঝাপিয়ে পড়ে মতি মিয়াঁর রুগ্ন শীর্ণ দেহের ওপর। চেয়ারম্যান হাসিমুখে এগিয়ে এসে তার দলের লোকদের সরিয়ে নেন। যদিও ভেতরে তার প্রতিহিংসার আগুনের দলা আগ্নেয়গিরির লাভার মতো লাফিয়ে ওঠে।
সাক্ষীদের চমৎকার সাক্ষ্যপ্রমানে মতি মিয়া মুরগি চোরায় সাব্যস্ত হয়। রায় অনুযায়ী মতি চোরার দুহাত কব্জি অবধি কেটে ফেলা হবে। সমস্যা বাধে অন্যখানে। সালিশ কমিটি জুরিতে যায়- কিন্তু তারা দুহাত কাটার পক্ষে সবাই একমতে পৌঁছতে পারে না। বেশিরভাগ লোক এক হাত কাটার পক্ষে সাঁয় দেয়। জুরি শেষে এবং সবার সম্মতিতে একহাত এবং ডানহাত কাটার পক্ষে রায় হয়। চেয়ারম্যান বেশ শাহিমেজাজে বিস্তারিত রায় পড়ে শোনায়। রায়, পড়া শেষে সালিশ কমিটির সাক্ষরও যুক্ত করা হয়। চেয়ারম্যান সাহেব ঝানুলোক, কাঁচা কাজে ফেঁসে যাওয়ার ফাঁক-ফোকর রাখতে রাজী নন !
সালিশ বেশ পাকাপোক্তভাবে-ই শেষ হয়। কোনো ফাঁক ফোকরের অবকাশ থাকে না। এবং জনদরদী চেয়ারম্যানের পক্ষ থেকে কুলসুম বেগমের জন্য আগামী ছ’মাস খরপোষের ব্যবস্থা করা হয় এবং বর্ষার জল নেমে গেলে খোঁয়াড় এবং মুরগির ব্যবস্থাও করে দেয়া হবে বলে নিশ্চয়তা দেয়া হয়। সন্তোষজনক রায়ে কুলসুম বেগমের খুশি হবার যথেষ্ট কারণ থাকলেও তাকে কেমন যেন বিমর্ষ দেখায়। নানান ভাবনা মাথায় এসে গোলমাল পাকিয়ে দেয়। ঘোরপাক শুধু কুলসুম বেগমের মাথায় নয়, সালিশে উপস্থিত প্রায় সবার মনেও হাজারো প্রশ্ন উঁকিঝুকি দেয়। সেসব প্রশ্ন অবশ্য গলা অবধি এসে কৈ মাছের ত্রিকোণা কণ্টকের মতো পুক্তভাবে আটকে থাকে।
সাক্ষীদের ভাষ্যে- মতি মিয়াঁ একা নিশুতি রাতে খোঁয়াড়সহ মুরগি চুরি করে পালায়। খোঁড়ায়, কুলসুম বেগমের বাড়ির পাশের পাটখেতে ফেলে রেখে মুরগি নিয়ে পালিয়ে যায়। সবার উপস্থিতিতে সাক্ষীর দেখানো পাটক্ষেত থেকে খোঁয়াড়ও তোলা হয়। ভিজা গামছায় মুরগির গলা পেঁচিয়ে শিবরামপুর হাঁটে নিয়ে সেসব মুরগি বিক্রি করে মতি মিয়াঁ।
চমকপ্রদভাবে মুরগিক্রেতাকেও শালিসে হাজির করা হয়। ক্রেতা কিভাবে, কোথায় এবং কতো দরদামে মুরগি কিনেছে সেসব বিস্তারিত ময়না পাখির মতো গড়গড়িয়ে বলে যায়। মতি মিয়া বিস্মিত দৃষ্টিতে ক্রেতার দিকে চেয়ে থাকে। জীবনে কখনো তার সাথে এ-লোকের দেখা হয় নাই, এই প্রথম তার সাথে সাক্ষাত। সে স্তম্ভিত হয়ে নির্বিকার তাকিয়ে থাকে ক্রেতার দিকে, মুখের ভাষা হারিয়ে যায়। তীব্র ঘৃণায় আরেক দলা থুথু অবলীলায় মুখের ভিতর জমা হলে সে ক্রেতাকে লক্ষ করে ছুঁড়ে দেয়। চ্যালারা এ সুযোগে এবারও তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এবার অবশ্য চেয়ারম্যান তাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসেন না। মতি মিয়াঁর চোখের ঠিক নিচে নীল হয়ে কদমফুলের আকৃতিতে ফুলে ওঠে। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে। চোখের ঘোলাটে জ্যোতি ধীরে ধীরে নিছক অন্ধকারে ঢেকে যায়। সে জ্ঞান হারায়।
গুণীজনে কয়-’ ধর্মের কল বাতাসে নড়ে’। কিন্তু এখানে সহসা যা ঘটল তাতে ধর্মের কল শুধু বাতাসে নড়ল-ই না, সাজানো গোছানো সমস্ত আয়োজন মুহূর্তে তছনছও হয়ে পড়ল। মজলিসে দুলাল মিয়া ( চেয়ারম্যানের চ্যালাদের একজন সহসা ঢুঁকরে কেঁদে ওঠে। দুলাল মিয়ার ভেতরটা শামুকের ভেতরের মতো নরম মোলায়েম, দয়া মায়ার অতল সমুদ্র। পেটের দায়ে চ্যালামি করলেও এতবড়ো মিথ্যা রায় তার বিবেককে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয়। নিজের প্রায়াশ্চিত্তের কথা সে মুহূর্তে ভুলে যায়। সালিশে শত লোকের সামনে সে প্রকৃত সত্য ঘটনা গড়গড় করে বলে যায়।
নিজে এবং চেয়ায়ম্যানের দলের আরও দশ বারো জন মিলে মুরগি চুরি করে এবং তা মতি মিয়াঁকে ফাঁসানোর উদ্দেশ্যে। চেয়ারম্যান নিজে তাদের এ বুদ্ধি বাতলে দিয়েছেন। মতি মিয়াঁকে চোর সাব্যস্ত করতে চেয়ারম্যানসহ তাদের এ-জঘন্য কাজের বর্ণনা শুনে সালিশে উপস্থিত প্রায় সকলে স্তম্ভিত বনে যায়। চেয়ারম্যান জঘন্য খারাপ লোক তা গাঁয়েরলোকের কাছে নতুন কোনো বিষয় নয় কিন্তু সামান্য এক আধ- পাগলা ছেলেকে নিয়ে এমন নোংরা ষড়যন্ত্রে সকলে বাক্যহারা হয়ে যায়। চেয়ারম্যান কাজের তাড়া দেখিয়ে তড়িৎগতিতে সালিশ থেকে কেটে পড়ে। এবং সে যাত্রায় মতি মিয়া শাস্তি থেকে রেহাই পায়।
কিন্তু এবারের বিষয়আসয় সম্পূর্ণ ভিন্ন। মতি মিয়াকে হাতেনাতে ধরা হয়েছে। করিম বেপারির বড় ছেলেটা তাদের ঘরের জানালার কাছে বসা ছিল। উঠোনে লম্বা তারের দড়িতে সাতসকালে কেচে দেওয়া কাপড় রোদের আঁচে শুকাতে দেওয়া হয়েছে। মতি মিয়াঁর পরনে সেই কবেকার লুঙ্গিটা কয়েক জায়গায় ফুটা হয়ে আছে। লোকজন তার লুঙ্গি নিয়ে মশকরা করে। ভারী লাজ লজ্জার কথা। এসব বিবেচনায় মতি মিয়া, পড়িমরি করে একটা লুঙ্গি দড়ি থেকে টেনে নিয়ে তার কোঁচরে ভরে নেয়। লুঙ্গিটা খুব কাজ দেবে এমন স্বস্তিদায়ক ভাবনায় যখন বাড়ির সীমানা ছেড়ে বের হবে। করিম বেপারির ছেলে পেছন থেকে তাকে ঝাপটে ধরে। কূলহারা মতি মিয়াঁ নির্বিকার থাকে। কোনোরকম ছল চাতুরি না করে কোঁচর থেকে লুঙ্গি বের করে করিম মিয়ার ছেলেকে ফিরিয়ে দেয়। কিন্তু তা-তে তার শেষ রক্ষা হয় না।
করিম মিয়াঁর ছেলে মরা চিৎকার শুরু করলে বাড়ির লোকজন এগিয়ে এসে মতি মিয়াঁকে শক্তপোক্তভাবে বেঁধে ফেলে। চিৎকার চেঁচামেচিতে আশেপাশের লোক জড়ো হয়। বিস্তারিত শুনে চেয়ারম্যান তার দলের লোকদের সাথে নিয়ে ঝড়োয়া মিটিং করেন। বিকেলের নির্ধারিত সালিশ স্থগিত করেন। করিম বেপারিকে তার কাঁছে ডেকে পাঠান। গোপন শলাপরামর্শ করেন।
করিম বেপারি চেয়ারম্যানের কাছেরলোক। সে পরপর দু’বার ইলেকশনে চেয়ারম্যানের হয়ে কাজ করেছে। মোটা অঙ্কের টাকাও ইলেকশনে খরচ করে চেয়ারম্যানের পক্ষে ভোট কিনেছিল। ইলেকশনের পর করিম বেপারি স্বাভাবিকভাবেই চেয়ারম্যানের খোশ নজরে থেকে যায়। পড়শির সাথে জমি জিরাত ভাগ বাটোয়ারের সময় চেয়ারম্যানও তার পক্ষ নিয়ে তাকে বাড়তি সুবিধা পাইয়ে দিয়েছে। এবং এ গাঁয়ের নামে সরকারি বন্দোবস্তের দানখয়রাত চেয়ারম্যান,তার সাথে সবসময় ভাগজোক করে খায়। করিম বেপারি অকৃতজ্ঞ নন, সেসব প্রাপ্তির কথা তার স্মরণে আছে। তাছাড়া আসছে শীতে নামার ডেঙ্গাটার একটা বিহিত করতে হবে। চেয়ারম্যানের সুনজর না পেলে বহু টাকার সম্পদ ডেঙ্গাটা হাতছাড়া হবে বৈকি। চেয়ারম্যানের কথা মতো ছেলেকে সাঁজানো ঘটনা বারকয়েক কণ্ঠস্থ করান। ছেলেটা বরাবরই একটু সহজ সরল। শিখিয়ে দেয়া বুলিও ঠিকঠাক মতো আওড়াতে পারে না। সালিশে যাতে বিপদ না হয় সেদিক থেকে চেষ্টার কমতি রাখা হয় না।
মতি মিয়ার মত সাধারণ আধ-পাগলা এবং তার হাঁটুর বয়সী ছেলের সাথে চেয়ারম্যানের রেষারেষির বিষয়টা তার খুব কাঁছের দু চারজনের কাঁছে জানা থাকলেও গাঁয়ের বাদবাকিরা তেমন খোলাসা করে কিছুই জানে না। তবে একদম যে ধারণা করতে পারে না তা কিন্তু নয়। সাধারণ মানুষের ভালোমন্দ বোঝার ক্ষমতা তথাকথিত শিক্ষিত অন্ধের চেয়ে একটু বেশিই বটে কারণ তারা মানবিক চোখ দিয়ে পৃথিবী দেখে। তাঁদের বিবেকবোধ, শেষরাত্তিতে আঁকাশের বুকে জেগে থাকা নক্ষত্রের মতো এখনও জ্বল জ্বল করে জ্বলে আছে বলেই পৃথিবীতে এখনও সত্যের জয় হয়। অথচ বেশিরভাগ শিক্ষিতমানুষ, “শিক্ষিত” নামক তকমা গলায় ঝুলানোর সাথে সাথে মানবিকতা বিষয়টা খুইয়ে ফেলে। চেয়ারম্যানের কুকর্মে গাঁয়ের লোকজন অতিষ্ঠ হলেও এসব ‘করিম বেপারিদের’ জন্যে তাদের পক্ষে কিছু করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। চেয়ারম্যান শুধু চাল, গম চুরি করেই ক্ষান্ত হয় না; এলাকার বৌ- ঝিরাও এর কুদৃষ্টি -কুকর্ম থেকে রেহাই পায় না।
বছর দুই আগে একদিন ভরসন্ধেবেলায় চারদিক নিষক কালো অন্ধকার করে আষাঢ়ি বৃষ্টি নামে। এমন বর্ষণ, দুহাত দূরের জিনিসও দৃষ্টিগোচর হয় না। মুহূর্তে গ্রামের মেটে পথেঘাটে হাঁটুজলে ভরে যায়। মতি মিয়া বাড়ির অদূরে স্থানিয় বাজারে চায়ের দোকানে আটকা পড়ে। এমন ঘোরবর্ষণ, থামার কোনো লক্ষণ নাই। কিন্তু সহসা মতি মিয়ার বাড়ির জন্য মনটা অতিরিক্ত ছটফট করে ওঠে। এমন দুর্যোগে দোকানের বাঁশের ঝাঁপ সবার অলক্ষ্যে সামান্য ফাঁক করে সে রাস্তায় নেমে পড়ে।
কাকভেজা হয়ে বাড়ি ফিরে। বাড়ির সীমানা ঘেঁষতে ঝড়ের বাতাসের সাথে মায়ের চিৎকারের শব্দ কানে এসে লাগে। মতি মিয়াঁ দৌড়ে ঘরের কাছে যায়। দুহাতে কপাট আঘাত করে কিন্তু কেউ ভেতর থেকে তা খুলে দেয় না। কপাটে কান রাখতে ভেতরে ধস্তাধস্তির আওয়াজ ভেঁসে আসে। মতি মিয়া শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে দোরে আঘাত করলে ভগ্নপুরনো ঘুণেখাওয়া কপাট ভেঙ্গে গড়িয়ে পড়ে। ঘরময় মিশমিশে অন্ধকার ! চেয়ারম্যা্ন এবং তার এক চ্যালা ,বোনের শরীরের উপর জোর জবরদস্তি করছে। মা একহাতে তার হাঁটার লাঠির উপর ভর করে অন্যহাতে জমাটবাঁধা আঁধারে মেয়েকে হাতড়ে বেরাচ্ছেন। মুহূর্তে মতি মিয়ার দীর্ণশীর্ণ শরীরে অশুরের শক্তি ভর করে। একঝটকায় মায়ের হাতের লাঠি টেনে নিয়ে চেয়ারম্যানের মাথা বরাবর আঘাত করে বসে। চ্যালা মুহূর্তে লাফ দিয়ে ঘর হতে বের হতে পারলেও চেয়ারম্যান লাঠির আঘাতে ঘুরে পড়ে যায়। আঘাতটা মাথায় না লেগে চেয়ারম্যানের বাঁ হাতের কনুয়ে লাগে। আঘাতের তীব্রতায় কনুয়ের হার ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। ঘটনা বিভিন্নভাবে ধামাচাপা দেয়া হলেও সেই থেকে মতি মিয়াঁর প্রতি চেয়ারম্যানের ক্রোধের বহ্নি দাউদাউ করে জ্বলছে।
মাইকে ঘোষণার পরপরই লোক জমায়েত শুরু হয়। করিম বেপারির উঠান উপচে মানুষের ঢল নামে। জায়গা সঙ্কুলানে চেয়ারম্যানের কথা মতো মতি চোরাকে স্থানিয় খেলার মাঠে সরিয়ে নেয়া হয়। মতি মিয়ার দুপায়ে একফোটা জোর নেই। তাকে পেছনে হাত বাঁধা অবস্থায় টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয় খেলারমাঠে। মানুষের মিছিলের ঢলও মতি মিয়াঁর পথ অনুসরণ করে এগিয়ে যায় মাঠের দিকে। মতি মিয়াঁর আন্ধা মা এবং বোনকে দেখা যায় মানুষের মিছিলের সাথে সাথে এগিয়ে যেতে। মায়ের একহাতে লাঠি অন্যহাত সামনে বাড়িয়ে ছেলেকে ছুঁয়ে দেখার বুকফাঁটা আকুতি। বোনের চোখের অশ্রুধারা শুকিয়ে গালের উপর কালো আস্তরণ হয়ে ঢেকে আছে।
বিশাল মাঠ লোকে লোকারণ্য। সাধারণ মানুষের চোখেমুখে ভয় আতঙ্কের ছাপ। ভয়ঙ্কর তামাশা দেখে পৈশাচিক আনন্দ পেতে অনেকে অবশ্য অত্যন্ত ব্যগ্র হয়ে অপেক্ষা করছে। চেয়ারম্যানের উপস্থিতি টের পেয়ে তার চ্যালাপ্যালাদের কণ্ঠে ঝরে আনন্দের উষ্মা ! তাদের মিলিত কণ্ঠের জয়ধ্বনিতে চেয়ারম্যান দুহাত শূন্যে দোলাতে দোলাতে মানুষের ঢলের ভেতর হয়ে তার নিদিষ্ট আসনে এসে বসেন।
সালিশে চারগ্রামের গন্যমান্য লোকসহ শপাঁচেক লোকের বেশি লোকের জমায়েত হয়। বিচার কাজ শুরু হয়। বিপক্ষ দলের লোকের অভব না হলেও মতি মিয়াঁর পক্ষের লোকের কোনো সারাশব্দ নেই। মা, বোনকে মাঠের পুবপাশে ভয়ক্লেশে জড়োথরো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। মতি মিয়াঁকে কেন্দ্র করে যেভাবে লোক দাঁড়িয়ে আছে, সার্কাস দেখার মতো উৎসুক চোখে মতি মিয়াঁর মা-বোনকেও লোকে বেষ্টন করে আছে।
সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। করিম বেপারির বড় ছেলেটা বাপের স্বভাবের কিছুই পায় নাই। শেখানো তরজমা ঠিকঠাক মতো বলতে পারল না। জনসম্মুখে সাধারন লোকের পক্ষে তরতাজা মিথ্যা বলা সহজ কাজ নয়। চেয়ারম্যান, করিম বেপারির দিকে বিষধর গোখরাসাপের মতো শীতল দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। করিম বেপারি ভয়ে কুঁকড়ে যায়। আসছে মাঘে মাঝেরচকের মাছের ডেঙ্গাটার- কার্ত্তিক ঘোষের সাথে একটা ফয়সালা হওয়ার কথা ছিল। চেয়ারম্যান তাকে ধরাবান্ধা কথাও দিয়েছেন। বর্ষাজল নেমে গেলে ডেঙ্গায় প্রচুর মাছ আটকা পড়ে। সেসব মাছ শীতের শেষে গায়েগতরে বেড়ে বিশাল আকৃতির হয়। শহরগঞ্জ থেকে মাছের বেপারিরা এসে চড়াদামে কিনে নিয়ে যায়। একদাগে মোটাঅঙ্কের টাকা হাতে আসে। টাকাটা এবারও হাতছাড়া হোল বলে। পোলা হইছে স্বভাবচরিতে শতভাগ মায়ের মতো। করিম বেপারির ঘরের বউয়ের উপর চরম রাগ ওঠে। রাগে তার শরীর কাঁপে।
মায়ের সোনারবালা মতি মিয়ার কুঁচর থেকে কিভাবে উদ্ধার হলো! সে ঘটনার একমাত্র সাক্ষী করিম বেপারির ছেলে, সবিস্তারে বর্ণন করে। ‘সোনারবালার’ স্থলে তার মুখ ফসকে “লুঙ্গি” শব্দটা বেরিয়ে আসে। সে মুহূর্তে বাবার অর্থাৎ করিম মিয়াঁর দিকে চোখ পড়তে সে সাথে সাথে তার ভুল বুঝতে পারে এবং শোধরে নেয়। পরবর্তীতে সে আবার সোনারবালা’’ বলতে যেয়ে লুঙ্গি’ শব্দটা উচ্চারণ করে অর্থাৎ একই অবস্থার পুনরাবৃত্তি করে। সালিশজুড়ে হাসির হিরিক পড়ে। নেংটা ছেলেপুলেও হাসিতে গড়াগড়ি যায়। সাক্ষী বারকয়েক গলা খাঁকারি দেয়। গলায় মরুভুমির তৃষ্ণা ঠেকে। সামনে রাখা সিল্ভারের পানির জগ মুহূর্তে গলায় ঢেলে পেছন রাস্তা দিয়ে সে বাড়ির পথ ধরে পালিয়ে বাঁচে। করিম বেপারিকে মাথা নিচু করে বসে থাকতে দেখা যায়। তবে লুঙ্গিটা যে মতি মিয়ার কুঁচরে পাওয়া গেছে সে তথ্যে একরত্তি মিথ্যে নেই। এরকম চুরি মতি মিয়া অহরহ করে। এবং তা গাঁয়েরলোকে যেমন জানে মতি মিয়া নিজেও তা অকপটে স্বীকার করে।
চেয়ারম্যান সাহেব চতুর লোক। সঠিক কাজটি কখন- কোথায়- কীভাবে করতে হবে, সে বিষয়ে তার চেয়ে ভালো অত্রঅঞ্চলে কেউ পারঙ্গম আছে বলে জানা নেই। এমন চতুরতার কারনে পরপর তিনবার চেয়ারম্যানের পদে সে সদর্পে টিকে আছে। উঁচুমহলের সাথে তার লাইনঘাটও বেশ পরিস্কার। এসব কারণে এ অঞ্চলে তার উপরে কথা বলার হিম্মত কেউ সামনা সামনি দেখায় না।
করিম বেপারির ছেলেকে নিয়ে হাস্যরসের মধ্যিপথে চেয়ারম্যান উঠে দাঁড়ালে সালিশে পিনপতন নিরবতা ফেরে। চেয়ারম্যান সময় ক্ষেপণ না করে সোজাসাপটা রায় ঘোষণা করেন। “লুঙ্গি চুরির অপরাধে মতি মিয়াঁর ডান হাতের কব্জি অবধি কর্তন করা হবে” ! রায় ঘোষণার মুহূর্তে সালিশে গুঞ্জন ওঠে। সামান্য একটা লুঙ্গি চুরির দায়ে হাত কাটা পড়বে, এমন রায় একমাত্র চেয়ারম্যানের চ্যালারা ছাড়া কারো পক্ষে মেনে নেয়া সহজ হয় না। যদিও কেউ চড়া গলায় চেয়ারম্যানের কথার বিপক্ষে কিছু বলতে সাহস করে না কিন্তু অন্যায় রায় মেনে নিতেও অনেকের বোধে আঁচড় লাগে। মতি মিয়াঁ একদলা থুথু আগের মতো চেয়ারম্যানকে লক্ষ করে ছুঁড়ে মারে। চেয়ারম্যান অবশ্য তাতে কোনোরকম ভ্রূক্ষেপ করে না। চেয়ারম্যানের পক্ষের লোকেরা হর্ষধ্বনি দেয়। রায় কার্যকরের সমস্ত আয়োজন চেয়ারম্যানের লোকেরা আগেভাগে ঠিক করে রেখেছিল। যাতে দ্রুত তা কার্যকর করা যায়।
শেষমুহূর্তে গুঞ্জন পাল্টা গুঞ্জনের মাঝে সাদামাটা অতি সাধারণ বেশের একজন মানুষকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। যিনি এতক্ষণ মাথা নিচু করে মনোযোগ দিয়ে চেয়ারম্যানসহ বাদবাকিদের বক্তব্য খুব মনোযোগ দিয়ে শুনেন। তিনি স্থানিয় হাইস্কুলের দীর্ঘদিনের প্রধান শিক্ষক। আশেপাশের চৌদ্দ গাঁয়েরলোক -এ যুগেও তাঁকে পরম সমীহ করে চলে। তিনি অত্রঅঞ্চলের বাতিঘর। সাধারণ মানুষ অতি আগ্রহ নিয়ে তাঁর ভাষ্য শুনার অপেক্ষায় নিশব্দে দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু চেয়ারম্যানের লোকেরা বরাবরের মত ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। মতিমিয়াঁকে ইতিমধ্যে টেনে হিঁচড়ে মাঠের নিদিষ্টস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে রায় কার্যকর হবে।
প্রধান শিক্ষকের ঠোঁটে বিদ্রুপসম হাসির রেখা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি মতি মিয়াকে ফেরত আনার নির্দেশ দেন। মতি মিয়াকে চেয়ারম্যানের পাশে দাঁড় করানো হয়। সালিশে দ্বিতীয়বার পিনপতন নিরবতা ফেরে। প্রধান শিক্ষক বলেন— “ বিচার অবশ্যই উচিত হয়েছে। তা-তে কারো কোনো দ্বিমত থাকার কথা নয়। কিন্তু মতি মিয়ার হাত কাটার আগে বিচারের রায় প্রদানকারী চেয়ারম্যানের হাতটা কি স্ব-স্থানে থাকার কথা?” তিনি সালিশে উপস্থিত শত মানুষের উদ্দেশ্যে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেন। এ সময় সালিশে উপস্থিত সাধারন জনস্রোতের মধ্যে তুমুল উত্তেজনা দেখা দেয়। তারা এতক্ষণে সাহস-ভরসা ফিরে পায় এবং সমস্বরে চেয়ারম্যান এবং তার চ্যালাদের শাস্তির দাবিতে সোচ্চার হয়।
গাঁয়ের লোকদের সাথে রেখে প্রধান শিক্ষক যথার্থ রায় ঘোষণা করেন। তিনি বলেন,-” মতি মিয়াঁর হাত যদি কাটতেই হয় তবে চেয়ারম্যানের হাতটা আগে কাটতে হবে”।
এ যাত্রায়ও মতি মিয়া রক্ষা পায়।