You are currently viewing একজন মন্টুর ময়না বু / এইচ বি রিতা

একজন মন্টুর ময়না বু / এইচ বি রিতা

একজন মন্টুর ময়না বু

এইচ বি রিতা

ভূমিকাঃ বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস এলেই প্রবাসের মাটিতে হেঁটে হেঁটে নিজ জন্মভূমি ও মাটির তীব্র একটা গন্ধ পাই। মন উদাস হয়ে উঠে, কখনো অন্যদের মুখে বাংলাদেশ সৃষ্টির সাহসী গল্পও পাশাপাশি বর্বরতার ঘটনাগুলো শুনে গা শিউরে উঠে। যুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ, বর্বতা, স্বাধীনতা- কিছুই নিজ চোখে দেখিনি। জন্মেছি দেশ স্বাধীন হবের এক যুগের বেশি পর। তবু, খুঁটে খুঁটে  ইতিহাসের পাতা উলটে পড়ি, মানুষের মুখে শুনার চেষ্টা করি বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিবৃত্তান্ত।
একদিন, এমনই কিছু আবেগ অনুভূতি নিয়ে কথা হয় আমার এক বন্ধুর সাথে। তার মুখে শুনি যুদ্ধের এক নির্মম ঘটনার কথা, যা এখনো কারো রাতের ঘুম কেড়ে নেয়।সেই বাস্তবিক ঘটনা  অবলম্বনেই আমার আজকের ‘মন্টুর ময়না বু’ গল্পটা লেখা। কারণবশত ঘটনার মূল চরিত্রের  প্রকৃত নাম আড়াল করা হয়েছে। —এইচ বি রিতা

১৯৭১ এর এপ্রিল মাস। জন্মভুমি কেশবপুরে তখনো পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতার ছোঁয়া লাগেনি। তবে মাঝরাতের নির্জনতায় দুই একটা গুলীর শব্দ কানে আসতো। একদিন খেতে বসে বাবা বলছিলেন,

“মন্টু রে, দেশে যুদ্ধ শুরু হইয়া গেছে। পাক হানাদার বাহিনী ঢাকায় অনেক লোক মাইরা ফালাইসে। কবে জানি আমাগর দিকে আহে।”

কাকে যেনো বিড়বিড় করে বলতে শুনতাম, “বাঙালিগর বিনাশ করতে তারা উইঠা পইড়া লাগসে। এই হারামিগুলারে যদি একবার পাইতাম…”

আমি তখন ৯ বছরের শিশু। কারো কথার কোন সারমর্মই  তেমন মাথায় ঢুকেনি।

কয়েক সপ্তাহ পরেই, এক বিকেলে পাশের গ্রাম থেকে ফুপু চলে এলেন আমাদের বাড়িতে। বললেন, ওদের গ্রামে পাক হানাদাররা ঢুকে পরেছে। বাড়িঘর পুড়ছে, লুটপাট করছে, মানুষ ও নাকি মারছে।

ফুপু আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নেয়ার কিছুদিনের মধ্যেই দেশ জুড়ে পাক হানাদার বাহিনীর নাশকতা বৃদ্ধি পেতে লাগলো।

তারা নির্বিচারে মানুষ খুন করতে লাগলো। পাক হানাদাররা শহর ও গ্রামের অসংখ্য বাড়িঘর পুড়িয়ে দিতে লাগলো। নারী, বৃদ্ধা, শিশু কেউ রেহাই পেলনা। বিভিন্ন হোটেল, কলেজ, প্রাসাদ, অফিস, আদালত, থেকে শুরু করে গরিবের কুঁড়েঘরগুলো পর্যন্ত সব ধ্বংস করে দিতে লাগলো । লুটতরাজরা এমনকি গ্রামের মানুষের গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগী, টাকা,  স্বর্নালঙ্কার সবই লুট করতে লাগলো। অনেককেই তখন হত্যা করে কূপে ফেলে মাটি চাপা দিয়ে দিতেও শুনেছি।

দিনটি ছিল শুক্রবার। সাধারণত প্রত্যুষে মানুষের ঘুম ভাঙে পাখির কলতানে। কিন্তু সেই দিনটি আমাদের গ্রামবাসী ও আমাদের পরিবারের জন্য ছিলো এক ভয়াবহ পৈশাচিক যাতনার। বিশাল আকৃতির জঙ্গী বিমানের বিকট শব্দ, মেশিন গানের ব্রাশ ফায়ারে আমাদের তন্দ্রা কাটে।

বেলা যত বাড়তে থাকলো, গুলির শব্দ আর মানুষের আর্তনাদের শব্দ  ততই স্পষ্ট কানে বাজতে লাগলো। একসময় আগুনের কুণ্ডলী

উপরে উঠতে দেখা গেলো।

বাবা বললেল, আজই গ্রাম ছেড়ে পালাতে হবে। যা আছে সব বেঁধে নাও। মা আমাদের কাঁথা বালিশ আর কিছু কাপড় জড়ো করে পুটলা বেঁধে আনলেন। ফুপু ও তার দুই মেয়ে সহ, তখনই বাবা আমাদের নিয়ে ঘর ছেড়েবেরিয়ে পরলেন।

ততক্ষণে গ্রামের মাঠে নেমে পড়েছে শতশত মানুষের ঢল। যে যেভাবে পারছে এদিক-ওদিক ছুটছে।

সবার একটাই লক্ষ্য, নদী পার হতে হবে। নদীর ওপারে কি আছে, তা কারোই জানা নেই। তবু মানুষ ছুটছে প্রাণপণে নদীর ঘাটে।

বড় বড় হেলিকপ্টার গুলো মাথার উপর ঘুরপাক খাচ্ছে। কি বিকট শব্দ। শত শত গ্রামবাসীর ভয়ার্ত চোখ। তারা তাকিয়ে আছে ভয়ানক আতঙ্ক নিয়ে, আকাশ নয়, আকাশের বুকে বহনকারী যন্ত্রটির দিকে। মানুষের অসহায় চোখ এত করুন, এত বেদনাময়, তা সেদিন দেখেছিলাম।

সকলের সাথে আমরাও তখন দৌড়াচ্ছি। হঠাৎ করে মা থেমে গেলেন।  এদিক ওদিক ভয়ার্ত চোখে তাকাতে লাগলেন। তারপর বুক ফাটা  চিৎকারে বলতে লাগলেন,

“আমার ময়না কই? ও ময়নার বাপ, আমার ময়না তো আসেনাই। ওর গায়ে জ্বর, ও তো ঘুমাই ছিলো!”

বলেই মা সবার ছোট বোনটিকে কোলে নিয়েই উল্টা বাড়ির পথে দৌড়াতে লাগলেন। মায়ের পিছু পিছু আমরাও দৌড়াতে লাগলাম ময়না বু’কে আনতে। আমরা ছিলাম ৫ ভাই বোন। ময়না বু সবার বড়। বয়স ১৩।

তারপর আমরা ৩ ভাই। সবশেষে ৬ মাসের বোনটি।যখন বাড়ীর  উঠোনে এসে পৌঁছুলাম, ততক্ষণে পাক হানাদার বাহিনী আমাদের

বাড়ির একাংশ জ্বালিয়ে দিয়েছে। আতঙ্কে আমরা কি করবো বুজতে

পারছিলাম না। আমাদের দেখা মাত্রই খান সেনারা ঘর থেকে বের হতে হতে গুলি শুরু করলো। আমি সবার পিছনে থাকায় দৌড়ে গিয়ে লুকাই রান্না ঘরের গোলার ভেতর। গোলা খালি ছিল বলেই আমি লুকাতে পেরেছিলাম। হাতে থাকা কাঁথা বালিশ এঁটে দেই গোলার মুখে। আর ওদিকে খান সেনাদের গুলিতে পাখির মত মাটিতে লুটিয়ে পরে আমার পরিবারের ৯ জন।

ভীষণ আতঙ্কে আমি জ্ঞান হারাই।

যখন জ্ঞান ফিরে, তখনো আমি গোলার ভিতর। চোখ খুলেই দেখতে  পাই এক নারকীয় দৃশ্য। অতটুকু বয়সে, কি হচ্ছিলো তা ঠিক দিশে  করতে পারিনি। তবে বুঝতে পেরেছিলাম, ময়না বু’কে ওরা খুব কষ্ট  দিচ্ছে। একের পর এক খান সেনা ময়না বু’র উপর চড়ছিলো, আর ময়নাবু রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে এক সময় বু  আমার নীরব হয়ে যায়। নিথর দেহটি নিয়ে ওরা সন্ধ্যা পর্যন্ত পালা করে খেলতে থাকে।

আমি নিশ্চুপ স্বার্পপর ৯ বছরের শিশু, তখনো গোলার ভিতর লুকিয়ে আছি। চোখের পলকটি ও পড়েনি আমার। আমি শুধু দেখছিলাম। চোখের পানির ফোঁটা গাল গড়িয়ে মাটিতে পড়তে দেইনি, চেটে নিচ্ছিলাম। যদি শব্দ হয়! যদি ওরা আমায় দেখে ফেলে।
বয়স এবং পরিস্থিতিটাই এমন ছিলো যে, ভালো-মন্দ বা বিবেক-বিবেচনার বিষয়গুলো তখনো খুব একটা জাগ্রত হয়নি। চোখে দেখা দৃশ্যটাই ছিল তখন সত্য।

এক সময় খান সেনারা চলে যায়। তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। চারিদিকের পরিবেশ নীরব। আমি গোলা থেকে বের হয়ে আসি। দেখি, ময়না বু’র  দেহটি রান্নাঘরের মেঝেতে পড়ে আছে, শরীরের কোন কাপড় নেই। আমি এদিক ওদিক ভালো করে দেখে নিয়ে কাছে গিয়ে বসি।

গোলা থেকে কাঁথাটি এনে শরীরে পেঁচিয়ে দিই। কী করা দরকার ঠিক বুঝতে না পারলেও, ময়না বু’কে যে কোথাও লুকায়ে হবে, তা বুঝতে পারছিলাম।

তারপর শরীরটা টেনে উঠাবার চেষ্টা করলাম।

সারাদিন না খাওয়া বলেই হয়তো আমি গায়ে জোর পাচ্ছিলাম না। কোন রকমে ময়না বু’কে পা ধরে টেনে টেনে, রান্না ঘরের পিছনের ডোবার কাছটায় নিয়ে যাই। ব্যথায় ময়না বু ককিয়ে উতঠে, কিন্তু   কোন কথা  বলেনি।

যদি আবার খান সেনারা আসে? যদি আবার ময়না বু’কে কষ্ট দেয়?

আবার কাপর খুলে? না না! বু’কে বাঁচাতে হবে!

ময়না বু’কে টেনে টেনে গলা অবধি ডোবায় নামালাম। রাতভর ময়না বু’কে নিয়ে দুর্গন্ধময় ডোবায় জড়িয়ে ধরে লুকিয়ে রইলাম। ময়না বু তখনো নীরব।

ভোরের আলো ফোটে উটলো। দু’চার জন করে মানুষ এদিক ওদিক বের হতে লাগলো। মসজিদের বুড়ো ইমাম কাকাকে তসবি হাতে এদিকে আসতে দেখেই ডাকলাম। কাকা দৌড়ে এলেন। আমাদের ভাই বোনকে

ডোবা থেকে টেনে তুললেন। তারপর কিছুক্ষন ময়না বু’র হাত টিপে, বুকে কান পেতে বললেন,

“মন্টুরে, ময়নায় তো হেই কহন মইরা গেছে!”

মনে পরে, আমি তখন শুধু ময়না বু’র শরীরটা জড়িয়ে ধরে বসে ছিলাম। মা-বাবা, ভাই বোন, ফুপু কেউ নেই। একটা ময়না বু ছিলো শুধু আমার। সেও মরে গেলো। কেনো গেলো? কী হবে এখন আমার—কিছু বুঝতে পারছিলাম না।

কাকাকে বললাম, ময়না বু’কে কোথায় মাটি দেবো! কাকা বললেন,

“ময়নারে মাটি দেয়া যাবে না। গ্রামে কুন সময় জানি খান সেনা ঢুকে  আবার!  চল নদিতে ভাসাই দেই। তারপর তুই আমার লগে গ্রামের বাড়ি চল। আইজি পলাইতে হবে। নাইলে মারা পরবি!”

ময়না বু’কে নদিতে ভাসিয়ে দেয়া হলো। আমার বু, আমার ১৩ বছরের লক্ষ্মী ময়না বু, রক্তাক্ত দেহ নিয়ে ভেসে গেলো নদীর জলে!

দেশ স্বাধীন হল। বড় বড় দালান কোঠা হলো। আবারো মানুষ হাসি  ঠাট্টায় মেতে উঠলো। আমি শুধু হাসতে ভুলে গেলাম। ছোট ছোট শিশুরা মা-বাবার হাত ধরে যখন স্কুলে যায়, আমার ভিতরে  জ্বালা পোড়ন হয়। চিৎকার করে কাঁদি। কেউ শুনে না। কারো কিছু  যায় আসে না।  যখন রাস্তার পাশে, পার্কে, ভাই  বোন হাত ধরাধরি করে খেলে, তখনো চিৎকার করি।

সবাই আমায় পাগল ভাবে। বিস্ময় নিয়ে, বিরক্তি নিয়ে তাকায়। কারো কিছু যায়  আসে না।

আজ কেবলই মনে হয়, ময়না বু বেঁচে থাকলে কেমন হতো? লাল শাড়ীতে বউ সাজতো  কি? তার ঘরে বাবু হতো কি? বাবুটার নাম কি হতো ?

আমায় আদর করে বলতো কি, ”এই মন্টু এদিকে আয়, দেখ, তোর জন্য নতুন শার্ট কিনেছি। এই মন্টু এতো বড় চুল রেখেছিস কেন?”

বু কি আমায় লুকিয়ে সিগারেট খাওয়া নিয়ে মারতো?

আজ স্বাধীনতার ৫০ বছর পর, কত খান সেনা হয়তো বিভোরে ঘুমায়।  কত রাজাকার হয়তো পালঙকে ঘুমায়। শুধু,  আমি ঘুমাতে পারিনা। চোখের পাতা  এক করতে পারিনা। রাত হলেই  অদ্ভুত এক ভয়ে অসহনীয় এক তীব্র ব্যথায়,  আমারmনিঃশ্বাস থেমে যেতে চায়।

আজ শুধু মনে হয়, আমি স্বার্থপর। সেদিন যদি প্রাণের ভয়ে গোলায় না লুকাতাম! সেদিন যদি খান সেনাদের টুঁটি চেপে ধরতাম! আমার ময়না বু কি তবে বেঁচে থাকতো? সেদিন যদি ময়না বু’কে বাঁচাতে ফিরে না  আসতাম, তবে কি আমার পরিবার বেঁচে থাকতো?