You are currently viewing একগুচ্ছ কবিতা – হোসাইন কবির

একগুচ্ছ কবিতা – হোসাইন কবির

প্রত্ন-অবয়ব

এই নদী মাঠে খালে বিলে

এখন আর স্বপ্নের কথা বলে না কেউ

কান তো খোলা, সেই আগের মতই—

তবু রাতবিরেত— আজও শুনতে চাই, কেন চাই?

ঝুমঝুম নূপুর বাজনার কোরাস।

ওরা কারা যেতো?

মধ্যরাতে অমন করে নূপুর বাজিয়ে রথ টেনে

স্বপ্নে দুঃস্বপ্নে শবযাত্রায়

প্রত্ন-অবয়বে কান্নার কলরোলে—

তখন বালক-বয়স

একান্নবর্তী পরিবারে অনেকের পাশে শুয়ে রাত গভীর হলে শুনতাম

টিনের চালে, পুরোটা ঘরজুড়ে

আদিভৌতিক কীসব বাজনা আর কান্নার সমবেত মূর্ছনা।

কোন কোন রাতে একে ওকে জাগিয়ে

শোনাতে চাইতাম; কিংবা জানতে চাইতাম—

তারাও শুনেছে কিনা সুরেলা সে নিক্কণ, কান্নার কলরোল

বলতো—

কেউ শুনেনি সেসব!

ভাবতাম যে শুনতে চাইতো

সেও বুঝি মুখ টিপে হাসতো আড়ালে আবডালে—

না! তারও কথা শোনা হয়নি।

পিঠে চিমটি কাটায়

কোন আভাস ইঙ্গিত ছিলো কিনা কে জানে?

বিনু খালা তাকেও পড়ে না মনে আজ আর—

যার বুকের উষ্ণতায় দীর্ঘশ্বাসে মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যেত!

বয়সে বড়রা এ গল্প শুনে প্রসঙ্গ পাল্টে এড়িয়ে যেত,

মিটি মিটি হাসতো শুধু।

তবে কি ওসব অস্তিত্বহীন ছায়া!

ছায়ার ভেতর আজও কারো

প্রত্নমুখে— কঙ্কাল-অবয়বে— ক্ষতচিহ্নে— চুম্বনে—

ছিন্নভিন্ন দেহের মানচিত্রে—

খুঁজে ফেরা—

নির্ভেজাল ভালবাসা, আহা বয়ঃসন্ধিকাল।

******

নিঃশব্দে নিঃশ্বাস নিতে দাও

নিঃসঙ্গে নিঃশ্বাস নিতে দাও

যেতে হয় যাবো নির্জনে একাকী

নিঃশব্দে নিঃশ্বাস নিতে দাও

প্রাণভরে মৃত্যুঘুমের নিঃশ্বাস নিতে দাও

যদি যেতে হয় যাবো

পৃথিবীর বুক ছিঁড়ে লাল নীল আলোর সংকেত

ফুসফুসে হৃদয়-কপাটে ঝুলিয়ে

যাবো চলে একেবারে

যেতে যেতে পথে পথে শুনতে চাই না আর সাদা চুম্বনের

শোকার্ত অ্যাম্বুলেন্সের দুঃসহ বেদনার মাতাল ঝুমঝুমি

হৃদয়ের প্রাণিত বাসনা– বৃষ্টি হলে

শুভদিনে রোদের আলোয়

কালো মেঘ সরে যাবে

মানুষ যাবে কি ভুলে

দূরত্ববিধির কঠিন কঠোর বিয়োগান্তক  সংলাপ, আর

শুভ্র কফিনে একাকী তার প্রস্থানের আয়োজন

জানি, মানুষের সংলাপে বিস্তার-বিচরণে

বহুদিন স্বপ্ন ও কান্নার চাষাবাদ যুগপৎ হবে

তবুও মানুষ শ্রেণিভেদ বিভাজন দ্বেষ-বিদ্বেষের যাবতীয় ক্ষত মুছে

গাইবে কি গান – সুষমবণ্টন আর সাম্যের সপক্ষে– কোরাস-গীতিতে?

জানি, আবারও বৃষ্টি হবে

কাঙ্ক্ষিত প্রণয়-প্রজনন পলিতে

মৃত্যুতে জীবনের  আরেক অধ্যায়ের সূচনা হবে– আলোর উদ্ভাসনে

সম্পর্কবুননে পুনরুত্থানে–

প্রকৃতির নৈকট্য পুরাণে মানুষের নির্ভরতার পুনর্বয়নে

আবারও বৃষ্টি হলে

দূরত্ববিধির দেয়াল উপড়ে

দু-হাত বাড়ায়ে আলিঙ্গনে এক হবে মানুষ– রতি-রমণে

অনাগত সন্তানের মুখচ্ছায়ায়, আর

বিবিধ বিভেদ রেখা ধুয়ে মুছে

বাজাবে যুগলবন্দী– সেতার এস্রাজ

নিঃসঙ্গে নিঃশ্বাস নিতে দাও

যেতে হয় যাবো নির্জনে একাকী

 

কঙ্কালের বিমর্ষ নিনাদ

ভাবি আমিও এক প্রগৈতিহাসিক মানুষ

প্রাচীন কোন এক কঙ্কালে ভর করে

ঘুরে বেড়াই  শতাব্দীর সময়ের স্রোতে

আসলে ছিলাম কি কোথাও কোন কালে

নাকি কেউ নই, প্রস্থান পরম্পরায়—

কে আমি?

পদ্মা মেঘনা ডাকাতিয়া কর্ণফুলীর শ্যামলিম মৃত্তিকা হতে

মাঝে মাঝে ধূলিতে-ধূসর স্মৃতির পাতায়

রাইনের এপারে দাঁড়িয়ে ওপারের পর্বতশৃঙে

দেখি আজও অপ্সরা লোরেলাই;

মনে পড়ছে বাদামী চুলের উইলিয়া টেরাপেট

সেও গল্পের নায়িকা হতে চেয়েছিল

কীর্তনখোলা কিংবা তুরাগ কন্যাকেও

সেরকম ভুল করে ভাবি না তো!

জানি, অপ্সরা লোরেলাই

তোমাতে মুগ্ধ অসংখ্য প্রেমিক–

পাল তোলা নৌকার মাঝি, রাইনের খরস্রোতে

হারিয়ে যাবার, তলিয়ে যাবার কথা– শুনেছি বহুবার

তবে তুরাগ কিংবা কীর্তনখোলা

এখন আর সেরকম কোন নদী নয়

শুধু লুকিয়ে দেখে আড়াল থেকে

চঞ্চল বালিকাদের বাড়ন্ত যৌবন

কে আমি?

পাহাড়ের কোল ঘেঁষা পটোমেক নদী পাড়ে

অসংখ্য দাস আর শ্রমিকের পুরাতন কঙ্কাল স্মৃতিরেখায়

কিংবা হাডসন আর ইস্ট রিভারের পাতাল পথে

যেতে যেতে কে আমায় আজও টোকা দেয়

হেঁটে যায় নিঃশব্দে নিরিবিলি পাশাপাশি

ভাবি এ পথেও ধুলোবালির গালিচায়–

শুয়ে আছি মৃতের লাশ–

আদিবাসী ভূমিজসন্তান, দাস-শ্রমিক কলো মানুষের ভিড়ে–

কত শতাব্দী ধরে, একদমই একা– পতঙ্গময়

মাঝেমধ্যে শুনি গর্জন

সাবওয়ে ট্রেনে সমান্তরাল রেলপাতে

প্রাগৈতিহাসিক কঙ্কালের বিমর্ষ নিনাদে…

 

তবু মুখোমুখি অবিশ্বাসে শেকড় বিস্তার

আজও রাত গভীর হলে কাঠের মজ্জা কাটে ঘুনপোকা

ভাবি সংগোপনে আমাকেও কাটছে বুঝিবা কেউ

নিবিড় আলিঙ্গনে বিচ্ছেদের করাতে অবিরাম

আর শান বাঁধানো ঘাটের আঁধারে

ডুবে যাওয়া আত্মহননের কাল

আঁচলের সান্ধ্যভাষ্যে প্রখর হয়ে ওঠে

বুঝিবা মেঘের আলোয় জোছনার চাঁদ ডুবে যায় বারবার

পুরনো পালঙ্কে এপাশ ওপাশ হা হা শূন্যতা

কাঠের মজ্জায় ধরেছে ঘুন

রাতভর অবিরাম কটকট মটমট

এরূপ শব্দঘোরে মনে পড়ে গোপন স্মৃতির সংলাপ

যৌনতায় অসতর্ক ডুব দেয়া ডুবে যাওয়া বালকবেলার

জানি আরও বিস্তৃত হবে সম্পর্কবুনন

খসে পড়বে প্রাচীন পলেস্তারায় খোদিত নামাবলী

সৃষ্টিতে সৃজনে অনাথ অনার্য অনাচার

প্রতিহিংসায় প্রতিশোধের পশ্চাৎপদ গুমোট আঁধার

জলে-স্থলে অপেক্ষার অশরীরী অচেনা ভুবন

হামাগুড়ি দেবে অজানায় মৃত্যুময় অচেতন

বিস্মৃত নিথর নিঊরণ-তরঙ্গমালায়

বুঝিবা শত-সহস্র আলোকবর্ষ পার হয়ে যাবে

তবু মুখোমুখি তবু পথচলা–

ভয় আর অবিশ্বাসে শেকড় বিস্তার।