You are currently viewing একগুচ্ছ কবিতা / রাজু আলাউদ্দিন 

একগুচ্ছ কবিতা / রাজু আলাউদ্দিন 

একগুচ্ছ কবিতা

রাজু আলাউদ্দিন 

(কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক রাজু আলাউদ্দিনের জন্ম শরিয়তপুরে। তাঁর লেখাপড়া এবং বেড়ে ওঠা ঢাকা শহরে। ইংরেজি এবং স্প্যানিশ ভাষা থেকে বিস্তর অনুবাদের পাশাপাশি দেশি ও বিদেশি সাহিত্য নিয়ে নিয়মিত লিখে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে তাঁর কবিতা ও প্রবন্ধ ইংরেজি, স্প্যানিশ, ইতালিয় ও সুইডিস ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তাঁর প্রথম কবিতাগ্রন্থ আকাঙ্খার মানচিত্র গোপনে এঁকেছি স্প্যানিশ ভাষায় অনুদিত হয়ে ইকুয়েডর থেকে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় চল্লিশ)।

 

১. অসংখ্য মৃত্যু নিয়ে আমার জন্ম হয়েছিল

 

অসংখ্য মৃত্যু নিয়ে আমার জন্ম হয়েছিল।

মৃত্যু ছিল আমার ঘনিষ্ঠ সহোদর।

আমার রক্তের স্রোত নিয়ে তারা ছুটে গেছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে।

তারা এতটাই কাছাকাছি ছিল, তারা এত বেশি ঘনিষ্ঠ ছিল

মনে হতো প্রেমিকের মতো তারা পেছন থেকে কাঁধের বাদিক দিয়ে

আমার কপোলে চুমু খেতে চায়।

মৃত্যুগুলো প্রায় পোষ্য বেড়ালের মতো আমার কাঁথার নিচে শীত রাত্রে

কাটিয়েছে পরম আরামে।

মৃত্যু ক্রমে, ধীরে ধীরে আমার প্রেমিকা হয়ে উঠেছিল এই ছোট্ট একাকী

জীবনে,অবসরে শুনাতো সে ঠাকুরের গান:

তুহুঁ মম শ্যাম সমান।

আমি বুঝতে পারিনি, মড়কের মতো অসংখ্য মৃত্যু আমার সাথে ভূমিষ্ঠ

হয়েছিল এই পৃথিবীতে।

এইসব মৃত্যুগুলো এত বেশি বলীয়ান ছিল, এইসব মৃত্যুগুলো দলে দলে

এত বেশি বড় হয়ে গেছে; আমি ক্রমে হয়েছি একাকী।

এসব মৃত্যুর চাপে আমার জীবন ক্রমে ছোট হয়ে গেছে।

 

আমার মৃত্যুগুলো নিয়ে কিছুদিন আগে বিশাল বিশাল সব প্রদর্শনী হয়ে

গেছে ইরাক, তুরস্ক ও আফগানিস্তানের বড় বড় গ্যালারিগুলোয়।

এগুলোর উদ্বোধন করেছিল মার্কিন প্রেসিডেন্ট আর তার নাতিদীর্ঘ

মুখবন্ধ লিখেছিল জাতিসংঘের মহান সচিব।

বেশ কিছু মৃত্যু আমি গোপনে বিক্রি করে দিয়েছি সাংসদ ও মন্ত্রীদের কাছে।

থানায় থানায় আমি কিছু মৃত্যু বিক্রি করেছি চড়া দামে।

আরও কিছু মৃত্যু আমি ছড়িয়ে দিয়েছি আমাদের ব্যস্ত সড়কে।

এইসব মৃত্যুগুলো আমাকে বাঁচিয়ে রাখে প্রতিদিন।

আমার মৃত্যুগুলো জ্যামিতিক হারে ক্রমে বেড়ে যেতে থাকে দেশে ও বিদেশে।

আমার মৃত্যুগুলো ঘুমে ও নিদ্রায় আমাকে ক্লান্ত করে শুধু।

সুজলা সুফলা মৃত্যুতে ভরে গেছে আমার হৃদয়।

 

২. অপর-প্রবণ

কেন পর-নারীতে আমার এত লাল আর গোলাকার লোভ জেগে ওঠে?

কেন সাদা নারীতে আমার লোভ পুঞ্জীভূত হয়ে ওঠে শরণার্থী মানুষের মতো?

কেন নিজের জায়ার চেয়ে অন্য নারীরা বেশি প্রিয় মনে হয়?

কেন নিজের দেশের চেয়ে অন্যদেশ বেশি লোভনীয়?

কেন মেঘ চলে যায় দূরে, আরও দূরে তার উৎসভূমি ছেড়ে?

কেন অবৈধ সঙ্গম ছাড়া সুখ নেই কোনো?

কেন অপরের দৌলতে বাসনা প্রবল হয়ে ওঠে?

কেন ধর্মের চেয়ে আজ অধর্মে আমার প্রাণ মুক্তি খুঁজে পায়?

কেন মন ওঁৎ পেতে বসে আছে অন্য নারীর প্রত্যাশায়?

কেন মন মজে আছে অন্য কবির কবিতায়?

 

হে পাঠক, মহাত্মন, অপর-প্রবণ

আরও কিছু খোলামেলা বলবার কথা ছিল এই কবিতায়

তুমি তা একাকী লিখে নিও

দোসর যমজ ভাই আমার।

 

৩. স্বপ্নের অনুবাদ

 

ঘুমের স্ট্রেচার যখন সন্তর্পণে আমাকে লোকান্তরের মর্গে ফেলে দিয়ে আসে,

আমার শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলো তখন খরস্রোতা নদীর মতো কলকলিয়ে ওঠে।

নিজস্ব মুদ্রায় তারা শিরদাঁড়ার নির্ভরে ফণা তুলে দাঁড়ায়, নিহিত নির্জনের ছায়ার

পাৎলুনে ঢাকা তাদের শরীর, বাৎসল্যের চূড়ান্ত ছুঁয়ে আছে তাদের প্রত্যেকের

নিকানো শরীর-সংসার। আমারই ঔরসে জন্ম তবু যেন এরা কেউ আমার

সন্তান নয়; এই নষ্ট, ভ্রষ্ট আর তুচ্ছতার কর্দমে আটকে পড়া আমাকে ছাড়িয়ে

ওরা বহু দূর চলে যায়। এক সময় নক্ষত্রের ক্ষুদ্রাকারে ঝুলে থাকে কালোত্তর

আকাশের গভীর খিলানে, যেন উদ্বাস্তুর স্বদেশহীনতার অভিমান এদের

প্রত্যেকের রক্তে প্রবাহিত, প্রগতি ও রাষ্ট্রের যাবতীয় সুফল থেকে বঞ্চিতের

মতো সময়ের অনেক গভীরের তলানির নিঃসঙ্গ নিস্বন বুক নিয়ে ওরা

ভীষণ আলাদা হয়ে আছে।

 

আমি প্রতিদিন ঘুমের গভীর আলিঙ্গনে মরে যাই। আর ওরা জেগে ওঠে,

যেন ওরা আমার শেশবের খেলার প্রতিপক্ষ দল। আমি ফিনিক্স পাখির

মতো অশান্তির তীব্র আগুনে আত্মাহুতি দেই; ওরা আমার ছাই থেকে

জন্ম নিয়ে আমার জন্মের সবচেয়ে নির্মল রূপান্তর চুরি করে তস্করের

মতো চলে যায়, দূরে।

 

ওরা অভিশপ্ত টাইরেসিয়াস, কেন না ওরা আমার মধ্য দিয়ে দেখেছিল

সভ্যতার সবচেয়ে নির্মম নিষিদ্ধ দৃশ্য : মানুষের রক্তে স্নানরতা অভিজাত

নগ্ন অ্যাথিনীকে। নাকি অর্থনীতিকে? ওরা সেই উপহাস ও শে­ষবিদ্ধ টাইরেসিয়াস,

কেননা ওরা বলে দিয়েছিলো ইডিপাস কিভাবে মাতৃভূমিকে ক্রমাগত সঙ্গমে

কলুষিত করে যাচ্ছে দিনের পর দিন।

 

আমি যখন এইসব কবিতার ঝনাৎকারে মৃত্যুর খুচরো আলিঙ্গন ভেঙে

জেগে উঠি; ওরা ততক্ষণে ঊর্ধ্বশ্বাসে উধাও পালায়, যেন অবাঞ্ছিত কেউ;

যেন টিলো এক্সপ্রেস খেলতে গিয়ে ভুল করে মৈথুন-মগ্ন কোনো দম্পতির

ঘরের জানলায় চোখ পড়তেই দ্রুত-সটকে-পড়া এক বালক।

 

এইভাবে আমার শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলো প্রতিদিন নাগালের বাইরে থেকে যায়;

আমি আকাঙ্ক্ষা উসকে দিয়ে পৃথিবীর যাবতীয় আড়াল করে ধীবরের মগ্নতায়

একা বসে থাকি; কিন্তু ওরা কেউ পূর্ণাঙ্গ ও পরিশুদ্ধ হয়ে আসে না কখনো,

শুধু ওদের নিঃসৃত বর্ণালির রক্তিম-সরণ আমাকে অযথাই মাঝে মধ্যে বিচলিত করে,

 

…বিস্রস্ত করে রাখে দিনের পর দিন।

 

 

৪. তুমি আমার পৃথিবী 

 

আমি যত দূরে যাই

আমার জন্মভূমি তত বেশি বড় হতে থাকে।

মিগেল জানতে চায়: কোথায় তোমার দেশ?

বাংলাদেশ, শোনো নি কখনো?

না, কখনোই নয়।

কোথায় এ দেশ?

ভারতের কাছে।

ওহ্, তাই বলো।

 

আমি যত দূরে যাই

আমার জন্মভূমি তত বেশি বড় হতে থাকে।

একদিন মারিয়ানা জানতে চেয়েছে,

কোথায় তোমার দেশ?

একই কথা বললাম তাকে।

লজ্জিত জানালো সে, হ্যাঁ,

ভারতের কথা আমি শুনেছি, যদিও

জানি না আসলে ঠিক কোথায় এ দেশ।

এশিয়ার কথা তুমি শোনো নি কখনো?

ওহ্, তাই বলো। বাংলাদেশ তবে সেই

এশিয়ার মাঝে!

ঠিক তাই।

 

যদি আমি কোনোদিন আরও দূরে চলে যাই

ধরা যাক, মঙ্গলগ্রহে।

তখন সেখানকার কেউ যদি জানতে চায়,

হেই, কোথায় তোমার দেশ?

আমি তো এসেছি দূর সবুজে আচ্ছাদিত

পৃথিবী নামক এক গোলাকার গ্রহভূমি থেকে।

সেখানে এশিয়া নামে বড় এক মহাদেশ আছে।

সেই মহাদেশে আছে ভারতভূমি।

আর সেই ভারতেরই কাছে এক সমুদ্র-তনয়া

হলো আমার স্বদেশ।

আমি যত দূরে যাই

আমার জন্মভূমি তত বেশি বড় হতে থাকে।

বড় হতে হতে ক্রমে আমার নিকটে চলে আসে।

যখন নিকটে আসে, কানে কানে বলি তাকে:

যত ছোট মনে হয় তুমি তত ছোট নও, শোনো,

তুমি পৃথিবীর যেকোনো দেশের মতো বড়,

তুমি এই পৃথিবীরই মতো,

তুমি আমার পৃথিবী।