একগুচ্ছ কবিতা/ ফজলুল হক
মায়ারেখা
তবু ফুরোল না
সেই নম্র নত অবসান
এমনকি কপালের কুমকুম টিপ থেকে
স্মিত স্মৃতির টুকরো
লাজুক ভুল
বিদায়মুহূর্তে যে-প্রবালদ্বীপের
ছায়ারা ভেসে উঠেছিল
তারাও আজ প্রত্নইতিহাসের
অধরা নন্দন !
এই কি বসন্তদিন তবে?
অথচ আমাদের সকলেরই ইচ্ছে ছিল
বসন্ত পেরিয়ে, একদিন
কৌম আনন্দে ভাসতে-ভাসতে
প খন্ড যাব
সেখানে অগণন কমলা, আনারস বাগান
আর বল্লরী ইচ্ছের মহাবনস্পতি
কমলারঙের আলোকধনু গায়ে মেখে মেখে
খুঁজে নেয়া যাবে, তৃণের গভীরে লুকোনো তৃণাংকুর
তারপর, ধর্মনগর
ধর্মতলার পথে মাধবকুন্ড পাওয়া যায়
যারা ব্রাজক
তারা কেউ হয়তো সর্বনাশের আশায়
ঊনকোটি পর্যন্ত যাবে
মন্দিরের আঙিনায় বসে তৃষ্ণাপিপাসায়
অজিপালী নাচ দেখবে,
পড়ে নেবে লোকনৃত্য পরম্পরায়
গৌরবআখ্যান, প্রতœ-অবশেষ
এখনো তাই, মাঝে মাঝে যাই
লুপ্তজীবনের ধারে জল-জংলার সংসারে
আজও দেখি আছে
নীরবের কোনো চিরদিন
ভাবি, তারা তো আমারই উদ্দেশে
এতদিন পরে বনবাসী
সেই শান্ত পথ, দীর্ঘপদে সময়েই হাঁটি
অপভ্রংশ হয়ে পড়ে থাকে মেঘ
তাম্রপত্রে অপার সংকেত নিয়ে এ কার সংসার?
গভীর ভিক্ষায় তবু পূর্ণ হয় রাত
দেখি রাশি রাশি শতদল, সত্যের কাছাকাছি সেও
তবু মুখরতা, জাতকের পদচিহ্ন
মায়ারেখা আজও সত্য
মহাকালমন্দিরের আঙিনায় হয়তো নৃত্যগীত হবে
আসন্ন বসন্তে
প্রত্ন ভোরে একদিন ফিরে আসবে তুমিও
তখন আমাদের পথের ধারে
অনেক ঘাসফুল, পরম্পরা কৌমদিন
নয়নে-নয়নে ভেসে যাওয়া
তবু ফুরোবে না
সেই নম্র নত অবসান !
স্মৃতি ও সংসার
চৌরাস্তার কাছে দায়হীন যে সন্ধ্যাফেরি। সে কেবলই
চেটে যাচ্ছে ক্ষত।
শোভন বিষাদে এই অংশত জীবন, ক্ষণে-ক্ষণে
রঙবদলের রোদ্দুর
শেষবারের মতো দেখে নিচ্ছে প্রশ্নহীন অভিমান।
এবং আলগা সূর্যালোক
বেলা পেরিয়ে চেয়ে পরা পোশাকের ভিড়ে কী হারাচ্ছি,
কতোটা হারিয়ে
রূপসী সময় ভরে তোমার জন্য আপাতত চলি;
অধোগামী প্রান্ত ছুঁয়ে প্রতিদিন ভেসে উঠছে পরবর্তী
মেঘবর্ণ জীবন
অনন্ত স্তব্ধতা, অসীম অন্ধকার কৃপণ ছায়ার মতো ঘিরে
থাকুক শিকড়বাকড়
বরং কিছুটা জ্যামিতিক-প্রাক্কথন স্মৃতি ও সংসার।
পরাবাস্তবের আঙুল ছুঁয়ে বৃষ্টি পড়ছে, ভাষায় জমে ওঠে
অসমান মেঘ
মিথের ফলক নিয়ে অবিরাম গড়ে যাচ্ছি বিভেদ রেখায়
গভীর মেঘ আর মানবিকতা ডিঙিয়ে শেষতক বৃষ্টি
থেমেছিল কি না
একটা সমর্পণ পথ খুঁজতে-খুঁজতে যে রেখাচিত্রে
বৃষ্টি হচ্ছিল তার পাশে
এক নারী দাঁড়িয়েছিল সন্ধ্যাফেরির আগে,
প্রেমের খাঁড়ির মুখে
ধর্ম আর অধর্ম ভুল করে ফেলে গেছে সেও
সেই অভয়ে চৌরাস্তার মোড়ে একা অন্ধটি তাকিয়ে থাকে
জঙ্গলের দিকে।
ধর্মাধর্ম
গাছের পাতার একপিঠে রোদ
অন্যপিঠে রাত্রি
ঠান্ডা পাথরে পা রেখে আছি নিস্তব্ধতার যাত্রী
পা বাড়ালেই
আগে ও পরে অনেক পায়ের শব্দ
দাঁড়ায়নি কেউ
গাছের পাতারা, কথামুখ এবং চিহ্ন
এখনও কথারা মায়ের মতো
জেগে থাকে সারা রাত
সাধ্যসাধনা কথামুখ চিরে চিত্রেমূর্ত
দ্ব›দ্বধূসরতা-সরণি-শব্দ অভিসম্পাত
পথের দু’পাশে ধর্মের ভীড়
ডাকিনীর চোখ কার
একটু দূরেই অপমৃত্যু
ধর্মহীন শুধুই অন্ধকার।।
ফজলুল হক
কবি, প্রাবন্ধিক-সমালোচক। বাংলাদেশ বেতারের প্রবীণ গীতিকার।