You are currently viewing ঋতো আহমেদের কবিতা হাওয়া-পুস্তক

ঋতো আহমেদের কবিতা হাওয়া-পুস্তক

ঋতো আহমেদের কবিতা হাওয়া-পুস্তক

 

[কবিতা ৪০]

পাখিদের ঘুম ভাঙার পূর্বেই ঘুমিয়ে পড়তে হবে তোমাকে। পূবাকাশ ফর্সা হওয়ার আগে এই নাও দু’তিনটা দানা খেয়ে নাও। শুধুশুধু খেও না যেন। খাও এক গ্লাস পানির সঙ্গে ঢকঢক করে গিলে। তারপর, তোমার যা অপরাধ, সমস্ত মুছে ফেল। যা যা ভেবেছ এতক্ষণ, কী সব করবে কার সাথে, সব মুছে ফেল মানুষের দৃষ্টিসীমার থেকে। আলো ফুটে ওঠার পূর্বেই বিভ্রান্ত করো পৃথিবীরে। যেকোনো দিক ধরে এগুলেই যেন বিড়াল তার লেজটারে ভাবতে পারে সাপ। কিংবা সাপ তার দেহটারে মনে করতে পারে যেকোনো পশুর লেজ। এমন বিভ্রান্ত করো, যেন কোথাও গর্ভপুকুর ছিল না কোনও কালে। কোথাও ছিল না তোমার অসম্পর্কের ঋণ। কই, খেয়েছ? এবার ঢলে পড়ো। রতিপাথরের জঙ্গলে ভাসছে কামের অনন্ত সংকেত। সেইদিকে ভুলেও তাকিও না আর।

 

[কবিতা ৪১]

যেই বললাম ছিঃ, ওমনি আমার লজ্জারা দু’দিকে ভাগ হয়ে ফুলে উঠল সমুদ্রের মতো। মাঝখানে মুসার লাঠি হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি আমি। আমার পেছনে বিশাল সৈন্যসামন্ত সহ তেড়ে আসছ তুমি। আমাকে বধ করবে বলে সংকল্প তোমার। এমতাবস্থায়,

লাঠিকে ঠুকতেই ভূমণ্ডলে ভূকম্পন হয়, পোয়া শতাব্দী প্রাচীন পৃথিবীর অমীমাংসিত ঘুমটুকু ভাঙে ঝিনাইগাতির বনে। হারানো কম্পাস, অলৌকিক ধোঁয়া আর সেই গোলানো পাহাড়। এইসব দেখা দেয় আকাশসমান্তরালসময়দিকচক্ররেখায়।

আহা, ব্যতিব্যস্ত হইয়ো না কখনও, হে উত্থিত মর্মর। বলো, কে বেশি উন্মাদ, তুমি না মহাপরিণতি? আমার চোখের থেকে তোমার চোখের দিকে বিসর্জন বিসর্জন কেন ওঠে? হে পরমার্থ পরিমিতি। আমার লজ্জার জল তবে এ কোন অনশ্বর অনুশোচনায়।

 

[কবিতা ৪২]

যে কথা বলতে চাও ধীর লয়ে, সেটা বলতে গেলে ধীর আর থাকে না সে—
গড়গড়িয়ে গড়গড়িয়ে ট্রেনের চাকার মতো আসে। অথচ যাওয়ার নেই কোথাও।

এই যে ঝিঁঝিঁ, ডেকে যাচ্ছে একটানা, এরও ধৈর্য নেই। আর আমার নিরুদ্দিষ্ট পাখি—
সে কি আসে মাঝেমধ্যে? স্বপ্নে এসে দানা খেয়ে যায়?—দু’চারটে পোকাও?

নাও, তার জন্য রেখো তুমি কয়েকটা পাতার স্তুপ। আর রেখো যতিচিহ্নের ধূসর পালক।
হাওয়ার হট্টগোলে এ জীবন ভায়োলিন ভায়োলিন, চিঠিভর্তি ড্রয়ার,—তাকাও—

না হয় অস্ফুট গান, না হয় বাদাম সংকেত, না হয় ছদ্ম নিয়ে থাকো। যে-কোনও
বিকেল এলেই আকাশে প্রান্তর খোলো, রামধনু ভেদ করো, কামিনী-কাঞ্চন আঁকাও—

 

[কবিতা ৪৫]

এইতো, পুলসিরাতের আগে যে মাটি তোমাকে আগলে নেবে
তার কাছে বসে বুক ভরে শ্বাস নাও। এইখানে, ধূলো হয়ে যাবার পূর্ব পর্যন্তই
সময় তোমার। খুব কাছে থেকে
কারা যেন এইসবই বলে গেল আমায় গতরাতের স্বপ্নে। মা বলেছিলেন, ভালো স্বপ্নগুলো
জমিয়ে রাখবি ভোরের জন্য। আর যত মন্দ কিছু, শেষ করবি গভীর রাতে।
অথচ আমার রাত কখনও ভোর হয় না। কিন্তু প্রায়শই ভোররাত হয়ে যায় গভীর।
পরিচিত সব মুখোশ পরে কারা যেন আসে। পাখিদের ভাষায়
কথা বলে। যদিও

ভালো ও মন্দের প্রভেদ খুব একটা বুঝতে পারি না আমি। প্রতিবার
ঘাম দিয়ে জ্বর সারার মতোই ঘুম ভাঙে মধ্য-দুপুরে। দেখি-যে নির্জন মাঠের মধ্যে
পাতাদের স্তুপের পাশেই শরীরটা বিস্তারিত হয়ে আছে।
ঝরঝরে মাটির আকাশে কোথাও নক্ষত্র নেই চুম্বন নেই। নিখিল ঘাসের উপর কেবল
দুটো চড়ুই আর একটা বুলবুল। আমার দিকেই কৌতূহল নিয়ে তাকাচ্ছে বারবার।
আমি জিজ্ঞেস করি, তুমিই কি সেই বেহেস্তের বুলবুল? বলতে পারো
পুলসিরাতের কোন পাড়েইবা রয়েছি আমরা?
সে কোনও উত্তর দেয় না।
হঠাৎ উড়ে যায়।

একটা গূঢ় সত্য থেকে যায় অমীমাংসিত এবং পরম প্রশ্নের চাদরে আবৃত।

 

[কবিতা ৪৮]

সব ধ্বনি মিলে একটা না ধ্বনি শুনতে পাও?
বিকেলে বের হও না অনেক দিন। মাঠের উত্তর কোণের বিড়ালটা কি
মর্মবেদনায় জর্জরিত এখন। আর, শিউলির ফুলগুলো?
সত্যের থেকে পালিয়ে আর কোথায় লুকোবে তুমি। নশ্বর মেঘেদের রণন শুনতে শুনতে
ঝাউবনের পেছন পেছন হারিয়ে গেল সন্ধ্যাতারাটি। সেও শতাব্দী কাল পেরিয়ে গেছে।
একটিমাত্র ঘাস দাঁড়িয়ে রয়েছে উঁচু মিনারের মতো টানটান হয়ে। চূড়া থেকে
চূড়ান্ত নিঃসঙ্গতা ঝরে পড়ছে সমগ্র মাঠের ধূলিতে। এরই মধ্যে
একেকটা জখম তোমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে পাঁচশ বছর আগের মাতামুহুরি, লুসাই পর্বত;
যেখান থেকে নভোবর্ণ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাখি একযোগে উড়ে যেত বঙ্গোপসাগর।
তবে কি এরাই সেই ভ্রমরচক্র—
পঞ্চ শতাব্দীর ওপার থেকে
যাদের সমস্বর গুঞ্জন তোমার কর্ণকুহরে ক্রমাগত একটা না ধ্বনির ফ্রিকোয়েন্সি পাঠাচ্ছে!
তুমি কি তাদের সেই ঘেরাটোপ বুঝতে পারছ?

 

[কবিতা ৪৯]

নাও, সহজ শর্তে তোমাকে এই ষড়যন্ত্র দিতে রাজি আছি আমি। শিখে নাও,
অনির্ণেয় অক্ষরগুলো কী করে লক্ষ্যভেদী হয়ে ওঠে। কী করে কবিতা আর বুনো বাঘ
দক্ষ শিকারির সমূহ সতর্কতা সত্যেও পেরিয়ে যেতে পারে খরস্রোতা নদী।
কিন্তু মুশকিল হলো, পাখিদের মৃত্যু তুমি ঠেকাতে পারবে না। টানা বৃষ্টির আফিম একবার
বন্দুক থেকে বেরিয়ে গেলে পাখিরা কোনও কথাই আর মানবে না। যতই
হামাগুড়ি দিয়ে নামুক না কেন, জীবনদেবতার আত্মার ভিতর হয়ে উঠবে সে
নরক-অশ্রু। এখন—

কী অভিপ্রায় তোমার? তন্ত্রমন্ত্রের কেকাধ্বনি কি ছড়িয়ে দেব আকাশগঙ্গায়? বিলিয়ে দেব
যতিচিহ্নের প্রচ্ছন্ন ইশারা? ভেজাবিলাই হয়ে থেকো না কেবল। সিদ্ধান্ত তোমার হাতে।

 

[কবিতা ৫০]

মূলত বাতাস থেকেই শরীর পেয়েছ তুমি। তোমাকে যারা বলতে চেয়েছে মাটির কথা
তারা কেউ ভাষার ঊর্ধ্বে ছিল না। গোপন বাঘিনীর কাছে তারাও পেয়েছে কামার্তনাদ।
প্রসবা সভ্যতার কাছে, পেয়েছে পোশাক। তাদের ৭ নম্বর ভোরে মরণতরঙ্গ বাজতেই
মৃত্যুর ওপাশ থেকে উড়ে উড়ে আসে পথনক্ষত্রদের জীবাশ্ম, অশ্বক্ষুরধ্বনির উল্কা আর
অট্টহাসির লেজ। তাই তারা মাটিকেই বুঝতে চেয়েছে সবসময়। হাওয়াকে বোঝে নি
কখনও। হাওয়া-পুস্তক ভেবেছে পরিহাস্য। অথচ, সমস্ত মৃন্ময় বস্তুই-যে বাতাস থেকে
উদ্গত, এ কথা পাখিরাও জানে। আর সবচে’ ভালো জানে ওই কুচক্রী সাপটা। যাকে
তারা দেখতে পেয়েছিল তাদের আদি বাগানে।

 

[কবিতা ৫১]

তোমার বাগানের উত্তর পশ্চিম প্রান্তে যেই ঘোড়াটি বেঁধে রেখেছ,
তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল কাল। বলল, তোমার
মন ভালো নেই। খোক্ষসদের রাজ্যে আটকা পড়েছে তোমার অপ্রকাশ্য আত্মার মৃৎপাত্র।
যেখানে উৎকীর্ণ হয়ে আছে ভবিষ্যৎ।
এখন, হ্রেষা ডাকতে পারে এমন একটা ঘোড়ার প্রয়োজন। যার পিঠে চড়েই তবে
উদ্ধার অভিযানে যেতে হবে ওই অগ্নিচরাচর।
কিন্তু হ্রেষা সে ডাকতে পারে না। তার ডাক কাঞ্চন ফুলের ঘ্রাণের মতোই উদ্বায়ী।
সে যখন ডাকতে ডাকতে এগিয়ে যায়, তখন তার গমনপথ জুড়ে
জ্যোৎস্নামাখা পাখিরা তাদের ডানা সমূহ প্রসারিত করে। দু’পায়ে দাঁড়িয়ে ভোঁদড় তার
উঁচু করে দ্যায় কৌতূহল। আর, বিষণ্ণ ধূলিরা অভিবাদন নিয়ে মেখে থাকে
দিগন্তরেখার ঘোর বরাবর।—
এমন ঘোড়ার পিঠে কেউ কি কখনও রাজ্য জয়ে যায়!

আমি তার কষ্টের কথা টের পেয়ে ভাবতে থাকি, ঘোড়ারা কি আদৌ
হ্রেষা ডাকতে পারে? শুনেছি কখনও?
গহিন আয়নার দিকে মুখ করে আমি সেই ভবিষ্যতের দিকে তাকাই। আর কান পাতি
অশ্বক্ষুরধ্বনির…

 

[কবিতা ৫৮]

তুমি যা ভাবছ তাই। সব কিছুই তোমার চিন্তার ভিতরে জায়মান।
পৃথিবীটাও ঘুরছে তোমার ইচ্ছের উপর। ফর্মুলা আর কিছুই নয়। উন্মাদ অশ্বটাও
তোমার চিন্তার গতির সঙ্গেই লড়ে যাচ্ছে। সে এখন বুলেট-ট্রেন। ছুটিয়ে দিচ্ছে তোমার
অস্পর্শের ঋণ।
অতএব, শ্বাস নাও। সমস্ত সন্দেহের ঊর্ধ্বে ওঠো। কোনও কোনও দুপুরবেলা
বেরিয়ে যাও সাপের গর্ত খুঁজতে,
আর ঘুঘুদের বাসা। তোমার জন্য
অপেক্ষা করে আছে গিরগিটি। কবে একবার কথা দিয়ে এসছিলে—
মনে নেই তোমার। আমগাছের পিঁপড়েগুলোও দেখতে দেখতে কুচকুচে হয়ে উঠল।
গতবার যে কবিতাটির নদীর দিকে গিয়েছিলে—
আজ রাত্তিরে তার অক্ষরগুলো উল্টেপাল্টে দেখো। আর রেখো
সামনের মওসুমে তোমার কুকুরটিকেও, ভাবনার স্রোতের ভিতরে। মনে আছে,
প্রতিবার সে তোমার মেহমানদের এগিয়ে দিতো
রিক্সা পর্যন্ত।

 

[কবিতা ৫৯]

মানবসম্পদ আমাকে ডাকবে, আর আমি তুতানখামুনের পোশাক পরেই
রওনা হবো পৃথিবীর পথে। আমাকে জিজ্ঞেস করা হবে জলদগ্ধ ইতিহাসবইয়ের প্রশ্ন।
যার উত্তরে রয়েছে কৈলাস পর্বত আর পশ্চিমে আমার দাদার দেশ—
ভগীরথপুর। যেখান দিয়ে একটা নদী, জলঙ্গী,
এঁকেবেঁকে কোথাও চলে গিয়েছে।
আমাকে এক কাপ চা-ও পেশ করা হবে। আমি হয়তো চিনির বদলে
এক টুকরো দারুচিনি চাইব মিশিয়ে দিতে।
আমাকে জিজ্ঞেস করা হবে রক্তরঞ্জিত মাঠ আর খেকশিয়ালের লিঙ্গ বলতে কী বুঝি। আর,
কোন কোন ম্যাজিক আমি দেখাতে পারবো।
বিশ্বাস করো, মূসার লাঠি হাতে হাঁটতে হাঁটতে এতোটাই ক্লান্ত লাগে এখন
মনে হয় যেন শুয়ে পড়ি, হাজার-সহস্র বছর আমাকে পেঁচিয়ে রাখুক কোনও মমিকরণ।
মনে হয় তোমরা আমাকে উন্মোচন করো একটা কাঠবিড়ালির চঞ্চলতায়,
একটা গঙ্গাফড়িঙের ডানায়, একটা লজ্জাবতীর লাজে।
মনে হয় একটা নদীর স্রোতের সঙ্গে কতদূর চলে যাওয়া যায়…
একটা মেঘের বজ্রের সঙ্গে কতোটা কেঁপে ওঠা যায়…
কিংবা কোনও বিভোর জঙ্গলে কতবার হারিয়ে যাওয়া যায়…

অথচ মানবসম্পদ আমার পোশাক দেখে কিছুই বুঝতে পারে না। মূর্খের মতো
প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যায়…

=====================