You are currently viewing উত্তাল মার্চের শক্তি ও স্বদেশ ভাবনার বিবিধ/  আজিজ কাজল

উত্তাল মার্চের শক্তি ও স্বদেশ ভাবনার বিবিধ/ আজিজ কাজল

উত্তাল মার্চের শক্তি ও
স্বদেশ ভাবনার বিবিধ

আজিজ কাজল

উত্তাল মার্চ বাঙালি জাতির জন্য একটি স্মরণীয় মাস। উপলব্ধির মাস। অনুধাবনের মাস। বাঙালির ফাগুনমাসের আগুন। ইংরেজি মার্চ মাস। ভাষা আন্দোলন।  মুক্তিযুদ্ধ—বিষয়গুলো নানা সূচকে একসূত্রে গাঁথা।এই মার্চেই আছে ঋতুর রাজা বসন্ত। ফলে বাঙালির বসন্ত মানে অন্য  কিছু। বাঙালির ফাগুন মানে অন্য আগুন।উত্তাল মার্চের প্রতিটি দিন প্রতিটি মুহূর্ত এগিয়ে গেছে একেকটি
প্রস্তুতি কাল এবং  বড়ো ত্যাগের মাঝে। ইতিহাসের অন্য বাঁকেও যদিএকটু চোখ ফেরাই তাও দেখি ফাগুন-আগুনের মেলা। শ্রী-কৃষ্ণ জন্মগ্রহণ করেছেন ফাগুন (দ্বাপর যুগে, পূর্ণিমায়) মাসে। ফাগুন মাসেই  জন্মগ্রহণ করেছেন শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু। লালনের চিন্তা ও অধ্যাত্ম জুড়েও আছে তাদের বিশাল প্রভাব। এবং তার সময়টাও কিন্তু এই ফাগুন মাস। মোটাদাগে বললে ইতিহাসের এই বিবিধ বাঁক পেরিয়ে বাঙালি ও বাংলাদেশ নির্মাণে ফাগুন,মার্চ, ভাষা আন্দোলন  এবং মুক্তিযুদ্ধ —বাঙালি জীবনের অন্যরকম একটি অস্তিত্ব এবং ভিত্তি গড়ার সূচনা পর্ব বলা যায়।

১৯৭১ সালে ১ মার্চ এক বেতার ভাষণে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে ৩ রা মার্চেরনির্ধারিত অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন। সাথে সাথে বাঙালি জনতা ক্ষোভের আগুনে জ্বলতে থাকে। ‘বীর বাঙালি
অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ  স্বাধীন করো’ স্লোগানের মধ্য  দিয়ে শিক্ষার্থীরা এর একটি আশু সমাধান চায় বঙ্গবন্ধুর কাছে। তখন ২ রা মার্চ সারাঢাকা শহর এবং ৩রা মার্চ পুরো বাংলাদেশে লাগাতার হরতালের ডাক দেন। এছাড়াও তিনি ৭ ই মার্চের রেসকোর্স ময়দানেবিশাল অধিবেশনের ডাক দেন। এবং সেখানেই জনগণের সামনে সর্বাত্মক আন্দোলনের কর্মপন্থা ঘোষণা করবেন বলে জানান।এ থেকেই বাঙালি পেয়েছে আরেকটি উজ্জীবন। স্বাধীন সার্বভৌম  বাংলাদেশ গড়ার আরেকটি নতুন উৎসমুখ। বাঙালি পেয়েছে, ৭-ই মার্চের ভাষণের মতো  বিশ্বের মাঝে দৃষ্টান্ত সৃষ্টিকারী একটি ধ্রুপদী ভাষণ।

এখন এই ভাষণের তাৎপর্য আমাদের বুঝতে হবে।এবং সংবিধানের মূল চারনীতি জাতীয়তাবাদ । গণতন্ত্র। সমাজতন্ত্র। বুঝতে হবে  ধর্ম নিরপেক্ষতাসহ বাকশালের বাস্তবতা; ধর্মনিরপেক্ষতাসহ  এই চার মূলনীতির অন্তর্গত ভাবনা ও চেতনার বাস্তবতা কি তাও আমাদের বুঝতে হবে ।বাঙালির  মূল ধারার স্বাভাবিক জীবন ব্যবস্থাপনার মধ্যে কোনটা আরোপিত ছিলো।মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বাঙালির জাতীয় জীবনে একটা লুটতরাজ শ্রেণি এবং হঠাৎ আলগা ধনপতি শক্তি ফুলে ফেঁপে উঠেছিল । বর্তমান সময়ে তাদের বংশধররাও যেন আবার জেগে ওঠেছে। এবং  অনেক মুক্তিযোদ্ধা পরে স্বার্থের  কারণে রাজাকার হয়েছে। আমাদের দরকার এই শ্রেণি গুলোকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা। দরকার জাতীয় সম্পদের সঠিক বন্টন। দেশীয় যে গ্রামীণ অর্থনীতি; সেই অর্থনীতিকে আরো শক্তিশালী করা। এবং তাকে জাতীয় অর্থনীতির সাথে আরো বিজ্ঞানসম্মত করে সম্পৃক্ত করা । সর্বোপরি তাকে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক শক্তিতে রুপান্তর করা। আমাদের নিজস্ব যে অর্থকরী ফসল। সেই ফসলের আবাদ বাড়ানো। জেনেটিক্যাল মডিফাইড যে ফল ফ্রুটের চাষ। সেই চাষবাসের জন্য আমাদের মাটি কতোটুকু উপযোগী। সেটা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।

দেশীফসল, তরি তরকারি, মাছ, মাংস পর্যন্ত কীভাবে দেশি বীজ বা দেশীয় জাতকে গুরুত্ব দেওয়া যায়,সে বিষয়ে আমাদের ভাবতে হবে। শরীর এবং মানসিক গঠনের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি উপাদান কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন আর মিনারেল। এসবের বড়ো
উৎস আমাদের  মাটিজাত  অর্গানিক শস্য থেকেও পাওয়া যায়। এরকম বিবিধ বিষয়গুলো নিয়েও ভাবা এখন জরুরি। নিত্য পণ্যসহ তেল, ভোজ্য পণ্যের দাম বাড়ানো—মাঝখানে পিঁয়াজ নিয়েও আমরা জাতীয় সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলাম। যা সত্যি দু:খজনক। এখান থেকে নিতে হবেঅভিজ্ঞতা। কেন আমাদের কৃষক ধানের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না? কেন দেশি উৎপাদিত লবণ পানির দরে  বিক্রী হচ্ছে? রসুন নিয়েও  এখন তৈরি হয়েছে আরেক সমস্যা। শুনা যাচ্ছে চীন থেকে মোটা সাইজের যে রসুন বাজারে আসছে। সেই রসুনে আছেমানবদেহের জন্য ক্ষতিকর উচ্চ মাত্রার রাসায়নিক পদার্থ, মিথাইল ব্রোমাইড।  শিসা ও সালফাইড। এটি আদৌ কতটুকু সত্য এই বিষয়ে চিন্তক এবংসচেতন পরামর্শক দেশি জাতের রসুন খাওয়ার জন্যই বলছেন।

আমাদের দেশি জাতের আউশ এবং আমন ধান। আউশ ধানেআয়রন এবং ক্যালিসিয়াম দুটাই থাকে। ফলে বাজার থেকে (ফার্মেসীতে গিয়ে) শত শত টাকার আয়রণ ট্যাবলেট এবং ক্যালসিয়াম  টেবলেট কেনার কী প্রয়োজন! মাটির গুনাগুন নষ্টকারী বিদেশী জাতের ধানের উৎপাদন কমাতে  হবে। অন্যথায় এরকম অনেক তরি তরকারী সবজির হাইব্রীড বীজের উৎপাদন বাড়াতে বাড়াতে  আমাদের দেশি জাতের বীজ অচিরেই বিলুপ্ত হবে। মাটি হয়ে যাবে আরো বন্ধ্যা । হয়তো একসময়  আমাদের হরপ্পা আর মহেঞ্জেদাড়োর মতো বিলুপ্ত সভ্যতার ভাগ্যকে বরণ করতে হবে।

আমরা কিছু বড়ো আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে এখনো এগিয়ে চলেছি। বিদেশী জাতের অনেক  মাছ আমাদের জলাশয়ে ছেড়ে দেশিজাতের অনেক মাছের প্রায় বিলুপ্ত ঘটিয়েছি। যেটা ইউক্যালিপটাস গাছের মতো মাটির গুনাগুন নষ্টকারীএবং অধিক পানি শোষণকারী বৃক্ষের মতো। এটিও দেশি মাছের মতো দেশি জাতের বৃক্ষকে রীতিমতো হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছিল-কথা হচ্ছে ধীরে  ধীরে আমরা আমাদের নিজেদের ক্ষতিকরেছি।  দেশীয় উৎপাদিত পণ্য দ্রব্য। মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা সম্ভাব্য খনিজ সম্পদ এবং দেশি কোম্পানীর প্রতি অধিক মনোযোগী হওয়া দরকার।

উত্তাল মার্চের নৈতিক শক্তিও আমরা স্বদেশী-ভাবনার প্রতি বিশেষ মনোযোগ, আগ্রহ আর ভালবাসা থেকেই নিতে পারি। কেননা দেশের সক্ষম জিনিসের প্রতি মনোযোগ না দিলে তার দিগুণ ক্ষতির  অভিশাপ আমাদের বরণ করতে হতে হবে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় আরো বেশি বাজেট বাড়ানো দরকার। গবেষণার কাজে দরকার প্রশাসনের বিশেষ নজরদারী। কেননাআমাদের ক্রান্তিকালের শনি কেটে মঙ্গল বের করে আনার জন্য এই খাত গুলোতে বাজেট বাড়ানোর বিকল্প নেই।

একটি বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থাই আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। উত্তাল মার্চের এই  কর্মপরিকল্পনা এবং এগিয়ে চলার উদ্দীপনা থেকেই নিতে হবে এর মূল প্রেরণা। অন্যথায় অটোমান সাম্রাজ্যের ভাগ্য আমাদেরকেও বরণ করতে হবে। যেখানে সাম্রাজ্যবাদ আর অশিক্ষিত জনশক্তি পরস্পর পরস্পরের বিপরীতে অবস্খান করেছিল। উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মেলাতে না পারাই এই  সাম্রাজ্য পতনের বড় কারণ। শিক্ষাদীক্ষা আর জ্ঞান-বিজ্ঞানে পিছিয়ে থাকার ফলে শুধু সমর শক্তিতে তারা আরকুলিয়ে উঠতে পারেনি। তাছাড়া উন্নত শিক্ষা। উন্নত জ্ঞান-চিন্তাও দিতে পারে  উন্নত আধুনিক সমরশক্তি।

এখন আমরা সামনে যে প্রজন্ম দেখছি তারা পড়াশুনার চেয়ে বিসি এস, সরকারী অন্যান্য লোভনীয়  চাকরি এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের দিকে  ঝুঁকছে।ক্ষেত্র বিশেষে বিসি এস কে তুলনা করা যায় হাইব্রীড বীজের সাথে। কারণ বর্তমান প্রজন্ম এখন বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির পর নিজের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনার চেয়ে বিসি এস, সরকারী বড়ো আমলা অথবা ক্যাডারসহ হওয়ার স্বপ্নেই বেশি বিভোর। ফলে নাই কোন সৃজনশীল চিন্তা। নাই কল্পনাশক্তিকে কাজে লাগানোর সময়। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনাতেও মূল বিষয়ের ভেতরে না গিয়ে মুখস্থকরার অন্ধ  কৌশলকে তারা গ্রহণ করছে । একটা মুখস্ত প্রবণ, সাধারণ জ্ঞান-মূলক তথাগত শিক্ষার প্রজন্ম গড়ে তুলছি আমরা। এটাকে তুলনা করতে পারি, জেনেটিক্যাল মডিফাইড ফুডের সাথে। যে খাবার থেকে আমরা সাময়িক পেটের ক্ষুধা নিবারণ করতে পারবো । কিন্তু এর ভেতরের যে অন্তর্গত ভিটামিনের মৌলিক শক্তি সেই শক্তি আমরা পাবো না। যে হাইব্রীড সঠিক শর্করা আর আমিষের ভেতরে কমপ্লিকেটেড যৌগ তৈরি করবে সেটা আমরা কেনইবা গ্রহণ করবো। বর্তমান প্রজন্ম যেন আস্তে আস্তে সেই আত্মঘাতি সিদ্ধান্তের দিকেই ধাবিত হচ্ছে। সুতরাং উত্তাল মার্চের শক্তির প্রেরণা হোক একটি সুন্দর তথ্য প্রযুক্তমূলক উন্নত দেশ তথা রাষ্ট্র গড়ার হাতিয়ার। আরো বিজ্ঞানসম্মত। আরো উন্নত-শিক্ষায় শিক্ষিত। মার্জিত আধুনিক মানবিক প্রজন্ম গড়ার মূলমন্ত্র।