You are currently viewing ঈহা/রাজিয়া নাজমী

ঈহা/রাজিয়া নাজমী

ঈহা

রাজিয়া  নাজমী

সেতারের সুরের মূর্ছনায় চোখের পাতা থেকে ঘুম সরে গেল কনীনিকার। ঘড়ির কাটা না দেখেও কনীনিকা জানে অন্ধকারকে সরিয়ে ভোর হতে আর বেশি বাকি নেই । প্রতিদিন একই সময় সেতারের সুরে ঘুম ভাঙ্গে কনীনিকার। তবে, নিউ ইয়র্কের ব্যস্ত ম্যানহাটনের থরে থরে বহুতল বাড়ির আশেপাশে কেউ এই সকালে সেতার বাজাবে না। আর বাজালেও  শব্দদূষণ থেকে  সুরক্ষিত এই বাড়িতে সে সুর ভেসে আসার কথা নয়। তবুও কনীনিকার ঘুম ভাঙে সেতারের সুর শুনেই। সূর্য ওঠার আগেই কে যেন খুব চুপিচুপি এসে বলে, কনীয়া এবার উঠে এসো । সেতারের সুরে সুরে সূর্যোদয় দেখবে এসো..

জীবনের এমনি কত সকালে ঘুম ঘুম চোখে কনীনিকার এলোমেলো পা চলে যেতো দিঘীর পাড়ে বাধানো ঘাটে, অয়নের পিঠে মাথা রেখে সূর্যোদয় দেখতে।

সেতারে  অয়নের  আঙ্গুলের টোকায় রাগ আহির-ভৈরবীর সুরের আমন্ত্রণে জ্যোৎস্নাস্নান শেষে সূর্য যখন তার লাল আবরণ একটু একটু করে খুলে ফেলত সুরের মূর্ছনার তালে তালে, অয়ন বলতো, কনীয়া তুমি না এলেও সূর্য উদিত হবে।  কিন্তু সে কোন নতুন সূর্যোদয় নয় । তুমি এলেই যে সূর্য নতুন করে উদয় হয়!

সেই কবেকার  স্মৃতি । সূর্যোদয় দেখার স্মৃতি। অয়নের স্মৃতি! কিছুতেই পিছু হাটেনি । যেন থেকে গেছে থাকার কথা ছিল বলেই।

শুকনো চোখে হাত দিয়ে পুরানো চোখের পানি মুছে দিতে দিতে কনীনিকা মনে মনে বলল, অয়ন, তোমার আমার প্রতিটি সূর্যোদয় থেকে আমি আমাদের  স্বপ্ন বেঁধে রেখেছিলাম। কে জানত সেদিনের বর্তমান তুমি একদিন প্রাক্তন হয়ে যাবে। সুধু স্মৃতি হয়ে চারপাশে ঘুরে বেড়াবে। ভালোবাসাও যে পদ্মপাতায় এক ফোটা জলের মত টল টল করে, কেউ জানে না কখন কী হবে।

কিন্তু কী জান অয়ন,একদিন আমাদের আবার দেখা হবে – আমাদের বয়স যখন আশি ।কিংবা তার চেয়েও বেশি। কিছু আলো কিছু অন্ধকারে আমরা হারিয়ে যাব – আকাশে, নদীতে, আর মেঠো পথে।

মনে পড়ে অয়ন ?একবার আমাদের ষ্টীমারে করে সুন্দরবনে যাওয়ার কথা হল। আর যাবার আগের দিন আমার ধুম জ্বর আসাতে আমি যেতে পারলাম না বলে তুমিও কাজের অজুহাত দেখিয়ে গেলে না। চল না  আমি তুমি আবার যাই সেই না যাওয়া নদীতে ! সঙ্গে যাবে তোমার সেতার আর আমার কবিতার খাতা। মেঘনা আর পদ্মার ঢেউয়ের তালে তাল বেজে উঠবে সেতারের ঝঙ্কার আর দূরের ঢেউ মনে করিয়ে দিবে আমাদের বলা সব কথা আবার নূতন করে!

সূর্যের আলো নদীর বুকে যে চকচকে রুপালি নরম কঙ্করবিহীন পথ এঁকে দেয়, যে পথ উদাস হয়ে কোথায় হারিয়ে যেতে চায়, সেই পথে  হাত ধরে হেটে হেটে তুমি আমি আমাদের অজানা সব কথা বলব। এসো না একবার আবার ফিরে! যা কিছু জানা যা কিছু অজানা সবকিছু সংগে করে, অন্ধকারকে সাথী করে তুমি আমি আরেকবার একবার হাতে হাত রাখি।

আমি যে বহুকাল ধরে সূর্যোদয় দেখি না অয়ন! তুমি আসলেই আমি আরেকবার সূর্যোদয় দেখবো।

তুমি আমি জানতে চাইব না  আমরা সুখে দুঃখে কেমন আছি।   আমি তোমায় বলবো না আমার সাজানো সংসার জীবনে ভালো থাকার জন্য যা কিছু প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি কিছু যেমন আছে, তেমনি আছে শূন্যতা। থরে থরে পরিপূর্ণতার মাঝেও শূন্যতা । তোমার কনীয়ার চোখের জমানো অশ্রু  মুছে দিতে  তোমার হাত কেঁপে গেলেও সেই কাঁপা হাতের ছোঁয়ায় আমি আগের মত  চোখ বন্ধ করে ফেলব। তুমি তোমার বৃদ্ধ কণ্ঠে বলবে কনীয়া তোমার চোখের হাসি দেখব বলেই যে এলাম।  বলবে,কনীয়া, কথা ছিল তুমি আমায় ভুলে যাবে না তবে কাঁদবেও না। আমাদের দিনগুলো তেমনি আছে কনীয়া। হারিয়ে যায়নি মিলে মিশে একাকার হয়ে আর কারো সাথে।

তিরিশ বছর পরেও একুশ বছরের অয়নের মুখ মনে করে আজও কনীনিকার ঘুম ভাঙ্গে । সারাদিনের জাগতিক সব দায়িত্ব পালন করে আবার অয়নের মুখ মনে করেই সে প্রতিরাতে ঘুমাতে যায়। এইটুকুই তার নিজের। যাকে সে ভুলতে পারবে না তাকে জোর করে মন থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা সে করেনি । বরং সযত্নে লালন করে গেছে মনের গভীরে। খুব যত্নে করে আড়াল করেই রেখেছে অয়নকে অন্য সব সম্পর্কের সাথে।

অয়নের ভাবনার মাঝেই  কনীনিকার গায়ের উপর আলতো একটি হাত এসে পড়লো।

ছুটির দিনের আলসে গলায় তুষার বলল, কনী, এখনই উঠে তোমার ঘর সংসারে ব্যস্ত হয়ে যেও না। বৌয়ের মাথায় আদরমাখা হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, যা ভাবছিলে তাই বরং ভাব । কনী অবাক না হয়েই বলল, তাই বুঝি। কি ভাবছি ? তুষার কনীর ঘন কালো চুল সরিয়ে ওর ঘাড়ে মুখ রেখে বলল, সানবাঁধানো  ঘাট, দীঘির পাড়ের লাল বাড়ির বারান্দা আর সেই দুর্লভ বাগান বাড়ি। আর সেখানে বসে কবিতা লিখছে একজন।

কনী হেসে ফেলল তার অর্থনীতিবিদ স্বামীর কথায় । তুষারের দিকে ফিরে বলল ,ভাবনাটা কি তোমার না আমার?

তুষার আর ঘন হয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, আমি তো  অমন এক আলিসান বাড়ি আর অত হৈরৈ লোকে লোকারণ্য বাড়ির বাগানে বসে কনে দেখার আলোতে দেখা সেই শান্ত সুন্দরী কুমারীকে ভাবি।

কনীর কপালে হাত দিয়ে বলল, কদিন বেশ জ্বরে ভুগলে, আজ সারাদিন বিশ্রাম নেবে। চিন্তা করো না তোমার দুই কন্যা থেকে যাবতীয় কাজের ভার আমার। আজ তোমার ছুটি। এখন আর কোন কথা নয়।

কনীনিকাকে লাল বাড়ি, সানবাঁধানো  ঘাটে ছেড়ে দিয়ে  তুষার আবার ঘুমিয়ে গেছে। এতগুলো  বছরেও  সে তুষারকে কখন ভোরে উঠতে দেখেনি।

অথচ কনীনিকার এখন সেই আগের মতই রাত শেষ না হতেই ঘুম ভেঙে যায়। শুধু ভোর হওয়া আর দেখা হয় না তার। মাথার বালিশটা আঁকড়ে ধরে পাশে ঘুমিয়ে থাকা স্বামীর কাছ থেকে একটু সরে গিয়ে অতীতের শরীরের ভিতর ঢুকে গেলো সে।

সত্যি , বিশাল বাড়িটায় কী দারুণ সানবাঁধানো  ঘাট বানিয়ে ছিল বাবা। বরাবরই বাবা নাকি খামখেয়ালি ছিল। স্কুল শেষ হতেই চলে এলো আমেরিকায়। বেশিদিন মন বসলো না । আবার ফিরে গেলো দেশে – একদম নিজের গ্রামে।

বাপ দাদার পুরনো জমিদারির সাথে নতুন ব্যবসা ছিল দাদার । ছেলের ছন্নছাড়া মতিগতি দেখে দাদা যতটা সম্ভব সংসারের গুটি গুছিয়ে রেখে যেতে চেয়েছিলেন। তার তিন ছেলের মধ্যে এই ছোট ছেলেই মেধাবী তবু তার উপরও কোন ভরসা করতে সাহস হয়নি। আয়ের চাইতে খরচের হাতটাই বড় লম্বা ছোট ছেলে নাজিমুদ্দিনের।

খুব শখ করে দাদা তার বাবার নামের সাথে মিল করে নাম রেখেছিলেন আবুল কালাম নাজিমুদ্দিন চৌধুরী । ছেলে বিদেশ যাওয়ার আগেই তা কেটে ছেঁটে  নাজিম চৌধুরী করলো । দিন দুয়েক কথা বলেননি দাদা বাবার সাথে। বিদেশ যাওয়ার দিন ঘনিয়ে আসতে রাগ দুঃখ চেপে রেখে দাদা বাবার সাথে কথা বলতে শুরু করলেন।

দুম করে বিদেশ থেকে ফিরে ছয়মাসের মধ্যেই বাবা হঠাৎ একদিন আবদার করে বললেন, তাদের এই সেকেলে জমিদার বাড়ির ভেতর-বাহিরটা একটু বদলাতে চান।

দাদা চিন্তিত হয়ে বললেন তুমি কি আমার বনেদি বাস তুলে শহুরে করে তুলতে চাও?

বাবা বললেন, না তা নয় । আমি আরও অথেনটিক রূপ দিতে চাই এই বাড়ির।

মানে?

মানে, যখনই এই বাড়ির কোন মেরামত হয়েছে তখন সেটা ঠিক ভাবে হয়নি। আমি একটু ঠিক করতে চাই । তাছাড়া বাড়ির পিছনের পুকুরটা কেটে আর বড় করব – জায়গা তো পড়েই আছে।

অর্থাৎ তুমি এটাকে দীঘি বানাতে চাও। তারপর?

দীঘির চারদিকে ঘাট সিঁড়ি বানাবো । সিঁড়িগুলো দীঘির ভিতরে অনেকটা দূরে টেনে নিয়ে যাব। একটু খরচ হবে তবে,

কিন্তু কেন?

করতে দিন আগে তারপর দেখবেন।

এটা কি একবারেই বাজে খরচ নয়? এখন যেমন আছে তাতে কারো অসুবিধা হচ্ছে বলে তো শুনি নাই। কিছুটা কিছুটা  নিচুস্বরে বললেন, শুধু শুধু বিদেশ গিয়েও কতগুলো টাকা…। ছেলের দিকে তাকিয়ে কথাটা শেষ করলেন না । দাদার স্বভাবের এটাও বিশেষ দিক ছিল। কাউকেই অসম্মানিত করতে পারতেন না। ছেলের বিদেশ যাওয়ার ব্যাপারে তাঁর খুব মত ছিল না। না করেছিলেন তবে তখনও ছেলেকে বাধা দিতে পারেননি।

ছেলে খুব আস্তে করে বলল, বাবা , আমি পুরনো কিছু ভাঙ্গছি না । আমি পুরনোকে ধরে রেখে নতুনের স্বাদ আনতে চাইছি ।  দেখবেন বারান্দায় বসে  দীঘি , বাগান দেখে আপনার ভালো লাগবে। সুন্দর কিছু দেখতে ,উপভোগ করতে যা খরচ হয়, তা অপচয় নয় ।

বাড়ির থেকে দীঘি অবধি হেটে যাওয়ার পথ লাল রঙের ইট, শুধু একটি ঘাট একটু অন্যরকম হবে। সেই ঘাটে বাড়ির সবাই মিলে বসবে। দীঘির পাড়ে গাছের ছায়ায় সবাই মিলে।

ছেলের কথায় বিরক্ত হচ্ছে জেনেও ছেলের কোন হুঁশ নেই দেখে দাদা উঠে যেতেই বাবা বললেন, আমাদের এই বাগানেও আর কিছু গাছ লাগাতে হবে আর বাগানের ভিতরে আমি পাথরের রাস্তা বানাবো , কিছু বসার চেয়ার আর দোলনা বসাবো…

দাদা নাকি আর বাকি কথা শুনতে চাননি। বলেছিলেন, যা খুশি কর কিন্তু আমারও শর্ত আছে। তোমাকে বিয়ে করতে হবে । তোমার পছন্দ থাকলে জানাও। নয়ত আমি ঘটক ডাকছি। তোমাকে এবার ব্যবসায়ও মন দিতে হবে। দাদা ভেবেছিলেন এতে করে যদি এই ভ্যাগাবণ্ড ছেলের সুমতি হয়।

আছে তোমার নিজের পছন্দ? তোমার কাছে সে উত্তরে আমি অবাক হব না । তবে পাত্রী আমাদের উপযুক্ত হতে হবে। বাবা দাদাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, না; আমার নেই।

বাবা রাজি হলেন ঘটক দিয়ে আনা পাত্রিকে বিয়ে করতে। তবে তারও শর্ত ছিল। পাত্রীর সাথে তাকে কথা বলতে দিতে হবে । আর দাদার রঙ আর কাঠের ব্যবসা তিনি করবেন না । তাকে নতুন ব্যবসা করতে দিতে হবে ।

কি করতে চাও?

বইয়ের ব্যবসা।

বই?

দাদা যেন কোন জন্মে শোনেন নাই এমন ব্যবসার নাম । ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলে উঠলেন তোমার মায়ের স্বভাব পুরোটাই পেয়েছ।

বাবা আস্তে করে বলছিলেন, ভাগ্যিস। তবুও দাদা ঠিক শুনতে পেয়েছিলেন।

বাবা আর দাদার তর্কাতর্কির শেষ নাকি সবসময় দাদীকে নিয়েই হত। দাদী খুব ভালো গান গাইতেন , কবিতা লিখতেন । দাদা  দাদীর  গান  তেমন করে না শুনলেও দাদীকে বাধা দেননি  গাইতে।

দাদীর ধারনা উনি শুনতেন ঠিকই কিন্তু ধরা দিতেন না। দাদী যখন হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করতেন। দাদা নাকি ইচ্ছে করেই অন্য দিনের চাইতে দেরি করেই সবকাজ করতেন , কাপর জামা ধীরে ধীরে পরতেন। দাদীর গান শেষ হলেই বলতেন, কোথায় যে কি রাখি আজকাল খুঁজেই পাইনা । দাদী হেসে বলতেন যেখানে থাকে সেখানেই আছে , দাঁড়াও আমি দিচ্ছি। দাদী বলতেন তোদের দাদা আমার প্রতি তার সব ভালবাসা যত্ন করে লুকিয়ে রাখতেন। আমাকে সে লুকানো ভালোবাসা খুঁজে নিতে হত। দাদীকে জরিয়ে ধরে কনীনিকা দাদীর কুঁচকানো ফরসা গালে চুমু দিয়ে বলতো, আমার সোনা দাদু এটাকে বলে আন্ডারস্ট্যান্ডিং।

দাদী তার একমাত্র নাতনীকে পালটা জবাব দিয়ে বলত অত সব বুঝিনারে আমার চোখের মনি, শুধু জানি উনি আমাকে অনেক কথা বলতে চাইতেন কিন্তু পারতেন না। এক সময়ের জমিদার তারপর রঙ আর কাঠের ব্যবসায়ীর মনের সাগরে মুক্ত থাকলেও হাতে তুলে দিতে লজ্জা পেতেন। তাই তো আমাকেই তুলে নিতে হত। জানিস, আমি যখন রবি ঠাকুরের ‘ অনেক কথা যাও যে বলে কোন কথা না বলে’ গাইতাম তখন তোর দাদার গোঁফের কোনে হাসি ফুটে উঠতো। আমার সাথেই মুখচোরা ছিল সে। অথচ ওর পায়ের আওয়াজেও লোকজন ভয় পেত। পান থেকে চুন খসলেই রক্ষা ছিল না কারো। অত রাশভারী লোক আমার কাছে এলেই যেন অন্য এক মানুষ হয়ে যেত। সেই প্রথম দিন থেকে শেষ দিনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সে আমাকে খুব যত্ন করেছ । কখন একবারের বেশি দুইবার তার কাছে চাইতে হয়নি কিছু। তোর বাবা আমাকে ঢাল বানিয়ে সব আদায় করত বাবার কাছ থেকে। তোর বাবাকে রাগ করলেও সব সন্তানের মধ্যে ওকেই বেশি আদর করতো। সবাই বলতো তোর বাবা আমার মত দেখতে আর স্বভাবেও আমার মত তাই ওর প্রতি পক্ষপাতিত্ব ছিল। ছেলের সাথে তর্কাতর্কি উপর উপরই ছিল ।

দাদীর তার এই নাতনীর কাছেই তার সুখের দিন, তার প্রিয় মানুষকে হারানোর ব্যথার কথা বলতে ভালবাসতেন। অনেকবার শোনা কিছু কথাও কনীনিকার কাছে নতুন লাগতো ।

দাদী বিধবা হলেও বিয়ের রাতে স্বামীর দেওয়া আংটি পড়ে থাকতেন।

একদিন আংটিটা আঙ্গুলে ঘুরাতে ঘুরাতে তার জীবনের সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত দিনের কথা মনে  বলেছিলেন, কী যে হলো একদিন সকাল বেলা । আগের রাতেও কত ভালো ছিল। তোর বাবা কাকুদের সাথে বসে রাতের খাবার খেলেন, তারপর শোবার ঘরের সাথে লাগোয়া বারান্দায় বসে হুঁকো টানলেন রোজকার মত। নিয়মের সাথে কোন বাড়াবারই ছিল না তার । সারাজীবন ধরেই ঘড়ির কাঁটায় নজর রেখে চলতেন। সেদিন হুঁকো টানতে টানতে মাধবের নাতী  সোনাইকে বলেছিলেন ঘাড় কেমন নাকি ধরে ধরে আসছে তাই একটু চেপে দিতে। মাধব ছিলো তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত কাজের লোক। ওকে ছাড়া সে এক পা চলতে পারত না । ভৃত্যস্থানীয় হলেও মাধবের সাথে তার চাকর মনিব সম্পর্ক ছিল না । ছোট বেলায় দুজনে একসাথে খেলত। আমাকেও বলেছিলে মাধব আর তার বউ বাচ্চাদের যেন আমি ওই নজরে না দেখি ।

সেই মাধব বলা নেই কওয়া নেই দুমকরে দাঁড়ানো থেকে মাথা ঘুরে পড়ে গেল আর উঠলো না। তোর দাদার অনেকদিন লেগেছিলো সেই শোক কাটিয়ে উঠতে। অবাক কাণ্ড কী জানিস, তোর দাদাও বলতে গেলে মাধবের মত করেই গেলে। তার যে এত শরীর খারাপ ছিল আমি বুঝতেই পারিনি।

সোনাই আমাকে বলেছিল, কর্তাদাদাজানের মনে হয় ঘাড়ে ব্যথা। আমি জানতে চাইলেই বলল, এই মাধব বেটা দিয়ে গেছে আমার জন্য ছোট মাধব । সারাক্ষণ কর্তাদাদার খবরদারি। মাধব ওকে উপর থেকে চালায় কিনা কে জানে। তুমি ওর কথা কানে নিও না । কিছু হয়নি আমার । ঘাড়ে আরাম লাগে তাই বেটাকে বলেছিলাম একটু চেপে দিতে । আমি ওর কপালে হাত দিয়ে বললাম মিথ্যে বলছ না তো? কপাল থেকে আমার হাত নামিয়ে হাতে ধরে বলল, সত্যি বলব, কেন জানি মাধবকে আজ খুব মনে পড়েছিল তাই চাইছিলাম সোনাইটা কাছে থাকুক কিছুক্ষণ। বললে বিশ্বাস করবে কিনা জানি না। আজ ওর হাতের ছোঁয়াটা ভীষণ ভাবে মাধবের মত লাগছিলো। যেন মাধবই ঘাড় চেপে দিচ্ছে। মনে হচ্ছিল মাধব দাড়িয়ে আছে আমার মাথার কাছে। চোখ খুললেই ওকে দেখতে পাব।

আমি তোর দাদাকে খুব ভাল বুঝতে পারতাম। তাই জানতাম ওর ভিতরটা কত নরম। আমরা সবাই পুরনো দিনের কথা, ফেলা আসা দিনের স্মৃতির কথা বলি ,উনি তা পারতেন না। ভিতরে ভিতরে কষ্ট পেতেন। তাই সেদিন যখন বলতে চাইলো আমি তাকে বাধা দেয়নি। সে রাতে যা সে কোনদিন করেনি তাই করলো, আমাকে বলল তুমি খুব ভালো গান কর। গানটা ছেড়ে দিও না । তোমাদের বাড়িতে প্রথম যেদিন যাই তুমি আমাদের ছোড়দির অনুরোধে গান গেয়েছিলে। সবাই ভেবেছিল আমি শুনছি না কিন্তু আমি মন দিয়ে শুনছিলাম । আমার খুব ভালো লেগেছিল।

আমি বললাম আমাকে না গানকে ?

না হেসেই বলল, তোমাকে, তোমার গানের গলা, তোমার গায়কী ঢঙ্গ , সবটাই ভালো লেগেছিল। তারপর ছোড়দি বাড়ি ফিরে আমাকে ডেকে নিয়ে বলল, সত্যি করে বল তোর মেয়েটাকে ভালো লাগেনি ? আমাদের সবার খুব মনে ধরেছে। কী সুন্দর দেখতে, গায়ের রঙ, শরীরের গঠন কি ভালো। আর এত ভালো গান করে। বাবা যে ওকে কী ভালোবাসবে।

আমি বললাম, তোমাদের সবার পছন্দ হলে আমাকে জিজ্ঞাসা করছো কেন। ছোড়দি হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, কথা দে আমায় ছুঁয়ে, আর অমত করবি না।

আমি তোর দাদাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আর যদি সবার পছন্দ না হত তবে কী করতে? সে তখন আমার কপালে হাত রেখে বলল তোমার এখানে যে এটাই লেখা ছিলো । আমার মত বেরসিকের সাথেই যে তোমার এ জীবনের গল্প কাহিনী লেখা ছিল। দুঃখ এই যে আমি এতটাই বেরসিক যে আমার অনেক কথাই অব্যক্ত রয়ে গেলো।

আমি হেসে বলেছিলাম তবু এই বেরসিককে ছেড়ে দুদিন কোথায় গিয়ে থাকতে ভালো লাগে না। তোমায় আজ একটা কথা বলি , আমার এই বেরসিকই ভালো। এই জীবনে নয় , যদি আবার জীবন হয় তবে এই বেরসিক মানুষটাকেই যেন পাই।তুমি ভাব আমি তোমাকে বুঝতে পারি না, না গো না আমি তোমায় খুব বুঝতে পারি।

সে বলল ,পারো বুঝি!

জানিস এই কথাটা বলতে বলতে  তোর দাদা তার বুকে হাত বুলাচ্ছিল। হয়ত তখন বুকে কেমন কেমন করছিল। আমি বুঝতে পারিনি  অথবা খেয়াল করিনি ।

আমাদের পারিবারিক ডাক্তার তো তার প্রেশার মাপতো সব সময় । তোর দাদা বলত, ঘড়ি ঠিক চলছে ডাক্তার ও নিয়ে তুমি ভেবো না।

সেদিন সেই রাতে তোর দাদাকে কথায় পেয়ে গিয়েছিলো । আমি বিছানায় যেতেই বলল আজ না হয় একটু দেরিতে ঘুমাতে যাই, তোমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে । আমি  পালঙ্ক থেকে নেমে ঘুরে ওর কাছে এসে বসে বললাম, তোমার আজ কি হয়েছে বলবে ? কিছু কি লুকাচ্ছো আমার কাছে?

আমার হাতে হাত রেখে বলল, আমি যেমনই হই না কেন তোমার কাছে লুকাইনি কিছু কোনদিন। কোনদিন এমন করে কথা বলিনি বলে কি আজ বলতে বারণ মনি ?

আমি বললাম, বারণ কেন হবে , তবে আজ এত রাত হয়ে গেছে , এখন ঘুমিয়ে পড় , কাল শুনব।

এতবার বলার পরেও তোর দাদা কিছুতেই শুনল না। বলেই চলল । আমার হাত বুকের উপর রেখে বলল, আচ্ছা আমার মত এই রোগা পাতলা মানুষ তোমার কেন পছন্দ হল?

আমি তখন তোর দাদার কপালে হাত দিয়ে বললাম এইখানে যে লেখা ছিল আমার নাম। কী করে আমায় ছাড়া থাকতে তুমি ?কি করে আমিই এই পাতলা রোগা রোগা মানুষকে পছন্দ না করে পারতাম!

সেদিন অনেক কথা বলেছিলাম দুজনেই। পঞ্চাশ বছর একসাথে কাটাবার পর সেদিন রাতে আমাকে বলেছিল, একটা গান করবে?

অবাক হয়ে বললাম এই এখন ? ছেলে মেয়েরা কি বলবে ?

না হয় ভাবলো কিছু, তাতে কী ? আমার মাথা ওর বুকের উপরে টেনে নিয়ে বলল, খেলা ঘর বাধতে লেগেছি গানটি গাও।

গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছিল । রোজকার মত আজান শুনে উঠে নামাজ পড়লো । উনি সব সময় নামাজে শেষে আরেকবার সেজদায় যেতেন ।একটা বাড়তি সেজদা দিতেন । সেদিনও তাই করে উঠে দাড়াতে গিয়ে আমাকে বলল, মনি আমার খুব কষ্ট হচ্ছে । তুমি ওদেরকে ডাক । আমি বারান্দায় গিয়ে তোর বাবা কাকাদের ডেকে ফিরে এসে দেখি বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে আছে । সারা কপাল জুড়ে ঘাম । গায়ের ফতুয়াটা ঘামে ভিজে গেছে।

আমি কি করব বুঝতে পারছিলাম না। আমার কোলে ওর মাথা রেখে আচল দিয়ে ঘাম মুছে দিতে দিতে পাগলের মত কাঁদছিলাম । তোর দাদার সাথে বিয়ের পর থেকে কোনদিন আমাকে কোনকিছু নিয়ে ভাবতে হয়নি। যে মানুষ আমার সবচেয়ে বড় সহায় ছিল সেদিন তার মাথা কোলে নিয়ে নিজেকে সবচেয়ে বেশি অসহায় লাগছিল।

তোর বাবা গাড়ি নিয়ে গেল ডাক্তার ভাইকে নিয়ে আসতে।

ডাক্তার আসার আগেই মানুষটা চলে গেল তার এতদিনের চেনা বাড়ি, চেনা জগত , কাছের সবাইকে ছেড়ে, আমাকে ছেড়ে।

যাবার আগে আমার কোলে মাথা রেখে, আমার হাত ধরে বলেছিল তোমার সাথে আমার আরো অনেকদিন থাকার ইচ্ছে ছিল ।  পারলাম না।তুমি আমায় ক্ষমা করে দিও মনি। আমি যে তোমায় খুব ভালবাসি, এই কথা তোমায় বলিনি কখন । তবে আজ বলে গেলাম । তুমি তোমার বাকি জীবনে এই কথাটি মনে রেখ । খুব ভালোবাসি আমি তোমাকে।

এরপরে আরো কিছু বলতে চেয়েছিল কিন্তু সেসব কথা বোঝা যায়নি। তার চোখ আমার দিকে তাকিয়ে থেকেই নিথর হয়ে গেলো। আমি চাইনি ওর চোখের পাতা কেউ বন্ধ করে দিক। কতক্ষণ ওর মাথা কোলে নিয়ে বসেছিলাম জানিনা। এক সময় আমার কোল থেকে মাথা নামিয়ে দিয়ে তোর বাবা আমাকে  বুকের ভিতর জরিয়ে ধরে বলল, বাবা আছে বাবা থাকবে আমাদের সবার মাঝে। আমি দেখলাম ডাক্তার আস্তে আস্তে ওর চোখের পাতা বন্ধ করে দিয়ে চাঁদর টেনে দিলো মুখের উপরে।

দাদী আঁচল দিয়ে চোখ মুছে বলল, তুই জানিস মাধব এসেছিল সেদিন। কনীনিকা চমকে উঠেছিল দাদীর কথায়। কি বলছ তুমি ?

হ্যাঁ রে , বিশ্বাস কর ,যখন ওনাকে জানাজায় নিয়ে যাবার আগে আমাকে শেষবারের মত দেখাতে নিয়ে গেলো, তখন দেখি মাধব দাড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে বলল, বউদিদি তুমি একদম ভেবো না , আমি তো আছি দাদাবাবুর সাথে। আমি মাধবদা বলে উঠে দাঁড়াতেই সবাই আমাকে ভিতরে নিয়ে এলো । বিশ্বাস করলো না কেউ যে মাধব ছিল ওখানে তখন। তুই বিশ্বাস কর মাধব এসেছিল সেদিন।

দোতলার বারান্দায় দাড়িয়ে আমি দেখলাম মাধবদা খাটিয়ার কাছে দাঁড়িয়ে। নিচ থেকে আমাকে আরেকবার দেখে মাধবদা খাটিয়ার পায়া ধরে ধরে সবার সাথে চলে গেলো ।যাবার আগে চোখের ইশারায় যেন বলে গেলো মন খারাপ কর না, দাদাবাবু তোমার চোখের জল চাইছে না।

সেই তখনই আমি চোখ মুছে ফেললাম । প্রতিজ্ঞা করলাম আমি এতকাল যেমন ছিলাম তেমন করেই থাকব । তোর দাদা আমাকে খুব সুন্দর একটা জীবন দিয়েছে । তার দেওয়া সেই জীবনকে আমি নষ্ট করি কি করে। যদি করি তবে যে তার বড় অসম্মান হত।  তবুও অনেক চেষ্টা করেও তোর দাদার অনুপস্থিতি মেনে নিয়ে জাগতিক জীবনে ফিরে যেতে আমার অনেক মাস কেটে গিয়েছিল।

কনীনিকা দাদির কোলে মাথা রেখে দাদীর ভালোবাসার কথা শুনতে শুনতে ভাবছিল ভালোবাসা কত ভাবে একেকজনের জীবনে আসে। কারো বুকে রক্তক্ষরণ হয়েই যায় আরে কারো বুকে ক্ষরণ হয় না –  হিমশীতল রক্ত জমাট বেঁধে থাকে ! সেই জমে যাওয়া রক্তের ভার বয়ে বেড়ায় কেউ কেউ। কি জানি এই রক্তের পাথরেই হয়ত সর্বক্ষণ প্রতিধ্বনিত করে অয়নের নাম কনীনিকার নিঃশ্বাসের ধ্বনিতে !

দাদীকে সে জিজ্ঞাসা করেছিল দাদাকে কেন এত ভালবেসেছিল। সে কি করে বুঝতো দাদা তাকে ভালবাসে? যে মানুষ তাকে ভালবাসার কথা বলতো না। তার ভালবাসা কি করে বোঝা যায়?

দাদী মিষ্টি হেসে বলেছিলো ,প্রথমদিন ওনার চোখের দিকে তাকিয়ে কেন যে ভীষণ ভাললেগেছিল জানিনা । মুখের কথাই  কী মনের ভাব , ভালোবাসা বোঝা যায় দিদিভাই । মনকে বোঝার জন্য যে মন থাকতে হয়। খনির মধ্যেই মনিমাণিক্য লুকিয়ে থাকে, যেমন থাকে ঝিনুকের ভিতর মুক্তো। ভালোবাসার মানুষদের যে তা খুঁজে আনতে হবে।

কনীনিকা বলেছিল, কিন্তু দাদু সব ঝিনুকের ভিতর যে মুক্তো থাকেনা । ভুল করে সেই ঝিনুক বেছে নিলে যে শূন্যতা জীবনভর ঘিরে থাকে। মুক্তো না পাওয়ার বেদনা যে অনেক কঠিন। আবার ধরো, তুমি ঠিক ঝিনুক পেলে কিন্তু হারিয়ে ফেললে তবে কি করবে?

দাদী কোল থেকে নাতনীর মাথা তুলে বলল, মুক্তোর মধ্যে যে রকম আছে। সব মুক্তো পেলেই যে তোমাকে মানাবে এমন যে নয় আমার চোখের মনি । একটা কথা মনে রেখ, দ্বিধা দন্ধ নিয়ে যে পাওয়া তাতে ফাঁক থেকে যায়, সে পাওয়া হারিয়ে যাওয়াই ভালো।

দাদীকে মনে মনে বলেছিল, তুমি অয়নের কথা বলছ তো !দ্বিধা দন্ধ তো ছিল না আমার। তবুও আমি যে ভালোবাসাকে হারিয়ে ফেললাম, সে যে তুমি জানলে না দাদু !আমার যে সবটুকু বোঝাই হল না। তার আগেই হারিয়ে গেল অয়ন।

তুষারের বারণ সত্যেও কনীনিকা উঠে পড়লো।এতক্ষণ বিছানায় পড়ে থাকার অভ্যাস নেই তার। বাইরে এখন ভোরের আলোয় ভরে গেছে। নিজের জন্য চা বানিয়ে রান্নাঘরের পাশেই ফ্যামিলি রুমের সোফায় গিয়ে পা গুটিয়ে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতেই দেয়ালে দাদীর ছবিটার দিকে চোখ পড়লো। দাদীর এই ঘরটা খুব পছন্দের ছিল। এই ঘরে বসে কত গল্প করতো দাদী।

দাদীর ছবির পাশেই বাবা মায়ের দুটি আলাদা ছবি। কনীনিকা আজ অনেকক্ষণ  ছবি দুটির দিকে তাকিয়ে ভাবল, বাবা মায়ের একসাথে কোন ছবি নেই তার কাছে ।

বাবা মায়ের সম্পর্ক সব সময় কেমন আলগা গোছের ছিল। বিয়ের আগে কনীর এসব কখন মনে হয়নি। বিয়ের পরেই মনে হয়েছে ওদের জীবন যেন সব রীতিনিয়ম মেনে চলা বিবাহিত জীবন । মা আর সবার সাথে বাবার সাধ করে বানানো ঘাটে বসলেও কখন একা বা বাবার সাথে বসেছে কিনা কনীনিকা জানে না । কোনদিন বাগানেও কি ওরা দুজন অকারণে সময় কাটিয়েছে ?কনীর চোখে পড়েনি।

নিজের বাবাকেই কতটা জেনেছে সে! বাবা মানেই একরাশ বইয়ের ভিতর ভারী চশমা পড়া একজন । মাঝে মাঝে দাদীর কাছেই কেমন শিশুর মত শুয়ে থাকত। এসব এতই স্বাভাবিক মনে হত যে মনের ভিতর কোন প্রশ্ন জাগেনি। যেমন জাগত না মা- কাকীমাদের  চট করে চোখ মুছতে দেখলেও। যৌথ পরিবারে বড় হওয়ার কারণেই পরিবারের কাউকেই সম্পূর্ণ করে চেনা যায়নি হয়ত । নিজের বাবা মাকেও নয়। কনীনিকার মনেই পড়ে না মা বাবার সাথে কোন একলা দিনের কথা । মায়ের আদর আর কাকীমার আদর যেন একই ছিল। মা -কাকীমাদের  যৌথ যত্নে সবাই বড় হয়েছে।

শুধু বাড়তি আদর আর সঙ্গ পেত দাদীর কাছে । বই পাগল বাবাও দাদীর কাছেই শুনেছিল মেয়ের কবিতা লেখার কথা । একদিন শুধু ডেকে বলেছিলেন, চর্চাটা রেখো।  ভালো লিখতে গেলে অনেক পড়তেও হয়। মায়ের কাছে আমার লাইব্রেরির চাবি রেখে দিয়েছি ।  অনেক ভাল বই আছে ।

বাবা কোনদিন জানতে চায়নি কি সে লিখত আর কেন একসময় সেই চর্চাও হারিয়ে ফেলল । কেউ কখন জানতে চায়নি কোন অভিমানে ভালোলাগার অনেক কিছুকেই হারিয়ে যেতে দিয়েছে সে।

দাদীই মাঝে মাঝে বলতো কার উপর অভিমান করে লিখিস না । দেয়ালে টাঙানো দাদীর ছবিটি দেখলো কনীনিকা।

অনেক জোর করে দাদিকে আমেরিকায় আনতে পেরেছিল । সব নাতিদের জেদের কাছে হার মেনে শেষ অবধি আসতে রাজী হয়েছিল। ধরে বেধে একবছর রেখে দিয়েছিল । কনীনিকার কাছেই বেশি সময়  ছিল দাদী। দাদীর সেই ঠোট চেপে হাসি মুখের ছবিটি সেই সময়ে তুষার তুলেছিল । ছবিতেও দাদীকে কি প্রাণবন্ত লাগছে !

দাদীই রেখেছিল তার নাম । পাঁচ নাতির মাঝে একটি নাতনি। তাই দাদী নাম রাখলো  কনীনিকা – চোখের মনি। দাদীর কাছেই তার গান শেখা।

দাদীর শরীর বরাবরই ভাল ছিল। নব্বইতে মনে হত সত্তর বছর বয়স। শনি রবি এলেই তুষারকে বলত নাতজামাই কোথায় যাব আজ! নয়ত বলত সেন্ট্রাল পার্কে নিয়ে চল আজ ।

কখন ওরা সবাই মিলে যেত কখন ওরা দুজন শুধু যেত। নাতজামাইর সাথে তার খুব ভাব ছিল। তবে দাদীর সাথে কার ভাব ছিলো না! কী এক যাদুকরী স্বভাব ছিল দাদীর। যে কোন মানুষের মন জয় করতে তার দুই মিনিট সময়ও লাগত না। এক সময় এমন হত ওদের বন্ধুরা দাদীর জন্যই বাড়িতে আসতে চাইত।

সাদা শাড়িতে চওড়া কালো পাড়ে দাদীকে সবসময় কী যে অন্য রকম আকর্ষণীয় লাগত। একবারে পিকচার পারফেক্ট জীবন বলেই হয়ত দাদীর কখন অসুখ হত না । হাতে পায়ে ব্যথা ছিলো না , কানে শুনতেন ঠিকঠাক মত। সুধু একবার সামান্য হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতেই মা নাকি বাবাকে বলেছিলেন চোখের ডাক্তার দেখাতে। দাদী হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন, তোমার শ্বশুর মশাই আমাকে তোমাদের কোলে তুলে দিয়ে গেছে। তাই বলে এত ভেবো না। একটু হোঁচট খেলেই চোখের দোষ হয় না । বাবাকে বলেছিলেন খোকা দূর থেকে আমি তোমার মাথার সাদা চুল দেখতে পাই। তার দুদিন বাদে মা কাকীমার সাথে বসে দাদী যখন টিভি দেখছিলেন তখন নাকি ঠিক মত দেখতে না পেয়ে ভুলভাল নাম বলেছিলেন। ব্যাস, মা কাকীমা আর কথা মানলেন না । চোখ দেখিয়ে কাল ফ্রেমের চশমা কিনে বাড়ি ফিরলেন। কনীনিকাকে চশমা নিতে হয়েছে সেই কবে। মেট্রিক পরীক্ষার দেওয়ার সময়। অয়ন দুষ্টামি করে বলেছিলে এখন আমাকে ভালো করে দেখতে পাবে। এতদিন তো আধা দেখেছ। তাই…

তাই কী অয়ন ?

তাই আমার চোখে তোমার ছায়া দেখতে পাওনি ।

অয়ন রমা পিসীর ছেলে ।

কনীনিকা  অনেক বড় হয়ে জেনেছে রমা পিসী দাদার পালক মেয়ে। দাদা তার কাঠের ব্যবসার কাজে গিয়েছিলেন এক গ্রামে। ঘরে আগুন লেগে রমা পিসীর বাবা মা দুজনেই মারা যায়। শুধু রমা পিসীই বেচে যায়। পিসীর বাবা তাকে ঘরের বাইরে এনে প্রতিবেশীর কোলে দিয়ে আবার ঘরে গিয়েছিলেন বউকে বাঁচাতে। ততক্ষণ আগুন ছড়িয়ে গিয়েছিল সারা ঘরে। দুজনের কেউই আগুনের ভিতর থেকে বের হতে পারেনি। তিন বছরের শিশুটির কাছের কেউ ছিল না। গ্রামের চেয়ারম্যানকে রাজি করিয়ে দাদা রমা পিসীকে নিয়ে এসে স্ত্রীর কোলে দিয়ে বলেছিলেন, তোমার তিন ছেলের সাথে একেও মেয়ে জ্ঞানে বড় করবে তবে ওর বাবা মায়ের দেওয়া নাম পাল্টাবে না। আর ওর জন্মসূত্রের হিন্দু ধর্মও বদলাবে না। এটা ওর অধিকার। ওর বোঝার মত বয়স হলে ওকে ওর জন্ম পরিচয় জানাবে। ও আমাদের কাছে কন্যার অধিকারেই বড় হবে কিন্তু ওর শিকড় আমরা উপড়ে ফেলব না। ওর নাম রমা মিত্তির ।ওকে যেন কেউ চৌধুরী করে না দেয় সে খেয়ালটা রেখ।

সেই থেকে বাড়ীর সকলের আদরে বড় হলো রমা পিসি। দাদা বিয়ে দিলেন ঠিকঠাক হিন্দু মতে, পাত্রের সাথে জাত মিলিয়ে , ঠাকুর ডেকে, লগ্ন মিলিয়ে, শাঁক উলু বাজিয়ে, সাতপাক ঘুরে, সিঁদুর-দান করে  দাদা পাত্রের হাতে তুলে দিলেন মেয়েকে একেবারেই হিন্দুমতে সম্প্রদান করে । বিয়ের সেই লগ্নে যেন রমা পিসীর জন্মদাতাই দাদার মধ্যে বসে ছিলেন।

মুসলমান ঘরে বড় হওয়া মেয়েকে হিন্দুঘর মেনে নিলো কী কারণে সে কথা দাদাকে কেউ জিজ্ঞাসা করতে পারেনি।

রমা পিসীর বিয়েতে দাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরেছিলেন। ধুতির এককোণা দিয়ে কেবল নাকি হাতের ঘাম মুছছিলেন। রমা পিসীকে একহাতে ধরে আরেক হাত মাথায় রেখে কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারেননি। গলা থেকে ফিসফিস আওয়াজ বের হয়েছিল যার কোন অর্থ কেউ বুঝতে পারেনি। রমা পিসী নাকি কেঁদেকেঁদে বলেছিল, বাবা তোমার কষ্ট হচ্ছে তুমি কথা বোল না ।

সন্তানদের মধ্যে রমা পিসীই দাদাকে তুমি বলে ডাকতো।

তার সেই আদরের মেয়ে রমা একদিন তার বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিলে বাবা তুমি আমাকে পুরোপুরি করে কেন নিলে না ? দাদীর নাকি এ ভয়টাই ছিল।

দাদা তার একমাত্র মেয়েকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন।এতদিনে তুমি এই বুঝলে মা! ধর্ম কী বাবা আর মেয়েকে আলাদা করতে পারে! তুমি যখন পুজো করবে তখন পিতা হিসাবে আমার জন্য প্রার্থনা করবে ।আমি ভিন্ন ধর্মের বলে ঈশ্বর কি আমাকে তোমার পিতার স্থান থেকে বঞ্চিত করতে পারে? ঈশ্বর যে অত জাত বিচার করেন না। যদি করতেন তবে তুমি কেন আমার মেয়ে হতেই জন্ম নিলে?

আমি যখন দুহাত তুলে মোনাজাত  করি  তখন যে তোমাদের সবার জন্য একসাথেই  দোয়া করি। তুমি আমার আলাদা কেউ নও। তুমি এই পৃথিবীতে যে ভাবে এসেছ যাদের ভিতর দিয়ে আমার কাছে এসেছ আমি শুধু তাদেরকে সম্মান করতে চেয়েছি। সবারই যে নিজের জন্মগত পরিচয় থাকে। কেন তা বদলে যাবে? তোমার জন্মগত পরিচয়কে তুমি সম্মানের সাথে মনে রাখবে । এই আমার চাওয়া তোমার কাছে।

অয়নের বয়স যখন মাত্র পাঁচ বছর তখন কি এক ষড়যন্ত্র থেকে বাঁচার জন্য পিসেমশাই দেশ ছেড়ে চলে গেলেন। বলে গিয়েছিলেন সবকিছু গুছিয়ে নিয়েই বউ বাচ্চাকে নিয়ে যাবেন। দাদা পিসের এই চলে যাওয়ার ব্যাপারটায় চিন্তিত ছিলেন। তার যাওয়ার কারণটি খুব অস্পষ্ট লেগেছিলে সবার কাছে।

দিন মাস বছর পার হয়ে গেলেও পিসোর কাছে থেকে যখন কোন খোজ পাওয়া গেলো না। তখন দাদা তার মেয়ে আর নাতিকে নিয়ে এলেন। মেয়েকে তার বাড়ীর অংশ লিখে দিলেন । ছেলেদের ডেকে অন্য আরো সব সম্পত্তির অধিকার পাকাপাকি ভাবে লিখে দিলেন মেয়েকে। পিসোর কোন খোজ পাওয়াও যায়নি । তবু পিসোর কাছ থেকে ডিভোর্সের কাগজ না আসায় রমা পিসী পিসোর সধবা স্ত্রী হিসাবেই কাটিয়ে দিলেন। রমা পিসীর ধারনা ছিল তার স্বামী  বেঁচেই আছেন। তবে বয়স বাড়তে থাকলে হাতে শাঁখা-পলা আর হাল্কা রঙিন শাড়ি পড়লেও সিঁদুর পরতেন না । বলতেন কার মুখ মনে করে পড়ব। লোকটার চেহারা যে ভুলে গেছি।

দাদা সবাইকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলবে না। ওকে ওর মতন করে থাকতে দিও।

দাদীর ধারনা দাদার জীবনে এর চেয়ে বড় পরাজয় হয়নি। এমন ভুল হিসাব এমন ভুলচেনা ভাবতে বোধ হয় তার গ্লানি হত।

কী জানি হয়ত কখন মনে হয়েছিল, রমার জন্ম পরিচয় সবটা যদি মুছে ফেলে দিত, যদি ওকে অতটুকু আলাদা না করে ওর নাম ,ধর্ম সব তার নিজের করে নিতো। তবে হয়ত আজ ওকে নতুন করে সংসার গড়ে দিতে পারত।

ওকে এভাবে শুধুমাত্র ধর্মের নিয়মে নিরুদ্দেশ স্বামীর সধবা হয়ে ঘুরে বেড়াতে হত না। দাদার জীবনে তার সবচেয়ে আদরের সন্তানই তার সবচেয়ে বড় বেদনার ছিল। যে মেয়েটিকে তিনি তিন বছর থেকে বড় করেছিলেন, পড়াশোনা, গান, গীতা পাঠ, কিচ্ছুটি বাদ দেননি, রোজ নামাজে যার নাম তার মুনাজাতের থেকে একদিন বাদ যায়নি তার কি করে এমন হয় ! কোথায় ভুল করলেন তিনি? মেয়ে বুঝতে পারতো বাবার মনের কথা , মুখের ভাব, চাপা শ্বাস । বলত, বাবা নিয়তি খণ্ডাবে কে বলো, আমার যে তোমার কাছেই থাকার কথা তাই চলে এলাম, এবার তো আর পারবে না বিদায় করতে । এখন এই নাও তোমার চা।

ছোট বেলা থেকেই নাকি দাদার চা অন্য কেউ দিতে পারত না। যখন ছোট ছিল তখন মাধবদাদার হাতে চায়ের পেয়ালা থাকতো, আর ছোট্ট রমা তার মাধবকাকুর এক আঙুল ধরে ধরে দাদার কাছে এসে পেয়ালার নিচে হাত রেখে বলতো বাবা এই নাও তোমার চা । তারপর অপেক্ষা করত কখন বাবা তাকে পিরিচে ঢেলে চা খাওয়াবে ।

নিয়তি রমা পিসীকে পিতৃ-মাতৃহীন করেছে না বোঝার বয়সে। সেই নিয়তি স্বামী আছে কি না আছে সেই সন্দেহ আর আশার মাঝখানে এনে দিয়েছিল রমার পিসীর বাকী জীবন।

যে বাবা তাকে নিজের জীবন দিয়ে বাঁচিয়ে দিয়ে গেলো আরেক বাবার কোলে, নিয়তি সেই বাবাকেও ছার দিলো না । ভুল না ভাগ্য এই দন্ধে কেটে গেলো তার বাবার বাকী  জীবন। সবার ধারনা এই ধাক্কাটা দাদার জীবনীশক্তি কমিয়ে এনেছিল।  অন্তর্মুখী স্বভাবের ছিলেন তাই  কাউকে তার কষ্টের ভাগ দিতে পারতেন না। নিয়তির কাছে হার মেনে নিতেই হল তাকে।

নিয়তি!! নিয়তি অয়নকেও ছায়া বানিয়ে রেখে দিলো কনীনিকার জীবনে চিরদিনের মত।

অয়ন যখন এ বাড়ীতে পাকাপাকি ভাবে এলো তখন কনীনিকা, তার প্রথম বছর পার করে দুইয়ে পা রেখেছে। দুরন্ত এক মেয়ে কখন হামাগুড়ি দিয়ে, কখন এলোমেলো পা ফেলে ছুটছে। কখন অয়ন ওর পিছে পিছে ছুটছে কখন কনীনিকা ওর পিছে ছুটছে।

চোখ বুজলেই সেই বাড়ি, সেই সব কেমন ভেসে ওঠে । অনেক বছর পরে গিয়েছিল কনীনিকা একবার বাড়িতে। বাড়ির নতুন মালিক তখন কিছু ভেঙে ফেলেনি । সেই আগের মতই ছিল সব। সেই টানা লম্বা বারান্দা – বারান্দা ঘেঁসে রমা পিসীর লাগানো সেই আম গাছ! কী ভীষণ রকম ছায়া হয়ে কত কিছু ঘুরছিল। পিছনের বারান্দার লাল মোজায়িকের খাপে খাপে কত পায়ের চিহ্ন । বারান্দার দেয়ালে সবার হাতের ছাপ  ছুঁয়ে ছুঁয়ে পেতে ইচ্ছে করছিল কনীনিকার।

বারান্দার সেই বেঞ্চটাও ঠিক সেই জায়গাতেই ছিল। কনীনিকা বারান্দার রেলিঙে ভর দিয়ে নিচে তাকাতেই বড়দাদার বিয়ের দিনটা চোখে ভেসে এলো ।সেই প্রথম কনীনিকা শাড়ি পরেছিল। বিকেল থেকেই অয়ন বাড়ি ছিল না । কনীনিকা সাজগোজ করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলো অয়নের অপেক্ষায় —   অনেক দেরিতে এলো অয়ন – মেজদার সাথে কী নিয়ে রাগ করে চলে গিয়েছিল । অয়ন ফিরে এলেই মেজদাই ওকে নিয়ে খেতে বসেছিল।

সেই খাবার টেবিলটাও সেই  জায়গাতেই ছিল। যেখানে একদিন আচমকাই পিসী রাতের খাবার বেড়ে দিতে দিতে বলেছিলো, মা , দাদা বউদি, আমার একটা কথা বলার ছিল – সবাই তখন অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল পিসীর দিকে , রমা কবে এত ঘটা করে কিছু বলতে আসে! রমা পিসী সেই রাতে খুব ধীর খুব শান্ত ভাবে কি ভীষণ কঠিন ভাবে তার মতামত বা আদেশ জারি করল। বলেছিল, অয়নের সামনে কথাটা তোমাদের সকলের জানা দরকার। আমি চাই বাবার নিয়ম মেনেই অয়ন চলবে।

সেটা এমন করে বলার কি আছে রমা , বাবা বলে উঠলেন। আমরা সবাই কি বাবার নিয়ম মেনে চলি না ।

কথাটা এত সহজ নয় ছোড়দা। রমা পিসীর কণ্ঠস্বর যেন আরও শক্ত হলো।

অয়ন যে মেয়েকেই বিয়ে করুক আমার তাতে কোন বাধা নেই কিন্তু হিন্দুঘরের মেয়ে হতে হবে।

দাদী বললেন, রমা আবার কেন ধর্মের বাধা আনছিস জীবনে? এর থেকে বের হয়ে আয় মা, অয়ন কে মুক্ত করে দে এসবের বাঁধন থেকে।

রমা পিসী বলল, না মা তা হয় না । আমি বাবার আদর্শে বড় হয়েছি। আমার শিকড়, আমার জন্মদাতা পিতার বংশ যে আমাকেই রক্ষা করতে হবে মা। আমি অনেক ভেবে আমার মতামত জানালাম।

অয়ন খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে চলে গিয়েছিল। বাকিরা সবাই অন্ন ধ্বংস করা যাবে না বলেই হয়ত পাতের খাবার শেষ করে উঠেছিল কোন কথা আর না বলে।

কনীনিকা পায়ে পায়ে অয়নের ঘরের সামনে গিয়ে দেখেছিলো ঘর অন্ধকার । সে জানতো অয়নের মন খারাপ হলে ও তখন তখনি কারো সাথে কথা বলবে না। তাই ওকে আর বিরক্ত না করে নিজের ঘরে চলে গিয়েছিল। সে রাতে চোখের পাতা এক করতে পারেনি কনীনিকা।

খুব ভোরে সেতারের টুং টাং আওয়াজে রোজকার মত ঘাটে গিয়ে বসলেও অয়নের কাঁধে মাথা রাখেনি কনীনিকা সেদিন।

অয়ন সেতারের তারে আঙুল চেপে ধরে বলেছিল, কোন কিছু বদল হবার দরকার নেই কনীয়া । আমারা একসাথে প্রথম সূর্যোদয় দেখে বড় হয়েছি, একসাথেই শেষ সূর্যোদয় দেখব।

আমার শিকড় কোন ধর্মের গোঁড়ামিতে আটকে থাকার নয় । যদি থাকে তবে সেই শিকড় উপড়ে ফেলব আমি। মায়ের মতামত মায়ের, আমার মতামত আমার। কাল সারারাত আমি ঘুমাইনি। দুশ্চিন্তায় নয়, দুঃখ লেগেছে। আর কতকাল এসব চলবে ভেবে। কনীয়া আমার তোমার মধ্যে কোনকালেই কেউ ছিল না । কোনকালেও কেউ থাকবে না । মানুষ হিসাবে আমার দুজন নানাই আমার কাছে সম্মানিত ব্যক্তি । কিন্তু তাদের বিশ্বাস আর আমার বিশ্বাস এক নাও হতে পারে। আমার শিকড়ের পরিচয় একটাই, আমি বাঙালি। কনীয়া, দুঃখ করো । তবে ভয় করো  না পুরনো সেকেলে মতবাদ আমাদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে বলে। পুরনো সংস্কার বদলে ফেলার দায় দায়িত্ব যে আমাদের ।

রমা পিসীর সেই দিনের সেই কথার পর খুব সামান্য হলেও যেন একটা চিড় ধরেছিল শক্ত বাঁধনে বাঁধা  এতদিনের পরিবারে। পিসী ধর্মেকর্মে বেশি করে মন দিলেন। সোনাইকে নিয়ে একবার তার নিজের বাবা মায়ের গ্রামে ঘুরে এলেন।

দাদী ভাবতেন রমা পিসী বিবাহিত জীবনের এমন পরিণতি আর হঠাৎ করে তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ, ওর বাবার মৃত্যু, দুটো ঘটানাই তাকে এমন এলোমেলো করে দিয়েছিল। এই অভাবগুলো তাকে তাড়া করে বেড়াত আর তা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এই সব করতো। দাদী তাই কিছু বলতেন না পিসীকে।

ছেলে বউদের বলতেন ও যা করে শান্তি পায় তাই ওকে করতে দিও।

রমা পিসীর সেই এলোমেলো হয়ে যাওয়া জীবনে যেন আরও কিছু বাকি ছিল যা নিয়তি তার জন্য লিখে রেখেছিল একাত্তরের যুদ্ধের সাথে ।

অয়ন মুক্তিযুদ্ধে গেলো।

সেদিন সকালে সেতারের আওয়াজ না পেয়েও কনীনিকা ঘাটে গিয়েছিল। এই প্রথম অয়ন নেই ঘাটে। বৃষ্টির দিন ছাড়া এমন কখন হয়নি। কনীনিকা পায়ে পায়ে অয়নের ঘরে গেলো । পরিপাটি বিছানা । বালিশের কোনায় সাদা খামের ভিতর চিঠি।

কনীয়া ,

আমি জানি আজ সকালে ঘাটে আমায় না পেয়ে আমার ঘরেই আসবে।

আমার জীবনে আমি কারো আইন যেমন মানি না আমার দেশেও অন্য কারো আইন আমি মানব না ।

বাড়ীতে একজনের থাকার প্রয়োজন আছে তাই ছোটকু রয়ে গেলো । দেশের ভিতরে থেকেও অনেক কাজ করা যায়। ওকেও আমরা কাজ দেবো তবে সংগে রেখে নয়।

বড়দা মেজদা এখন দেশের বাইরে সেটাও একটা কারণ ওকে রেখে যাওয়া। না যেতে পেরে ছোটকুর মন খুব খারাপ। ওকে দেখ । ভুল কিছু করে না বসে।

বাড়ীর সকলকে নিয়ে সাবধানে থেকো। মাকে দেখ ।

আমি জানি আমার প্রয়োজনে আমি তোমার সাহায্য পাব । সময় মত ঠিক চেয়ে নেব।

ভালবাসি তোমাকে  চিরদিন।

তোমার অয়ন।

পুনশ্চ: আমি ঠিক ফিরে আসব। তোমার কাছে আসতে যে আমায় হবেই। আমার কথা মিলিয়ে নিও ।

শেষ মুহূর্তেই অয়ন ছোড়দাকে নিয়ে যেতে চাইলো না , অয়নের ছোড়দাকে বাড়ীতে রেখে যাওয়ার কারণ কনীনিকা । ছোড়দা সেটা বুঝতে পেরেছিল তাই মন খারাপ হলেও মেনে নিয়েছে অয়নের কথা, সবচেয়ে শান্ত প্রকৃতির মানুষ ছোড়দা, অয়নের ছোটকু ।

অয়ন আর সেজদার বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে যাওয়ায় বাড়িসুদ্ধ লোকের নাওয়া খাওয়া বন্ধ হয়ে গেলো। ছোড়দা এর ওর কাছে থেকে শেষ অবধি ওদের কলকাতা যাওয়ার খবর এনে দিলে সবার একটু হলেও তখনকার মত চিন্তা দুর হল। পিসীকে পুজোর ঘর থেকে বের করা গেলো।

অয়ন কথা রেখেছিল । যুদ্ধ শেষ ফিরে এলো, তবে আগের মত নয়। এক নতুন অয়ন ফিরে এলো। শারীরিক ভাবে অক্ষত । তবে মানুষিক ভাবে বিক্ষিপ্ত, অস্থির । যেন যেমন করে সব হবার কথা তেমন হয়নি বলে সারাক্ষণ এক ক্ষোভের মধ্যে বসবাস । সেজদা বরাবরই সোজা সরল মানুষ। যুদ্ধের প্রয়োজনে গিয়েছিল নাকি অয়নকে একা ছাড়বে না বলে গেল, সে নিয়ে সবার সন্দেহ ছিল। সেজদা যেমন গিয়েছিলে তেমন করেই অয়নকে নিয়ে ফিরে এলো। এবার বরদার কথা মত বাইরে যাবার প্রস্তুতি নিতে হবে তাকে। সেজদার তাই স্বাধীনতার পরবর্তী কালকে নিয়ে ভাবার সময় নেই। আর অয়ন! স্বাধীনতার যত দিন যাচ্ছে অয়নের ক্ষোভ বেড়ে চলছে। কনীনিকা দেখলও অয়ন হারিয়ে যাচ্ছে স্বাধীন দেশের পতাকার উথাল পাতাল বাতাসের স্রোতের গভীরে।

সেজদা বড়দার কাছে চলে যাওয়ার সময় বলে গেলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অয়নকে নিয়ে যেতে হবে এখান থেকে।

অয়ন সেসব কথায় কান দেবার প্রয়োজন মনেই করেনি। পার্টী , মিটিং মিসিল করে রাত দুপুরে বাড়ি ফেরা ,মাথার চুল ঘাড় অবধি, শার্টের পকেটে পেনের কালির দাগ, প্যান্টের পকেটে সিগারেটের পোড়া দাগ । অয়নের একটাই লক্ষ তখন, ভুলগুলো শুধরে নিয়ে স্বাধীনতার স্বাদ ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া।

শুধু এত কিছুর মধ্যেও সেতারের সুরে সূর্যোদয় দেখতে ভুলতো না অয়ন। কনীনিকা রাগ করে যায়নি কদিন। অয়ন বাজনা থামিয়ে বসে থাকত। এক সকালে এসে বলেছিল কোথায় কিছু ঠিক নাই কনীয়া , সুধু এই সকালটা ঠিক থাকতে দাও। তুমি না এলে আমার সূর্যোদয় দেখা হবে না।

অয়ন তুমি এখন কোথায় বসে সূর্যোদয় দেখ? কনীয়া ছাড়া তোমার সূর্যোদয় দেখা হয় অয়ন?

অয়ন সেই অস্থিরতা থেকে আর শান্ত হতে পারেনি। মেধাবী অয়ন, কৃতি অয়ন গ্রাম বাংলার মাঝে হারিয়ে গেলো। কেউ জানলো না সে কোথায়। কোন চিঠি এবার রেখে যায়নি তার কনীয়াকে।

অয়নের আশায় থাকতে থাকতে রমা পিসী একদিন পুজোর ঘরে থেকে আর বের হল না । পিসীর দেরি দেখে মা পুজোর ঘরে গিয়ে দেখল পিসী তার দয়াময়ী কালির পায়ের কাছে মাথা ঠুকে পড়ে আছে। আরতি করার মঙ্গল প্রদীপ নিভে গেছে।

পিসীর মুখাগ্নি করেছিল ছোড়দা ।কেউ কোন আপত্তি করেনি। অয়নের আনা স্বাধীনতার এটাই হয়ত বড় পাওয়া ওদের বাড়ির জন্যে।

তারপর একদিন মাঝরাতে ধুপধাপ পায়ের আওয়াজ তুলে কে যেন ওদের বড় লোহার গেটের উপর থেকে লাফিয়ে সদর দরজায় জোরে জোরে কড়া নেড়ে একবারই বলেছিলো দরজাটা খোলো।

কনীনিকা বারান্দায় বের হয়ে আসতেই ঝাঁকড়া চূলের অয়নকে দেখলো পাইপ বেয়ে উপরে  ওঠার চেষ্টা করেই আবার নেমে বাগানের পিছ দিকে দিয়ে দীঘির পানিতে নেমে গেলো।

কনীনিকা বারান্দা থেকে পা বাড়াতেই অয়নের পিছে পিছে তাড়া করতে আসা একদল ছেলের দল বলে উঠলো আমরা অনুরোধ করছি নামবেন না । আর কোন রকমের সাহায্য করতে চেষ্টা করবেন না। কনীনিকা, ছোড়দা আর সোনাইদা ছাড়া সে রাতের কথা বাড়ীর আর কেউ জানলো না। ছোড়দা ওর হাত ধরে ঘরে নিয়ে এলো। ছোড়দার চোখে পানি , কাঁপা কাপ গলায় বলল ছেলেটা বেঁচে যেন একদিন আবার ফিরে আসে।

তাড়া করা ছেলেগুলো চলে গেলো অনেক পরে। রাত তখন ভোর ভোর । অয়নের ঘরে গিয়ে ওর সেতারটা তুলে নিয়ে ঘাটে গেল কনীনিকা । কেন ওর মনে হয়েছিল এই এখনি দীঘির কোন থেকে ভেজা চুলে ,ভেজা কাপরে এসে বলবে কনীয়া ওড়নাটা দাও। কনীনিকা একা একা সূর্যোদয় দেখলো, অয়ন এলো না। হঠাত করে ঝুপঝাপ শব্দে চমকে দেখলো ছোড়দা আর সোনাইদা দীঘিতে ডুব সাতার দিচ্ছে। ওরা চলে যাবার পর থেকেই ছোড়দা আর সোনাইদা বাগানের আশেপাশে খুঁজেছে, কোন চিহ্ন খুঁজে পায়নি।  বেলা বাড়তেই ছোড়দা মাছ ধরার লোক ডেকে এনে জাল ফেলল। মাছ উঠলো অনেক আর কিছু নয়।

বাবা ছোড়দার হঠাৎ পাগলামি দেখে বকলেন। কনীনিকা বাগানে হেটে বেড়ালো পায়ের ছাপ যদি পায়ে লেগে যায় সেই আশায়।

তিনদিন পরে মীরাদির গাড়ি এসে দাঁড়ালো ওদের গেটে। মীরার হঠাৎ আসায় কেউ অবাক হয়নি তবে ওর ভাবভঙ্গি অন্য রকম লাগছিল।

মীরা ছোড়দার বয়সী । এ পাড়ার অন্য বড় দুই বাড়ীর এক বাড়ীর মেয়ে।

কারো কাছেই লুকাবার কিছু ছিল না তবু অনেকটাই ফিসফিস করে মীরাদি যা বলেছিল, তার মুল কথা ছিল সেদিন রাতে দীঘির পানিতে অনেকক্ষণ লুকিয়ে থাকার পর রাতের শেষে কোনভাবে অয়ন মীরাদির বাড়ী যেতে পেরেছিল। দেয়াল টপকে কোন ভাবে মীরাদির ঘরে গিয়েছিল। রাত শেষ হতেই বাড়ীর সকলকে মীরাদি অয়নের কথা জানিয়েছে ।সকাল থেকেই অয়নের ধুম জ্বর এসেছিল। খুব সম্ভব শামুকেই বাম পা কেটে গিয়েছে বেশ অনেকটা। সেজন্য অথবা অতক্ষণ পানিতে ডুবে থাকার জন্য হয়ত জ্বর এসেছে।  তবে কাল রাত থেকে জ্বর কমে এসেছে। আজ একটু ভাল তাই সবাইকে খবর দিতে এলো ।কনীনিকার দিকে তাকিয়ে মীরাদি বলল, কাকু আপনারা দেখা করতে না গেলেই হয়ত ভালো। কেউ হয়ত সন্দেহ করতে পারে ,কি জানি হতে পারে যারা ওকে তাড়া করেছিল, ওরা এখন চোখ পেতে বসে আছে।

অয়নের কোন প্লান মীরা জানেনা । জানলে এসে জানিয়ে যাবে বলে মীরা যাবার জন্য দাঁড়ালো।

ছোড়দার অনুরোধ ফেলতে না পেরে মীরা ছোড়দাকে সংগে করে নিয়ে গেলো। যাবার সময় কনীনিকার দিকে চেয়ে যেন বলল যাবি?

কনীনিকা নিঃশব্দে চলে গেলো ঘাটে। অয়ন মীরাদির কাছে বিপদ মুক্ত আছে । মীরাদির বাড়ীর সবাই ওকে চোখে চোখে রাখছে। আর সে কি করলো ? কোন মুখে সে যাবে অয়নের কাছে !

মীরা অয়নকে বাঁচালো , কনীনিকার যে তা ভালো লাগার কথা। তবু পারছিল না  যেমন পারত না মীরাদি যখন বলতো, কি ভাল সেতারের হাত তোমার অয়নদা ! খুব ভাল বাজিয়েছ অয়নদা ! মীরাদির এসব কথা  ভাল লাগত না । নাহ; একবারেই ভাল লাগত না অয়নের দিকে তাকিয়ে মীরাদির সেই হাসি !

ছোড়দা অয়নকে অনেক বুঝিয়ে মানিয়ে এসেছিলে সেদিন রাতে । অন্তত ছোড়দা তাই ভেবেছিল। বাড়ি ফিরে বাবা কাকাদের সাথে বসে আলাপ করলো অয়নকে এই নকশাল দল থেকে মুক্ত করবে কেমন করে। অয়ন ফিরে আসতে চাইছে তাই ওরা ওকে ছাড়বে না। ওদের বিশ্বাস নেই ওর উপরে, ও হয়ত ওদের গোপন কথা ফাঁস করে দিতে পারে। অয়ন পালিয়ে বেড়াচ্ছে আর ওরা ওকে তাড়া করছে। দলের সাথে না থাকলে এ পৃথিবীতেই থাকতে দিবে না। ওদের সাথে অয়নের বনছিল না । প্রতিবাদী অয়ন কাদের সাথে প্রতিবাদ করছিল বুঝতে পারেনি। ছোড়দা এসব কথা বলতে বলতে কাঁদছিল।

কনীনিকা চুপচাপ শুধু শুনে যেত । কথা বলতে ভালো লাগত না। দাদী কোলে টেনে নিয়ে গান শোনাতেন। তার সাথে গান করাতে চাইতেন।

কনীনিকার ভাল না লাগা বেড়ে যেতেই বড়দা তাকে তার কাছে নিয়ে গেলো । কলেজের ভর্তির জন্য যা কিছু করতে হয় সব করে কনীনিকা এক ক্লাস নিচে নেমে আবার পড়াশোনা করার চেষ্টা করল। কনীনিকা যেন কিছুদিনের জন্য নিজের বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে চেয়েছিলো। অয়ন ছাড়া বাড়ি , বাগান, দিঘী , সূর্যোদয় আর নিতে পারছিলো না সে ।

বড়দা তাকে ব্যস্ত রাখার যা কিছু করা যায় করেছিল। একটা পার্টটাইম চাকরিতে ঢুকিয়ে দিলো। ছুটির দিনে কোথায় নিয়ে চলে যেত। ওদের ছোট্ট সংসারে ওর ভালই লাগত ।

আমেরিকায় আসার কয়েক মাস পরেই অয়নের আবার আরেক খবর এলো। বরিশালের শহর ছেড়ে একটু দুরে গ্রামের ধান ক্ষেতের ভিতর অয়নের গুলিবিদ্ধ দেহ পড়ে ছিল। গুলির আঘাতে অয়ন সারা রাত অজ্ঞান হয়ে পরে থাকার পরও প্রাণে বেঁচে ছিলো। গ্রামের ডাক্তার সাধ্যমত চেষ্টা করে বরিশাল শহরের মেডিকাল হাসপাতালে আনার মত অবস্থায় এনে দিয়েছিল। অয়নের জ্ঞান ফিরেছিল সাত দিন পড়ে। তিন মাস হাসপাতালে বেডে শুয়ে কেটে গেলেও এক নতুন জীবন নিয়ে অয়ন  বেঁচে  ফিরে এলো । এবারও মীরাদি ওর পাশে সম্পূর্ণ ভাবে। নিয়তই যেন মীরাদিকে  বরিশাল মেডিকাল কলেজের ছাত্রী বানিয়ে ছিল অয়নের সেবা করার জন্য ।

হাসপাতালে তিনমাস মীরাদি অয়নকে মন প্রাণ দিয়ে সেবা করেছে। একটা ভগ্নস্তূপ থেকে অয়নকে কী ভাবে বের করে আনা যায় তা বোধ হয় মীরাদি জানত।

কনীনিকার জন্য অয়ন ছিল মীরার অয়নকে অর্জন করতে হয়েছে।

দাদীর কাছে যখন অয়ন আর মীরার এক হওয়ার কথা শুনলো, কনীনিকার তখন মনে হয়েছে এটাই হওয়ার ছিল।

অয়নকে ধরে রাখার মত শক্ত বাধন ওর কাছে ছিল না। অয়ন আবার হারিয়ে যেত। তার চেয়ে এই ভাল । অস্থিরতা থেকে মীরাদি ওকে মুক্ত করেছে।    ওরা ঘাটে বসে সেতারের সুরে সুরে সূর্যোদয় না দেখলেও ওদের এক সাথে পথ চলাই নিয়তি ছিল। কী জানি হয়ত মীরাদির ভালবাসায় জোর ছিল – কনীনিকার বুকের ভিতর হিম হয়ে যায় এই কথাটি মেনে নিতে।

যেদিন মীরাদি এসে অয়নের ওদের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়ার কথা জানিয়েছিল। সেদিন কনীনিকা ওদের সাথে না গেলেও পরদিন খুব সকালে গিয়েছিল । অয়ন কম্বল গায়ে বিছানায় শুয়েছিল। কাছে যেতেই অয়ন বলল, খুব ভয় পেয়ে গিয়েছ কনীয়া ! এই প্রথম অয়নের বুকের ভিতর মাথা রেখে কেঁদেছিল কনীনিকা।

বলেছিল, চল আমার সাথে বাড়ি চল। আমি তোমাকে লুকিয়ে রাখব। অয়ন বলল, কনীয়া আমি কাল এখান থেকে চলে যাচ্ছি। কনীনিকাঅয়নের হাত ধরে বলেছিল তা হলে চলে দূরে কোথায় চলে যাই।

অয়ন ওর মাথায় নিজের মাথা ঠেকিয়ে বলেছিল কনীয়া তোমাকে আমি কোনদিন কোন বিপদের মধ্যে নিয়ে যেতে পারব না। আমার এ জীবনের সাথে এখন আর আমি তোমাকে জড়াতে চাই না। আমি চাই আমার কনীয়া সব সময় নিরাপদে থাকুক। আমি যে ভেবেছিলাম দেশ স্বাধীন করে তোমাকে সব কিছু থেকে নিরাপদে রাখব। এই কথাগুলো বলতে অয়নের কষ্ট হচ্ছিল। হাতের তালুতে চোখের পানি মুছে বলল, কনীয়া আমি যেখানে থাকি যতদিন থাকি, যদি কোনদিন সূর্যোদয় দেখি তবে তোমার মুখ মনে করে দেখব । কথা দাও তুমি নিজেকে একা করে রাখবে না । তুমি আমাকে মনে করবে তবে চোখের পানিতে নয়। আমাদের এত দিনের ভাল সময়কে মনে করে । তোমার খুব সাজানো জীবনে আমি তোমার মনের ভিতর থাকব কনীয়া ।

কনী মাথা তুলে বলল অয়ন তুমি আমাকে ভালোবাস না ?

অয়ন তার কনীয়ার কপালের চুল সরিয়ে দিতে দিতে বলল, ভালবাসি বলেই যে আমার এই ছন্নছাড়া জীবনে তোমাকে জড়াতে পারব না। আমি বুঝিনি এমনটা হবে। আমি ভুলগুলো শুধরে দিতে গিয়ে দেখলাম সবকিছু ভুলে ভরা। আমি হেরে গেলাম কনীয়া।

কনীনিকা চলে আসার জন্য দাড়াতেই অয়ন যা কখন করেনি তাই করলো। কনীয়াকে বুকের ভিতর টেনে নিয়ে দুই ঠোটে সমস্ত আবেগ ঢেলে দিলো। অনেকক্ষণ ধরে সেই আবেগের সবটুকু স্বাদ নিয়ে অয়নের কপালে আদর করে বলেছিলো আমি আবার কাল আসব এমন সময়। অপেক্ষা কর।

পরদিন গিয়েছিল কনীনিকা ।মীরাদির মা দুঃখ আর ভয় মাখা গলায় বলল, অয়ন কাউকে কিছু না বলে কখন চলে গেছে কেউ জানেনা। কনীনিকার মনে হয়েছিল মীরাদির চোখ দুটি লাল আর ভীষণ রকমের ফোলা।

কনীনিকার যখনই মীরাদির কথা মনে পড়ে তখনি যুদ্ধের সেই সব দিনের কথা মনে পড়ে। আবার একাত্তরের যুদ্ধের কথা যখন মনে পড়ে তখনও সেই মীরাদি চলে আসে অনিশ্চিত সেই দিনের সাথে । অনিশ্চিত অস্থির একেকটি দিন। সকাল, দুপুর, রাতে বাতাসের ধাক্কায় গেটে আওয়াজ হলেই সবার মনে ভয় আর আশা দুটোই জাগত। কেউ ফিসফিস করে বলতো ছেলে দুটো ফিরল না তো। আবার মনে হত অন্য কেউ নয়ত । যদিও আশ্বাস ছিল ওদের ভয় নেই।

বাবার বন্ধু মীরাদির কাকাই বলতে গেলে ওদেরকেই শুধু নয় গোটা পাড়াকেই আগলে রেখেছিলেন । মীরাদির বাবা কাকারা আদিকালের ব্যবসায়ী । পুরনো টাকার মালিক ।রাজনীতির সাথে সরাসরি জড়িত না থেকেও ছিলেন কোন না কোনভাবে । আর সেই ক্ষমতাই ব্যবহার করেছিলেন মীরাদির কাকা । ওদের অঞ্চলের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানও সমীহ করে চলতেন কাকাকে। কিছুটা বোধ হয় কৃতজ্ঞও ছিল কাকা চেয়ারম্যান না হয় তাকে করাতে।

বাবা একদিন তার ছোটবেলার বন্ধু মীরাদির কাকাকে বলেছিল, এত বুদ্ধি রাখ তুমি অথচ রাজনীতিতে নাম লেখালে না কেন ?  কাকা , হা হা করে তার বিখ্যাত অট্টহাসিতে রমা পিসীর পুজোর ঘর অবধি পৌঁছে দিয়েছিল।

রমা পিসির আরতি করা হাত সেই হাসিতে থমকে গিয়েছিল কিনা কে জানে ।

কাকা বাবার ভয় দুর করতে বাবার হাত ধরে বলেছিলেন রমাকে নিয়ে ভয় কর না । আমি  বেঁচে থাকতে রমার কিছু হবে না । তোমার বাড়িতে আর্মি এলেও সুধু এক কাপ চা খেতেই আসবে আর তা এই তোমাদের বসার ঘর পর্যন্ত । বাবা কাকার কাঁধে হাত দিয়ে বলল, দেখ যদি চায়ের ও প্রয়োজন না হয় । কাকা আশ্বাস দিয়েছিলেন। তবুও চেয়ারম্যান একদিন দুজনকে নিয়ে চলে এলো । বাবাকে চোখের

ইশারায় বোঝাল ভয় না পেতে। বাড়ির বাগানেই বসেছিল ওরা । চা দিতে হয়নি কারণ অফিসার চা পছন্দ করে না ।

কাকা বাবাকে ফোন করে বলেছিলেন, এইটুকু ইচ্ছে করেই আটকাতে চাইনি । তা করলে সন্দেহ বাড়ত ওদের। ওরা কিন্তু জানে তোমার বাড়ির বাকি দুই ছেলেও বিদেশ আছে অন্য দুই ভাইয়ের সাথে । এটাই সবাই জানে। তবে পারলে বড় ছেলেকে দিয়ে একটা মিথ্যে চিঠি আনিয়ে রেখ।

কনীনিকা এসব কিছুর  শুধু সাক্ষীই থেকে গিয়েছিল । মীরাদির মত সাহস করে অচেনা অয়নদেরকে সাহায্য করতে পারেনি। মীরাদি ছোড়দার হাতে দিয়ে যেত ওদের চলাচলের সুবিধার জন্য আইডি কার্ড। তাকেও তো কাকা খুব ভালবাসতেন । সে চাইলেও কাকা তাকেও এনে দিত আইডি কার্ড । তবু কনীনিকা কোন কিছুই করেনি । ছোড়দা একবার মীরাদিকে  বলেছিল অয়নদেরকে পাঠাবার জিনিসগুলো ওর কাছে রেখে যেতে।

মীরাদি সাথে সাথে নাকচ করে দিলো । তার সাথে এও বলল , পাগল তুই, ওই শামুকের মত গুটিয়ে থাকা মনভোলা মেয়েকে ভরসা করতে পারব না।

ওরা সবাই মিলে যখন ঘরের দরজা জানালা সব বন্ধ করে রেডিওর ভলিউম যতটা সম্ভব নামিয়ে রেডিওর কাছে কান পেতে যুদ্ধের খবর জানার জন্য স্বাধীনবাংলা বেতার শুনতো তখন কনীনিকা চুপ করে ওদের পাশেই বসে থাকত । একবার একটা মারাত্মক অ্যামবুশের খবর শোনা মাত্র মীরাদি বলে উঠলো এটা অয়নের দলের কাজ , আমি জানি আমি জানি এটা … উত্তেজনা না চাপতে পেরে চিৎকার করে উঠতেই ছোড়দা ওর মুখ চেপে  ধরে বলল , চুপ কর , রমা পিসি শুনতে পাবে ।

যুদ্ধে শেষ হওয়ার দিন দশ আগে মীরাদির কাকা এক বিকেলে ওদের বাড়িতে এলো দেখা করতে । বাড়ির সবাই এমনকি দাদীও বসার ঘরে এলো। কাকা দুই একদিনের মধ্যেই পাকিস্তানে চলে যাচ্ছে তাই দেখা করতে এসেছে । বলল ব্যবসায়ের কাজে যাচ্ছে। তবু সবার ধারনা এই যাওয়া তার চেয়ে বেশি কিছু। বাবা জানতে চাইলো কবে ফিরে আসবে । কাকা বললেন ঠিক জানা নেই । হয়ত ফিরলাম না আর। আমি একা মানুষ চলে গেলে একদিকে ভালই হবে । দেশের পরিস্থিতি কোথায় যায় বলা যাচ্ছে না। বাবা বললেন তুমি তো কারো ক্ষতি করনি বরং উপকারই করেছে নিজের লোকদের। কাকা বললেন সেই চেষ্টাই করছি। এই যাওয়াটাও সেই চেষ্টাই বলতে পার। আমি থাকলে আমার পরিবারের উপর ঝামেলা আসতে পারে।

চেয়ারম্যান লোকটি আর ভালো রাস্তায় চলছে না। আমিই যে ওকে চেয়ারম্যান করেছিলাম সে দায় এড়াই কী করে !

পর্দার ওপাশে রমা পিসী দাড়িয়ে ছিল। কথা শেষ হতেই ট্রে হাতে ঘরে ঢুকে বলল , এগুলো একটু আগেই বানিয়েছি । খেয়ে যেও।

মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল , বউদি চায়ে দুধ চিনি মেশান আছে , কাপে ঢেলে দিও। বলে পা বাড়াতেই কাকা বলে উঠলো , বাহ বেশ ভাল বিকেলে এসেছি । তোমার হাতে পাকন পিঠে বহুদিন খাওয়া হয়নি।

রমা পিসী সে কথার কোন জবাব না দিয়ে পর্দা ঠেলে বের হয়েই বারান্দার বেঞ্চিতে বসে থাকা কনীনিকা দেখে বলল , কনী এখানে বসে আছিস কেন , মন খারাপ লাগছে?

পিসী কনীর পাসে বসে বলল আয় তোর চুলে বেণী করে দেই …। চিরুনি দরকার নেই আমার আঙ্গুল দিয়েই দেখ কেমন আঁচড়ে দিচ্ছি।  রমা পিসি কি সেদিন শুধুই কনীর চুল বেধে দিতে বসার ঘরের বারান্দার বেঞ্চিতে বসেছিল ! নাকি কাকার কথা শুনতে পাবে বলে!

কতক্ষণ ওরা দুজন চুপচাপ বসে ছিল মনে নেই …  রমা পিসী হয়ত ভিতর -ঘরের কথা বার্তা শুনছিলেন, কনীনিকা খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে এলোমেলো ভাবনার মাঝে মাঝে বসার ঘরের কথাও শুনছিল।  কাকার ‘এই আমি একলা মানুষ’ কথার পিঠে মা বলল, দোকা যে কেন হলেন না , কত পাত্রীই তো ছিল আপনার জন্য। বিয়ে না করে …। একাই থেকে গেলেন ।

কাকা স্বভাবসুলভ অট্টহাসি না দিয়ে বরং একটু উদাস কণ্ঠে বলল,  বিয়ে করার জন্য যে বিয়ে করতে আমি বিশ্বাস করি না ভাবী। মন যে দিতে হয় বিয়ে করা মানুষটিকে । আমার মন যে অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছি । বিয়ে করবো মন দিব না সে যে খুব অন্যায় হত। ইচ্ছাকৃত অন্যায় যে আমি করতে চাইনি কারো সাথে।  কথাগুলো কী কাকা একটু জোরেই বললেন , যাবার আগে আরেকবার জানিয়ে দিতে তার মনের কথা। বসার ঘর থেকে পর্দা উড়লেই তো দেখা যাচ্ছিল বারান্দায় বসা ওদের দুইজনকে।

খানিক বাদেই বাবার সাথে কাকা বের হয়ে এলো। কনীনিকার মাথায় হাত দিয়ে বললেন, মুখ এমন মলিন কেন মা ? ভাইদের জন্য মন কেমন করছে ? মন খারাপের সময় খুব তাড়াতাড়ি শেষ হবে।  রমা পিসীর দিকে তাকিয়ে বলল, রমা, অয়নের জন্য ভেবো না, ও বাড়ি ফিরে আসবে খুব তাড়াতাড়ি । একটু থেমে আবার বললেন ওদের বাড়ি ফেরার খবরটা দিও আমাকে । এবার বাবার দিকে তাকিয়েই কথাটা বললেন।

বলেই মনে পড়ে যাওয়ার মত করে বলে উঠলো অবশ্য মীরার কাছেও জানাতে পারব। কনীনিকা নিজেকেই বলল, সেই আবার অয়নের সবটাতেই মীরা।

রমা পিসী দাঁড়িয়ে কিছু বলার আগেই কাকা লম্বা বারান্দার কালো সাদা চারকোনা ঘরের মত ডিজাইন করা মোজাইকে পা ফেলে ফেলে চলে গেলেন সিঁড়ির শেষ মাথায়। বাবার সাথে আরেকবার হাত মিলিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে বাবার কাঁধের উপর থেকে দোতলার বারান্দার দিকে তাকিয়ে আরেকবার রমা পিসীকে দেখলেন – হয়ত জানতেন এই তাদের শেষ দেখা ।

রমা পিসী কি ভাবছিল তখন ? সবার ভালো করলে, এই বাড়ি, এই পাড়ার সবার ভাল দেখলে , চলে যাচ্ছ সেও সবার ভালোর জন্য , তাতে তোমার কি ভাল হল! এ দেশ, এই মাটি, এই নিরালার বাড়ি যে তোমার খুব আপনার খুব ভালবাসার ছিল। কোন অভিমানে নিজের জীবনকে এমন সর্বনাশের হাতে ছেড়ে দিলে!

কাকার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে কনীনিকার মনে হল সব মানুষই কি কোন না কোনভাবে নিজের জীবনের কিছু দুঃখকে নিজেই টেনে আনে !

আস্তে আস্তে বাড়িটার আরো অনেক পরিবর্তন হলো । ছোড়দাও আমেরিকায় পাড়ি জমালে বাড়িতে শুধু থেকে গেলো দাদী আর তার তিন ছেলে বউরা । বড়দা ব্যবসা কমিয়ে আনতে বললেন। দাদী যতদিন ছিলেন তার তিন ছেলে বাড়িতেই ছিলেন। দাদীর পর বড় কাকা মারা গেলেন। কাকা জেঠিমাকে তাদের বড় ছেলে বড়দা বেড়াতে নিয়ে এসেছিলেন নিজের কাছে। সেখানেই বড়কাকু মারা যান হার্ট অ্যাটাক করে।

জেঠিমা কিছুদিন আমেরিকা বাংলাদেশ করে সেও একদিন শ্বশুর ভিটায় মারা গেল। মেজদা সেজদা বিয়ে করে নিলো আমেরিকায় বসেই বাঙালী মেয়ে দেখে। আর ছোড়দার বিয়ের ইচ্ছেটাই হল না । মেজদা বিয়ের পর মেজ কাকা আর জেঠিমাকে নিয়ে এলো তার সংসার দেখাতে । কনীনিকার বাবা মা ছেলেদের আর কনীনিকার সংসার দেখতে একবার এলো।

বাবা কাকারা একেএকে চলে গেল । ছোট কাকী আর মা তাদের ছেলেদের কাছেই চলে এলেন। মা বিশেষ করে ছোট ছেলের জন্যই থেকে গেল দেশ ছেড়ে বিদেশে।

বড়দা কদিন আগে সবাইকে ডেকে বাড়ি বিক্রি করার কথা বলল। বড়দার মুখের উপর কোন কথাই কেউ কোনদিন বলেনি । সুধু ছোড়দা বলল অয়নের অংশের জন্য ওকে জানিও।

অয়ন বাংলাদেশের শিকড় ছেড়ে মীরাদির হাত ধরে পৃথিবীর আরেক প্রান্তে পড়ে আছে। পিছুটান ত্যাগ করে কতটা ভাল আছ অয়ন কেউ জানেনা । ছোড়দা ম্লান মুখে কনীয়ার দিকে তাকাল যেন কনীয়ার কাছে থেকে দুরে থাকবে বলেই অয়ন বাকি সবার কাছ থেকে দুরে চলে গেলো।

বড়দা অনেকক্ষণ চুপ থেকে বলল, দেখ যোগাযোগ করে যদি ওকে আনতে পারিস।

অয়নের নাম অনেকদিন পরে ওদের কথার মধ্যে এলো। ক্ষণিকের জন্য যেন থেমে গেলো সব কিছু ।

কনীনিকা টের পেলে ওর নিঃশ্বাসের সাথে বুকের ভিতরের পাঁথরে প্রতিধ্বনিত হল অয়ন অয়ন , ফিরে আস একবার; আরেকবার সূর্যোদয় দেখব বলে ফিরে এসো!

 

রাজিয়া নাজমীঃ গল্পকার, প্রযুক্তিবিদ।