ইউসুফ মুহম্মদ-এর নেহাই:
পরিণতি প্রবণ অভীপ্সা ও কৃতিত্ব
আবু মুসা চৌধুরী
একটি জীবন কবিতা-রূপ মানস সরোবরে ডুবুরিবৎ মাণিক্য অন্বেষণে ব্যাপৃত ইউসুফ মুহম্মদ-এর পরিণত-প্রবণ অভিযোজনা ‘দোঁহা’। ইতিপূর্বে প্রকাশিত অজস্র দোঁহা রচনার সাফল্যেও তিলক-অভিষিক্ত, তাঁর এই ‘নেহাই’ শীর্ষক কাব্য উৎকর্ষের সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে সাফল্যেও অপরূপ সৌধ নির্মাণ প্রক্রিয়া-অবশ্যই।
‘নেহাই’ শব্দের মধ্যেই এক ধরনের অভিঘাত। কামারশালার হাপর, গনগনে লৌহ, চুল্লির লকলকে আগুন- এক ধরনের জান্তব সৃজন যজ্ঞের ক্ষেত্র। যেখানে রয়েছে জীবন-যন্ত্রণার চিত্ররূপ। আর দোঁহা হলো অধ্যাত্ম বাণীবদ্ধ মানবিক, অসাম্প্রদায়িক ও জীবন চেতনার নির্যাস, মরমী সংগীত। ক্ষিতি মোহন সেন কর্তৃক রচিত ‘কবীর’ শীর্ষক বহুল গবেষণা লব্দ মহার্ঘ্য গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর বাংলা ও বাঙালির কাছে দোঁহা ব্যাপক পরিচিতি অর্জন করে। অতঃপর অনেকেই দোঁহা রচনায় প্রবৃত্ত হয়েছেন। কিন্তু সাফল্যেও নিরিখে ইউসুফ মুহম্মদ তাদের প্রত্যেককেই অতিক্রম করে সিদ্ধির চুড়ো স্পর্শ করেছেন।
শ্রম ও নিষ্ঠায় ইউসুফকেও কবীরের চিন্তার নিকটতম প্রতিবেশি বলা যায়, এ অর্থে যে, তিনি দোঁহার পীঠস্থান, মহান সাধক কবি কবীরের বিচরণ ক্ষেত্র, জন্ম-মৃত্যু, সাধনমার্গ ও চৌহদ্দি পরিভ্রমণ করেছেন, একজন প্রকৃত গুণগ্রাহী, গবেষক ও কবির মর্মচেতনায়। তাই তাঁর রচিত দোঁহায় প্রাণ সত্তা ও সত্য ঠিকরে বেরিয়ে আসে। দোঁহা এক ধরনের সাধন সঙ্গীত। উত্তর ভারতে কবীরপন্থী এক বিশেষ গোষ্ঠিও রয়েছে।
আধ্যাত্মিক পুরুষ কবীরকে নিয়ে প্রচুর গল্প-গাথা-কিংবদন্তী রয়েছে। কবীরের দোঁহার মূল মর্ম হলো সমম্বয়বাদী দর্শন। কবীরের একটি দোঁহার উদ্ধৃতি দিলেই সেটা স্পষ্টহবে–
‘জো খোদায় মসজিদ বসত হৈ,
ওর মুলক কোহিকেরা?
তীরথ মুরত রম নিবাসী
বাহর করে কো হেরা?’
অর্থাৎ-‘খোদা যদি মসজিদেই বাস করেন আর সব মুলুক তবে কার? তীর্থ মূতিতেই যদি রাম বাস করেন, তবে বাইরেটা দেখে কে?
পক্ষান্তরে ইউসুফ মুহম্মদ উচ্চারণ করেন –
‘ইউসুফ বলে সত্য মানুষ নাভজিয়া যাও যদি গয়া-কাশি-মদিনা
নিজের মধ্যে পাবেনা নিজেরে, হারাবে পন্থ মানুষ না হও যদি না’।
কিংবা
‘ঈশ্বর তোমাকে ছুঁলো, তুমি পাপ ঢাকলে আড়ালে
ফতোয়া শুনিয়ে বুঁদ, আচানক হাত বাড়ালে’।
ইউসুফ মুহম্মদ তার রচিত দোঁহায়, এই ভাব সঙ্গীতের আন্তঃশক্তি, আর্জ, রূপরেখা, অতলস্পর্শী গভীরতা, ইংগিতময়তা, রহস্য- বলা যায় প্রাণ স্পর্শ করেছেন, তার কৃত্যেও সাফল্য উপচে পড়েছে। আপাত সাদা মাটা পঙক্তির আড়ালে, অভ্যন্তরে জীবনের গভীরতর সত্য প্রস্ফুটিত হয়েছে এই পরিণত নির্মিতিতে।
ইউসুফ মুহম্মদ লেখেন- ‘কেউ কি জানো নদীটি আজ নদী ছেড়ে গেছে কত দূর?/ সে তো তোমারই সঙ্গে জ্যোৎস্না উড়িয়ে পোহাবে রোদ্দুর।’ কিংবা ‘আমার দু’দিকে ভরা নদী একদিকে পূর্ণাঙ্গ সাগর/সকল কাঁপিয়ে তার একা অন্বেষণ, সুগন্ধী আগর।’
পঙক্তিসমূহের আন্তঃশক্তি হলো– এই জীবন নদীর প্রতীকায়নে এবং ব্যক্তিসত্তার সঙ্গে সাহচর্য ও বিচারে অন্য কোনো এক মানসলোক বা গন্তব্য বেরিয়ে আসে। আর এই ইংগীত ময়তা, দার্শনিকতাই দোঁহার মৌলিক বৈশিষ্ট্য।
দোঁহা এক ধরনের মরমী কবিতা। বাংলা কবিতায় মরমীবাদ বা মিস্টিসিজম বিশেষ স্থান জুড়ে বিরাজিত। শ্রী চৈতন্যের দর্শন কিংবা লালনের ‘মনের মানুষ’ অথবা রবীন্দ্রনাথের ‘প্রাণের মানুষ বা জীবন দেবতা’ এক সূত্রেই গাঁথা যেন। পূর্বসূরী অবশ্যই শ্রীকৃষ্ণ কৃর্তন। এখানে জীবাত্মা ও পরমাত্মার; আশুক-মাশুকের মিলনাকাঙ্ক্ষা প্রবল।
উত্তর ভারতে কেবল কবীরনয়, এ ধারার সবিশেষ স্থান জুড়ে রয়েছেন দাদু, রজব, গুরু নানক প্রমুখ।
ইউসুফ মুহম্মদও দোঁহা রচনায় চমৎকার দক্ষতা প্রদর্শন করেছেন। তাঁর দোঁহায় ঝলসে ওঠে লিরিক লাবণ্য। যেমন –
‘বরফের প্রজ্জ্বালন দেখার মোহন প্রতীক্ষায়-একাকী ছিলাম,
বিরতির সবটুকু ভার আজ খাঁজ কেটে কেটে বরফে দিলাম।’
আবার ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াৎধর্মী চমৎকার পঙক্তি রচনায়ও তিনি সুচারু নৈপুণ্য দেখিয়েছেন-
‘ইউসুফ দিলো তৃষ্ণার জল, সুশীতল রোমকূপ
তাহার কবরে ঢেলে দিও সুরা জ্বালিও গন্ধ-ধূপ’।
কেবল প্রসঙ্গ বা বিষয়ের ব্যাপ্তি নয়, প্রকরণ দক্ষতায়ও ইউসুফ মুহম্মদ সিদ্ধহস্ত। তিনি ভোরের রজনৗ, জলে ভাসা চিতা, প্রাকৃত খুনি, মাছের আকাঙ্ক্ষা, জাহ্নুবীজল, সুপ্ত-সরস্বতী, অরূপ ক্ষয়-এর মতো বৈপরীত্য ময়, অগতানুগতিক. মৌলিক ও চমৎকার Phrase রচনা করেছেন। তার শব্দবোধও মোক্ষম। তিনি মনচারী, একলগে, অপবাতায়ন, কাঁচুলি জাতীয় ব্যতিক্রমী শব্দ ও যোজনা করেছেন। যা সত্যই প্রশংসার্হ।
ইউসুফ মুহম্মদ বক ধার্মিকতার মুখোশ উন্মোচন ও কবিতায়িত করেছেন এভাবে—
`তোমাদের মৌল-কথা বারুদের কণা, জাগে হিংসা ও বিদ্বেষী ফণা
প্রেম-ধর্ম-ভালবাসা মনের বন্ধনে ঘোচে মানুষের ঐহিক যন্ত্রণা।’
ইউসুফ-এর পরিণতি প্রবণ কাব্য সত্তায় অজস্র হিরে-মানিক্য ছড়িয়ে আছে, এ কাব্যেও ইতিউতি। এক জীবনের চর্যা-চর্চা, ধ্যান-জ্ঞান, কবিতা যাপনের নিবিড় নির্যাস আলোচ্য কাব্য। অন্ত্যমিলের অপরূপ মাধুরী এ কাব্যে সুলভ। যেমন মিলবিন্যাসে তাঁর ক্রুেশে’র সঙ্গে গুরু সে, ঊর্ধ্বে-সুর দে ইত্যাদি অভিনব ও সুদক্ষ যোজনা কবিতাকে অন্য মাত্রায় অভিষিক্ত করেছে। সর্বতোমিলিয়ে ইউসুফ মুহম্মদ-এর দোঁহা বাংলা সাহিত্যেও একটি মহার্ঘ্য সংযোজন।