You are currently viewing আশ্রম – মহুয়া ভট্টাচার্য

আশ্রম – মহুয়া ভট্টাচার্য

অবশেষে আজ বিকেলের দিকে লাশটা ভেসে উঠলো পুকুরে।

দুপুরে মহা প্রসাদ বিতরণের পর পরই আশ্রমে তারই বয়েসী একজনের খেয়াল হল – অনেক্ক্ষণ ধরে অনিত্য প্রভুকে দেখা যায়নি। সে একথা একলব্য প্রভুকে জানতে গিয়ে ধমকও খেলো জোরেসোরে- ” পাঁচ ছ’বছরের একটা ছেলেকে তোরা দেখে রাখতে পারিসনে? বড্ড বাড় বেড়েছে এই ছেলের।

আশ্রমবাসী সকল পুরুষ, ভক্ত একে অন্যকে ” প্রভু” সম্বোধন করেন, এবং সকল নারী তাদের ” মাতাজি”। তাঁরা অকৃতদার, নিরামিষভোজী। হরি নাম সংকীর্তনই তাঁদের বেঁচে থাকার রসদ। এই আশ্রম প্রাঙ্গনটি বেশ বড়। দোতলা বাড়ি পুরোটাই ভগবানের কাজে নিবেদিত। সামনের দিকে বড় একটি পুকুরে শান বাঁধানো ঘাট। ওখানে কেবল আশ্রমের মহারাজ ও জ্যোষ্ঠ প্রভুদের স্নানাচারের জন্য নির্ধারিত। তাই এই পুকুরের জল পবিত্র রাখতে হয়। আশ্রমের ভোগ নিবেদনের জল,  আশ্রমবাসীদের পানীয় জল, ভগবানের সেবার যাবতীয় কার্যাদির জন্য ব্যবহার্য জল – সবই এই পুকুর থেকে সংগৃহীত হয়। আর আশ্রমবাসী বালকদের স্নান, বাসন কোসন ধোয়াসহ নিত্য ব্যবহার্য কাজ আশ্রমের পেছনের পুকুরে। এঁটো পুকুর বলে এই পুকুরের জলে জ্যোষ্ঠ প্রভু ও মহারাজের ছুৎ মার্গ রয়েছে।

দুটি পুকুর, উঠোন সমেত দোতলা বাড়ি মিলিয়ে আশ্রমের জায়গা কিছু কম নয়। প্রথমদিকে দোতলা ঘরের একটি কামড়া ভাড়া নিয়ে ছয় জন প্রভু ভগবানের সেবায় আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতি সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় আরতি, হরিনাম জারি রাখলেন প্রভুগণ। দোতলা ভবনের মালিক শহরের বাসিন্দা, ভেবেছিলেন প্রভুদের সন্ধ্যারতি ও হরিনামে তার খালি পরে থাকা ভিটেতে অন্তত প্রদীপ জ্বলবে। এই আশায় তিনি বিনা শর্তে প্রভুদের একটি কামরা দিয়ে নিশ্চিন্তে পরপারের পুণ্য সঞ্চয় করছিলেন।

ধীরে ধীরে হরিনামের মহত্ত্ব প্রচার হচ্ছিলো আশেপাশের গ্রামে। সকাল, বিকেল দু’ বেলা খাঁটি গাওয়া ঘিয়ের নানাপদের অপূর্ব নিরামিষ ব্যন্জনের সুবাসে গ্রামের লোকজনের মধ্যেকার ভক্তিভাব জাগ্রত হতে লাগলো। বিশেষত নারীরা বাল্যভোগ, রাজভোগ,শীতলভোগ এবং আরতির সময়টা এমন ভীড় বাড়িয়ে তুলল যে, প্রভুদের জন্য নির্ধারিত কামড়ার বাইরেও পরবর্তী কামরাগুলোও ভক্ত সমাগমে পূর্ণ হতে লাগলো।  মহাপ্রসাদ আস্বাদনে – সর্ব দুঃখক্ষয়, সর্ব পাপক্ষয়। জ্বরা,ব্যাধি মুক্ত হওয়া যায় হরিনাম সংকীর্তনে। ফলতঃ একটি,দুটি, তিনটি কামরা ছাড়িয়ে আশ্রম এখন সম্পূর্ণ দোতলা বাড়িতে পরিব্যপ্ত।  দোতলা বাড়ির মালিক ভগবানের নামে এতটাও উদার হতে চাননি। তিনি পুরো বাড়ি ভগবানের নামে লিখে দিতে আপত্তি করে অবশেষে একটি মামলাও রুজু করেছেন সম্প্রতি। যা হোক, সে মামলাও চলছে, নাম সংকীর্তনও চলছে। দুপুর ও সন্ধ্যায় গোলোকবিহারী শ্রীকৃষ্ণের বন্দনায় মাতে সমস্ত দোতলা বাড়িটি। ভক্তগণ  কখনো শ্রী রাগ, কামোদ, পটমঞ্জরী রাগ ও রসে মজেন, কখনো শ্রী খোল, মন্দিরায় তাল ধরেন- দাদরা, একতাল,রূপক।

হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে

হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।

এরই মধ্যে আশ্রমে প্রাণের সংখ্যাও বেড়েছে একটি দুটি করে। কিছু অনাথ সন্তান এসে জুটেছে। বেশিরভাগই মা – বাবা গছিয়ে দিয়েছে খেতে দিতে পারেনা বলে। এখানে অন্তত দু’ বেলা খেতে তো পাবে। তারওপর ভগবানের নামগান শুনে শুনে বড় হতে পারবে।  জ্যোষ্ঠ প্রভু ছয়জন, তাঁদের মাথার ওপর রয়েছেন আশ্রমের মহারাজ এবং এ নিয়ে বারোজনের মত অনাথ এসে জুটেছে আশ্রমে। সবশেষে এসেছে এই পাঁচ ছ’ বছরের অনাথ শিশুটি, আশ্রমের নিয়ম মাফিক তার নাম দেয়া  হয়েছিলো – অনিত্য প্রভু। মাস ছয়েক আগে তার মা মহারাজের কাছে বহু মিনতি করে ছেলেটিকে আশ্রমে রেখে গিয়েছিলো। মহারাজকে মেয়েটি বলেছিলো ছেলেটির বাপ মরেছে। বিধবা মেয়ে মামুষ, লোকের কাছে হাত পেতেই তো চলতে হবে। কিন্তু ছেলেটি যেনো একটু আরামে থাকে।

মহারাজের অবশ্য কেনো যেনো সন্দেহ হয়েছিলো মেয়েটি কোথাও মিথ্যে বলছে। তবুও শেষমেশ ছেলেটির আশ্রমেই গতি হোলো। ভগবানের সেবা, প্রভুদের যাবতীয় কাজকর্ম এবং ভোগ রান্নার কাজও তো কম নয়। এই অনাথ আশ্রম বালকদের মধ্যে সে সমস্ত কাজ বন্টন করে দেওয়া হয়েছে। এই আশ্রম বালকদের প্রত্যেকেই  দশ থেকে বারো, তেরো বছর বয়সের। সর্বকনিষ্ঠ ছিলো এই ছেলেটি। বয়স পাঁচ ছ’ বছরের মধ্যেই হবে। মুখচোরা, লাজুক,দূর্বল। তার কাজ নির্ধারিত হোলো প্রভুদের প্রসাদ গ্রহণের সময় পাতে ঘি,নুন,লেবু দেওয়া এবং প্রসাদ গ্রহণের পর পাত পরিস্কার করা। তা সেই কাজটিও খুব সহজ নয়। প্রতিদিন কম করে কুড়ি তিরিশজনের পাত পরে আশ্রমে। ভগবানের জন্মতিথি কিংবা অন্যকোন পূজোপার্বণে সেই সংখ্যা বেড়ে পঞ্চাশও কিংবা তারও বেশি হয়।

দুপুরে ভগবানের উদ্দেশ্যে ভোগ  প্রসাদ নিবেদনের পর  শুরু হয় নামকীর্তন। মাতাজীরা এখন আশ্রমের অপরিহার্য অনুষঙ্গ। কোন মাতাজী একদিন না এলে প্রভুগণ খবর পাঠান ভগবানের পূণ্যার্জনের অংশীদার হওয়ার জন্য। ভগবানের নাম সংকীর্তনে মাতোয়ারা হয়ে উঠলে ভক্তের দেহে প্রাণ থাকে না। পরমাত্মার সাথে আত্মা বিলীন হয়ে শ্রীখোল, মৃদঙ্গের তালে তালে নর-নারী উভয়ই আত্মহারা হয়ে যায়। নৃত্যরত ভক্তের সংকীর্তনের পুণ্যবানে প্রকম্পিত হয় দোতলা বাড়িটি। নৃত্য ও নামগানের শেষে মহা প্রসাদ আস্বাদন। মহারাজ,  জ্যোষ্ঠ প্রভু এবং পরম ভক্ত মাতাজীদের  প্রসাদে পদ কিছু বাড়তি থাকে।  যেমন, পনীরের দোলমা, মুগ মনোহরা, ফুলকপির কোর্মা- ইত্যাকার সুস্বাদু পদ নির্দিষ্ট থাকে মহারাজ, জ্যোষ্ঠ প্রভু ও ভগবানের চরণে আত্মনিমগ্ন মাতাজীদের জন্য।

আশ্রম বালক গিরিধারী প্রভু, মুকুন্দ প্রভু, রাধারমণ প্রভু,অনিত্য প্রভুদের ওপর ন্যস্ত আশ্রমের কাজকর্ম ও পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার ভার। সকাল বেলা গীতাপাঠের পর পরই শুরু হয় নিত্যদিনের নির্ধারিত কাজ।  আশ্রমের বালকেরা মোটামুটি অভ্যস্ত হয়ে গেলেও পাঁচ বছরের অনিত্য প্রভু এখনো অভ্যস্ত হয়নি তেমন।  ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠতে হয় বলে, প্রায় দুপুরেই মন্দিরের সিঁড়িতেই ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু তার নির্ধারিত কাজ তো তাকেই করতে হবে।  আজ তার লাশ ভেসে উঠলো পুকুর ঘাটের নিচ থেকে। সারা দুপুর খোঁজ চলেছে। পেছনের এঁটো পুকুরে বাসন ধুতে গিয়ে হয়তো টাল সামলাতে পারেনি, হয়তো ধুতির পাড়ে আটকে গিয়ে উল্টে পড়ে গিয়েছিলো। কি করে ডুবলো ভগবান জানেন!