You are currently viewing আশ্চর্য বতুয়া শাক ও কাঁচা দুধের ডিসকোর্স / বদরুজ্জামান আলমগীর

আশ্চর্য বতুয়া শাক ও কাঁচা দুধের ডিসকোর্স / বদরুজ্জামান আলমগীর

 

আশ্চর্য বতুয়া শাক ও কাঁচা দুধের ডিসকোর্স

বদরুজ্জামান আলমগীর

ঢাকা শহরে ঢোকার মূল মূল জায়গায় চোখ রাখলে একটি দৃশ্য চোখে পড়ে; সবখানে তার নমুনা একই, জায়গাভেদে দৃশ্যায়নে হয়তো কিছুটা রকমফের থাকতে পারে।

কমলাপুর রেলস্টেশনে গাড়ি এসে থামার পর যাত্রীরা হুড়মুড় করে নামে; ট্রেনের শ্রেণি ও ব্যক্তিত্ব বুঝে যাত্রীসকলের ভিন্নতা হয়; কথা বলাবলির মেজাজমর্জি, গাম্ভীর্য, চাপল্য, কুলীদের শাসানি- ধমকানি, কারো কারো বিস্ময় বিহ্বলতা উনিশ-বিশ হয়; কিন্তু সদ্যাগতদের মধ্যকার একটি তৎপরতা একই রকম থাকে : তারা গাড়ির বগি থেকে নামামাত্র চোখে সূর্যচশমা সাঁটে, নয়তো হাবেভাবে এমন একটি ভঙ্গিমা আনে যে, সে নিজেকে চেনে না, ঢাকা শহরের জৌলুসের ভিতর আপসে আপ যে লোকটা ঢুকে যাচ্ছে- সে ঠিক নিজে নয়, অন্য কেউ, চলনে বলনে সে রপ্ত করে নিচ্ছে ভিন্ন এক কেতাদুরস্ত ভিন্নতা। কেউ কেউ আবার স্টেশনের আধাসচল পানির কলে তাদের পা ধোয়, শরীরের ঘাম মোছে, কাঁকই দিয়ে মাথার চুল পরিপাটি করে।

উত্তর বঙ্গ থেকে যারা গাবতলী বাস স্টেশনে এসে নামে তারা যেমন, দক্ষিণ বঙ্গ থেকে স্টিমারে যারা সদরঘাট টার্মিনালে আসে তারাও সবাই পা ধোয়, ও ঘাম মোছামুছির কাজটি করতে ভোলে না। ঢাকা শহরে ঢোকার এ এক অলিখিত দস্তুর। মেগা রাজধানী ঢাকায় এসে তার মতিগতির সঙ্গে যোগাযোগ  তৈরি করার শর্ত হয় পায়রাবন্ধের ধুলা ও দুধকুমার নদীর যে পানির দাগ পায়ের গোড়ালির সঙ্গে লাগানো তা ধুয়েমুছে সাফ করা; হাকালুকি হাওরে ছোট ছোট তারাবাইন মাছের  সখ্যের কারণে শরীরের আঁশটে গন্ধ ঘষেমেজে তুলে ফেলা; ময়নামতির পিছুটান, ও পিছনে ফিরে তাকানোর স্থৈর্য, মৈন পাহাড়ের অটলতা আর সর্বোপরি আশ্চর্য বতুয়া শাক ও কাঁচা দুধের ডিসকোর্স পিছনে ফেলে রাজধানী ঢাকা শহরে ঢোকার অধিকার করায়ত্ত করতে হয়।

একই সংঘটন, ব্যাকরণ ও  বিধিবিধানের ভিতর দিয়ে এলেও একটি ভাষা কখনো এক ভাষা নয়, ভাষার পেটের মধ্যে আরো ভাষার সমাহার থাকে।

১৯৫২ সনে বাঙালি খেলা জিতে মেডেল ঘরে তোলার মত সাড়ম্বরে নিজের সম্পূর্ণ অধিকারে বাঙলা ভাষা ঘরে তুলে আনে। কিন্তু এতো বছরেও বাঙলা তার প্রাণের সবটুকু আকুতি বাঙ্ময় করে তোলার মত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও মর্যাদাবান হয়ে উঠতে পারেনি। তার প্রধান কারণ নাগরিকগণ তাঁদের অর্জিত সম্পদ স্বপ্ন ও ভাষা প্রধানত পূর্ব বাঙলা ও ক্রমান্বয়ে যে বাঙলাদেশ নাম রাষ্ট্রের হেফাজতে রাখেন, সেই রাষ্ট্র ঈমানদার রাষ্ট্র  নয়, সে কথা আর কাজে মিল রাখেনি।

বাঙলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকার করে নিলেও এ-রাষ্ট্র কখনো ব্যক্তির নিজস্ব অভিব্যক্তি থেকে শুরু করে সর্বস্তরে শিক্ষায়, উচ্চ আদালতে বাঙলা জারি রাখার বলিষ্ঠতা অর্জন করেনি। ফলে আটান্ন সালেই বাঙলা রাষ্ট্রভাষা হিসাবে পরিগণিত এবং স্বীকৃত হবার পরও ভাষা হিসাবে বাঙলা কোনদিন মায়ের খাঁটি যত্ন পায়নি। ভাষাবিজ্ঞানী নোয়াম চমস্কি যেভাবে ভাষা পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন তা একবার মিলিয়ে দেখা যাক : তিনি বলেন,  একটি ভাষায় যদি শৃঙ্খলার ঘাটতি থাকে, তাহলে তার কারণ খুঁজতে হয় সেই সমাজের মনস্তত্ত্বের ভিতর; কোন ভাষা একটি সৃজনশীল রাষ্ট্র ব্যবস্থার সরাসরি মনোযোগ  ও কর্মনিষ্ঠা ছাড়া সৃষ্টিশীল ভাষাকাঠামোয় উত্তীর্ণ হতে পারে না।

বাঙলাদেশ রাষ্ট্র জন্মগ্রহণের অতি প্রথম মুহূর্তে যে সংবিধানের উপর তাকে দাঁড় করানো হয় তা গোঁজামিলে ঠাসা; এই সংবিধানে নিম্নবর্গীয় নাগরিকের আশা, চাওয়া আর মনস্তাত্ত্বিক অবকাঠামোর সঙ্গে উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণির খোয়াব একদিকে যায়নি, উচ্চবিত্ত শ্রেণির লাগামহীন ক্ষমতায়ন, ক্ষমতাসীন পার্টির প্রশ্রয় ও আশকারায়- এক হরিলুট পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। ধর্মকে একদিনের জন্যও রাষ্ট্র ও ডিসিশনমেকারদের মাথা থেকে আলাদা করা যায়নি। তার ফলে হয়েছে কী- নানা পর্যায়ে রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সাধারণ নাগরিকের কোন প্রতিশ্রুতিশীল ও সম্মানজনক যোগাযোগ তৈরি হয়নি- ভাষা এখানে সম্পূর্ণ অচল। সাধারণ জনগণ যখন চায় শিক্ষার অধিকার, রাষ্ট্র ও ধুরন্ধর আমলা শ্রেণি তাদের দেখায় দয়াদাক্ষিণ্য; নাগরিকগণ যখন দাবি করেন তথ্যের অধিকার প্রতিপক্ষ রাষ্ট্র নিরাপত্তার নামে তাদের চোখরাঙায়। এই ধরনের রাষ্ট্র ও তা পরিচালনাকারী সরকার গড়ে তোলে এক শোষণের সংস্কৃতি,  এই শোষণের অবকাঠামো সমাজে আমদানি করে এক ভয়ানক ভাষা। সামাজিকগণ ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন যে পুলিশ তাদের পিটাবে- এমনই বিধান; মন্ত্রী আমলাগণ হেলিকপ্টারে এসে নামবেন, আর আমাদের দূর থেকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে হবে, কখনো কাছে যাওয়া যাবে না- এরকমই নিয়ম; কেবল জন্মগতভাবে পুরুষ হওয়ামাত্রই সে নারীর উপর কর্তৃত্ব করবে,তা-ই শাশ্বত! এই মনস্তাত্ত্বিক কাঠামোর আদি ও আসল বীজ সুরক্ষিত ঔপনিবেশিকতায়। ঔপনিবেশিকতা বিভক্তিকারী ও চাকর সংস্কৃতির নাম, এবং এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার নামান্তর। এই সংস্কৃতি প্রতিশোধপ্রবণ, আর তা নিরবচ্ছিন্নভাবে মানহানি উৎপাদন করে।

ঘরের যে নিরাপদ গৃহিণী তার উপর স্বামীবর কারণে অকারণে ছড়ি ঘোরায়; স্বামী যে-লোকটি তাকে খানিকটা ভৎর্সনা করে দেয় স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার সাহেব, মেম্বারকে চোখ রাঙায় চেয়ারম্যান,  যুবলীগ বা যুবদল- যখন যে-জমানা- তাদের ইউনিয়ন কমিটির সভাপতি চেয়ারম্যান সাহেবকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে বলে যে বাড়াবাড়ি করলে থাবড়াইয়া দাঁত ফেলে দেবো হারামজাদা; জেলা কমিটির ক্যাডারের কাছে সেই যুবনেতা পায়ের তলায় বসে ম্যাঁও ম্যাঁও করে, মদতদাতা মন্ত্রীর কাছে ক্যাডার এসে ইনিয়ে বিনিয়ে কান্নাকাটি করে অস্থির, মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর কাছে চাকরেরও অধম, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, কী বারাক ওবামার কাছে একেবারে লাছাড়! এই যে অপমানে গৌরবান্বিত হবার সংস্কৃতি তার মধ্যে বড় ধরনের ত্রুটি ও সর্বনাশ আছে যা গ্রহণ করা যায় না।

বায়ান্ন সন থেকেই বাঙলা ভাষার অনেকটা পরীর দশা; পরী খুব রূপবতী কিন্তু অসহায়, পরী লাবণ্যে চমৎকৃত কিন্তু বাস্তবে রক্তশূন্য ও দূরবর্তী।

ভাষা বিজয় ও দেশজয়ের এতো দীর্ঘ বছর পর এই স্বাধীন ভূখণ্ডে যে প্রজন্ম বেরিয়ে এসেছে তাদের মধ্যকার আন্তঃযোগাযোগের পরিস্থিতি পরখ করার পর আতঙ্কিত না হবার উপায় কী! এখানে মোটাদাগে তিন প্রজাতির মানুষ পয়দা হয়। বিলের পানির সঙ্গে নদীর জল এক স্রোতে চলার পরও যেমন একটির মধ্যে আরেকটি ধারা মেশার প্রবেশাধিকার নেই, বরং বলা ভালো- বিভেদ আরো গভীরে: যেমন পানির সঙ্গে তেলের কখনোই মিলমিশ খায় না সেই রকম। ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল থেকে যারা বেরোয়, তাদের সঙ্গে বাঙলা মাধ্যমের ছেলেমেয়েদের মনোজগৎ ও ব্যক্তিত্বে আকাশ-পাতাল তফাৎ; মাদ্রাসা থেকে যারা আসে তারা রীতিমত ভিন গ্রহের মানুষ! এই যে একদেশে তিনটি ভিন্ন ভিন্ন কারখানা- সেখানে উৎপন্ন তিন ধরনের পণ্যের সম্পূর্ণ আলাদা আলাদা বাজার! ধরা যাক, এই তিন পদের মানুষ একই ভাষা বাঙলায় কথা বলে,  তারা পরস্পরের মুখোমুখি হলে কী কথা বলবে- মনে হবে কিছু শব্দ আছে, ভাষা তো নাই! ফলে রাজনীতি ও বিশ্বাসে তারা সবসময়  মুখোমুখি হয়, পাশাপাশি হয় না। কোন ভাষা-ই কেবল নিজেনিজে  একটি ভাষামাত্র নয়, বাঙলাও তাই, বাঙলা একটি ভাষা শুধু নয়- আস্ত একটি মনোজগৎ।

হালজমানার দুনিয়ায় বাঙলার ভূমিকা ও দায়িত্ব অনেক। এই করপোরেট বিশ্বে সবকিছু বিক্রয়ের অধীন। সহোদর পিঠাপিঠি ভাইবোন যে একই পেন্সিল বক্সের পেন্সিল নিয়ে টানাটানি মারামারি করে, অবশেষে অসীম আস্থা, স্নেহ ও ভালবাসার বন্ধনে জড়ায়, করপোরেট দুনিয়া সেই সুযোগ রাখেনি: বোনের পেন্সিলের রঙ গোলাপি, আর ভাইয়ের পেন্সিলের রঙ ধার্য করা হয়েছে নীল। তাই গোড়াতেই আলাদা, এক বক্সের বদলে তারা কেনে দু’টি আলাদা পেন্সিল বক্স- একটি গোলাপি,  আরেকটি  সবুজ। তাই আপাতভাবে তাদের মনে হয় সুখী ও পরিপূর্ণ, কিন্তু আসলে ওরা এক থেকে ভাগ হয়ে পরিণত হয় দুইয়ে; ত্যাগের, ভাগের আনন্দ পিছনে ফেলে তারা বেড়ে ওঠে ব্যক্তিসর্বস্বতার মেকি জৌলুসে।

পাশ্চাত্যে প্রেম পরিণত হয়েছে একাগ্র যৌনতায়, যৌনতা বলাৎকারের পর্যায়ে উন্নীত হতে তেমন আর বাকি নেই। প্রাচ্যের প্রেম নিয়তির অমোঘ বাণীর অনিবার্যতায় স্থির গন্তব্যে বাঁধা- সেই গন্তব্যের নাম বিবাহ। দু’খানেই একটি ব্যাপার কমন, তা হলো: পাশ্চাত্যে কী প্রাচ্যে দুই ভিন্ন কায়দার ধোঁয়াশায়, কুয়াশায়, উৎপীড়নে, অবিশ্বাসে থেঁৎলে বিমর্ষ প্রাণের ভাষা! পাশ্চাত্যে নারী-পুরুষ কী বলবে, কী করবে তার সবটুকু নির্ধারণ করে দেয় বাজার সংস্কৃতি, প্রাচ্যের নারী-পুরুষ আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা ধর্মীয় রক্তচক্ষুর নিগড়ে। প্রাণের যে নিজের ভাষা- তার দেখা মেলা ভার!

তাই আমরা যখনই বলি বাঙলা,  তখন তা কেবল একটি ভাষামাত্র নয়- একটি বিদ্যালয়,  একটি প্রাক্সিস। বাঙলা ব্রাত্যজনের ভাষা- সংস্কৃত আশরাফদের অবহেলা ও ঘেরাটোপ থেকে প্রান্তিক জনমনিষ্যির মায়া, ভোগান্তি আর মাটিতে বুকঘষা আতরাফের জ্ঞানতত্ত্ব নিয়ে বাঙলা ভাষা তার অবকাঠামো গড়ে তোলে। তাই বাঙলায় আগুন বললে তার সঙ্গে আপনাআপনি একবিন্দু অশ্রুকণা আলগোছে এসে যোগ হয়, জলের সর্বনাশা ঢেউয়ের সঙ্গে নিভৃতে মেলে রাধার হারিয়ে যাওয়া প্রেমবতী কলস।

বাঙলায় এক প্রাণের সঙ্গে আরেক হিয়া বাঁধাপড়ার যে জীবনতত্ত্ব তার সঙ্গে লীলা আবশ্যক। যেখানে লীলা নাই সেখানে প্রেম নাই, যেখানে প্রেম নাই সেখানে ঈশ্বর নাই! বাঙলায় ঈশ্বর পাকাপাকি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিরাজ করেন না; বাঙলায় ঈশ্বর থাকেন দুঃখে ও ভাষায়। বাঙলায় ঈশ্বর,  ভগবান বা খোদার সঙ্গে বান্দার যে যোগাযোগ ও ভাব বিনিময় তার ভাষা সকলের আয়ত্ত্বের অধীন; বাঙলায় ঈশ্বর থাকেন লীলায় ও প্রতিটি শ্বাসের ভিতর- তারজন্য মক্কা বা কাশী যাবার দরকার পড়ে না।

হালজমানার যে হালচাল তাতে আবার প্রান্তিক সহজ জনমনিষ্যির প্রসঙ্গ মনে পড়ে যায়; করপোরেট পুঁজিবাজারে ঈশ্বর একনম্বর বিনিয়োগ – সাধারণ্যের কী বুকের পাটা যে সে ঈশ্বরের সিংহ দরজার সামনে দাঁড়ায়? ইবাদত বলি, উপাসনা কই, বা প্রার্থনা নাম দিই- তা আজ সম্পূর্ণ বেহাত। বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর  ধমকে মুসা নবী সারাক্ষণ তটস্থ; মক্কায় অন্যায় পুঁজির যে দাপট ও চক্কর- যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায়- তাদের কী সাধ্য যে তারা আল্লার ঘরের ধারেকাছে ভেড়ে? বুদ্ধের শমনগণ নির্বাণের জেল্লায় সিদ্ধার্থের অতি চিত্তাকর্ষক মূর্তি গড়ায় ব্যতিব্যস্ত,  তা না হলে হলিউড তারকা রিচার্ড গিয়ার- এর মন তো ভরে না; মা দূর্গা তার নিজের মুখে ঐশ্বরিয়া রাই-এর আদল না বসালে ভক্তদের অনুরক্ত করার কোন শক্তিই তার হাতে থাকে না।

শ্রীমদ্ভগবত গীতা বলে, ঈশ্বর এক নির্গুণ গুণের আধার। ভাষাও তা-ই, ভাষা নির্গুণ এক গুণের আধার। উৎপীড়কের ভাষা ধনদৌলতের সকাশে  যায়, কিন্তু উৎপীড়িতের ভাষা ব্রতযাত্রা করে নৈঃশব্দ্যের দিকে, কেননা উৎপীড়িতের কোন আশ্রয় অবলম্বন নাই- তাই সে যায় নৈঃশব্দ্যের কাছে- যে নৈঃশব্দ্যের মধ্যখানে ঈশ্বর থাকেন। সর্বশক্তির আধার এই নীরবতা; লালন সাঁই একদিন নিঃশব্দ শব্দরে খাবে- বলার ভিতর দিয়ে এ-কথাই বলেন।

গবেষণাগারে ভাষা বাঁচে না, চুৎমার্গেও তার আয়ু সীমিত। ভাষা বাঁচে ঘামে, কামে ও প্রকৃতির সখ্যে; এটাই স্বাভাবিক- যেখানে যে জন্মায় সেখানেই সে বেঁচেবর্তে থাকে। সমস্যা হয়, যখন দেখি যে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রতিপত্তি ও লোভ লালসার হাত ধরাধরি  করে চলে। বিজ্ঞান যখন পরিচর্যা ও বিনয়ের বদলে ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করে, বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানী তাদের প্রকৃত ব্যক্তিত্ব হারিয়ে পুঁজির অঙ্গুলি নির্দেশে ওঠ-বস করে তখন সভ্যতা ও যাবতীয় অর্জন সর্বনাশের কিনারায় এসে দাঁড়ায়। যে বেঙ্গমা-বেঙ্গমি আমাদের লোককাহিনীর নায়ক বিপদগ্রস্ত রাজকুমারকে সমস্ত বিপদের পূর্বাভাস জানায়- সে কীভাবে শত্রুপক্ষ হয়; তিতাস নদীর মাছের গন্ধ যদি আমাদের অঙ্গে জড়িয়ে না থাকে- তাহলে এ-দেহ কাঠামোর সঙ্গে ইটসুড়কির দালানকোঠার তফাৎ কী!

পাখিরা  মনের কথা বলার লাগি আর তাদের বন্ধুর দেখা পায় না, কেননা সোলেমান পয়গম্বর তাঁর  অভিজ্ঞান ও দরদ নিয়ে সে মেলাদিন হয় উধাও। পাখি ফরিদউদ্দীন আত্তারে, পক্ষী লালন সাঁইজি, কী ভবা পাগলার গানে যে মরমিয়া চৈতন্যের মর্ম বহন করে- তাকে পরম যত্নে আমাদের আধ্যাত্মিক মধুক্ষরায় তুলে আনার সময় কোথায়! পাখি এখন কেবলই একখণ্ড মাংসপিণ্ডের বাইরে কোন হৃদপরাণের অভিব্যক্তি নয়।

জলের নিচে মৌন পানির নিচে খোয়াজ খিজির লাপাত্তা, সে-ও বহুদিন।

পাখিদের ভাষা, মাছেদের উৎসারণ আর বোবা মেয়েটির সবটুকু আকুতি বোঝার এক সহজ ভাষা অধিকারে আনার এখনই সময়। কাটা গাছের গুঁড়ি, খনার কাটা জিহ্বা আর আদমজী পাটকল বন্ধ হবার আর্তনাদ একই।

নিসর্গের সঙ্গে মানুষের লেনদেন ও যোগাযোগ নিত্য একান্নবর্তী,  ফাল্গুন-চৈতের বসন্তমাধুরী আমাদের শরীর ও মনে কী অদ্ভুত আনাগোনা করে! তারুণ্য-যৌবনে শ্রীশ্রী প্রজাপতি ঘুরেঘুরে উড়ে শরীরে এসে আসন পাতলে আমাদের বিয়ের ফুল ফোটে- এভাবেই বাঙলায় একের ভিতর অন্যের যাওয়া আসার সুবাদে প্রকৃতি ও মানুষের অভিব্যক্তি বাঙ্ময় হয়ে ওঠে। কিন্তু দিনকেদিন প্রকৃতির উপর মানুষের অন্যায়, পাপবিদ্ধ একতরফা কর্তৃত্ব আর জুলুম বলবৎ থাকায় এ-দুয়ের মধ্যকার অন্তর্গত কথা বলাবলি ও সুখদুঃখের অদলবদল করার ভাষা কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ে।

অভিমানী দোর্দণ্ডপ্রতাপ ষাঁড় কৃত্রিম প্রজননের ফলে কবেই খুইয়ে বসেছে তার সঙ্গিনীর সঙ্গে যৌনমিলনের অধিকার, মোটামোটা ইরি ধানের সাথে চিকনসুন্দর কালিজিরা ধানের আর যোগ কোথায়, গোসলের পুকুর ভরে ওঠে বিষাক্ত বর্জ্যে। ফলে মাছের ঝাঁকের ভিতর সাঁতার কেটে স্নান করার অধিকার আর আনন্দ বেবাক গরহাজির; বাঙলার নারী পুকুর ঘাটে নেমে যদি আনমনে তার কলস না হারায় তাহলে বাঙলা ভাষা কোত্থেকে মধুঝরা হবে, এ-বাঙলার সঙ্গে পশ্চিমের কী তফাৎ যদি কৃষ্ণ না থাকে, রাধার প্রতীক্ষা ও অভিমান বিহনে বাঙলা ভাষার বিহবলতা দানা বাঁধবে কীভাবে?

এই এক আশ্চর্য  বাঙলা যেখানে জগতের ঘোর রহস্যকথা বর্ণিত হয় গানে, ফলে এখানে সক্রেটিসের জন্ম হয় না, জন্ম হয় লালন সাঁইয়ের,  জাঁ পল সার্ত্রে অতো সুবিধা করতে পারার কথা নয়, এখানে আপনঘরের ছেলে হিসাবে সুর সাধেন রাধারমণ দত্ত। গান ছাড়া এ-দর্শন হয় না, গদ্যযুক্তি এখানে অচল- কেননা প্রকৃতির অন্তর একটি অদেখা সুরের সাধনে বাঁধা- লালন সাঁই দীক্ষা নিয়েছেন নদী ও ধসের কাছে; আমাদেরও প্ল্যাটো আছেন- তিনি বুড়ো অশ্বত্থ গাছ; বিলের একাকী ধৈর্য আর কোলজুড়ে পদ্মফুল ফোটার গরিমা গানে বাঁধেন শাহ্ আবদুল করিম।

গানে গানে এ বাঙলায় বেড়ে ওঠে এক অসামান্য  দার্শনিক ঘরানা- পুরুষের মধ্যে যে শক্তির নিশানা তা নারী; নারীর মধ্যে প্রকৃতির মাধুরী পুরুষ। নারীর মধ্যে বিরাজ করে পুরুষ ও নারী, পুরুষের মধ্যে খেলা করে নারী ও পুরুষের সম্মিলন- এভাবেই হয় অর্ধনারীশ্বর। বাঙলার দর্শন বিখণ্ডনে বিশ্বাস করে না- বাঙলা শিল্পতত্ত্বও সেই নিশানা ইঙ্গিত করে। গদ্যের ভিতর পদ্যের বীজানু, গানের অতলে দার্শনিক বাহাস- যেভাবেই গঠিত হোক, বাঙলার প্রাণে সুরের অধিষ্ঠান অক্ষয়।
একের ভিতর দুই, কিংবা দুইয়ের ভিতর সংখ্যাতীতের চলাচল বিজ্ঞানে,  দর্শনে এক অতুল্য জ্ঞানতত্ত্ব। বাক্স্বাধীনতা থেকে শুরু করে যে কোন স্বাধীনতার স্বেচ্ছাচারিতায় ডোবার একটা ঝুঁকি থাকে। প্রকৃত প্রস্তাবে, বাকস্বাধীনতাসহ যে-কোন পূর্ণস্বাধীনতা-ই আসলে অর্ধেক। স্বাধীনতাকে যথেচ্ছাচার থেকে রক্ষা করার একমাত্র পথই তাই; অর্ধেক উপভোগ করতে হয় নিজে, আর বাকি অর্ধেক আগলে রাখতে হয় সহনাগরিকের জন্য। আট আনা  আর আট আনা মিলে হয় ষোল আনা। মনের ঋতুক্রম অনুযায়ী কথা বলার অধিকার যেমন স্বাধীনতা, কথাবিহীন নৈঃশব্দ্যের ধ্যানে নিমজ্জনের অধিকারও বাক্স্বাধীনতার আওতার মধ্যে পড়ে।

গিরিধারী নাগরের সঙ্গে মীরাবাঈ-এর একজনমে দেখা হয়নি, কিন্তু নীরবে নিথরে ফুলে ফুলে ভরে ওঠে তার তৃষ্ণার গহন কথা; রাবেয়া বসরী নিত্য অদেখা প্রেমসখার জন্য বয়ান করে যান উজ্জ্বল গীত।

ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য পরিশেষে এক বুদ্ধিবৃত্তিক স্বেচ্ছাচারিতা, একটি সামাজিক দেওয়াল ও অন্তঃসারশূন্যতা ছাড়া আর কী! ব্যক্তিস্বাতন্ত্র‍্যের চূড়ান্তে এসে রাষ্ট্র পরিণত হয় এক অসংবেদনশীল আইনী সন্ত্রাসের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে।

রাষ্ট্রকে মানবিক সংবেদনশীল রাখতে হলে সমাজকে দাঁড় করাতে হবে অর্ধনারীশ্বরের ধারণার উপর। ওখানে সমাধান নেই- ব্যক্তি যদি সমবায়ী না হয়, ব্যক্তির সাফল্য কখনও উত্তীর্ণ নয় যতক্ষণ পর্যন্ত না তা অন্যকে গৌরবান্বিত করে।

পুঁজিবাদ সামাজিক মনস্তত্ত্বে  আর কোন নোতুন সৃজনশীলতা যোগ করতে পারছে না, বরং সর্বগ্রাসী মুনাফাবাদী টেকনোলজি আর ভয়াল করপোরেট পুঁজির কাছে গোটা মানুষ ও তার জীবনকে প্রতিবিন্দুতে লগ্নি করে ফেলছে, মানুষ হয়ে পড়ছে ক্রীতদাসের অধিক তস্যক্রীতদাস। তাই ভাষা এখন অভিব্যক্তির বদলে কিছু ডাটার লেনদেন মাত্র; আমরা এ-ও প্রত্যক্ষ করেছি একচ্ছত্র পার্টিজান সমাজতন্ত্র কিংবা পারিবারিক সোস্যালইজম চিত্তের স্ফূরণের বদলে এক আতঙ্কের কারখানা বানায়।

ফলে বাঙলার কাছে যাই- ভাষা ও ব্যক্তির মুক্তি দেখি ভাববাদী চিত্তের সঙ্গে এক যুক্তিবাদী সমাজের সম্মিলনের ভিতর- আর প্রাণ খুলে মেলতে পারি মনসুন্দর কথা।।