You are currently viewing আমিনুল ইসলামের কবিতা : দিগন্তের মতো বিস্তৃত

আমিনুল ইসলামের কবিতা : দিগন্তের মতো বিস্তৃত

আমিনুল ইসলামের কবিতা : দিগন্তের মতো বিস্তৃত

এলিজা খাতুন

মানবসভ্যতার মতোই কবিতা বহমান। কবিতার নিজস্ব গতিপথ ও গতিবৈচিত্র্য আছে। তা আবার পরিবর্তনশীল। সময় ও প্রেক্ষাপটের কারণে বাঁক নেয় কবিতা। ধরা পড়ে কবির কাব্যভাবনার বৈশিষ্ট্য, ভিন্ন ভিন্ন কবির ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশভঙ্গি। ব্যক্তির স্বাধিকারবোধ বিকাশের শর্ত মেনে নিয়ে যে-কোনো সমাজের কবিতা যদি সেই সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর চেতনার প্রতিনিধিত্ব করে, তাহলে সাধারণত সেই কবিতার আবেদন দীর্ঘস্থায়ী হয়। 

 

কোনো জাতির আত্মবিকাশের ক্ষেত্রে দিকনির্দেশনা দানে ভূমিকা রাখা কবিতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ  ধর্ম; আমরা তা জানতে পারি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কবিতার ইতিহাস থেকে। মানুষের জীবনের, মনের, মননের, সমাজের, রাষ্ট্রের, পৃথিবীর রূপ ও রূপান্তরের ইতিহাস মানোত্তীর্ণ কবিতার শিল্পশরীরে ধরা পড়ে; এ কথা কবিতা-অঙ্গনে চিরন্তন একটি সত্য। একটি আয়ুর ভেতর সময়ের ভাঁজে ভাঁজে শরীর ও মনের অজস্র পরিবর্তন ঘটে; তেমনই বোধের রকমফের ও বিবর্তনের সাথে সাথে কবিতার প্রকৃতি বিচিত্র রূপ লাভ করে। একথা মনে রেখে বলা যায়, পৃথিবীর বিস্তৃত ভৌগোলিক প্রেক্ষাপট  স্থান করে নিয়েছে আমিনুল ইসলামের  কবিতায়। তাঁর দূরকে নিকট করে তোলার ভাষাসমূহ স্বতঃস্ফূর্ত, স্বাভাবিক ও প্রাঞ্জল। স্বদেশের রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস, নৃতত্ব, মনস্তত্ত্ব, স্বদেশের নদনদী, মাঠঘাট, গ্রামীণ জীবন ইত্যাদি প্রাচূর্য নিয়ে যুক্ত আছে তাঁর বহু কবিতার পরতে ও প্রাণে। স্বজাতির শেকড়-অন্বেষা তাঁর কবিতায় ফুটে ওঠে অনেকসময়।

সত্তার গভীরে বারুদের গন্ধে টের পাই

আমার শেকড়-সংশ্লিষ্টতায় যে মাটিজল,

তা কোনো এক উত্তাল অতীতে পুড়েছিল

পোড়ামাটি-নীতির লোভী বর্বর অনলে

(শেকড় ছুঁয়ে )

আমিনুল ইসলামের কবিতার বিষয় ও প্রকরণের অনন্যতা নিয়ে এখন পর্যন্ত অনেক গুণী কাব্যসমালোচক আলোচনা করেছেন। সে সম্পর্কে নতুন করে না বললেও চলে। তবু সংক্ষেপে বলা যায়– তাঁর কবিতায় সংমিশ্রিত হয়ে উঠে এসেছে সীমারেখাহীন ভূগোল, মিথ ও ইতিহাস। বিষয়ভাবনার প্রতীকীকরণে, চিত্রকল্প নির্মাণের অভিনবত্বে, উপস্থাপনার কৌশলে, বাস্তবকে আড়াল করতে কল্পচিত্র অঙ্কনে  আমিনুল ইসলাম মিশিয়ে দেন কবিতার অজস্র নতুন উপাদান ও উপকরণ। তাঁর কবিতায় প্রাকৃতিক, ভৌগোলিক, পৌরাণিক, সাম্প্রতিক প্রযুক্তিগত নানা অনুষঙ্গ আছে। অসংখ্য কবিতায়  চেনাজানা ভাষাকে এবং জেনাজানা বিষয়কে নতুন রূপ ও ভাষা দিয়ে জমিয়ে তুলেছেন তিনি। ভাবনা ও ভাষা উভয় বিচারেই আমিনুল ইসলামের কবিতা সাবলীল ও স্বতঃস্ফুর্ত । 

কবিতা হয়ে ওঠার  ন্যূনতম যতগুলো কারণ থাকতে হয়,  সেসবের মধ্যে একটি হচ্ছে কাব্যভাষার ও শব্দের  স্বতঃস্ফূর্ততা। আমিনুল ইসলামের কাব্যভাবনার মধ্যে আছে নানা অনুষঙ্গ; আছে অজস্র অভিনব উপমা এবং বিশ্বপ্রকৃতির নানাবিধ নতুন দিগন্ত। বিশ্বপ্রকৃতিকে তিনি অনেকখানি নতুন চোখে  নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে  অবলোকন করেন।  ষড়ঋতুর বৈচিত্র্য, নদ-নদী, অরণ্য, পাহাড়, সমুদ্র. পৌরাণিক চরিত্র, ঐতিহাসিক স্থান ও চরিত্র, আকাশের চন্দ্র, তারা, দিগন্ত, নীলিমা প্রভৃতি নতুন অর্থব্যঞ্জনায় ও  অভিনব শিল্পসৌন্দর্যে অনায়াসে উঠে আসে তাঁর কবিতায়। 

কবিতায় শব্দ ব্যবহারে , ছন্দ ব্যবহারে, জটিল ও সহজবোধ্যতার সংমিশ্রণে, চিত্রকল্প-উপমা-অলঙ্কারের সুসজ্জায় আমিনুল ইসলাম স্বাধীন থাকেন, এটা তাঁর অধিকাংশ কবিতায় পরিলক্ষিত হয়। যদিও কিছু অযথা শব্দের ভিড় ধরা দিয়েছে তাঁর কতিপয় কবিতায়, মনে হয়– কিছু কিছু শব্দ বাদ দিলেই সেসব কবিতার স্মার্টনেস নিশ্চিত হতো, তবে সেসবও  উপেক্ষণীয় হয়ে পড়ে কবিতার স্বরের সৌগন্ধ্যে। 

তিনি জনপদে ও পথে-প্রান্তরে  ছড়িয়ে থাকা প্রেমের রূপ  ও প্রকৃতিকে তুলে আনেন কবিতায়– বহুমাত্রিক সমাবেশে, সেখানে প্রেম ও প্রকৃতি একাকার হয়ে ওঠে। সবকিছু মিলিয়ে তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে একধরনের নুতন সৃষ্টি।

 

 

 

 

হতাশ শ্যামার চোখে ফিলিস্তিনের মতো স্বপ্ন পুড়ে যায়;

অথচ আষাঢ় আনে অঙ্কুর উৎসব!

বিস্মিত রাখাল ভাবে মুগ্ধ-দোটানায়: বীজ না মাটি?

উন্মুক্ত বাজারঘাট, নগরের তপ্ত কোলাহলে

ছায়াকামী চোখ গেলে আপন অন্তরে-

প্রশ্ন জাগে সদৃশ বিস্ময়ে:

আড়ালে তোমার বাঁচা কোন গূঢ় জলে?

(বীজ না মাটি)

শীতলপাটির গাঁথুনির মতো সুসজ্জিত সুনির্মিত কবি আমিনুল ইসলামের কবিতার বুনট। তাঁর কবিতায় অভিনব চিত্রকল্পের শৈল্পিক উপস্থিতি কবিতাকে পাঠকের মনে স্মরণীয় করে রাখার ঐশ্বর্য দান করে । ভাবনায়, আশায় ও বিশ্বাসে মানুষের দ্বৈত সত্তার মনস্তাত্ত্বিক অনুষঙ্গ সুচারুরূপে প্রস্ফুটিত তাঁর কবিতায়। তাঁর কবিতায় একদিকে ভাষার শিল্পমন্ডিত সজীবতা- যেখানে প্রেম ও ঐতিহ্যসন্ধান নিহিত, অন্যদিকে শুদ্ধ মননের সময়োপযোগী তাড়নায় সমাজ-রাষ্ট্রের না-বোধক অনুষঙ্গমূহের শৈল্পিক উপস্থাপন। প্রকৃতি ও যান্ত্রিকতা, প্রেম ও প্রতিবাদ সমবেত সৌন্দর্যে রোপিত হয়েছে তাঁর কবিতার জমিতে। আবার তাঁর কবিতায় শোভনীয় রোমান্টিকতা এবং রূঢ় বাস্তবতার বিস্ময়কর সহাবস্থান লক্ষ করা যায়। আমিনুল ইসলামের কবিতা দুর্বোধ্য নয়, ব্যঞ্জনাময়— পাঠান্তে পাঠকের কাব্যতৃষ্ণাকে গভীরভাবে জাগিয়ে তুলতে সক্ষম।  

তবুও তো প্রতিদিন প্রভাতের সূর্য এসে 

চুমু খায়-

দূষণের ছোঁয়া লাগা বৃক্ষের অধরে;

মাঝরাতে চুমু দিয়ে ছদ্মবেশী ডেভিডের গালে

অভিচারে হেসে ওঠে

জাতিসংঘের চূড়ায় আসীন আণবিক লোভ

(নিষেধাজ্ঞার মুখে )

সময়ের সাথে পরিবর্তনকে  ও  পরিস্থিতিকে মননে বেঁধে লেখকগণ মানবিক পৃথিবীর পক্ষাবলম্বন করবেন, এটাই প্রত্যাশিত। সামাজিক বিশ্লেষণে আত্মজিজ্ঞাসা ও আত্ম-আবিষ্কারের মাধ্যমে অনেক কবি জীবনের নতুন সত্য অনুধাবনে সমর্থ হয়েছেন। একজন শক্তিমান কবির কবিতায়  সাম্যবোধ, প্রেম, ধর্মনিরপেক্ষতা, উন্নত জীবনদৃষ্টি,  অধিকার অর্জনের প্রশ্নে আত্মপ্রকাশ, রাজনৈতিক মতভেদ, গণতন্ত্র মনস্কতা  প্রভৃতি কবিতার  গন্তব্যে ও বক্তব্যে  শিল্পিত অভিব্যক্তি  পায়। কবির বোধ-ব্যক্তিত্ব ও মানসগঠনকে পরিপুষ্ট  করে  তোলে রাজনীতি-সচেতনতা, যার পরিবর্তনশীল-প্রতিফলন ঘটে সময়ের সমান্তরালে কবিতার বাঁকে বাঁকে। আমিনুলের কবিতাতেও এসব চোখে পড়ে। 

এখানে রক্তের দাগ- ওখানে টাটকা খুলি

বামে বাঘের থাবা- ডানে কুমিরের দাঁত

————————————

এ এক অদ্ভুত জঙ্গল- বাঘ ভালুক হরিণ

হায়েনা–আদিম বন্যতার সবকিছু আছে

কিন্তু নেই কোনো নদী, নেই কোনো ছায়া 

(অদ্ভুত জঙ্গল )

অঞ্চল বিশেষে কবিতার গ্রহণযোগ্যতা ব্যাপারটি নিরর্থক নয়। উপকূলীয় দুর্গম ভূমি বা প্রত্যন্ত এলাকার মানুষ, পাখি, অন্যান্য প্রাণীর জীবন যাপন এবং সমতলের শহরের মানুষ, পাখি ও জীবজন্তুর জীবন যাপনে তারতম্য আছে। অনুরূপভাবে পরিবেশ-পরিস্থিতি, জীবন যাপনের প্রকৃতি, ভাষা-সংস্কৃতি এসবকিছুই স্বাভাবিক প্রভাব রাখে কবিতার সৃষ্টিশৈলীতে, স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আনে কবিতার ভাবে ও চরিত্রে। আসলে প্রত্যেক কবির যাপন-ব্যবস্থার পটভূমিতে তাঁদের জীবনবোধ ও লিখনশৈলী হয়ে ওঠে ভিন্ন আঙ্গীকের, ভিন্ন ভিন্ন স্বরের। আমিনুল ইসলামের কবিতার অনুষঙ্গ যেমন বৈচিত্র্যের দ্যুতিবেষ্টিত, তেমনি তাঁর কবিতায় এক  পরম্পরার আস্বাদ নিহিত। তিনি কোনো অলৌকিক সুরাহার ফুলঝুরিতে আস্থা রাখেন না । রক্তমাংস ভেদ করে হাড়ের কাঠামো পর্যন্ত আলো ফেলে দেখতেই স্বস্তি তাঁর। তিনি বিচিত্র জগৎসংসারের বিদগ্ধ জীবনযাপনে যুক্তি-সংযোগে বিরহকে মধুর করে তুলেছেন। সেই দৃষ্টান্ত মেলে তাঁর ‘প্রণয়ী নদীর কাছে’ কাব্যগ্রন্থের ‘বিজয়সেনের রাজধানী এবং ভালোবাসার রাজকন্যা’ কবিতায় । সে কবিতা থেকে প্রেম ও প্রকৃতির, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের, অতীত ও বর্তমানের বৈচিত্র্যময় সংশ্লেষের এক অভিনব নিতে পারি:-

শরতের রোগা সকালটা মাতোয়ারা ঘ্রাণে- কাঁচাধানের সবুজ গন্ধ;

তার সঙ্গে দ্রবীভূত তোমার উষ্ণতার নিকোটিন; দুপাশে সারিবদ্ধ 

গাছ, ধানক্ষেত, ওপরে সাদা-কালো আকাশ‘মোগলে আজম’-

এর দর্শক সবাই, সবার চোখে সেলিমের চোখ, আনারকলি অধর; 

সম্রাট আকবর পরাজিত সবখানি পথসারাটা সময়। গাড়ির 

জানালা ফুঁড়ে তোমার আমার নিঃশ্বাস পদ্মা-যমুনার সম্মিলিত 

স্রোত হয়ে মিশে যায় ইলামিত্রের এমবোস স্কেচ আঁকা ভূগোলে। 

অথচ আমি জড়িয়ে ধরিনি বাহু, চুমু দিইনি ইচ্ছুক অধরে! আমাকে 

টানছিল মঞ্চ; আমাকে টানছিল সংবর্ধনা; আমাকে টানছিল সময়!

(বিজয়সেনের রাজধানী এবং ভালোবাসার রাজকন্যা) 

কবিতার ভুবনে যুগে যুগে তত্ত্ব, নান্দনিকতা, দর্শন, আঙ্গিক ইত্যাদি বদলেছে।  কবিতার আলোচনায় মনের দরজায় এসে  যায় বিষয়বস্তু, উদ্দেশ্য,  আদর্শগত তত্ত্ব,  শব্দ, ভাষা, চিন্তা, সৌন্দর্য, প্রকাশরীতি ইত্যাদি। আমিনুল ইসলামের কবিতা এইসব অনুষঙ্গকে তাড়িত করে। তাঁর কবিতার বিষয় ও শেলী উভয়ই পাঠকের ভাবনাকে নাড়িয়ে দেবার ক্ষমতা নিয়ে হাজির হয়। কখনো স্যাটায়ার, কখনো নাটকীয়তা, কখনো-বা প্রতীকায়িত চিত্রকল্প, আবার কখনো প্রচলিত মিথের বিপরীত ব্যবহার তাঁর কবিতাকে ভরে তোলে নতুন স্বাদে। স্যাটায়ার ও পরিহাস তাঁর কবিতাকে একইসঙ্গে অর্থসমৃদ্ধ ও উপভোগ্য করে তোলে।  

আহা কী সুখ, দার্শনিক অনিদ্রায় রাত জেগে কষ্টকল্পনার

কষ্ট থাকছে না আর! এ সুযোগে শামুকের কাছে প্রাইভেট

পড়ে শিখে নিচ্ছি- গুটিয়ে নেওয়ার পাঠ;

কেননা, যেমন খাপটি- তেমনটি তলোয়ার! 

(কুয়ায়ন)

মানুষ মাত্রেই প্রশান্তির আশ্রয় চায়। তাই চায় প্রেম, চায় গভীর বন্ধুত্ব। হৃদয়ের প্রশান্তি অনুসন্ধানের মধ্য দিয়েই কবিতায় কাব্যিকতা ও আধুনিকতা সুসজ্জিত রেখে পুনর্জাগরণের কথামালা আমিনুল ইসলামের কবিতায়। সেখানে প্রেম ও মনস্তাত্ত্বিক উজ্জ্বলতা বৃষ্টিধারার মতো শীতল করে দেয় তপ্ত অনুভূতিকে– সুস্থির করে তোলে বিপন্ন ধুলো ওড়া মুহূর্তকে। বৈচিত্র্যময়তার অনায়াস উপস্থিতি  আমিনুল ইসলাম এর কবিতায়। কবি এক জায়গায় বলছেন-

উৎসাহিত আমি, – মুগ্ধডানা মৌমাছি হই-

হাতের কাছেই নন্দনকানন- গন্ধমফলের ঘ্রাণ… 

(অনুরাগের জানালা )

তিনিই আবার আর্ত প্রেমভাবনার অভিনব প্রকাশ ঘটিয়ে আবার অন্যখানে বলছেন- 

হে বিধাতার অদ্ভুত উপন্যাসের নায়িকা,

কারখানার দুর্গন্ধশাসিত ফ্ল্যাটে শুয়ে

তুমি কি কারো-

হৃদয়ক্ষরণের কোনো ঘ্রাণ পাও? পাও?

( প্রেম অথবা চাপা-পড়া উপন্যাস)

আমিনুল ইসলামের কাব্যভাবনায় প্রকৃতি ও জীবনের মেলবন্ধনের ছবি বিস্তৃত, যেখানে সমৃদ্ধ পটভূমি অকৃপণ উদারতায় পাঠকের চিন্তার খোরাক জোগায়, পাঠককে নিয়ে যায় সেই সমস্ত স্থানে, সেই সময়ের  তীরে । তিনি মনের গভীরে পুষে রাখেন জীবনের নানা রং ছুঁয়ে দেখবার আকাঙ্ক্ষা। এবং সেইসাথে নিজের দেখাটুকুও পাইয়ে দিতে চান বা  গেঁথে দিতে চান সমাজের-সংসারের-জীবনের দেয়ালে। যেখানে প্রেম ও প্রতিবাদ, প্রার্থনা ও পরিহাস, অফিস ও আঙিনা,  অঞ্চল ও আন্তর্জাতিকতা সংশ্লেষিত হয়ে যায় এযাবত অদেখা একাকারে।

আর নক্ষত্রের বর্ণমালায় রচিত পাণ্ডুলিপিখানি

যার শুরুর ও শেষের পাতাগুলো ছেঁড়া, সংরক্ষিত

নীল আর্কাইভে যেখানে পৌঁছাতে পারে না, এমনকি

থোক বরাদ্দে কিংবা ইউনেস্কোর যৌথ অথায়নে গৃহীত

সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন প্রকল্প। 

(প্রেম অথবা চাপা-পড়া উপন্যাস )

আমিনুল ইসলাম শব্দের অভিনব ব্যবহারে এক সুদক্ষ শিল্পী। তিনি অনায়াস সাবলীলতায় ব্যবহার করেন নতুন ও পুরাতন শব্দ, অফিসিয়াল পরিভাষা ও প্রযুক্তিগত নতুন টার্মিনলজি, দেশি ও বিদেশি শব্দ। শব্দ সংযোজনায় যেমন তাঁর স্বকীয়তা, কবিতার গভীরে তেমনি শিল্পবোধের সোনালি স্মারক । তাঁর কবিতায় প্রবাহিত ভালোবাসার ফল্গুধারা এবং প্রজ্জ্বলিত জীবনবোধের গভীর দীপ্তি । 

আজ কোথাও কোনো আদালত নেই;

নিরুপায় আমি বিকল্প হাওয়ায় আমার তপ্ত অশ্রুকে জলীয়

বাষ্পের বর্ণমালা বানিয়ে লিখে দিই

ঘোলাটে আকাশের খাতায়

তারা সময়ে অসময়ে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে তোমার 

পূর্ণতার আঙিনায়, আবাদি ভূগোলে; 

(আমার যত উজ্জ্বল ব্যর্থতা )

আমিনুল ইসলামের কোনো কোনো কবিতায় মানবিক আবেদনে উঠে এসেছে সাধারণ মানুষের জীবন সংগ্রামের প্রতি অপার সহানুভূতি। তিনি কোনো স্বার্থসর্বস্ব আত্মকেন্দ্রিক কবি নন। শিল্পের ধর্ম অক্ষুণ্ন রেখেই তিনি বৃহত্তর সমাজ ও মানবজাতির প্রতি দায়বোধ পোষণ করেন। সমাজে , রাষ্ট্রে ও পৃথিবীতে মানবসৃষ্ট ব্যাধি দেখে উৎকণ্ঠিত হন তিনি এবং একইসঙ্গে সোচ্চার হয়ে ওঠেন প্রতিবাদে। 

দ্যাখো দূরে- মধ্যপ্রাচ্যে-আফ্রিকায়

দ্যাখো কাছে- দুপাশের পড়শি ভূগোলে

ভেসে যায় প্রেম!

ভেসে যায় অহিংসা!

ভেসে যায় শান্তি !

ভেসে যায় ন্যায়বিচার !

বানে ভেসে যাওয়া শস্যের  উপমা এর চেয়ে ভালো

আর কোথায় পাবে?

(প্রাচ্যের অসুখ)

আমিনুল ইসলামের অসংখ্য কবিতার গায়ে ইতিহাস ও পৌরাণিক চিত্র লেগে আছে , নদীর কিনারে ঢেউয়ের দাগ লেগে থাকার মতোন। তিনি ইতিহাস, ঐতিহ্য, মিথ ইত্যাদির ব্যবহার করেন অতীতের সাথে বর্তমানের যোগসূত্র স্থাপনে এবং ভেদাভেদহীন পৃথিবী রচনার স্বপ্নে মানবজাতির অভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্পর্কসূত্রটি পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। 

আমি কিন্তু মোটেও নতুন কোনো আগন্তুক নই,

আমি আসছি সেই তখন থেকেই,

যখন চাঁদ সওদাগরের সপ্তডিঙা মধুকর এসে ভিড়তো

ভেনাসের ঘাটে আর রোমান জাহাজগুলো 

করতোয়ার ঘাটে গিয়ে

বোঝাই করতো অগ্রগামী প্রভাতের আলো 

(অভিবাসী চিরদিন )

আমিনুল ইসলামের কবিতা প্রাণবন্ত ও গতিময়। নিজস্ব জীবনবোধ ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গতিশীল ভুবনের পরম সত্যকে উপলব্ধি ও প্রকাশ করেন তিনি। সামাজিক পরিবর্তন ও সভ্যতার বিবর্তনের দিকে তাঁর কবিতার দৃষ্টি জাগ্রত। আবার শব্দের অভিনব, কুশলী ও কৌশলী ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত তিনি। তিনি অনায়াসেই প্রেম ও প্রতিবাদ, সামাজিক ভাঙন ও রাষ্ট্রীয় মূল্যবোধের অবক্ষয়কে অভিনব উপমা ও অভূতপূর্ব চিত্রকল্প সহযোগে সমৃদ্ধ কবিতা করে তুলতে পারেন। ইচ্ছা ও অধ্যাবসায় বলে এই ক্ষমতার অধিকার লাভ করেছেন বলেই আমিনুল ইসলামের কলমে এমন বাক্যস্ফুরণ ঘটেছে-

অথচ অনড় তুমি- লেলিয়ে রেখেছা

রাতের জানালা আর দিনের দুয়ারে

আঁধারের রংমাখা একগুঁয়ে কতিপয় নিষেধের র‌্যাব! 

(নিষেধাজ্ঞার মুখে )

শপথে কবুল হও- ভেঙে ফেলো আগের শপথ

মিডিয়ায় চোখ রেখে শিখে নাও বিজ্ঞাপনি কলা

প্রয়োজনে পায়ে ধরো-  প্রয়োজনে টিপে ধরো গলা

তোমার ভোগের রাতে তুচ্ছ করো আলোর পর্বত।

(সভ্যতার সংঘর্ষ )

মানুষ মাত্রই প্রশান্তির আশ্রয় চায়। পারিবারিকভাবে, সামাজিকভাবে ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সেই প্রশান্তির আশ্রয় রচনার দায়িত্ব ও ক্ষমতা রাষ্ট্র ও সম্মিলিত জনমানুষের। কবির একার পক্ষে সেখানে কোনো সফল ভূমিকা পালনের সুযোগ নেই, সেই সামর্থ্যও নেই। কিন্তু তাই বলে থেমে থাকেন না কোনো সত্যিকারের কবি। যান্ত্রিক জগৎ, বিকারগ্রস্ত মন, হীন-হৃদয়ের চালচিত্র দেখে ক্ষুব্ধ ও বিদগ্ধ কবি একা একা খুঁজে বেড়ান শান্তি ও স্বস্তির ছায়াঘন সুনিবিড় আশ্রয়ের ঠিকানা। তিনি হৃদয়ের প্রশান্তি অনুসন্ধানের মধ্য দিয়েই কবিতায় শুভবোধ ও আধুনিকতাকে সুসজ্জিত করেন অনন্য শব্দচিত্রে। কবি বিশেষে সেই সৃষ্টি প্রাতিস্বিকতায় আলাদা ও অনন্য হয়ে ওঠে। আমিনুল ইসলাম তেমনি এক কবি যিনি নিজস্বতায় অনন্য। অভিবাদন ও শুভ কামনা কবির জন্য। 

******************************

আমিনুল ইসলাম : কবি ও নজরুল-গবেষক

প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ: 

(ক) কবিতাগ্রন্থ

তন্ত্র থেকে দূরে-(২০০২); মহানন্দা এক সোনালি নদীর নাম-(২০০৪);  শেষ হেমন্তের জোছনা –(২০০৮);  কুয়াশার বর্ণমালা (২০০৯);  পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি-(২০১০); স্বপ্নের হালখাতা –(২০১১); প্রেমসমগ্র-(২০১১); . জলচিঠি নীলস্বপ্নের দুয়ার-(২০১২); শরতের ট্রেন শ্রাবণের লাগেজ-(২০১৩); কবিতাসমগ্র-(২০১৩);  জোছনার রাত বেদনার বেহালা : (২০১৪) ; তোমার ভালোবাসা আমার সেভিংস অ্যাকউন্ট ( ২০১৫)  প্রণয়ী নদীর কাছে (২০১৬), ভালোবাসার ভূগোলে(২০১৭); নির্বাচিত কবিতা ( ২০১৭);  অভিবাসী ভালোবাসা ( ২০১৮) , জলের অক্ষরে লেখা প্রেমপত্র (২০১৯) ( বাছাই কবিতা ( ২০১৯), প্রেমিকার জন্য সার-সংক্ষেপ ( ২০২০), হিজলের সার্কিট; রমনার কোকিল( ২০২২); মহানন্দা থেকে মধুমতী(২০২৩)।

(খ) ছড়ার বই

১.দাদুর বাড়ি-(২০০৮); ২. ফাগুন এলো শহরে-(২০১২) ৩. রেলের গাড়ি লিচুর দেশ (২০১৫)।

 (গ) প্রবন্ধগ্রন্থ:  

বিশ্বায়ন বাংলা কবিতা ও অন্যান্য প্রবন্ধ-(২০১০);

নির্বাচিত প্রবন্ধ(২০২৩)।

(ঘ) গবেষণাগ্রন্থ: নজরুলসংগীত: বাণীর বৈভব (২০২১) [বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত] ।

==========================

এলিজা খাতুনঃ কবি, গল্পকার ও প্রাবন্ধিক

************************************