আমার শাহিদ আনোয়ার
আলী সিদ্দিকী
শাহিদ আর আমার জীবনের সুদীর্ঘ সময়ের পথচলার ইতিবৃত্ত সংক্ষেপে বিবৃত করা দুষ্কর। ’আমার শাহিদ আনোয়ার’ স্মৃতিকথা রচনার কাজে হাত দিয়েছি কিছুদিন হলো যার প্রেক্ষাপট অনেক বিস্তৃত। এখানে তার সংক্ষিপ্ত কিছু অংশ তুলে ধরা হলো।
যাত্রা শুরু যেভাবে
১৯৮২ সালের মার্চের দিকে শাহিদ আনোয়ারের সাথে আমার পরিচয় হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে। গিয়েছিলাম দুইটি পাঠ্যবই ইস্যু করাতে কিন্তু একটির বেশি দেয়া হচ্ছে না। অথচ আমার দুইটি বইই দরকার। শাহিদ হঠাৎ সামনে এসে পরিচয় দিয়ে বললো, আমি শাহিদ আনোয়ার। তারপর জানতে চাইলো কি হয়েছে। বলার পর সে আমাকে সাথে নিয়ে লাইব্রেরিয়ানের কক্ষে নিয়ে গেলো। যেতে যেতে জানালো লাইব্রেরিয়ান তার আত্মীয় এবং আমাকে বই দুইটি ইস্যু করিয়ে দিলো। লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে আমরা পুরনো ক্যাফেটেরিয়াতে এসে বসলাম। অতিদ্রুত জড়তা কাটিয়ে লেখালেখির আলোচনায় ঢুকে গেলাম। একটু পরে শাহিদের পরিচিত ঢালী আল মামুন এসে আমাদের আড্ডায় যোগ দিলেন। তিনি ফাইন আর্টসের ছাত্র। আমাদের আড্ডা ক্রমশঃ জমজমাট সাহিত্য আড্ডায় পরিণত হয়। বিশেষতঃ প্রগতিশীল চিন্তাবিদ ও লেখকশিল্পীদের কর্মকান্ড নিয়ে ঢালী আল মামুন অনেক ধারণা শেয়ার করেন। পরবর্তীতে আমরা তিনজন প্রায়শঃই দলবেঁধে ক্যাম্পাসে, জোবরা ক্রসিংয়ের আড্ডায় এবং নগরের শিল্পকলা একাডেমিতে যাতায়াত শুরু করি। মামুন ভাই আমাদের সিনিয়র হলেও বন্ধু হয়ে উঠতে সময় লাগেনি। পড়ুয়া মামুন ভাইয়ের বহুমুখী পাঠ্যাভ্যাসের প্রভাব আমাদের উপরও পড়ে।
শাটল টু ক্যাম্পাস, শাটল টু বটতলী
আমার হইহুল্লোড়ের সাথী ছিলো ম্যানেজমেন্টের বন্ধু রফিকুজ্জামান রুশো। রুশো আর আমি কৈশোর থেকে বন্ধু। যদিও হাইস্কুল আর কলেজ ছিলো দু’জনের ভিন্ন কিন্তু যোগাযোগ কখনোই বিচ্ছিন্ন হয় নি। রুশো নয়াবাজার থেকে হেঁটে আমাদের পানিরকলের বাড়িতে চলে আসতো। তারপর দু’জনে রিক্সা নিয়ে কদমতলী রেলক্রসিং এবং রেললাইন ধরে স্টেশন। এটাই আমাদের ডেইলি রুটিন। শাহিদের সাথে যেদিন রুশোর পরিচয় করিয়ে দেই সেদিন রুশো ঠোঁটের ফাঁকে হেসেছিলো, তুই লেখক হয়ে গেলি। রুশো আমাদের শাটল গ্রুপ–পূর্ব মাদারবাড়ির সাইফুল গণি চৌধুরি, আলো, নয়ন আর মিহিরের-সাথে আগের মতোই বসে। ভর্তির দিন থেকেই আমিও এই হইহুল্লোড় গ্রুপে যথারীতি হুল্লোড়ে ছিলাম। এই প্রথম গ্রুপ ছেড়ে শাহিদের সাথে একা হলাম, শাহিদও হলো তার পুরনো গ্রুপ থেকে আলাদা।
আমি আর শাহিদ বটতলী থেকেই শাটলে উঠি। রুশোর সাথে এলেও ছাড়ার মুহূর্তে ছুটে অন্য সিটে গিয়ে বসি আমি অর শাহিদ। ঝাউতলা স্টেশন থেকে মামুন ভাই উঠতেন আর ক্যান্টনমেন্ট থেকে রিজুয়ান আর আরজু। একসময় আমি সলিমুল্লাহ খানের সাথে প্রাক্সিস জার্নাল-এ যুক্ত হই। বন্ধু রিজুয়ান খান, ইকবাল করিম হাসনু, পারভেজ কায়সার এবং আমি পাঠচক্র পরিচালনা ও প্রকাশনার কাজ করছি চবিতে। শাহিদ শুনে আগ্রহ প্রকাশ করলো। দুয়েকটা বৈঠকে হাজির হলেও খুব একটা সম্পৃক্ত হতে চায় না। আমি প্রাক্সিস থেকে সরে গেলে রিজুয়ানের সাথে দেখা সাক্ষাত ধীরে ধীরে কমে গেলো। ক্রমশঃ আমাদের গল্পের চরিত্র পাল্টে যেতে থাকে, বিষয় আশয় বদলে যেতে থাকে। কবিতা আর গানে নতুন আবহ তৈরি হয়ে যায়। অন্যভাবের, অন্যধাঁচের যাত্রাপথে যুক্ত হয় অনেকেই। সবার মাঝে থেকেও শাহিদ আমি কেমন যেন আলাদা ভুবনের বাসিন্দা হয়ে উঠি, খুবই দ্রুত। সকালের ক্লাশ ধরার তাড়া থাকলেও ফেরার সময় অফুরন্ত সময়। ক্যাম্পাস থেকে বাসে জোবরা ক্রসিংয়ে এসে শুধু আড্ডা, আড্ডা, আড্ডা। গল্প গুজব, পড়া আর আবৃত্তি। হাংরি জেনারেশন থেকে পঞ্চপান্ডবের কাহিনী, বিভূতি থেকে মানিক, শক্তি- শঙ্খ-সুভাষ-সুকান্ত, সমরেশ মজুমদার থেকে বিনয় ঘোষ, এপার বাংলার সোমেন চন্দ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শওকত আলী। অন্তহীন আলোচনা, পাঠ বিনিময়। প্রায়শঃ আমাদের আড্ডার মধ্যমণি হিসেবে থাকতেন ঢালী আল মামুন। আমরা ক্রমশঃ সোভিয়েত বিপ্লব এবং তার অবিসংবাদী নেতা লেনিন ও মার্কস-এঙ্গেলস রচনাবলী, রাশান সাহিত্য প্রভৃতি ক্রমশঃ পাঠতালিকায় ঢুকে যাই। শাটল থেকে বটতলীতে নেমে প্রায়শঃ আমেল ভাই কিংবা বড়ুয়া বাবুর রেলওয়ে বুক স্টল নয়তো সোজা জলসা সিনেমা সংলগ্ন কারেন্ট বুক সেন্টারে গিয়ে হাজির হতাম। নতুন যা পেতাম তাই নিয়ে নিতাম। বিশেষ করে লিটল ম্যাগাজিন। তারপর সোজা শ্যামাচরণ কবিরাজ ভবনের দোতলার দক্ষিণ ও পশ্চিমের জানালাওলা বারান্দা সংলগ্ন ঘরে। দূপুরের পরে আসলে চাচী কোনোদিনই আমাকে না খাইয়ে ছাড়তেন না। আমার খুব সংকোচ হতো। শাহিদকে অনুযোগ করতাম, এভাবে এসে জ্বালাতন করাটা অন্যায়।
আম্মা তোমাকে লাইক করে, প্রাণখোলা হাসে শাহিদ।
আমার লজ্জা করে, আমি যুক্তি দাঁড় করাই, ছোট ভাইবোনগুলো কি মনে করে বলো তো!
ওরা তোমাকে পছন্দ করে, শাহিদের সে-ই মনকাড়া হাসি।
হিটু তখন মুসলিম হাইতে, মাঈনু কলেজে, জাফরিন ভার্সিটিতে, জেসমিন ফাইন আর্টসে। সবাইকে একসাথে খুব একটা পাওয়া হয় না। হিটু, মাঈনু আর জাফরিনের সাথে মাঝেমধ্যে দেখা হলেও জেসমিন আর চাচা ডাঃ ফয়েজুল ইসলামের সাথে খুব কমই দেখা হয়েছে কবিরাজ ভবনে। পূর্ব মাদারবাড়ীতে মিছিল করার সময় দেখতাম ডাক্তার চাচা গম্ভীর মুখে বসে শীতল চোখে আমাকে দেখছেন। আমার সবচেয়ে বেশী দেখা হতো ছোটভাই হিটুর সাথে। সে ক্রিকেট খেলতো। দেখা হলেই বলতাম, আমাদের ইমরান খান। হিটুর ছিলো মনকাড়া হাসি।
শহর চট্টগ্রামঃ পাঁজরে গেঁথে যাওয়া ধ্বনি
শাহিদ আমাকে ফুলকিতে যুক্ত হতে বলে। ফুলকি সম্পর্কে আমার তেমন ধারণা ছিলো না। একদিন আমি আর শাহিদ ফুলকিতে যাই দুপুরবেলায়। ঝাঁঁকড়াচুলো অচিন্ত্যদা, ওমর কায়সার, বিশ্বজিৎ চৌধুরী, ইব্রাহিম আজাদ, মাঈনুল হাসান, জ্যোতির্ময় নন্দী ও অজয় দাশগুপ্তের সাথে পরিচয় হলো। সবাই লেখালেখির মানুষ। ভালো লাগলো। ক্রমশঃই আমি ফুলকিমুখী হয়ে উঠি। বোস ব্রাদার্স আর ফুলকি হয়ে ওঠে আমাদের সান্ধ্যকালীন আড্ডার প্রাণকেন্দ্র। তখন দৈনিক আজাদী আর নয়াবাংলায় আমার ছড়া গল্প ছাপা হচ্ছে। লেখালেখির পাশাপাশি পঠন-পাঠনও করছি দেদার। পুরনো ডায়েরীতে দেখলাম যে, ”অচিরা”প্রকাশের সিদ্ধান্তের দিন আবুল মোমেন ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় হয়। ডায়েরী অনুযায়ী দিনটি ছিলো ১৬ই মে, ১৯৮২ ইংরেজী, ২রা জৌষ্ঠ্য, ১৩৮৯, রবিবার। পাঠচক্রে তখন ওমর কায়সার, বিশ্বজিৎ চৌধুরী, ইব্রাহিম আজাদ, মাঈনুল হাসান, জ্যোতির্ময় নন্দী ও অজয় দাশগুপ্তের সাথে আবুল মোমেন, তপনজ্যোতি বড়–য়াও উপস্থিত ছিলেন। শাহিদ আমাকে মোমেন ভাই ও তপনজ্যোতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়, ”ও মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী। হিস্ট্রি থার্ড ইয়ারে। লেখালেখি করে। আমাদের সাথে থাকবে।” সেদিন জ্যোতির্ময় নন্দী আমার ’পাথুরে মমতা’ ও ’যাত্রা অবিনাশী’ কবিতা দু’টি পাঠ করে। তপনজ্যোতি বললেন, প্রতি হপ্তায় এসো।
ফুলকি চক্রের একটা মাসিক পত্রিকা বের করার প্রয়াস চালানো হচ্ছে বলে জানিয়েছিলো শাহিদ। সেজন্য আজ একটা কমিটি গঠন করা হলো। কমিটি ছিলো নিম্নরূপঃ
যৌথ সম্পাদকঃ শাহিদ আনোয়ার ও বিশ্বজিৎ চৌধুরী
অর্থ সচিবঃ অজয় দাশগুপ্ত
অনুষ্ঠান তত্ত্বাবধায়কঃ ওমর কায়সার, মঈনুল হাসান ও মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী
সিদ্ধান্ত হয় যে, পত্রিকা দু’মাসে একবার প্রকাশিত হবে। (কিন্তু পরবর্তীতে রাজনৈতিক কর্মকান্ডে ব্যাপকভাবে জড়িয়ে পড়ায় ”অচিরা”র কার্যক্রমে আর যুক্ত থাকা হয়ে ওঠেনি)। কবিতা লেখার চেষ্টা করাই নেশা তখন। কবি আসাদ মান্নানের সাথে তার ”সমিজম” কবিতাপত্র নিয়ে তখন কৌতুহলী আমি। লিটল ম্যাগে, ঢাকার পত্রপত্রিকায়, চট্টগ্রামের দৈনিকে লিখছি। শাহিদ আর আমি প্রায়শঃই সুনীল নাথের দেখা করতাম। মফঃস্বল পত্রিকা হাতে সুনীলদা খুশীতে জ্বলজ্বল করতেন। আমরা রাপুদের বাসায় গিয়ে খেলাঘরের কিশোর-কিশোরীদের আবৃত্তি আর গানের চর্চা দেখতাম। তারপর ভেতরের অলিগলি পেরিয়ে চলে যেতাম ফুলকিতে। সেখান থেকে অরুণ দাশগুপ্তের বাসায়। সেখানে ড. অনুপম সেন, চৌধুরী জহুরুল হক আসতেন। মিনার মনসুরের সাথেও দেখা হতো মাঝেমধ্যে। কখনো চৌরঙ্গীতে, কখনো চকবাজার সবুজ হোটেলে। আমাদের পায়ে যেন চাকা লাগানো ছিলো। সিগারেট চা, আড্ডা আর কবিতা। সবচেয়ে প্রাণবন্ত আড্ডা হতো বোস ব্রাদার্সে। অজয়ের দমবন্ধ করা কৌতুক, বিশুর কন্ঠে ”ওরে বিহঙ্গ ওরে বিহঙ্গ মোর..এখনি অন্ধ বন্ধ করো না পাখা..” গান, কায়সারের কবিতা, পূজনের মশকরা আর চা এবং ধোঁয়ার কুন্ডলী নৃত্য। শাহিদের কন্ঠে হাসির কল্লোল। পাঁজরে গেঁথে যাওয়া ধ্বনিময় অনন্য সেসব দিন।
নতুনদিনের পদধ্বনি বুঝি শুনি
সময়টা ১৯৮৩ সালের জানুয়ারি। সোনারোদে ঝলমলে শীতের সকাল। কলাভবনের মূল ফটকের সামনে বুঝি রোদ পোহানোর পালা চলছে। দোতলার করিডোর থেকে দেখলাম ছাত্র-ছাত্রীদের বেশ জটলা। দেশে সেনাশাসন চলছে। রাজনৈতিক কর্মকান্ড ও সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ। ছাত্রছাত্রীদের জটলা দেখে কৌতুহল নিয়ে নীচে নেমে এলাম। দেখি সেখানে স্বাক্ষর সংগ্রহ করা হচ্ছে। মজিদ খানের গণবিরোধী শিক্ষানীতি বাতিলের দাবীতে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের গণস্বাক্ষর অভিযান। রাজনৈতিকভাবে সচেতন আমি সেই কিশোরবেলা থেকেই কিন্তু কোথাও সম্পৃক্ত নই। তবে চট্টগ্রাম সরকারী সিটি কলেজ থেকে একেবারে ধোয়া তুলসী হয়ে আসি নি। প্রথমদিন ইউনিভার্সিটিতে আসার পথে শাটলে বসার বাগড়ায় বড়ো ভাইদের ট্রেন থেকে ফেলে দেয়ার ইতিহাস সমৃদ্ধ অতীত আছে আমার। বন্ধুদের সাথে দলবেঁধে আড্ডা, হইচই করা আমার নেশা। তাছাড়া শিক্ষানীতি বিষয়ে তেমন কোন ধারণাও নেই। বিষয়টি সম্পর্কে জানার আগ্রহ হলো। তখন, যতদূর মনে পড়ে পাবলিক এ্যাডের বড়ভাই মোহাম্মদ শফিকুর রহমান আমি আর শাহিদকে একপাশে ডেকে নিয়ে কুদরত ই খুদার গণমুখী শিক্ষানীতি এবং মজিদ খানের গণবিরোধী শিক্ষানীতি সম্পে ০র্ক বোঝাচ্ছেন। দু’জনে আগ্রহ নিয়ে শফিক ভাইয়ের কথা শুনছি। শাহিদ টুকটাক প্রশ্ন করছে। আমিও। এ সময় আমাদের কাছে এগিয়ে এলেন ছাত্রনেতা মনোয়ার আহমেদ। নিজের পরিচয় দিয়ে হাত মেলালেন। তিনি আমাদের উৎসাহ দেয়ার চেষ্টা করলেন। সম্ভবতঃ মনোয়ার আহমেদের সাথে শাহিদের কিঞ্চিত পূর্বপরিচয় ছিলো। আলাপচারিতা শেষে এই প্রথম একটি রাজনৈতিক সংগঠনের আহবানে সাড়া দিয়ে কর্মসূচীতে শরীক হলাম। শাহিদ বললো, মনে হচ্ছে নতুন কোন এক দিনের হাতছানি দেখতে পাচ্ছি। দেখছো না জলপাই ট্যাংকগুলো কেমন গোঁ গোঁ করছে জানোয়ারের মতো! ওরা হামলে পড়বে, দেখো।
শাহিদের আশংকা সত্য হলো।
১৪ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৩ঃ ঝড়ো সময়ের ঘূর্ণি
মজিদ খানের গণবিরোধী শিক্ষানীতি বাতিলের দাবীতে ডাকা ছাত্রসমাবেশে হামলা করে সামরিক শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করলো ছাত্রহত্যার মাধ্যমে। খবরটা যখন পেলাম তখন আমরা ক্যাফেটেরিয়াতে আড্ডা দিচ্ছি। সমুচাটা শেষ করে সবে চাতে চুমু দিয়েছি, তীব্র শ্লোগানে হাত কেঁপে গেলো। শাহিদ আর আমার সাথে তখন কবি কচি মাহমুদও ছিলো। আমরা ছুটে গিয়ে মিছিলে হারিয়ে গেলাম। নতুন এক রাজনৈতিক কালস্রোত আমাদের টেনে নিয়ে গেলো নতুন যাত্রাপথে। সে-ই থেকে আমরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম শহরের মিছিলের পরিচিত মুখ হয়ে উঠলাম।
ভার্সিটি থেকে ফিরে কবিরাজ ভবন হয়ে দারুল ফজল মার্কেটে এসে সংগ্রামের নতুন অধ্যায় রচনা হয়ে উঠলো আমাদের আড্ডার নতুনতর বিবর্তন। গণতন্ত্রের সংগ্রামের আলোকে সমাজতন্ত্রের লড়াইয়ের অংশ হিসেবে আমরা রাজপথের সংগ্রামের অংশভাগী হয়ে গেলাম। উৎপল দত্ত, আবদেল মান্নান, উত্তম সেন ও আমার সাথে শাহিদ আনোয়ারও যুক্ত হয়ে গেলো ছাত্র ইউনিয়নের সাথে। সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন সংগ্রামের সকল কর্মসূচীতে নিয়মিত অংশগ্রহনের পাশাপাশি শাহিদ শ্রমিক-মেহনতি মানুষদের কাছে শোষণ নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরার জন্য সারাক্ষণ চিন্তা করতো। “আত্মমুক্তি অধ্যয়ন সমিতি”র মাধ্যমে বায়োস্কোপ আদলে শোষণচিত্র তুলে ধরার প্রকল্প তুলে ধরে। এটি ছাত্র ইউনিয়ন গ্রহন করে। বিভিন্ন শ্রমিক এলাকায় এই প্রকল্প চালু করা হয়। এ সময় মনোয়ার আহমেদ ”সমস্বর”নামে একটা অনিয়মিত সাপ্তাহিক ট্যাবলয়েড করেন। শাহিদ আর আমি কিছু রাজনৈতিক লেখা লিখি।
আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন সংগঠনে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কাজের পরিধি বিস্তৃত হয়ে গেলো পনের দলীয় ঐক্যের আন্দোলন সংগঠনে। এলাকায় এলাকায় আন্দোলন গড়ে তুলতে হলে সংগঠনের প্রয়োজন। আমি পাহাড়তলী, ডবলমুরিং ও বন্দর এলাকায় সংগঠনের কাজে ব্যাপক জড়িয়ে পড়ি। ছাত্র, যুব, মহিলা, শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলার কাজে এতো বেশি জড়িয়ে পড়ি যে, শাহিদের সাথে নিয়মিত দেখাটা কমে যায়। তবে দারুল ফজল মার্কেটে তো প্রায়ই আসতে হয়। শাহিদ সাংগঠনিক দায়িত্ব না নিয়ে সাংস্কৃতিক কর্মসূচীর সাথে কিছু কিছু সক্রিয় থাকে। পার্টির কাজ সেরে শাহিদের সাথে বোস ব্রাদার্সে, ফুলকিতে দেখা হয়ে যেতো।নতুন লেখা কবিতা পড়ে শোনায় শাহিদ। আমার কবিতা লেখায় একটু ভাটা পড়ে। আমি রাজনৈতিক লেখালেখি বাড়িয়ে দেই। শাহিদ বলে, মৌলিক লেখা ছেড়ো না। না, ছাড়ি নি। ’৮২ সালের মাঝামাঝিতে থেকে ’৮৮ পর্যন্ত লেখা কবিতাগুলো শাহিদ আমাকে শোনাতো হাঁটতে হাঁটতে, বৌদ্ধমন্দিরের রেলিংয়ে বসে, বোস ব্রাদার্সের ধুমায়িত টেবিলে বসে। আমরা হেঁটে হেঁটে চক্কর দিতাম শহরে। চলে যেতাম কথাকলিতে। চৌরঙ্গীতে। কারেন্ট বুক সেন্টারে। কার্ফ্যু শুরু হবার আগে আমাকে ফিরতে হতো। নিউ মার্কেটের সামনে থেকে টেম্পু বা বাসে আমি পানিরকলে ফিরতাম।
প্রথম কর্মজীবনে শাহিদ: পূর্বকোণ
পঁচাশিতে মাস্টার্স করে কাজ খুঁজছিলো শাহিদ। এ সময় চট্টগ্রামে আজাদী’র প্রতিপক্ষ হিসেবে এলো দৈনিক পূর্বকোণ। সরকারী চাকুরীতে এমবার্গো, লক্ষ লক্ষ বেকার। ১৯৮৬ সালের ১০ই ফেব্রæয়ারি পূর্বকোণ প্রকাশিত হলো। আবুল মোমেন, শিশির দত্ত, বিশ্বজিৎ চৌধুরী, ওমর কায়সার, উত্তম সেন, আবসার হাবীব, স্বপন দত্ত, ফারুক ইকবাল ও শাহিদসহ এক ঝাঁক বন্ধুরা যোগ দিলো পূর্বকোণে। আমি আন্দোলন সংগ্রামে চষে ফিরছি পুরো শহর। সন্ধ্যেও পরে হাজির হই পূর্বকোণে। হইচই করি। শাহিদকে নিয়ে চা-নাস্তা খাই, ধোঁয়া ওড়াই। কুহেলীর খবর নিই। খুনসুটি করি। সেও আমাকে নাসরিনের কথা বলে ফোঁড়ন কাটে, আমার জন্য নাকি একটি মেয়ে পড়ালেখা ছেড়ে বিয়ে করে ফেলেছে ব্যাংকার বাবার কথামতো। নতুন কবিতা শুনি। শাহিদ পূর্বকোণের নিউজপ্রিন্টের ছেঁড়া নোটে এলোমেলো হাতে লেখা কবিতা দেখিয়ে বলে, কাজের ফাঁকে লিখেছি! পাগল! আমি একটা নোট বই দিয়েছিলাম। সে আমাকে ফেরত দিয়ে বলে, ইস্তিরি করা ভালোবাসায় মাদকতা নেই। সেই নোটবইটি ডায়েরী বানিয়েছিলাম, যা অনেক বছর পর খুঁজে পেয়েছি। পূর্বকোণের সাহিত্যপাতায় আমি গল্প-কবিতা, আজাদীতে প্রবন্ধ, গল্প ও কবিতা লিখে চলেছি। মামুন ভাই দেখা হলে বলেন, লেখা ভালো হচ্ছে তবে ধার আরো শাণিত করতে হবে। সময় পেলে শাহিদ আমি আর মামুন ভাই আড্ডায় বসে যাই। মামুন ভাই ঢাকার শিল্পীদের সমন্বয়ে ”সময় শিল্পগোষ্ঠী” গঠন করেন। যার কিছু এক্সিবিশনের সময় আমি আর শাহিদ যথাসম্ভব সহযোগিতা করেছি। আমার রাজনৈতিক ব্যস্ততা আর মামুন ভাই ইউনিভার্সিটিতে যোগ দেবার পর যোগাযোগ কমে গেছে। ’৮৬ সালে ছোটবোন জেসমিনের বিয়ে হয়ে যায়।
শাহিদের কক্ষ পরিবর্তনঃ দৈনিক সংবাদ
পূর্বকোণে ব্যবস্থাপনার সাথে নাকি সিনিয়রদের সাথে শাহিদের ঠিক বুঝি বনিবনা হচ্ছিলো না। সে বেশ কিছুদিন ধরে অস্বস্তিতে ভুগছিলো। বছর দুয়েক কাজ করে হঠাৎ একদিন জানালো দৈনিক সংবাদে তার চাকুরী হয়েছে। সে ঢাকায় চলে গেলো ১৯৮৮ সালে। যোগ দিলো দৈনিক সংবাদের বার্তা বিভাগে। ছেদ পড়লো আমাদের অনেক দিনের অভ্যস্ততায়। তবে আমাকে ঢাকায় প্রায়শঃই যেতে হতো। বংশাল রোডের অফিসে নয়তো পলাশী বাজারের পেছনে মেসে গিয়ে হাজির যখন তখন। সংবাদেরই কুন্ডু ছিলো শাহিদের রুমমেট। বেশ আমুদে মানুষ। শাহিদ থেকে একদিন আড়াল করে আমাকে জানালো, শাহিদের নাকি মাথা ভারী ভারী লাগে। চিকিৎসার দরকার। আমি পরে শাহিদকে জিগ্যেস করেছিলাম। সে বলেছিলো, অনেকদিন ধরে এমন হয়। বিষয়টি আমি হালকাভাবে না নিলেও শাহিদ গায়ে মাখলো না। বলে, ও কিছু না, স্ট্রেস।
পিতৃবিয়োগ, অসুস্থতা ও অস্থিরতার বেড়াজাল
১৯৮৯ সালে ডাঃ ফয়েজ চাচার হার্ট এ্যাটাক হয়। শাহিদ ঢাকা থেকে ছুটে আসে। চাচাকে রক্ষা করা যায় নি। শাহিদ একেবারে বেসামাল হয়ে পড়ে। সারাক্ষণ বলতে থাকে, এতো বড়ো পরিবার আমি কিভাবে সামলাবো? তার মাথা ব্যথা বেড়ে যায়। খাওয়া-দাওয়ায়, চলাফেরায় একেবারে উদাসীন হয়ে পড়ে। তার ডিপ্রেসনের মাত্রা বেড়ে যায়। তার এই সময়কার কবিতাগুলোতে অসুস্থতার, দিকভ্রান্তির, অস্থিরতার, সাহচর্যের আকুলতার ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
এ বছরই শাহিদ হঠাৎ ঢাকায় চলে যায়। এক মাস উদভ্রান্তের মতো ফিরে আসে। সারাক্ষণ কেমন যেন তটস্থ থাকে। একদিন সে আমাকে একটা লিফলেট দেখায়। ময়লাটে, লালচে কাগজে ছাপা।ওপি ওয়ানের বিরুদ্ধে লেখা লিফলেট। ওপিওয়ান সাম্রাজ্যবাদীদের নীলনক্সা, তৃতীয় বিশ্বকে মেধাশূন্য করার এক সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র, ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব কোন নতুন কথা নয়। সে জানায় লিফলেট বিতরণের সময় তাকে কিডন্যাপ করা হয় এবং রাশিয়ার বলে ইন্টারোগেশন করা হয়। তাকে এসময় বার বার আঁতকে উঠতে দেখি। বুঝতে পারি শাহিদ ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। আমি ওর পরিবারের সাথে আলাপ করি। ওকে ডাক্তার দেখানো হলো। অষুধ দেয়া হলো। ডাক্তার শাহিদকে কাজকর্মে, আড্ডা ও পারিবারিক আনন্দঘন পরিবেশে রাখতে পরামর্শ দেন।
এদিকে ছোটবোন জাফরিনের বিয়ের কথাবার্তা চলছে। ছেলে আমেরিকায় থাকে। শাহিদ হঠাৎ এক ভিজিট ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে গেলো। এবং অল্প কিছুদিন পরে ফিরেও এলো। জাফরিনের বিয়ে হয়ে গেলো।
দৈনিক আজাদীঃ নতুন আলো
শাহিদকে নিয়ে অরুণদা’র বাসায় গেলাম। দা’মণিকে আদ্যান্ত সব বললাম। অরুণদার সহযোগিতায় শাহিদ আজাদীতে যোগ দিলো। আমি তখন কালুরঘাটে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টে জয়েন করেছি। অফিস শেষ করে চলে আসি আজাদীতে। অলোকময় তলাপাত্র, আমি, শাহিদ আড্ডায় বসি। কবিতা পড়ি, কবিতা শুনি। শাহিদ বেশি বেশি আরবী শব্দের ব্যবহার বাড়িয়ে দিয়েছে লেখায়। দেহতাত্ত্বিকতা নিয়ে মশকরা করছে বেশ। হাঁটতে কখনো আমরা ক্লান্তি বোধ করতাম না। অনেকদিন না গেলেও এ সময়ে সে রেলওয়ে ম্যানস ক্লাবে যেতে চাইতো। হাউজীর কোন নেশা আমাদের ছিলো না। ওখানকার শুঁড়িখানার মানুষগুলোকে শাহিদ খুঁটিয়ে দেখতো। ওদের নিয়ে কাব্য করতো। ফুটপাতের গণিকাদের দেখে বলতো, এরা কেন পৃথিবীকে জ্বালিয়ে দেয় না? লেখালেখি আর চলাফেরায় একটু সাবলীলতা দেখা গেলেও শাহিদের অসুস্থতা সারেনি। আমাকে মাঝেমধ্যে চট্টগ্রামের বাইরে, বিশেষতঃ বান্দরবানে যেতে হতো অফিসের কাজে পাঁচ ছয়দিনের জন্য। তখন খুব টেনশন হতো ওকে নিয়ে। কখন কি করে বসে!
একদিন বিকেলে আমি বান্দরবান থেকে আসছি। বাস দাঁড়িয়েছে সাতকানিয়ার মোড়ে। হঠাৎ ”আলী, আলী” ডাক শুনে অবাক হলাম। দেখি শাহিদ জানালার কাছে। আমি ছুটে নেমে এলাম, তুমি এখানে?
বাড়ীতে এসেছিলাম, সেই প্রাণখোলা হাসি, চলো নাস্তা করি। আজকে আমার ছুটি।
দু’জনে অনেকক্ষণ আড্ডা দিলাম। তখন আমি রুমা এলাকার পাহাড়ী জনপদের অভিজ্ঞতায় লেখা গল্প নিয়ে কথা বলি। নুনছিটাহ নামের এক মারমা মেয়ের কথা ওকে বললে শাহিদ খুনসুটি করে বলে, তাহলে তো রুবাকে বলতে হয়।
রুবা, দিলরুবা ইয়াসমিন তখন আমার প্রেমিকা। শাহিদকে বলি, আগেই ওকে বলেছি , আর রুবা বলেছে আমি রুমায় গেলে নুনছিটাহ’র জন্য ওকে ভুলে যাই।
ঠিকইতো বলেছে, শাহিদ আলো ছড়ানো চোখে হাসে, তুমি আমাকেও ভুলে যাও।
আর তাই আমি আজ ফিরবো জেনে তুমি ছুটির বাহনায় এখানে এসে প্রত্যেক বাসে আমাকে খুঁজছো, তাই না?
হঠাৎ এমন প্রশ্নে সেদিন গোধুলীবেলায় শাহিদের মুখাবয়বে বাৎসল্যের যে স্ফূরণ দেখেছি, এতোটি বছর পরও তা ভুলিনি।
অক্টোবর ০৮, ২০১৭। রামপুরের বাড়িতে। আমাদের শেষ দেখা। শেষ স্পর্শ।
এরশাদ পতন, বিএনপি ক্ষমতায়, পার্টির ভাঙন ও ঘূর্ণিঝড়
নব্বুইয়ের ১০ই অক্টোবর সচিবালয় ঘেরাও, জেহাদের মৃত্যু এবং নভেম্বরে ডাক্তার মিলনের হত্যার মধ্য দিয়ে এরশাদ স্বৈরাচারের পতন নিশ্চিত হয়। কিন্তু দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামে প্রচুর ত্যাগ স্বীকারকারী ১৫ দলের পরিবর্তে স্বাধীনতাবিরোধীদের সমর্থনপুষ্ট সাতদলীয় জোট তথা বিএনপি ক্ষমতায় এলো। এ সময়ে কমিউনিস্ট পার্টি ভেঙে গেলো। রক্ত ঘাম যৌবন আর মেধা দিয়ে গড়ে তোলা বিশাল সংগঠনটি চোখের পলকে চুরমার হয়ে গেলো। হতাশায় নিমজ্জিত হলো সবাই।
এখন কি করবে, হতাশ কন্ঠে বলে শাহিদ।
তখন আমি আর রুবা বিয়ে করেছি। শাহিদ খুব কেটেছে। কিন্তু জিএমের সাথে দ্বন্ধের কারনে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের চাকুরীটা ছাড়তে হলো। কোডেকে ইন্টারভিউ দিয়ে অপেক্ষা করছি।
চাকুরীই করবো, বললাম, আমি এখন কোন গ্রুপেই যোগ দেবো না। বিলোপবাদীদের পক্ষে তো নয়ই।
অবশ্য আমাদের বিয়ে নিয়ে পার্টির কিছু নেতাদের আচরণের বিরোধিতা করে আমি কার্যক্রম থেকে তখন দূরেই আছি।
এখন কাজ আর লেখালেখিতে মন দাও, শাহিদ বলে।
আমি তাই-ই মনস্থির করি। কিন্তু একানব্বুইয়ের ঘূর্ণিঝড় উপকূল অঞ্চলের মানুষের জীবনের মতো আমরা দুইবন্ধুর জীবনও লন্ডভন্ড করে দেয়। ঘূর্ণিঝড়ের পরে আমি চট্টগ্রাম ছেড়ে লক্ষ্মীপুরে চলে যাই। আমাদের বিচ্ছেদ বুঝি সময়ের ক্যালেন্ডারে নির্ধারিত ছিলো!
শাহিদের বিয়ে, নতুন সংগ্রামে নতুনধারায়
বিরানব্বুই সালের মার্চে আমার মেয়ে অর্চি জন্ম নেবার পর আমি কিছুদিনের জন্য চট্টগ্রাম আসি। ইতিপূর্বে এলেও শাহিদকে খুব একটা সময় দিতে পারিনি। দেখা হলে সে জানিয়েছিলো, টাকা পয়সার সংকট কাটছে না। বেতন বেশি পেলে পূর্বকোণে ফিরে যাবে। একবার পূর্বকোণে গিয়ে নাসির ভাইয়ের (নাসিরউদ্দীন চৌধুরী) সাথে দেখা করি। ফারুক ইকবাল বলে, লেগে থাকো।
১৯৯৪ সালে চট্টগ্রাম ফিরে জানলাম শাহিদ বিয়ে করেছে সেলিনা শেলীকে। অবশ্য শেলীর সাথে আমার আগে পরিচয় হয়নি। তাদের একটা ছেলেও আছে, তুর্য। আমার ছোট ছেলে অংশুর মাসকয়েকের বড়। শাহিদ পানিরকল এলাকায় বাসা নিয়ে মুভ হয়ে আসে। বসর ম্যানেজারের বাড়ী। তখন শেলীর সাথে আমার পরিচয়। শাহিদ প্রায়শঃ তুর্যকে নিয়ে আমাদের বাড়ীতে চলে আসতো। কিন্তু কিছুদিন পরে আমি আবার লক্ষ্মীপুরে চলে যাই সপরিবারে। আবার বিচ্ছেদ। ফিরে আসি ১৯৯৬ সালে। শাহিদ তখন বাসা নিয়েছে আমতলার দক্ষিণবিলের কাছে। হাঁটা দূরত্ব। প্রায়শঃ বিকেলে দেখা হতো শাহিদের সাথে। তখন আমার অফিস চাদঁগাও এলাকায়। শাহিদ পূর্বকোণে আর ইসলামিয়া কলেজে কাজ করছে। সকালে ইসলামিয়া কলেজ বিকেলে পূর্বকোণ। প্রায়শঃ পূর্বকোণে নইলে আমাদের বাড়ীতে দেখা হতো। হাঁটার অভ্যাস থাকলেও সুযোগ ছিলো সিমিত। জীবন ধারা পালটেছে, ব্যস্ততা বেড়েছে। জীবনধারণের সংগ্রাম বদলে দেয় অনেক কিছু।
দেখা হয়, কথা হয় লেখালেখি নিয়ে, নতুনধারার গল্পকথায়, কবিতায়। আমি জীবনমুখীনতার গল্পে ব্যাপৃত হই আর শাহিদ দেহমনস্তাত্তি¡ক রোমান্টিকতায়। লেখার গতি কমে দায়-দায়িত্বের নিত্তির পাল্লায়। আমি প্রথম গল্পগ্রন্থ ’শঙ্খসোহাগ’-এর পান্ডুলিপি তৈরি করি। এ সময় আমার যুক্তরাষ্ট্রে সপরিবারে অভিবাসী হবার সকল আয়োজন সম্পন্ন হলো।
চলে যাবে? হাহাকারদীর্ণ কন্ঠে বলে শাহিদ।
যাই, দেখি পৃথিবীটা, আমি বেদনা গিলে ফেলি সন্তর্পণে, যোগাযোগ তো থাকবেই।
২০০০ থেকে ২০২০ সাল
দীর্ঘ বিশটি বছর আমি বাইরে আছি কিন্তু এমন কোন সপ্তাহ ছিলো না আমি আর শাহিদ কথা বলিনি। এর মধ্যে যতো বারই দেশে এসেছি, দু’জনে আমাদের স্মৃতিময় পথ ধরে আমরা হেঁটেছি। ইথারে ছড়িয়ে দেয়া কথামালাদের খুঁজেছি আলুথালু। কখন কোন লেখাটি আমরা লিখছি, কখন কোন বইটি কোন প্রকাশনা থেকে বেরুচ্ছে, প্রচ্ছদ কে করছে ইত্যাদিই বাক্সময় হয়ে থাকতো আমাদের আলাপচারিতায়। ২০১৯ সালে আগামী প্রকাশনী প্রকাশ করে শাহিদের ”শ্রেষ্ঠ কবিতা” আর বেহুলাবাংলা প্রকাশ করে আমার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ’ মনোময়’ যা আমি শাহিদকে উৎসর্গ করেছি।
২০১৭ সালের অক্টোবরে শাহিদের সাথে শেষ দেখা রামপুরের বাড়ীতে। শাহিদকে বলেছিলাম, ২০২০ সালের বইমেলায় আমি যাবো, আমার ’অন্ধশিকার’ গল্পগ্রন্থটি প্রকাশিত হবে পাঞ্জেরী প্রকাশনী থেকে। কিন্তু আমার আসা হয়নি। শাহিদের স্ট্রোক
শাহিদকে উৎসর্গিত ‘মনোময়’ হাতে শাহিদ।
হলো। শব্দের ঝর্ণাধারা বন্দী হয়ে গেলো নীরবতার কয়েদখানায়। আমি বিমূঢ হয়ে গেলাম।
(লেখাটি আমি সংক্ষিপ্ত করলাম । শাহিদের কাব্যমানস, আদর্শিক চেতনা, রাষ্ট্র-সমাজ-সাংস্কৃতিক ভাবনার বিষয়গুলো তুলে ধরা হয় নি। তার কাব্য ভাবনার ১৯৮০-২০০০ এবং ২০০১-২০২০ পর্বের বিস্তারিত বিষয়াবলী ’আমার শাহিদ আনোয়ার’ এ সন্নিবেশিত করার প্রত্যাশা রাখি)।
মার্চ ০২, ২০২১
পেনসেলভেনিয়া, যুক্তরাষ্ট্র