আমার বন্ধু বিষ্ণু বিশ্বাস
ফয়জুল ইসলাম
আশির দশকের শক্তিমান কবি বিষ্ণু বিশ্বাস খুবই জনপ্রিয় এক জন ব্যক্তি হিসেবে নাম কুড়িয়েছিলেন। মানুষকে আকর্ষণ করতে পারবার ক্ষমতাটা ছিল তার সহজাত- এর জন্য তাকে কোনও কসরৎ করতে হয়নি। সেই সময়কার ছোট কাগজের লেখক, পাঠক, আবৃত্তিকার, স্বৈরাচার-বিরোধী রাজনৈতিক কর্মী- এদের অনেকেই কোনও না কোনোভাবে তার সাথে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ১৯৯৩ সালে ঢাকা ছেড়ে ঝিনাইদহে চলে যাবার আগ পর্যন্ত এমনটাই দেখেছি। সুদর্শন এবং সদা হাস্যময় এই মানুষটির আত্মার কাছে যাবার সুযোগ ঘটেছিল আমার, কাকতালীয়ভাবেই। বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনে বিষ্ণু আর আমি পাঁচ বছর ধরে এক রুমে থেকেছি বলে আমাদের মাঝে অচ্ছেদ্য বন্ধন গড়ে উঠেছিল। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হবার পরেও একই সূত্রে গাঁথা হয়েছিল আমার জীবন। সেটা আমার জন্য সৌভাগ্যই ছিল বলতে হবে!
জানুয়ারি ১৯৮৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রথম বর্ষের ক্লাসে আমি যোগ দেই; উঠি গিয়ে শের-ই-বাংলা হলের পূর্ব ব্লকের ২০ নম্বর রুমে। রাজশাহীতে মানিয়ে নিতে অসুবিধেই হচ্ছিল আমার! তার কারণ এই যে: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বন্ধুদের তেমন কেউই ভর্তি হয়নি। আমাদের পাবনা জেলা স্কুলের সিনিয়ারদের অনেকেই সেখানে পড়তেন বটে। তবে তাদের সাথে আমার কোনও ঘনিষ্ঠতা ছিল না। আর রাজশাহী-শহরে আমার এক ফুপু এবং কবি ও আবৃত্তিকার মোহাম্মদ কামাল ছাড়া আর কাউকেই আমি চিনতাম না। তাদের সাথে সব সময় আমার দেখাও হতো না। সময় কাটাতো না বলে আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আবৃত্তি-সংগঠন ‘স্বনন’-এ যোগ দেই। সেলিনা খান শেলিই আমাকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন। এক বিকেলে বাছাইপর্বে উপস্থিত হলে আরও অনেকের সাথে ইতিহাস বিভাগের প্রথম বর্ষের সুদর্শন ছাত্র বিষ্ণু বিশ্বাসের সাথে আমার আলাপ হয়। উল্লেখ্য, আমরা দু’জনেই সে বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে ঢুকেছিলাম। সে তখন শামসুজ্জোহা হলে তার বন্ধু মধুর কাছে উঠেছিল। সেদিন বাছাইপর্বে বিষ্ণু বিশ্বাস আর আমি দু’জনেই টিকে যাই। বাছাইপর্ব শেষ হলে ‘স্বনন’-এর তৎকালীন আহবায়ক আরিফুল হক কুমার, মোহাম্মদ কামাল, মনিরুজ্জামান, নিশাত জাহান রানা, নাহার মওলা এবং সেলিনা খান শেলি আমাদেরকে চা খাওয়াতে নিয়ে যান। চা খাওয়া হয়ে গেলে পরে আমরা যখন ক্যাম্পাসের প্যারিস রোড ধরে হাঁটছি তখন নিশাত জাহান রানা কোনও একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে শুরু করলে তার সাথে গলা মেলাতে বসে বিষ্ণু বিশ্বাস। আমি চমৎকৃত হই তাদের দু’জনের গায়কী দেখে! আর বিষ্ণু বিশ্বাসের গমগমে কন্ঠ তখন সহজেই সবার নজর কেড়ে নেয়। তাকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারি, সে আনুষ্ঠানিকভাবে গান শেখেনি, যা শিখেছে তা আকাশবাণীর সম্প্রচার শুনতে শুনতে। তারপর থেকে প্রতিদিন বিকেলে ‘স্বনন’-এর আড্ডাতে আমি যোগ দিতে শুরু করি। আমি লক্ষ করি, স্মৃতি থেকে অনর্গল রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, সুধীন, অমিয়, বুদ্ধদেব, শক্তি, সুনীল, নীরেন- এদের কবিতা আবৃত্তি করছে বিষ্ণু বিশ্বাস! বিষ্ণু বিশ্বাসের মতো এমন অসম্ভব শ্রুতিধর একজন মানুষ তখন আমাকে মুগ্ধ করেছিল (সত্যি বলতে কি, মোহাম্মদ কামাল এবং নিশাত জাহান রানাই কেবল তার সাথে পাল্লা দেবার যোগ্যতা রাখতেন)! আরেকটা ব্যাপার আমাকে আকর্ষণ করল তখন- আকাশবাণীতে প্রচারিত জনপ্রিয় বাংলা আধুনিক গানের প্রায় সবগুলোই গাইতে পারে বিষ্ণু বিশ্বাস। এ জায়গাটাতে তার সাথে আমার ভয়ানক মিল পড়েছিল। এখানে বলে রাখা ভাল, ‘স্বনন’-এর যাদের সাথে আমরা আড্ডা দিতাম তখন তাদের বেলাতে আমি রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি একছত্র অনুরক্তিই দেখেছি। বিষ্ণু বিশ্বাস আর আমি সেসবের তোয়াক্কা না করে গলা ছেড়ে জনপ্রিয় বাংলা আধুনিক গান গাইতাম, রবীন্দ্রসঙ্গীত তো বটেই! আমি তখনও জানিনি যে বিষ্ণু বিশ্বাস তলে তলে কবিতা লিখে। কাজটা তখন আমিও করবার চেষ্টা করছিলাম, ব্যর্থ হচ্ছিলাম যদিও!
এরই মাঝে স্বৈরাচরী সরকারের বিতর্কিত শিক্ষনীতির বিরুদ্ধে ছাত্রদের আন্দোলন চুড়ান্ত পর্যায়ে উঠে গেল। ১৯৮৩-র ১৪ ফেব্রুয়ারিতে ছাত্ররা যখন সচিবালয়ে শিক্ষনীতির বিরুদ্ধে স্মারকলিপি জমা দিতে যাচ্ছিল তখন হাইকোর্টের সামনে পুলিশবাহিনী তাদেরকে প্রতিরোধ করে। এতে করে সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়। পুলিশবাহিনীর গুলিতে জয়নাল এবং দিপালী সাহাসহ নিহত হন অন্তত দশ জন ছাত্র আহত হন। প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে সারা দেশের ছাত্ররা। তার ফলে সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়; আবার খোলে একই বছরের এপ্রিলে। এবার আমরা ‘স্বনন’-এর ব্যানারে বাংলা কবিতা আবৃত্তির অনুষ্ঠান আয়োজন করতে শুরু করি। এক দিন বিষ্ণু আমাকে জানায় যে শামসুজ্জোহা হলে সে সিট পায়নি আর তাই তার থাকবার জায়গা নিয়ে খুবই সমস্য হচ্ছে! ততদিন তার সাথে আমার বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে বলে আমি তাকে শের-ই-বাংলা হলে আমার রুমে কিছু দিন থাকবার জন্য নিয়ে যাই। আমি তখন পূর্ব ব্লকের ২০ নম্বর রুমে থাকি। গোলটা বাঁধে তখনই- ফোর সিটের রুমের রুমমেটরা বেঁকে বসে। তারা যুক্তি দেয়, রুমে বাড়তি মানুষ থাকলে রুমের পরিবেশ নষ্ট হতে পারে। আমি বলি- বেশি দিনের মামলা তো আর নয়! মজার ব্যাপার হলো, আমার রুমমেটদের আশঙ্কা অক্ষরে অক্ষরে ফলতে শুরু করল: রাত দু’টো-তিনটের দিকে রুমে ফিরতে শুরু করল বিষ্ণু (তখন রুমের সকলেই ঘুমোচ্ছে); দেখা গেল, বিষ্ণুর নৈশ-অভিযানে আমিও তার সঙ্গী হচ্ছি প্রায়শই; রুমে ফিরে সে আর আমি কবিতার বই পড়ছি বাতি জ্বালিয়ে; রুমমেটরা খেঁকিয়ে উঠলে বাতি নিভিয়ে দিয়ে সে আর আমি মৃদু স্বরে গল্প করছি; সারা সকাল ঘুমিয়ে, স্নান করে, ফুলবাবু সেজে বিষ্ণু দুপুরে রুম থেকে বেরুতে থাকল আর তখন রুম আটকাবার জন্য তার কাছে রেখে যাওয়া আমাদের চাবিগুলো সে ক্রমাগত হারাতে শুরু করল! বিষ্ণু ইতিহাস বিভাগের ক্লাসট্লাস কিছুই করছিল না- আড্ডা দিয়ে বেড়াচ্ছিল সারা দিন। রুমমেটদের চাপে পড়ে বিষ্ণুকে তাই আমি রুটিন-টুটিন শেখানোর চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু সে কিছুতেই আর সবার রুটিনের সাথে চলতে পারছিল না। এ নিয়ে আমার সাথে আমার রুমমেটদের ঝগড়াঝাটি শুরু হয়ে গেল! এভাবে কিছুদিন চলবার পরে দেখা গেল, বিষ্ণু প্রায়শই ঝিনাইদহের বিষয়খালিতে তাদের বাড়িতে যাচ্ছে এবং পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করে পকেট ভর্তি করে টাকা নিয়ে আসছে (সাথে বোরোলিন আর কেউকার্পিন তেল), সে আমার রুমমেটদেরকে নিয়ে খিচুরি-বিরিয়ানি-দারু খেয়ে উড়িয়ে দিচ্ছে সেই অর্থ। বিষ্ণুর দিলখোলা স্বভাবের কারণে শেষপর্যন্ত আমাদের রুমমেটদের সাথে গভীর বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে গেল তার। আমাদের রুমমেটরা দুষ্টুমি করে বিষ্ণুর নাম দিয়েছিল ‘বিষ্ঠা’। কখনও তারা বিষ্ণুকে ‘পূর্ণ’ বা বিকৃতভাবে ‘পূণ্য’ নামে ডাকত। সেটা বিষ্ণুর আরেকটা নাম। এ নামেই তাকে ডাকে তার পরিবারের মানুষজন। মাসপয়লাতেই বন্ধুবান্ধবদের পেছনে সব টাকা বিষ্ণু উড়িয়ে দিত বলে আমাদের রুমমেটরা তাকে বাকি তিন সপ্তাহ ধরে টেনেছে অনেক- অর্থ দিয়ে, খাদ্য দিয়ে। ক্ষিধেই কাতর কেউ যদি ভুবনজয়ী হাসিতে এসে বলে- ‘ভাই! আমার খুব ক্ষিধে পেয়েছে!’ তখন তাকে কী বলে ফেরানো যাবে?
আমি লক্ষ করলাম, বাংলা কবিতা তো বটেই, কথাসাহিত্যের ক্লাসিক সব পড়া হয়ে গেছে বিষ্ণুর। জানতে পারলাম, ঝিনাইদহের নলডাঙা স্কুলের একটা ভাল লাইব্রেরি ছিল। সেখান থেকে বই ধার নিয়ে সে পড়ে ফেলেছ অনেক কিছুই। এতে করে আমার একটা সুবিধে হয়েছিল- বিভিন্ন বই নিয়ে তার মন্তব্য জানতে পারছিলাম আমি। এই গুণের কারণে ক্যাম্পাসের লেখকদের সাথে তার গভীর সক্ষ্য তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এ গুণটা মিলেছিল তার দিলখোলা স্বভাবের সাথে। সেই সময়টাতে যেহেতু সে আর আমি হরিহর আত্মা ছিলাম কাজেই লেখকদের সাথে আমারও আড্ডা দেয়া পড়ছিল নিয়মিতভাবেই। এর মাঝে, ১৯৮৪ আর ১৯৮৫-তে, অল্প ক’টা রোমান্টিক কবিতা লিখেছিল বিষ্ণু। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসভিত্তিক পত্রিকাতে ছাপা হয়েছিল তার দু’একটা। তবে সে দেশের জাতীয় কোনও দৈনিক বা সাপ্তাহিকীতে কখনোই তার কবিতা ছাপতে দেয়নি। ১৯৮৬-র পয়লা দিকে দেখা গেল, বাঁক বদল হচ্ছে তার কবিতার- রোমান্টিক কবিতার পাশাপাশি নৈর্ব্যক্তিক কবিতা লিখছে সে, বাহবাও পাচ্ছে। এর কারণ হলো এই যে ততদিনে আমরা দু’জনাই ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরি থেকে রোমান্টিক এবং আধুনিক ইংলিশ কবিদের বই তুলছি দেদারসে আর পড়ছি জম্পেশ করে। তখন টি. এস. এলিয়ট, ম্যাথিউ আর্নল্ড আর টেড হিউজ আমাদের প্রিয়তম কবিতে পরিণত হয়েছেন। দ্বিতীয়ত, কবি অসীমকুমার দাসের সাথে আমাদের সক্ষ্য গড়ে উঠেছে সেই সময়টাতে, বিষ্ণুর সাথেই বেশি। তখন চুটিয়ে কবিতা লিখছেন অসীমকুমার দাস। এসব কারণে বিষ্ণুর কবিতাতে দর্শন এবং ইন্টারটেক্সুয়ালিটির সমাবেশ ঘটতে শুরু করল। দ্বিতীয় পর্যায়ের কবিতাও কোথাও ছাপতে দিচ্ছিল না বিষ্ণু।
কবিতা লিখবার জন্য নির্দিষ্ট কোনও খাতা ছিল বিষ্ণুর। সাধারণত, ছেঁড়া কাগজে সে কবিতা লিখত এবং কবিতাগুলো সে বিভিন্ন বই, বিশেষ করে গীতবিতানের ভাঁজে ভাঁজে রেখে দিত। তার হাতে লিখা কবিতাগুলোর কিছু কিছু রয়ে যাচ্ছিল তার বন্ধুদের কাছে। পরে, ১৯৮৭-তে শামসুল কবির কচি আর এনায়েত কবির টুকুন মিলে যখন ‘পেঁচা’ নামের ছোট কাগজ বের করে তখন সেখানে এ পর্যায়ের ক’টা কবিতা ঠাঁই পায়। ‘পেঁচা’-র দ্বিতীয় সংখ্যা বের হয় ১৯৮৯-তে। সেখানেও প্রকাশিত হয় তার ক’টা কবিতা। ‘পেঁচা’-র প্রকাশনার সাথে প্রথম থেকেই যুক্ত ছিল বিষ্ণু- বাবার জমি বেচা টাকা দিয়ে, নিজের শ্রম দিয়ে। ‘পেঁচা’-র দ্বিতীয় সংখ্যা বের হবার পেছনে তারই চাপাচাপিও ভুমিকা রেখেছিল।
১৯৮৬ সালের কথা বলছি। বিষ্ণু বেড়াতে যায় কোলকাতা, মাদ্রাস আর ত্রিভেন্দ্রামে। ফিরে এসে সে গল্প করে অনেক। আমার মনে হয়, কন্যাকুমারীকা যেতেই হবে আমাকে! সে একটা সুতির জ্যাকেট কিনে নিয়ে আসে। সুযোগ পেলেই আমি তা গায়ে লাগিয়ে ঘুরে বেড়াই। বিষ্ণুর প্রেমিকাভাগ্যকে ঈর্ষা করতে করতে আমি হীনমন্যতায় ভুগি। এসবের মাঝে আমরা কবিতা পড়ি, আবৃত্তি করি, ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াই ক্যাম্পাসে। কোনও এক দিন একটা ক্যাসেট-প্লেয়ার কেনে বিষ্ণু- সেটাতে আমরা সারাদিন রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজাই- ঋতু গুহ, দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র, সুবিনয় রায়, কণিকা বন্দোপাধ্যায়, শান্তিদেব ঘোষ, পঙ্কজকুমার মল্লিক, কুন্দনলাল সায়গল, কানন দেবী প্রমুখের গান। গানগুলো ক্যাসেটে বন্দী করে নিয়ে আসে বিষ্ণু আর নিশাত জাহান রানা। ক্যাসেট-প্লেয়ারটা কখনও চলে যায় রোকেয়া হলে, নিশাত জাহান রানার কাছে। তখন ফাঁকা ফাঁকা লাগে আমার। বিকল্প হিসেবে আমাদের রুমমেট জলিল ভাই তার রেডিওতে আকাশবাণীর গান বাজায়।
এই সময়টাতে আমাদের আড্ডার আকার বাড়তে শুরু করে। আমাদের সাথে যোগ দেয় শিক্ষকপাড়ার ছেলেমেয়ে- কল্যাণী রমা, সুম্মিতা আনোয়ার, ইমতিয়াজ আহমেদ, মুজতবা হাকিম প্লেটো, লাইসা আহমেদ লিসা, ফারহানা শাওন প্রমুখ। কল্যাণী রমার সাথে বিশেষ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে বিষ্ণুর। এবাদে আমরা ঢুকে যাই কবি রাজা হাসান, কবি স্বদেশবন্ধু সরকার, কথাশিল্পী মামুন হুসাইন, আবৃত্তিকার ফারহানুর রহমান অপি, আবৃত্তিকার ও গায়ক মিজানুর রহমান লিখন প্রমুখদের বিশাল দলে। এসব আড্ডার অন্যতম মধ্যমণি হয়ে থাকে বিষ্ণু। সে তার প্রগাঢ় স্বরের আবৃত্তি, গান আর সাহিত্য বিষয়ক আলোচনা দিয়ে ভরে দেয় আড্ডাগুলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেটের মন্টুর দোকানে আমরা প্রায় সারাদিনই বসে থাকি তখন। সেখানে যে যার লিখা কবিতা নিয়ে আসে, পাঠ করা হয় কবিতাগুলো। কবিবন্ধুদের প্রভাবের কারণে তখন আমিও ক’টা কবিতা লিখবার চেষ্টা করেছিলাম বটে।
এদিকে আমাদের অনার্স পরীক্ষা সমাসন্ন। আমি প্রস্তুতি নিচ্ছি, বিষ্ণু কিন্তু পড়ছে না কিছুই! সে বলছে- ঘন্টা হবে পড়াশোনা করে! আমিও তার সাথে একমত হই। কিন্তু আমার ভয় হয় এই ভেবে যে ভাল রেজাল্ট না করতে না পারলে সহজে আর চাকরিবাকরি তো আর মিলবে না! কাজেই পড়াশোনা না করলে চলবে কী করে? সে আমাকে অভয় দেয়- ভাবিস না! দিন চলে গেলেই হলো! চাকরি করে কোন শালা! আমি শুধাই- তো তোর চলবে কী করে? বিষ্ণু উত্তর দেয়- জমিজমা সব বেচে দেব! মানতেই হবে, ঝিনাইদহের বিষয়খালিতে ওদের পরিবারের তখন বিস্তর জমিজমা ছিল। সে পরিবারের একমাত্র সন্তান হওয়াতে সেই সম্পত্তিতে ভাগ বসানোর কেউ ছিল না। আমাদের এসব ভাবনার ভেতরে অনার্স-পরীক্ষা ১৯৮৬ থেকে পেছাতে পেছাতে ১৯৮৭-তে চলে গেল। সেশনজটটা লেগেছিল স্বৈরাচারী সরকারের সাথে ছাত্রদের সংঘর্ষের কারণে। স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দোলনের পরিণতিতে ১৯৮৭ সালে আবারও অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ হয়ে যায় সকল বিশ্ববিদ্যালয়। আমি ঢাকা-পাবনা করতে থাকি, বিষ্ণু ফিরে যায় ঝিনাইদহতে। দীর্ঘ ছুটিতে চিঠি বিনিময় করি আমরা। সেসব চিঠির দু’একটা এখনও হয়ত খুঁজে পাওয়া যাবে আমার পুরোনো কাগজপত্রের ভেতরে।
অনির্দিষ্ট কালের বন্ধ (আমরা কৌতুক করে যাকে ‘এরশাদ ভ্যাকেশন’ বলতাম) শেষে ক্যাম্পাসে ফিরে গিয়ে আমরা ১৯৮৮ সালে অনার্স পরীক্ষা দেই। বিষ্ণু রাতারাতি পড়ে পরীক্ষা দেয় এবং আমাদের সবার মতো করে সেকেন্ড ক্লাস পেয়েও যায় সে। যাহোক, অনার্স পরীক্ষার পরপরই বিষ্ণু আর আমি ঢাকায় চলে আসি। আমি যথারীতি সিদ্ধেশ্বরীতে আমার নানুর বাসায় আশ্রয় গ্রহণ করি। আর বিষ্ণু থাকতে শুরু করে শহরের বিভিন্ন মেস আর বন্ধুদের ডেরায়- আজ মালিবাগে, তো কাল আরামবাগে, পরশু কমলাপুরের সর্দার কলোনিতে। এই পর্যায়তেও ঝিনাইদহের কিছু পৈতৃক জমি বিক্রি করে দেয় সে। এক সপ্তাহের ভেতরে বন্ধুবান্ধব নিয়ে ভালমন্দ খেয়েদেয়ে, সাকুরাতে বসে দারু গিলে হাজার হাজার টাকা উড়িয়ে দিয়ে সে ফতুর হয়ে যেতে থাকে। অবস্থা বেগতিক দেখে বিষ্ণুর ঘনিষ্ঠতম বন্ধু নিশাত জাহান রানা তাকে ঢুকিয়ে দেয় আরামবাগের একটা প্রকাশনাসংস্থায়। সেখানে এক হপ্তার বেশি টেকেনি সে। তার ভুলো মন আর কাজের ক্ষেত্রে তার ক্যাজুয়াল দৃষ্টিভঙ্গীই এর জন্য দায়ী বলে মনে হয়েছিল আমার কাছে। আমি তখন নিউজপ্রিন্টে ছাপানো কিছু পত্রপত্রিকার জন্য খবর অনুবাদ আর বুকরিভিউ করছিলাম। তাতে করে চা-সিগারেটের টাকা উঠছিল বটে। তবে বিষ্ণু সেসব দিকে গেল না- অস্থির জীবনের ভেতরে বসে কবিতা লিখাতেই মনোযোগ দিল সে।
শাহবাগে আড্ডা দিতে যাবার ব্যাপারে আপত্তিই ছিল আমার! এর কারণ হলো, খসরু মামা (চলচিত্রামোদী মুহম্মদ খসরু) আর রাজা মামা বিশ্ববিদ্যালয়-জীবন থেকে আমার মামার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। আমার মামা একদা তাদের সাথেই আড্ডা দিয়েছেন সিনোরিটাতে। সেটা সত্তর দশকের কথা। কাজেই খসরু মামা আর রাজা মামা যেখানে আছেন সেখানে গিয়ে বোলচাল মারাটা আমার জন্য অস্বস্তিকরই ছিল। তবু বিষ্ণু নাছোড়বান্দার মতো লেগে রইল আমার পিছে। তারপর আমি ১৯৮৮ থেকে নিয়মিতভাবে শাহবাগের বিভিন্ন গ্রুপের সাথে আড্ডা দিকে শুরু করি। এই সময়টাতে বিষ্ণুর সবচাইতে খাতির গড়ে ওঠে ‘প্রসূণ’-এর কবি সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের সাথে। বিষ্ণুর এই পর্বের ক’টা কবিতা পরে ‘গান্ডীব’-এ ছেপেছিলেন তপনজ্যোতি বড়ুয়া। তবে কোনও বড় কাগজে কখনোই লিখেনি বিষ্ণু। লিটিল ম্যাগাজিনগুলো তার কবিতা ছাপল কি ছাপল না তা নিয়েও কোনও মাথাব্যথা ছিল না তার। সে কেবল কবিতাচর্চাই করতে চেয়েছিল; করেও ছিল তাইই! এমন নির্মোহ লেখক তখন আমি খুব একটা দেখিনি!
অনার্সের রেজাল্ট বেরুলে বিষ্ণু সিদ্ধান্ত নিল যে সে আর মাস্টার্স করবে না কেননা কোথাও কোনও চাকরি পেতে গেলে মাস্টার্স ডিগ্রির কোনও প্রয়োজন নেই। যুক্তিটা আমারও মনে ধরেছিল। তবে যা হয়, ক্লাস শুরু হয়ে যাবার মাস দু’য়েক পরে আমার ভয় লেগে গেল- মাস্টার্স না করলে যদি ভদ্রস্থ কোনও চাকরি না পাই! তাই আমি মাস্টার্স করতে চলে গেলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ততদিনে প্রায় তিন মাস ক্লাস হয়ে গেছে সেখানে। সেটা ১৯৮৯-র মার্চ-এপ্রিলের কথা। মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়ে ঢাকায় ফিরে এলাম ডিসেম্বরের শেষদিকে। ফিরে এসে দেখি, বিষ্ণু থাকছে মালিবাগ চৌধুরীপাড়ায়, শামসুল কবির কচির সাথে (শামসুল কবির কচিকে সে ‘আমার জন্মজন্মান্তরের ভাই’ বলে ডাকত)। নিশ্চিন্ত হলাম এই কারণে যে কচি ভাই খুব দরদী মানুষ, সে বন্ধু-অন্ত প্রাণ- তার ডেরা সব সময়েই বন্ধুবান্ধবের জন্য খোলা থাকত। তাই সেখানে বিষ্ণুর অযত্ন ঘটবার কোনও সম্ভাবনা নেই। তারপর কি হলো, বিষ্ণু আবারও থাকতে শুরু করল বিভিন্ন মেসে, বিশেষ করে সর্দার কলোনিতে। মেসবাসের মতো মানবেতর জীবন মেনে নিয়ে সে কবিতা লিখা চালু রাখল আর ক্যালেন্ডার করা পোশাক পড়ে লিটিল ম্যাগাজিনের কবিদের সাথে সে আড্ডা দিতে থাকল শাহবাগে। এমনও দিন গেছে, বিষ্ণুর পকেটে খাবার কেনার মতো অর্থ থাকেনি। তখন, বলতেই হবে, আমাদের বন্ধুরা নানান ভাবে সাহায্য করেছে তাকে। কিন্তু তার মুখে হাসি ছাড়া কিছুই দেখেনি সে।
যাহোক, ১৯৮৯-র শেষে ঢাকাতে ফিরে এসে দেখি, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, এনায়েত কবির আর শামসুল কবির কচি বাদেও বিষ্ণুর সাথে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে সৈয়দ তারিক, সুমন রহমান আর ফরিদ আহমেদের। স্বাভাবিকভাবে এই দলেই আমি ভিড়েছিলাম। তবে বলতেই হবে, শাহবাগের সবার সাথেই সমান তালে মিশেছে বিষ্ণু। কখনও সে ঘুরেছে তপনজ্যোতি বড়ুয়াদের সাথে, কখনও সে বসেছে কাজল শাহনেওয়াজদের সাথে, কখনও নিশাত জাহান রানাদের সাথে, সবগুলো গ্রুপ মিলে যখন বসছে গিয়ে পিজি হাসপাতালের ভেতরের চত্বরে তখনও সেখানে গাঞ্জার ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় আলো ছড়াচ্ছে বিষ্ণু- গলা ছেড়ে জলদ গম্ভীর কন্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছে সে, তার সাথে গলা মেলাচ্ছে কেউ কেউ; সে আবৃত্তি করছে কখনও। শাহবাগে আড্ডা দিয়ে রাতের রমনা পার্কের ভেতর দিয়ে বিষ্ণু আর আমি প্রায়শই হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম শান্তিনগর মোড়ের দিকে। চার মাথা থেকে সিদ্ধেশ্বরীতে ফিরছি আমি, বিষ্ণু চলে যাচ্ছে কমলাপুরে। ব্রাত্য রাইসু কখনও সঙ্গী হতো আমাদের। তাদের বাসা ছিল বাড্ডায়। তখন আমি মতিঝিলের একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি নিয়েছি; সকাল থেকে বিকেল অবধি আটকে থাকি অফিসে; বিকেলে বাসায় না গিয়ে সোজা চলে যাই টিএসসি-শাহবাগ এলাকাতে। আমি চাকরি করি, অন্যদিকে বিষ্ণু, সুব্রত, সৈয়দ তারিক আর ফরিদ সারা দিন মাতাল অবস্থায় ঘুরে বেড়ায় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়, কখনও তারা দুপুরের খানা খেতে চলে যায় সুব্রতদের ডাইলপট্টির বাসায়, যখন তখন আড্ডা মারতে বসে যায় শামসুল কবির কচির ডেরা ফকিরাপুলের ‘হোটেল গ্রিনলিফ’-এ। তুরীয় অবস্থাতে থাকলেও সে সময়ে তাদের কবিতা রচনাতে কোনোই ভাটা পড়েনি।
১৯৯২ সালে শাহবাগে গাঞ্জার জায়গাতে জনপ্রিয় হয়ে উঠল ড্রাগ- হেরোইন, পেথিড্রিন, ইউনোক্টিন ইত্যাদি। সেই হাওয়া লাগল গিয়ে বিষ্ণু, সুব্রত, সৈয়দ তারিক আর ফরিদের গায়েও। এই পর্যায়ে বিষ্ণু গদ্যকবিতা লিখেছিল কিছু। যাহোক, বিষ্ণুর শারিরীক আর মানসিক অবস্থার অবনতি হলো, কপালগুণে আর কারও তা হলো না। এদিকে ১৯৯২-র ডিসেম্বরে অযোধ্যার বাবরি মসজিদে উগ্র ভারতীয়রা আক্রমণ করে বসে। তার অভিঘাত এসে পড়েছিল বাংলাদেশেও- সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছিল সাম্প্রদায়িকতা। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, ঢাকেশ্বরী মন্দিরে আক্রমণ করা হয়েছিল তখন- মন্দিরের ইমারতের একটা অংশের খানিকটা ভেঙে দেয়া হয়েছিল, আগুনও দেয়া হয়েছিল সেখানে। পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারত। প্রশাসন এবং জনগণের সচেতনতার কারণে তা আর হয়নি। এমন একটা সাম্প্রদায়িক উস্কানিতে ভয়ানক আতঙ্কিত হয়ে পড়ল বিষ্ণু। তার মনে হচ্ছিল, একটা সাদা রঙের মোটরকার তাকে অনুসরণ করে বেড়াচ্ছে সারাক্ষণ। তার দৃঢ় ধারণা হলো, সে যেহেতু ধর্মীয় সংখ্যালঘিষ্ঠদের একজন সদস্য তাই তাকে মেরে ফেলার জন্য ছুরি হাতে তার পিছে লেগে রয়েছে কোনও আততায়ী। অবস্থা এমন দাঁড়াল যে আদৃশ্য আততায়ী থেকে সে কেবল লুকোতে লাগল, একা আর চলতে পারছিল না সে- সবসময় সে কোনও না কোনও বন্ধুকে ধরে শাহবাগে আড্ডা দিতে যাচ্ছিল, ডেরায় ফিরছিলও একই পদ্ধতিতে; ঘুমাতেও পারছিল না ঠিকমতো; খেতেও পারছিল না। এই সময়টাতে আমাদের বন্ধুরা তাকে অনেক সময় দিয়েছে। আমি তাকে কিছু দিন আমাদের সিদ্ধেশ্বরীর বাসায় রেখেছি তখন। তবে মুশকিল হচ্ছিল এই যে আমি অফিসে চলে যাবার পরে তাকে দেখভাল করবার মতো কেউ থাকছিল না। বিষ্ণুর বন্ধুদের সকলেই যেহেতু তখন ব্যস্ত ছিলেন জীবন-জীবিকা নিয়ে কাজেই তারাও আমার মতোই মনঃস্তাপে ভুগছিলেন। শেষে বিষ্ণুর অকৃত্রিম বন্ধু নিশাত জাহান রানা বিষ্ণুকে ভর্তি করে দিল লালমাটিয়ার মনোরোগ ক্লিনিকে। ডাক্তার বলেছিল, অসুখটা আসলে স্কিৎজোফ্রেনিয়া। সেখানে সপ্তাহ তিনেক ছিল সে। মনোরোগ ক্লিনিক থেকে ফেরার পরে তার ড্রাগ নেয়া কমল বটে, তবে গেল না একবারে। এ সময়টাতে শহরের বিভিন্ন মেসে মেসে সে ভেসে বেড়াচ্ছিল। কবিতা লিখাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তার। সারাক্ষণ একটা ভেজিটেটিভ স্টেটে ডুবে থাকছিল সে। এদিকে অস্থিরতার কারণে কোথাও সে একনাগাড়ে থাকতে পারছিল না। আজ এই বন্ধুর বাসায় তো কাল অন্য বন্ধুর বাসায় অথবা কোনও মেসে- এভাবে দিন কাটাচ্ছিল সে। তখন সবাই মিলে তাকে পরামর্শ দিয়েছিল ঝিনাইদহতে গিয়ে নিজের মা’র কাছে কিছু দিন থেকে আসতে। সেই মতো বিষ্ণু চলে গেল রাজশাহীতে। সেটা ১৯৯৩ সালের পয়লা দিকের কথা। তার পরিকল্পনাটা ছিল এমন যে সে কবি অসীমকুমার দাসের সাথে কিছু দিন সময় কাটিয়ে চলে যাবে ঝিনাইদহতে। তাইই সে করেছিল। এর পরেই হারিয়ে যায় বিষ্ণু। আমরা ভেবেছিলাম, ক’দিন পরেই সে ফিরে আসবে ঢাকায়। সেটা আর ঘটেনি অবশ্য।
বিষ্ণু বিশ্বাসের অন্তর্ধান নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরেই নানান রকমের গুজব শোনা যাচ্ছিল- মারা গেছে বিষ্ণু অথবা সে দেশান্তরী হয়েছে। ২০১৪-র দিকে কবি নভেরা হোসেনের সূত্রে খবর মিলল বিষ্ণুর- মা’র সাথে থাকছে সে; কোনও এক গ্রামে। নিশাত জাহান রানাও তেমনটাই খবর পেয়েছিল। সে তিন বার গিয়ে দেখা করে এল বিষ্ণুর সাথে, একবার তার সাথে নাহার মওলাও গিয়েছিল, সাহিদুল টুকুও গিয়েছিল একাই। জানলাম, খুব অসুস্থ ছিল বিষ্ণু। নিশাত জাহান রানা আর সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ দূরে বসেই তাদের বন্ধুদেরকে দিয়ে বিষ্ণুর চিকিৎসা করাল। কিছুটা সুস্থ হলো সে। তারপর নিশাত জাহান রানা ২০১৫-র মাঝামাঝি ঢাকাতে নিয়ে এল তাকে। ঢাকাতে এসে পয়লাতে সে উঠল কবি ও কথাশিল্পী এনায়েত কবিরের ধানমন্ডির বাসায়, সেখানে মাস ছয়েক থাকবার পরে সে চলে গেল নিশাত জাহান রানার মহাখালির বাসাতে। এনায়েত কবিরের বাসায় বসে বিষ্ণুর সাথে গল্প করতে করতে আমি জানলাম: বিষ্ণুর বেড়াল আছে ক’টা; সে ঘরে বসেই বেশির ভাগ সময় কাটায়; সে সস্তা বিড়ি খায়; মাঝে মাঝে হাটে যায় চা খেতে; কবিতা লিখে না, কথায় কথায় আবৃত্তি করে না, গানও গায় না আর; কারও সাথে কথাটাথাও বলে না; বিষ্ণুর স্বজনরা তাকে বিয়ে দিয়েছিল, মেয়েটা সপ্তাহ দুয়েক বাদেই চলে গেছে (আমি বললাম- সে কী রে? চলে গেল? তো তুই কী করলি? বিষ্ণু উত্তর দিল- দূর! আমি তার কী করব?)। সে ঢাকাতে আসবার পরে তার শরীরের যে হাল দেখলাম তা আসলেই ভয়ঙ্কর ছিল: শুকিয়ে সে কাঠ হয়ে গেছে যেটাকে অসুস্থতা আর অপুষ্টির চিহ্ন ছাড়া আর কিছু বলবার অবকাশ ছিল না; লম্বা মানুষটা খানিকটা কুঁজো হয়ে পড়েছে; তার সেই সুদর্শন চেহারাটা আর নেই; সারাটা ক্ষণ কি যেন ভাবে সে; নিজে থেকে তেমন একটা কথোপকথনে নামে না। মোদ্দা কথা- সেই সদাহাস্যময়, প্রাণোচ্ছল বিষ্ণুকে আর পেলাম না আমি! এনায়েত কবির সদাহাস্যে বিষ্ণুর থাকা-খাওয়া বাদেও সিগারেট সাপ্লাইয়ের দায়িত্ব নিয়েছিল। বিষ্ণু তখন প্রয়াত চিত্রকর আব্দুস সালামের পরামর্শ মতো শেখ ব্রান্ডের সিগারেট ধরল। মিজানুর রহমান লিখন আর আমি বিষ্ণুকে সিগারেট কিনে দিচ্ছিলাম। নিশাত জাহান রানার মহাখালির বাসাতে চলে যাবার পরেও আমরা বিষ্ণুর সাথে দেখা করতে গেছি। ওখানে একদিন তপনজ্যোতি বড়ুয়া আর শান্তনু গিয়েছিলেন। আমাদের বন্ধুরা বারবার বিষ্ণুর সাথে দেখা করবার আগ্রহ প্রকাশ করছিল; তারা বলছিল- বিষ্ণুকে বাসার বাইরে নিয়ে এস। তাকে তো পথেই মানায়! কিন্তু অনেক সাধাসাধির পরেও বিষ্ণু কোথাও যেতে চায়নি।
এনায়েত কবির, মিজানুর রহমান লিখন, নভেরা হোসেন, আব্দুস সালাম আর নিশাত জাহান রানার উৎসাহে বিষ্ণু কবিতা লিখতে বসল শেষপর্যন্ত। নিশাত জাহান রানা তার নিজের অফিস ‘যুক্ত’-র একটা রুম ছেড়ে দিল বিষ্ণুর জন্য; বিষ্ণু বিজয়লিপিতে টাইপ করা শিখে নিল; কবিতাও লিখল বেশ ক’টা। আমরা দেখলাম, ধীরে ধীরে জট খুলছে তার চিন্তার। প্রায় চব্বিশ বছরের অনভ্যাস তো আর কম কিছু নয়! ১৯৯৩-র পয়লাতে ঢাকা ছেড়ে যাবার পরে সে আর কবিতা লিখেনি; কোনও বইটইও পড়েনি! অজ পাড়াগাঁতে বই আসবেই বা কোথা থেকে? এ যাত্রায় ঢাকাতে বসে লিখা সেসব কবিতা নিশাত জাহান রানার কাছেই রয়ে গেছে, বিষ্ণু আর সেসব সাথে করে নিয়ে যায়নি।
২০১৬-র শেষের দিকে বিষ্ণু আমাকে বলল, ঢাকাতে তার আর ভাল লাগছে না। কারণটা তবে কী? অনেক আলাপেও তার ভাল না লাগবার কারণ আমি পরিষ্কার করে বুঝতে পারিনি। এমন হতে পরে, চব্বিশ বছর আগে যে জলহাওয়া সে ফেলে গিয়েছিল তা সে আর খুঁজে পায়নি। এমনটা তো ঘটে অনেকের বেলাতেই। তাই ২০১৬-র ডিসেম্বরে অনিচ্ছাতেই বিষ্ণুকে তার মা’র কাছে রেখে এল নিশাত জাহান রানা। ততদিনে আবারও কবিতা লিখা বন্ধ করে দিয়েছে বিষ্ণু।
উত্তাল আশির কবিতার অন্যতম এক কন্ঠস্বর বিষ্ণু বিশ্বাস। আমি তাকে কবি হিসেবে বেড়ে উঠতে দেখেছি; প্রত্যক্ষ করেছি কবিতায় তার বাঁক বদলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টাকে। তার এই প্রচেষ্টা কেবল ব্যক্তিক প্রক্রিয়া ছিল না- লিটিল ম্যাগাজিনের গোষ্ঠীবদ্ধ আন্দোলনেও সে তার মেধা নিয়োগ করেছিল। এ কারণে সে প্রথাগত পথে হাঁটেনি; স্বনামধন্য সাহিত্যিকদের সাথে উঠবস করেনি; বড় কাগজে কবিতা ছাপতে দেয়নি কখনও। তা’তে করে কোনও ক্ষতি হয়নি তার, সে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে ঠিকই। লক্ষণীয়, সে কোনও সাহিত্য-পুরস্কার পায়নি। তবে কিছু যায়-আসেনি তার। বিষ্ণু বলত, খিস্তি দিয়েই, যা ভদ্রচিত ভাষাতে অনুবাদ করলে এমনটা দাঁড়ায়- নতুন কিছু সৃষ্টি করার প্রচেষ্টাটাই বড় কথা। জুরিরা যে নতুন প্রচেষ্টাকে চিহ্নিত করতে পারবে, স্বাগত জানাবার মতো যোগ্যতা রাখবে- তেমনটা না-ও হতে পারে! তাই এইসব পুরস্কারের খ্যাতায় আগুন দেই আমি!
আশির দশক এবং নব্বইয়ের শুরুর দিকে বিষ্ণু বিশ্বাস যেসব কবিতা লিখেছিল সেগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়ে গিয়েছিল তার বন্ধুদের কাছে। ১৯৯২-তে সেগুলোর কিছু এক জায়গাতে করে সে ‘ভোরের মন্দির’ নামের একটা পান্ডুলিপি তৈরির কাজে হাত দিয়েছিল। পান্ডুলিপিটা অসম্পূর্ণ রেখেই হারিয়ে যায় বিষ্ণু। ওর বাল্যবন্ধু জীবনের কাছে রয়ে গিয়েছিল পান্ডুলিপি। বিষ্ণুর রেখে যাওয়া পান্ডুলিপিটার সাথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আরও কিছু কবিতা যোগ করে নিশাত জাহান রানা তাদের প্রকাশনী ‘যুক্ত’ থেকে কবিতার বইটা বের করে। পরে সুব্রত অগাস্টিন গোমেজের সম্পাদনায় বইটার দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। অদ্যাবধি সেটাই বিষ্ণুর একমাত্র বই। এই এক বইতেই সে তার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছে, পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে সে দুই বাংলাতেই। ব্যাপারটা ঈর্ষণীয় বৈকি! যতদূর মনে পড়ে, স্প্যানিশে তার ক’টা কবিতার অনুবাদ করেছিলেন কেউ।
নিশ্চয় কবি-আবৃত্তিকার-গায়ক বিষ্ণু বিশ্বাসের সাথে আবারও আমাদের দেখা হবে- এই শহরে না হোক, অন্য কোথাও। আমরা গলা ছেড়ে আবারও গান গাইব- ঝরা পাতা গো, ঝরা পাতা গো! আমি তোমারই দলে!
মিরপুর ডিওএইচএস, ঢাকা
১৫-১৭ জুলাই ২০২২