আমার পঁচিশে বৈশাখ
অমিতা মজুমদার
খুব সাধারণ আমি কী করে লিখি তাঁর কথা। মহাসমুদ্র সম যিঁনি তাঁর এক গণ্ডূষ জলও তো পান করতে পারিনি আমি।তাই তাঁকে নিয়ে লেখার দুঃসাহস নাইবা করি।
শিশু বয়সে যাকে চিনেছিলাম বাড়িতে রাখা কাচের ফ্রেমে বন্দি মনীষিদের ছবির সারিতে দেখে। বর্ণ পরিচয়ের আগে বড়োদের শেখানো কবিতা ‘পুরাতন ভৃত্য” “বীর পুরুষ” না বুঝেই তোতা পাখির মতো স্কুলের বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে টেবিলের উপর দাঁড়িয়ে বলে।
বর্ণপরিচয়ের পরে ধীরে ধীরে লম্বা জামা পড়া পেছনে হাত রাখা সাদা শশ্ম্রুমণ্ডিত মানুষটাকে জানলাম রবি ঠাকুর বলে। যাঁকে অন্যান্য ইষ্ট দেবতার সাথে প্রণাম করতে হয়।
স্কুলে যেতে যেতে একসময় হাতে আসে গল্পগুচ্ছ,সঞ্চয়িতা।এর চেয়ে বেশি কিছু পাওয়ার ভাগ্য গ্রামে বসে হয়নি। বাবার গলায় গান শুনতাম “মেঘের পরে মেঘ জমেছে আঁধার করে আসে,আমায় কেন বসিয়ে রাখো একা দ্বারের পাশে”।ছোটোরা যেমন এমনি এমনিই হরলিক্স খায় তেমনই এমনি এমনিই ভালো লাগে সঞ্চয়িতা পড়তে।একই কবিতা বার বার পড়ি তবু পড়ার ইচ্ছে ফুরায় না। এলো ১৯৭১ সাল সুরে বেসুরে সবাই গায় আর কাঁদে “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি”
“ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা”এরকম গান ছোট্ট রেডিওতে কান পেতে বড়োরা যখন শোনে তখন আমাদেরও চোখে জল আসে।জানলাম এসব রবি ঠাকুরের গান।
মুক্তিযুদ্ধ শেষে দেশে এসে স্কুলে গিয়ে উর্দূ গানের বদলে গাইতে পারলাম বাংলা গান।
আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি—-
স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হলো রবীন্দ্রনাথের গান। কিশোরবেলায় এতটুকু পরিচয়ই আমার রবিঠাকুরের সাথে। বয়ঃসন্ধি না পেরুতেই শেষের কবিতা পড়ে এপার বাংলার এক গ্রামের কিশোরীর চোখে লাবণ্য,অমিত,কেতকী,শোভনলাল যেমন চিরচেনা হয়ে গেল তেমনি দার্জিলিং নামক অদেখা শহরটাও যেন খুব চেনা হয়ে গেল।বয়ঃসন্ধির অস্ফুট অনুভবে এসেও ধরা দিলো সেই রবি ঠাকুর- কেউ একজন ছোট্ট চিরকুটে লিখে দিলো “ রাত্রে যদি সূর্যাশোকে ঝরে আশ্রুধারা,সূর্য নাহি ফেরে ,শুধু ব্যর্থ হয় তারা”
তারপর কখন যেন মনে হলো যাকিছু ভাবি সবটা জুড়েই তিঁনি। চার অধ্যায়,নৌকা ডুবি,গোরা,ঘরে বাইরে,নষ্টনীড়,মাল্যদান,সমাপ্তি সবটাই তো আমাদের চিরচেনা জগতের আপনজনের কথায় ভরা।খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তনের রাইচরণ বা পোস্টমাস্টারকে খুঁজে ফিরি লোকালয়ে যদি পেয়ে যাই!
মেঘে মেঘে বেলা গড়িয়ে যায় গ্রামের দুরন্ত শৈশব কৈশোরের বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো,পুকুরে নদীতে সাঁতার কাটা মেয়েটা এসে পড়লো মহানগরের ছকে বাঁধা জীবনে।দশটা পাঁচটার কর্মজীবন আর সংসার নামক ঊর্ণনাভের জালে জড়িয়ে যখন হাঁসফাঁস করত তখন একমুঠো দখিনা বাতাস হয়ে উঠত সঞ্চয়িতা নামের একখানা বই। বুঝে পড়া হয়নি কোনো কবিতা শুধু ভালোবেসে পড়া। সে হোক “এবার ফিরাও মোরে,নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ,অতীত,পরিচয়,দুই পাখি,সোনার তরী,নিষ্কৃতি,বা সাধারণ মেয়ে।
হতে পারে কর্ণ কুন্তী সংবাদ,বিদায় অভিশাপ আবার দু লাইনের
“কতো বড়ো আমি’কহে নকল হীরাটি।
তাইতো সন্দেহ করি নহ ঠিক খাঁটি।।
শেফালি কহিল,আমি ঝরিলাম তারা।
তারা কহে, আমারো ত হল কাজ সারা—
ভরিলাম রজনীরবিদায়ের ডালি
আকাশের তারা আর বনের শেফালি।।
আকাশে তো আমি রাখি নাই, মোর
উড়িবার ইতিহাস।
তবু, উড়েছিনু এই মোর বিশ্বাস।।
জীবনের তিন প্রহর কেটে গেল এভাবেই, আর দশটা ছাপোষা মানুষের যেমন হয় তেমন করেই। চার প্রহরের প্রথম লগ্নে হঠাৎ এলো এক অনাকাঙ্ক্ষিত প্রলয়। স্বাভাবিক ছন্দময় জীবনে ঘটল ছন্দপতন। দেশের ডাক্তার বললেন শেষ ঘন্টা বেজে গেছে, প্রতিবেশী দেশে যোগাযোগ করা হলে তারা যেতে বললেন এবং ভরসা দিলেন আশা আছে তবে বড়ো ধরনের অস্ত্রোপচার করতে হবে। কিন্তু অস্ত্রোপচারের পরে কোনোরকম ব্যথানাশক বা চেতনানাশক ওষুধ দেওয়া যাবে না।
অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হবে কিন্তু সেই ভয়াবহ সময়টা আমার ভয়াবহ হয়নি শুধুমাত্র তিঁনি ছিলেন বলে। চেতনে অবচেতনে ভুল শুদ্ধ এলোমেলোভাবে বলে গেছি সঞ্চয়িতার যেখান থেকে যা মনে এসেছে। অদ্ভুত এক ঘোরের মধ্যে কেটে গেছে সেই ভয়ংকর দিনগুলো।
আজও মনের আকাশে যখন মেঘ জমে,চিরতরে হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনদের কথা মনে পড়ে,কিংবা সেইসব প্রিয়মুখ যাদের ছেড়ে কখনো থাকব ভাবিনি তারা চলে গেছে দৃষ্টিসীমার বাইরে তাদের জন্য হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয় তখন আশ্রয় খুঁজি তাঁর সৃষ্টির মাঝে।
ইচ্ছে করে নিজের কথা নয় তাঁর কথাই বার বার লিখে যাই
কিন্তু আমার দুর্বলতায় তার বিন্দুসম লেখাও উল্লেখ করতে পারিনি।
শেষ কথা তাঁরই লেখা দিয়ে শেষ করি—
রূপ- নারানের কূলে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রূপ-নারানের কূলে
জেগে উঠিলাম;
জানিলাম এ জগৎ
স্বপ্ন নয়।
রক্তের অক্ষরে দেখিলাম
আপনার রূপ—-
চিনিলাম আপনারে
আঘাতে আঘাতে
বেদনায় বেদনায়;
সত্য যে কঠিন,
কঠিনেরে ভালোবাসিলাম—-
সে কখনো করে না বঞ্চনা।
আমৃত্যুর দুঃখের তপস্যা এ জীবন—-
সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে,
মৃত্যুতে সকল দেনা শোধ ক’রে দিতে।