বর্ষার মাতাল করা অপরূপ দৃশ্য যে কাউকেই উদাস করে। এক টানা রিমঝিম ছন্দে ছন্দে বৃষ্টির অবিরাম শব্দে মন পাগল হয় না এমন মানুষের সংখ্যা বিরল। কবি গুরুর কবিতায় যেমন করে বর্ষা এসেছে ‘ রাশি রাশি ভারা ভারা ধান কাটা হলো সারা কাটিতে কাটিতে ধান এলো বরষা।‘ অথবা আমার বর্ষা জলে ভেজা প্রেমের প্রথম কদম ফুল, গীতিকবির গানে, কবিতায় বর্ষা বন্দনা। সব শব্দই বর্ষায় বাংলার চিরায়ত রূপকে সাজানো।
আমি যে ভাবে বাংলার বর্ষা কে উপভোগ করেছি তাই এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। দিন নেই, রাত নেই আকাশ কেঁদেই চলছে। এক দিন, দুদিন করে সাতদিন পর্যন্ত ঝরছে তো ঝরছে থামার কোন নিশানা নেই। এ কয়দিন কালো মেঘে ঢেকে রাখা আকাশ সূর্য মামার দেখা নেই বহুদিন। মেঘলা আকাশে গুড় গুড় শব্দ আর মাঝে মাঝে বিদুৎ চমকানো। পথ ঘাট, মাঠ প্রান্তর, পুকুর জলাশয় জলে টইটম্বুর। মানুষের সীমাহীন কষ্ট বাড়িয়ে দেয়। অনেক সময় গবাদিপশু পাখি সহ একই ঘরে থাকতে হয়। পানির তোড়ে ঘর বাড়ি ভেসে যায়। তখন কেউ কেউ নৌকায় বসবাস করে। সাথে গবাদিপশু পাখি নিয়ে যায়। সে এক অসহনীয় যন্ত্রণা। নিজের খাবার ব্যবস্থা করা। গবাদিপশুর খাবার ব্যবস্থা করা খুব কঠিন হয়ে পড়ে।মানুষের দুর্দশার শেষ নেই। বর্ষায় ছোটরা মজা, আনন্দ একটু বেশিই করে। তাদের কাজ খাওয়া আর জলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো। সুযোগ পেলেই ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়া আর দীঘির জলে ডুব সাঁতার খেলা। শাপলা শালুক তোলা, মাছ শিকার, বৃষ্টির জলে ভেজা। ইচ্ছে করে কাঁদা মাটিতে আছড়ে পড়া, আম কুড়ানো আরও কত আনন্দ।। সে আর লিখে শেষ করা যাবে না। কখনো কখনো বৃষ্টি আর বজ্রপাত শুরু হয়। তখন বড়রা ছোটদের ঘর থেকে বের হতে দিতেন না। মা, চাচী, দাদী সবাই মিলে কাঁথা সেলাইয়ের কাজ শুরু করতেন। তখন ঘরের বাইরে কোন কাজ করার কোন সুযোগ থাকতো না। ছোটদের দিয়ে কাঁথা সোজা করে ধরে সেলাইয়ের জন্য সাহায্য নিতেন। এই সুযোগে ছোটরা কাঁথায় গড়াগড়ি খেতো। অনেকেই সুঁইয়ের খোঁচাও খেয়েছে। অবিরাম বৃষ্টির কারণে মোরগ মুরগী গুলো ঘরের পাশে ঢেলার উপর এক পায়ে ভর করে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকে আর ঝিমিয়ে পড়ে। তখন অবশ্য হাঁসদের আনন্দ বেড়ে যায়। যতদূর চোখ যায় ঘুরে আসে। বর্ষার থৈ থৈ পানিতে সাঁতার কাটার মজাই আলাদা। গৃহস্তের সংশয় থাকে সন্ধ্যায় হাঁস গুলো ঠিক ভাবে ঘরে ফিরে আসবে তো! নয়তো কাদা জল মাড়িয়ে খুঁজে আনতে হয়। সকালের নাস্তায় থাকতো মুড়ি বা খই খেজুরের গুড় মিশিয়ে মোয়া বানিয়ে খাওয়া। মিষ্টি আলু সেঁকে বা মিষ্টি আলু চুলার ছাইয়ের ভেতর পুড়ে খাওয়া।। কখনো কখনো মা, ফুফু দাদী অবসর থাকলে বিভিন্ন রকম পিঠা তৈরি করে দিতেন। বিকেলের নাস্তা বেশির ভাগ সময়ই হতো ডাটা শাক, কচু শাক বা পাট শাক সিদ্ধ সাথে শুকনো মরিচ টালা।
একটা কথা বলাই হয়নি আমাদের ছিল যৌথ পরিবার। একসাথে ১২/১৪ জন বাচ্চা থাকতাম। লম্বা লাইন ধরে বসে নাস্তা, ভাত, ঘুমানো সবই চলতো। সেই ফেলে আসা দিন আহা কি মধুর ছিল। বৃষ্টি থামতে দেরি আমাদের বের হতে দেরি হতো না। যদিও মায়ের বারণ আছে। বার বার কাপড় ভেজানো। মায়ের কষ্ট বাড়ে। শুকাতে সময় লাগে। রোদ নেই, শুকাতে দেওয়ার জায়গা নেই। তারপরও একটা ব্যবস্থা হয় চুলার উপর বাঁশ বা রশি বেঁধে কাপড় শুকানোর। কিন্তু সেখানে কয়টা কাপড়ই বা দেওয়া যায়? বৃষ্টি ভেজা পথ থাকে পিছলে। কর্দমাক্ত পথে জুতা বা চপ্পল পরে চলাও মুশকিল। পিচ্ছিল পথে কত যে আছাড় খেয়েছি তার হিসেব নেই। বর্ষার দিনে বৃষ্টি থামলে আমাদের যে কী আনন্দ হতো। বড়দের সাথে মাছ ধরতে জলে থৈ থৈ মাঠে চলে যেতাম। কখনো পুলের নিচে পানির স্রোতের সাথে আসা মাছ জাল ফেলে ধরতাম। মাছ ধরার আনন্দ বাড়তো যখন দেখতাম নব জলে বধুর সাজে রঙিন শাড়ি পরে মাছ গুলো আসছে। বিশেষ করে পুঁটি মাছ।
গ্রামের বাড়িতে বর্ষায় সবচেয়ে বেশি অসুবিধা হতো টয়লেট ব্যবহার। তখন ঘরের সাথে টয়লেট ছিলো না। ঘর থেকে একটু দূরে। বৃষ্টির ভেতর ছাতা বা মাথাল বা জোংরা মাথায় দিয়ে কাদা মাড়িয়ে টয়লেটে যাওয়া ছিল সব চেয়ে কষ্টের। কোথাও কোথাও দেখা যেতো টয়লেটসহ জলের নিচের ডুবে গেছে। সে এক মহাবিপদ। বৃষ্টির পানিতে কৃষকের ফসল ডুবে যেতো,মাছ চাষির মাছ ভেসে যেতো। অনেকেই এক বেলা ঠিক মতো খেতে পারতো না। কেউ কেউ মাড়সহ ভাত খেয়ে দিন কাটিয়ে দিতো।
এগুলো বর্ষার কষ্টের কথা। বর্ষায় ছোটদের ডাক পড়তো রসই ঘরে রান্নার সময়। আধ ভেজা লাকড়ি দিয়ে রান্না করতে গিয়ে আগুন জ্বালাতে মায়ের খুব কষ্ট হতো। তখন বাঁশের চোঙ্গা বা লোহার পাইপ দিয়ে ফুঁ দেওয়ার পর আগুন জ্বলে উঠত। কিন্তু এই সময় রসই ঘর সহ আশ পাশ ধোঁয়ায় ভরে যেতো। বৃষ্টি আর ধোঁয়া এক অদ্ভুত পরিবেশ তৈরি করতো। বৃষ্টি থামলেই আমরা বাড়ির পাশের দীঘিতে নেমে জল কেলিতে মত্ত্ব হয়ে যেতাম। কলাগাছ দিয়ে ভেলা বানিয়ে সারা দীঘিতে ভেসে বেড়াতাম। তবে খুব সাবধানে দীঘির কিনারে কিনারে ভেলা ভাসাতাম। দীঘির অশান্ত জল বাতাসে ঢেউ খেলতো, আমরা ভয় পেয়ে যেতাম। বর্ষায় জল বাড়ার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে শাপলা বাড়তো। আমরা খুব ভোরে কে কার আগে শাপলা তুলতে যাবো সেই প্রতিযোগিতা চলতো। শাপলা দীঘির জলে থেকেই খেতাম। বা বাড়ি এনে তরকারি রানা বা শাক ভাজা হতো। সেদিন আর ফিরে আসবে না। দীঘির জলে আমাদের মূল কাজ ছিল মাছ ধরা। বর্ষায় জল বাড়তো মাছও বড় হতো। বিশেষ করে শোল মাছ, বোয়াল মাছ। বর্ষার শুরুর কয়েকদিনের মধ্যেই শোল মাছ, টাকি মাছ পোনা ছাড়তো। আর মা মাছ পোনাদের নিয়ে দল বেঁধে চলতো। শিকারীরা মা মাছ ও পোনাসহ ধরে ফেলতো। তখন আমার খুব খারাপ লাগতো। আমি ভাবতাম বড় হলে পোনা গুলো অনেক মাছ হতো। আমরা অবশ্য টাঙা ফেলে ( এক ধরনের মাছ ধরার বর্শি) বড় বড় শোল বোয়াল ধরতাম। তাজা তাজা মাছের ঝোল দিয়ে গরম গরম ভাত খাওয়ার মজাই ছিলো অন্য রকম তৃপ্তির। ভারী বর্ষনে যখন জন জীবন স্থবির হয়ে যেতো তখন ছোটদের ঘরে আটকিয়ে রাখা খুব কষ্টকর ছিলো। ছোটদের ভুলিয়ে রাখার জন্য কিছুক্ষণ পর পর বাদাম, শিমের বিচি, ডাল, বুট, কাঁঠালের বিচি বা মিষ্টি কুমড়ার বিচি ভেজে দিতেন। যাতে সময়টা পার করা যায়। ছোটরা লুডু বা খেজুরের বিচি দিয়ে এক ধরনের খেলা খেলতো। এছাড়া পুতুল বিয়ে, মিছেমিছি রান্না করা, খাটের উপর। মায়ের শাড়ি দিয়ে ঘর তৈরি এমন অনেক খেলায় মেতে উঠতাম। বর্ষার সময় বেশি কষ্ট হতো খেটে খাওয়া মানুষদের। যারা দিন এনে দিন খেতো। কাজ নেই। আয় নেই। খাবার নেই। বড় অসহায় অবস্থায় পড়ে যেতো। এবাড়ি ও বাড়ি থেকে ধার দেনা করে চলতে হতো। এ দৃশ্য ছিলো খুবই করুন। অস্বচ্ছল পরিবারের খাবার ছিলো মাড় মেশানো ভাত আর তরকারির পরিবর্তে শুকনো মরিচ পোড়া। বিদ্যুৎ নেই, কেরোসিন তেল নেই, আলো জ্বালানোর ব্যবস্থা নেই। তখন সন্ধ্যার আগে আগে খাবার শেষ করে সন্ধ্যার পর পরই শুয়ে পড়তো। আরো কষ্ট গবাদিপশু নিয়ে। গরু ছাগলের ক্ষুধার জ্বালায় চিৎকার অনেক দূর থেকে শোনা যেতো। সুখ দুঃখ নিয়েই বাংলায় বর্ষা আসে। মানুষের জীবনযাত্রা থেমে যায়। জীবন ও জীবিকার ঘানি টানতে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। অন্যদিকে গাছ পালা পেলবতা খুঁজে পায়। পাতার রং সবুজ থেকে সবুজতর হয়। রোদের আলোয় ঝিকমিক করে সবুজবীথি।। নতুন স্বপ্ন নিয়ে পথচলা শুরু।।