আমাদের উপযুক্ত শব্দ ও ভাষাগত ত্রুটি
এইচ বি রিতা
একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের বাংলা ভাষা ব্যবহারকারীদের জন্য গৌরবোজ্জ্বল একটি দিন। একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের দিন, বাঙালির ভাষা আন্দোলনের মর্মন্তুদ ও গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতিবিজড়িত একটি দিন। এইদিনটি বিশ্বের অনেক দেশেই গভীর শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠার সাথে পালিত হয়, স্মরণ করা হয় ভাষা শহীদ রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারও শফিউরসহ নাম না জানা আরও অনন্য ভাষা শহীদদের, যারা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষাকরার দাবীতে প্রাণ দিয়েছিলেন।
বাংলা ভাষা কী? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথায় ভাষা হলো-
‘”বাংলাদেশের ইতিহাস খণ্ডতার ইতিহাস। পূর্ববঙ্গ পশ্চিমবঙ্গ, রাঢ় বরেন্দ্রের ভাগ কেবল ভূগোলের ভাগ নয়; অন্তরের ভাগও ছিল তার সঙ্গে জড়িয়ে, সমাজের মিলও ছিল না। তবু এর মধ্যে এক ঐক্যের ধারা চলে এসেছে সে ভাষার ঐক্য নিয়ে। আমাদেরযে বাঙালি বলা হয়েছে তার সংজ্ঞা হচ্ছে, আমরা বাংলা বলে থাকি।‘
সুতরাং বলা যায় বাঙালিরা যে ভাষায় কথা বলে তাকেই বাংলা ভাষা বলে।সে ভাষা হতে পারে কারো বিভাগীয় বা আঞ্চলিক ভাষা। কিন্তু অনেক সচেতন ও বিজ্ঞজনদের পর্যালোচনায় প্রশ্ন থাকতে পারে, অকথ্য শব্দও কি তবে বাঙালির উপযুক্তবাংলা ভাষা?
আধুনিক জার্মান মনীষী হুমবোল্ট যখন ভাষার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেন, “মানুষের ভাষাই হল তার আত্মা এবং তার আত্মাই হল তার ভাষা।“, তখন ভাবনায় পড়ে যেতে হয়। ভাষা যদি আমাদের আত্মা হয় এবং আত্মাই যদি আমাদের ভাষা হয়, তবে সেখানে ককথ্য অভদ্র, অশালীন ভাষা নয়, বরং ভাষার ব্যবহারে সৌন্দর্য অলংকার ও শালীনতা রক্ষা করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
জালাল উদ্দিন রুমি বলেছিলেন, “Raise your words, not voice. It is rain that grows flowers, not thunder.”
বর্তমান সময়ে বাংলা ভাষার সৌন্দর্য ও মর্যাদা রীতিমতো হুমকির সম্মুখীন। আমাদের ভাষাদূষণ এখন নদীদূষণ বায়ুদূষণেরমতই বিধ্বংসী। শিল্প-সাহিত্য জগতে বর্তমানে ভাষা দূষণের নতুন উপদ্রব হলো অশ্লীল শব্দের ব্যবহার। অনেক কবি/লেখকরা তাদের লেখায় যৌনতাকে ব্যবহার করছেন শিল্প হিসাবে। তাতেও সমস্যা নেই, যদি সেটা শৈল্পিক আকারে মার্জিতভাবে ব্যবহার করা হয়। কিন্তুকেউ যখন রোমাঞ্চকর বা ক্ষোভের অজুহাতে সরাসরি “চু” জাতিয় শব্দ দ্বারা তার কাব্য-কবিতা শুরু করেন, তখন সেটা বেশ দৃষ্টিকটু লাগে।
কারো কারো কারণবশত প্রতিবাদী কবিতা বা কলামে “হিন্দু-মুসলিম” এর ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত করে “মালাউন-জঙ্গি” শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়। এই শব্দগুলো ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক শব্দ। এগুলো কোন লেখক/কবির শিল্পকে কোন ভাবেই উপস্থাপন করে না। অশালীন শব্দের মতো এইসব ঘৃণ্য শব্দগুলোও আমাদের পরিহার করা উচিৎ।
অনেক ক্ষেত্রে আমাদের রাগ ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হলো মৌখিক এবং লিখিত উভয়েই নেতিবাচক শব্দ ও ভাষার ব্যবহার করা। আবার অনেক সময় হাসতে হাসতেও আমরা এমন সব কথা বলি বা লিখি যা মূলত অন্যকে হেয় করে, আঘাত করে। যেমন- অনেক সময় কারো প্রতি ক্ষোভ প্রকাশে আমরা অটিস্টিক/ প্রতিবন্ধি/ পাগল/স্টুপিড/মানসিক রোগী/ যক্ষ্ম-মৃগী রোগী/ কানা/খোড়া/ কাইল্লা/ গাবগাছ/ শয়তান/ কুত্তা/ শূকর / সিজোফ্রেনিক/ পাগলাগারদে ঢুকানো দরকার,…ইত্যাদি ইত্যাদি শব্দগুলো প্রয়োগ করে থাকি।
এই যে আমাদের শব্দ ও ভাষাগত ত্রুটিগুলো রোজ প্রকাশ হচ্ছে কিন্তু আমরা কেউ সেটা বুঝতেই পারছিনা, এর কারণ শুধু শিক্ষাগত অদক্ষতাই নয়, বরং আমাদের নষ্ট হয়ে যাওয়া মানবিকতা ও বিবেচনাহীন বিবেক এর জন্য দায়ী।
বাংলাদেশে আমাদের নতুন প্রজন্ম বাংলা ভাষার আন্দোলন বা বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাস সম্পর্কে অনেকটাই অনভিজ্ঞ। নতুন প্রজন্ম টম ক্রুজ, জন সিনা, ফুসাজিরো ইয়ামাউচি’র নাম খুব ভালো করেই জানে, কিন্তু রফিক, শফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ অরো অনেক বাংলার দামাল ছেলেদের কথা অনেকেই জানে না। তারা চেয়ার চিনে, কেদারা চিনেনা। তাদের ভাইব্রেটর সম্পর্কে অনেক তথ্য জানা আছে, গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য ঢেঁকি সম্পর্কে কোন ধারণা নেই। তারা ভেলেন্টাইনস, কিস ডে, ফ্রেন্ডশিপডে’ সম্পর্কে অবগত, কিন্তু বাংলার মুক্তিযুদ্ধ, যোদ্ধা, ভাষা দিবস সম্পর্কে অনভিজ্ঞ।
এর জন্য দায়ী আমরা অভিভাবকরা। কারণ আমরা অভিভাবক হিসাবে আমাদের সন্তানদের নিজ দেশ ও দেশের ভাষা, সংস্কৃতি, উৎপত্তি সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা দিতে ব্যর্থ। পরিবর্তে আমাদের অনেকেই সন্তানকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়তে দিয়ে গর্ববোধ করেন।অর্থ ব্যয়ে সন্তানদের ইংলিশে দক্ষতা বৃদ্ধি করেন যেন দেশের বাইরেগিয়ে তারা আরো উন্নত পদে কোন চাকরি করতে পারে।
তাতেও কোন সমস্যা নেই। বর্তমানে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং পড়াশুনা ও উপযুক্ত শ্রমের যা মূল্য, তাতে করে শুধু এক ভাষা এবং এক দেশে আটকে থাকাও বুদ্ধিমানের কাজ নয়। মানুষ যেখানে মূল্যায়ন হয়, সেখানেই ছুটে। জীবন যাপনের মান উন্নত করতে এই যুগে ইংলিশ ভাষার দরকার আছে।
একটি শিশু ইংলিশ, হিন্দি বা স্পেনিশ যে কোন ভাষাকেই তার দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে গ্রহণ করতে পারে, এটি সমস্যা নয়। সমস্যাটি হল যদি তাদের প্রাথমিক মাতৃভাষার উপর সাবলীলতা না থাকে। আমাদের বাংলা ভাষায় সাবলীলতা না থাকার বড় সমস্যাটি হল, আমাদের দেশে এখনও আমাদের শিক্ষার একটি মানসম্পন্ন বাংলা ভাষী পাঠ্যক্রম পাস করা সম্ভব হয়নি৷ বিভিন্ন লোক বিভিন্ন উপভাষায় কথা বলে। তাই সাবলীলতা অর্জন করা যায় না৷ নিজ মাতৃভাষার উপর সাবলীলতা রেখেই আমাদেরকে শেষ পর্যন্ত হিন্দি, স্প্যানিশ, ল্যাটিন, বা ইংরেজি যাই হোক না কেন, তাগ্রহণ করতে হবে।
আজকাল হিন্দি ভাষাটা ও আমাদের অনেকের ভিতরেই বেশ একটাশক্ত অবস্থান গড়ে নিয়েছে। এখনকার নতুন প্রজন্ম “পদ্মানদীর মাঝি” টাইপ ছবি পছন্দ করেন না। জিসম, রাম লীলা, কামাসুত্র টাইপ হিন্দি ছবিতেই রোমাঞ্চ আর থ্রিলিং খুঁজে পায় তারা।
আর তাদেরই বা দোষ কী? পরিবারে যা দেখবে, যা দেখাবে সন্তান তাই অনুসরণ করবে। সন্ধ্যা হলেই অনেক মায়েরা বসে যান স্টার প্লাস, জি টিভি, জি সিনেমা, বি ফর ইউ চেনেলগুলো খুলে। তাদের পাশে বসে ছোট ছোট ছেলে মেয়েরাও শিখছে নিত্য নতুন হিন্দি ভাষা। বাংলা নাটক গুলোতেও আজকাল দেখা যায়, শাশুড়ী কে ডাকছে শাসুমা, বোনকে ডাকছে দি। হিন্দি যেন এখন অনেকটা ড্রাগ এডিকশন এর মতই বইছে আমাদের শিরা উপশিরায়।
তাছাড়া, আমাদের এফএম চেনেলস এবং আর’যে সম্পর্কে সবাই অবগত। এফএম চেনেলগুলোতে যেভাবে বাংলা আর ইংলিশ মিশিয়ে একটা মিশ্র বিকৃত শব্দ উপস্থাপন করা হয়, তা সত্যিই দুঃখজনক। তাদের এক লাইনের বাক্যে ৬/৭ টা ইংলিশ শব্দ থাকতেই হবে। বাংলা শব্দ গুলোকে তারা এমন ভাবে উচ্চারণ করেন, শুনে মনে হয় যেন তারা জন্মগতভাবে ব্রিটিশ নাগরিকত্বেরঅধিকারি কিংবা বাংলা শব্দটা তাদের কাছে খুব অপরিচিত।
বাংলা ভাষায় শব্দ ও বাক্য ব্যবহারে আমাদের কিশোর-তরুণদের অবস্থা আরো ভয়াবহ। তারা কম সময়ে সব কিছু অর্জন করে ফেলতে চায়। ধৈর্য ধরে গন্তব্যে পৌছানোর বদলে তারা খুঁজে শর্টকাট রাস্তা। আজকের কিশোর-তরুণরা বাবাকে বলছে ড্যাড, ভাই বা বন্ধুকে বলছে ব্রো। শব্দের অর্থ না বুঝে বাক্য ব্যবহারে কারোপ্রতি ক্ষুদ্ধ হয়ে বলছে, “তুমি বড্ড প্যারা দেও আমাকে।”
অথচ একাধিক বাক্যের রচিত গদ্যের অংশ হলো প্যারা। ক্ষুদ্ধ অনুভূতির সাথে এই শব্দের কোন সংযোগ নেই। শুধু তাই নয়, কিশোর-তরুণরা এখন ‘শুভ সকাল/শুভ রাত্রি’ বলতে ভুলে গেছে। পরিবর্তে দুই অক্ষরে ‘GM/GN’ ব্যবহারের হিড়িক বেশি।
বাংলাদেশের চলচিত্র জগতকে একটা শিল্পজগত হিসাবেই বিবেচনা করা হয়। কিন্তু এই চলচিত্র জগতের বিভিন্ন মুভিগুলোতেও বর্তমানে নোংরা ভাষায় গালির ব্যবহার লক্ষ্যণীয়। বিশেষ করে ভিলেন চরিত্রগুলোর মুখে বাংলা ইংরেজি দুই ভাষাতেই গালাগালি শুনা যায়। যেমন-ফাক/ মাদার ফাকার/ ডিক/ এসহোল/ সাকার/ হারামজাদা/ কুত্তার বাচ্চা/ হারামখোর/ শুয়ারেরবাচ্চা/ নটির পু/ হালার পু..ইত্যাদি। এই শিল্প অবশ্যই আমাদের ভালো কিছু শিক্ষা দেয় না।
আমাদের মৌখিক বা লিখিত শব্দের কাজ হলো অর্থ প্রকাশ করা। অর্থাৎ শব্দ হলো ভাষার সম্পদ। এবং ভাষা হল কাঠামোগত এবং প্রচলিত উপায়ে শব্দের ব্যবহার দ্বারা কথিত বা লিখিত মানব যোগাযোগের একটি পদ্ধতি, যার মাধ্যমে আমরা আমাদের নিজস্ব অনুভুতি, চিন্তা চেতনা, আবেগ প্রকাশ করে থাকি। প্রায় সময়ই আমরা যে কথ্য এবং নেতিবাচক শব্দগুলি বলে থাকি বা লিখে থাকি, সেগুলি অন্যের ব্যক্তিগত জীবন এবং সামাজিক জীবন উভয় ক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করতে পারে এবংস্থায়ী স্মৃতিতে দুর্দান্ত প্রভাব ফেলতে পারে, হোক সেটা ভাল বা মন্দ। তাই মৌখিক বা লিখিত যে কোন ভাষায় অনুভূতি প্রকাশেরআগে শব্দগুলো বুদ্ধিমানের সাথে বেছে নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।