You are currently viewing আমরা রোজ মিথ্যা বলি/ এইচ বি রিতা

আমরা রোজ মিথ্যা বলি/ এইচ বি রিতা

আমরা রোজ মিথ্যা বলি

 এইচ বি রিতা

ছোট বেলা বইতে পড়েছিলাম-মিথ্যা বলা মহাপাপ। বই ছাড়াও অসংখ্যবার এই নীতিগত বিশ্বাসটা মুখস্ত করতে হয়েছে। অথচ, আমার জীবনে এই একটি কাজই আমি বার বার করেছি, অসংখ্যবার মিথ্যা বলেছি। এখনো বলি।

ঘুম ভেঙ্গেই আমরা দিনটা শুরু করি প্রচন্ড শারীরিক বা মানসিক কষ্ট নিয়ে। তারপর ও কেউ যখন জানতে চান, আমরা কেমন আছি, হাসি মুখে মিথ্যা বলি, ভাল আছি।

কারো সাথে মিলছে না, কারো কিছু একটা সহ্য হচ্ছে না, তারপর ও সেই মানুষটার সামনে গিয়ে আমরা হাসি মুখে মিথ্যা ভালবাসার কথা বলি।

সেই ছোট বেলা যখন প্রথমবার ভালো আর মন্দের পার্থক্য বুঝতে শিখেছিলাম, অনেক অনৈতিক কাজ আশেপাশে ঘটতে দেখেও সাক্ষ্য প্রমানে চুপটি মেরে যেতাম। বড়দের গোপন কিছু দেখে ফেললে, অনায়াসে সাক্ষ্য দিতে দিয়ে বলতাম, আমি কিছু দেখিনি।

ছবিঃ অন্তর্জাল

এই মিথ্যাগুলি আমরা প্রায় সকলেই শিশু বয়সে করে থাকি।

আমরা মুখ বাঁচাতে মিথ্যা বলি, অন্যের অনুভূতিতে আঘাত করা এড়াতে, অন্যকে প্রভাবিত করতে মিথ্যা বলি। দায়িত্ব এড়ানোর জন্য, অপকর্ম আড়াল করতে, সামাজিক দ্বন্দ্ব রোধ করতে এবং আরও অনেক কারণেই মিথ্যা বলি।

প্রতি ভোরে চোখ মেলেই আমরা মিথ্যা বলতে শুরু করি। ভালো না থেকেও বলি ভালো আছি।  বিছানায় দুটি বালিশ নিষ্প্রাণ পড়ে থাকে, কারো সাথে  কারো প্রেম, ভালবাসা নেই, মধ্যরাতের কামনা কুমড়ো ডগার মত লিকলিকিয়ে বেড়ে উঠে। তবুও আমরা বলি, আমাদের ওসব ছাইপাশ লাগেনা। ভাল আছি। ভালবাসাহীন মূহুর্তগুলোতে আমরা নিঃসঙ্গতায় হাঁপিয়ে উঠি। তবু আমরা বলি, ভালবাসা কি বুঝিনা।  ভয়ানক নিঃসঙ্গতায় আমরা আঁতকে উঠি। আবারো বলি, আজকাল রাতে ঘুমের সমস্যা হয়।

সমুদ্রের ঢেউ যেমন একলা মনে বালির কোলে আছড়ে পড়ে, সম্পর্কের বেলায় অভিমান আর অভিযোগগুলোও চোখের কোণে বারিধারায় প্লাবিত হয়ে গড়িয়ে পড়ে, মসৃন চকচকে ত্বক বেয়ে বুকের ঠিক মধ্যখানে। তবু বলি, আমরা ভালো আছি।

আমরা প্রতিটা মানুষই রোজ মিথ্যা বলি। প্রয়োজনে বলি। অপ্রয়োজনেও বলি। প্রয়োজনে মিথ্যা বলায় মানবতা, নৈতিকতা লঙ্ঘন হয় না।

ছোটবেলার একটা গল্প বলি, একদিন এক বৃদ্ধ মহিলা তার সাত বছর বয়সী নাতনীকে নিয়ে চাল নিতে এলেন আমাদের বাড়িতে। আমি তখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। নাতনীর গায়ের জামাটা ছিল খুব অপরিষ্কারএবং ছেঁড়া। শরীরের প্রায় পুরোটাই দৃশ্যমান। দেখে আমার খুব কান্না পেল। সে সময়ের শিশু আমি ভাবছিলাম, ‘আমার এত সুন্দর জামা আছে, ওর কেন নেই!’

মাকে বললে অবশ্যয়ই একটা জামা দিত তাকে। কিন্তু ততটা বিবেচনায় রাখার মত বয়স যে ছিলনা। সেদিনই আমি আম্মার একটা শাড়ি আলমারি থেকে চুরি করে রাখলাম। পরদিন সেই বৃদ্ধ মহিলা আবারো আসলেন নাতনী নিয়ে। চুরি করা শাড়িটা উনার আঁচলে লুকিয়ে দিয়ে দিলাম সেই মেয়েটির জন্য একটা জামা বানাতে। শাড়ি কেটে জামা বানাতেও যে টাকার দরকার কিংবা চুরি করা যে অপরাধ, সেই বোধটুকুও আমার ছিলনা তখন। শুধু মনে হয়েছিল, ‘আমার আছে, ওর নাই কেন?’

এ নিয়ে মায়ের কাছে ধরা পড়ে গেলাম। তবু তার রক্তচক্ষু প্রশ্ন এড়িয়ে বলেছিলাম, ”আমি তোমার শাড়ি চুরি করিনি।’

একেক জনের দৃষ্টিভঙ্গিতে আমার এই আচরণ একেক রকম ব্যাখ্যা হতে পারে। তবে আমার ভাবনা ছিল ভিন্নরকম। চুরি করে অসহায় একটি শিশুর শরীরে কাপড় দেয়া এবং মাকে মিথ্যা বলা দুটোই, নৈতিক এবং অনৈতিক আচরণ দু’টোকেই সংজ্ঞায়ীত করে।নৈতিকতা আমাদের শেখায় চুরি করা বা অন্যের সম্পদ হরণ করা পাপ, অন্যায়। মিথ্যা বলা মহাপাপ-‌অপরাধ।  সেক্ষেত্রে চুরি করা এবং মিথ্যা বলা ছিল আমার ‘অনৈতিক’ আচরণ। আবার চুরি বা মিথ্যার মত অন্যায় কাজটা করার পিছনেও আমার যথার্থ কারণ ছিল এবং সেটার ও যুক্তি ছিল’। যুক্তিটা ছিল-শিশুটি অর্ধনগ্ন ছিল। তাকে সাহায্য করতে হবে।

এবং এই যুক্তিটা এতটাই শক্ত যে, এটা আমার অপরাধকে মায়ের কাছে শাস্তি পাওয়া থেকে কিছুটা শীথিল করে দিয়েছিল।

কিন্তু এই যে আমরা ভাল না থেকেও মিথ্যা বলে ভাল থাকার একটা কৌশল বা অভিনয় রপ্ত করি, নিজেকে প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করি, এটা কি খুব প্রয়োজন? এই মিথ্যা বলে জোড়াতালি দিয়ে নিজেকে ভাল রাখার চেষ্টা বা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার চেষ্টায় কি আমরা আসলেই খুব ভাল থাকি? কিংবা নতুন প্রজন্মকে ভাল, স্বাস্থ্যকর কিছু উপহার দিতে পারি? পারি না।

অভিনয়ের সাথে মিথ্যে বলে বলে আমাদের পুরো জীবনটাই শেষ হয়ে যায়। এবং আমরা এভাবেই মিথ্যা বলে ভাল থাকি। বেঁচে থাকার কঠিন লড়াইয়ে জীবন আমাদের রোজ মিথ্যা বলতে শেখায়।