আমরা যখন নদী থেকে সমুদ্র
সুনীল মাজি
১
সূর্য ঘুমিয়ে গেলে আমি চেতনার সঙ্গ পাই না তেমন,
আমার ঘুম পায়–আমার চারপাশে আঁধার নামে
আমার বুকে তখন অন্য এক জ্যোতি নামে।
দিন আমাকে পাহারা দেয়, তবে রাতকে পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের।
আমরা মানে, অনেক গ্রহ তারা উপগ্রহ ও জ্যোতিস্কমণ্ডলী।
আমরা নিজেদের কবিতার অমৃত কলস পেতে দাঁড়িয়ে থাকি।
দয়া কৃপা ইত্যাদির ঠাঁই নেই এখানে—
এখানে অনেকগুলো সাগর আছে—আমি বাইরে জ্ঞান আর ভেতরে ভক্তি নিয়ে এসেছি।
আমার অবলম্বন বলতে এই—ঘুম ঘুম রাত্রির ভেতর কখনও হারিয়ে যাওয়া খেলার মতো…
যে কোনও হারিয়ে যাওয়া মানেই বুকের ভেতর রাধার আকর্ষণ।
সূর্য ডুবে গেলে বাইরে আমার কোনও দৃশ্য নেই।
অতঃপর আমি অদৃশ্য হতে হতে কখনও গন্ধের ভেতর কখনও সুরের ভেতর
আমি কোনও এক মহাধ্বনির কাছে মোহনা চাই…
২
আমাদের মায়ের নাম ধরিত্রী। পৃথিবী নামে তাকে সবাই চেনে।
তার তিনভাগ জল। একভাগ স্থল। ছয়ভাগ আকাশ।
আমরা যে যার মতো সংগ্রহ করি নিজস্ব তান সুর চিত্র।
আমার ইন্দ্রিয় বাহনে চড়ে এখানে সেখানে যাই।
অরণ্যের মতো ঘন সবুজ স্থানে আমি বসে থাকি, বুনোপাতার গন্ধ থেকে পুষ্প অভিযান করি।
নদীর মতো কারো বুকে ভাসি–কেউ আমাকে বুকে নিয়ে ভাসায়।
ঠিক তখনই আমি মেঘের মতো এক পাহাড়ের চিত্র হয়ে, মনে হয়, অনেক যুগ
স্তরে স্তরে সাজানো আমার বিশ্বাস আমাদের চিরাচরিত আস্থা ও প্রত্যয়
কি জানি কি বলতে চাইছিলাম ভুলে গেছি,
মনে হয়, সব জন্মের আমরা উপগ্রহ–আমরা চাঁদ,
আমাদের নিজস্ব চেতনা নেই।
গতিময় এই জগতে কেউ ঠিক করে দেয় স্ব স্ব অবস্থান, দিক দিশা দর্শন।
কে পিতা আমাদের? মহাকাল? আমি বারবার জড়িয়ে ধরে যাকে, তার কোনও দিনরাত্রি নেই
একটা ধ্বনি ক্রমশ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়, ওঁ শান্তি বলি স্থল জল অন্তরীক্ষে…
৩
মনে হয়, আমাকে কোনও দূরতম দ্বীপে চলে যেতে হবে।
এখানে এত কোলাহল কোনও কিছুই আমি শুনতে পাচ্ছি না।
এখানে ককে খ শুনছি, গকে ঘ এবং এখানে ই ও ঈ এবং উ ও ঊ এর তফাৎ নেই।
এখানে বন্ধুকে প্রেমিকা ভাবে আর প্রেমিকাকে বৌ।
এখানে একজন অন্যজনকে আব্দারের বদলে দাবি করে,
আর সম্পর্ক নিয়ে আনাচে কানাচে কেবলই ফিসফাস…
এখানে আফিংএর চাষ হয় অথচ আফিং খাওয়া অপরাধ
এখানে মদ প্রস্তুত হয় বাণিজ্য হয় সরকার অনুমতি দেয়, অথচ মদ খেলেই অন্য চোখে…
পতিতা পল্লী তো মেয়ে মানুষের শরীর নিয়ে বাণিজ্য,
এতে কতটা ইজ্জত মর্যাদা পায়?
এত ফুল নষ্ট হয় এত শৈশব কৈশোর নষ্ট হয়
মনে হয় আমার বুকের ব্যথা কমবে না, মনে হয় এই অসভ্য মেকি সভ্যতার আমি কেউ না।
৪
কিছু কিছু চিত্র সুর ও গান আমাকে অন্যমনস্ক করে দেয়।
কিছু কিছু মানুষের চোখ মুখ বুক আমাকে এতটাই আকর্ষণ করে আমি চোখ ফেরাতে পারি না।
আমি তখন চোখের ভেতর এক আশ্চর্য নদী সাগর দেখতে পাই এবং ভ্রমণে যাই।
আমি সেই চোখের ভেতর পালতোলা নৌকো ভাসাই
এবং এক সুন্দর ঘ্রাণ পাই অরণ্যের।
একমাথা চুলে অরণ্যের আলো উত্তাপ থাকে,মেঘের পাহাড় থাকে,
সেই পাহাড়ের একদিক থেকে নদী ঘুরে ঘুরে অরণ্যের ওপারে যায়,
তখন আমি আমার নৌকোয় একটি কদমগাছকে সারথী করি।
আমার এই নৌকোয় কোনও হাল নেই–আমি তো কোনও ঘাটে পৌঁছাতে চাইছি না।
আমি যদি সত্যিই এই নদীকে ভালোবেসে থাকি তবে আমার বাঁশির সুরে গাছের পাতা কেঁপে উঠুক,
তবে পাতার সুরধ্বনিতে জল কেঁপে উঠুক,
আমি যেন জলতরঙ্গের ভেতর থেকে আমার হারিয়ে যাওয়া প্রেমের স্বরলিপি পাই!
৫
হয়তো তুমি স্থির দাঁড়িয়েছিলে আমি জড়িয়ে ধরতে তুমি গাছের পাতার মতো নড়ে উঠলে
আমি তখন চোখের পাতা ফুলের চুম্বন
আমি তখন বুকের পাঁজর সারস্বত বীণা
তুমি পাখির সুরের মতো বেজে উঠলে
আমি যেন ভীষণ ঝলমল করে উঠলাম
আমি যাযাবরের তাঁবু থেকে সর্দারের পোশাকে বেরিয়ে কী যেন এক মরুভূমির বুকে নদীর মতো গান গাইতে লাগলাম।
হঠাৎই পৃথিবীর স্থলভূমি জলের মতো কাঁপতে লাগল
কখনও পৃথিবীটা নেপচুনের মতো গ্যাসীয় মেঘের মতো ভাসমান
আমি তোমাকে যত জড়িয়ে ধরছি তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরছ আরো জোরে
যতবার জড়িয়ে ধরছি ততবারই গানের মতো বেজে উঠছ
আমরা কখনও পরস্পরের শরীরে ঘুমিয়ে নিচ্ছি
আর হাই তুলতে তুলতে বলছি : এত বেলা হল– আমাদের তো একসাথে সূর্যসংশ্লেষ করার কথা ছিল।
*************
পরিচিতি
সুনীল মাজি
বাবা : রেণুপদ। মা : ঠাণ্ডাবালা। জন্মভূমি : বৈঠা। কুলবাতপুর। হুগলি। পশ্চিমবঙ্গ। বর্তমান বাস : সুভাষপল্লী কালীমন্দিরের সন্নিকটে। খড়্গপুর। পশ্চিম মেদিনীপুর। পশ্চিমবঙ্গ ৭২১৩০১। শিক্ষা : এম এ (ইংরেজি) বি এড। কর্মজীবন : প্রথম যৌবনে বিমানবাহিনীতে বিশ বছর। জীবনের শেষ বিশ বছর একটি সরকারি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। কাব্যগ্রন্থ: একুশটি কাব্য উপন্যাস : দুটি গদ্যগ্রন্থ : তিনটি উপন্যাস : পাঁচটি সম্পাদিত গ্রন্থ : পাঁচ সম্পাদিত পত্রিকা: চার ( বর্তমানে আয়ু) পুরস্কার ও সম্মাননা : বেসরকারি পুরস্কার কয়েক বছর।================