আপন করে পাওয়া
সোহেল মাহবুব
আনিস সাহেব আজ একটু তাড়াতাড়ি করে বাড়ি ফিরবেন বলে অফিসের কাজ আগে-ভাগে গুছিয়ে নিতে শুরু করেছিলেন। কাজ প্রায় শেষও করে ফেলেছিলেন। এমন সময় বিকেল সাড়ে চার টার সময় বড় সাহেব একটি এ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে বললেন- এটি কাল সকাল দশটার মধ্যে হেড অফিসে জমা দিতে হবে। আপনি এর প্রতিবেদনটি এক্ষুণি তৈরী করে ফেলুন।
আনিস সাহ্বে কোন দিন বড় সাহেবের কথার অবাধ্য হননি, বা কোন কাজের ব্যাপারে না বলেননি। শুধু তাই নয় তিনি কখনোই কারো কথার উপর কথা বলেন না। স্বল্পভাষী হিসেবে তার একটা পরিচিতি আছে। কেউ এটাকে সুনজরে দেখে। আবার কেউ কেউ এনিয়ে নেগেটিভ কথাও বলে। কিন্তু বড় সাহেব আজ তাকে প্রতিবেদনটি করতে বলায় তিনি বললেন- স্যার আমাকে আজ একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে। আপনি কাজটি আর কাউকে দিয়ে করান।
বড় সাহেব নাছোড় বান্দা। তিনি বললেন- না আনিস সাহেব, আমি জানি এ কাজ আপনাকে ছাড়া অন্য কাউকে দিয়ে হবে না। তাই একটু কষ্ট হলেও আপনি প্রতিবেদনটি তৈরী করে দিয়ে তারপর বাড়ি যান।
বাধ্য হয়ে আনিস সাহেব প্রতিবেদনটি নিয়ে বসলেন। তিনি জানেন এটি শেষ করতে দুই থেকে আড়াই ঘন্টা লাগবে। এরপরেও তিনি বসের আদেশ অমান্য করতে পারলেন না। এ সময় তার দু’সন্তানের কথা মনে হল। আজ সোমবার তার দু’সন্তানের জন্ম দিন। তারা আজ সকালে তাদের নানা বাড়ি গেছে। সেখানেই তাদের জন্ম দিন পালিত হবে। স্ত্রী ও দুই ছেলে মেয়েকে তিনি সকালে পাঠিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, অফিস থেকে একটু আগে-ভাগে বের হয়ে সন্ধ্যা ছ’টার মধ্যে তিনি পৌঁছে যাবেন। কিন্তু তার এ কাজ শেষ করতেই সাড়ে ছ’টা বেজে যাবে। এরপর অফিস থেকে বের হয়ে তার শ্বশুর বাড়ি ১০ কিলোমিটার দূরের পথ যেতে আরো এক ঘন্টা লেগে যাবে। যাই হোক এরপরেও আনিস সাহেব মন দিয়ে কাজ শুরু করে দিলেন।
আনিস সাহেবের বর্তমান বয়স একান্ন বছর। বিয়ে করে ছিলেন সাতাশ বছর বয়সে। বিয়ের পর সতের বছর তার স্ত্রীর গর্ভে সন্তান আসেনি। একটি সন্তানের জন্য আনিস ও তার স্ত্রী চিকিৎসা করান নি এমন ডাক্তার বা কবিরাজ এলাকার মধ্যে নাই। এ ব্যাপারে যে যাই বলেছে তিনি সেভাবেই চিকিৎসা করিয়েছিলেন। শেষ অবধি আনিস সাহেব মেনেই নিয়ে ছিলেন তার স্ত্রীর আর সন্তান হবেনা। এভাবে চলতে চলতে একদিন হঠাৎ আনিস সাহেবের স্ত্রী মর্জিনা বেগম অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাকে মেডিকেলে ভর্তি করানো হল। ডাক্তারেরা অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর রিপোর্ট দিলেন মর্জিনা বেগম সন্তান সম্ভবা। এ রিপোর্ট তো আনিস সাহেবের প্রথমে বিশ্বাসই হচ্ছিল না। এর কয়েক মাস পর আনিস সাহেব তার স্ত্রীর শারীরিক পরিবর্তন দেখে নিশ্চিত হলেন যে সত্যি সত্যি তার ঘরে প্রদীপ জ্বালাতে সন্তান আসছে। আনিস সাহেব তার স্ত্রীর উপর আলাদা যত্ন শুরু করে দিলেন। ষোড়শী নববধূর মত স্ত্রীকে আদর যত্ন, সোহাগ ভালোবাসা দিতে শুরু করলেন। মাঝে মাঝে তিনি স্ত্রীর পেটের উপরের কাপড় সরিয়ে হাত দিয়ে আলতো করে পেটে পরশ বুলাতেন। মর্জিনা বেগম এতে মনে মনে পুলকিত হলেও কি ছেলে মানুষি করছ বলে বাধা দিতেন। মর্জিনা বেগমের গায়ের রং ধব ধবে ফর্সা না হলেও উজ্জ্বল ফর্সা। কিন্তু আনিস সাহেব এতদিন সেভাবে খেয়াল করে দেখেনি স্ত্রী মর্জিনার পেটের রং এত সুন্দর! এরপর থেকে আনিস সাহেব মাঝে মধ্যেই সুযোগ পেলে স্ত্রীর পেটের উপরের কাপড় আগলা করে আদর করতেন। স্বামী-স্ত্রী মিলে আগত সন্তানের নামও ঠিক করে ফেললেন। দু’জনের অনেক পছন্দ অপছন্দের পর ঠিক হলো ছেলে হলে নাম হবে “আপন” আর মেয়ে হলে নাম হবে “মায়া”।
এভাবে দিন যেতে যেতে একদিন মর্জিনা বেগম প্রসব ব্যথা অনুভব করলেন। আনিস সাহেব মফস্বল শহরে চাকুরী করেন। সেখানে যে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স আছে সেখানে প্রথমে মর্জিনা বেগমকে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানকার ডাক্তারেরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর এটি জটিল কেস বলে শহরের বড় হাসপাতালে রেফার্ড করে দিলেন। বড় হাসপাতালে প্রসব ব্যথা নিয়ে দু দিন থাকার পর বাধ্য হয়ে সেখানকার ডাক্তারেরা সিজার করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এতে আনিস সাহেব তার ভবিষ্যৎ বংশধর এবং স্ত্রীর অবস্থা নিয়ে বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন।
মর্জিনা বেগম অপারেশন থিয়েটারের মধ্যে ঢোকার আগে স্বামী আনিস সাহেবকে একান্তে বললেন- আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। মনে হয় আমি আমার সন্তানের মুখ দেখে যেতে পারব না। তাতে আমার কষ্ট নাই। কারণ অনেক পরে হলেও খোদাতায়ালা আমাকে তোমার সাধ পূরণ করার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এখন মরণেও আমার দু:খ নাই। তবে আমার ছেলে সন্তান হলে আপন আর মেয়ে হলে মায়া নাম রাখবে। আমি না থাকলেও ওরা তোমার মাঝে আমাকে আপন করে মায়ার বাঁধনে বেঁধে রাখবে। কথাগুলো বলতে বলতে মর্জিনা বেগমের দু চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
আনিস সাহেব মর্জিনা বেগমের চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে বললেন- তুমি চিন্তা করোনা। আল্লাহ এত নিষ্ঠুর নন। আমাদের এত দিনের আকাক্সক্ষার ফসল আসছে। তাকে বুকে নিলেই তোমার প্রাণ জুড়িয়ে যাবে। তোমার কিচ্ছু হবেনা।
সিজার করার পর আরো অনাকক্সিক্ষত ঘটনা ঘটল। একটি নয় দু দুটি সন্তান এসে আনিস সাহেবের ঘর আলোকিত করে দিল। তাও আবার একটি ছেলে ও একটি মেয়ে। এবার আনিস সাহেবের আর খুশি ধরে না। তিনি ভাবলেন তার ঘরে “আপন” “মায়া” দুটোই একসাথে এসেছে। এতদিন পরে মুখ তুলে তাকানোর জন্য তিনি বারবার মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া আদায় করতে লাগলেন।
আপন ও মায়ার বয়স এখন সাত বছর। অন্যান্য বছর তেমনভাবে তাদের জন্ম দিন পালন না করা হলেও এবছর আপন ও মায় বায়না ধরেছে তারা এবার তাদের জন্ম দিনটি নানার বাড়ি গিয়ে করবে। আনিস সাহেবের তেমন ইচ্ছা না থাকলেও জমজ সন্তান দুটির আব্দার ফেলতে পারলেন না। গতকাল অফিসে ছুটি নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় বড় সাহেবের কাছে ছুটির কথা বলতে পারেন নি। একথা তিনি বাড়িতে স্ত্রীর কাছে বলতে পারেন নি। স্ত্রী মর্জিনা বেগম জিজ্ঞাসা করলেন- ছুটির কি হলো?
আনিস সাহেব বললেন- ছুটি নিতে পারিনি। তোমরা সকালে যাও আমি দুপুর পরপরেই অফিস থেকে বলে চলে আসব।
তুমি তাও আসতে পারবে না। আমি তোমাকে চিনি, তুমি আগে আসার কথা তোমার বসকে বলতেই পারবে না।-মর্জিনা বেগম বলল।
না না আমি চলে আসব। আর শোন, তোমরা ঐখানে তৈরী থেক। বিকালে আপন আর মায়াকে নিয়ে আমরা এবার তোমাদের পুরো এলাকা ঘুরব আর মজা করব। -বললেন আনিস।
এ কারণে তিনি আজ সকালে দুই সন্তানসহ স্ত্রীকে পাঠিয়ে দিয়ে বলেছেন একটু আগে অফিস থেকে বের হয়ে যথা সময়ে পৌঁছে যাবেন। কিন্তু তা আর হলো না। প্রতিবেদন তৈরী করে অফিস থেকে বের হতে তার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা বেজে গেল। অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে তিনি বাজারে ঢুকলেন। আগে থেকে অর্ডার দিয়ে রাখা একটি মাঝারি আকারের জন্ম দিনের কেক এবং আপন ও মায়ার জন্য কিছু খেলনা, কিছু পোশাক ও কিছু খাবার কিনে গাড়িতে চড়ে শ্বশুর বাড়ির দিকে রওনা দিলেন।
আনিস সাহেবের শ্বশুর এমাজ মন্ডল ঐ এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তি। তিনি এলাকার বিচার আচার করে থাকেন। এসব কারণে এলাকাবাসী তাঁকে মেনে চলেন। আনিস সাহেব যখন তার শ্বশুর বাড়ির কাছে পৌঁছলেন তখন রাত সাড়ে আটটা বেজে গেছে। আনিস সাহেব একটু দূর থেকে দেখলেন বাড়ির গেটে বেশ মানুষের জটলা। তিনি ভাবলেন তার শ্বশুর হয়ত নাতি-নাতনীর জন্ম দিনের জন্য অনেক মানুষকে দাওয়াত করেছেন। গেটের কাছে আসতেই জটলা পাকানো লোকজন সরে গেল এবং আনিস সাহেবকে ভেতরে যাওয়ার জায়গা করে দিল। সবাই আনিস সাহেবের মুখের দিকে তাকালো কিন্তু কেউ কিছু বলল না। বাড়ির মধ্যে পা দিতে কান্নার আওয়াজ এলো। আনিস সাহেবের মনে হলো এ বাড়ির সবাই মিলে এক সাথে বসে কাঁদছে। আনিস সাহেব ভাবলেন আজ এই খুশির দিন, আজতো কান্না কোন কারণ নেই। ভেতরে এগিয়ে যেতেই আনিস সাহেবের শ্যালক শফিক দৌড়ে এসে বলল- দুলাভাই আপনি এতক্ষণ কোথায় ছিলেন? সব শেষ হয়ে গেছে।
সব শেষ হয়ে গেছে মানে! আনিস সাহেব আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।
শফিক বলল- দুলাভাই আপন আর মায়া নাই। আজ সন্ধ্যার কিছু আগে তারা পুকুর পাড়ে খেলতে খেলতে পানিতে পড়ে…
একথা শুনে আনিস সাহেবের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। মাথার ভেতর কেমন যেন শব্দ শুরু হলো। মনে হলো মাথায় কে যেন বিশালাকার হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করছে। ঢং ঢং শব্দে আশে-পাশের সব কিছুই গুলিয়ে যেতে লাগল। হাতে থাকা জন্ম দিনের কেক ও আপনও মায়ার জন্য কেনা উপহার সামগ্রী পড়ে গেল। আনিস সাহেবের যখন জ্ঞান ফিরে এলো তখন রাত দশটা বেজে গেছে। তিনি দেখলেন অজ্ঞান মর্জিনা বেগমের পাশে তাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। পানি থেকে আপন ও মায়ার লাশ তোলার পর মর্জিনা বেগমের আর জ্ঞান ফিরেনি। আনিস সাহেব উঠে বসতেই তার শ্বশুর এমাজ মন্ডল এসে তাকে ধরলেন। এরপর যেখানে লাশ দুটি রাখা আছে আনিস কে সেখানে নিয়ে গেলে তিনি। আনিস দেখলেন তার কলিজার টুকরা আদরের ধন দু’সন্তান জড়াজড়ি করে ঘুমিয়ে আছে।
এমাজ মন্ডল কান্না জড়িত কন্ঠে বললেন-তুমি আসবে বলে ওরা বিকেল থেকে জামা-কাপড় পরে তৈরী হয়ে বসেছিল। সন্ধ্যার কিছুক্ষণ আগে পাশের বাড়ির ওদের সমবয়সী কয়েকজন ছেলে-মেয়ে খেলার জন্য ওদেরকে ডেকে নিয়ে বাইরে যায়। এর অল্পক্ষণ পরে ওদের মধ্যে থাকা একজন ছেলে দৌড়ে এসে খবর দেয় আপন পুকুরে পড়ে গেছে। তাকে তুলতে এসময় মায়াও পানিতে ঝাঁপ দেয়। ভরা পুকুরে সাঁতার নাজানা দুজনেই মুহূর্তের মধ্যে তলিয়ে যায়। এখবর পেয়ে আমরা পুকুর পাড়ে দৌড়ে গিয়ে তাড়াতাড়ি তাদের খুঁজতে মানুষ নামিয়ে দিই। কিন্তু এত বড় ভরা পুকুরে তাদের খুঁজে পেতে পেতে আধা ঘন্টা সময় লেগে যায়। আধা ঘন্টা পর যখন তাদের কে পাওয়া গেল তখন সব শেষ। পানির মধ্যেও এভাবেই মায়া আপনকে জড়িয়ে ধরে ছিল। পানি থেকে তোলার পর মোড়ের উপরে একজন এমবিবিএস ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তিনি অনেক পরীক্ষা করে বললেন তারা আর বেঁচে নাই। সেজন্য আর মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়নি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো মায়া সেই যে আপনকে ধরে রেখেছে সেখান থেকে আর খোলা যাচ্ছে না।
আনিস সাহেবের গলা দিয়ে কোন স্বর বেরুচ্ছে না। তিনি নিস্পলক তাকিয়ে থাকলেন নিষ্পাপ দুটি সন্তানের মুখের দিকে। তার যেন মনে হলো মায়া আপনকে ডেকে বলছে- দেখ ভাইয়া আব্বু দেরী করে এসেছে। তাও আবার খালি হাতে।
আনিস সাহেব ধপ করে আপন ও মায়ার লাশের কাছে বসে পড়ে বলে উঠলেন- না আব্বু আম্মু আমি তোমাদের জন্য খেলনা, জামা কাপড় ও জন্ম দিনের কেক নিয়ে এসেছি। আমার আসতে দেরী যাওয়ায় তোমরা রাগ করে ঘুমিয়ে পড়েছ ? আর রাগ করোনা। এবার উঠ, এবার আমরা কেক কাটব। বলেই আনিস সাহেব মায়ার গায়ের উপর হাত দিয়ে ঝাঁকি দিলেন। সাথে সাথে মায়ার হাত আলগা হয়ে গেল। দুটি লাশ আলাদা হয়ে গেল। আনিস সাহেব বললেন-তাহলে এবার তোমাদের রাগ ভেঙ্গেছে ? চল আমরা এবার তোমাদের জন্ম দিনের কেক কাটব। বলেই তিনি দু’সন্তানকে একসাথে বুকে জড়িয়ে নিলেন। এবার তার গলার স্বর আর স্তব্ধ থাকল না। তিনি চিৎকার করে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে কান্না শুরু করে দিলেন। তার এ আর্তচিৎকার শুনে বাড়ির আর যারা কান্না-কাটি করছিল তারা থেমে গেল। এসময় অজ্ঞান থাকা মর্জিনা বেগমের জ্ঞান ফিরে এলো। তিনিও উঠে এসে স্বামীকে জড়িয়ে ধরে সমস্বরে কান্না শুরু করে দিলেন। না পাওয়ার পর সব পেয়ে একান্ন বছরে আবার সব হারিয়ে তাদের আর কি থাকল এ কান্নার মধ্যে সবাই দেখতে পেল।
****************************