অভিসার
বিচিত্রা সেন
১.
-এই নেন আপনার চা।
চায়ের কাপটা নিতে গিয়ে আলতো করে মালতীর আঙ্গুলগুলো ছুঁয়ে দেয় রতন। থির থির করে কেঁপে ওঠে মালতী। লজ্জায় রতনের দিকে তাকাতে পারে না সে। এই লাজরাঙা মুখটা বড় ভালো লাগে রতনের। কিন্তু ভালো লাগলে কী হবে! মালতীকে পাওয়া অত সহজ না। ও আরেকজনের বউ। যেমন তেমন কারো বউ না। সে যে বাড়িতে দুইমাস ধরে রাজমিস্ত্রির কাজ করছে,সেই বাড়িরই মনিবের বউ। তবে হিসাব আছে। মালতীর জামাই এই বাড়ি তুলছে না। বাড়ি তুলছে এ বাড়ির বড় ছেলে দুবাইওয়ালা রাখাল দাশ। রাখাল দাশেরই ছোটভাইয়ের বউ মালতী। মালতীর জামাই বাস ড্রাইভার। আন্তঃনগর বাস চালায় সে। বাড়িতে আসে দশ পনেরোদিন পর পর। মালতী খুব গরীবঘরের মেয়ে। এই বাড়িতে তার বউ হয়ে আসার কথা না। তবুও সে এ বাড়ির বউ হতে পেরেছে। কেন একটা বুয়ার মেয়েকে এমন স্বচ্ছল পরিবারে বউ করলো তার একটা ইতিহাস আছে। সে ইতিহাস মালতীর কাছ থেকেই জেনেছে রতন।
রতন চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আহ বলে একটা তৃপ্তির ঢেঁকুর দেয়,তারপর বলে,
-চা আপনি বানাইছেন?
মালতী চোরাচোখে একবার রতনকে দেখে নিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে বলে,
-হ,ভালা হয় নাই?
রতন হেসে বলে,
-আপনার হাতের চা ভালা না হইয়া পারে? এক্কেবারে ফার্স্ট ক্লাস।
মালতী লজ্জায় যেন মরে যায়। এই বাড়িতে তিনজন রাজমিস্ত্রী কাজ করে। কিন্তু রতনের পোশাকআশাক একদম আলাদা। হঠাৎ কেউ দেখলে বুঝতেই পারবে না যে সে রাজমিস্ত্রি। সবসময় জিনসের প্যান্ট আর কলারওয়ালা গেন্জি গায়ে। চুলের কাটটাও দারুণ। মাথাভর্তি ঘন চুল, এক্কেবারে শাহরুখ খানের মতো। প্রথমদিন দেখেই ওকে মালতীর খুব ভালো লেগে গিয়েছিল। রতনও যেন সেটা টের পেয়েছিল। তাই অন্য দুই মিস্ত্রি প্রয়োজনীয় সব কথা মালতীর বড় জায়ের সাথে বললেও ও সব কথা মালতীর সাথেই বলতো। এই যে দুইবার সে বাড়তি এক কাপ করে চা পায় তা ওই মালতীর বদৌলতেই।
রতনের সাথে মালতীর যে একটু বাড়তি খাতির আছে সেটা চোখে পড়েছিল মালতীর বড় জায়ের। একদিন ছোট জাকে ধমক দিয়ে সে প্রশ্ন করেছিল,
-রতন্যার সাথে তোর এত কথা কিসের? হে একটা মিস্ত্রি এটা মনে রাখিস। হে আমগো বাড়িত কাজ করে। আমরা তার মনিব হই। তোর যেন কথাটা মনে থাকে।
মালতী নিজেও ভাবে,রতনের সাথে তার এভাবে মেশাটা ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু সে তো রতনকে দেখলে আর নিজেরে সামাল দিতে পারে না। সে জানে, সে একজনের বউ। পরপুরুষের সাথে এত কথা বলা তার উচিত হচ্ছে না। কিন্তু তার নিজের পুরুষ যে একটা আকাইম্মা,এ কথা সে কাকে বোঝাবে? মাখাল দাশের প্রথম বউয়ের কথা জেনেই ওর বাবা-মা ওকে বিয়ে দিয়েছিল। ওরা জানতো মাখাল দাশের বউ আরেকজনের সাথে প্রেম করে ভেগে গেছে। দোষটা ওই বউয়ের ভেবে দ্বিতীয় বউ হতে আপত্তি করেনি মালতী। কিন্তু এখন সে বোঝে কেন ওই মহিলা মাখাল দাশকে ত্যাগ করেছিল। ও নিজেই তো এখন পালাবার রাস্তা খুঁজছে। কাপড়চোপড়, সোনাদানা দিয়ে কী হবে যদি জামাই আকাইম্মা হয়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে চায়ের কাপটা রতনের কাছ থেকে নেয়। রতন বুঝতে পারে মালতীর দীর্ঘশ্বাস। কারণ মালতী একদিন কথায় কথায় তাকে সে ইঙ্গিত দিয়েছিল। মালতী কাপটা নিয়ে চলে যাবার সময় রতন আস্তে করে ডাক দেয়,
-শোনেন,একদিন আমার সাথে বেড়াতে যাইবেন? আপনার স্বামী তো আপনারে লইয়া কোথাও যায় না। আমার লগে যাবেন?
মালতীর বুকের ভেতর খুশির ধাক্কাটা জোরেই লাগে। কতদিন সে কোথাও যায় না। স্বামীর কাছে কতবার বায়না ধরেছে বাবার বাড়িতে যাওয়ার জন্য। নেবো নেবো করে পাঁচমাস পার করে দিলো,অথচ নিলো না। হলে গিয়ে একটা সিনেমা দেখার তার কতদিনের শখ। সেই স্বপ্নও পূরণ হলো না। আর রতন কিনা তাকে নিজ থেকেই বেড়াতে নিতে চাচ্ছে। সে আকুল হয়ে বললো,
-আপনি আমারে সত্যি সত্যি বেড়াতে নিবেন?
রতন চোখ নাচিয়ে বললো,
-আপনি রাজি থাকলে আমিও রাজি।
মালতী ঘরের দিকে উঁকি দিয়ে বললো,
-আমি রাজি,তয় মিছা কথা কইয়া যাইতে অইবো।
রতন বললো,
-তাইলে কালকে বিকেল চারটায় আপনি বাজারে চইলা আইসেন।
মালতী মাথা কাত করে সায় দিয়ে ভেতরে চলে যায়।
মালতী চলে গেলে আরেক রাজমিস্ত্রি বাদল এগিয়ে আসে রতনের দিকে। তারপর গলা নামিয়ে বলে,
-তোমার কামডা কিন্তু ঠিক হইতাছে না।
রতন অবাক হওয়ার ভঙ্গি করে বলে,
-কোন কামটা?
বাদল বলে,
-এই যে মনিবের বউয়ের লগে সুযোগ পাইলেই ফুসফাস,হেই কামডা।
রতন তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে,
-আমি কী করুম? হেই তো আমার লগে আসি আসি কথা কয়। তয় খারাপ কিছু কয় না।
বাদল সাবধান করে দেওয়ার স্বরে বলে,
-এসবের পরিণতি কিন্তু ভালা হয় না কইলাম।
রতন আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে,
-আইচ্ছা যাও,আর কমু না কথা।
তারপর ওরা নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
২.
আজ সকাল থেকে মালতীর মনটা বড্ড অস্থির। বিকেলে সে রতন মিস্ত্রির সাথে বেড়াতে যাবে। কিন্তু বাড়ি থেকে কী বলে বের হবে সে কিছুতেই ভেবে পাচ্ছে না। শাশুড়ী অন্ধ, যদিও মুখটা সারাক্ষণ চলে। তবুও তাঁকে নিয়ে ভাবছে না সে। তাঁর চিন্তা বড় জাকে নিয়ে। বড় জায়ের একটা ছেলে,একটা মেয়ে। মেয়েটা ক্লাস ওয়ানে পড়ে,ছেলেটা থ্রিতে। স্কুল থেকে ফেরার পর ওদেরকে নিয়ে প্রায়দিনই সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমায় তার বড় জা। এসময়টায় সে কাউকে কিছু না বলেও বেড়িয়ে আসতে পারে। চারটায় বেরুলে,পাঁচটায় চলে আসলে হবে। সাড়ে ছয়টার আগে তার জা উঠবে না। শাশুড়ীও এসময়টায় ঘুমাবে। বাড়ির কেউ জানবে না সে বেড়াতে গেছে। ওরা না জানলে তার স্বামীও জানবে না। লোকটার কথা ভাবতেই বিতৃষ্ণায় তার মনটা ভরে যায়। সবাই বাইরে থেকে দেখে ভাবে,সে কত সুখী। ঘরে স্বচ্ছলতা আছে,দেখতে সুন্দর স্বামী আছে। আর কী চাই এমন একটা গরীব ঘরের মেয়ের?
কিন্তু সে যে কতটা কষ্টে আছে সেটা জানে শুধু সে নিজে আর তার স্বামী। আরও একজন জানে,কিন্তু সে তো এ বাড়ি থেকে পালিয়ে বাঁচছে। না দেখা তার সতীনটির প্রতি এ মুহূর্তে তার প্রচণ্ড ঈর্ষা হয়। মহা বাঁচা বেঁচে গেছে সে। অথচ এ নরককুণ্ডে তাকে ধুঁকে ধুঁকে মরতে হচ্ছে। আজীবন হয়তো মরতে হবে। এজন্যই তো রতনকে দেখলে তার শরীর মনে কেমন একটা শিহরণ জেগে ওঠে। মাঝে মাঝে চায়ের কাপ নেওয়ার ছলে রতন যে তার আঙ্গুলগুলো ছুঁয়ে দেয়, সে এক অপূর্ব অনুভূতি৷ মাখাল দাশ সেটা কোনোদিনও বুঝবে না। হঠাৎ মোবাইলের রিংটোনে তার ভাবনার সুতোয় টান পড়ে। নিয়মিত কথা বলার জন্য মাখাল তাকে একটা বাটম মোবাইল দিয়েছে। তার কত শখ ছিল একটা স্মার্ট ফোনের। মাখালের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও সেটা কিনে দেয়নি। অথচ তার জায়ের কাছে কত বড় একটা স্মার্ট ফোন! তার ভাসুর এনেছে বিদেশ থেকে। দুই ভাইয়ে কত তফাৎ। রিংটোন বাজতে বাজতে একবার থেমে যায়। ততক্ষণে মালতীর হুঁশ এসেছে। ফোনটা হাতে নিতেই আবার বেজে ওঠে। সাথে সাথেই মালতী রিসিভ করে। ওপাশ থেকে মাখাল জানতে চায়,
-কী করতেছিলা? ফোন ধরতে দেরি হইলো ক্যান?
মালতীর বিরক্ত লাগে,তবুও সে বিরক্তি চেপে সে অবলীলায় মিথ্যা বলে–
-রান্নাঘরে আছিলাম,তাই দেরি হইলো। আপনি আইবেন আজ?
মাখাল হতাশার সুরে বলে,
-আজ আইতে পারুম না। সামনের শুক্কুরবারে আমু। তোমার জন্য কিছু আনা লাগবো?
মালতী বলে,
-আপনার যেটা আনবার মন চায় সেইটা আইনেন।
কিছুক্ষণ এই সেই আলাপ করে মাখাল ফোন রাখে। মালতী যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। এখন তার অন্য কোনোদিকে মন নাই। বিকেল চারটা তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। রতন তাকে কোথায় বেড়াতে নেবে? কোন শাড়িটা পরবে সে? কেমন করে চুল বাঁধবে? এই আঠারো বছর বয়সে কোনোদিন সে কোনো পুরুষের সাথে বেড়াতে যায়নি। ভেবেছিলো স্বামীর সাথে একবার কক্সবাজার যাবে। নেবে নেবে করে এখনো নিলো না মাখাল। একবার খুব আহ্লাদ করে বলেছিল মার্কেটে নিতে। সেই শখও পূরণ করেনি তার স্বামী৷ তার বুঝি রাগ হয় না? আজ সে রতনের সাথেই ঘুরবে। কেউ জানবে না সে কথা। যদি আজকে ভালোয় ভালোয় সব হয়,তবে সে মাঝে মাঝে রতনের সাথে বেড়াতে যাবে সবাইকে ফাঁকি দিয়ে। খুব জব্দ হবে তখন মাখাল।
দুপুরে একসাথে সবাই ভাত খায়। ভেতরে ভেতরে খুশিতে ডগমগ করলেও উপরে সেটা বুঝতে দেয় না মালতী। খেয়েদেয়ে সবাই যার যার রুমে ঢুকে পড়ে। তিনটা বেজে গেছে। আলমারি থেকে বিয়ের শাড়িটা বের করে মালতী। বিয়ের পর থেকে কোথাও যাওয়া হয়নি বলে শাড়িটাও আর পরা হয়নি। আজ এটা পরেই সে সুন্দর করে সাজবে। রতনের মুখটা মনে পড়তেই লজ্জায় লাল হয়ে যায় সে। রতনকে ভাবতে ভাবতেই সে নিজেকে মনের মতো করে সাজায়। শ্যামলা রঙের ছিপছিপে গড়নের মালতীকে সত্যি অপূর্ব লাগে। মালতী আয়নাতে নিজেকে দেখে নিজেই শিহরিত হয়। চারটা বাজার পাঁচমিনিট আগে মালতী ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। বেরুনোর সময় দরজার চৌকাঠে একটা হোঁচট খেলেও সে দমে না,একবারও পিছু ফিরে চায় না। আজ সে কোনো বাধাই মানবে না। রতনের সাথে সে বেড়াতে যাবেই। হনহন করে বেরিয়ে যাবার সময় তার দিকে চোখ পড়ে অন্য দুই রাজমিস্ত্রীর। মালতী ওদের দিকেও তাকায় না। ওরা মালতীর সাজসজ্জা দেখে পরস্পরের দিকে তাকায়। বাদল রফিককে বলে,
-আজ তো আধাবেলা কাম কইরা রতন ভাগলো। ছোট বৌদি এমন সাজগোজ কইরা কই যায়? কার লগে যায়?
সে প্রশ্ন মালতীর কানে যায় না। সে মাথায় ঘোমটা টেনে হনহন করে ছুটতে থাকে বাজারের দিকে। যেখানে তার অপেক্ষায় আছে রতন।
********************************