You are currently viewing অবনঠাকুরের সাইক্লোন/ সরকার আবদুল মান্নান

অবনঠাকুরের সাইক্লোন/ সরকার আবদুল মান্নান

অবনঠাকুরের সাইক্লোন

সরকার আবদুল মান্নান

মানুষের শিক্ষা কীভাবে হয়, জ্ঞান কীভাবে হয়- এই নিয়ে তথ্য ও তত্ত্বের অভাব নেই। কিন্তু ঠাকুর বাড়ির, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর ভাইয়ের ছেলে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (৭ই আগস্ট, ১৮৭১-১৫ই ডিসেম্বর, ১৯৫১) বেলায় বিষয়টা ভিন্ন। প্রথাগত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকগণ যেভাবে শিক্ষাদান করেন তার প্রতি তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না তাঁদের। ফলে না রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, না অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্কুলে পড়তে চেয়েছেন কখনো। তাঁরা স্কুলে যাননি এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও তেমন গ্রহণ করেননি। রবীন্দ্রনাথের কিছু গল্পে শিক্ষকদের যে চরিত্র উন্মোচিত হয়েছে তা মোটেই শিক্ষাবান্ধব নয়, শিক্ষার্থীবান্ধব নয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার যে বিশ্বব্যবস্থা দেশে দেশে গড়ে ওঠেছে, সেই শিক্ষার মধ্যে থেকে অসামান্য প্রতিভাধর ব্যক্তি যে তৈরি হয়নি তা বলা যাবে না। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই উন্মোচিত হবে যে, তাদের সৃষ্টিশীলতায় প্রাতিষ্ঠানিক ওই শিক্ষা খুব একটা কাজে আসেনি। এ হলো অনন্য এক জীবনবোধ। জীবন ও জগৎকে দেখার ভঙ্গির উপর নির্ভর করে মানুষের শিক্ষার মূলগত বনিয়াদ। মনে করা হয়, গড়পরতা এই বোধ তৈরি হয় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ভেতর দিয়ে। কিন্তু যারা জন্মগ্রহণ করেন সৃষ্টিশীলতার অফুরন্ত আনন্দ ও বেদনা নিয়ে, তাপ ও দাহ নিয়ে তাদের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। অবনীন্দনাথ ঠাকুরের আপন কথা নামক স্মৃতিগ্রন্থের ‘সাইক্লোন’ শীর্ষক আখ্যানের মধ্যে ওই জীবনবোধের পরিচয় আছে। উদ্ধৃতি দিই:

এটা জানি তখন- দিন আছে, রাত আছে, আর তারা দু’জনে একসঙ্গে আসে না আমাদের তিনতলায়। এও জেনেছি, বাতাস একজন ঠান্ডা, একজন গরম; কিন্তু তাদের দু’জনের কারো একটা করে ছাতা নেই গোলপাতার। রোদে পোড়ে, বিষ্টিতে ভেজে ওদের গা। এও জেনে নিয়েছি যে একটা একটা সময় অনেকজন রোদ বাইরে থেকে ঘরে এসেই জানলাগুলোর কাছে একটা একটা মাদুর বিছিয়ে রোদ পোহাতে বসে যায়। কোনোদিন বা রোদ একজন হঠাৎ আসে খোলা জানলা দিয়ে সক্কালেই। তক্তপোশের কোণে বসে থাকে সে, মানুষ বিছানা ছেড়ে গেলেই তাড়াতাড়ি রোদটা  গড়িয়ে নেয় বালিশে তোশকে চাদরে আর আমার খাটেই। তারপর চট্ করে রোদ ধরা পড়ার ভয়ে বিছানা ছেড়ে দেওয়াল বেয়ে উঠে পড়ে কড়িকাঠে।

Personification বলে ইংরেজিতে একটি পরিভাষা আছে। বাংলায় একে বলা যায় ব্যক্তিত্বায়ন। কোনো ভাব, বস্তু বা প্রাণীর মধ্যে মানবীয় ব্যক্তিত্ব আরোপ করা। সাধারণত কবিতায় এই প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। গদ্যে যে তাব্যবহৃত হয় না তা নয়। এমন কি মানুষ দৈনন্দিন কথাবার্তায়ও ব্যক্তিত্বায়নের আশ্রয় নেন। যেমন বলা হয়, এই ঘরটা আমি ছাড়তে চাচ্ছি, কিন্তু ঘরটা তো আমাকে ছাড়ছে না। অতি মামুলি ব্যবহার। কিন্তু অবনঠাকুর রোদ, বৃষ্টি আর বাতাসকে যেভাবে ব্যক্তিত্ব প্রদান করেছেন তার কি কোনো তুলনা চলে! প্রতিটি শিশুই প্রাণী ও বস্তুময় বিশ্বকে মানুষ থেকে আলাদা করে দেখে না। ‘আলাদা’- এই বোধ তাদের মধ্যে তৈরি হতে সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম ও অর্থনৈতিক পথপরিক্রমার প্রয়োজন হয়। কিন্তু অবনঠাকুর জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির তাঁর তিনতলার জীবনে প্রকৃতিকে যে শব্দে-রূপে-রঙে-রসে-স্পর্শে মানবিক করে তুলেছেন তার অবয়ব, তার গড়ন ও সৌকর্য আমাদের মুগ্ধ করে। রাত আর দিন এই দুজনে যে একসঙ্গে আসে না, অবন ঠাকুরের তিনতলায় তো নয়ই, কোত্থাও না- এই কথাটা বলার কি আছে? আর এটা যে বলা যায় এবং তার জন্য যে সাহস দরকার অবন ঠাকুরের সেই অসাধারণ শিল্প-ন্যয়বোধ আছে। আর বাতাসের কথাও তিনি জানেন। তাদের একজন ঠান্ডা এবং আরেকজন গরম। কিন্তু তাদের কারোরই একটি করে গোলপাতার ছাতা নেই। তাই ওরা রোদে পোড়ে আর বৃষ্টিতে ভিজে। ছাতা নেই বলে বাতাসের গা রোদে পোড়ে আর বৃষ্টিতে ভিজে – ভাবনার এই জগৎ তৈরি করা কি খুব সহজ! একমাত্র শিশুরাই পারে এই অযৌক্তিকতার জগৎ তৈরি করতে। খুব একটা শিশুমন না থাকলে একজন পরিণত মানুষের এমনতর ভাবনা সম্ভব নয়। এও তিনি জেনেছেন যে “একটা সময় অনেকজন রোদ বাইরে থেকে ঘরে এসেই জানলাগুলোর কাছে একটা একটা মাদুর বিছিয়ে রোদ পোহাতে বসে যায়। কোনোদিন বা রোদ একজন হঠাৎ আসে খোলা জানলা দিয়ে সক্কালেই। তক্তপোশের কোণে বসে থাকে সে, মানুষ বিছানা ছেড়ে গেলেই তাড়াতাড়ি রোদটা  গড়িয়ে নেয় বালিশে তোশকে চাদরে আর আমার খাটেই। তারপর চট্ করে রোদ ধরা পড়ার ভয়ে বিছানা ছেড়ে দেওয়াল বেয়ে উঠে পড়ে কড়িকাঠে।” এই অংশটুকু আবারও  উল্লেখ করলাম। রৌদ্রোজ্জ্বল একটি সকালকে, গড়িয়ে যাওয়া বেলার একটি গতিময়তাকে, এবং সেই গতির সঙ্গে সময়ের চঞ্চলতাকে এমন মধুময় করে তোলার শক্তি সবার থাকে না। এই চিত্র একজন শিশুর মনে কি অবিশ্বাস্য কল্পনা প্রতিভার জন্ম দিতে পারে তা নিশ্চয়ই অনুমেয়। তলস্তয়ের একটি পক্ষিসাবক তার মাকে বলেছিল, গাছগুলো এত নড়াচড়া না করলেই তো পারে, তা হলেই তো আর ঝড় হয় না। খুব সাধারণ মানের কোনো লেখকের পক্ষে শিশুর এই জগৎকে ধরতে পারা সম্ভব নয়।

ছাতের কাছেই আল্সের কোণে দুটো নীল পায়রা থাকে জানি, আলো হলেই তারা দু’জনে পড়া মুখস্থ করে- পাক্পাখম্… মেজদি…সেজদি… কড়ে আঙুল বলে খাবো; আংটির আঙুল বলে কোথায় পাবো; মাঝের আঙুল বলে ধার করোগে; আর একটি আঙুল, তার নাম যে তর্জনী, তা জানিনে, কিন্তু সে বলে জানি, শুধবো কিসে; বুড়ো আঙুল বলে লবডংকা। কি সেটা, দেখতে লঙ্কার মতো আর খেতে ঝাল না মিষ্টি তা জানিনে, কিন্তু খুব চেঁচিয়ে কথাটা বলে মজা পাই।

এও একটি উদ্ধৃতি। পায়রাদের জগৎ। আলো হলেই তারা দুজনে পড়া মুখস্থ করে। এ পর্যন্ত বেশ চলে। কিন্তু আঙুল যখন কথা বলে তখন শিশুদের মধ্যে কৌতূহলের সীমা থাকে না। বিশেষ করে যখন বলে “আর একটি আঙুল, তার নাম যে তর্জনী, তা জানিনে, কিন্তু সে বলে জানি, শুধবো কিসে;”- যাদের রসবোধ আছে, তারা নিশ্চয়ই অফুরন্ত আনন্দ উপভোগ করবে। খুব রসিয়ে রসিয়ে মজাটা নেওয়ার অস্বাদ তারাই লাভ করবে যাদের মধ্যে রুচি ও পরিচ্ছন্ন কৌতুক বোঝার ক্ষমতা আছে। এ হলো শিশুর মনোরাজ্যে আনন্দের আয়োজনে এক মুকুটহীন শিশুসাহিত্যের সম্রাটের তৈরি জগৎ। নাম তাঁর অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর- সবাই যাকে বলেন অবনঠাকুর। বন্ধ খড়খড়ির একটু ফাঁক পেয়ে রাত আসে এক-একদিন। রাতের সেই অন্ধকারে সাদা প্রজাপতির মতো এক ফোঁটা আলো মাথার বালিশে পাখা বন্ধ করে ঘুমোয়। হাতচাপা দিলে সে হাতের তলা থেকে উঠে আসে উপরে। ওই আলোটুকু এমন চটুল আর এমন ছোট যে বালিশচাপা দিলেও ধরে রাখা যায় না। চট্ করে উঠে আসে বালিশের উপর। আর চিৎ হয়ে ওই এক বিন্দু আলোর উপর শুয়ে পড়লে দেখা যায় পিঠ ফুঁড়ে এসে বসেছে নাকের ডগায়। আর উপুড় হয়ে চেপে পড়লেই মুশকিল বাধে তার- ধরা পড়ে যায় একেবারে। উপুড় হয়ে চেপে ধরলে ধরা তো পড়বেই, কারণ তখন তো আর আলোর ওই বিন্দুটুকু চোখের সামনে থাকে না। আড়ালের ওই আনন্দটুকু বেশ উপভোগ্য। আর পুরো যে ছবিটা আঁকা হলো, রাতের অন্ধকারে একবিন্দু আলো নিয়ে যে খেলাটার আয়োজন করা হলো, বাংলার শিশুসাহিত্যে তা কি খুব সহজপ্রাপ্য? আমার মনে হয় মোটেই নয়। আমার এও মনে হয়, তাবৎ বিশ্বের শিশুসাহিত্যে ওরকম হীরের টুকরো আলোর বিন্দু খুব বেশি নেই।

জ্ঞান কী করে হয় সে কথা বলেছিলাম শুরুইে। স্কুলে গিয়ে? বই-পুস্তক পড়ে? তা হলে তো একটি মস্তবড় প্রশ্ন দাঁড়ায়। যখন স্কুল ছিল না, বই-পুস্তক ছিল না তখনো তো অসাধারণ জ্ঞানী মানুষ ছিলেন। সেটা তা হলে কীভাবে হলো? অবনঠাকুর লিখেছেন :

পড়তে শেখার আগেই, দেখতে শুনতে চলতে বলতে শেখারও আগে, ছেলেমেয়েদের গ্রহ-নক্ষত্র, জল-স্থল, জন্তু-জানোয়ার, আকাশ-বাতাস, গাছপালা, দেশবিদেশের কথা বেশ করে জানিয়ে দেবার জন্যে বইগুলো তখন ছিলোই না। বই লিখিয়েও ছিলো না হয়তো, কাজেই খানিক জানি তখন নিজে নিজে, দেখে কতক ঠেকে কতক, শুনে কতক, ভেবে ভেবেও বা কতক।

জ্ঞানার্জনের ওই পথটাই চিরস্থায়ী পথ। ওই যে, “খানিক জানি তখন নিজে নিজে, দেখে কতক ঠেকে কতক, শুনে কতক, ভেবে ভেবেও বা কতক।” অবন ঠাকুরের অভিজ্ঞতার আলোয় যাওয়ার আগে নিজেরটা বলে নিই। ‘ঢাকার গাছ সাদা কেন’- ওরকম একটি গল্প আমার আছে। বড়ো বোন জ্যোৎস্না চন্দ্রালোকিত ফটিকস্বচ্ছ এক রাতের প্রথম প্রহরে ঘুমজড়ানো চোখে পড়ছিল “এ্যা এ্যা এ্যা ঢাকার গাছ সাদা কেন, ঢাকার গাছ সাদা কেন, ঢাকার গাছ সাদা কেন?” কিন্তু মুশকিল হয়েছিল এই যে, ওই কেন-এর উত্তর না দিয়েই বেচারি ঘুমিয়ে পড়েছিল। আর আমরা তিন বালক ঘরের বাইরে থেকে বুঝেছিলাম ঢাকা শহরের গাছ সাদা। অনেক ঘটনা। সে গল্প এখন আর বলব না। শুধু এটুকু বলি, বড়ো ভাই যখন বললেন ঢাকার গাছ সাদা নয়। গাছ ঢেকে রাখলে সাদা হয়ে যায়। পরীক্ষা করার কথা সে বলেনি। কিন্তু চাচির সীম গাছের উপর ওই পরীক্ষাটা করে আশ্চর্য ফল পেয়েছিলাম। তখনো শালোকসংশ্লেষণ জানার দরকার হয়নি। এ হলো একরকম জ্ঞান। এই জ্ঞানের কথা বলছেন না অবনঠাকুর।  তিনি বলেন লোকজ জ্ঞানের কথা, যে জ্ঞান লোকমুখে চলতে থাকে বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ। তাঁর কথায় যাই।

আমি দিচ্ছি পরীক্ষা তখন আমারই কাছে, কাজেই পাশই হয়ে চলেছি জানাশোনার পরীক্ষাতে। আমাদের শান্তিনিকেতনের জগদানন্দবাবুর  ‘পোকা-মাকড়’ বই কোথায় তখন, কিন্তু মাকড়সার জালশুদ্ধ মাকড়সাকে আমি দেখে নিয়েছি। আর জেনে ফেলেছি যে, মাকড় মরে গেলে বোকর হয়ে খাটের তলায় কম্বল বোনে রাতের বেলা। ‘মাছের কথা’ পড়া দূরে থাক, মাছ খাবার উপায় নেই তখন, কাঁটা বেছে দিলেও। কিন্তু এটা জেনেছি যে, ইলিশ মাছের পেটে এক থলিতে থাকে একটু সতীর কয়লা, অন্য থলি ক’টাতে থাকে ঘোড়ার ক্ষুর, বামুনের পৈতে, টিকটিকির লেজ এমনি নানা সব খারাপ জিনিস যা মাছ-কোটার বেলায় বার করে না ফেললে খাবার পরে মাছটা মুশকিল বাধায় পেটে গিয়ে। জেনেছি সব রুইমাছগুলোই পেটের ভিতরে একটা করে ভূঁই-পটকা লুকিয়ে রাখে। জলে থাকে বলে পটকাগুলো ফাটাতে পারে না; ডাঙায় এলেই তারা মরে যায় বলে পটকাও ফাটাতে পারে না নিজেরা। সে জন্যে মাছের দুঃখ থাকে, আর এইজন্যেই  মাছ-কোটার বেলায় আগে-ভাগে পটকা মাটিতে ফাটিয়ে দিতে হয়। না হলে মাছ রাগ করে ভাজা হতে চায় না, দুঃখে পোড়ে, নয় তো গলায় গিয়ে কাঁটা বেঁধায় হঠাৎ।

এই লোকজ্ঞান কেন আছে সারা পৃথিবীতে? কেন বড় বোন বলত “খবরদার, জামের বিচি গিলে ফেলবি না কিন্তু! পেটে গিয়ে গাছ হবে। ওই গাছ মাথা ফুঁরে বের হবে। আর কাক আসবে তোর মাথায় গজানো জাম গাছের জাম খেতে। ওরা তোর কালো চোখ দুটিকে জাম ভেবে ঠোক দিয়ে খেয়ে নেবে। তুই কিন্তু আন্ধা হয়ে যাবি।” এমন অকাট্য কথা কি আর হয়! ভুলেও আমরা জাম খেতে গিয়ে বিচি গিলে ফেলতাম না। আর কখনোই আমাদের মাথায় আসতো না যে, ওই কথায় কোনো ভুল আছে। অবনঠাকুরও বিচি গিলে না ফেলার গল্প করেছেন। এই জ্ঞানগুলো তো স্কুলে গিয়ে হয়নি। জোর করে কেউ গেলায়ওনি। শৈশবে বন্ধুরা যেমন আসে, খেলাগুলো যেমন আসে অবলীলায়, আনন্দে তেমনি এই জ্ঞানগুলোও আনন্দের সঙ্গেই এসেছে। অবনঠাকুর বলতে চেয়েছেন, তাঁর জীবনে যা কিছু এসেছে, যারা এসেছেন আপনা থেকেই এসেছে, আপনা থেকেই এসেছেন। কাউকেই খুঁজে নিতে হয়নি। প্রাণান্ত কষ্ট করতে হয়নি পাওয়ার জন্য। তাই তিনি লিখেছেন :

আজও যেমন বোধকরি- যা কিছু সবই- এরা আমাকে আপনা হতে এসে দেখা দিচ্ছে- ধরা দিচ্ছে এসে এরা। খেলতে আসার মতো এসেছে, নিজে থেকে তাদের খুঁজতে যাচ্ছিনে- নিজের ইচ্ছামতো তারাই এসে চোখে পড়েছে আমার , যথাভিরুচি রূপ দেখিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে খেলুড়ির মতো খেলা শেষে। সেই পঞ্চাশ বছর আগে তখনো তেমনি বোধ হতো। দেখছি না আমি, কিন্তু দেখা দিচ্ছে আমাকে সবাই; আর এই করেই জেনে চলেছি তাদের নির্ভুল ভাবে। রোদ, বাতাস, ঘর, বাড়ি, ফুল, পাতা, পাখি এরা সবই তখন কি ভুল বোঝাতেই চললো অথবা স্বরূপটা লুকিয়ে মন-ভোলানো বেশে এসে সত্যি পরিচয় ধরে দিয়ে গেলো আমাকে, তা কে ঠিক করে বলে দেয়?

জ্ঞানের কি কোনো পরিপূর্ণ রূপ আছে? কেউ কি এসে সেই রূপ আমাদের দেখিয়ে যায়? কিংবা জ্ঞান আপনা থেকে এসে তার সবটুকু রূপ উন্মোচন করে দেয় আমাদের সম্মুখে? এর কোনোটাই কিন্তু হয় না। পূর্ণতা বলে বিষয়টি এতই অপূর্ণ যে সেটা নিয়ে কথা বলার কোনো মানে নেই। কিছুই পরিপূর্ণ নয়। কমপক্ষে মানবীয় জীবনে পূর্ণতার কোনো পরিচয় নেই। আর জ্ঞান তো দূরওয়াস্ত!

ঠাকুর বাড়ির তেতলায় থাকতেন শিশু অবনঠাকুর। ওই বাড়িটাই তাঁকে জানিয়েছে যে সে তেতলাই। তেতলার নিচে যে আরেকটা তলা আছে যার নাম দোতলা এবং তারও নিচে একতলা বলে একটি তলা আছে সে কথা জানতে দেয়নি বাড়িটা। কিন্তু ওই বাড়িটা জলে বা হাওয়ায় ভাসছে সেই মিথ্যেটাও সে কোনো দিন বলেনি। শিশুর বোধের মধ্যে এমন একটি মিথ্যে কখনোই কাজ করেনি যে বাড়িটা ভাসছে বাতাসে কিংবা পানিতে। বাড়িটা অপনার খানিকটা রেখেছিল নিজের আড়ালে আর দেখতে দিয়েছিল খানিকটা। ওই যে দেখা আর না- দেখার বাড়িটার যে রূপ অবনঠাকুর তার শিশুমনের মধ্যে গেঁথে রেখেছেন তার তো কোনো তুলনা হয় না সবটুকু জানার সঙ্গে। সেই দেখাটা তো আর কিছুতেই সম্ভব নয়। পুরো বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখে কিংবা ইঞ্জিনিয়ারের প্ল্যান ধরে ধরে যে দেখা তার মধ্যে কি শৈশবের বাড়িটার রহস্য, তার বিচিত্র আড়াল-আবডাল কখনো দেখা যাবে? যাবে না। তিনি বলেছেনও: “আজকের দেখা এই বাড়ি সে একটা স্বতন্ত্র বাড়ি বলে ঠেকে, যেটা সত্যিই আমাকে দেখা দেয়নি। কিন্তু সেদিনের  সে একতলা দোতলা নেই এমন যে তিনতলা, সে এখনো তেমনিই রয়েছে আমার কাছে।” রবীন্দ্রনাথকে আমরা কতভাবে চিনি তার তো কোনো ইয়ত্তা নেই। বিশেষ করে তাঁরে গানে আমরা তাঁকে পাই সবচেয়ে আপন করে। কি যে আপন! কিন্তু অবনঠাকুরকে আমরা কতটুকু চিনি। বলতে গেলে চিনিই না। তাই এই মানুষটি যে একদম অন্যরকম, একদম- তার একটু পরিচয় দিই। সেই পরিচয়টা যদি আমি লিখে দিই তা হলে ওই দেওয়াটা খন্ডিত হতে পারে। তাই ওঁর লেখা থেকেই তুলে দিই। ওটাই মনে হয় নিরাপদ।

নিজে থেকে জানাশোনা দেখা ও পরিচয় করে নেওয়া আমার ধাতে সয় না। কেউ এসে দেখা দিলে, জানান দিলে তো হলো ভাব; কেউ কিছু দিয়ে গেলো তো পেয়ে গেলাম। পড়ে পাওয়ার আদর বেশি আমার কাছে; কুড়িয়ে পাওয়ার নুড়ির মূল্য আছে আমার কাছে; কিন্তু খেটে পাওয়া পাঁঠার মুড়ির দিকে টান নেই আমার। হঠাৎ খাটুনি জুটে গেলে মজা পাই, কিন্তু ‘হঠাৎ’ সত্যি ‘হঠাৎ’ হওয়া চাই, না-হলে নকল ‘হঠাৎ’কোনোদিনই মজা দেয় না, দেয়ওনি আমাকে। আমি যদি সাহেব হতেম তো অবিবাহিতই থাকতে হতো, কোটশিপটা আমার দ্বারা হতোই না। দাসীটা চলে গেলো তার যে-টুকু ধরে দেবার ছিলো দিয়ে হঠাৎ। এমনি হঠাৎ একদিন উত্তর-পুব কোণের ঘরটাও যা-কিছু দেখাবার ছিলো দেখিয়ে যেন সরে গেলো আমার কাছ থেকে।

এ এক বিস্ময়কর মানুষ। কী করে যেন তিনি বুঝে ফেলেছিলেন যে, জীবন অন্যরকম। নিক্তিতে মেপে মেপে জীবনের ওজন ঠিক করা যায় না। এবং ওই যে ‘হঠাৎ’ হয়ে যাওয়া এর মধ্যেই আছে জীবনের সহজলভ্যতার ব্যাকরণহীন ব্যাকরণ। এই জীবনে আমরা যত কিছু শিখেছি তার প্রায় সবটুকুই তো আপনা থেকে শেখা। কখন যে শেখা হয়ে গেলো তার কি কোনো পাঠ্যসূচি ছিল বা আছে? নেই। বাড়ির অলিগলি, ক্ষেতখামার কে আমাদের চিনিয়ে দিল; আত্মীয়-স্বজন, আপন-পর কেউতো চিনিয়ে দেয়নি আমাদরে।শীত-গ্রীষ্মের পাথর্ক্যটা আমরা কী করে বুঝলাম; কাকের ডাক আর কোকিলের কণ্ঠের পার্থক্যটা কে আমাদের শিখিয়ে দিল; গরু আর গাধার পার্থক্য, মানুষ আর বানর যে এক নয় এবং আরও কত ভালো আর মন্দের ধারণা, সুন্দর আর অসুন্দরের বোধ, কল্যাণ আর অকল্যাণের বিষয়-আসয় কে আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে ? কেউ না। আপনা থেকে ওই জানাগুলো, তাতে কি কোনো ভুল আছে? নেই। আর ভুল থাকলেই বা কী আসে যায়! অবনঠাকুর এভাবেই জানতে চেয়েছেন জীবনটাকে। বলেছেন :

সেই ছেলেবেলা থেকে আজ পর্যন্ত  না-জানা থেকে জানার সীমাতে পৌঁছানোর বেলা একটা কোনো নির্দিষ্ট ধারা ধরে অঙ্কের যোগ বিয়োগ ভাগফলটার মতো এসে গেলো জগৎ-সংসারের যা-কিছু, তা হলো না তো আমার বেলায়। কিম্বা ঘটা করে থাকতে জানান দিয়ে ঘটলো ঘটনা সমস্ত তাও নয়। হঠাৎ এসে বললে তারা বিস্ময়ের পর বিস্ময় জাগিয়ে- ‘আমি এসে গেছি!’ ঠিক যেমন ছবি এসে বলে আজও হঠাৎ- ‘আমি এসে গেলেম, এঁকে নাও চটপট।’ যেমন লেখা বলে- ‘হয়ে গেছি তৈরি চালিয়ে চলো কলম।’ […] দেখার পুঁজি জানার সম্বল তিল তিল খুঁটে ভরে তুলতে কতো দেরি লাগতো যদি চম্কি না থাকতেন সঙ্গে দাসীটা ছেড়ে যাবার পরেও। কিন্ডারগার্টেন স্কুলের ছাত্রের মতো স্টেপ বাই স্টেপ পড়তে পড়তে চলতে দিলেন না দেবী আমাকে, হঠাৎ পড়া হঠাৎ না-পড়া দিয়ে শুরু করলেন শিক্ষা তিনি।

কিন্তু এই লেখাটার নাম তো ‘সাইক্লোন’, তার কী হলো? এতক্ষণেও তো সাইক্লোনের কিছু হলো না! লেখাটা যেখানে প্রায় শেষ সেখানে সাইক্লোন আছে। সেও একটা জানারই কথা- অবনঠাকুর কী করে পরিচিত হলেন সাইক্লোনের সঙ্গে। সাইক্লোন কী, তার পুরো রূপটিকেই তিনি বুঝতে পেরেছেন ওই ঘটনার পরে। বিবরণটা যে দিয়েছেন তার সঙ্গে জীবনের কত পাঠ যে জড়িত তার পরিচয় দেব না। তেতলার সেই ছোট শিশুটি কী করে এক রাতে বড় হয়ে গেল এবং শিখল ঘরের এবং ঘরের বাইরের অনেক কিছু। তারই এক মাহাকাব্যিক পরিচয় পাওয়া যায় শেষ এই অংশটিতে। অবনঠাকুর লিখেছেন :

সেই সময় সেই বহুকাল আগের একটা ঝড় পাঠালেন আমাকে দেখতে চম্কি দেবী। ঝড়টা এসেছিলো রাতের বেলায় এ-টুকু মনে আছে, তা ছাড়া ঝড় আসার পূর্বের ঘটনা, ঘনঘটা, বজ্রবিদ্যুৎ, বৃষ্টি, বন্ধ-ঘর, অন্ধকার কি আলো কিছুই মনে নেই। ঘুমিয়ে পড়েছি, তখন উঠলো তেতলায় ঝড়। কেবলি শব্দ, কেবলি শব্দ। বাতাস ডাকে, দরজা পড়ে; সিঁড়িতে ছুটোছুটি পায়ের শব্দ ওঠে দাসী চাকরদের। হঠাৎ দেখেও ফেললেম চিনেও ফেললেম – দুই পিশিমা, দুই পিশেমশায়, বাবামশায়, আর মাকে, যেন প্রথম সেইবার। তেতলায় এ-ঘর ও-ঘর সে-ঘর সবক’টা ঘরই যেন ছুটোছুটি করে এসে একসঙ্গে একবার আমাকে দেখা দিয়েই পালিয়ে গেলো।

তারপর কে তাঁকে দোতলার বৈঠক খানায় নিয়ে এসেছে তা আর মনে নেই। কিন্তু ওই ঘরে এসে যা তিনি দেখলেন সেই তাঁর প্রথম দেখা। মাথার উপরে সাদা কাপড়ের গেলাপমোড়া একটার পর একটা বড়ো ঝাড়; দেয়ালে দেয়ালে ঝোলানো প্রদীপ- মানে দেয়ালগিরি; আর বাড়ির লোকের ছোটো-বড়ো সব অয়েলপেন্টিং। সেই প্রথম তাঁর মনে হয়েছে “ঝড় যেন একটা কী জানোয়ার”। গর্জন করে ফিরছে বন্ধ বাড়ির চারদিকে! দরজাগুলোও ধাক্কা দিয়ে কেবলি পথ চাচ্ছে ঘরে ঢোকবার। কিন্তু ওটা যে ‘সাইক্লোন’এই শব্দের সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন তিনি ওই রাতেই। একসময় ছেলেদের শুইয়ে দেবার হুকুম হলো। দক্ষিণ শিয়রে মায়ের কাছে সেই প্রথম মেঝেতে পাতা শক্ত বিছানায় মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছিলেন শিশু অবন। কিন্তু ঘুমিয়ে পড়েননি। অনেক রাত পর্যন্ত শুনতে পেলেন বাতাস ডাকছে, বৃষ্টি পড়ছে, আর দুই পিশি পান-দোক্তা খেয়ে বলাবলি করছেন এমনি আর একটা আশ্বিনের ঝড়ের কথা। সেই রাতেই তিনি শুনতে পেলেন ‘সাইক্লোন’ শব্দটি। ঝড়ের এক ধাক্কায় যেন তিনি বাড়ির অনেকখানি, বাড়ির মানুষদের অনেকখানি, সেই সঙ্গে ঝড়ই বা কি, সাইক্লোনই বা কাকে বলে- জানা হয়ে গেল তাঁর। লিখেছেন তিনি : “এক রাত্তিরে যেন মনে হলো অনেকখানি বড়ো হয়ে গেছি, জেনেও ফেলেছি অনেকটা- ঘরকে, বাইরেকেও।” আপনা থেকে জানার ভেতরগত ওই প্রেরণাই তাঁকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতি বিমুখ রেখেছে। বই পড়েছেন তিনি। বিপুল সেই পঠনাভিজ্ঞতা। কিন্তু বইকে বেদবাক্য মনে করেননি কখনো। বরং যা কিছু পড়েছেন তার সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে চেয়েছেন তাঁর দেখা জীবন ও জগৎকে। যদি মিলেছে তবেই ওই পাঠকে গ্রহণ করেছেন। আর ওই পাঠের জোরেই এন্ট্রান্স পাস না করা অবনঠাকুর বিখ্যাত শিল্পী, শিল্পগুরু, শিল্পরসিক, শিল্পতাত্ত্বিক, কলকাতা আর্ট কলেজের প্রথম বাঙালি উপাধ্যক্ষ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বাগীশ্বরী অধ্যাপক এবং বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য। তাঁর বিপুল শিল্পসৃষ্টি আর লেখালেখির পরিচয় নাই-বা দিলাম।