অনুবাদ সাহিত্য ও আমাদের অনুবাদের ভুবন
দিলওয়ার হাসান
অনুবাদ নিয়ে গুরু অনুবাদক এডিথ গ্রসম্যানের একটি উক্তি বরাবরই প্রনিধানযোগ্য বলে বিবেচনা করি : Translation makes us better people, because it opens our mind and allows a better understanding between cultures…Translation expand and deepen our world, our consciousness, in countless indescribable ways….
একথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, বিশ্বসাহিত্য দাঁড়িয়ে আছে ক্ল্যাসিক ও মাস্টারপিস অনুবাদের ওপর ভর করে। সব দেশে সব কালে অনুবাদের মাধ্যমে মহৎ সাহিত্য সংরক্ষিত হয়ে থাকে। অনুবাদ বিষয়টি অনেক প্রাচীন হলেও সাহিত্য হিসেবে এর মর্যাদা বা পৃথক একটি পাঠযোগ্য তত্ত্ব সংবলিত বিষয় হিসেবে স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হওয়ার বয়স বেশি দিনের নয়। মাত্র গত দশকের শেষ ভাগ থেকে অনুবাদ সাহিত্য সমালোচক ও ভাষাতাত্ত্বিকদের কাছে একটি বিবেচনা যোগ্য বিষয় বলে প্রতিভাত হয়েছে। দীর্ঘ দিনের বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অনুবাদ সাহিত্য একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ সাহিত্য – ঘরানা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি। এ আক্ষেপ খ্যাতনামা অনুবাদক খলিকুজ্জামান ইলিয়াসের। সাম্প্রতিক এক লেখায় তিনি বলেছেন, ইদানিং অনুবাদ সাহিত্যের কদর বাড়লেও এবং এর প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য বলে স্বীকৃত হলেও সম্ভবত বিশ্বের কোনো সাহিত্যেই এর আসন এখনও সৃজনশীল সাহিত্যের এক কাতারে নয়। বাংলা সাহিত্যেও এর কোনো ব্যতিক্রম নেই। অথচ একটি দ্বিতীয় কি তৃতীয় মানের মূল রচনার চেয়ে উৎকৃষ্ট একটি অনুবাদকর্মের প্রয়োজনীয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেশি বলে আমি মনে করি। ইলিয়াস মনে করেন, এই দৃষ্টিভঙ্গির অবসান প্রয়োজন কেননা, অনুবাদকর্মও মূলত একটি সৃজনশীল কাজ।
১৯৩৫ সালে লেখা একটি রচনায় বিশিষ্ট অনুবাদক শ্রীনৃপেন্দ্র কৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, কিছুদিন আগে পর্যন্ত আমাদের সাহিত্যে অনুবাদের বিশেষ কোনো স্থান ছিল না, যদিও কাগজপত্রে ‘ছায়া অবলম্বনের’ ছড়াছড়ি ছিল। প্রকাশকেরা অনুবাদের গ্রন্থ ছাপতে চাইতেন না, সাধারণ পাঠক – পাঠিকা গ্রন্থে অপরিচিত বিদেশি নামের নায়ক – নায়িকা দেখলেই সে বই সরিয়ে রাখতেন, সাহিত্যিকরাও অনুবাদকে স্কুল – মাস্টারের মতন সাহিত্য – সমাজের পংক্তি-ভোজনে বিশেষ কোনো সম্মানের আসন দিতেন না। সাহিত্যিক হলো স্রষ্টা… সেইজন্য অনুবাদরা সাহিত্যিক নন, এই রকম একটা ধারণা এখনও পর্যন্ত আছে। তিনি লিখেছেন, তবে একথা ভাবতে আজ আনন্দ লাগে যে, আজ বাংলা – সাহিত্যে অনুবাদ তার স্থান খুঁজে পেয়েছে। প্রকাশক ও পাঠক উভয় শ্রেণির কৃপা – দৃষ্টি অনুবাদের উপর পড়েছে এবং বিদেশি নাম আজ আর অন্ত:পুরচারিণীদের কাছে তত বিদেশি বলে মনে হয় না।
এই স্বীকৃতির সঙ্গে সঙ্গে আজ অনুবাদকের দায়িত্ব শতগুণে বেড়ে গিয়েছে এবং আজ সাহিত্যিকরা উপলব্ধি করেছেন, সাহিত্যের যে কোনো অঙ্গের মত অনুবাদও এক অতি মহৎ আনন্দদায়ক সৃজনকর্ম। অবশ্য একথাও ঠিক যে, সৃজনশীল লেখক বন্ধ্যা সময়ে— যাকে রাইটার্স ব্লক বলা হয়, অনুবাদকর্মে আত্মনিয়োগ করতে পারেন যার মাধ্যমে তিনি তার নিজের সৃষ্টিশীলতা জাগিয়ে তুলতে পারেন, আর মূলের কাছে গিয়ে নিজের কর্ম ও শক্তি পরখ করে দেখতে পারেন। অবশ্য এডিথ গ্রসম্যান এক জায়গায় বলেছেন, প্রায় সব অনুবাদকই একান্তে নিজেদের মৌলিক লেখকরূপে বিচার করতে চান, কারণ অনুবাদকরা যখন এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় পুনর্লিখন করেন তখন তারা মূল ভাষায় রচিত সাহিত্যকর্মের অন্তর্নিহিত আবেগানুভূতি, শৈল্পিকতা ও নান্দনিকতাকে সম্যক উপলব্ধি করে অনূদিত ভাষায় পূন: স্থাপনে ব্যাপৃত হতে পারেন যাকে সফল অনুবাদকের সর্বোচ্চ ও তীব্র যাচনা বলে চিহ্নিত করা যায়, আর সে অর্থে সব ভালো ও সফল অনুবাদকই লেখক।
অনুবাদের আলোচনায় অনিবার্য ভাবেই একটি উদ্ধৃতি উঠে আসে : Translation is like a woman : if she is faithful, she is not beautiful; if she is beautiful, she is not faithful….
আর একটি বিষয় হচ্ছে : Lost in translation…ভাষার ভিন্নতার কারণে একটি টেক্সট এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় প্রতিস্থাপনের সময় মূল টেক্সটের সত্যিকার অর্থ হারিয়ে যায়।
এই অনিবার্যতা মূল লেখক প্রায়শই মেনে নিতে পারেন না। এ প্রসঙ্গে মিলান কুন্ডেরা ওলগা কারলিসলির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে নিজের বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিলেন : I once read a French translation of this page. I was amazed. What in the original text is illogical and fragmented becomes logical and rational in the French translation.
অনুবাদের বড় একটি বিতর্ক হচ্ছে আক্ষরিক অনুবাদ না ভাবানুবাদ। এ বাবদে স্পষ্ট দুটি মত আছে। এক দল আক্ষরিক অনুবাদের পক্ষপাতি। অন্য দল ভাবানুবাদে উৎসাহী।
এ ব্যাপারে জন ড্রাইডেন (১৬৩১-১৭০০) উত্থাপিত অনুবাদের তিনটি শ্রেণির কথা স্মরণ করা যেতে পারে :
১. আক্ষরিক অনুবাদ ( মেটাফ্রেজ) : শব্দ থেকে শব্দ বা বাক্য থেকে বাক্য অনুবাদ।
২.অননুচ্ছেদায়ন (প্যারাফ্রেজ) বা কিছু স্বাধীনতা নিয়ে অর্থ থেকে অর্থ অনুবাদ।
৩.আত্মীকরণ (ইমিটেশন) বা মূল পাঠ থেকে যৌক্তিক ভাবে বর্জন।
গুরু লেখক মহাত্মা বোর্হেস অবশ্য আক্ষরিক অনুবাদ অনুবাদ পছন্দ করতেন। তিনি বলেছেন, বর্তমানে আমরা আক্ষরিক অনুবাদ করি ; বস্তুত, আমরা অনেকেই কেবল আক্ষরিক অনুবাদকেই গ্রহণ করি, কারণ আমরা সবাইকে তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দিতে চাই।… ( শব্দ, সংগীত ও অনুবাদ: কবিতার কারখানা, অনুবাদ : অপূর্ব জামান)।
ইদানিং বাংলাদেশে বিস্তর অনুবাদের বই প্রকাশিত হচ্ছে যার অধিকাংশই ইংরেজি থেকে করা। অন্য ভাষা থেকে অনুবাদের উদাহরণ সামান্যই আছে। এইসব অনুবাদ আবার বেশির ভাগই ফিকশন। নন ফিকশনের অনুবাদ নগন্য।
অনুবাদের ক্ষেত্রে যে দুটি প্রধান ক্যাটাগরি : Translation in and translation out এর যে বিষয়টি আছে সেক্ষেত্রে Translation in অর্থাৎ অন্য ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় অনুবাদ আর Translation out অর্থাৎ আমাদের ভাষার লেখা অন্য ভাষায় অনুবাদ। শেষের বিষয়টি একবারেই উপেক্ষিত হচ্ছে। এ বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাববার সময় এসেছে। আমাদের সাহিত্যে মননশীল ও সৃজনশীল উভয় ক্ষেত্রেই বড় কাজ রয়েছে যা অন্য ভাষায় অনুবাদের দাবি রাখে । Translation in ও Translation out এই উভয় প্রকারের অনুবাদের সমৃদ্ধির জন্য সরকারি ও প্রাথিষ্ঠানিক সহায়তা প্রয়োজন।
বাংলাদেশে অনুবাদের বিষয়টি এখনও সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও ব্যক্তিগত ভাললাগা থেকে উৎসারিত। প্রকাশদের কাছ থেকে প্রনোদনা ও আর্থিক সহায়তা খুব কমই পাওয়া যায়। এই অবস্থার অবসান প্রয়োজন।
গুরু অনুবাদক এডিথ গ্রসম্যানের একটি একটি উক্তি অনুবাদকদের দুর্দশা বাবদে এক কঠিন সত্যকে প্রকাশ করে : Poorly paid and with no job security. Who do not look for fame or fortune but do their job out of love for literature…