অনুবাদের সৃজনশীলতা
খলিকুজ্জামান ইলিয়াস
বাংলা অনুবাদ সাহিত্য বেশ পুরনো – বস্তুত আধুনিক বাংলা ভাষারই সমবয়সী। বাংলা ভাষায় সংস্কৃত থেকে যেমন বহুযুগ আগে অনুবাদ হয়েছে তেমনি অন্যান্য ভারতীয় ও ইউরোপীয় ভাষা থেকেও হয়েছে। তবে ইংরেজ শাসনের পর থেকেই অনুবাদ সাহিত্য একটি বিস্তৃততর প্রেক্ষিত অর্জন করে। এবং এর সিংহভাগই হয়েছে ইংরেজি থেকে। অনুবাদ সাহিত্য কে আমাদের এখানে মোটামুটি অবহেলার চোখেই দেখা হয়েছে কারণ অনুবাদকে সৃজনশীল শিল্পকর্মের পর্যায়ভুক্ত বলে মনে করা হয় নি। কিন্তু এই শিল্পের কদর এখন বেড়েছে এবং অনুবাদ সাহিত্যকে একটি অতি প্রয়োজনীয় এবং সীমিত গন্ডির ভেতরে হলেও আমি কবিতা, উপন্যাস, নাটকের মতো একে সৃজনশীল শিল্প প্রকরণ হিসেবেই মেিন করি।
অনুবাদ শিল্প যে একটা সৃষ্টিশীল প্রকরণ তার পক্ষে বিপক্ষে দীর্ঘদিন থেকেই নানা মতামত প্রকাশ পেয়ে আসছিলো। প্রথম দিকে বিরোধী মতেরই ছিলো প্রাধান্য। যেমন রবার্ট ফ্রষ্ট বলেছিলেন অনুবাদে কবিতার মৃত্যু ঘটে। কিংবা নবোকভের মতে অনূদিত কবিতা হলো তস্তুরিত করে পরিবেশিত কবির বিষন্ন ও বিস্ফারিত দৃষ্টি সম্বলিত মাথা। কিন্তু ফ্রস্ট বা নবোকভের বিপরীতে সমমানের কবি অক্টাভিও পাজ-এর মতে অনুবাদে একটি নতুন কবিতার জন্ম হয় কারণ এর মূল কবিতা আর অনূদিত কবিতা পরষ্পর বিপরীত মুখী, এজন্য সেখানে দুটো কবিতার জন্ম ঘটে- অনুবাদের আলোকে মূল পায় নতুন রূপ। ওযাল্টার বেঞ্জামিনেও এ ধরণের ভাবনার প্রকাশ ঘটে। বেঞ্জামিন বলেন যে, অনুবাদ যদি মূলের মতোই হতে চায় তাহলে তা সম্ভব নয় কারন অনুবাদ হলো মূলের পরবর্তী জীবন। অনুবাদে মূল লেখাকে পরিবর্তিত হতেই হয়। জীবনানন্দ দাশের “হায় চিল“ কে যদি ইয়েটসের “ঞযব জবঢ়ৎড়াবং ড়ভ ঈঁৎষব’ি’ এর সৃজনশীল তর্জমা হিসেবে দেখি, তাহলে তো বলতেই হয় যে, একটি নতুন কবিতার জন্ম হয়েছে।
অনুবাদ শিল্পতত্তে¡ আরেকটি মত আছে যাকে বলে ফরেনাইজেশন অর্থ্যাৎ মূল টেক্সট এর সময় এবং আবহ ও অনুষঙ্গঁ কিছুটা হলেও অনুবাদে রসিত হওয়া উচিত। এই মতবাদও একভাবে নভোকভ কি ফ্রষ্টের মতেরই সমর্থক। এতে বলা হয়, অনুবাদে মূলেও আবহ, সংস্কৃতি, স্থানকাল মানুষজন সবই মোটামুটি বহাল রেখে অনুবাদ করলে লক্ষ্যভাষার পাঠক মূলের একটা সম্যক ধারনা পাবেন। কিন্তু এমন ধারনা খুব একটা বাস্তবসম্মত বলে মনে হয় না। বর্তমানের লক্ষ্যভাষার পাঠক ভিনদেশী ভাষায় সৃষ্ট মানুষজন আর পারিপাশির্^ক কে কখনোই পুরোপুরি অনুভব করতে পারেন না। মূল সাহিত্যকর্মের মানুষ, স্থানের নাম, খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকর্মের নাম অবিকৃত পেলেই তো যথেষ্ট। এতেই পাঠক বুঝবেন যে তিনি একটি বিদেশী সাহিত্য পাঠ করছেন। উৎসভাষার অনেক উপাদানই অনুবাদে চলে আসে- আসতে বাধ্য। যদি না আসে তাহলে তাকে অনুবাদ না বলে অ্যাডাপটেশন বা ছায়া অবলম্বনে রচিত ইত্যাদি বলা উচিত। আসলে সচেতন ফরেনাইজেশন অনুবাদ পাঠককে আকৃষ্ট করে না। কারণ, বোর্হেস যেমন বলেন আক্ষরিক অনুবাদের কোনো সাহিত্যমূল্য নেই।
অনুবাদের সৃজনশীলতা বহুলাংশে নির্ভর করে অনুবাদক হিসেবে আপনি কতটুকু স্বাধীনতা নেবেন, তার ওপর । বেশিও নয় আবার আক্ষরিকও নয়–এই দুয়ের মাঝামাঝিই মনে হয় অনুবাদক তার সৃজনশীলতা প্রমান করতে পারেন। এজন্য সৃজনশীলতা মানেই অনুবাদককে লক্ষ্যভাষায় মাতৃভাষা সুলভ দক্ষতা দেখাতে হবে। মূলভাষার পারঙ্গমতায় কিছুটা ঘাটতি থাকলেও লক্ষ্যভাষায় কোনোরকম দূর্বলতা থাকা চলবে না। সবভাষারই সীমাবদ্ধতা আছে, বস্তুত ভাষা মাত্রই এক নড়বড়ে হাতিয়ার। হারমান হেস যেমন বলেন ভাষায় কেবল অর্ধসত্যই প্রকাশ করা চলে, কিংবা যেমন কাজানজাকিস বলেন, হায় আমার অন্তর যা জানে তা যদি জানতো আমার মস্তক- অর্থাৎ ভাষায় যদি অন্তরের কথা প্রকাশ করা যেত, কিন্তু এই টুটাফাটা হাতিয়ার ছাড়া আমাদের উপায়ই বা কী। তবে একেক ভাষার বিচিত্র শক্তির জায়গাও থাকে। বাংলা ক্রিয়াপদকে বিভিন্নভাবে বাক্যের বিভিন্ন জায়গায় ব্যাবহারের সুবিধা তা বরং ইংরেজি ভাষায় সেভাবে নেই। ইংরেজির সুবিধা হলো দীর্ঘ বাক্যবন্ধ সর্বনাম যোগ করে লেখা যায় এবং তা পড়তে খারাপ লাগে না। একইভাবে ইংরেজি বাকে রহঃবৎৎঁঢ়ঃরহম স্টেটমেন্ট ব্যবহারের সুযোগ আছে, যা স্বাভাবিক বাংলায় নেই বললেই চলে । এরকম ক্ষেত্রে দীর্ঘ ইংরেজি বাক্য ভেঙে একাধিক বাংলা বাক্য সৃষ্টি না করলে অনুবাদ পাঠযোগ্য হয় না।
অনুবাদের সৃষ্টিশীলতায় অন্যতম একটি দৃষ্টান্ত হলো একই গ্রন্থ একাধিক অনুবাদকের হাতে একাধিক রূপ আর ব্যাঞ্জনা পায়। একটি রাগ যেমন এক এক জন শিল্পীর কন্ঠে একাধিক রূপ পরিগ্রহ করে, একই লয়-তাল-মুদ্রা সম্বলিত নাচের কম্পোজিশন যেমন দুজন নাচিয়ের দ্বারা দুভাবে পরিবেশিত হয়, একই চরিত্রের অভিনয় যেমন দুজন অভিনেতা বা অভিনেত্রী দুভাবে করে থাকেন, তেমনি অনুবাদেও মূলভাষায় একটি সাহিত্য কর্মের অনুবাদ দুজন অনুবাদকের হাতে দুরকম স্বাদ, বর্ণ, ছন্দে উদ্ভাসিত হয়। অনুবাদের সৃজনশীলতা প্রকাশ পায় অনুবাদকের স্টাইলে। আ লিক ভাষার উপস্থাপনাতেও অনুবাদক তার সৃষ্টিশীলতার স্বাক্ষর রাখতে পারেন। যে কোন সাহিত্যে আ লিক উপকরন থাকবেই। ভাষা একটি অ লকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে।
একটা সম্প্রদায়ের দীর্ঘকাল একই ধরনের আবহাওয়ায় একত্র বসবাস, একই রকমের খাদ্যাভাস এবং জীবনযাত্রা নির্বাহের ফলে আ লিকতা যেকোন সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাড়াঁয়। এরপরও যখন ক্ষুদ্রজনগোষ্ঠী বাইরের বৃহত্তর দুনিয়ার সংর্স্পশ প্রায় না পেয়ে বিচ্ছিন্নভাবে জীবন যাপন করে, তখন তাদের সৃষ্ট হয় লোকাল কালার । এখন এরকম সম্প্রদায়ের নৃ ও সমাজতাত্তি¡ক চরিত্র অক্ষুন্ন রেখে অনুবাদ করতে গেলে লোকাল কালার কে বহুলাংশে এর বৈশিষ্ঠ্য বজায় রাখতে হয়। আ লিক বর্ণকে রূপান্তর করা কঠিন কাজ কারণ ঐ সংস্কৃতির সমপর্যায়ের প্রকাশ লক্ষ্যভাষায় মেলা ভার। একবারে খোলনচলে পাল্টিয়ে যদি জয়েসের ডাবলিনারের চরিত্রগুলোকে ঢাকাইয়া চরিত্রে রূপান্তর করা হয় তাহলে তো সেটা অনুবাদ হলো না, হলো ছায়া অবলম্বনে রচিত জাতীয় কিছু। ফকনারের কল্পিত স্থান ইয়োকনাপাটাওফা কাউন্টি বা নারায়নের মালগুদির কাহিনি পুরোপুরি আ লিক, এবং অনুবাদে ওদের ওপরেই রাখতে হবে। ওখানকার একেবারে তৃনমূল পর্যায়ের চরিত্র যদি প্রমিত ভাষা ব্যবহার করে অনুবাদ করা হয় তাহলে যেমন চরিত্রগুলো জ্যান্ত হবে না, তেমনি ওদের মুখে লক্ষ্যভাষার কোন অ লের বুলি তুলে দিলেও তা শোনাবে বেখাপ্পা। আর লক্ষ্যভাষার কোনো অ লের কথা ব্যবহার করে মূলভাষার চরিত্রকে কিছুটা হলেও জীবন্ত করে তোলা যাবে সেটা নির্ভর করে অনুবাদকের সৃজনশীলতার উপর।
আফ্রিকা বা এশিয়ায় যাঁরা ইংরেজি ভাষায় সাহিত্যকর্ম করেন তাঁরা নিজেদের মানুষজন সংস্কৃতি আর্যা প্রবচন ইত্যাদিকে রূপান্তরিত করে সৃজনশীল কাজে নিয়োজিত হন। যেমন চিনুয়া আচেবে ইগবো সম্প্রদায়ের মানুষের মুখে প্রমিত ইংরেজি ব্যবহার করেও তাদের অথেনটিক সমাজকে স্বার্থক ভাবে বিবৃত করেন, কেবল মাঝে মাঝে ইগবো শব্দ বা প্রতিবেশিক অনুষঙ্গঁ, বচন প্রবচন ব্যবহার করেন। এরা একটি বিদেশীভাষায় বেশ জোরালো ভাবে নিজেদের অথেনটিক সমাজকেই চিত্রিত করেছেন। এখন এরা যদি তৃণমূল পর্যায়ের সংস্কৃতিকে বিদেশী ভাষায় আঁকতে পারেন, তাহলে অনুবাদেও আরেকটি বিদেশী ভাষায় সেই সংস্কৃতিকে রূপান্তরিত করতে না পারার কোনো কারন নেই; এবং এই রূপান্তরেও অনুবাদককে মূল লেখকের মতোই সৃজনশীল হতে হয়।