অনন্ত পিপাসার কবি শাহিদ আনোয়ার
ইউসুফ মুহম্মদ
সৃজন পিপাসা মানুষের আদি এবং অকৃত্রিম, সে কথা আমরা সবাই জানি। মানব সভ্যতা বিকশিত হতে হতে মানুষের আচরণ, আচার ব্যবহার, সঙ্গ-অনুষঙ্গ ও চৈতন্যে রূপান্তর ঘটে এবং অন্তর নিসৃত অনুভবকে ভাষায় প্রকাশ করে; সৃষ্টি হয় কবিতা। পথে চলতে চলতে কবিতার শব্দ-ছন্দ-গন্ধ-আকার-প্রকার-অনুভব বদলে যায়, পরিবর্তন আসে বাসনার রঙে, নতুন রস উৎসারিত হয় কামনার স্রোত ধারায়, যে ধারা কখনো শুকায় না, যে স্রোতের প্রবাহে মানুষ গায় আনন্দ-বেদনার গান।
পৃথিবীর বিচিত্র রূপ, ব্যক্তিক ও নৈর্ব্যক্তিক বোধ, অভিঘাতের অভিব্যক্তি ও জীবন-ভঙ্গির প্রকাশে এই কবিতার পথ তরঙ্গসংকূল, ক্ষুব্ধ । এ পথের আবেগীনিকেতনে শিল্পের ছোঁয়া না থাকলে কারবার জমানো দূরুহ বৈকি। সত্য-সুন্দর বাকবিন্যাসে একটি স্বতন্ত্র স্বর তৈরি করে কবিকে এগিয়ে যেতে হয় সৃজন পিপাসায়। এভাবে নিজেকে দগ্ধ করে এগিয়ে যাওয়াদের কাতারে আমরা অনেকের সাথে একজনকে পাই – তিনি কবি শাহিদ আনোয়ার।
শাহিদ আনোয়ার (শহীদুল ইসলাম) ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৬০ সালে পৃথিবীর আলো দেখেন । তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামেই। তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে সম্মিলিত মেধা তালিকায় যথাক্রমে তৃতীয় ও পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করেন। সেখানেও রাখেন মেধার স্বাক্ষর।
ঘোরগ্রস্ত নীচু-স্বরের শাহিদের মধ্যে আছে স্বপ্নভঙ্গের বেদনা, শাশ্বত বিশ্বাসের সুক্ষ্ম তন্ত্রী খোঁজার আকুতি, স্মৃতি রোমন্থনের পট ও প্রেমানুষঙ্গের রঙধণু তরি। এ তরি ভাসিয়ে তিনি সৃষ্টি করেছেন অনির্বচনীয় শব্দের নতুন বিন্যাস। অন্তর্গত সৌন্দর্যের প্রতি অনুরক্ত কবির আনন্দ-প্রেম বিষাদের পায়ে সমর্পিত।
শাহিদ “শুঁড়িখানার নুড়ির মধ্যে” কাব্য গ্রন্থের তৃতীয় কবিতায় নিজেই তার কাব্য- ঘোরের কথা প্রকাশ করেছেন এভাবে:
শুঁড়িখানার নুড়ির মধ্যে / একটি গোলাপ ফোটে / ব্যর্থ প্রেমের সন্তাপে কী / প্রেমিক চন্দ্র ওঠে? / জোছনা জোগায় মদ্য তাজা / নেশার কাব্য ঘোর / রাতের শরীর দাফন করে / আকুল হলো ভোর।
এ গ্রন্থের চুয়াল্লিশটি কবিতা পাঠ করলে বুঝা যায় শাহিদ আনোয়ার জীবন নিংড়ে কতটা নির্জনতা খুঁজে পেয়েছেন, খুঁজেছেন “কবিতার অন্ধকারে” নিজের ও মানসপ্রিয়ার কবর।
মানুষের ঋজু সৌন্দর্য, জীবনের আয়নায় বিম্বিত প্রেম, হর্ষ-বিষাদ এ সব শাহিদ আনোয়ার স্বভাব-সুলভ সারল্যে অভিজ্ঞতার আলোয় মেলে ধরেন আমাদের সামনে।
তাই আমরা পাই ‘ধাত্রী’র মতো এমন খুরধার কবিতা— যেখানে কবি জীবন আকাঙ্খা ছুঁয়ে মুক্তির স্বাদ পাওয়ার বাসনায় ধাত্রীকে আহবান করছেন তাঁকে মুক্ত করার জন্য। এর মাধ্যমে ব্যক্তিক বিষয়কে সামষ্টিক করায় প্রয়াশি শাহিদ আনোয়ার মুক্তি চান পরাধীনতা থেকে, মুক্তি চান সামাজিক কূপমণ্ডকতা , মিথ্যা ও অসত্য থেকে, শুনতে চান মানুষের জয়গান। তিনি স্বাধীনভাবে পৃথিবীর রূপ পরিপূর্ণভাবে দেখতে আগ্রহী, যা চিত্রিত হয়েছে এ ভাবে—
কুঁকড়ে আছি মনোটোনাস গর্ভে / ধাত্রী আমায় মুক্ত কখন করবে? / শুনেছিলাম সূর্য দারুণ সুন্দর / শুনেছিলাম রাত্রি দারুণ সুন্দর / শুনেছিলাম তোমার ওমুখ সুন্দর / শুনেছিলাম বিশ্ব দারুণ সুন্দর / বন্ধ চোখের রন্ধ্রে আলো ঝরবে / ধাত্রী আমায় মুক্ত কখন করবে?/
জড়িয়ে আছি গর্ভে ফুলে ফুলে / মনোটোনাস রাত্রি ওঠে দুলে / উৎস থেকে আমায় ফেলো খুলে / মিথ্যা থেকে আমায় লহো তুলে / স্বপ্ন ছিঁড়ে দোলনা কাছে আনো / ধাত্রি আমার দুহাত ধরে টানো। (কুঁকড়ে আছি মনোটোনাস গর্ভে)
শাহিদ আনোয়ার তাঁর নিজস্ব ঋতি, ভাব ও ভাবনার তরঙ্গে আমাদের ভাসাতে পারেন তাঁর সৃজনশীল মননে। তাঁর অনুসন্ধানী মন আরাধ্য প্রিয়াকে খুঁজে নিতে উৎসুক, যা পাঠককে রোমান্টিকাতার অন্য এক স্রোতে অবগাহন করায়। কবি তাঁর প্রিয়াকে বাসায় ও হাসপাতালে না পেয়ে ছুটে যান চিতায়— সেখানে হৃদয়স্পর্শী যে বয়ান তা যে কোনো পাঠককে পোড়াতে পারে। তাঁর যে বেদনা তা কবি সবার
সাথে ভাগ করে নেন এবং সকলকে অংশী করেন। যা ছড়িয়ে যায় অন্তরে অন্তরে।
“প্রতিবেশীর জন্য এলিজি” কবিতায় তিনি লিখেন:
যখন বাসায় গেলাম / তুমি হাসপাতালে / যখন সমস্ত কেবিন খুঁজে কর্তব্যরত ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করি— / তুমি পরলোকে। / ফের বাসায় গেলাম / তুমি চিতায় /এবং যখন চিতায় গেলাম / তুমি পুড়তে পুড়তে অঙ্গার। / শুধু দুটি পায়ের পাতা দেখতে পেয়েছি / পরক্ষণে / তুমি পা গুটিয়ে নিয়েছ। …
এ কবিতায় তিনি তাঁর অন্তরের অধিবাসীর একটি নাম করণও করেছেন ‘আঁখি দাশ গুপ্তা’। এখানে তিনি নিজেই আবার বলছেন, ‘ভালোবাসা বলতে যা বোঝেন বিজ্ঞ লোকেরা/ও রকম কিছুই ছিলো না আমাদের/তবে, মিথ্যে নয়/ তোমাকে লক্ষ্য করে মাঝে মাঝে ভাবনার কালো পিপীলিকা/একটুও হাঁটতো না, এমনও নয় ‘…
কবির অনুসন্ধানী মন এভাবে শব্দের দরজায় দরজায় ঘুরে বেড়ায়, পাঠককে হাত ধরে নিয়ে যায়, ভ্রমণ করায়তার সাথে। যাকে ভালোবাসতে মন চায় তার এড়িয়ে যাওয়া দেখে পীড়িত হয়নি এমন মানুষ খুব কমই আছেন। এই এড়িয়ে যাওয়ার দহন তিনি অতি সংগোপনে সকলের মধ্যে বিলিয়ে দেন।
এভাবে তিনি আমাদের চোখের ওপর মেলে ধরেন তাঁর কবিতা প্রকরণ। আমরা ক্রমাম্বয়ে পেয়েছি তাঁর সৃষ্ট নতুন অম্বয়, নববিন্যাসের কাব্যগ্রন্থ “দাড়াও আমার ক্ষতি” ,“বৈদেহী এক ওষ্ঠ পোড়ে”, “শ্রেষ্ঠ কবিতা” ভুক্ত হয়েছে অগ্রন্থিত কিছু কবিতাও।
শাহিদ আনোয়ার কবিতার কেন্দ্রে নিজেকে স্থাপন করে যে বিষয় উপস্থিত করেছেন তা শুধু তার নিজের কথা নয়, সে কথা পাঠকেরও। পড়তে পড়তে মনে হবে এতো আমারও কথা। এভাবে কারো মনের কাছে পৌঁছুতে পারার মধ্যেই নিহিত আছে শাহিদের কাবিকৃতি।
শব্দ ও ভাব নিয়ে খেলা শাহিদের মজ্জাগত, তার কবিতার চরণই এর বড় প্রমাণ:
“একজন দক্ষিণপন্থি মৌলবাদী” কবিতায় আমরা দেখি এখানে তিনি সামাজিক প্রেক্ষাপটে আবস্থান করে কবিতাকে নিয়ে খেলছেন। খেলতে খেলতে নির্দেশ করেন মানুষের চিরন্তন সত্যের অম্লান দ্যুতি—
“একজন দক্ষিণপন্থি মৌলবাদী / আমাকে বললো, / আপনি একজন পাড় কমিউনিস্ট / অতএব আপনি ধর্মচ্যুত। / ওই মেয়েটির বাবা / আমাকে একজন মুসলিম সন্তান ছাড়া / আর কিছুই ভাবে না / অতএব আমি মুসলিম ছাড়া আরক কী? / বর্ণশ্রেষ্টত্বের দাবিদার একজন শ্বেতাঙ্গ লোক / আমাকে কৃষ্ণাঙ্গ ছাড়া কিছুই ভাবে না / অতএব আমি একজন ঘৃণিত মানুষ। / একজন কলের মালিক / ভাবলো আমি এক শ্রমিক ভিন্ন আর কী / সুতরাং আমি এক পেছন সারির লোক / বাকি আছো / কেবল তুমি / হ্যাঁ, তুমি / তুমিই কেবল। / তুমি আমাকে / কীভাবে নিচ্ছো / এটাই আমার শুধু / শুনতে ইচ্ছা করে।”
কবিতা পাঠ শেষে জীবনের অন্য এক আকুতি জেগে ওঠবে পাঠকের মনে, এ কথা নির্দিধায় বলা যায়। জীবন সেঁচে আনন্দ ও বিষাদ মাতাল মুক্তো প্রকাশ করার এক অদ্ভুদ ক্ষমতা রয়েছে শাহিদ আনোয়ারের।
“ব্যথা হচ্ছে আপেল বিশেষ” কবিতায় কবি ভাবের বৈচিত্র্য সৃষ্টি করেছেন এ ভাবে –
আমি সংগীত ও সমুদ্র লবনের ক্রীতদাস কবি / আপেলের ক্রীতদাস, আপেল পাতার কাছে বন্দি মানুষ। / আমি সময়ের আত্মার অফুরান স্পন্দনভুক লোক / আমি লালিমা ছড়ানো এক আপেল টুকরা করি / আয়ুভুক প্রেমের করাতে। / তাকে খেতে দিই, খেতে দিই, খেতে দিই তাকে / অতৃপ্ত, নিষ্পাপ, অজস্র অফুরান, অনাবিল তৃষ্ণার রাতে। / আমার প্রেমিকা খায় আমারই আপেল তার / প্রভাতের জুঁইফুল দাঁতে। / সবুজ ছড়ানো কিছু আপেল পাতার মালা / গেঁথে ফেলি আয়ুভুক নষ্ট সুতোয় / তার বাহুতে পরিয়ে দিই, কব্জিতে, কণ্ঠা কিনারে / তাকে খেতে দিই প্রাণের হীরার দ্যুতি / তাকে আমি পুরোপুরি ঢেকে ফেলি আপেল পাতার বর্ষাতে / আমার প্রেমিকা খায় আমারই আপেল / তার প্রভাতের জুঁইফুল দাঁতে।
তাঁর কবিতায় আমরা লক্ষ্য করি ভাবের সৌরভ, সমৃদ্ধ সুর; যে সুর কখনো উদাত্ত-উচ্চকিত, কখনো নীচু, কখনো মৃদু, কখনো ধীরলয়ে, কখনো দ্রুতবেগে একধরনের খোয়াব তৈরি করছে। ছন্দ নিয়েও খেলেছেন নানা ভাবে। তান, ধ্বনি ও শ্বাসাঘাতসমৃদ্ধ ছন্দের প্রয়োগে তাঁর মুন্সিয়ানা ও নৈ্পুণ্য বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণের দাবি রাখে। আধুনিক মন-মানস ও যুগ-যন্ত্রণার প্রেক্ষাপট বিবেচনায় কবির চোখে প্রেম-দেহের সীমায় অস্তিত্ব হারা এক বেলুন। তাই কবি অকপটে বলতে পারেন:
…“সোনালি রমণী তোর হাসিটুকু লেগে আছে ঠোঁটে / ছেনালি জানিস তুই, শুধু আমি তার ব্যতিক্রম / অধিবিদ্যা-জোরে তোর দেহকোষে শুক্রানুরা ছোটে / আমাকে চুম্বন দিস, নেবো না কো তার চেয়ে কম। …
লাজুক, অন্তর্মুখী ও নিভৃতচারী শাহিদ আনোয়ার ভেতরের সুপ্ত বারুদ ঘষে নিজে পুড়ে পুড়ে আমাদেরও পোড়ার আয়োজন সম্পন্ন করেন তাঁর কবিতায়। তিনি নিজেকে ভাঙেন এবং গড়েন জীবন জিজ্ঞাসার নতুন আলোয়। এভাবে তিনি তাঁর সিঞ্চিত অভিজ্ঞানের অমিমাংশিত প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে প্রস্থান করেন নিরুদ্দেশ গন্তব্যে। কিন্তু তিনি তাঁর কাব্যের স্তনে যে দুগ্ধবীজ রোপন করেছেন তার স্রোতধারা বহুকাল বহমান থাকবে বাংলা সাহিত্যে। তাঁর দগ্ধ-বেদনার এ ভাষ্য ও প্রেম জাগরুক থাকবে পাঠকের মনে। পাঠক তাঁকে প্রতিদিন আবিষ্কার করবেন নতুনভাবে নতুন প্রত্যাশায়।