You are currently viewing অধিহার || নাহার মনিকা

অধিহার || নাহার মনিকা

অধিহার || নাহার মনিকা

অন্ধকার দিয়ে মোড়া বেইজমেণ্ট যেন দিন-মাসের পোয়াতির পেট, ধীর নিথর থেকেও কেঁপে কেঁপে ওঠে। বাল্বটা বদলাতে হবে। দোকানের ষ্টক, মশলাপাতি, ক্যানফুড ইত্যাদি শেষে পুরু প্লাষ্টিকের পর্দ্দার পেছনে ওয়াক-ইন ক্লজেটের মত ফ্রিজ। টাল টাল ছাল ছাড়ানো পোলট্রি আর ঝোলানো গরু, খাসির কাঁচা মাংসের গায়ে ঠেকায় পড়ে লেপ্টে থাকা শাদা চর্বি, ঠান্ডায় গা শির শির করে সাইদুলের। একটা ফোল্ডিং খাট ফেলার মত জায়গা আছে কোনায়, মিজান ভাইয়ের বাসায় নাকি আছেও বাড়তি একটা। স্লিপিং ব্যাগের ওপরে আরেকটা ভারী লেপ চাপাতে হবে ঘুমের সময়। সময় করে একবার স্যালভেশন আর্মির দোকানে ঢু মারতে হবে। পুরান দোকানে প্রায়ই ভালো জিনিষ পাওয়া যায়।
মাথা গোজার ঠাঁই হলো, আর কি চাই? সাইদুল আরেকবার দেখে, ঘরের ভেতরের চারপাশ, তাল শ্বাসের মত ঘন বাতাস। আমিষগন্ধী ঝাঁঝ। তারপরও কুছ পরোয়া নেহি। এক বছরের বাসা ভাড়া বাঁচলে বিদেশ আসার ধার শোধ হয়ে যাবে।
সব দেখিয়ে শেষে মিজান ভাই যখন মিট স্লাইসিং মেশিনটার কাছে আসে, সাইদুলের ভয় লাগে, প্রথম ব্যবহার দেখতে গিয়ে অজান্তে তার আঙ্গুল কাঁপে, তারপর খুব সাবধানে শুরু করে। তার পাঁচফুট তিন ইঞ্চির হাইট উপযোগী করতে একটা নিচু জলচৌকির মত কিছু সামনে জুতে দেয়। সপ্তাখানেকের মধ্যে আরিফুলের এক্সপার্ট হাত, প্রায়শই ঠান্ডা, শক্ত। বিদেশে গ্রোসারী ষ্টোরে কাজ করতে হবে এটা আবছা মাথায় ছিল, কিন্তু এভাবে হেভী ডিউটি মাছ মাংস কাটতে হবে কখনো ভাবেনি। অসুবিধা নাই, সাইদুলের তাতে তেমন অসুবিধা নাই। মাথার পরিশ্রমের বদলে গায়ে খাটাই ভালো লাগে তার। আর সেতো আর সারাজীবন এই দেশে থাকবে না।
*
সোমবার, অফ ডে। ডোর বেল বেজে উঠলেও সাইদুল তাড়াহুড়ো করে ওপরে দৌড়ায় না। মিজান ভাই আছে। রোজার মাসে সোমবারেই শুধু সে আয়েশ করে ইফতার খেতে পারে। অন্য দিনে বিশেষ করে শুক্র, শনি, রবি ইফতারের টাইমেই দম ফেলার ফুরসত পায় না সাইদুল। রোজা, ইফতার কিছুই মনে থাকে না, কাঁধে করে গরুর ফ্রোজেন রান এনে মিট কাটারের টেবিলে ফেলে টুকরো করতে করতে কখন যে ইফতারের টাইম হয়! কাষ্টমার দু’একজন থাকলে- ‘পানির বোতল নেন’ বলে মিজান ভাই হাক ডাক শুরু করলে তার হুশ হয়। কারুর হয়তো তখন সেল ফোন বেজে ওঠে- ‘এইতো কোরাল মাছটা কাটায়া আসতেছি’ বললে সাইদুল বোঝে তাকে এখনি নিচের ফ্রিজার থেকে বড় কোরালের দু চারটা ওপরে আনতে হবে।

ফোল্ডিং খাটের পায়ের দিকে ষ্টীলের তাক বসিয়ে ছোট্ট একটা টেলিভিশন দিয়েছে মিজান ভাই। ওপরে পয়তাল্লিশ ইঞ্চি ফ্ল্যাট স্ক্রীন, যাদু টিভির কানেকশনে কাষ্টমারেরা বাংলা চ্যানেল দেখতে প্রায়ই ভীড় জমায়, বিশেষ করে ইণ্ডিয়া, পাকিস্থান আর বাংলাদেশের ক্রিকেট ম্যাচ থাকলে। একই সংযোগে অফ ডে’তে সাইদুল বিছানায় শুয়ে রিমোর্ট টিপতে পারে। মিজান ভাইকে ভালো লাগে- কত দিকে খেয়াল লোকটার! এমনি এমনি কি ব্যবসা চালু হয় নাকি?
রিপন আসবে বলে সাইদুল উঠে পরে, লেপটা ভাঁজ করে।
রিপনকে নিয়ে বাইরে যাওয়াই যায়, সেভেন এইটি সিক্স নামের ইন্ডিয়ান রেষ্টুরেন্টে খাওয়া দাওয়া করে আসা যায়। কিন্তু সাইদুল যেমন জানে, রিপনও জানে- ঈদের আগে তিরিশ চল্লিশ ডলারের ব্যবহারিক মূল্য দেশের আত্মীয়স্বজনের কাছেই বেশী। ভরপেট খাওয়ার আনন্দের পরে টাকা গচ্চার আফসোস বড় হয়ে দাঁড়ালে খেয়ে আর লাভ কি। তারচে ঘরের খিচুরী মাংসই ভালো। সবচেয়ে বড় কথা তাপমাত্রা মাইনাস টেন হলে দশ মিনিট হাঁটার ইচ্ছা আশমানে গিয়ে ওঠে সাইদুলের। তেমন প্রয়োজন হয় না বলে মাসকাবারী বাস পাসও সে কেনে না। রিপনের নাকি শীত গায়ে লাগে না, সুতরাং সেই রাস্তায় নামুক, সাইদুলের কাছে আসুক।
রিপন এসেই হই হই করে সাইদুলের খাটে বাংলা পত্রিকা খুলে বিছায়। মাইক্রোওয়েভে কেনা হান্ডি কাবাবের কন্টেইনার বিজ বিজ শব্দে তুলে ঘুরছে। মুড়ি মাখা, চাক চাক শশা পেপার প্লেটে রেডী। ওপরে মিজান ভাই রোজা না থাকা পাব্লিক, তবু তাকে এক প্লেট না দিয়ে নিজেরা খায় কি করে? সাইদুল সাবধানে খেজুরের প্যাকেট খোলে।
-“হালায় রোজা থাকে না ক্যান জানস?” রিপন ফিস ফিস করে… “টাকা বানায়া তো বদহজমের পর এখন আলসার হইয়া গেছে, রোজা রাইখা আল্লার কাছে আর কি চাইবো?” দুজনের আচমকা চাপা হাসির দমকে ঘরের বাতাস টাল খায়।
কামরাঙ্গীর চরের শেষ মাথার ঠিক আগে যে দেড় কাঠার ওপরে সাইদুলের চারতলা, যা শেষ করার অভিপ্রায়ে সে বিদেশে পারি জমিয়েছে সেটা প্রায় শেষ। এত বড় একটা ঝুঁকি সে নিতে পেরেছে রিপনের মেজভাই ছিল বলে। কে বলে পর আপন হয় না? মা এখন দোতলার ডানদিকের ফ্ল্যাটে উঠে গেছে। খুব খোলামেলা না, চারদিক একরকম বেড় দেয়া তারপরও এই বাড়ি মাকে মুন্সীগঞ্জের কথা মনে করায়। রিপনের ভাই কাজের বুয়াও যোগাড় করে দিয়েছে। না হলে সাইদুল কাছে না থাকায় মৃতবৎসা এই নারী কার ওপরে ভরসা করতো। আর সাইদুল তো তার প্রজেক্ট শেষ করেই ফিরবে। চারতলা উঠে গেলে আর কি লাগে? কে থাকে এই আবালের দেশে! ভাষা বোঝে না, বাইরে বের হওয়া যায় না শীতের চার পাঁচ মাস। কোন আক্কেলে মানুষ এইসব দেশে থাকে বোঝে না সাইদুল।
-“পয়সা কামাইতে আসো, পাসপোর্ট বাগাইতে আসো- ভালো কথা, খাটো, কামাও তারপর ঘরের পোলা ভাই ঘরে যা গা, তরে কেউ বাইন্ধা রাখবো?”
নাহ, সাইদুল অন্তত থাকতে আসেনি। থাকার আবেদন জানিয়ে কেইস ফাইল একটা সে করেছে বটে, তা নইলে পুলিশ ধরবে, ওয়ার্ক পারমিট পাওয়া যাবে না। কিন্তু সেটা তার বাড়িটা কমপ্লিট হওয়া পর্যন্ত চললেই হবে। তারপর তাকে ক্যানাডিয়ান সরকার ডিপোর্ট করে দিলেও সে হাসি মুখে প্লেনে ওঠার আগে লুকিয়ে একটু থুথু ফেলে যাবে কানাডার মাটিতে।
-“একটা দেশ হইলো, শালা ঠান্ডার ঠান্ডা, হাড্ডি গুড্ডি শুদ্ধা এমুন শক্ত যে ধার দিয়া মিট কাটারে লাগায়া দিলে ফ্রোজেন গরু কাইট্টা ফালান যাইবো”।
সাইদুলের বকবকানি শুনে রিপন হাসে। তার কোন ইচ্ছা নাই নিজের গার্বেজ দেশে ফিরে যাওয়ার। নিজের দেশ বলেই সে চালনি দিয়ে ছেঁকে ছেঁকে সমালোচনা করতে পারে। -“ মিরপুর থেইকা গুলিস্থান আইছস কুনোদিন? সি এন জিতে বইয়া থাকতে থাকতে পাগলা কুত্তা হইয়া যাবি। এইহানে বইয়া ট্যার পাইতাছো না হালার পো। আর ঠান্ডার কথা কও, গরমের কি করবি? কত কাপড় খুলবি?”
রিপনের রেষ্টুরেন্টের কাজ খারাপ না। মেজদার শালার ফ্যামিলির সঙ্গে সাবলেটে ভালোই আছে। সাইদুলের মত বাড়তি কষ্ট করতে হয় না।
-“দোস্ত, মেজদাদারে যে কি বইলা প্রশংসা করুম বুঝতে পারিনা। মায়রে কইছি, উনি ডেলি আইলেও খবরদার না খাইয়া যাইতে দিবা না”… সাইদুলের আবেগজাত ইষৎ কম্পন কন্ঠে এসে ধরা দেয়। একটু ত্রস্ত হাতেই প্লেটে প্লেটে ইফতারী সাজায় সে।
আজকে বেইজমেন্টের মেঝেটা বেশী স্যাতস্যাতে। একটু ভেজাও কি? গত মাসে ড্রেইনেজের সংযোগ খুলে গিয়ে সেকি কেলেংকারী! সাইদুল সেদিন গোড়ালী ভাসা ময়লা পানি পার হয়ে বিছানায় উঠেছে। পরদিন অবশ্য মিজান ভাই মিস্ত্রী ডাকলো।

ইফতারের টাইম হয়ে গেছে। তড়িঘড়ি দু’জনেই আমের জুসের বোতল খোলে। হাতের তালু ভর্তি মুড়ি নিয়ে মুখে পোড়ে। গরম গরম হাণ্ডি কাবাব বাঁধাকপির ক্লোসলা সালাদের সঙ্গে খেলে সারাদিনের অনাহারী দেহ কিছু রসদ পায়। কিছুক্ষণের মধ্যে শীতের প্রকোপ কমে বায়বীয় উষ্ণতার স্পর্শ আসে ঘরটায়।
সাইদুল দৌড়ে ওপরে গিয়ে একটা কোকের বোতল নিয়ে আসে, কাবাবের সঙ্গে জমে ভালো। রিপন ততক্ষণে রিমোর্ট টিপে টিভি চালিয়ে দিয়েছে।
*
ছোলামুড়িতে মুখ ভর্তি করে কোকের ক্যান খুলতে গিয়ে সাইদুল খেয়াল করতে পারে না টিভির কোন চ্যানেল থেকে রিপন কোন চ্যানেলে বদলে দিলো। যাদু টিভির কারিশমায় এনটিভি, চ্যানেল আই আর এটিএন বাংলা। সব কয়টায় বিজ্ঞাপন। দেশে এখন ভোর। লোকজন হয়তো সেহেরী খাচ্ছে। সাইদুল ছোটকালে সেহেরীর সময় কাফেলাতে শামিল থাকতো, বিনিময়ে মসজিদের ফ্রি ইফতার! সেইসব স্মৃতিময় দিন মনে পড়ে। রিপনকে সে সুরেলা গলায় লোক ডাকাডাকির কায়দা শুনিয়ে হাসায়। বাড়তি ছোয়াব হবে বলে কত ঠেলেঠুলেই না মা তাকে পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে পাঠাতো! বঙ্গমার্কেটে সেলসম্যানের চাকরী পাওয়ার পর কাফেলা পার্টির সঙ্গী হওয়ায় ক্ষান্ত দিয়েছে।
একটু পরে সব চ্যানেলে নিউজ শুরু হয়। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তিনটা চ্যানেলে সেই একঘেয়ে বিজ্ঞাপন, একই রকমের নিউজ। সাইদুলের সিবিসি দেখতে ইচ্ছা করে, লোকাল খবরাখবর। স্পোর্টস, সল্প বসনা সাঁতার প্রতিযোগিনী শরীরে পানির স্ফটিক ফুটিয়ে সাক্ষাৎকার দেয়। সন্তরণকারী দেহ দেখতে দেখতে বিরক্তি অথবা কি ভেবে আবার এটিএন বাংলায় ফেরত আসে। ততক্ষণে সংবাদ শুরু হয়ে গেছে।
টেলিভিশন চলতে থাকে, তবে দুই বন্ধুর মশগুল কথার ফাঁকে সংবাদের টুকরো কন্ঠস্বর জায়গা করতে চাইলে জুৎ করতে পারে না। কচি শসার মুচমুচে স্বাদ জিভের ভেতরে মিলিয়ে না যেতে এক বৃদ্ধার মৃত অবয়ব দেখানো হয় টিভি পর্দ্দায়। সাইদুলের হা করা মুখ থেকে ফ্যাকাশে শসার ক্ষয়িত দু একটা কুচি নিচে পড়ে যায়। বৃদ্ধা মহিলাটির মুখ সবেগে এসে তাকে ধাক্কা মারে, যেন তীর, যেন মহাকর্ষ হারানো উল্কা। তার মায়ের চোখ তখনো কেউ বুজিয়ে দেয় নি। ঘরের লালচে মেঝেতে টিভি ক্যামেরা ঘুরে ঘুরে আসে, তার মায়ের কুন্ডুলী পাকানো দেহ তখনো কেউ উঠিয়ে সোজা করে শোয়ায় নি। দূর্বৃত্তরা ব্লেড দিয়ে কন্ঠনালী চিড়ে তাকে ফেলে রেখে গেছে।
ইফতারের সময় টেলিভিশনের সংবাদের মাধ্যমে ছাড়াও মায়ের মৃত্যু সংবাদ আরো কত অন্যরকম ভাবেই তো তার কাছে পৌঁছাতে পারতো! সাইদুলের সামনে ঢাউস তরমুজের ফালিগুলো ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে। প্লেটের নীচে কমিউনিটির বাংলা কাগজের পাতায় ছোট ছোট বিজ্ঞাপন, ওপরে হেডলাইনে বড় করে লেখা-“ছোট কিন্তু শরভেদী”- এর মানে কি জানে না সাইদুল।

– “ওই ওই ওইডা কি কয়? কি কয়?” মুখচাপা খাবারের সঙ্গে তার আর্তনাদ কিছুটা ম্রিয়মাণ হয়ে প্রকাশ পায়। রিপন ক্ষিপ্রহাতে টিভির চ্যানেল বদলায়, একই রকম সব সংবাদ। অন্য কোথাও যদি দেখায়!
কয়েক সেকেন্ড আগে দেখানো সংবাদটা কি বিভ্রম? তার না শেষ হওয়া চারতলা বাড়ীটাই তো দেখালো, না কি? সিঁড়ির কাছে স্তুপ করা ইট, কাঠ, বালি। তিন বছর আগে সেই যে সাইদুল পাগলামী করে বাড়ির শেষ হওয়ার আগেই নেইম প্লেট বানালো- ‘কাজী মঞ্জিল’, মায়ের ইচ্ছাতে, দাদার নামে। শাদা পাথরের ওপরে কালো অক্ষর। সিঁড়ি দিয়ে ক্যামেরা যাচ্ছিলো, লাল বর্ডার দেয়া রেলিংএর নিচে সেটা দাঁড় করানো, এখনও। ঘরের ভেতরের ষ্টিলের আলমারী- ঘি চকচকে সবুজ রঙ্গের। মায়ের খাট, আলনায় ভাঁজ করা শাড়ী। সব তার চেনা পরিচিত। আর মায়ের মুখটা, নামটা? কিন্তু ব্লেড পোচ দেয়া গলাটা? ওটা কার?
এটা কি সংবাদ! এটি এন বাংলা, নাকি এন টিভি নাকি বৈশাখী টেলিভিশন? যাদু বাক্স নামের স্যাটেলাইট সার্ভার কাকে দিয়ে এই সংবাদ সাইদুলের কাছে পৌঁছে দিয়ে গেল? বিছানায় দু’মিনিট হাঁটুতে মুখ গুজে থেকে ঝট করে উঠে দাঁড়ায় সাইদুল। এক দৌড়ে ওপরে এসে দু একজন কাষ্টমারকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে রাস্তায়, ফুটপাতে এসে দাঁড়ায়। ফুটপাত বিষণ্ণ, ধারাল শীতের আস্তর মেখে সন্ধ্যেবেলার মানুষের গাড়ি বহরের রক্ত চক্ষু দেখে। সাইদুলের কান্না পায় না। বোকার মত লাগে। রাস্তার এপাশে ওপাশে একবারও না দেখে একটা দৌঁড় দিতে ইচ্ছা করে। তাতে যেখানে পৌঁছায় পৌঁছাক, এমনকি না পৌঁছানোর দেশে যদি হয়, তাও আপত্তি করবে না সে।
একটু পরে তার জ্যাকেট হাতে রিপন, তার পেছন পেছন মিজান ভাই আরো দু’ একজন কাষ্টমার নিজের পাশে দেখে বিহবল লাগে। তাকে টেনে ভেতরে ঢোকালে সে বিনা বাক্যে মেনে নেয়। তিনচারজন দাঁড়ালে অন্য খরিদ্দারের অসুবিধা হয়। সাইদুলকে রিপন বেইজমেন্টে নিয়ে আসে। টিভিটা এখনো চলছে। মিহি সুরে ফোন কোম্পানীর বিজ্ঞাপন চলছে – ‘কই রইলা রে বন্ধু কই রইলা রে…’। সাইদুল নিজের চোখের ভেতর আতি পাতি দৃষ্টি তুলে টিভি দেখে। কামরাঙ্গীর চলে এক নির্মানাধীণ ভবনের দোতলায় বৃদ্ধা খুনের সংবাদ কি পূনঃপ্রচার হবে?
সাংবাদিক বলে যাচ্ছিলো- ধারনা করা হচ্ছে সম্পত্তির জন্য বৃদ্ধাকে খুন করা হয়েছে। বাড়ির জমিটা সাইদুলের দাদা তার বাপ মরা নাতির নামে লিখে দিয়েছিলেন। মায়ের যেমন কোন সম্পত্তি নাই তেমনি তার আত্মীয় স্বজনের কাছে যাওয়া আসাও ছিলো না। তাহলে ষ্টীলের আলমারিতে ক্যাশ টাকা, বড়জোর বিশ-বাইশ হাজার। তার টাকা পাঠানোর কথা এই সপ্তায়। ঈদের জন্য বাড়ির কাজ বন্ধ বলে সে দেরী করছিলো। এই বিশ বাইশ হাজার টাকার জন্য তার মায়ের জীবন চলে যাবে! বিশ্বাস হয় না সাইদুলের। আর কি কারণ থাকতে পারে, আর কি? সাইদুল ভাবলেশহীন বসে বসে অপেক্ষা করে, আবারো সংবাদ পূনরাবৃত্তির, যেখানে দেখাবে- ঐ বাড়িটা গলির শুরুর বাড়ি না। ঐ ধরনের আলমারি সবার ঘরেই একটা করে থাকে, আর ঐ বয়স্ক মহিলাটা তার জন্মদাত্রী না।
মিজান ভাই দু’বার এসে খোঁজ নিয়ে গেছে। সামনের উইকএণ্ডে ঈদ, বিক্রিবাট্টা বেশী। কোনমতেই ক্যাশ খালি রাখার উপায় নাই। সোমবারে যে ছেলেটা সাইদুলের জায়গায় মাংস কাটে- বড় স্লো। তার নিজেরও হাত লাগাতে হচ্ছে।
রিপন অপ্রস্তুত ব্যস্তহাতে ফোন টিপতে থাকে। মেজভাইকে এই ভোররাতে ফোনে পাওয়া যায় না। আর কাকে ফোন করবে। সংবাদে কি বলেছিলো- যে এটা পুলিশ কেইস এখন? লাশ কার কাছে? একগাদা প্রশ্ন এসে মুখের কাছে জমা হলে সে খামোখা সাইদুলকে খেঁকিয়ে ওঠে- “ তরে না কইলাম একটা বাসা নে। এই কুয়ার মইধ্যে কেমনে থাকস তুই?”।
অধোবদন সাইদুল মায়ের সঙ্গে তার গত শুক্রবারের টেলিফোনালাপ মনে করে। কাজের বুয়া সংক্রান্ত খিটিমিটির কথা ছিল। খুব একগাল হেসে কোন ইফতারের দাওয়াতের কথা ছিল। ডায়াবেটিস চেক করানোর কথাও ছিল- সাইদুল বলেছিল পরের দিনই যেন ডাক্তারের কাছে যায়। ইত্যকার কথার মধ্যে কোথাও এক আততায়ী লুকিয়ে ছিল-এই দূর হতচ্ছাড়া প্রবাসে বসে সাইদুল কেমন করে টের পাবে!
রিপন মেজভাইকে কিছুতেই মোবাইলে পায় না। ভাবীর সাইনাসের সমস্যা- ফোন করে তার ঘুম ভাঙ্গানো যাবে না। রিপন তার বড়ভাইকে চেষ্টা করে- আর ‘এই মুহূর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না’ শুনে তার মুখ ব্যাজার হয়।
তারপর তার –“কি করবি”র জবাবে মৌনমুখ সাইদুলকে দেখে সেও চুপ করে বসে থাকে। বেইজমেন্টের শৈত্যপ্রবণ বাতাস তাদের রোমকূপে কাঁপন ধরাতে থাকে।
এক পর্যায়ে রিপন উঠে দাঁড়ায়।
-শোন, আমার কামে যাইতে হইবো। এর তো আর ঈদ রমজান নাই। তুই ফোন দিস, আর আমিও দেখি মেজদারে পাই কিনা”।
সাইদুল একই রকম বসে থাকে, যেন তার কাঁধের ফেরেস্তারা বিশাল বিশাল হিমালয় পর্বত দু’হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। টিভিতে বিজ্ঞাপন বিরতি ক্রমাগত –‘কই রইলা রে বন্ধু কই রইলারে’ বাজিয়ে যায়। রিপনের চলে যাওয়ার পেছন দিকে তার খয়েরী উইন্টার জ্যাকেটের রেশ ফ্রিজারে ঝোলানো চামড়া খসানো, মাথা থেকে গলা বিচ্ছিন্ন লালচে বাদামী গরু খাসির অঙ্গ প্রত্যঙ্গর সমান্তরালে মাথার ভেতরে ঝুলতে থাকে। বিদ্যুৎচমকের মত ভাবনা আসে- মেজদা না তো? রিপনের মেজদা না তো? মা সহ তার সমস্ত স্থাবর দেখভালকারী মেজদা তো আর তার আপন ভাই না!
কাষ্টমারের সাথে মিজান ভাইয়ের ঠাট্টা ইয়ার্কির দরাজ হাসি হামাগুড়ি দিতে দিতে বেইজমেন্ট পর্যন্ত ভেসে আসে। সাইদুল চৌকোনা ঘরের সরু জায়গায় পায়চারী করে, অস্থির। চালের বস্তা, মশলার কার্টুন, শাক শুটকি ইত্যাদি উবে গিয়ে তার চোখে শুধু মস্তকবিহীন খাসি গরুর ধর আটকে থাকে। সাইদুল ফোন বের করে মায়ের মোবাইলে ঘোরায়। টেলিভিশন বন্ধ তবু কোথায় যেন একঘেয়ে ‘কই রইলা রে, বন্ধু কই রইলা রে’ বেজে যায়।

**********************