You are currently viewing অংশুমান কর: একগুচ্ছ কবিতা

অংশুমান কর: একগুচ্ছ কবিতা

অংশুমান কর: একগুচ্ছ কবিতা

 

পরিত্যক্ত

 

কোনও কোনও বাড়ি লিন্টল পর্যন্ত উঠে থেমে যায় ঢালাই হয় না জানলা-দরজা বসে না মাঠের প্রান্তে, গ্রাম শেষ হওয়ার মুখে ধুলোকালি মেখে দাঁড়িয়ে থাকে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ইটের গায়ে জমে কালচে শ্যাওলা কে যে এর মালিক, কে যে একটা গোটা বাড়ি বানাতে গিয়ে মাঝপথে থেমে গেছে—অনেক খোঁজ খবর করলে তবে হয়তো জানা যায় মালিকের কথা বাড়িটার অবশ্য মনেও থাকে না তার মেঝে খুঁড়ে গর্ত বানিয়ে  আগুন জ্বালে ছেলেরা, ফিস্টি করে পোড়া দাগের ওপর ইট ঘষে ঘষে লেখা হয় সুমন+মল্লিকা আর কোনও একদিন অন্য এক মল্লিকার পাপড়ি দলে দেয় অন্য এক সুমন সারা গ্রামের রাগ দেয়ালে দেয়ালে খিস্তি হয়ে ফুটে থাকে যে বাড়ি তৈরি হয়ে গেছে, যে বাড়ির জানলা-দরজা আছে, সে বাড়িতে কোনও ফিস্টি হয় না, সে বাড়িতে কেউ মল্লিকা দলে দেয় না দেয়ালে লেখে না খিস্তি এসবের জন্যে চাই লিন্টল পর্যন্ত উঠে থেমে যাওয়া একটা বাড়ি যে চায় ফিস্টি হোক,প্রস্তর যুগের শিলালিপির মতো দেয়ালে দেয়ালে লেখা হোক খিস্তি, প্রখর রৌদ্রের ভেতর পা টিপে টিপে একদিন সুমনের জন্যে এসে দাঁড়াক মল্লিকা

মাঠের প্রান্তে, গ্রামের শেষে, তাই লিন্টল পর্যন্ত উঠে থেমে যায় একটা বাড়ি, আমার কবিতা

 

বাবা


পুরোনো শোক আমারা ভুলে গিয়েছি। দুজন নতুন মানুষ এসেছে আমাদের ঘরে আর আমরা তাদের কোথায় বসাব, কী খাওয়াব, কীভাবে এগিয়ে দেব হাত ধোয়ার জল ভাবতে ভাবতে ভুলেই গেছি এই জ্যৈষ্ঠে পুরে যাবে পাঁচ বছর। আশ্চর্য না? যে-শোক মনে হয়েছিল কাটবে না কোনোদিন, বছর যায় আর সস্তা ডিসটেম্পারের মতো ফিকে হয়ে আসে তা। ছোটো সিংহাসনে যেখানে ঠাকুর থাকে এখন সেখানে কালী-দুর্গা-শিবের সঙ্গে তুমিও। সেই ঠাকুর যাকে তিনশো চৌষট্টি দিন ভুলে থাকতে থাকতে বিপদে পড়ে, একদিন হঠাৎ বলে উঠি : ‘রক্ষা করো’

 

প্রাকৃতিক


তিন দিন ভাইয়ের বাড়িতে থাকার পর
চারদিন আমার বাড়িতে থাকতে আসে মা।
আবার তিন দিন আমার বাড়িতে থেকে
চার দিন ভাইয়ের বাড়িতে থাকতে যায়।
চাকরি সূত্রে আমি এক জায়গায়
ভাই আরেক জায়গায়।
সম্পত্তি নিয়ে গোলমাল হয়নি
ঝগড়া-ঝামেলা হয়নি
ভাগাভাগি হয়নি
তবু আমি এক জায়গায়, ভাই আরেক জায়গায়।
মা এখানে চারদিন, ওখানে তিন দিন।

লোটাকম্বল নিয়ে, ট্রেনে চড়ে, রিকশো ঠেলে
কাঁচুমাচু মা-কে আসতে দেখি আর ভাবি
বাঘের বাচ্চাকে বড়ো করে দিলেই বাঘের মায়ের মুক্তি
মানুষের মায়ের মুক্তি নেই!


কাঙাল


খবর না দিয়েই
মাঝে মাঝে বন্ধুরা নম্বর পালটে ফেলে

সবুজ বাটনে তখন যতই চাপ দিই
পুরোনো নম্বরে আর রিং হয় না

অবশ্য মাঝে মাঝে
রিং হয়।
অপরিচিত গম্ভীর কণ্ঠ বলে:
‘রং নাম্বার’

মাঝে মাঝে
রিং হয়, শুনি: ‘হ্যালো’
পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছি
ভেবে
কথা বলে যাই
দুম করে কেউ কেটে দেয় না লাইন
দশ সেকেন্ড যায় কুড়ি সেকেন্ড যায়
তারপর একসময়
ঈষৎ বিষণ্ণ স্বরে
যে বলে ওঠে, ‘রং নাম্বার’
সেও আসলে কথার কাঙাল
তার বন্ধুরাও
খবর না দিয়েই
নাম্বার পালটে নিয়েছে!


মাইন


শুধুমাত্র বেঁচে থেকেই কেউ কেউ আমাদের কষ্ট দেয়। কোনো ক্ষতি করে না আমাদের, ভয় দেখায় না, চাক্কু দেখায় না, ভিড়ের ট্রেনে ছিঁড়ে নেয় না বউ-এর লকেট। শুধু বেঁচে থাকে। বছরের পর বছর, শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা, মানুষের উপেক্ষা, ছোড়া গরম জল হজম করে বেঁচে থাকে। আমরা ভাবি, লোকটা মরলেও তো পারে, কাল থেকে যেন আর দেখতে না হয় ওর মুখ। কিন্তু পরের দিনও আমরা দেখি মোড়ের মাথায়, শিবমন্দিরের পাশে, প্ল্যাটফর্মের গা ঘেঁষে ঠিক বেঁচে আছে। আমাদের যাওয়া ও আসার পথে ঘুমন্ত মাইনের মতো বেঁচে থেকে অস্বস্তি ছড়াচ্ছে।

 

ফ্রিজ


প্রথম ফ্রিজ এল আমাদের বাড়ি
টেম্পো চড়ে, লাল, আলালের ঘরের দুলাল
প্রথম ফ্রিজ
ঘরে বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব
দু-দিন বেশ আইসক্রিম খেলাম আমরা
ছোটো ছোটো রেকাবিতে আপেল, সন্দেশ
           ঝকঝক করতে লাগল
তারপর ফ্রিজ পড়ে রইল, বন্ধু আরশোলা
আর ঠান্ডা, মারাত্মক ঠান্ডা

ঘরে রয়েছে ফ্রিজ
আপেল নেই আর, সন্দেশ নেই
ছোটো ছোটো ট্রে-তে টলটল করছে জল
জল জমে বরফ
ঘরে রয়েছে বরফ, কেবল বরফ

 

আদিম সাম্যবাদী সমাজ


জড়বুদ্ধিসম্পন্ন একটি বাচ্চা এসেছে বিয়েবাড়িতে
কথা বলছে না, গ্রিট করছে না
আদিম মানুষের মতো
পাহাড় সমুদ্র পেরোনো দৃষ্টি নিয়ে
দূর কোনো এক মায়া সভ্যতার দিকে তাকিয়ে রয়েছে
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে
আমরা তাকে বসার জায়গা করে দিচ্ছি
গেলাস ভরে এগিয়ে দিচ্ছি জল
ভূর্জপত্রে সাজিয়ে দিচ্ছি অন্ন

জড়বুদ্ধিসম্পন্ন একটি বাচ্চা, আদিম মানুষ,
এসেছে বিয়েবাড়িতে

আমাদের ভুলে যাওয়া সাম্যবাদ
প্র‍্যাকটিস করাতে…


চক্র


গুহার পেছনে সাজানো ডিভান বালিশ বিছানা মহাঘুম
ঘুমের পেছনে অন্ধ একাকী হাতড়ায় কিছু হাতড়ায়
হাতের স্পর্শ কয়লা খাদানে হাতের স্পর্শে পার্কস্ট্রিট
বার রেস্তোরাঁ শপিং এরিনা ফুটবল মাঠে দর্শক
লোকাল ট্রেনের প্রথম ভোরের মৃদু ভিজে থাকা কোনো সিট
সিটের পেছনে চোঁয়ানো আলোয় দিগন্ত কাটা গুহামুখ
গুহার অতীতে এখনও অন্ধ বন্ধ করেনি পাখা তার
সে পাখার নীচে এসি-র আরাম…গতি…স্তব্ধতা…শীতকাল


মেঘদূত


অনেকদিন পরা হয়নি বলে
বন্ধ হয়ে গেছে ঘড়ি।
শোরুমের মিষ্টি মেয়েটি
হেসে বলল: বন্ধ তো হবেই
হাতঘড়িদের চাই হাতের উত্তাপ

কতদিন দেখা নেই, তাপ নেই
আমি তবু দিব্যি চলেছি…

 

মিনতি আমার রেখো


যেভাবে
টিকিট চেকার, রাগী প্যাসেঞ্জার
জুতো পালিশওয়ালা আর চা বিক্রেতার
হাঁকডাক এড়িয়ে
ভিড়ের ট্রেনে অন্ধ বাউলের
কণ্ঠে আসে গান
ভালোবাসা
যদি এসো
অতখানি মগ্ন হয়ে এসো

 

পরিচয়লিপি

জন্ম বাঁকুড়ার বেলিয়াতোড়ে। বাঁকুড়া-পুরুলিয়ায় জীবনের অনেকটা সময় কাটানো এই কবি, ঔপন্যাসিক ও অনুবাদক বর্তমানে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক। স্বল্পকালের জন্য ছিলেন  সাহিত্য অকাদেমির পূর্বাঞ্চলের সচিব। কবিতা ও উপন্যাসের পাশাপাশি অংশুমান লিখেছেন বেশ কিছু ছোটোগল্প ও কয়েকটি নাটক। বিনয় মজুমদারের জীবন অবলম্বন করে রচিত উপন্যাস “আমি বিনয় মজুমদার” ইতিমধ্যেই পাঠকের সমাদর পেয়েছে। সমাদৃত হয়েছে সুনীল ও স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়ের জীবন অবলম্বনে লেখা সংলাপ উপন্যাস “পারিজাতে প্রহরে প্রহরে”। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় অংশুমান নিয়মিত প্রবন্ধও লিখে থাকেন। ধারাবাহিক ভাবে যুক্ত থাকেন অনুবাদকর্মে। সম্পাদনা করেছেন অস্ট্রেলিয়ার অ্যাবওরিজিনাল কবিতার বাংলা অনুবাদের একটি গ্রন্থ, “কালো অস্ট্রেলিয়ার কবিতা”  ও ভারতবর্ষের বিভিন্ন ভাষার কবিতার বাংলা অনুবাদের সংকলন, “সীমানা ছাড়িয়ে”। সম্পাদনা করেছেন শঙ্খ ঘোষের ওপর ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত প্রথম বই “ওয়ার্ড অ্যান্ড ট্রুথ: রিডিং শঙ্খ ঘোষ” এবং বাংলা কবিতায় দেশভাগের প্রভাব বিষয়ক প্রথম প্রবন্ধ সংকলন “কাঁটাতার ও কবিতা”। সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে দেশভাগ নিয়ে লেখা তাঁর দীর্ঘ ডকু-কবিতাগ্রন্থ “দেশছাড়া দেশহারা”।  কবিতা রচনার জন্য পেয়েছেন বাংলা আকাদেমি, কৃত্তিবাস, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ প্রভৃতি পুরস্কার। কবিতা পড়েছেন বাংলাদেশ, স্কটল্যান্ড, আমেরিকা ও জার্মানিতে।