You are currently viewing অঁরে দ্য বালজাক এবং ভ্রাতৃগণ/ শফিউল আজম মাহফুজ

অঁরে দ্য বালজাক এবং ভ্রাতৃগণ/ শফিউল আজম মাহফুজ

অঁরে দ্য বালজাক এবং ভ্রাতৃগণ

শফিউল আজম মাহফুজ

ফরাসী ঔপন্যাসিক ও নাট্যকার বালজাক ( Honore de Balzac ) ১৭৯৯ সালের বিশে মে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি উনিশ শতকের ঠিক মধ্যভাগ পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন, তার মৃত্যু হয় ১৮৫০ সালের ১৮ই অগাস্ট। ইউরোপিয়ান সাহিত্যে সম্ভবত বালজাকই প্রথম ‘realism’ এর চর্চা শুরু করেন। ইংরেজি ‘great’ শব্দকে যদি বাংলায় মহান হিসেবে তর্জমা করা হয় তবে তাকে মহান উপন্যাসিক ও নাট্যকার বলা যেতে পারে। উদ্ভট চরিত্র সৃজনে দারুণ মুন্সিয়ানা দেখিয়েছিলেন এই শিল্পী। তবে এই উদ্ভট চরিত্রগুলো মোটেই বাস্তবতা বিবর্জিত ছিলো না। সত্যিকথা বলতে গেলে বলতে হয়, এই ধরনের উদ্ভট চরিত্র আমাদের চারপাশে এমনকি প্রত্যেক সমাজেই ছড়িয়ে আছে, বোধ করি বালজাকের সময়কালীন সময়ে ও এমন অদ্ভুত এবং উদ্ভট চরিত্র ছড়িয়ে ছিলো; সেই দৃষ্টিভঙ্গিতে বলতে গেলে বলতে হয়, এই সব চরিত্র মোটেই অবাস্তব চরিত্র ছিলো না বরং এইসব চরিত্র ছিলো জীবন এবং সমাজ সত্যের অনুগামী। এই প্রসঙ্গে একটা কথা যোগ করছি, না করলেও পারতাম বস্তুতঃ করার চাইতে না করাই সহজ (এটা অনেক বিষয়েই সত্য), সেটা হচ্ছে- আমরা বেশিরভাগ ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও মহাকাব্য রচয়িতার হাতে যে সকল মহান চরিত্র অংকিত হতে দেখেছি বরং প্রকৃত প্রস্তাবে সেই মহান চরিত্রগুলোই বাস্তবতার নিরিখে উদ্ভট এবং অবাস্তব। কারণ তাঁদের হাতে অংকিত এতো মহান এবং ত্রুটিমুক্ত চরিত্র বাস্তবতা বিবর্জিত। বাস্তবে আমরা যেইসকল চরিত্র পেয়ে থাকি তাদের অনেককেই মহৎ বলা গেলেও একেবারে ত্রুটিমুক্ত বলা যায় না, অন্ততঃ আমি সেইরকম সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত চরিত্রের সাক্ষাত লাভ করিনি, পাঠকদের অনেকের সেই সৌভাগ্য হলেও হতে পারে হয়তো। মোদ্দা কথা- বাস্তব জীবনের চরিত্রগুলো অনন্যোপায়ভাবেই জীবন্ত এবং নানা ত্রুটিতে সমৃদ্ধ। বালজাকের কাজ কারবার ও ছিলো এই ধরনের বাস্তব চরিত্র সৃষ্টি করা, তাই বলা হয়ে থাকে তার রচিত চরিত্র সম্পূর্ণ কালো বা সাদা নয় (এখানে শরীরের রং নয় বরং মন ও চরিত্রকে ইঙ্গিত করা হচ্ছে) বরং সেগুলো ত্রুটি ও মানব স্বভাবজাত বৈচিত্র্যপূর্ণ খামখেয়ালীতে ভরপুর সে কারণেই অনেক বেশি মানবিক ও সত্যনিষ্ঠ। একভাবে মূল্যায়ন করতে গেলে, তা করা হয় ও বৈকি, বলা যেতে পারে তাঁর হাতেই তৎকালীন ফরাসী সমাজ অংকিত হয়েছিল সচাইতে সত্যনিষ্ঠভাবে। তার বিখ্যাত গ্রন্থ যাকে আমরা প্রধান কাজ বা ‘magnum opus’ বলে থাকি তা হচ্ছে ১৮১৫ সালে নেপোলিয়ান বোনাপার্টের পতনের পরবর্তী সময়কালীন ফরাসী সমাজ ও জীবনের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরা কিছু ছোট গল্প ও উপন্যাসের এক সমষ্টি এবং সমষ্টিগতভাবে যার নাম দেয়া হয়েছিল ‘লা কমেডি হিউম্যাইন’ ( La comediehumaine).

আজকের সমাজে বালজাকের নাম মূল লেখার কারণে যতটা না উচ্চারিত হয় তার চেয়ে ঢেরবেশি উচ্চারিত হয় তার দ্বারা অনুপ্রাণিত বিপুলসংখ্যক শিল্পী তথা ঔপন্যাসিক, গল্পকার, সিনেমা-পরিচালক এবং চিন্তাবিদের কাজের জন্য। এই বিপুলসংখ্যক বালজাক দ্বারা অনুপ্রাণিত শিল্পী বালজাককে নানাভাবে তাদের শিল্পকর্মে আলোচনায় এনেছেন। বালজাককে এই কারণেই বলা হয়ে থাকে ‘Seminal Writer’ বা সৃষ্টিশীল লেখক। না ‘সৃষ্টিশীল’ শব্দটাতে পুরো ব্যাপারটা বোঝা গেলোনা, মুলতঃ প্রত্যেক লেখকইতো কোন না কোনভাবে সৃষ্টিশীল তাই বালজাককে কেবলমাত্র সৃষ্টিশীল বললে কম বলা হবে। ‘সেমিনাল’ শব্দটা ঐ ধরনের বিশেষ মানুষদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হয় যাদের কথা, লেখা, চিন্তা অন্য আরো অনেকের লেখার, কথার এবং চিন্তার যোগান দেয়। এই ধরনের ‘সেমিনাল’ লেখকরা প্রায়শই এমন চিন্তা ভাবনার অবতারণা করেন যা নিয়ে আরো অনেক কাজ এবং গবেষণা করা যায়, তাঁরা মৌলিক মৌলিক চিন্তার সূত্রগুলো ধরিয়ে দেন আর পরবর্তীকালে এইসকল এক একটি চিন্তা সূত্রের রশি টানতে টানতে অনেকেই জনপ্রিয় হয়ে যান। এবং এই সকল মৌলিক চিন্তা সূত্রের দড়ি বা রশি বহুদিন অবধি টানাটানি চলতে থাকে আর তা স্বাভাবিক ও বটে, কারণ এইসকল মৌলিক চিন্তাসূত্র পরবর্তী গবেষণা ও পূর্ণ বিকশিত হওয়ার দাবী রাখে। এই মৌলিক চিন্তা সূত্রগুলোকে বীজ এবং বীর্যের সাথে তুলনা চলে যা কিনা পরবর্তীতে সৃষ্টি করে দিতে পারে এক বিশাল অরণ্য কিংবা সৃষ্টি করে দিতে পারে এক বিশাল সমাজের। কারণ এই সকল চিন্তাসূত্রের মধ্যে লুক্কায়িত থাকে সৃষ্টিশীলতার মন্ত্র। সত্যি কথা বলতে ইংরেজি ‘seminal’ শব্দটি ‘seed’ ও ‘semen’ তথা বীজ ও বীর্যের সাথে সম্পর্কযুক্তও বৈকি। আসল কথায় আসা যাক- বালজাকের লেখায় এই ধরনের ‘চিন্তাসূত্র’ অকৃপণভাবেই লুকিয়ে আছে। অনেক ক্ষেত্রে লুকানো নয় অনেক খোলাখুলিভাবেই আছে এবং তার লেখা পড়ে সমাজের অনেক ঘটনাই আপনার কাছে নতুনভাবে নতুনরূপে ধরা দিতে পারে। যেমন ধরুন না সেই লাইনটার কথা ‘প্রতিটি ঐশ্বর্যের পেছনে রয়েছে একটি অপরাধ’ (Behind every fortune there is a crime)- এই আপাতঃ সাধারণ লাইনটা আপনার দৃষ্টিভঙ্গিকে তুমুল পাল্টে দিতে পারে এবং আপনি হয়তো সমাজকে একটু ভিন্নভাবে দেখতে শিখবেন। ও ভালো কথা, মারিও পুজোর ‘গডফাদার’ বইটির সাথে যদি আপনি পরিচিত থাকেন তাহলে নিশ্চয়ই জানেন বইটি শুরু হওয়ার আগেই মারিও পুজো বালজাকের এই লাইনটি ‘প্রতিটি ঐশ্বর্যের পেছনে রয়েছে একটি অপরাধ’ তুলে ধরেছেন। এর দ্বারা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে মারিও পুজো বালজাক দ্বারা দারুণভাবে উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত ছিলেন। বালজাক দ্বারা অনুপ্রাণিত ঔপন্যাসিকদের মধ্যে রয়েছেন- চার্লস ডিকেন্স, এডগার এলান পো, ফিউদোর দস্তয়ভস্কি, অস্কার ওয়াইল্ড, গুস্তাভ ফ্লোবার্ট, হেনরী জেমস, উইলিয়াম ফকনার প্রমুখ। বলা হয়ে থাকে ‘কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোর’ রচয়িতা কার্ল মার্কস এবং ফ্রিডরিখ এঙ্গেলসের মতন দার্শনিকেরাও বালজাক দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত ছিলেন। ফিউদোর দস্তয়ভস্কি ১৮৩৮ সালের ৯ই আগস্ট তার ভাইকে লেখা এক চিঠিতে জানান, তিনি বালজাকের অধিকাংশ রচনা পড়ে শেষ করেছেন। পরবর্তীতে ১৮৪৩ সালে সামরিক বাহিনীর প্রকৌশল বিভাগে সেনা হিসেবে কর্মরত অবস্থায় দস্তয়ভস্কি বালজাকের ‘ইউজেনি গ্রান্ডেট’ (Eugenie Grandet) বইটি অনুবাদ করেন যা কিনা রিপারটরি এবং পেন্থিওন

(Repertoire and Pantheon) জার্নালে প্রকাশিত হয়। এটিই দস্তয়ভস্কির প্রথম সাহিত্যকর্ম হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল।

বালজাক কেন আজো গুরুত্বপূর্ণ এই প্রশ্ন যদি করা হয় তা হলে একটি কথাই আমার মনে সর্বাগ্রে উঁকি দেয় তা হলো– বালজাকের সমসাময়িক পাঠকেরা যতটা না বালজাককে তথা বালজাকের চিন্তা-ভাবনাকে আত্মস্থ করতে পেরেছিলো সম্ভবত তার চেয়ে অনেক বেশি আত্মস্থ করতে পেরেছে বর্তমানের পাঠকেরা। একারণেই শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে একটা কথা প্রায়ই বলা হয়, শিল্প-সাহিত্য সবসময় সমসাময়িকতা থেকে এগিয়ে থাকে। সমসাময়িক পাঠকেরা তাই এসব সাহিত্য পরিপূর্ণভাবে আস্বাদন করতে প্রায়শই ব্যর্থ হয়ে থাকে। এ প্রসঙ্গে একটি কথা বলতে ইচ্ছে করছে– একবার ভারতের জনপ্রিয় চিত্রশিল্পী মকবুল ফিদা হোসেনকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তিনি মনে করেন কিনা যে তিনি ভারত সরকার কিংবা ভারতের লোকজনের আক্রোশের শিকার। বস্তুতঃ ফিদা সে সময় অশ্লীল এবং ধর্মকে হেয় করা ছবি আঁকার অভিযোগে ভারতের উগ্রপন্থী লোকজনের আক্রোশে পড়ে বিদেশে স্বেচ্ছা নির্বাসিত ছিলেন। কিন্তু জবাবে ফিদা বলেছিলেন, আধুনিক চিত্রকলা সব সময়ই সময়ের চেয়ে এগিয়ে তাই সমসাময়িক লোকজন হয়তো আজ তাকে ভুল বুঝছেন কিন্তু একদিন লোকজন ঠিকই এ সকল চিত্রকলাকে সঠিকভাবে অনুধাবন করতে শিখবেন। অবাক হওয়ার মতন বিষয় এই যে, বালজাক এবং তার কাছাকাছি সময়ের লেখক গুস্তাভ ফ্লোবার্টের লেখা সমালোচিত হয়েছিল “অমার্জিত” লেখা হিসেবে। যদিও সেসব লেখাকে এখনকার বোদ্ধা পাঠকেরা বিবেচনা করছেন ঊনবিংশ শতাব্দীর ফরাসী সাহিত্যের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ লেখা হিসেবে।

বালজাক নিবিষ্ট ছিলেন তার সময়কার ফরাসী সমাজের এক বৃহৎ পরিদৃশ্য চিত্রনে। তার লেখনীতে সঠিকভাবে বিনির্মিত হয়েছিলো ফরাসী শহুরে শ্রমজীবী মানুষের জীবন এবং প্রাদেশিক মানুষের বিচিত্র জীবনও, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় বালজাক ভাবাবেগকে প্রশ্রয় না দিয়ে অনেকটা নিরাবেগভাবেই এ সকল লেখা লিখেছিলেন রোমান্টিক যুগে বসেই। সেই রোমান্টিক যুগে ‘গথিক মেলোড্রামা’ এবং সেন্টিমেন্ট লেখা লিখে প্রবল জনপ্রিয়তা উপভোগ করছিলেন ওয়াল্টার স্কট, আলেকজান্ডার ডুমাস এবং ভিক্টর হুগোর মতন ঔপন্যাসিকেরা। বালজাক বিশ্বাস করতেন ব্যক্তি ‘ego’ কে মূল্য দেয়া রোমান্টিকদের ভাবাবেগপূর্ণ লেখা সমাজকে অর্থপূর্ণভাবে উপস্থাপনে ব্যর্থ হয়েছে। তাই “সামাজিক-প্রজাতি” (Social Species) কে গভীরভাবে পাঠ করাই ছিলো তার লেখার অন্যতম উদ্দেশ্য তা তিনি তার “হিউম্যান কমেডি”র ভূমিকায় পরিষ্কার করে বলেওছিলেন। বালজাক প্রথম জীবনে সাংবাদিকতার যে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তা তার লেখায় প্রভাব ফেলেছে বিশেষ করে শব্দ নির্বাচনে, শব্দের যথোপযুক্ত ব্যবহারে এবং দৈনন্দিন জীবনের নাটকীয়তার প্রতি গভীর মনোযোগে। বালজাকের লেখায় বাস্তব জীবনের পুঙ্খানুপুঙ্খ চিত্রনের জন্য তাকে আধুনিকও বলা চলে যদিও তখনো ‘ইজম’ হিসেবে ‘modernism’ শব্দটির সৃষ্টিই হয়নি। তার এই আধুনিকতা মার্কিন মুলুকের আধুনিক কবি উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামসের আধুনিকতার সাথে তুলনা করা হয়। বিংশ শতাব্দীর আধুনিক কবি উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামস তার প্রবাদতুল্য বাক্য “No ideas but in things” এর জন্য বিখ্যাত। এই লাইনটি তার ‘পেটারসন’ নামক কবিতার একটি সাধারণ লাইন যা কিনা বিংশ শতাব্দীর কাব্যজগতে মন্ত্রের মতন প্রভাব ফেলেছিলো। যদিও উইলিয়ামসপরবর্তীতে এই লাইনটি সম্পর্কে বিশদ কোন ব্যাখ্যা দেননি, কিন্তু অনেক সমালোচক এবং কবি সাহিত্যিক পরবর্তীতে এ বিষয়ে অসখ্য প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। ঐতিহাসিক সূত্র বিবেচনা করে বলা যেতে পারে উইলিয়ামস কবিতার ক্ষেত্রে বস্তু সম্পর্কে কল্পিত ধারণার চেয়ে অভিজ্ঞতালব্ধ বস্তুকে প্রকাশেই অধিক আগ্রহী ছিলেন। এই আধুনিক কবির মতন বালজাকও একই ভাবে বাহ্যিক জগতকে পর্যবেক্ষণ করতেন বাস্তবতার নিরিখে। কিন্তু বালজাকের আধুনিকতা জেমস জয়েস প্রমুখ আধুনিক ঔপন্যাসিকদের মতন অব্যক্তিক, দিকনির্দেশনাহীন অভিজ্ঞতা দ্বারা তাড়িত ছিলো না, তা ছিলো স্বীকৃত নৈতিক কাঠামো দ্বারা পরিচালিত। যদিও বালজাককে কোন অর্থেই ‘নীতিবিদ’(moralist) বলা চলে না। বালজাক নিয়ে গবেষণা থেমে নেই এবং একটি বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ তা হচ্ছে বালজাককে পরবর্তীতে আরও নতুন নতুন ব্যঞ্জনায় আবিষ্কার করা সম্ভব।

এ লেখার এখানেই ইতি টানা যেতো, কিন্তু আমি সমসাময়িক কবি সাহিত্যিকদের অসহিষ্ণু মনোভাবে, এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে তাদের শারীরিক সংঘর্ষে যার-পর-নাই ব্যথিত। তাই এ প্রসঙ্গে বালজাকের একটি ছোট গল্প The-Brothers-in-arms বা ‘বাহুবন্ধনে ভ্রাতৃগণ’ এর কথা মনে পড়ে গেলো। এই ছোটগল্পে বালজাক অতীতের একটি মহৎ, সুন্দর এবং কিছুটা অদ্ভুত প্রথার কথা উল্লেখ করেন। এই প্রথা অনুযায়ী তখনকার ‘নাইটরা’ (knights) অপর একজন নাইটকে পছন্দ করে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ হতেন যাকে বলা হতো ‘brothers-in-arms’ । বালজাকের মতে এই প্রথা এমনকি রাজা হেনরি দ্বিতীয় এর সময়কাল পর্যন্ত প্রচলিত ছিলো। এই প্রথায় একজন নাইট অপরজনকে বিশ্বস্ত ও সাহসী হিসেবে বিবেচনা করে যুগল-বন্ধনে আবদ্ধ হতেন। এই সুন্দর যুগল আনুষ্ঠানিকভাবে বিবাহ করতেন এবং এই বিয়ের মাধ্যমে একে অপরের ভাই হিসেবে বিবেচিত হতেন। তারা পরবর্তীতে আসন্ন শত্রুর হাত থেকে একে অপরকে রক্ষা করতেন এবং বিচারালয়ে অপবাদ দাতাদেরবিরুদ্ধে লড়তেন। একজন অপরজনকে এতই সম্মান ও বিশ্বাস করতেন যে কেউ যদি কখনো একজনের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ তুলতেন তখন অন্যজন সাথে সাথে বাঁধা দিতেন এবং বলতেন তুমি মিথ্যাচার বন্ধ করে মাঠে কাজে নেমে যাও। আর একথা বলাই বাহুল্য যে, একজনের কাজে অপরজন যেভাবে সাহায্য করতেন তা ছিলো অতুলনীয় এবং একে অপরের ভালো-মন্দ ভাগ্যে সবসময় সাথে থাকতেন। তাদের ভ্রাতৃত্বের বন্ধন অন্য সাধারণ ভাইদের চেয়ে দৃঢ় ছিলো কারণ তাদের ভ্রাতৃত্বের বন্ধন প্রাকৃতিক দৈবযোগে ঘটেনি বরং তারা সচেতনভাবে বিশেষ ভাবাবেগ এবং পারস্পরিক ইচ্ছায় এই পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। এই বাহু বন্ধনে মিলিত ভ্রাতৃত্ব চমৎকার চমৎকার চরিত্র সৃষ্টি করেছে যারা ছিলো প্রাচীন গ্রীক এবং রোমান বীরদের মতনই সাহসী। বর্তমান সময়ের কবি সাহিত্যিকদের এহেন দুর্দশা দেখে এবং বিপদ ও নিন্দুকদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য বালজাক বর্ণিত অতীতের এই সুন্দর প্রথা “বাহুবন্ধনে ভ্রাতৃগণ” ফিরিয়ে আনলে মন্দ হতোনা !

বালজাক সম্পর্কে ভিন্ন ধরনের একটি খবর দিয়ে লেখাটা শেষ করছি- বালজাক ছিলেন কফি-প্রেমিক, কফিতে আসক্তও বলতে পারেন। এক দুই কাপ কফিতো অনেক কবি সাহিত্যিকই খেয়ে থাকেন, কিন্তু তাই বলে ৫০ কাপ! হ্যাঁ বালজাক সত্যিই দৈনিক ৫০ কাপের মতন কফি পান করতেন। বলা হয়ে থাকে, এক কাপ কফি থেকে আরেক কাপ কফিতে যাওয়ার অবসরটুকু ও তার সহ্য হতোনা, তখন তিনি কফি-বীজ মুখে দিয়ে চিবুতেন। মাত্র ৫১ বছর বয়সে বালজাকের জীবন ফুরিয়ে যাওয়ার পিছনে এই কফি পানের অবদানও কম ছিলো না। আগ্রহী পাঠকেরা যদি খোঁজ নিয়ে থাকেন তাহলে দেখবেন গোটা দুনিয়ায় অসংখ্য কফি হাউস ছড়িয়ে রয়েছে বালজাকের নামে, কানাডা আর জার্মানিতে-তো রীতিমতো কফি ইন্ডাস্ট্রি রয়েছে তার নামে। আর এর সবই হয়েছে এই মহান কফি-খাদককে সম্মান জানিয়ে। আপনাদের কারো কফি হাউস খোলার ইচ্ছা থাকলে আপনারা ও নাম দিতে পারেন বালজাক কফি হাউস। আমরা এই মহান ঔপন্যাসিক, নাট্যকার এবং কফি-প্রেমিককে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি।