You are currently viewing ৫টি কবিতা : জয় হারজো। বাঙলা ভাষান্তর > বদরুজ্জামান আলমগীর

৫টি কবিতা : জয় হারজো। বাঙলা ভাষান্তর > বদরুজ্জামান আলমগীর

৫টি কবিতা : জয় হারজো

বাঙলা ভাষান্তর: বদরুজ্জামান আলমগীর

 

 

জয় হারজো- মৌলে কবি, ১৯৫১ সনের ৯ই মে যুক্তরাষ্ট্রে ওকলাহোমার তালসায় জন্মগ্রহণ করেন। নৃতাত্ত্বিকভাবে তিনি আদিবাসী মুসকোগী সম্প্রদায়ের মানুষ; এ-পরিচয়কে তিনি জীবনে মোক্ষম করেছেন, ফলে হারজো কাজে, স্বপ্নে, যুক্তিবাদিতা ও সৃষ্টিশীলতায় পূর্বপুরুষের প্রতিনিধি হিসাবে নিষ্ঠাবতী থাকেন। এভাবেই তাঁর সমাজ ও শিল্পভাবনা এক প্রণিধানযোগ্য অভিজ্ঞান: তিনি বিশ্বাস করেন, কোন কাজ- তা হতে পারে একটি কবিতা, বা গান- যাকে মনে হতে পারে স্বয়ম্ভু, একা ও প্রাতিস্বিক, কিন্তু আসলে তা সামষ্টিক; জয় হারজো প্রতিটি কাজ উৎখাত হয়ে যাওয়া পূর্বপুরুষের মধ্য থেকে কুড়িয়ে তুলে স্বপ্নের দানা বাঁধিয়ে লেখেন; তাঁর কবিতা সহজ ও ন্যায়বিচারের একাগ্রতায় নিরাপোষ।

 

 

লালপাখি ভাব

 

আমাদের চোখের সামনে সে বড় হয়ে ওঠে

তার আনন্দ মনতারা চোখ এড়াবার নয়-

এমন লমলমে কিশোরী এক।

বসন্তের সবুজ ফুঁ-এর ভিতর

তাকে আমরা ফুটে উঠতে দেখি

সেয়ান হয়ে ওঠে- এক নারী পাখি।

চারদিকে বেটাছেলেরা ধুমধাম কাত হয়ে পড়ে

পাখা ফুলিয়ে বাকুম বাকুম ডাকে

আসমানের ঢেউয়ে, ভাঁজে

গোত্তা খেয়ে যুবা পাখিসব নাগরামি করে।

শেষপর্যন্ত মাত্র একজন তার মন কাড়ে

আমাদের সবার বেলায়ই একই ঘটনা ঘটে।

সবার ভিতরে একজন একচিত্তায় বাসর সাজাতে

ফিরে আসে।

সকালে এই নিরঙ্কুশ একজোড়া পাখি

উঠানে খুঁটেখুঁটে বীজদানা খায়

পক্ষিণীর তলপেটে আনকোরা ডিম বড় হয়।

তাদের মিলিত হিয়া কোমল ডেন্ডিলায়ন,

চুরচুর পেঁজাপেঁজা জালি!

জামাই বাবু আস্তে সরে পথ করে দেয়-

ওগো তনু সহচরী, আলতো মুখে নাও

তোমার দানা।

দামান পাখি অতি সন্তর্পণে বধূয়ার পাশে যায়-

মুখে খাবার দেবার অছিলায় চুমু খায় তারে।

সেই চূর্ণক্ষণে তামাম দুনিয়া সম্ভ্রমে নত,

আনন্দ মোচড়ে উচ্চ করে শির।

 

Poem : Redbird love.

 

গোপন মাছ

 

পলকাটা বালুকারাশি, পানির জামা পরা নুড়িপাথর বয়ান করেছে- তামাদি সাগরে গোপন মাছ সাঁতার কাটে। অচিরে মাছসম্প্রদায় হাঁটতে শিখে যাবে, সেই সূত্রে মানুষ প্রজাতি সমুদ্র উপকূলে বেড়াতে আসবে, ক্ষয়মান পাথরের উপর নিজেদের পঞ্চসালা বিংশতিসালা পরিকল্পনা খোদাই করতে লেগে যাবে। তারপর দিনান্তে, বছর শেষে শেভি ট্রাকে সাগরের নিরাপত্তা মছকে দেবে, ভবিষ্যৎ গড়নেওয়ালারা পালে পালে উত্তরসূরীসহ পাথর দর্শনে একাগ্র ভিড়ে জমে উঠবে।

 

Poem : Invisible fish.

 

চিল

 

তোমার সবটুকু তুমিকে আমূল উন্মোচিত করো

নিজেকে যুক্ত করো আকাশের প্রাণে,

দুনিয়ার ভিতর, চন্দ্র আর সূর্যের দরবারে।

তোমার অন্তর্গত ষোলআনা কারবার খুলে ধরো

নিয়ত করো এভাবে-  তুমি এবার প্রার্থনা করবে।

 

তোমার বোঝকে অন্তহীন করো-

কোথাও এমন কিছু আছে –  যা তুমি দেখো না;

এমন আছে কিছু ধ্বনি – যা তুমি শোন না।

 

চোখের সামনে প্রকাশিত কিছু ছাড়াও এমন কিছু

অবগুণ্ঠনে আছে- যা তুমি বোঝো না,

হয়তোবা এক নিরবধি বহতা অন্তরাল।

 

অনেকটা বুঝি সল্ট রিভারের উপর উন্মুক্ত নীলে

উড়ন্ত চিলের পূতশ্রী ডানা এক নির্বাক চিল্লায়

আমাদের প্রাণ প্রসন্ন করে তোলে।

 

আমরা তোমাকে দেখি, তোমার স্রোতস্বিনী বনে

অবগাহন করি, এভাবে জানি-

জগতে যা-কিছু সামান্য ধুলিকণা- কপালে তিলক করি,

সকল প্রাণের কাছে দয়ার্দ্র হৃদয় বিছিয়ে দিই।

 

আমাদের জীবন বিধি ঋণের অনুকূল-

যা থাকে ভাণ্ডে তার সবই রয় আমারও অঙ্গে,

জগতের সামান্য ধুলিসংসার গ্রহণে এই দেহ তুলি

সমান আবর্তে দেহখানি রাখি!

 

আমাদের প্রাণের অতল নীলে

এক চিল ঘুরেঘুরে ডাকে- কাঁদে অন্তহীন

আর্তি আকুল- বহে সুন্দর, ওগো মাধুরী!

 

English Version : Eagle Poem

 

পথের নিশানা

 

যে দুনিয়া সামনের দিনগুলোতে আসবে

আমি তার জন্য একটা নকশা বানাতে চাই-

এই নকশা তাদের জন্য যারা আকাশের ধস বেয়ে

আরো উপরে উঠে যাবে!

 

আমার হাতে লোহালক্কড়, ইটকাঠের হাতুড়ি বাটাল নেই;

কেবল একটি ভাঙা বাসনা-ই আমার সম্বল- যা উঠে এসেছে

লণ্ডভণ্ড বিরান শস্যের মাঠ থেকে, শোবার চৌকি

আর রসুই ঘর থেকে।

কোটি নাঙা হাত, সরাসরি অযুত নিযুত পা-

যারা দিশাহীন এক আত্মার গতি।

 

এই ম্যাপের মূল উপকরণ বালু- খরখরে বালু,

চেনা আলো আর পরিচিত বাতির শিখায় তা পড়া যাবে না;

এই নকশার অন্তরাত্মায় থাকবে এক শরনার্থী আগুনের গোলক- যা পৌঁছাবে অনাগত এক আদিবাসী গ্রামে-

যেখানে এক ফুঁৎকারে জ্বলে উঠবে তাদের পূর্বপুরুষ।

 

লোককাহিনীর ঠাসবুননি এই ভাষার বুনিয়াদ,

আবার মাটির উপর পা গেঁথে দাঁড়াবার অনুমোদন;

নিজের পদচিহ্ন নিজেই চিনতে না পারার

দুর্দিন কেঁপেকেঁপে নড়ে উঠবে!

 

মায়ার বদলে, দয়ার জায়গায় আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ

গজিয়েছে দেখো- চোখধাঁধানো বিপনি-বিতান,

আর টাকা, টাকা, হুণ্ডির বেসাতি চারদিকে।

 

আমরা সব বেমালুম ভুলে গ্যাছি-

ভুলে যাবার ভুলগুলো হিসাবে আনো;

ঘুমের ঘোরে ছানিপড়া চোখে ঝিমুনির কালে

আমাদের শিশুরা নাই হয়ে গ্যাছে- চুরি করে

তারা হরণ করে নিয়ে গ্যাছে তাদের।

 

আমরা হাঁটুর নিচে মাথা গুঁজে বসেছিলাম,

সেই ফাঁকে বন ছেয়ে গ্যাছে  তাতানো ফুলে

তল্লাট কি তল্লাট চলে গ্যাছে দৈত্যের দখলে

পরমাণু, পরমাণু, এতো পরমাণুর কীযে একাকী দাউদাউ!

 

গাছেদের ছাইভস্ম মুছে যেতে নারাজ।

যাদের উৎখাত করা হয়েছে- তাদের উচ্ছেদের দাগ খতিয়ান

তাদের সামনে এই মানচিত্রে আবারও হাজির।

কী কী নাম ছিল- আদিবাসী পাখিদের ইতিউতি নামগুলো

মনে পড়ে না।

 

একদা এই সহজিয়া অঙ্গনে সবার নাম জানা ছিল।

 

আমি যা বলছি- তা অনড়, পাকা খাঁটি কথা-

আমরা সেইসব দিন, সেইসব মধুক্ষরা ভুলে গ্যাছি;

তারা একরোখা, ধেয়ে আসে আমাদের পিছনপিছন।

বনের ভিতর সরু আলপথ, কুশিকাঁটা আর কালশিটে রক্ত।

 

আমাদের একটি ভুলেভালে ভরা ম্যাপ তৈরি করতে হবে,

ছোটখাটো- পথে নামার বিবরণ।

 

এ-এমন এক জায়গার দলিল পরসা

একটি সাগরের মুখ দিয়ে যেখানে ঢুকতে হবে,

যে-সাগর আদতে তোমার মায়ের তাজা খুনে ফুঁসেফুঁসে ওঠে;

তোমার বাবা নিজের পরিচয় আঁকড়ে ধরতে বারবার খাবি খেয়েছেন- তার নেহায়েত মৃত্যুপরিখা হবে আমাদের

প্রবেশের দরোজা।

 

এখানে সব কানামুখ- বেরুবার পথ নেই!

 

এই ম্যাপ বুঝতে হবে অভিজ্ঞতার অলিগলি জ্ঞানের পথে।

আমরা মরণের বিভেদ বেয়ে হেঁটে যাবো।

 

দেখবো- আমাদের কোন আত্মীয় রান্না করছে মাছ,

হরিণ আর কর্ণ স্যুপ- অচেনা থেকে ভেসে আসে চেনা

মশলার কাঁচা ঘ্রাণ।

 

ওই রাঁধুনিরা কোনদিন আমাদের ছেড়ে যায় নি

আমরা বিজ্ঞান প্রযুক্তির নামে তাদের সরিয়ে দিয়েছি।

 

আমাদের অনাগত জমানায় কোন নিষেধের দণ্ডবিধি রইবে না

শব্দে, কথায় ব্যাখ্যা করার কোন গাইড বই লাগবে না।

তোমার মা যে গান গাইতেন

সেই গানের বনালা সুর হবে তোমার পথের নির্ণয়-

তুমি কেবল নোতুন করে তার পুরনো গানে সুর বসিয়ে নিও।

 

ইতিহাসের রক্তছলকে ছাপানো এই ম্যাপ-

টাটকা বরাভয় ঝলসাবে গ্রহ থেকে গ্রহান্তর,

এই ম্যাপ তোমায় পড়তে হবে সুকল্যাণ ধারায়,

সূর্য কিরণের ভাষায়।

 

কৃত্রিমতার দানু খেয়ে ফেলে সারল্যের নিরোগ হাওয়া

তোমাকে বিনাশ করতে হবে যা তোমাকে বিনাশ করেছিল।

 

দেখতে মইয়ের মত তোমরা দেখবে এক রক্তাক্ত খাড়া ঢালু

যা আসলে আমাদের হৃদয়।

 

মই বেয়ে ধ্বংসের অনন্ত অতল থেকে যখন একটি মানুষ

প্রথম তার মুখটি বাড়াবে- একটি সাদা হরিণ বলবে-

আমাদের ঘরে এসো হে সুন্দর।

 

এ-খাড়াই মনে করিয়ে দেবে

আমাদের উৎখাত করে ফেলার আদি ইতিহাস।

আমরা কখনোই ছিলাম না আঁটসাঁট নির্ভুল,

আমরা ছিলাম গার্হস্থ আলাভোলা।

 

বৈষয়িক নামতায় তা কেমন আমি জানি না-

ধরি তাতে ভুলত্রুটি ছিল।

আমরা জ্বলেছিলাম আকাশের তারা;

জানি নাগরিক বর্গে আমাদের যাত্রাপথে উনিশ-বিশ ছিল; নিশ্চয়ই কিছু ছিল ভ্রান্তির যোগফল।

 

আবার যখনই মাঠে নামবো-

আমরা ফের একই ভুল করে বসবো- আমি জানি।

 

শেষকথাটি বলবার শেষকথাটি এখনো নেই জানা-

 

কেবলই প্রবাহ, সামনের নিশানা।।

 

English version : A map to the next world.

 

আগুন

 

একজন নারী কেবল একা

নিজের শ্বাসেই বাঁচে না।

 

সে মরমে পাহাড়ের ধ্বনি বুঝতে পারে,

নীল আকাশের অফুরাণ প্রাণ

চিনে ফেলে একলহমায়।

 

রাত্রির কুহক বিভায় নারী

বয়ে যাই হাওয়ার সখী-

তার ভিতরানা ঘর ও বাহিরানা।

 

আমার দিকে চেয়ে দেখো,

আমি নই একা পৃথকিনী

আমি নীল আকাশের বিস্তারে লীন

স্যান্ডিয়া পাহাড়ের বাড়ানো গলা।

 

আমি রাত্রির বাতাসে হাওয়া যে উড়ি

প্রতিটি শ্বাসে নিজেকে পুড়ি।।

 

English version: Fire

 

বাঙলা ভাষান্তর

বদরুজ্জামান আলমগীর – কবি, অনুবাদক ও নাট্যকার।