You are currently viewing ১০নং বিপদ সংকেত > সিদ্দিক বকর

১০নং বিপদ সংকেত > সিদ্দিক বকর

১০নং বিপদ সংকেত
সিদ্দিক বকর
শোঁ শোঁ, শোঁ শোঁ- একটা সরু-চিকন শব্দ বল্লম বাঁক নিয়ে ওড়ে। কখনো মনে হয় এ বুঝি ঢাউস- পৃথিবীর বাতাস গরম হয়ে উঠলে সে শোঁ শোঁ ফোস ফোস করে উপরে উঠে, যে তাকে উড়ায় তাকে বদ করবে বলে। থেকে থেকে শোঁ শোঁ করে গুত্তা মারে। কখনো মনে হয় এ বুঝি সাপের ছোবল। মাথার উপর অসহনিয় গতিতে ভোঁ ভোঁ শব্দ করে ঘুরতে আছে নীল এক মাছি। আজ আর মন বসেও না ইউটিউবে । অতিশয় পেঁচানো-গতি ঝড়ো হাওয়া-বৃষ্টি এলোপাতারি-উড়ে পাটের ফেশ্যা।
সহসা সাগরে এক নিম্নচাপ থেকে মহা শক্তিধর এক সিত্রাং পুরুষের জন্ম হয়। সিত্রাং আকাশে উঠে তার শরীর নিংড়ানো বীর্য ছড়িয়ে দেয় সারা দেশে- বৃষ্টি হয়ে পড়ছে যখন বাতাসের সংঘর্ষে তীব্রভাবে একটি শোঁ শোঁ, শোঁ শোঁ শব্দ আছড়ে পড়ে। ইউটিউব জ¦র- কঁকিয়ে উঠে দেহ। শরীরের লোম সিকিউরিটি- তবু ঘুর্নায়মান আতংকের ঘানি।
*পূর্ব মধ্য বঙ্গোপসাগর-সৃষ্ট নিম্নচাপ এক গভীর-কূপঘূর্ণিজল মর্ত্য-অমর্ত্য আবর্ত দ্বিধা-নিম্নচাপ ঘূর্ণ্যামান গতি নিয়েছে গুহা রূপ । এর প্রভাবে মোংলা সমুদ্রবন্দরসহ সংলগ্ন উপকূলীয় এলাকায় গুমোট আবহাওয়া বিরাজ করছে। ভোর থেকে থেমে থেমে কোথাও গুড়ি গুড়ি আবার কোথাও মাঝারি বৃষ্টিপাত হচ্ছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টিপাতও বাড়তে শুরু করেছে। এতে কয়েকদিনের প্রচণ্ড তাপদাহ কিছুটা কমলেও এখন ভ্যাপসা গরম পড়ছে। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায়  চারদিকে শীতের কুয়াশাও পরিলক্ষিত হচ্ছে।
* বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত সুস্পষ্ট লঘুচাপটি আরও ঘনীভূত হয়ে নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে। এরপর তা আরও ঘনীভূত হয়ে ক্রমান্বয়ে গভীর নিম্নচাপ ও ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে বলে আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলছে।
*নিম্নচাপটি পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৭৩০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থান করছে। এটি আরও ঘনীভূত হয়ে উত্তর পশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে পারে। নিম্নচাপ কেন্দ্রের ৪৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিপথ ৪০ কিলোমিটার,  যা দমকা বা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত রৃদ্ধি পাচ্ছে।
* আগামী ৭২ ঘন্টার মধ্যে আন্দামান সাগরে অবস্থানরত নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে  রূপ নিতে পারে। সেই সঙ্গে উপকূলীয় এলাকায় প্রবল বৃষ্টিপাত হতে পারে। নিম্নচাপের প্রভাবে কুয়াকাটা সংলগ্ন বঙ্গোপসাগর উত্তাল হয়ে উঠছে। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন রয়েছে।
সারাদেশের সাধারণ মানুষ অজানা আতংকে ফ্রিজ হয়ে আছে। ঝড়ের গতিবেগ কি হয় বুঝা যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ সংকট, দিন-কে-দিন লোডসেডিংয়ের গতি বেড়েই চলেছে। সারা দেশে ঝড়োহাওয়াসহ বৃষ্টি হতে পারে। পানির সংকট, গ্যাস সময় সময় বন্ধই হয়ে যাচ্ছে না শুধু এও তুমুল গতিতে যেন বেড়েই চলেছে। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের উপর প্রচণ্ড ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সরকারী কোষাগারে টাকা নেই পর্যাপ্ত। তিন মাসও চলবে না যে রিজার্ভ আছে। কোনো ব্যাংকে ডলার নেই। নিম্নচাপ ঘনিভূত হচ্ছে, গভীর নিম্নচাপে রূপ নিচ্ছে- একেবারে সেন্টার থেকে শুরু হয়েছে নিম্নচাপটি। গরম হয়ে উঠছে দেশ, তাপে-চাপে ফুটছে- প্রচণ্ড তাপে নিম্নচাপটি মানুষের ভিতর জগত শূন্য করে দিচ্ছে। ক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠছে। সারা দেশে একটি ভয়ংকর ঘুর্ণিঝড় দানা বাঁধছে। বজ্রপাতসহ বৃষ্টিতে দেশ অচল হয়ে পড়ছে। জীবন কৈ মাছের কানকে দিয়ে হাটছে কান্তায়ে। বৃষ্টির কাদাজলে পড়ে জীবন লোপাট। টিনের চালার ঘরের ভিতর বন্দী দশায় বসে বসে চিন্তায় আকুল। বজ্রপাত আর বৃষ্টির মাঝে জীবনের ভিতরটাও ঘুর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে। ইউটিউব ওপেন করলে জীবন খতরা ভরাডুবি-  স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বলছেন ২০২৩ সালের দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনার কথা। আবার বলছেন অর্থনীতি সচল আছে- ভয় পাওয়ার কিছু নেই। পাবলিক কী লুডুর ঘুটি! দেশটি কী সাপ-লুডু খেলার বোর্ড! নিজ মনেই সে ভেবে কুল পায় না। জীবনের কল-কব্জা খোলে পড়ে। মাসিক ভাতা বন্ধ করার ষড়যন্ত্রের একটা উটকো গন্ধে মন-মগজ নেতিয়ে পড়ে। ভীষণ ভেঙে পড়ছে মনটা- কী এক ঘুর্ণিঝড় আসছে- সিত্রাং। এটা কী আম্ফানের মতোই! এটা গুগল না হয় ইউটিউব থেকে জেনে নেয়া যাবে। সিত্রাং কি দুর্ভিক্ষের বার্তা বহন করে নিয়ে আসছে! সিত্রাংয়ের ঘুর্ণিঝড় তার ঘরটা না উড়িয়ে নিয়ে যায়! সিত্রাংটা আর কয়েকটাদিন পর আসলেইতো বিল্ডিংয়ের কাজটা কমপ্লিটই হয়ে যেতো। জীবন ইউটিউব থেকে বেরিয়েই এমন বহুবিধ দুশ্চিন্তার ঘুর্নিঝড়ে পড়ে সমুদ্রের কড়াল ঢেউ সৈকতে আছড়ে আছড়ে পড়ে।
কিশোর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল পাড়ার যুবকদের সাথে। এখন সে কী না খুশি। সরকার কী সমাধানটাইনা করছে। প্রতি মাসে যে ভাতা দেয় সরকার তাতে বাজারে প্রতিদিন চা-টা খেয়ে অন্যকে খাওয়ানোর পরও তার চলতে আর কোনো অসুবিধাই নেই। আফসোস তার একটাও ছেলে মেয়েকে সে লেখাপড়া শিখাতে পারেনি। কতো সহজেইনা একটা চাকরি হয়ে যেতো। যহোক কতোজনকে টপকিয়ে সে একটি বিল্ডিং পেয়েছে সরকারী অনুদান হিসাবে। ওটা হয়ে গেলে তার আর কোনো চিন্তা নেই। চিন্তা একটা সে করে- যার কোনো শেষ নেই। আবার তার কিছু করারও নেই। কন্টাক্টরের হাতের কাজ- কীভাবে বিশ্বাস করা যায়! শোনা যায়, কাজটা পেতে কন্টাক্টরকে নাকি টু-পাইস খরচ করতে হয়েছে।
আজ তিনচারদিন ধরে বৃষ্টি- ঘর থেকেই বের হওয়া যাচ্ছে না কন্টাক্টর তার বিল্ডিংয়ের কাজ করবে কীভাবে! ঘুর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের আতংকে একপ্রকার অচলই দেশ। তার উপর দিয়ে যেন আরও বড় ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সিত্রাং যদি তার টিনের ঘরটা উড়িয়ে নিয়ে যায়! কন্টাক্টর কী সঠিক কাজ করবে! যদি দুর্বল হয়- না জানি মরি সপরিবারে বিল্ডিংয়ের নিচে পড়ে! কী করবে সে! সরকারকে দোষারোপ করবে! সরকার যদি মাসে মাসে ভাতা না দিত তাহলে নিশ্চিত এ বয়েসে তাকে না খেয়ে মরতে হতো। বিল্ডিংয়ের টাকাটা কেন সরকার নগদ দিল না! কী এমন কারণ! সে রহস্যের কারণ খুঁজতে খুঁজতে সে হয়রান হয়। সরকার কী তাহলে এক ডিলে দুই পাখি মারার সুকৌশল ব্যবস্থা করলো! সে বুঝতে পারে না কেন আজ তার মাথায় এতোসব ভাবনা নিম্নচাপে পাক খায়। সে বুঝতে পারে না একটানা বৃষ্টি মানুষকে কোথায় নিয়ে যায়। তার খুব একা একা লাগে। তার দৈনন্দিন কোনো কাজ নেই হাতে। প্রতিদিনের কাজের মধ্যে কাজ হলো সকাল সকাল বাজার করা, সমবয়েসীদের সাথে চা পান করতে করতে আড্ডা মারা। আবার বিকেলে বাজারে যাওয়া- চা-পানি গ্রহণ করা। এ কয়দিনের বৃষ্টিতে সবই ভেস্তে গেছে। কিন্তু মন আর বসছে না ঘরে। মন ক্রমেই বদ্ধমূল হতে থাকে একটি ভাবনায়- বৃষ্টির মাঝে এ ঘরটা একটি লোহার খাঁচা। তার মাঝে সে বন্দি- ঘরশুদ্ধ খাঁচাটা বাতাসে দোলে। অতীত সকল স্মৃতির সাথে মানুষের দুর্বৃত্তায়ন ও অসততার গাঁটছড়া ঘার মটকায়। হঠাৎ দমকা বৃষ্টি আর বাতাস মিলে প্রচণ্ড শক্তিতে একটা চাপ মারে- তার মনে হয় চাপটা শুধু তার উদ্দেশ্যে – হাত পা ঠাণ্ডা হয়। আত্মাটা আতংকে কাঁপে যেন করোনা ভাইরাসের ভয়। এই বুঝি এলো- এই বুঝি টিনের চালটা তার উড়িয়ে নিলো। সিত্রাং বাবা আর কয়েকটা দিন পর এলে পারতো না! এমন অসহায়তো ৭১ যুদ্ধের মাঠেও সে হয়নি। তখন সারা শরীর জুড়েই ছিল কলিজাটা- সাহসে থমথম করতো- সেই কলিজা কোথায় গেলো- সব শুকিয়ে এখন আছে শুধু পাটখড়ি। সে তার নিজের মধ্যেই একটি নিদারুন নিম্নচাপ অনুভব করে। এই সময়ে দুইটা চড়ুই সিত্রাংয়ের গতির চেয়েও দ্রুত গতিতে উড়া দিয়ে ঘরের এক কোণ থেকে অণ্য কোণে যেয়ে বসে। তার কানের পাশ দিয়ে যখন যায় মনে হলো যুদ্ধবিমান দুইটা দ্রুত চক্কর মারলো- সাথে সাথে মাথাও যেন পাক দিয়ে ঘুরতে থাকে তার। দৃষ্টিতেও তার নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়- ঘুর্ণিদৃষ্টি ঘুরতে ঘুরতে ঘরের এক কোণায় দুইটি চড়ুইকে দেখা যায় জড়োসড়ো আতংকিত। যে কোনো সময় উড়ে যাওয়ার প্রস্তুতি চলমান থাকার কারণে শান্তি মতো স্থির হয়ে বসতে যে পারছে না দেখে বুঝা যায়। সে ভাবে তারওতো একই দশা। নিজেরে রেখে তখন চড়ুই যুগলের জন্য মায়া জন্মে। তার মায়ার ভিতর চড়ুই পাখি নিরাপদ বাসা বাঁধে- সে ভাবে বিল্ডিংটা কমপ্লিট হয়ে গেলে যত বড় সিত্রাংই আসুক এই একজোড়া  চড়ুই পাখির আর কোনো আতংক থাকবে না। সে তো তখন জানালার একটা পাট খোলে বসে বসে বৃষ্টি দেখবে, তুফান দেখবে। তুফানে বৃষ্টি যে কাটা কাটা গতিতে চতুর্দিকে কিভাবে উড়ে তার সৌন্দর্য দেখবে। মেলায় উড়সের মজমায় বাউলপনার নাচের মাঝে এ দৃশ্যটা পাওয়া যায়। না, সেখানে নিজের মাঝে নিজের মজে যাওয়ার একটা গূঢ় আর্তনাদ কাজ করে- বৃষ্টি ও তুফানে কি সেটা আছে! তার মস্তিষ্কে এসব ভাবনা বিদ্যুৎ চমকায়। সিত্রাংয়ের ভয়ংকর রূপ মনে হয় বেড়েই চলেছে। ৫৬ হাজার বর্গমাইল জুড়ে সিত্রাংয়ের জাল। বাজারে এখনই আটা নেই, চিনি নেই, ময়দা নেই, তেল নেই। চালও যদি না থাকে! মুখে মুখে ফিরছে- টাকা দিয়েও জিনিষ পাওয়া যাবে না। বাজারে প্রয়োজনীয় জিনিষ থাকবে না। সরকারের ভাতা, বিল্ডিং দিয়ে কী করবে সে- না, এত আতংক আর নিতে পারছে না সে। ভাবতে ভাবতে হাফিয়ে ওঠে। আজ তিনচারদিন ধরে বাজারে যেতেও পারছে না সাহাবুদ্দির বউয়ের হাতের চা ও খেতে পারছে না।আজ মনে হয় সকাল সকাল সিত্রাংয়ের তাণ্ডব কমেছে। হাতমুখ ধুয়ে সোজা বাজারে। মানুষ জড়ো হচ্ছে আস্তে আস্তে- বাজার সরব হচ্ছে। বাজার তার চরিত্র ফিরে পাচ্ছে। মানুষ একেকজন তিনচারদিন ধরে ঢাকনার নিচে পড়ে দুর্বাঘাসের ন্যায় ফ্যাকাশে হয়েছে। সূর্যের আলো গায়ে না পড়লে মরে যাওয়া ফিকে রংটা সহসা ফিরবে না। এদিকে সূর্যের কোনো খোঁজ নেই। আকাশ মেঘলা না হলেও শিলাবৃষ্টিতে ফসল ধ্বংস হওয়া জমির পাশে দাঁড়ানো কৃষকের অন্ধকার মুখে আভির্ভূত হয়েছে আজকের সকালটা। ঊরু দেখে যেমন বোঝা যায় বেটাছেলেটা কেমন বেটা হবে তেমনি সকালটা দেখেও আঁচ করা যায় সারাদিন কেমন যাবে। তাও কপাল ভালো নিম্নচাপ সবল না হয়ে দুর্বল হয়েছে ক্রমে। প্রকৃতি সহায় হয়েছে। ভাবনার শেষ নেই জীবনের। সে সাহাবুদ্দির চাস্টলে বসে বসে চা খায় আর পিটপিট করে সবকিছু দেখে আর ভাবে, মনে হয় যেন সে বই খোলে বসে পড়ছে। প্রকৃতি তো সব সময় মানুষের সহায়। শত অত্যাচারেও প্রকৃতি কিন্তু সহজে রুষ্ট হয় না মানুষের উপর। প্রকৃতির ধৈর্য আছে- মানুষের নেই।

আজ, আজকের দিনটা মনে হয় ফকফকা। মন প্রাণও খুবই সুপ্রসন্ন। চোখেমুখে চাঁদসূর্যের ফকফকা জন্মলগ্ন হাসি। ভিতরটা ফুরফুরা থাকলে চোখেমুখে খই ফোটে। সন্ধ্যা রাতের আবছা শ্যামলা রংয়ের মানুষটারে তখন হলুদমাখা শরীরের মত ফর্সা ফর্সা লাগে। মনে হয় যেন হলুদমাখা শরীরে ভালোমত গোসল দেয়ার পরের যে ফর্সা উজ্জ্বল রংটা বেরুই সেটাই তার চোখেমুখে আজ ভালোমত ফোটে উঠেছে। মৃদু বাতাসে হলুদফর্সা ঢেউ বয়ে যায়- হলুদ মেখেছে গায় অঙ্গে লেগেছে বায় নেচে নেচে প্রজাপতি পেখম তুলে পাখায়। তার দিকে তাকালেই, যারই তার সাথে মোলাকাত ঘটছে সেই আক্রান্ত হচ্ছে প্রজাপতির নাচে- বাজারের মানুষ কেউ কেউ তার আনন্দে সংক্রামিত হয়ে জানতে চায় সূর্য আজ কোনদিক দিয়ে উঠেছে! সারা শরীর জুড়ে রঙধনু। আজ তার বিল্ডিংয়ের ছাদ উন্মুক্ত হবে- সকল খুঁটি খোলে দেয়া হবে। ছাদের নিচে সবার খাওয়ার ব্যবস্থা হবে। একটা গরু জবাই করে খাওয়াবে বলে অগ্রিম দাওয়াত দিয়ে রাখছে। তার আজ আনন্দ আর ধরে না। আজই সে সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে উপরে উঠবে- ছাদে। ছাদ থেকে সে তার শৈশব দেখতে পাবে- মুক্তিযুদ্ধের সময় ষ্ট্যানগানটা কাঁধে ঝুলিয়ে কোন চিপা-চাপা দিয়ে দৌড়েছিল দেখবে। ছাদে উঠে সে আজ আনন্দে আত্মহারা হবে।

একটা হাঁসগলা লাঠি তার বহুদিন ধরেই নিত্যসঙ্গি। চলতে গিয়ে লাঠি তার যতটুকু কাজেই লাগুক না কেন কিন্তু বন্ধু হিসেবে সে মন্দ নয়। একটা লাঠি তার জীবনে বন্ধু হয়ে উঠতে পারে কোনোদিন কল্পনায়ও আসেনি। জীবনের মোবাইলও একজন বন্ধু বটে। কিন্তু সে অনেক টাকা খসায়ে ফেলে। সময় দ্রুত অজগরের পেটে চলে যায়। তবু এন্ড্রয়েট মোবাইল থাকার কারণে বহুকিছু যেমন জানা যায়- সময়কে সময় সময় উপভোগও করা যায়। লাঠিটার গলায় হাত রাখলে ভরসা বাড়ে। তখন সে অনায়েসে চলতে ফিরতে পারে। কখনো কখনো লাঠিটাকে মনে হয় লম্বা গলার হাঁস। চলার সময় মনে হয় হাঁস তার বাহন। হাঁস তার পিঠে বসিয়ে জীবনকে নিয়ে চলেছে।

সেই বাহনে চড়ে জীবন এসে নামে তার বিল্ডিংয়ের সামনে। এই বিল্ডিং তার স্বপ্নের ফসল, মুক্তিযুদ্ধের ফসল। একটু একটু কওে অপলক দৃষ্টিতে বিল্ডিংটা সে দেখে। মনে হয় যেন পাখির মতো ঠোঁটে করে খড়কুটো এনে বাসাটা সে বানিয়েছে। হাঁসের গলায় একটা হাত রেখে ছোট ছোট ®েটপে সামনের দিকে আগায়- কাছিমের গতিতে। এভাবে তার বাসার চতুর্দিক ঘুরে ঘুরে সে দেখে। এমন অবস্থায় তার পরিবারের সদস্যদের দেখার কৌতুহলটা বেশি পরিমাণে তাদের মুক্তিযুদ্ধা কর্তার দিকে। তার সুখদুখ। সুবিধা অসুবিধা। সবকিছুই তারা খেয়াল রাখে যত্নের সাথে- মুক্তিযুদ্ধা যে এখন সোনার ডিম পাড়া হাঁস।

ইতিমধ্যে তার প্রতিবেশী কিছু লোকজন এসে জড়ো হয়েছে উঠোনে। তার দৃষ্টির ভিতর কে যেন ইউটিউব চ্যানেল চালু করে দেয়- ইউটিউবের পর্দায় তার টোটাল মুক্তিযুদ্ধের সকল স্মৃতি একে একে প্লেয়িং হতে থাকে। তাকিয়ে আছে এক মনে বিল্ডিংয়ের ওয়ালে-স্থির তাকানো নয়-চলমান তাকানো- বিল্ডিংয়ের ওয়াল যেন এখন ইউটিউবের পর্দা। সে সেই স্মৃতির ঢেউয়ে ঢেউয়ে সামনের দিকে ভেসে যায় আর কেমন জানি সেই নিম্নচাপ থেকে পাওয়া সেই শোঁ শোঁ, শোঁ শোঁ শব্দ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে। আজ বিশেষভাবে মনে পড়ে তার নিজের এলাকা শত্রুমুক্ত হওয়ার দিনের দৃশ্যগুলো। সবই ঝাপসা তবুও ঝড়ো হাওয়ার প্রবল বৃষ্টির ভিতর মাঠ ঘাট বৃক্ষের মতো বিমূর্ত হয়ে ভেসে উঠে চলে দৃশ্যগুলো।

কাল থানা শহর ঘেরাও হবে চতুর্দিক থেকে। এখানে যদিও কোনো পাক আর্মি নেই, প্রচুর রাজাকার বাহিনী দিয়ে দখল করে রেখেছে এই পুরো এলাকা। প্রায় প্রতিদিনই তারা কোনো না কোনো গ্রাম এলাকায় ঢুকে মুক্তিযুদ্ধা খোঁজে ঘর বাড়িতে আগুন দেয়, খাশি মুরগীর সাথে কিশোরি ও যুবতীদের ধরে নিয়ে যায়। রাতে জড়ো হয় মুক্তিযুদ্ধারা। এরিয়া কমাণ্ডার ব্রিফিং করে। একইভাবে পূর্ব উত্তর পশ্চিম দিক থেকেও আক্রমণ করা হবে।

পরেরদিন থানাশহরকে মাঝে রেখে চতুর্দিক থেকে আক্রমণ শুরু হয়। ঠিক সেই মুহূর্তে জীবন দেখে ইউটিউবের পর্দায়- তার কাঁধে একটি স্ট্যানগান, ডান হাতে ধরা সেই এসএলআর, শরীরে বুলেটের জাল পেঁচানো। সে কী উত্তেজনা! একবার কল্পনায়ও আসেনি নিজেরও মৃত্যু হতে পারে। থানা ক্যাম্পের খুব কাছাকাছি একটা বড় ঝোপের ভিতর ওরা। টাইগার এম্বুস নিয়ে প্রস্তুত। সংকেত এলেই ফায়ার ওপেন।

ফায়ার। জীবন ফায়ার ওপেন করেই ক্রলিং করে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। চতুর্দিক থেকে গোলাগুলির শব্দে স্বাভাবিক জীবন স্থবির, গোলাগুলির শব্দে সবকিছু জলোচ্ছ্বাসের মতো তল হয়ে গেছে- ৯১ জলোচ্ছ্বাসের মতো এখানে উত্তাল হয়ে উঠেছে শব্দের সাগর। চতুর্দিক থেকে গোলাগুলির শব্দ ফোলে উঠে জনজীবন সবকিছু থলিয়ে দিচ্ছে। প্রথম দিকে পাল্টা ফায়ার এলেও পরক্ষণেই সব থেমে যায়। মুক্তিযুদ্ধারা সবাই উঠে আসে চতুর্দিক থেকে- জয়বাংলা শ্লোগান দিতে দিতে অস্ত্র উঁচিয়ে সবাই থানার ভিতরে ঢুকে পড়ে। চতুর্দিক থেকে এতো গোলা এতো গ্র্যানেড চার্জ হয় কিছুক্ষণের মধ্যেই শত্রুপক্ষের প্রায় সবাই মারা পড়ে। অনেকেই পালাতে চেয়ে সাথে সাথেই গুলিবিদ্ধ হয়। আত্মসমর্পণ করার কোনো সময়ই পায়নি তারা। মুহূর্তে থানার অস্ত্রাগার লুট হয়ে যায়। আগুন যেন অপেক্ষায় ছিল কখন সুযোগ আসবে। পুরো থানা ক্যাম্প এক আগুনের গোলায় পরিণত হয়। হাজার হাজার মানুষ থানার চতুর্দিকে দাঁড়িয়ে যায়।ঁ জীবনের বয়স তখনও কিশোর। কৌতুহল তাকে দলচ্যুত করে বাজার ও বাজারের আশপাশে টেনে নিয়ে যায়। মানুষ একদিকে আনন্দ মিছিল করছে- শত্রুমুক্ত হওয়ার মিছিল, অন্যদিকে বাজারের সকল দোকান-পাটে হাজার হাজার ঈদুর ঢুকে গেছে। নিমিষে বাজারের সকল দোকান খালি হয়ে যায়। থাকে শুধু মেঝে- ধর্ষিতা নারীর লাশ। এলাকাটা শত্রুমুক্ত হয় ঠিকই কিন্তু পুরো এলাকা দেখলে মনে হবে একটা প্রচণ্ড ঘুর্ণিঝড় মুচড়ে দিয়ে গেছে। আগুনের লেলিহান ছোবল মারছে- একটা তীব্র গতির শোঁ শোঁ, শোঁ শোঁ শব্দ তার মস্তিস্কের ভিতর নিম্নচাপ তৈরি করছে, উত্তাল করে তুলছে সাগর, শিকড়শুদ্ধ মাটি থেকে তাকে উপড়ে ফেলছে।

সে এখন উপরে উঠবে, ছাদে গিয়ে মুক্ত বাতাসে খোলাসা হবে। আত্মহারা হওয়ার জন্য খোলা জায়গা দরকার, মুক্ত বাতাস দরকার। সে আগেই একটা জাতীয় পতাকা রেডি করে রেখেছিল ছাদে উঠে পতাকাটা তুলে ধরবে। এ মায়াভরা ইমোশন। এখন তার এক হাতে হাঁসগলা বন্ধু লাঠি অন্য হাতে পতাকা। প্রথম সিঁড়ির ধাপে পা রাখা মাত্র শোঁ শোঁ, শোঁ শোঁ শব্দটা যুদ্ধবিমানের মতো মাথার উপর ঘুর্ণি পাক খায়। সিঁড়ির ধাপগুলো একে একে মাড়িয়ে যেতে যেতে কখনো মনে হয় সে যাচ্ছে না, সে স্থির- সিঁড়ি যাচ্ছে। সিঁড়িই যেন তাকে মাড়িয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে সিঁড়ি চলন্ত হয়ে যেতে যেতে ছাদ এসে হাজির হয় তার পায়ের নিচে। ছাদ ঘুরে ঘুরে তাকে চতুর্পাশে নিয়ে যায়। তার আত্মহারা হওয়ার সুযোগ ক্ষণে ক্ষণে হাতছাড়া হয়ে যায়। মনে হয় নাগালের ভিতর কিন্তু ছোঁয়া যায় না- শোঁ শোঁ শব্দটা বাড়তে থাকে। একটা নিম্নচাপ অনুভব করে নিজের ভিতরই। এই শোঁ শোঁ শব্দটাই কী বয়ে নিয়ে আসে নিম্নচাপটি! নাকি নিম্নচাপের গতি কান মন প্রাণ তালা লাগা শোঁ শোঁ শব্দকে নিয়ে আসে! সে হিতাহিত হারিয়ে যায়- স্থান শূন্য করে উপরে উঠে যায়……৭১ এর সকল স্মৃতিদৃশ্য শোঁ শোঁ শব্দের সাথে ঘুর্ণিজলের গতিতে ঘুরতে থাকে। ক্রমান্বয়ে এর গতি বাড়ে। নিম্নচাপ এখন তার শরীরের ভিতর, পায়ের নিচে। ১০ নম্বর বিপদ সংকেত- চিন্তা ও চেতনার গতি বাতাসের সাথে সাথে বাএেক পর্যায়ে তার উপস্থিতি, অস্তিত্ব, চেতনালব্ধ পারিপার্শ্বিক অবস্থান সব যেন গতির সাথে একাকার হয়ে ঘুরতে থাকে। শোঁ শোঁ শব্দ আরো তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। তার পায়ের নিচে বিল্ডিংয়ের ছাদ মটমট শব্দে কেঁপে ওঠে। শোঁ শোঁ শব্দটা সাপের ছোবলের অবয়বে কানে এসে অনবরত বাঁধ ভাঙা জলের ন্যায় ঢুকতে থাকে- সারা শরীর পেঁচিয়ে দম আটকে দেয়। ছাদটা আরও কাঁপতে থাকে, মটমট শব্দটা আরও বাড়তে থাকে- ১০ নম্বর বিপদ সংকেতের ভয়ংকর রূপের কাছে বিল্ডিংটা একটা ঠুনকো কাচের ঘর। আয়নায় ঢিল পড়লে চতুর্দিকে যেভাবে ফেটে যায় কাচ, জীবনের পায়ের নিচ থেকে ছাদটা সেভাবে ফেটে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মাঝে ছাদটা ভেঙে পড়বে….. এক হাতে তার বাহন হাঁসের উপর চড়ে সে শান্ত হয়ে দাঁড়ায় আর এক হাতে শক্ত করে পতাকাটি উপরের দিকে তুলে ধরে…..ঠিক তখনি মটমট করে অত্যুগ্র ঠাডা ভাঙার শব্দে বিল্ডিংয়ের ছাদটা ভেঙে পড়ে। ধ্বংসস্তুপে মোঠ করে জীবনের হাতে ধরা পতাকাটাই শুধু তখন জীবন্ত মনে হয়। কারণ কোমল বাতাসে সে তখন শান্ত মৃদু স্বভাবে নড়ছিলো।

======================