You are currently viewing হেলিকপ্টার ও সোনার তলোয়ার (কিস্তি: আট)  > খালেদ হামিদী

হেলিকপ্টার ও সোনার তলোয়ার (কিস্তি: আট) > খালেদ হামিদী

হেলিকপ্টার ও সোনার তলোয়ার

         খালেদ হামিদী

 

কিস্তি: আট

১৫

একদিন দীর্ঘ একটি শ্বাস ফেলে নাসিমা প্রথমবারের মতো লুনাকে সুরভির কথা জিগ্যেস করে। এতে লুনা তৎক্ষণাৎ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে প্রসঙ্গটি এড়িয়ে অন্য কথা পাড়ে। হারানো বোনের স্মৃতি ওকে প্রথমত সন্ত্রস্ত করে। দ্বিতীয়ত, লুনারই ধারণানুযায়ী, সচরাচর হাভাতে ঘরের মেয়েরাই ওভাবে নেই হয়ে যায় বলে সুরভির প্রসঙ্গটা, তার অবস্থানগত গূঢ় অহংবোধে, সূ² একটা ঘা দেয়। কেবল সে নয়, ওর পরিবারের সকলেই একই কারণে এ-বিষয়ে গোপনীয়তা রক্ষায় তৎপর। কিন্তু এসবের কিছুই নাসিমার বোধগম্য হয় না। সে পাশের বাসার কারো কাছ থেকে গুপ্ত বিষয়টা জেনে নেয়ার কথা ভাবতেই লুনা প্রশ্ন করে:

আমাদের বাসায় আসার আগে কোথায়, কেমন ছিলা?

নাসিমা তৎক্ষণাৎ অকপটে বলে:

দুবাইয়ের কয়েদখানায় কিলিনিংয়ের কাম করতে হইছিল। কিছু দিরহাম পাইছিলাম। এখানে এয়ারপোর্টের সামনে এক ছোকরা আমার ৫০ দিরহাম মাইরা দিছে। ওইগুলি ভাঙাইতে গিয়া চিটিংবাজের খপ্পরে পড়ি আর কি! বাকি টেকা দিয়া মাত্র দুই মাস চলতে পারছি। আমার মায়ের দূর সম্পর্কের এক বইনের ঝুপড়িতে থাকছি ওই কয়দিন। এই বছর আমাকে আপনেরা কোন কাপড়-চোপড় না দিলেও চলবো। দুই-তিন জোড়া শাড়ি-বেলাউজ কিনছি।

নাসিমা সুরভিকে দুবাইয়ে দেখেছে কি না জিগ্যেস করতে, এখনো মর্মাহত জয়নাব, নিখোঁজ সন্তানের ছবি হাতে নেন। কিন্তু পরক্ষণেই বড় সন্তানকে অ্যালবামে ফিরিয়ে দিয়ে ছোট জন লুনাকে বুকে জড়িয়ে কাঁঁদেন তিনি। অথচ ছুটি কাটাতে আসা ওমান, ইরাক ও কুয়েতবাসী কাছের-দূরের আত্মীয়-পরিচিত কেউ পশ্চিম দিকে উড়াল দিলে, সুরভির একখানা ছবি তিনি তার বা তাদের হাতে তুলে দিয়ে, আশায় দিন গোনেন পাগলের প্রায়। এমনকি হজ করতে কিংবা ওমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করছে এমন কাউকেও তিনি ছাড়েন না। ওসব যাত্রীদের কেউও চক্ষুলজ্জা কিংবা মানবিকতা হেতু জয়নাবের অনুরোধ অগ্রাহ্য করেন না।

সরকারি মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী, দেখতে অপরূপ সুরভি, একদিন পরীক্ষা সেরে রিকশায় একা বাসায় ফেরার পথে হারিয়ে যায়। প্রিন্ট ও ইলেকট্রোনিক মিডিয়ায় সচিত্র হারানো বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, থানায় সাধারণ ডায়েরি দাখিল থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট উচ্চতম পর্যায়ে যোগাযোগসহ হাজারো চেষ্টা সত্ত্বেও ওর সন্ধান মেলেনি। কয়েক বছর আগের ওই ঘটনা কখনও হঠাৎ, বুঝি বা কয়েক ঘণ্টা আগের নিরব সন্ত্রাস ও অসহ উৎকণ্ঠা, নিয়ে আসে।

এদিকে ব্যাংকার, চৌত্রিশ বছরের যুবক ইফাত, ছোট বোন লুনার নিরাপত্তার প্রশ্নে কখনও খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। ওকে একা চলাফেরা করতেই দেয় না। অব্যবহিত ছোট বোনকে হারিয়ে, মায়ের সা¤প্রতিক উপর্যুপরি তাড়া সত্ত্বেও, বিয়ে করতে সে অনাগ্রহী হয়ে ওঠে প্রায়। এক পর্যায়ে জয়নাব বেগম পুত্রের এমন কথাও শোনেন:

আমার জন্য সুন্দরী পাত্রী খুঁইজো না মোটেও। বিয়ে যদি আমাকে দিতেই হয়, শিক্ষিত এবং চাকরি করে বা করতে চায় এমন মেয়েই দেইখো। দেখতে বিশ্রী হইলেও কোনো আপত্তি নাই।

ইফাতের মা এতে নিরাশ বোধ করেন না। বরং সুরভিকে তিনি প্রচÐরূপে মিস করেন বিধায় দেশের কোনও নদীতে নারীর মরদেহ ভেসে আসার সংবাদেও অস্থির বোধ করেন। ইফাতকে গোয়েন্দা বিভাগের সঙ্গে পুনরায় যোগাযোগের তাড়া দেন।

একদিন নাসিমা গৃহকর্ত্রীর জবাব আদায়ে প্রায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে বলে ওঠে:

খালামণি, আমি হুনছি। সুরভি আপা খুব শান্তশিষ্ট আছিলেন। কোনো পোলার লগেও মেলামেশা করেন নাই। কিন্তু কারা তাকে ওইভাবে লইয়া গেল, আপনেরা কি কিছুই বাইর করতে পারেন নাই!

কাজের মেয়ের এই অপ্রত্যাশিত অবগতি কিি ৎ বিরক্তি উৎপাদন করলেও, মায়ের উত্তর শোনার আগেই, পাশে হেঁটে-যাওয়া ইফাত হঠাৎ দাঁড়িয়ে যায়। নাসিমার কথাগুলো শুনে, বহুদিন পর, আবার ওর সারা গা ছমছম করে ওঠে। নিজের অতিক্রান্ত আয়ু জুড়ে নেমে আসে অদ্ভুত স্তব্ধতা। সাথে সাথে ওর মানবজন্মেও প্রচন্ড একটা ধাক্কা লাগে।

 

১৬

খোকন ভেবে পায় না তার অর্ধেক বয়সী বাবু কিভাবে ফেসবুকে তাকে খুঁজে পায়। সেও কেন বাবুর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অ্যাক্সেপ্ট করে? যাত্রাবাড়ির অধিবাসী, বিখ্যাত পাবলিক ইউনিভার্সিটির সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র বাবুকে, আরব দেশে বসে, রুচিশীল তরুণ বলেই ধরে নেয় সবুজ। তবে এক পর্যায়ে তাকে ম্যাসেঞ্জারেও যুক্ত করে সে সম্মুখীন হয় নিয়মিত বিড়ম্বনার। রাত নেই, দিন নেই, কি অফিসে কি বাসায়, যেখানেই থাকুক না কেন সে, বাবুর উপর্যুপরি কল তাকে রীতিমতো উত্যক্ত করে তোলে। বিশেষ করে, বাবুর ‘আই লাভ ইউ’ কথাটার পুনরাবৃত্তি তাকে অফিসে, ভিলায়, বিব্রত করে ছাড়ে। যদিও, আতিশয্য সত্ত্বেও, ওর আবেগ ও উচ্ছাসের প্রতি খোকন অশ্রদ্ধাশীলও হতে চায় না। কখনো বন্ধু অলিভের অনুরূপ কেমন একটা পুলকে মন্দ্রিত খোকন তাকে আত্মনিয়ন্ত্রণের পরামর্শও দেয় আর তার প্রতি ম্যাসেঞ্জারে বিরক্তি প্রকাশেও দ্বিধাহীন হয়ে ওঠে। এক সন্ধ্যায়, খোকন ওয়াশ রুমে থাকা অবস্থায় ওর রুমমেট শাহীন বাবুর কল রিসিভ করলে শাহীনেরই স্বাভাবিক কুশলেও সে বিরক্তি প্রকাশ করায়, সমালোচিত হয় খোকনও। ফলে পরের দিন সে ক্রোধ ঝাড়ে বাবুর ওপর। এতে বাবু ফেসবুক থেকে সরিয়ে নেয় নিজেকে। পরবর্তী দুবছরে পারস্পরিক যোগাযোগ ঘটে মাত্র দুতিনবার। তাও প্রথম কলটি বাবুই দেয়।

এরই মধ্যে দেশে ছুটি কাটানোর সুযোগ এলে খোকন বাবুকে জানায়। অবহিতকরণের বিষয়টি পরে মনেও থাকে না ওর। কিন্তু রিয়াদ থেকে রাত দেড়টায় সাউদিয়া এয়ারলাইনস্-এ ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়ার পাঁচ/সাত মিনিট আগেই, বাবু ম্যাসেঞ্জারে ফোন করলে, খোকন আশ্বস্ত বোধ করে। বিকেল পাঁচটার দিকে ফকিরাপুলের এক হোটেলে এসেই ওর বিলম্বের হেতু বাবু, দীর্ঘ অপেক্ষায় ক্লান্ত খোকনকে, এমনভাবে জানাতে শুরু করে যে মনেই হয় না আজই ওদের ঘটে প্রথম সাক্ষাৎ। অটো রিকশায় শেষ বিকেলে হাতির ঝিলে পৌঁছুলে খোকনের বারণ সত্ত্বেও ভাড়া পরিশোধ করে বাবু। তারপর হ্রদের কিনারে বসে দুজনে ব্ল্যাক টি খাওয়ার সময়, খোকনেরই কৌত‚হলের জবাবে সে শুধু বলে:

এখনো আমার কোথাও একটু জায়গা রয়ে গেছে আপনার জন্যে।

শান্ত স্বভাবের, প্রায় সৌম্য চেহারার বাবু এর বেশি আর কিছুই বলে না। তবে সাহিত্য ও রাজনীতি বিষয়ক খোকনের নানা কথায় সে সাড়া দেয়। হোটেলে ফেরার সময় অটো রিকশায় বাবুর নিরবতার হেতু জানতে চাওয়া হলে উত্তর মেলে:

আই হ্যাভ নাথিং টু সে।

এদিকে খোকন সকালে এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়েই, পরের দিন সকাল আটটার স্ক্যানিয়ায় বাড়ি ফেরার টিকেট কিনে ফেলায়, উভয়ে রেস্টুরেন্টে কোনোমতে ডিনার সারে। রাত ন’টায় বাবুকে বিদায় দেয় খোকন। আর, অবাক বিস্ময়ে দেখে প্রচন্ড ভিড় ঠেলে কিভাবে পাবলিক বাসের ভেতরে ঢোকে সে। যদিও, খোকনের প্রত্যাশানুযায়ীও বাবু তাকে এতোটা সময় দেয়।

বাড়ি ফেরার পর থেকে মাস খানেক খুব স্মৃতিকাতরতা বোধ করে খোকন। নারীপ্রেমের অভিজ্ঞতা না থাকলেও বহু বছর আগেকার কার কথা যেন মনে পড়ে তার। বাবুকে বহু যুগের আপন কেউ বলে মনে হয়। এখন থেকে  খোকনই বাবুকে কল দিতে শুরু করে নিয়মিত। বাবু কথা বলে। কিন্তু নিজে কল করে না। খোকনের মনে পড়ে না কতো কড়া ভাষায় ফোনে বাবুকে সে শাসায় দুই বছর আগে। কারো অভিমান যে এতো গভীর হতে পারে আগে জানতে পারেনি সে। নিজেকে সে অভিযুক্ত করে ওরই একখানা দীর্ঘ ফেসবুক পোস্ট পড়ে দেয়া বাবুর ভালো কমেন্টটাও এতোদিন মনে রাখেনি বলে, বাবু যে নিজের গার্ল ফ্রেন্ডেই আগের চেয়ে বেশি নিবিষ্ট তা ভুলে যায় বলে। কিন্তু মনে পড়ে,

চিত্রাবলীতে রবীন্দ্রনাথের আঁকা নগ্ন পুরুষের একটি মাত্র ছবি পাওয়া যায়।

খোকনের এই কথায়, সেদিন লেকের পাড়ে, বাবু বসে থাকে কয়েক মুহূর্ত ধরে মেঘাচ্ছন্ন এবং নিরুত্তর।

*************************************************